০৯. স্বামী-শিষ্য-সংবাদ ৪১-৪৬

৪১

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—১৯০২

 

পূর্ববঙ্গ হইতে ফিরিবার পর স্বামীজী মঠেই থাকিতেন এবং মঠের কাজের তত্ত্বাবধান করিতেন; কখনও কখনও কোন কাজ স্বহস্তে সম্পন্ন করিয়া অনেক সময় অতিবাহিত করিতেন। কখনও নিজ হস্তে মঠের জমি কোপাইতেন, কখনও গাছপালা ফলফুলের বীজ রোপণ করিতেন, আবার কখনও বা চাকরবাকরের ব্যারাম হওয়ায় ঘরদ্বারে ঝাঁট পড়ে নাই দেখিয়া নিজ হস্তে ঝাঁটা ধরিয়া ঐসকল পরিষ্কার করিতেন। যদি কেহ তাহা দেখিয়া বলিতেন, ‘আপনি কেন!’ তাহা হইলে স্বামীজী বলিতেন, ‘তা হলই বা। অপরিষ্কার থাকলে মঠের সকলের যে অসুখ করবে!’

ঐ কালে তিনি মঠে কতকগুলি গাভী, হাঁস, কুকুর ও ছাগল পুষিয়াছিলেন। বড় একটা ছাগলকে ‘হংসী’ বলিয়া ডাকিতেন ও তারই দুধে প্রাতে চা খাইতেন। ছোট একটি ছাগলছানাকে ‘মটরু’ বলিয়া ডাকিতেন ও আদর করিয়া তাহার গলায় ঘুঙুর পরাইয়া দিয়াছিলেন। ছাগলছানাটা আদর পাইয়া স্বামীজীর পায়ে পায়ে বেড়াইত এবং স্বামীজী তাহার সঙ্গে পাঁচ বছরের বালকের মত দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করিতেন। মঠদর্শনে নবাগত ব্যক্তিরা তাঁহার পরিচয় পাইয়া এবং তাঁহাকে ঐরূপ চেষ্টায় ব্যাপৃত দেখিয়া অবাক হইয়া বলিত, ‘ইনিই বিশ্ববিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ!’ কিছুদিন পরে ‘মটরু’ মরিয়া যাওয়ায় স্বামীজী বিষণ্ণচিত্তে শিষ্যকে বলিয়াছিলেন, ‘দেখ্, আমি যেটাকেই একটু আদর করতে যাই, সেটাই মরে যায়।’

মঠের জমির জঙ্গল সাফ করিতে এবং মাটি কাটিতে প্রতি বছরেই কতকগুলি স্ত্রী-পুরুষ সাঁওতাল আসিত। স্বামীজী তাহাদের লইয়া কত রঙ্গ করিতেন এবং তাহাদের সুখদুঃখের কথা শুনিতে কত ভালবাসিতেন।

সাঁওতালদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘কেষ্টা’। স্বামীজী কেষ্টাকে বড় ভালবাসিতেন। কথা কহিতে আসিলে কেষ্টা কখনও কখনও স্বামীজীকে বলিত, ‘ওরে স্বামী বাপ, তুই আমাদের কাজের বেলা এখানকে আসিস না, তোর সঙ্গে কথা বললে আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়; পরে বুড়োবাবা এসে বকে।’ কথা শুনিয়া স্বামীজীর চোখ ছলছল করিত এবং বলিতেন, ‘না না, বুড়োবাবা (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) বকবে না; তুই তোদের দেশের দুটো কথা বল।’ ইহা বলিয়া তাহাদের সাংসারিক সুখদুঃখের কথা পাড়িতেন।

একদিন স্বামীজী কেষ্টাকে বলিলেন, ‘ওরে, তোরা আমাদের এখানে খাবি?’ কেষ্টা বলিল, ‘আমরা যে তোদের ছোঁয়া এখন আর খাই না; এখন যে বিয়ে হয়েছে, তোদের ছোঁয়া নুন খেলে জাত যাবেরে বাপ।’ স্বামীজী বলিলেন, ‘নুন কেন খাবি? নুন না দিয়ে তরকারি রেঁধে দেবে। তা হলে তো খাবি?’ কেষ্টা ঐ কথায় স্বীকৃত হইল। অনন্তর স্বামীজীর আদেশে মঠে ঐ সাঁওতালদের জন্য লুচি, তরকারি, মেঠাই, মণ্ডা, দধি ইত্যাদি যোগাড় করা হইল এবং তিনি তাহাদের বসাইয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। খাইতে খাইতে কেষ্টা বলিল, ‘হাঁরে স্বামী বাপ, তোর এমন জিনিষটা কোথা পেলি? হামরা এমনটা কখনও খাইনি।’ স্বামীজী তাহাদের পরিতোষ করিয়া খাওয়াইয়া বলিলেন, ‘তোরা যে নারায়ণ; আজ আমার নারায়ণের ভোগ দেওয়া হল।’ স্বামীজী যে দরিদ্র নারায়ণসেবার কথা বলিতেন, তাহা তিনি নিজে এইরূপে অনুষ্ঠান করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন।

