৩৪. সুদূর ভারতবর্ষ হইতে

‘স্যাগিন কুরিআর হেরাল্ড’, ২২ মার্চ, ১৮৯৪

হিন্দু প্রচারক কানন্দের স্যাগিনে আগমন ও একাডেমীতে মনোজ্ঞ বাক্যালাপ।

গত সন্ধ্যায় হোটেল ভিন্‌‍সেণ্ট-এর লবিতে জনৈক বলিষ্ঠ সুঠাম ভদ্রলোক বসিয়াছিলেন। গায়ের শ্যামবর্ণের সহিত তাঁহার মুক্তা-ধবল দাঁত খুব উজ্জ্বল দেখাইতেছিল। চওড়া এবং উঁচু কপালের নীচে তাঁহার চোখ দুটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিতেছিল। এই ভদ্রলোকই হইলেন হিন্দুধর্মের প্রচারক স্বামী বিবে কানন্দ। মিঃ কানন্দ শুদ্ধ এবং ব্যাকরণ-সম্মত ইংরেজীতে কথাবার্তা বলিতেছিলেন। তাঁহার উচ্চারণে ঈষৎ বিদেশী ঢঙটি বেশ চিত্তরঞ্জক। ডেট্রয়েটের সংবাদপত্রসমূহ যাঁহারা পড়েন, তাঁহারা অবগত আছেন যে,মিঃ কানন্দ ঐ শহরে অনেকগুলি বক্তৃতা দিয়াছিলেন এবং কেহ কেহ খ্রীষ্টানদের প্রতি তাঁহার কটাক্ষের জন্য তাঁহার উপর রুষ্ট হইয়াছিলেন। মিঃ কানন্দের কাল একাডেমীতে বক্তৃতা দিতে যাইবার পূর্বে ‘কুরিআর হেরাল্ড’-এর প্রতিনিধি তাঁহার সহিত কয়েক মিনিট কথোপকথনের সুযোগ পান। মিঃ কানন্দ বলেন, আজকাল খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সত্য ও ন্যায়ের পথ হইতে কিরূপ বিচ্যুতি ঘটিতেছে, তাহা দেখিয়া তিনি অবাক হইয়াছেন; তবে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের ভিতরই ভালমন্দ দুই-ই আছে। মিঃ কানন্দের একটি উক্তি নিশ্চয়ই আমেরিকান আদর্শের বিরোধী। তিনি আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ পর্যবেক্ষণ করিতেছেন কিনা, জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন, ‘না, আমি একজন প্রচারক মাত্র।’ ইহা কৌতূহলের অভাব ও সঙ্কীর্ণতার পরিচায়ক এবং ধর্মতত্ত্বাভিজ্ঞ এই বৌদ্ধ প্রচারকের সহিত যেন খাপ খায় না।

হোটেল হইতে একাডেমী খুব কাছেই। ৮টার সময় রোল্যাণ্ড কোনর তাঁহাকে নাতিবৃহৎ শ্রোতৃমণ্ডলীর সহিত পরিচিত করিয়া দেন। বক্তা একটি লম্বা আলখাল্লা পরিয়া গিয়াছিলেন উহার কটিবন্ধটি লাল রঙের। তাঁহার মাথায় পাগড়ি ছিল, একটি অপ্রশস্ত শাল জড়াইয়া বোধ করি উহা গঠিত।

ভাষণের প্রারম্ভেই বক্তা বলিয়া লইলেন যে, তিনি মিশনরীরূপে এখানে আসেন নাই, বৌদ্ধরা (হিন্দুরা) অপর ধর্ম-বিশ্বাসের লোককে স্বমতে আনিবার চেষ্টা করেন না। তাঁহার বক্তৃতার বিষয় হইল—‘ধর্মসমূহের সমন্বয়’। মিঃ কানন্দ বলেন, প্রাচীনকালে এমন বহু ধর্ম ছিল—যাহাদের আজ আর কোন অস্তিত্ব নাই, ভারতবাসীর দুই-তৃতীয়াংশ হইল বৌদ্ধ (হিন্দু), অবশিষ্ট তৃতীয়াংশ অন্যান্য নানা ধর্মের অনুগামী। বৌদ্ধমতে মৃত্যুর পর মানুষের নরকে শাস্তিভোগের কোন স্থান নাই। এখানে খ্রীষ্টানদের মত হইতে উহার পার্থক্য। খ্রীষ্টানরা ইহলোকে মানুষকে পাঁচ মিনিটের জন্য ক্ষমা করিতে পারে, কিন্তু পরলোকে তাহার জন্য অনন্ত নরকের ব্যবস্থা করে। মানুষের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা বুদ্ধই প্রথম দেন। বর্তমানকালে বৌদ্ধধর্মের ইহা একটি প্রধান নীতি। খ্রীষ্টানরা ইহা প্রচার করেন বটে, কিন্তু কার্যতঃ অভ্যাস করেন না।

উদাহরণস্বরূপ তিনি এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিগ্রোগণের অবস্থার বিষয় উল্লেখ করেন। তাহাদিগকে শ্বেতকায়গণের সহিত এক হোটেলে থাকিতে বা এক যানে চড়িতে দেওয়া হয় না। কোন ভদ্রলোক তাহাদিগের সহিত কথা বলে না। বক্তা বলেন, তিনি দক্ষিণে গিয়াছেন এবং নিজের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ হইতে ইহা বলিতেছেন।