০২. ভারতের জীবনব্রত

[সানডে টাইমস—লণ্ডন, ১৮৯৬]

ইংলণ্ডবাসীরা যে ভারতের ‘প্রবাল উপকূলে’ ধর্ম-প্রচারক প্রেরণ করিয়া থাকেন, তাহা ইংলণ্ডের জনসাধারণ বিলক্ষণ অবগত আছেন। তবে ভারতও যে ইংলণ্ডে ধর্মপ্রচারক পাঠাইয়া থাকেন, তাহা ইংলণ্ডের জনসাধারণ বড় একটা জানেন না। সেণ্ট জর্জেস রোড, সাউথ ওয়েষ্ট, ৬৩নং ভবনে স্বামী বিবেকানন্দ অল্পকালের জন্য বাস করিতেছেন। দৈবযোগে (যদি ‘দৈব’ এই শব্দটি প্রয়োগ করিতে কেহ আপত্তি না করেন) সেখানে তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি কি করেন, এবং তাঁহার ইংলণ্ডে আসিবার উদ্দেশ্যই বা কি, এই-সকল বিষয়ে আলোচনা করিতে তাঁহার কোন আপত্তি না থাকায় ঐ স্থানে আসিয়া আমি তাঁহার সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিলাম। তিনি যে আমার অনুরোধ রক্ষা করিয়া আমার সহিত ঐ ভাবে কথোপকথনে সম্মত হইয়াছেন, তাহাতে আমি প্রথমেই বিস্ময় প্রকাশ করিলাম।

তিনি বলিলেন—আমেরিকায় বাস করিবার কাল হইতেই এইরূপে সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের সহিত সাক্ষাৎ করা আমার সম্পূর্ণ অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। আমার দেশে ঐরূপ প্রথা নাই বলিয়াই যে আমি সর্বসাধারণকে যাহা জানাইতে ইচ্ছা করি, তাহা জানাইবার জন্য বিদেশে গিয়া সেখানকার প্রচারের প্রচলিত প্রথাগুলি অবলম্বন করিব না, ইহা কখনও যুক্তিসঙ্গত হইতে পারে না। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকার চিকাগো শহরে যে বিশ্বধর্মমহাসভা বসিয়াছিল, তাহাতে আমি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি ছিলাম। মহীশূরের রাজা এবং অপর কয়েকটি বন্ধু আমাকে সেখানে পাঠাইয়াছিলেন। আমার বোধ হয়, আমি আমেরিকায় কিছুটা কৃতকার্য হইয়াছি বলিয়া দাবী করিতে পারি। চিকাগো ছাড়াও আমেরিকার অন্যান্য বড় বড় শহরে আমি বহুবার নিমন্ত্রিত হইয়াছি। আমি দীর্ঘকাল ধরিয়া আমেরিকায় বাস করিতেছি। গত বৎসর গ্রীষ্মকালে একবার ইংলণ্ডে আসিয়াছিলাম, এ বৎসর আসিয়াছি দেখিতেছেন; প্রায় তিন বৎসর আমেরিকায় রহিয়াছি। আমার বিবেচনায় আমেরিকার সভ্যতা খুব উচ্চ স্তরের। দেখিলাম, মার্কিনজাতির চিত্ত সহজেই নূতন নূতন ভাব ধারণা করিতে পারে। কোন জিনিষ নূতন বলিয়াই তাহারা পরিত্যাগ করে না, উহার বাস্তবিক কোন গুণাগুণ আছে কিনা, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখে—তারপর উহা গ্রাহ্য কি ত্যাজ্য, বিচার করে।

‘ইংলণ্ডের লোকেরা অন্যপ্রকার—ইহাই বুঝি আপনার বলিবার উদ্দেশ্য?’

‘হাঁ, ইংলণ্ডের সভ্যতা আমেরিকা হইতে পুরাতন। শতাব্দীর পর শতাব্দী যেমন চলিয়াছে, তেমনই উহাতে নানা নূতন বিষয় সংযোজিত হইয়া উহার বিকাশ হইয়াছে। ঐরূপে অনেকগুলি কুসংস্কারও আসিয়া জুটিয়াছে। সেগুলি ভাঙিতে হইবে। এখন যে-কোন ব্যক্তি আপনাদের ভিতর কোন নূতন ভাব প্রচার করিতে চেষ্টা করিবে, তাহাকেই ঐগুলির দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখিয়া চলিতে হইবে।’

‘লোকে এইরূপ বলে বটে। আমি যতদূর জানি, তাহাতে আপনি আমেরিকায় কোন নূতন সম্প্রদায় বা ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করিয়া আসেন নাই।’

‘এ কথা সত্য। সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা আমার ভাবের বিরোধী; কারণ সম্প্রদায় তো যথেষ্টই রহিয়াছে। আর সম্প্রদায় করিতে গেলে উহার তত্ত্বাবধানের জন্য লোক প্রয়োজন। এখন ভাবিয়া দেখুন, যাহারা সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়াছে, অর্থাৎ সাংসারিক পদমর্যাদা, বিষয়সম্পত্তি, নাম প্রভৃতি সব ছাড়িয়াছে এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানান্বেষণই যাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য, তাহারা এরূপ কাজের ভার লইতে পারে না। বিশেষতঃ ঐরূপ কাজ যখন অপরে চালাইতেছে, তখন আবার ঐ ভাবে কাজে অগ্রসর হওয়া নিষ্প্রয়োজন।’

‘আপনার শিক্ষা কি ধর্মসমূহের তুলনামূলক আলোচনা?’

‘সকল প্রকার ধর্মের সারভাগ শিক্ষা দেওয়া বলিলে বরং আমার প্রদত্ত শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে একটা স্পষ্টতর ধারণা হইতে পারে। ধর্মসমূহের গৌণ অঙ্গগুলি বাদ দিয়া উহাদের মধ্যে যেটি মুখ্য, যেটি উহাদের মূলভিত্তি, সেইটির দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার কাজ। আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের একজন শিষ্য, তিনি একজন সিদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁহার জীবন ও উপদেশ আমার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। এই সন্ন্যাসিশ্রেষ্ঠ কোন ধর্মকে কখনও সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখিতেন না; কোন ধর্মের এই এই ভাব ঠিক নয়—এ-কথা তিনি বলিতেন না। তিনি সকল ধর্মের ভাল দিকটাই দেখাইয়া দিতেন। দেখাইতেন, কিরূপে ঐগুলি অনুষ্ঠান করিয়া উপদিষ্ট ভাবগুলিকে আমরা আমাদের জীবনে পরিণত করিতে পারি। কোন ধর্মের বিরোধিতা করা বা তাহার বিপরীত পক্ষ আশ্রয় করা—তাঁহার শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ; কারণ তাঁহার উপদেশের মূল সত্যই এই যে, সমগ্র জগৎ প্রেমবলে পরিচালিত। আপনারা জানেন, হিন্দুধর্ম কখনও অপর ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার করে নাই। আমাদের দেশে সকল সম্প্রদায়ই প্রেম ও শান্তিতে বাস করিতে পারে। মুসলমানদের সঙ্গে-সঙ্গেই ভারতে ধর্মসম্বন্ধীয় মতামত লইয়া হত্যা অত্যাচার প্রভৃতি প্রবেশ করিয়াছে, তাহারা আসিবার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে আধ্যাত্মিক রাজ্যে শান্তি বিরাজিত ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুন—জৈনগণ, যাহারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী এবং ঐ বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলিয়া প্রচার করে, তাহাদেরও ইচ্ছামত ধর্মানুষ্ঠানে কেহ কোন দিন বাধা দেয় নাই; আজ পর্যন্ত তাহারা ভারতে রহিয়াছে। ভারতই ঐ বিষয়ে শান্তি ও মৃদুতারূপ যথার্থ বীর্যের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছে। যুদ্ধ, অসমসাহসিকতা, প্রচণ্ড আঘাতের শক্তি—এগুলি ধর্মজগতে দুর্বলতার চিহ্ন।’

‘আপনার কথাগুলি টলস্টয়ের মতের মত লাগিতেছে। ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এই মত অনুসরণীয় হইতে পারে; সে-বিষয়েও আমার নিজের সন্দেহ আছে, কিন্তু সমগ্র জাতির ঐ নিয়মে বা আদর্শে কিভাবে চলা সম্ভব?’

‘জাতির পক্ষেও ঐ মত অতি উত্তমরূপে কার্যকর হইবে দেখা যায়, ভারতের কর্মফল—ভারতের অদৃষ্ট—অপর জাতিগুলি কর্তৃক বিজিত হওয়া, কিন্তু আবার সময়ে ঐ-সকল বিজেতাকে ধর্মবলে জয় করা। ভারত তাহার মুসলমান বিজেতাগণকে ইতোমধ্যেই জয় করিয়াছে। শিক্ষিত মুসলমানগণ সকলেই সুফি—তাঁহাদিগকে হিন্দু হইতে পৃথক্‌ করিবার উপায় নাই। হিন্দু ভাব তাঁহাদের সভ্যতার মর্মে প্রবেশ করিয়াছে—তাঁহারা ভারতের নিকট শিক্ষার্থীর ভাব ধারণ করিয়াছেন। মোগল সম্রাট মহাত্মা আকবর কার্যতঃ একজন হিন্দু ছিলেন। আবার ইংলণ্ডের পালা আসিলে ভারত তাহাকেও জয় করিবে। আজ ইংলণ্ডের হস্তে তরবারি রহিয়াছে, কিন্তু ভাব-জগতে উহার উপযোগিতা তো নাই-ই, বরং উহাতে অপকারই হইয়া থাকে। আপনি জানেন, শোপেনহাওয়ার ভারতীয় ভাব ও চিন্তা সম্বন্ধে কি বলিয়াছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেনঃ ‘অন্ধকার যুগের’পর গ্রীক ও ল্যাটিন বিদ্যার অভ্যুদয়ে যেমন ইওরোপে গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছিল, ভারতীয় ভাব ইওরোপে সুপরিচিত হইলে সেইরূপ গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হইবে।’

‘আমায় ক্ষমা করিবেন—কিন্তু সম্প্রতি তো ইহার বিশেষ কিছু চিহ্ন দেখা যাইতেছে না।’

স্বামীজী গম্ভীরভাবে বলিলেন—না দেখা যাইতে পারে, কিন্তু এ-কথাও বেশ বলা যায় যে, ইওরোপের সেই ‘জাগরণের’সময়ও অনেকে কোন চিহ্ন পূর্বে দেখে নাই, এবং উহা আসিবার পরও উহা যে আসিয়াছে, তাহা বুঝিতে পারে নাই। যাঁহারা সময়ের লক্ষণ বিশেষভাবে অবগত, তাঁহারা কিন্তু বেশ বুঝিতে পারিতেছেন যে, একটি মহান্ আন্দোলন আজকাল ভিতরে ভিতরে চলিয়াছে। সম্প্রতি কয়েক বর্ষ ধরিয়া প্রাচ্যতত্ত্বানুসন্ধান অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। বর্তমানে ইহা পণ্ডিতদের হস্তেই রহিয়াছে এবং তাঁহারা যতদূর কার্য করিয়াছেন, তাহা লোকের নিকট শুষ্ক নীরস বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু ক্রমে লোকে উহা বুঝিবে, ক্রমে জ্ঞানালোকের প্রকাশ হইবে।

‘আপনার মতে তবে ভারতই ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ বিজেতার আসন পাইবে! তথাপি ভারত তাহার ভাবরাজি-প্রচারের জন্য অন্যান্য দেশে অধিক ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করে না কেন? বোধ করি, যত দিন না সমগ্র জগৎ আসিয়া তাহার পদতলে পড়িতেছে, ততদিন সে অপেক্ষা করিবে!’

‘ভারত প্রাচীন যুগে ধর্মপ্রচারকার্যে একটি প্রবল শক্তি হইয়া উঠিয়াছিল। ইংলণ্ড খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিবার শত শত বৎসর পূর্বে বুদ্ধ সমগ্র এশিয়াকে তাঁহার মতাবলম্বী করিবার জন্য ধর্মপ্রচারক পাঠাইয়াছিলেন। বর্তমানকালে চিন্তাজগৎ ধীরে ধীরে ভারতের ভাব গ্রহণ করিতেছে। এখন ইহার আরম্ভ হইয়াছে মাত্র। বিশেষ কোনপ্রকার ধর্ম অবলম্বন করিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তির সংখ্যা খুব বাড়িতেছে, আর শিক্ষিত ব্যক্তিগণের ভিতরেই এই ভাব বাড়িয়া চলিয়াছে। সম্প্রতি আমেরিকাতে যে লোক-গণনা হইয়াছিল, তাহাতে অনেক লোক আপনাদিগকে কোনরূপ বিশেষ ধর্মাবলম্বী বলিয়া শ্রেণীবদ্ধ করিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল। আমি বলি, সকল ধর্মসম্প্রদায়ই এক মূল সত্যের বিভিন্ন বিকাশমাত্র। হয় সবগুলিরই উন্নতি হইবে, নয় সবগুলিই বিনষ্ট হইবে। উহারা ঐ এক সত্যরূপ কেন্দ্র হইতে বহু ব্যাসার্ধের মত বাহির হইয়াছে, এবং বিভিন্ন প্রকৃতিবিশিষ্ট মানব-মনের উপযোগী সত্যের প্রকাশস্বরূপ হইয়া রহিয়াছে।’

‘এখন আমরা অনেকটা মূলপ্রসঙ্গের কাছে আসিতেছি—সেই কেন্দ্রীভূত সত্য কি?’

‘মানুষের অন্তনির্হিত ব্রহ্মশক্তি। প্রত্যেক ব্যক্তিই—সে যতই মন্দপ্রকৃতি হউক না কেন, ভগবানের প্রকাশস্বরূপ। এই ব্রহ্মশক্তি আবৃত থাকে, মানুষের দৃষ্টি হইতে লুক্কায়িত থাকে। ঐ কথায় আমার ভারতীয় সিপাহীবিদ্রোহের একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। ঐ সময়ে বহুবর্ষ-মৌনব্রতধারী এক সন্ন্যাসীকে জনৈক মুসলমান দারুণ আঘাত করে। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে লোকে ঐ আঘাতকারীকে ধরিয়া তাঁহার কাছে লইয়া গিয়া বলিল, ‘স্বামিন্, আপনি একবার বলুন, তাহা হইলে এ ব্যক্তি নিহত হইবে।’ সন্ন্যাসী অনেক দিনের মৌনব্রত ভঙ্গ করিয়া তাঁহার শেষ নিঃশ্বাসের সহিত বলিলেন, ‘বৎসগণ, তোমরা বড়ই ভুল করিতেছ—ঐ ব্যক্তিও যে সাক্ষাৎ ভগবান্!’ সকলের পশ্চাতে ঐ একত্ব রহিয়াছে—উহাই আমাদের জীবনের শিক্ষা করিবার প্রধান বিষয়। তাঁহাকে গড্, আল্লা, যিহোবা, প্রেম বা আত্মা যাহাই বলুন না কেন, সেই এক বস্তুই অতি ক্ষুদ্রতম প্রাণী হইতে মহত্তম মানব পর্যন্ত সমুদয় প্রাণীতেই প্রাণস্বরূপে বিরাজমান। এই চিত্রটি মনে মনে ভাবুন দেখি, যেন বরফে ঢাকা সমুদ্রের মধ্যে অনেকগুলি বিভিন্ন আকারের গর্ত করা রহিয়াছে—ঐ প্রত্যেকটি গর্তই এক একটি আত্মা—এক একটি মানুষসদৃশ, নিজ নিজ বুদ্ধিশক্তির তারতম্য অনুসারে বন্ধন কাটাইয়া—ঐ বরফ ভাঙিয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিতেছে!’

