২৬. পুনর্জন্ম

[মেমফিস্‌ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৯ জানুআরী প্রদত্ত; ২০ জানুআরীর ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]

পীত-আলখল্লা ও পাগড়ি-পরিহিত সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দ পুনরায় গতরাত্রে ‘লা স্যালেট একাডেমী’তে বেশ বড় এবং সমঝদার একটি সভায় বক্তৃতা দিয়াছেন। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘আত্মার জন্মান্তরগ্রহণ’। বলিতে গেলে এই বিষয়টির আলোচনায় কানন্দের বোধ করি স্বপক্ষসর্মথনে যত সুবিধা হইয়াছিল, এমন আর অন্য কোন ক্ষেত্রে হয় নাই। প্রাচ্য জাতি- সমূহের ব্যাপকভাবে স্বীকৃত বিশ্বাসগুলির মধ্যে পুনর্জন্মবাদ অন্যতম। স্বদেশে কিম্বা বিদেশে এই বিশ্বাসের পক্ষ-সমর্থন করিতে তাহারা সর্বদাই প্রস্তুত, কানন্দ যেমন তাঁহার বক্তৃতায় বলিলেনঃ

আপনারা অনেকেই জানেন না যে, পুনর্জন্মবাদ প্রাচীন ধর্মসমূহের একটি অতি পুরাতন বিশ্বাস। য়াহুদীজাতির অন্তর্গত ফ্যারিসীদের মধ্যে এবং খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের প্রথম প্রবর্তকগণের মধ্যে ইহা সুপরিচিত ছিল। আরবদিগের ইহা একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল। হিন্দু এবং বৌদ্ধদের মধ্যে ইহা এখনও টিকিয়া আছে। বিজ্ঞানের অভ্যুদয়কাল পর্যন্ত এই ধারা চলিয়া আসিয়াছিল। বিজ্ঞান তো বিভিন্ন জড়শক্তিকে বুঝিবার প্রয়াস মাত্র। পাশ্চাত্য দেশের আপনারা মনে করেন, পুনর্জন্মবাদ নৈতিক আদর্শকে ব্যাহত করে। পুনর্জন্মবাদের বিচার-ধারা এবং যৌক্তিক ও তাত্ত্বিক দিকগুলির পুরাপুরি আলোচনার জন্য আমদিগকে গোড়া হইতে সবটা বিষয় পরীক্ষা করিতে হইবে। আমরা এই বিশ্বজগতের একজন ন্যায়বান্ ঈশ্বরে বিশ্বাসী, কিন্তু সংসারের দিকে তাকাইয়া দেখিলে ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায়ই বেশী দেখিতে পাওয়া যায়। একজন মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট পারিপার্শ্বিকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিল। তাহার সারা জীবনে অনুকূল অবস্থাগুলি যেন প্রস্তুত হইয়া তাহার হাতের মধ্যে আসিয়া পড়ে, সব কিছুই তাহার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং উন্নতির সহায়ক হয়। পক্ষান্তরে আর একজন হয়তো এমন পরিবেষ্টনীতে পৃথিবীতে আসে যে, জীবনের প্রতি ধাপে তাহাকে অপর সকলের প্রতিপক্ষতা করিতে হয়। নৈতিক অধঃপাতে গিয়া, সমাজচ্যুত হইয়া সে পৃথিবী হইতে বিদায় লয়। মানুষের ভিতর সুখ-শান্তির বিধানে এত তারতম্য কেন?

জন্মান্তরবাদ আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসসমূহের এই গরমিলগুলির সামঞ্জস্য সাধন করিতে পারে। এই মতবাদ আমাদিগকে দুর্নীতিপরায়ণ না করিয়া ন্যায়ের ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে। পূর্বোক্ত প্রশ্নের উত্তরে তোমরা হয়তো বলিবে, উহা ভগবানের ইচ্ছা। কিন্তু ইহা আদৌ সদুত্তর নয়। ইহা অবৈজ্ঞানিক। প্রত্যেক ঘটনারই একটা কারণ থাকে। একমাত্র ঈশ্বরকেই সকল কার্য কারণের বিধাতা বলিলে তিনি এক ভীষণ দুর্নীতিশীল ব্যক্তি হইয়া দাঁড়ান। কিন্তু জড়বাদও পূর্বোক্ত মতবাদেরই মত অযৌক্তিক। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার এলাকার সর্বত্রই কার্য-কারণ-ভাব ওতপ্রোত। অতএব এই দিক্‌ দিয়া আত্মার জন্মান্তরবাদ প্রয়োজনীয়। আমরা এই পৃথিবীতে আসিয়াছি। ইহা কি আমাদের প্রথম জন্ম? সৃষ্টি মানে কি শূন্য হইতে কোন কিছুর উৎপত্তি? ভাল করিয়া বিশ্লেষণ করিলে ইহা অসম্ভব মনে হয়। অতএব বলা উচিত, সৃষ্টি নয়—অভিব্যক্তি।

