২৮. ‘এশিয়ার আলোক’—বুদ্ধদেবের ধর্ম

[ডেট্রয়েট শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৯ মার্চ প্রদত্ত; ‘ডেট্রয়েট ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]

গতরাত্রে অডিটোরিয়ামে বিবে কানন্দ ১৫০ জন শ্রোতার নিকট ‘এশিয়ার আলোক’—বুদ্ধদেবের ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেন। মাননীয় ডন এম. ডিকিনসন সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট বক্তার পরিচয়-প্রসঙ্গে বলেন—কে বলিতে পারে যে, এই ধর্মমতটি ঈশ্বরাদিষ্ট, আর অন্যটি নিকৃষ্ট? অতীন্দ্রিয়তার বিভাগ-রেখা কে টানিতে পারে?

বিবে কানন্দ ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মগুলির বিশদ পর্যালোচনা করেন। তিনি যজ্ঞ- বেদীতে বহুল প্রাণিবধের কথা বলিয়া বুদ্ধের জন্ম এবং জীবন-কাহিনী বর্ণনা করেন। সৃষ্টির কারণ এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বুদ্ধের মনে যে দুরূহ সমস্যাগুলি উঠিয়াছিল, ঐগুলির সমাধানের জন্য তিনি যে তীব্র সাধনা করিয়াছিলেন এবং পরিশেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন, এ-সকল বিষয় বক্তা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন যে, বুদ্ধ অপর সকল মানুষের উপরে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যাঁহার সম্বন্ধে কি মিত্র, কি শত্রু—কেহ কখনও বলিতে পারে না যে, তিনি সকলের হিতের জন্য ছাড়া একটিও নিঃশ্বাস লইয়াছেন বা এক টুকরা রুটি খাইয়াছেন।

কানন্দ বলেন, আত্মার জন্মান্তরগ্রহণ বুদ্ধ কখনও প্রচার করেন নাই। তবে তিনি বিশ্বাস করিতেন যে, সমুদ্রে যেমন একটি ঢেউ উঠিয়া মিলাইয়া যাইবার সময় পরবর্তী ঢেউটিতে তাহার শক্তি সংক্রামিত করিয়া যায়, সেইরূপ একটি জীব তাহার উত্তরকালীনে নিজের শক্তি রাখিয়া যায়। বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্ব কখনও প্রচার করেন নাই; আবার ঈশ্বর যে নাই, তাহাও বলেন নাই।

তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘আমরা সৎ হইব কেন?’ বুদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘কারণ তোমরা উত্তরাধিকারসূত্রে সদ‍্‍ভাব পাইয়াছ। তোমাদেরও উচিত পরবর্তীদের জন্য কিছু সদ‍্‍ভাব রাখিয়া যাওয়া।’ সংসার সমষ্টিকৃত সাধুতার সম্প্রসারের জন্যই আমাদের প্রত্যেকের সাধু আচরণ বিধেয়।

বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অবতার। তিনি কাহারও নিন্দা করেন নাই, নিজের জন্য কিছু দাবী করেন নাই। নিজেদের চেষ্টাতেই আমাদিগকে মুক্তিলাভ করিতে হইবে, ইহাই ছিল তাঁহার বিশ্বাস। মৃত্যুশয্যায় তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি বা অপর কেহই তোমাদিগকে সাহায্য করিতে পারে না। কাহারও উপর নির্ভর করিও না। নিজের মুক্তি নিজেই সম্পাদন কর।’

মানুষে মানুষে এবং মানুষে ও ইতরপ্রাণীতে অসাম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধ প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, সকল প্রাণীই সমান। তিনিই প্রথম মদ্যপান বন্ধ করার নীতি উপস্থাপিত করেন। তাঁহার শিক্ষাঃ সৎ হও, সৎ কাজ কর। যদি ঈশ্বর থাকেন, সাধুতার দ্বারা তাঁহাকে লাভ কর। যদি ঈশ্বর নাও থাকেন, তবুও সাধুতাই শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য। মানুষের যাবতীয় দুঃখের জন্য সে নিজেই দায়ী। তাহার সমুদয় সদাচরণের জন্য প্রশংসাও তাহারই প্রাপ্য।

বুদ্ধই প্রথম ধর্মপ্রচারক দলের উদ্ভাবক। ভারতের লক্ষ লক্ষ পদদলিতদিগের পরিত্রাতারূপে তাঁহার আবির্ভাব। উহারা তাঁহার দার্শনিক মত বুঝিতে পারিত না, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া এবং তাঁহার উপদেশ শুনিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিত।

উপসংহারে কানন্দ বলেন যে, বৌদ্ধধর্ম খ্রীষ্টধর্মের ভিত্তি। ক্যাথলিক সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্ম হইতেই উদ্ভূত।