‘আমার বোধ হয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জাতির আদর্শের মধ্যে একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। আপনারা সন্ন্যাস, একাগ্রতা প্রভৃতি উপায়ে খুব উন্নত ব্যক্তি গঠনের চেষ্টা করিতেছেন, আর পাশ্চাত্য জাতির আদর্শ—সামাজিক অবস্থার সম্পূর্ণতা সাধন করা। সেইজন্য আমরা সামাজিক ও রাজনীতিক সমস্যাসমূহের মীমাংসাতেই বিশেষ ভাবে নিযুক্ত; কারণ সর্বসাধারণের কল্যাণের উপর আমাদের সভ্যতার স্থায়িত্ব নির্ভর করিতেছে—আমরা এইরূপ বিবেচনা করি।’

স্বামীজী খুব দৃঢ়তা ও আগ্রহের সহিত বলিলেন, ‘কিন্তু সামাজিক বা রাজনীতিক সর্ববিধ বিষয়ের সফলতার মূলভিত্তি—মানুষের সততা। পার্লামেণ্ট কর্তৃক বিধিবদ্ধ কোন আইন দ্বারা কখনও কোন জাতি উন্নত বা ভাল হয় না, কিন্তু সেই জাতির অন্তর্গত লোকগুলি উন্নত ও ভাল হইলেই জাতির ভাল হইয়া থাকে। আমি চীনদেশে গিয়াছিলাম—এক সময়ে ঐ জাতিই সর্বাপেক্ষা চমৎকার শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল, কিন্তু আজ সেই চীন ছত্রভঙ্গ কতকগুলি সামান্য লোকের সমষ্টি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহার কারণ—প্রাচীনকালে উদ্ভাবিত ঐ-সকল শাসনপ্রণালী পরিচালনা করিবার উপযুক্ত লোক বর্তমানে ঐ জাতিতে আর জন্মাইতেছে না। ধর্ম সকল-বিষয়ের মূল পর্যন্ত গিয়া থাকে। মূলটি যদি ঠিক থাকে, তবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই ঠিক থাকে।’

‘ভগবান্ সকলেরই ভিতর রহিয়াছেন, কিন্তু, তিনি আবৃত রহিয়াছেন—এ কথাটা যেন কি রকম অস্পষ্ট ও ব্যবহারিক জগৎ হইতে অনেক দূরে বলিয়া বোধ হয়। লোকে তো আর সদা-সর্বদা ঐ ব্রহ্মের সন্ধান করিতে পারে না?’

