০৭. পুনর্জন্ম

‘ইভানষ্টন ইনডেক্স’, ৭ অক্টোবর, ১৮৯৩

গত সপ্তাহে কংগ্রীগেশনাল চার্চ-এ অনেকটা সম্প্রতি-সমাপ্ত ধর্ম-মহাসভার ন্যায় একটি বক্তৃতামালার অনুষ্ঠান হইয়াছিল। বক্তা ছিলেন দুইজনঃ সুইডেনের ডক্টর কার্ল ভন বারগেন এবং হিন্দু সন্ন্যাসী সিউআমি বিবেকানন্দ। … সিউআমি বিবেকানন্দ ছিলেন ধর্ম-মহাসভায় একজন ভারতীয় প্রতিনিধি। তিনি তাঁহার অপূর্ব কমলালেবু রঙের পোষাক, ওজস্বী ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ বাগ্মিতা এবং হিন্দুদর্শনের আশ্চর্য ব্যাখ্যার জন্য বহু লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছেন। তাঁহার চিকাগোতে অবস্থান তাঁহার প্রতি অবিচ্ছিন্ন উৎসাহ ও সাধুবাদের হেতু হইয়াছে। বক্তৃতাগুলি তিনটি সন্ধ্যায় আয়োজিত হইয়াছিল।

শনিবার এবং মঙ্গলবার সন্ধ্যার আলোচ্য বিষয়গুলির তালিকা দিয়া সাংবাদিক বলিতেছেনঃ

বৃহস্পতিবার ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ডক্টর ভন বারগেনের আলোচ্য বিষয় ছিল—‘সুইডেনের রাজকন্যা’-বংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘হালডাইন বীমিশ’। হিন্দু সন্ন্যাসী বলেন ‘পুনর্জন্ম’ সম্বন্ধে। শেষের বক্তৃতাটি বেশ চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল, কেননা এই বিষয়টির আলোচ্য মতসমূহ পৃথিবীর এই অঞ্চলে বিশেষ শোনা যায় না। ‘আত্মার জন্মান্তর-গ্রহণ’ তত্ত্বটি এই দেশে অপেক্ষাকৃত নূতন এবং খুব কম লোকেই উহা বুঝিতে পারে; কিন্তু প্রাচ্যে উহা সুপরিচিত এবং ওখানে উহা প্রায় সকল ধর্মের বনিয়াদ। যাঁহারা মতবাদরূপে ইহার ব্যবহার করেন না, তাঁহারাও ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। পুনর্জন্মতত্ত্বের মীমাংসার প্রধান বিষয় হইল—আমাদের অতীত বলিয়া কিছু আছে কিনা। বর্তমান জীবন আমাদের একটি আছে, তাহা আমরা জানি। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও একটা স্থির অনুভব আমাদের থাকে। তথাপি অতীতকে স্বীকার না করিয়া বর্তমানের অস্তিত্ব কিরূপে সম্ভব? বর্তমান বিজ্ঞান প্রমাণ করিয়াছে যে, জড়ের কখনও বিনাশ নাই, অবিচ্ছিন্ন উহার অস্তিত্ব। সৃষ্টি শুধু আকৃতির পরিবর্তন মাত্র। আমরা শূন্য হইতে আসি নাই। কেহ কেহ সব কিছুর সাধারণ কারণরূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করেন। তাঁহারা মনে করেন, এই স্বীকার দ্বারাই সৃষ্টির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হইল। কিন্তু প্রত্যেক ব্যাপারেই আমাদিগকে ঘটনাগুলি বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে—কোথা হইতে এবং কিভাবে বস্তুর উৎপত্তি ঘটে। যে-সব যুক্তি দিয়া ভবিষ্যৎ অবস্থান প্রমাণ করা হয়, সেই যুক্তিগুলিই অতীত অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কারণ স্বীকার করা প্রয়োজন। বংশগতির দ্বারা ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কেহ কেহ বলেন, ‘কই, আমরা পূর্বেকার জন্ম তো স্মরণ করিতে পারি না।’ কিন্তু এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া গিয়াছে, যেখানে পূর্বজন্মের স্পষ্ট স্মৃতি বিদ্যমান। এখানেই জন্মান্তরবাদের বীজ নিহিত। সেহেতু হিন্দুরা মূকপ্রাণীর প্রতি দয়ালু, সেইজন্যই অনেকে মনে করেন, হিন্দুরা নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মান্তরে বিশ্বাসী। ইঁহারা নিম্ন প্রাণীর প্রতি দয়াকে কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু মনে করিতে পারেন না। জনৈক প্রাচীন হিন্দু ঋষি ধর্মের সংজ্ঞা দিয়াছেনঃ যাহাই মানুষকে উন্নত করে, তাহার নাম ধর্ম। পশুত্বকে দূর করিতে হইবে, মানবত্বকে দেবত্বে লইয়া যাইতে হইবে। জন্মান্তরবাদ মানুষকে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখে না। মানুষের আত্মা অন্য উচ্চতর লোকে গিয়া মহত্তর জীবন লাভ করিতে পারে। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের স্থলে সেখানে তাহার আটটি ইন্দ্রিয় থাকিতে পারে। এইভাবে উচ্চতর ক্রমবিকাশ লাভ করিয়া অবশেষে সে পূর্ণতার পরাকাষ্ঠা—অমৃতত্ব লাভ করিবে। মহাজনদের লোকসমূহে তখন সে নির্বাণের গভীর আনন্দ উপলব্ধি করিতে থাকিবে।