০১. লণ্ডনে ভারতীয় যোগী

[ওয়েষ্টমিনষ্টার গেজেট—২৩ অক্টোবর, ১৮৯৫]

জনৈক সংবাদদাতা আমাদিগকে লিখিতেছেনঃ পাশ্চাত্য জাতির নিকটে একপ্রকার সম্পূর্ণ নূতন বলিয়া প্রতীত বেদান্তধর্মের প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। ইনি সত্য-সত্যই একজন ভারতীয় যোগী—যুগ-যুগান্তর ধরিয়া সন্ন্যাসী ও যোগিগণ শিষ্যপরম্পরাক্রমে যে-শিক্ষা দিয়া আসিতেছেন, তাহাই ব্যাখ্যা করিবার জন্য তিনি অকুতোভয়ে পাশ্চাত্য দেশে আসিয়াছেন, এবং সেই উদ্দেশ্যে গত সন্ধ্যায় ‘প্রিন্সেস হলে’ এক বক্তৃতা দিয়াছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি, মুখের ভাব শান্ত ও প্রসন্ন—তাঁহাকে দেখলেই বোধ হয় তাঁহার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব আছে।

আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ স্বামীজী, আপনার নামের কোন অর্থ আছে কি?—যদি থাকে, তাহা কি আমি জানিতে পারি?

স্বামীজী॥ আমি এখন যে (স্বামী বিবেকানন্দ) নামে পরিচিত, তাহার প্রথম শব্দটির অর্থ সন্ন্যাসী অর্থাৎ যিনি বিধিপূর্বক সংসারাশ্রম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করিয়াছেন, আর দ্বিতীয়টি একটি উপাধি [নাম?]—সংসারত্যাগের পর ইহা আমি গ্রহণ করিয়াছি। সকল সন্ন্যাসীই এইরূপ করিয়া থাকেন। ইহার অর্থ—বিবেক অর্থাৎ সদসদ্বিচারের আনন্দ।

‘আচ্ছা স্বামীজী, সংসারের সকল লোকে যে-পথে চলিয়া থাকে, আপনি তাহা ত্যাগ করিলেন কেন?’

তবে কি তিনি একটি সম্প্রদায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন—আপনি এখন তাহারই প্রতিনিধিস্বরূপ?’

স্বামীজী অমনি উত্তর দিলেন—না না, সাম্প্রদায়িকতা ও গোঁড়ামি দ্বারা আধ্যাত্মিক জগতে সর্বত্র যে এক গভীর ব্যবধানের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা দূর করিবার জন্যই তাঁহার সমগ্র জীবন ব্যয়িত হইয়াছিল। তিনি কোন সম্প্রদায় স্থাপন করেন নাই, বরং উহার সম্পূর্ণ বিপরীতই করিয়া গিয়াছেন। সাধারণে যাহাতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনচিন্তাপরায়ণ হয়, এই মতই তিনি পোষণ করিতেন এবং উহার জন্যই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তিনি একজন খুব বড় যোগী ছিলেন।

‘তাহা হইলে এই দেশের কোন সমাজ বা সম্প্রদায়ের সহিতই আপনার কোন সম্বন্ধ নাই, যথা—থিওজফিক্যাল সোসাইটি, ক্রিশ্চান সায়েণ্টিষ্টস্‌১ বা অপর কোন সম্প্রদায়ের সহিত?’

‘স্বামীজী স্পষ্ট হৃদয়স্পর্শী স্বরে বলিলেন—না, কিছুমাত্র না। (স্বামীজী যখন কথা কহেন, তখন তাঁহার মুখ বালকের মুখের মত উজ্জ্বল হইয়া উঠে—মুখখানি এতই সরল, অকপট ও সদভাবপূর্ণ!) আমি যাহা শিক্ষা দিই, তাহা আমার গুরুর শিক্ষানুযায়ী, তাঁহার উপদেশের অনুগামী হইয়া আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ আমি নিজে যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহাই ব্যাখ্যা করিয়া থাকি। অলৌকিক উপায়ে লব্ধ কোনপ্রকার বিষয় শিক্ষা দিবার দাবী আমি করি না। আমার উপদেশের মধ্যে যতটুকু তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিসম্মত এবং ব্যক্তিগণের গ্রাহ্য, ততটুকু লোকে গ্রহণ করিলেই আমি যথেষ্ট পুরস্কৃত হইব।

‘তিনি বলিতে লাগিলেন—সকল ধর্মেরই লক্ষ্য—কোন বিশেষ মানব-জীবনকে আদর্শস্বরূপ ধরিয়া স্থূলভাবে ভক্তি, জ্ঞান বা যোগ শিক্ষা দেওয়া। উক্ত আদর্শগুলিকে অবলম্বন করিয়া ভক্তি, জ্ঞান ও যোগ-বিষয়ক যে সাধারণ ভাব ও সাধনপ্রণালী রহিয়াছে, বেদান্ত তাহারই বিজ্ঞানস্বরূপ। আমি ঐ বিজ্ঞানই প্রচার করিয়া থাকি, এবং ঐ বিজ্ঞানসহায়ে নিজ নিজ সাধনার উপায়রূপে অবলম্বিত বিশেষ বিশেষ স্থূল আদর্শগুলি প্রত্যেকে নিজেই বুঝিয়া লউক—এই কথাই বলি। আমি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাহার নিজ নিজ অভিজ্ঞতাকেই প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করিতে বলিয়া থাকি, আর যেখানে কোন গ্রন্থের কথা প্রমাণস্বরূপে উপস্থিত করি, সেখানে বুঝিতে হইবে, চেষ্টা করিলে সেগুলি সংগ্রহ করা যাইতে পারে, আর সকলেই ইচ্ছা করিলে নিজে নিজে উহা পড়িয়া লইতে পারে। সর্বোপরি, প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি দ্বারা আদেশপ্রচারকারী—সাধারণ চক্ষুর অন্তরালে অবস্থিত মহাপুরুষদের উপদেশ বলিয়া কোন কিছু প্রমাণস্বরূপে উপস্থাপিত করি না, অথবা গোপনীয় গ্রন্থ বা হস্তলিপি হইতে কিছু শিখিয়াছি বলিয়া দাবী করি না। আমি কোন গুপ্ত সমিতির মুখপাত্র নই, অথবা ঐরূপ সমিতিসমূহের দ্বারা কোনরূপ কল্যাণ হইতে পারে বলিয়াও আমার বিশ্বাস নাই। সত্য— আপনিই আপনার প্রমাণ, উহার অন্ধকারে লুকাইয়া থাকিবার কোন প্রয়োজন নাই, সত্য অনায়াসে দিবালোক সহ্য করিতে পারে।

