৩৮. ভারতের ধর্মসমূহ

‘বষ্টন হেরাল্ড’, ১৭ মে, ১৮৯৪

ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ গতকল্য বিকালে এসোসিয়েশন হল-এ ১৬নং ওয়ার্ড ডে নার্সারী বিদ্যালয়ের সাহায্যার্থে ‘ভারতের ধর্মসমূহ’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। প্রচুর শ্রোতৃসমাগম হইয়াছিল।

বক্তা প্রথমে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে বলেন। ভারতের জনসংখ্যার এক পঞ্চামাংশ হইল মুসলমান। ইঁহারা বাইবেলের পুরাতন এবং নূতন দুই টেষ্টামেণ্টেই বিশ্বাস করেন, কিন্তু যীশুখ্রীষ্টকে শুধু ভগবদাদিষ্ট মহাপুরুষ মাত্র বলেন। খ্রীষ্টানদের ন্যায় ইঁহাদের উপাসনাসমূহের কোন সংস্থা নাই, তবে সম্মিলিত কোরানপাঠ প্রচলিত।

ভারতবর্ষের আর একটি ধর্মসম্প্রদায় পার্শী জাতি। ইঁহাদের ধর্মগ্রন্থের নাম জেন্দ্-আবেস্তা। ইঁহারা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতায় বিশ্বাসী—কল্যাণের অধিষ্ঠাতা আরমুজ্‌দ্‌ এবং অশুভের জনক আহ্রিমান। পার্শীদের নৈতিক-বিধানের সারমর্ম হইলঃ সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য এবং সৎ কর্ম।

হিন্দুগণ বেদকে তাঁহাদের ধর্মগ্রন্থ বলিয়া মনে করেন। প্রত্যেক ব্যক্তি স্বকীয় জাতির রীতিনীতি মানিতে বাধ্য, তবে ধর্মের ব্যাপারে নিজের খুশীমত চিন্তা করিয়া দেখিবার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রত্যেককে দেওয়া হয়। ধর্মসাধনার একটি অংশ হইল কোন সাধুপুরুষ বা ধর্মাচার্যকে খুঁজিয়া বাহির করা এবং তাঁহার মধ্যে যে আধ্যাত্মিক শক্তিপ্রবাহ ক্রিয়া করিতেছে, উহার সুযোগ লওয়া।

হিন্দুদের তিনটি বিভিন্ন সম্প্রদায় রহিয়াছে—দ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী এবং অদ্বৈতবাদী। এগুলিকে কোন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশের পথে স্বভাবিকভাবে উপস্থিত তিনটি ধাপ বলিয়া মনে করা হয়।

তিন সম্প্রদায়ই ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তবে দ্বৈতবাদীদের মতে ঈশ্বর এবং মানুষ পরস্পর ভিন্ন। পক্ষান্তরে অদ্বৈতবাদীরা বলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি মাত্র সত্তা আছে—ইহা ঈশ্বর ও জীব দুয়েরই অতীত।

বক্তা বেদ হইতে উদ্ধৃত করিয়া হিন্দুধর্মের প্রকৃতি কি, তাহা দেখান এবং বলেন, ভগবানকে পাইতে হইলে আমাদিকে নিজেদের হৃদয় অন্বেষণ করিতে হইবে। পুঁথিপত্রের মধ্যে ধর্ম নাই। ধর্ম হইল অন্তরের অন্তরে তাকাইয়া ঈশ্বর ও অমৃতত্বের সত্যকে উপলব্ধি করা। বেদের একটি উক্তিঃ ‘যাহাকে আমি পছন্দ করি, তাহাকে সত্যদ্রষ্টারূপে গড়িয়া তুলি।’ সত্যদ্রষ্টৃত্ব লাভ করাই ধর্মের মূল লক্ষ্য।

জৈনধর্ম সম্বন্ধে কিছু বলিয়া বক্তা তাঁহার আলোচনার উপসংহার করেন। এই ধর্মাবলম্বীরা মূক প্রাণীদের প্রতি বিশেষ দয়া প্রদর্শন করে। তাঁহাদের নৈতিক অনুশাসন হইল সংক্ষেপেঃ কোন প্রাণীর অনিষ্ট না করাই মহত্তম কল্যাণ।