০৪. ইংলণ্ডে ভারতীয় ধর্মপ্রচারক

[লণ্ডন হইতে প্রকাশিত ‘একো নামক সংবাদপত্র, ১৮৯৬]

… বোধ হয় নিজের দেশে হইলে স্বামীজী গাছতলায়, বড়জোর কোন মন্দিরের সন্নিকটে থাকিতেন, নিজের দেশের কাপড় পরিতেন ও তাঁহার মস্তক মুণ্ডিত থাকিত। কিন্তু লণ্ডনে তিনি ও-সব কিছুই করেন না। সুতরাং আমি যখন স্বামীজীর সহিত দেখা করিলাম, দেখিলাম—তিনি অপরাপর লোকের মতই বাস করিতেছেন। পোষাকও অন্যান্য লোকেরই মত—তফাত কেবল এই যে, তিনি গেরুয়া রঙের একটি লম্বা জামা পরেন।

আমি প্রথমেই ঐ ভারতীয় যোগীকে তাঁহার নাম খুব ধীরে ধীরে বানান করিতে বলিলাম।

* * *

‘আপনি কি মনে করেন, আজকাল লোকের অসার ও গৌণ বিষয়েই দৃষ্টি বেশি?’

‘আমার তো তাই মনে হয়—অনুন্নত জাতিদের মধ্যে এবং পাশ্চাত্য দেশের সভ্য জাতিদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত, তাদের মধ্যেও এই ভাব। আপনার প্রশ্নের ভাবে বোধ হয়, ধনী ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণের মধ্যে অন্য ভাব। বাস্তবিক তাই বটে। ধনী লোকেরা হয় ঐশ্বর্যভোগে মগ্ন, অথবা আরও অধিক ধন-সঞ্চয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত। তারা এবং সংসারকর্মে ব্যস্ত অনেক লোকে ধর্মটাকে একটা অনর্থক বাজে জিনিষ মনে করে, আর সরল ভাবেই এ-কথা মনে করে থাকে। প্রচলিত ধর্ম হচ্ছে—দেশহিতৈষিতা আর লোকাচার। লোকে বিবাহের সময় বা কাকেও কবর দেবার সময়েই কেবল চার্চে যায়।’

‘আপনি যা প্রচার করছেন, তার ফলে কি লোকের চার্চে গতিবিধি বাড়বে?‘

‘আমার তো তা বোধ হয় না। কারণ বাহ্য অনুষ্ঠান বা মতবাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মই যে মানবজীবনের সর্বস্ব এবং সব কিছুর ভেতরেই যে ধর্ম আছে, তাই দেখান আমার জীবনব্রত। … আর এখানে ইংলণ্ডে কি ভাব চলছে? ভাবগতিক দেখে বোধ হয় যে, সোশ্যালিজম্ বা অন্য কোনরূপ গণতন্ত্র, তার নাম যাই দিন না কেন, শীঘ্র প্রচলিত হবে। লোকে অবশ্য তাদের সাংসারিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির আকাঙ্ক্ষা মেটাতে চাইবে। তারা চাইবে—যাতে তাদের কাজ পূর্বাপেক্ষা কমে যায়, যাতে তারা ভাল খেতে পায় এবং অত্যাচার ও যুদ্ধবিগ্রহ একেবারে বন্ধ হয়। কিন্তু যদি এদেশের সভ্যতা বা অন্য কোন সভ্যতা ধর্মের উপর, মানবের সাধুতার উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে তা যে টিকবে তার নিশ্চয়তা কি? এটি নিশ্চয় জানবেন যে, ধর্ম সকল বিষয়ের মূল পর্যন্ত গিয়ে থাকে। যদি ঐটি ঠিক থাকে, তবে সব ঠিক।’

‘কিন্তু ধর্মের সার দার্শনিক ভাব লোকের মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া তো বড় সহজ ব্যাপার নয়। লোকে সচরাচর যে-সকল চিন্তা করে এবং যেভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, তার সঙ্গে তো এর অনেক ব্যবধান।’