তবে স্বামীজী, আপনার কোন সমাজ বা সমিতি প্রতিষ্ঠা করিবার সঙ্কল্প

স্বামীজী॥ না, আমার কোন প্রকার সমিতি বা সমাজ প্রতিষ্ঠা করিবার ইচ্ছা নাই। আমি প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়ে গূঢ়ভাবে অবস্থিত ও সর্বসাধারণের সম্পত্তিস্বরূপ আত্মার তত্ত্ব উপদেশ দিয়া থাকি। জনকয়েক দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি আত্মজ্ঞানলাভ করিলে ও ঐ জ্ঞান-অবলম্বনে দৈনন্দিন জীবনের কাজ করিয়া গেলে পূর্ব পূর্ব যুগের ন্যায় এ যুগেও জগৎটাকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করিয়া দিতে পারেন। পূর্বকালেও এক এক জন দৃঢ়চিত্ত মহাপুরুষ ঐভাবে তাঁহাদের নিজ নিজ সময়ে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিলেন।

‘স্বামীজী, আপনি কি এই সবে ভারত হইতে আসিতেছেন?’ ।

স্বামীজী॥ না। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিকাগোয় যে ধর্ম-মহাসভা হইয়াছিল, আমি তাহাতে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি ছিলাম। সেই অবধি আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করিয়া বক্তৃতা দিতেছি। মার্কিন জাতি পরম আগ্রহ সহকারে আমার বক্তৃতা শুনিতেছে এবং আমার সহিত পরমবন্ধুবৎ আচরণ করিতেছে। সেদেশে আমার কাজ এমন সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, আমাকে শীঘ্র সেখানে ফিরিয়া যাইতে হইবে।

‘স্বামীজী, পাশ্চাত্য ধর্মসমূহের প্রতি আপনার কিরূপ ভাব?’

আমি এমন একটি দর্শন প্রচার করিয়া থাকি, যাহা জগতে যত প্রকার ধর্ম থাকা সম্ভব, সে-সমুদয়েরই ভিত্তিস্বরূপ হইতে পারে, আর আমার সব ধর্মের উপরই সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে, আমার উপদেশ কোন ধর্মেরই বিরোধী নয়। আমি ব্যক্তিগত জীবনের উন্নতিসাধনেই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখি, ব্যক্তিকেই তেজস্বী করিবার চেষ্টা করি। প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বরাংশ বা ব্রহ্ম—এ কথাই শিক্ষা দিই, আর সর্বসাধারণকে তাহাদের অন্তর্নিহিত এই ব্রহ্মভাব সম্বন্ধে সচেতন হইতেই আহ্বান করিয়া থাকি। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ইহাই প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের আদর্শ।’

‘এদেশে আপনার কাজ কি ধরনের হইবে?’

‘আমার আশা এই যে, আমি কয়েকজনকে পূর্বোক্ত ভাবে শিক্ষা দিব, আর তাহাদের নিজ নিজ ভাবে অপরের নিকট উহা ব্যক্ত করিতে উৎসাহিত করিব। আমার উপদেশ তাহারা যত ইচ্ছা রূপান্তরিত করুক, ক্ষতি নাই। আমি অবশ্য-বিশ্বাস্য মতবাদরূপে কিছু শিক্ষা দিব না, কারণ পরিণামে সত্যের জয় নিশ্চয়ই হইয়া থাকে।’

‘আমি প্রকাশ্যে যে-সব কাজ করি, তাহার ভার আমার দু-একটি বন্ধুর হাতে আছে। তাঁহারা ২২ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে আটটার সময় পিকাডেলি প্রিন্সেস হলে ইংরেজ শ্রোতৃবৃন্দের সম্মুখে আমার এক বক্তৃতার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। চারিদিকে বক্তৃতার বিজ্ঞাপন দেওয়া হইতেছে। বিষয়—আমার প্রচারিত দর্শনের মূলতত্ত্ব—‘আত্মজ্ঞান’।  তার পর আমার উদ্দেশ্য সফল করিবার যে-পথ দেখিতে পাইব, সেই পথ অনুসরণ করিতে আমি প্রস্তুত; লোকের বৈঠকখানায় বা অন্য স্থলে সভায় যোগ দেওয়া, পত্রের উত্তর দেওয়া বা সাক্ষাৎভাবে বিচার করা—সব কিছুই করিতে আমি প্রস্তুত। এই অর্থলালসা-প্রধান যুগে আমি এই কথাটি কিন্তু সকলকে বলিতে চাই, আমার কোন কার্যই অর্থলাভের জন্য অনুষ্ঠিত হয় না।’

আমি এইবার তাহার নিকট হইতে বিদায় লইলাম—আমার সহিত যত ব্যক্তির সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে ইনি সর্বাপেক্ষা অধিক মৌলিকভাবপূর্ণ, সে-বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।