৪৮. জগতে ভারতের দান

‘ব্রুকলিন ষ্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ন’, ২৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫

সোমবার রাত্রে ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের উদ্যোগে পায়ারপণ্ট এবং ক্লিণ্টন ষ্ট্রীটের সংযোগস্থলে লং আইল্যাণ্ড হিষ্টরিক্যাল সোসাইটি হলে হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ‘জগতে ভারতের দান’ বিষয়ে বক্তৃতা করেন। শ্রোতৃসংখ্যা বেশীই ছিল।

বক্তা তাঁহার স্বদেশের আশ্চর্য সৌন্দর্যের কথা বলেন—যে দেশ নীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের আদিম বিকাশ-ভূমি, যে-দেশের পুত্রদের চরিত্রবত্তা ও কন্যাদের ধর্মনিষ্ঠার কথা বহু বৈদেশিক পর্যটক কীর্তন করিয়া গিয়াছেন। অতঃপর বক্তা বিশ্বজগতে ভারত কি কি দিয়াছে, তাহা দ্রুতগতিতে বিস্তারিতভাবে প্রদর্শন করেন।

ধর্মের ক্ষেত্রে ভারতের দানপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, খ্রীষ্টধর্মের উপর ভারত প্রচুর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। যীশুখ্রীষ্টের উপদেশগুলির মূল উৎসের অনুসন্ধান করিলে দেখান যাইতে পারে, উহা বুদ্ধের বাণীর ভিতর রহিয়াছে।

ইওরোপীয় এবং আমেরিকান গবেষকদের গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বক্তা বুদ্ধ এবং খ্রীষ্টের মধ্যে বহু সাদৃশ্য প্রদর্শন করেন। যীশুর জন্ম, গৃহত্যাগান্তে নির্জন বাস, অন্তরঙ্গ শিষ্যসংখ্যা এবং তাঁহার নৈতিক শিক্ষা তাঁহার আবির্ভাবের বহু শত বৎসর পূর্বেকার বুদ্ধের জীবনের ঘটনার মতই। বক্তা জিজ্ঞাসা করেন, এই মিল কি শুধু একটি আকস্মিক ব্যাপার অথবা বুদ্ধের ধর্ম খ্রীষ্টধর্মের একটি পূর্বতন আভাস? মনে হয়, পাশ্চাত্যের অধিকাংশ মনীষী দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিতেই সন্তুষ্ট, কিন্তু এমনও কোন কোন পণ্ডিত আছেন, যাঁহারা নির্ভীকভাবে বলেন, খ্রীষ্টধর্ম সাক্ষাৎ বৌদ্ধধর্ম হইতে প্রসূত, যেমন খ্রীষ্টধর্মের প্রথম বিরুদ্ধবাদী শাখা মনিকাই-বাদকে (Monecian heresy) এখন সর্বসম্মতভাবে বৌদ্ধধর্মের একটি সম্প্রদায়ের শিক্ষা বলিয়া মনে করা হইয়া থাকে। কিন্তু খ্রীষ্টধর্ম যে বৌদ্ধধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত, এই বিষয়ে আরও অনেক প্রমাণ রহিয়াছে। ভারত-সম্রাট্‌ অশোকের সম্প্রতি আবিষ্কৃত শিলালিপিতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। অশোক খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর লোক। তিনি গ্রীক রাজাদের সহিত সন্ধিপত্র সম্পাদন করিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে যে-সব অঞ্চলে খ্রীষ্টধর্ম প্রসার লাভ করে, সম্রাট্‌ অশোকের প্রেরিত প্রচারকগণ সেই-সকল স্থানে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা বিস্তার করিয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায়, খ্রীষ্টধর্মে কি করিয়া ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদ, অবতারবাদ এবং ভারতের নীতিতত্ত্ব আসিল এবং কেনই বা আমাদের দেশের মন্দিরের পূজার্চনার সহিত তোমাদের ক্যাথলিক গীর্জার ‘মাস্‌’১২ আবৃত্তি এবং ‘আশীর্বাদ’১৩ প্রভৃতি ধর্মকৃত্যের এত সাদৃশ্য। খ্রীষ্টধর্মের বহু আগে বৌদ্ধধর্মে এই-সকল জিনিষ প্রচলিত ছিল। এখন এই তথ্যগুলির উপর নিজেদের বিচার-বিবেচনা তোমরা প্রয়োগ করিয়া দেখ। আমরা হিন্দুরা তোমাদের ধর্ম প্রাচীনতর, ইহা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত আছি, যদি যথেষ্ট প্রমাণ তোমরা উপস্থিত করিতে পার। আমরা তো জানি যে, তোমাদের ধর্ম যখন কল্পনাতেও উদ্ভূত হয় নাই, তাহার অন্ততঃ তিনশত বৎসর আগে আমাদের ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিজ্ঞান সম্বন্ধেও ইহা প্রযোজ্য। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের আর একটি দান বৈজ্ঞানিক- দৃষ্টিসম্পন্ন চিকিৎসকগণ। সার উইলিয়ম হাণ্টারের মতে বিবিধ রাসায়নিক পদার্থের আবিষ্কার এবং বিকল কর্ণ ও নাসিকার পুনর্গঠনের উপায় নির্ণয়ের দ্বারা ভারতবর্ষ আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করিয়াছে। অঙ্কশাস্ত্রে ভারতের কৃতিত্ব আরও বেশী। বীজগণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ও বর্তমান বিজ্ঞানের বিজয়গৌরবস্বরূপ মিশ্রগণিত—ইহাদের সবগুলিই ভারতবর্ষে উদ্ভাবিত হয়; বর্তমান সভ্যতার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ সংখ্যাদশকও ভারতমনীষার সৃষ্টি। দশটি সংখ্যাবাচক দশমিক (decimal) শব্দ বাস্তবিক সংস্কৃত ভাষার শব্দ।

দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা এখনও পর্যন্ত অপর যে কোন জাতি অপেক্ষা অনেক উপরে রহিয়াছি। প্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। সঙ্গীতে ভারত জগৎকে দিয়াছে প্রধান সাতটি স্বর এবং সুরের তিনটি গ্রাম সহ স্বরলিপি-প্রণালী। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দেও আমরা এইরূপ প্রণালীবদ্ধ সঙ্গীত উপভোগ করিয়াছি। ইওরোপে উহা প্রথম আসে মাত্র একাদশ শতাব্দীতে। ভাষা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহা এখন সর্ববাদিসম্মত যে, আমাদের সংস্কৃত ভাষা যাবতীয় ইওরোপীয় ভাষার ভিত্তি। এই ভাষাগুলি বিকৃত উচ্চারণ-বিশিষ্ট সংস্কৃত ছাড়া আর কিছু নয়।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের মহাকাব্য, কাব্য ও নাটক অপর যে-কোন ভাষার শ্রেষ্ঠ রচনার সমতুল্য। জার্মানীর শ্রেষ্ঠ কবি আমাদের শকুন্তলা-নাটক সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে বলিয়াছেন, উহাতে ‘স্বর্গ ও পৃথিবী সম্মিলিত।’ ‘ঈসপ‍্‍স্ ফেব‍্‍ল‍্‍স্’ নামক প্রসিদ্ধ গল্পমালা ভারতেরই দান, কেননা ঈসপ্‌ একটি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে তাঁহার বই-এর উপাদান লইয়াছিলেন। ‘এরেবিয়ান নাইটস্’ নামক বিখ্যাত কথাসাহিত্য এমন কি ‘সিণ্ডারেলা’ ও ‘বরবটির ডাঁটা’ গল্পেরও উৎপত্তি ভারতেই। শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারতই প্রথম তুলা ও লাল রঙ উৎপাদন করে এবং সর্বপ্রকার অলঙ্কার-নির্মাণেও প্রভূত দক্ষতা দেখায়। চিনি ভারতে প্রথম প্রস্তুত হইয়াছিল। ইংরেজী ‘সুগার’ কথাটি সংস্কৃত শর্করা হইতে উৎপন্ন। সর্বশেষে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, দাবা তাস ও পাশা খেলা ভারতেই আবিষ্কৃত হয়। বস্তুতঃ সব দিক্ দিয়া ভারতবর্ষের উৎকর্ষ এত বিরাট ছিল যে, দলে দলে বুভুক্ষু ইওরোপীয় ভাগ্যান্বেষীরা ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হইতে থাকে এবং পরোক্ষভাবে এই ঘটনাই পরে আমেরিকা-আবিষ্কারের হেতু হয়।

এখন দেখা যাক—এই-সকলের পরিবর্তে জগৎ ভারতকে কি দিয়াছে। নিন্দা, অভিশাপ ও ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত-সন্তানদের রুধির-স্রোতের মধ্য দিয়া অপরে তাহার সমৃদ্ধির পথ করিয়া লইয়াছে ভারতকে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত করিয়া এবং ভারতের পুত্রকন্যাগণকে দাসত্বে ঠেলিয়া দিয়া। আর এখন আঘাতের উপর অপমান হানা হইতেছে ভারতে এমন একটি ধর্ম প্রচার করিয়া, যাহা পুষ্ট হইতে পারে শুধু অপর সমস্ত ধর্মের ধ্বংসের উপর। কিন্তু ভারত ভীত নয়। সে কোন জাতির কৃপাভিখারী নয়। আমাদের একমাত্র দোষ এই যে, আমরা অপরকে পদদলিত করিবার জন্য যুদ্ধ করিতে পারি না, আমরা বিশ্বাস করি—সত্যের অনন্ত মহিমায়। বিশ্বের নিকট ভারতের বাণী হইল—প্রথমতঃ তাহার মঙ্গলেচ্ছা। অহিতের প্রতিদানে ভারত দিয়া চলে হিত। এই মহৎ আদর্শের উৎপত্তি ভারতেই। ভারত উহা কার্যে পরিণত করিতে জানে। পরিশেষে ভারতের বাণী হইলঃ প্রশান্তি সাধুতা ধৈর্য ও মৃদুতা আখেরে জয়ী হইবেই। এক সময়ে যাহাদের পৃথিবীতে ছিল বিপুল অধিকার, সেই পরাক্রান্ত গ্রীক জাতি আজ কোথায়? তাহারা বিলুপ্ত। একদা যাহাদের বিজয়ী সৈন্যদলের পদভরে মেদিনী কম্পিত হইত, সেই রোমান জাতিই বা কোথায়? অতীতের গর্ভে। পঞ্চাশ বৎসরে যাহারা এক সময়ে অতলান্তিক মহাসাগর হইতে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিজয়-পতাকা উড্ডীন করিয়াছিল, সেই আরবরাই বা আজ কোথায়? কোথায় সেই লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষের নিষ্ঠুর হত্যাকারী স্প্যানিয়ার্ডগণ? উভয় জাতিই আজ প্রায় বিলুপ্ত, তবে তাহাদের পরবর্তী বংশধরগণের ন্যায়পরতা ও দয়াধর্মের গুণে তাহারা সামূহিক বিনাশ হইতে রক্ষা পাইবে, পুনরায় তাহাদের অভ্যুদয়ের ক্ষণ আসিবে। বক্তৃতার শেষে স্বামী বিবেকানন্দকে করতালি দ্বারা সাদরে অভিনন্দিত করা হয়। ভারতের রীতি-নীতি সম্বন্ধে তিনি অনেকগুলি প্রশ্নেরও উত্তর দেন। গতকল্যকার (২৫ ফেব্রুআরী) ‘স্ট্যাণ্ডার্ড ইউনিয়ান’ পত্রিকায় ভারতবর্ষে বিধবাদের নির্যাতিত হওয়া লইয়া যে উক্তিটি প্রকাশিত হইয়াছে, উহার তিনি স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করেন।

বিবাহের পূর্বে নারীর নিজস্ব সম্পত্তি যদি কিছু থাকে, ভারতীয় আইন অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর তাহাতে তাঁহার অধিকার তো বজায় থাকিবেই, তা ছাড়া স্বামীর নিকট হইতে তিনি যাহা কিছু পাইয়াছিলেন এবং মৃত স্বামীর সাক্ষাৎ অপর কোন উত্তরাধিকারী না থাকিলে তাঁহার সম্পত্তিও বিধবার দখলে আসিবে। পুরুষের সংখ্যা-ন্যূনতার জন্য ভারতে বিধবারা ক্বচিৎ পুনরায় বিবাহ করেন।

বক্তা আরও উল্লেখ করেন যে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীলোকের সহমরণ-প্রথা এবং জগন্নাথের রথচক্রে আত্মবলিদান সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ইহার প্রমাণের জন্য তিনি শ্রোতৃবৃন্দকে সার উইলিয়াম হাণ্টার প্রণীত ‘ভারত সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ নামক পুস্তিকাটি দেখিতে বলেন।