অবিদ্যমান কারণ হইতে কোন কার্যের উৎপত্তি হইতে পারে না। আমি যদি আগুনে আঙুল দিই, সঙ্গে সঙ্গে উহার ফল ফলিবে—আঙুল পুড়াইয়া যাইবে। আমি জানি আগুনের সহিত আঙুলের সংস্পর্শ-ক্রিয়াই হইল দাহের কারণ। এইরূপে বিশ্বপ্রকৃতি ছিল না—এমন কোন সময় থাকা অসম্ভব, কেননা প্রকৃতির কারণ সর্বদাই বর্তমান। তর্কের খাতিরে যদি স্বীকার কর যে, এমন এক সময় ছিল, কোন প্রকার অস্তিত্ব ছিল না, তাহা হইলে প্রশ্ন ওঠে—এই-সব বিপুল জড়-সমষ্টি কোথায় ছিল? সম্পূর্ণ নূতন কিছু সৃষ্টি করিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রচণ্ড অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হইবে। হইা অসম্ভব। পুরাতন বস্তু নূতন করিয়া গড়া চলে, কি

ন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নূতন কিছু আমদানী করা চলে না।ইহা ঠিক যে, পুনর্জন্মবাদ গণিত দিয়া প্রমাণ করা চলে না। ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে অনুমান ও মতবাদের বলবত্তা প্রত্যক্ষের মত নাই সত্য, তবে আমার বক্তব্য এই যে, জীবনের ঘটনাসমূহকে ব্যাখ্যা করিবার জন্য মানুষের বুদ্ধি ইহা অপেক্ষা প্রশস্ততর অন্য কোন মতবাদ আর উপস্থাপিত করিতে পারে নাই।

মিনিয়াপলিস্‌ শহর হইতে ট্রেনে আসিবার সময় আমার একটি বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়িতেছে। গাড়ীতে জনৈক গো-পালক ছিল। লোকটি একটু রুক্ষপ্রকৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসে গোঁড়া প্রেসবিটেরিয়ান। সে আমার কাছে আগাইয়া আসিয়া জানিতে চাহিল, আমি কোথাকার লোক। আমি বলিলাম, ভারতবর্ষের। তখন সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার ধর্ম কি?’ আমি বলিলাম, হিন্দু। সে বলিল, ‘তাহা হইলে তুমি নিশ্চয়ই নরকে যাইবে।’ আমি তাহাকে পুনর্জন্মবাদের কথা বলিলাম। শুনিয়া সে বলিলঃ সে বরাবরই এই মতবাদে বিশ্বাসী, কেননা একদিন সে যখন কাঠ কাটিতেছিল, তখন তাহার ছোট বোনটি তাহার (গো-পালকের) পোষাক পরিয়া তাহাকে বলে যে, সে আগে পুরুষমানুষ ছিল। এই জন্যই সে আত্মার শরীরান্তর-প্রাপ্তিতে বিশ্বাস করে। এই মতবাদের মূল সূত্রটি এইঃ মানুষ যদি ভাল কাজ করে, তাহা হইলে তাহার উচ্চতর ঘরে জন্ম হইবে, আর মন্দ কাজ করিলে নিকৃষ্ট গতি।

এই মতবাদের আর একটি চমৎকার দিক্‌ আছে—ইহা শুভ প্রবৃত্তির প্ররোচক। একটি কাজ যখন করা হইয়া যায়, তখন তো আর উহাকে ফিরান যায় না। এই মত বলে, আহা যদি ঐ কাজটি আরও ভাল করিয়া করিতে পারিতে! যাহা হউক, আগুনে আর হাত দিও না। প্রত্যেক মুহূর্তে নূতন সুযোগ আসিতেছে। উহাকে কাজে লাগাও।

বিবে কানন্দ এইভাবে কিছুকাল বলিয়া চলেন। শ্রোতারা ঘন ঘন করতালি দিয়া প্রশংসাধ্বনি করেন।

স্বামী বিবে কানন্দ পুনরায় আজ বিকাল ৪টায় লা স্যালেট একাডেমীতে ‘ভারতীয় আচার-ব্যবহার’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিবেন।