৩৭. ভারতীয় আচার-ব্যবহার

‘বষ্টন হেরাল্ড’, ১৫ মে, ১৮৯৪

গতকল্য ব্রাহ্মণ-সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ‘ভারতীয় ধর্ম’ (বস্তুতঃ—ভারতীয় আচার-ব্যবহার) সম্বন্ধে বক্তৃতা শুনিবার জন্য এসোসিয়েশন হল-এ মহিলাদের খুব ভিড় হয়। ১৬নং ওয়ার্ডের ডে নার্সারী বিদ্যালয়ের সাহায্যার্থে এই বক্তৃতার আয়োজন হইয়াছিল। (বস্তুতঃ টাইলার ষ্ট্রীট ডে নার্সারী বিদ্যালয়।) এই ব্রাহ্মণ-সন্ন্যাসী গত বৎসর চিকাগোতে যেমন সকলের মনোযোগ ও উৎসাহ আকর্ষণ করিয়াছিলেন, এবার বষ্টনে অনুরূপ ঘটিয়াছে। তাঁহার আন্তরিক সাধু মার্জিত চালচলন দ্বারা তিনি বহু অনুরাগী বন্ধু লাভ করিয়াছেন।

বক্তা বলেনঃ হিন্দুজাতির ভিতরে বিবাহকে খুব বড় করিয়া দেখা হয় না। কারণ ইহা নয় যে, আমরা স্ত্রীজাতিকে ঘৃণা করি। আমাদের ধর্ম নারীকে মাতৃবুদ্ধিতে পূজা করিবার উপদেশ দেয় বলিয়াই এইরূপ ঘটিয়াছে। প্রত্যেক নারী হইলেন নিজের মায়ের মত—এই শিক্ষা হিন্দুরা বাল্যকাল হইতে পায়। কেহ তো আর জননীকে বিবাহ করিতে চায় না। আমরা ঈশ্বরকে মা বলিয়া ভাবি। স্বর্গবাসী ঈশ্বরের আমরা আদৌ পরোয়া করি না। বিবাহকে আমরা একটি নিম্নতর অবস্থা বলিয়া মনে করি। যদি কেহ বিবাহ করে, তবে ধর্মপথে তাহার একজন সহায়ক সঙ্গীর প্রয়োজন বলিয়াই করে।

তোমরা বলিয়া থাক যে, আমরা হিন্দুরা আমাদের নারীদের প্রতি মন্দ ব্যবহার করি। পৃথিবীর কোন্ জাতি স্ত্রীজাতিকে পীড়া দেয় নাই? ইওরোপ বা আমেরিকায় কোন ব্যক্তি অর্থের লোভে কোন মহিলার পাণিগ্রহণ করিতে পারে এবং বিবাহের পর তাঁহার অর্থ আত্মসাৎ করিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে পারে। পক্ষান্তরে ভারতে কোন স্ত্রীলোক যদি ধনলোভে বিবাহ করেন, তাহা হইলে তাঁহার সন্তানদের ক্রীতদাস বলিয়া মনে করা হয়। বিত্তবান্ পুরুষ বিবাহ করিলে তাঁহার অর্থ তাঁহার পত্নীর হাতেই যায় এবং সেইজন্য টাকাকড়ির ভার যিনি লইয়াছেন, সেই পত্নীকে পরিত্যাগ করিবার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।

তোমরা আমাদিগকে পৌত্তলিক, অশিক্ষিত, অসভ্য প্রভৃতি বলিয়া থাক, আমরা শুনিয়া এইরূপ কটুভাষী তোমাদের ভদ্রতার অভাব দেখিয়া মনে মনে হাসি। আমাদের দৃষ্টিতে সদ্‌গুণ এবং সৎকুলে জন্মই জাতি নির্ধারণ করে, টাকা নয়। ভারতে টাকা দিয়া সম্মান কেনা যায় না। জাতিপ্রথায় উচ্চতা অর্থ দ্বারা নিরূপিত হয় না। জাতির দিক্ দিয়া অতি দরিদ্র এবং অত্যন্ত ধনীর একই মর্যাদা। জাতিপ্রথার ইহা একটি চমৎকার দিক্।

বিত্তের জন্য পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটিয়াছে, খ্রীষ্টানরা পরস্পর পরস্পরকে মাটিতে ফেলিয়া পদদলিত করিয়াছে। ধনলিপ্সা হইতেই জন্মায় হিংসা, ঘৃণা, লোভ এবং চলে প্রচণ্ড কর্মোন্মত্ততা, ছুটাছুটি, কলরব। জাতিপ্রথা মানুষকে এই-সকল হইতে নিষ্কৃতি দেয়। উহা তাহাকে অল্প টাকায় জীবনযাপন করিতে সক্ষম করে এবং সকলকেই কাজ দেয়। জাতিপ্রথায় মানুষ আত্মার চিন্তা করিবার অবসর পায়, আর ভারতীয় সমাজে ইহাই তো আমরা চাই।

ব্রাহ্মণের জন্ম দেবার্চনার জন্য। জাতি যত উচ্চ, সামাজিক বিধি-নিষেধও তত বেশী। জাতিপ্রথা আমাদিগকে হিন্দুজাতিরূপে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। এই প্রথার অনেক ত্রুটি থাকিলেও বহু সুবিধা আছে।

মিঃ বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের প্রাচীন ও আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের বর্ণনা করেন। তিনি বিশেষ করিয়া বারাণসীর (?) প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির উল্লেখ করেন। উহার ছাত্র ও অধ্যাপকদের মোট সংখ্যা ছিল ২০,০০০।

বক্তা আরও বলেন, ‘তোমরা যখন আমার ধর্ম সম্বন্ধে বিচার করিতে বস, তখন ধরিয়া লও যে, তোমাদের ধর্মটি হইল নিখুঁত আর আমারটি ভুল। ভারতের সমাজের সমালোচনা করিবার সময়েও তোমরা মনে কর, যে পরিমাণে উহা তোমাদের আদর্শের সঙ্গে মিলে না, সেই পরিমাণে উহা অমার্জিত। এই দৃষ্টিভঙ্গী অর্থহীন।’

শিক্ষা সম্পর্কে বক্তা বলেন, ভারতে যাহারা অধিক শিক্ষিত, তাহারা অধ্যাপনার কাজ করে। অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতেরা পুরোহিত হয়।