‘লোকে অনেক সময় পরস্পর একই উদ্দেশ্যে কার্য করিয়া থাকে, কিন্তু তাহা বুঝিতে পারে না। এটি স্বীকার করিতেই হইবে যে, আইন গভর্ণমেণ্ট রাজনীতি—এগুলি মানব-জীবনের চরম উদ্দেশ্য নয়। ঐ-সকল ছাড়াইয়া উহাদের চরম লক্ষ্যস্থল এমন একটি আছে, যেখানে আইন আর প্রয়োজন হয় না। এখানে বলিয়া রাখি, সন্ন্যাসী শব্দটির অর্থ—বিধিনিয়মত্যাগী ব্রহ্মতত্ত্বান্বেষী, কিম্বা ‘সন্ন্যাসী’ বলিতে নেতিবাদী ব্রহ্মজ্ঞানীও বলিতে পারা যায়। তবে এইরূপ শব্দ ব্যবহার করিলে সঙ্গে সঙ্গে একটা ভুল ধারণা আসিয়া থাকে। শ্রেষ্ঠ আচার্যগণ একই শিক্ষা দিয়া থাকেন। যীশুখ্রীষ্ট বুঝিয়াছিলেন, নিয়ম-প্রতিপালনই উন্নতির মূল নহে, যথার্থ পবিত্রতা ও চরিত্রই শক্তি। আপনি যে বলিতেছিলেন, প্রাচ্যদেশে লক্ষ্য আত্মার উচ্চতর বিকাশের দিকে—অবশ্য আপনি এ-কথা বিস্মৃত হন নাই বোধ হয় যে, আত্মা দুই প্রকারঃ কূটস্থ চৈতন্য, যিনি আত্মার যথার্থ স্বরূপ; আর আভাস চৈতন্য, আপাততঃ যাহাকে আমাদের আত্মা বলিয়া বোধ হইতেছে।’

‘বোধ হয়, আপনার ভাব এই যে, আমরা আভাসের উদ্দেশ্যে কার্য করিতেছি, আর আপনার প্রকৃত চৈতন্যের উদ্দেশ্যে কার্য করিতেছেন?’

‘মন নিজ পূর্ণতর বিকাশের জন্য নানা সোপানের মধ্য দিয়া অগ্রসর হয়। প্রথমে উহা স্থূলকে অবলম্বন করিয়া ক্রমশঃ সূক্ষ্মের দিকে যাইতে থাকে। আরও দেখুন, সর্বজনীন ভ্রাতৃভাবের ধারণা মানুষে কিরূপে লাভ করিয়া থাকে। প্রথমতঃ উহা সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃভাবের আকারে আবির্ভূত হয়, তখন উহাতে সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ—‘অপরকে বাদ দেওয়া’ ভাব থাকে। পরে ক্রমে ক্রমে আমরা উদারতর ভাবে—সূক্ষ্মতর ভাবে পৌঁছিয়া থাকি।’

‘তাহা হইলে আপনি কি মনে করেন, এই-সব সম্প্রদায়, যাহা আমরা—ইংরেজেরা—এত ভালবাসি, সব লোপ পাইবে? আপনি জানেন বোধ হয়, জনৈক ফরাসী বলিয়াছিলেন, ইংলণ্ডে সম্প্রদায় সহস্র সহস্র, কিন্তু সার জিনিষ খুব অল্প।’

‘ঐ-সব সম্প্রদায় যে লোপ পাইবে, সে-সম্বন্ধে আমার কোন সংশয় নাই। উহাদের অস্তিত্ব অসার বা গৌণ কতকগুলি বিষয়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য উহাদের মুখ্য বা সার ভাবটি থাকিয়া যাইবে এবং উহার সাহায্যে অপর নূতন গৃহ নির্মিত হইবে। অবশ্য সেই প্রাচীন উক্তি আপনার জানা আছে যে, একটা চার্চ বা সম্প্রদায়বিশেষের মধ্যে জন্মান ভাল, কিন্তু আমরণ উহার গণ্ডীর ভিতরে বদ্ধ থাকা ভাল নয়।’

‘ইংলণ্ডে আপনার কার্যের কিরূপ বিস্তার হইতেছে, অনুগ্রহপূর্বক বলিবেন কি?’

‘ধীরে ধীরে হইতেছে, ইহার কারণ আমি পূর্বেই বলিয়াছি। যেখানে মূল ধরিয়া কার্য, সেখানে প্রকৃত উন্নত বা বিস্তার অবশ্যই ধীরে ধীরে হইয়া থাকে। অবশ্য বলা বাহুল্য, যে-কোন উপায়েই হউক, এই-সব ভাব বিস্তৃত হইবেই হইবে, এবং আমাদের অনেকের বোধ হইতেছে, ঐ-সকল ভাব-প্রচারের যথার্থ সময় উপস্থিত হইয়াছে।’