২৯. জীবন-মৃত্যুর বিধান

প্রকৃতির অন্তর্গত সমুদয় বস্তু নিয়ম অনুযায়ী কর্ম করিয়া থাকে। কিছুই ইহার ব্যতিক্রম নয়।মন ও বহিঃপ্রকৃতির সমুদয় বস্তু নিয়ম দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।

আন্তর ও বহিঃপ্রকৃতি, মন ও জড়বস্তু, কাল ও দেশের মধ্যে অবস্থিত এবং কার্য-কারণ সম্বন্ধ দ্বারা বদ্ধ।

মনের মুক্তি ভ্রমমাত্র। যে মন নিয়ম দ্বারা বদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত, তাহার মুক্তি কিরূপে সম্ভব? কর্মবাদই কার্য-কারণবাদ।

আমাদিগকে মুক্ত হইতেই হইবে। আমরা মুক্তই আছি; আমরা যে মুক্ত—উহা জানিতে পারাই প্রকৃত কাজ। সর্বপ্রকার দাসত্ব ও সর্বপ্রকার বন্ধন পরিত্যাগ করিতে হইবে। আমাদিগকে যে কেবল সর্বপ্রকার পার্থিব বন্ধন এবং জগদন্তর্গত সর্বপ্রকার বস্তু ও ব্যক্তির প্রতি বন্ধন ত্যাগ করিতে হইবে—তাহা নয়, পরন্তু স্বর্গ ও সুখ সম্বন্ধে সর্বপ্রকার কল্পনা ত্যাগ করিতে হইবে।

বাসনার দ্বারা আমরা পৃথিবীতে বদ্ধ, আবার ঈশ্বর স্বর্গ দেবদূতের নিকটও বদ্ধ। ক্রীতদাস ক্রীতদাসই, মানব ঈশ্বর অথবা দেবদূত যাহারই ক্রীতদাস সে হউক না কেন। স্বর্গের কল্পনা পরিত্যাগ করিতে হইবে।

সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়া অনন্ত সুখময় জীবন যাপন করে—এই ধারণা বৃথা স্বপ্নমাত্র। ইহার বিন্দুমাত্র অর্থ বা যৌক্তিকতা নাই। যেখানে সুখ, সেখানে কোন না কোন সময় দুঃখ আসিবেই। যেখানে আনন্দ, সেখানে বেদনা নিশ্চিত। ইহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, যেভাবে হউক প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকিবেই।

স্বাধীনতার আদর্শই হইতেছে মোক্ষলাভের প্রকৃত আদর্শ। তাহা ইন্দ্রিয়ের সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব আনন্দ বা বেদনা, ভাল বা মন্দ যাবতীয় বিষয় হইতে মুক্তি।

ইহা হইতেও অধিক—আমাদিগকে মৃত্যুর কবল হইতেও মুক্তিলাভ করিতে হইবে; এবং মৃত্যু হইতে মুক্তিলাভ করিতে হইলে জীবন হইতেও মুক্ত হইতে হইবে। জীবন মৃত্যুরই ছায়া মাত্র। জীবন থাকিলেই মৃত্যু থাকিবে; সুতরাং মৃত্যুকে অতিক্রম করিতে হইলে জীবন হইতেও মুক্ত হও।

আমরা চিরকালই মুক্ত, কেবল আমাদিগকে উহা বিশ্বাস করিতে হইবে, যথেষ্ট বিশ্বাস থাকা চাই। তুমি অনন্ত মুক্ত আত্মা, চিরস্বাধীন—চিরধন্য। যথেষ্ট বিশ্বাস রাখ—মুহূর্ত মধ্যে তুমি মুক্ত হইয়া যাইবে।

দেশ কাল ও নিমিত্তের সমুদয় বস্তু বদ্ধ। আত্মা সর্বপ্রকার দেশ কাল ও নিমিত্তের বাহিরে। যাহা বদ্ধ, তাহাই প্রকৃতি—আত্মা নয়!

অতএব তোমার মুক্তি ঘোষণা কর, এবং তুমি প্রকৃত যাহা, তাহাই হও—সদামুক্ত, সদানন্দময়।

দেশ কাল ও নিমিত্তকেই আমরা মায়া বলিয়া থাকি।