‘সকল ধর্ম বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, প্রথমাবস্থায় লোকে ক্ষুদ্রতর সত্যকে আশ্রয় করে থাকে, পরে তা থেকেই বৃহত্তর সত্যে উপনীত হয়; সুতরাং অসত্য ছেড়ে সত্যলাভ হল, এটি বলা ঠিক নয়। সৃষ্টির অন্তরালে এক বস্তু বিরাজমান, কিন্তু লোকের মন নিতান্ত ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—সত্য বস্তু একটিই, জ্ঞানিগণ তাকে নানারূপে বর্ণনা করে থাকেন। আমার বলবার উদ্দেশ্য এই যে, লোকে সঙ্কীর্ণতর সত্য থেকে ব্যাপকতর সত্যে অগ্রসর হয়ে থাকে; সুতরাং অপরিণত বা নিম্নতর ধর্মসমূহও মিথ্যা নয়, সত্য; তবে তাদের মধ্যে সত্যের ধারণা বা অনুভূতি অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট বা অপকৃষ্ট—এই মাত্র। লোকের জ্ঞানবিকাশ ধীরে ধীরে হয়ে থাকে। এমন কি, ভূতোপাসনা পর্যন্ত সেই নিত্য সত্য সনাতন ব্রহ্মেরই বিকৃত উপাসনা মাত্র। ধর্মের অন্যান্য যে-সব রূপ আছে, তাদের মধ্যে অল্পবিস্তর সত্য বর্তমান; সত্য কোন ধর্মেই পূর্ণরূপে নেই।’

‘আপনি ইংলণ্ডে যে ধর্ম প্রচার করতে এসেছেন, তা আপনারই উদ্ভাবিত কিনা, এ- কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’

‘এ ধর্ম আমার উদ্ভাবিত কখনই নয়। আমি রামকৃষ্ণ পরমহংস নামক জনৈক ভারতীয় মহাপুরুষের শিষ্য। আমাদের দেশের অনেক মহাত্মার মত তিনি বিশেষ পণ্ডিত ছিলেন না বটে, কিন্তু অতিশয় পবিত্রাত্মা ছিলেন এবং তাঁহার জীবন ও উপদেশ বেদান্তদর্শনের ভাবে বিশেষরূপে অনুরঞ্জিত ছিল। বেদান্তদর্শন বললাম—কিন্তু এটিকে ধর্মও বলতে পারা যায়, কারণ প্রকৃতপক্ষে বেদান্ত ‘ধর্ম’ ও ‘দর্শন’ দুই-ই। সম্প্রতি ‘নাইনটিন্থ্‌ সেঞ্চুরি’ পত্রের একটি সংখ্যায় অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার আমার আচার্যদেবের যে বিবরণ লিখেছেন, তা অনুগ্রহপূর্বক পড়ে দেখবেন। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হুগলী জেলায় শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম হয়, আর ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর দেহত্যাগ হয়। কেশবচন্দ্র সেন এবং অন্যান্য ব্যক্তির জীবনের উপর তিনি প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। শরীর ও মনের সংযম অভ্যাস করে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। তাঁর মুখভাব সাধারণ মানুষের মত ছিল না—তাঁর মুখে বালকের মত কমনীয়তা, গভীর নম্রতা এবং অদ্ভুত প্রশান্ত ও মধুর ভাব দেখা যেত। তাঁর মুখ দেখে বিচলিত না হয়ে কেউ থাকতে পারত না।’

‘তবে আপনার উপদেশ বেদ হইতে গৃহীত?’

‘হাঁ, বেদান্তের অর্থ বেদের শেষভাগ, উহা বেদের তৃতীয় অংশ। উহার নাম উপনিষদ্। প্রাচীন ভাগে যে-সকল ভাব বীজাকারে অবস্থিত দেখতে পাওয়া যায়, সেই বীজগুলিই এখানে সুপরিণত হয়েছে। বেদের অতি প্রাচীন ভাগের নাম ‘সংহিতা’। এগুলি অতি প্রাচীন ধরনের সংস্কৃতে রচিত। যাস্কের ‘নিরুক্ত’ নামক অতি প্রাচীন অভিধানের সাহায্যেই কেবল এগুলি বোঝা যেতে পারে।’

* * *

‘আমাদের—ইংরেজদের বরং ধারণা, ভারতকে আমাদের কাছ থেকে অনেক শিক্ষা করতে হবে। ভারত থেকে ইংরেজরা যে কিছু শিখতে পারে, এ-সম্বন্ধে সাধারণ লোক একরূপ অজ্ঞ বললেও হয়।’

‘তা সত্য বটে। কিন্তু পণ্ডিতেরা ভালভাবেই জানেন, ভারত থেকে কতদূর শিক্ষা পাওয়া যেতে পারে, আর ঐ শিক্ষা কতদূরই বা প্রয়োজনীয়। আপনি দেখবেন—ম্যাক্সমূলার, মোনিয়ার উইলিয়ামস্, স্যার উইলিয়ম হাণ্টার বা জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিতেরা ভারতীয় সূক্ষ্মবিজ্ঞান (abstract science)-কে অবজ্ঞা করেন না।’