আহারান্তে সাঁওতালরা বিশ্রাম করিতে গেলে স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘এদের দেখলুম যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ। এমন সরল চিত্ত, এমন অকপট অকৃত্রিম ভালবাসা আর দেখিনি!’ অনন্তর মঠের সন্ন্যাসিবর্গকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ

দেখ্, এরা কেমন সরল! এদের কিছু দুঃখ দূর করতে পারবি? নতুবা গেরুয়া পরে আর কি হল? ‘পরহিতায়’ সর্বস্ব-অর্পণ—এরই নাম যথার্থ সন্ন্যাস। এদের ভাল জিনিষ কখনও কিছু ভোগ হয়নি।। ইচ্ছা হয়—মঠ-ফট সব বিক্রী করে দিই, এইসব গরীব দুঃখী দরিদ্র নারায়ণদের বিলিয়ে দিই, আমরা তো গাছতলা সার করেইছি। আহা! দেশের লোক খেতে পরতে পাচ্ছে না! আমরা কোন্ প্রাণে মুখে অন্ন তুলছি? ওদেশে যখন গিয়েছিলুম, মাকে কত বললুম, ‘মা! এখানে লোক ফুলের বিছানায় শুচ্ছে, চর্ব-চুষ্য খাচ্ছে, কী না ভোগ করছে! আর আমাদের দেশের লোকগুলো না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। মা! তাদের কোন উপায় হবে না?’ ওদেশে ধর্ম-প্রচার করতে যাওয়ার আমার এই আর একটা উদ্দেশ্য ছিল যে, এদেশের লোকের জন্য যদি অন্নসংস্থান করতে পারি।

দেশের লোকেরা দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না দেখে এক এক সময় মনে হয়—ফেলে দিই তোর শাঁখবাজান ঘণ্টানাড়া; ফেলে দিই তোর লেখাপড়া ও নিজে মুক্ত হবার চেষ্টা; সকলে মিলে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে, চরিত্র ও সাধনা-বলে বড়লোকদের বুঝিয়ে, কড়িপাতি যোগাড় করে নিয়ে আসি এবং দরিদ্র নারায়ণদের সেবা করে জীবনটা কাটিয়ে দিই।v

আহা, দেশে গরীব-দুঃখীর জন্য কেউ ভাবে না রে! যারা জাতির মেরুদণ্ড, যাদের পরিশ্রমে অন্ন জন্মাচ্ছে, যে মেথর-মুদ্দাফরাশ একদিন কাজ বন্ধ করলে শহরে হাহাকার রব ওঠে—হায়! তাদের সহানুভূতি করে, তাদের সুখে দুঃখে সান্ত্বনা দেয়, দেশে এমন কেউ নেই রে! এই দেখনা—হিন্দুদের সহানুভূতি না পেয়ে মান্দ্রাজ-অঞ্চলে হাজার হাজার পেরিয়া ক্রিশ্চান হয়ে যাচ্ছে। মনে করিসনি কেবল পেটের দায়ে ক্রিশ্চান হয়, আমাদের সহানুভূতি পায় না বলে। আমরা দিনরাত কেবল তাদের বলছি—‘ছুঁসনে ছুঁসনে।’ দেশে কি আর দয়াধর্ম আছে রে বাপ! কেবল ছুঁৎমার্গীর দল! অমন আচারের মুখে মার ঝাঁটা, মার লাথি! ইচ্ছা হয়, তোর ছুঁৎমার্গের গণ্ডী ভেঙে ফেলে এখনি যাই—‘কে কোথায় পতিত-কাঙাল দীন-দরিদ্র আছিস’ বলে তাদের সকলকে ঠাকুরের নামে ডেকে নিয়ে আসি। এরা না উঠলে মা জাগবেন না। আমরা এদের অন্নবস্ত্রের সুবিধা যদি না করতে পারলুম, তবে আর কি হল?হায়! এরা দুনিয়াদারি কিছু জানে না, তাই দিনরাত খেটেও অশন-বসনের সংস্থান করতে পারছে না। দে—সকলে মিলে এদের চোখ খুলে। আমি দিব্য চোখে দেখছি, এদের ও আমার ভেতর একই ব্রহ্ম—একই শক্তি রয়েছেন, কেবল বিকাশের তারতম্য মাত্র। সর্বাঙ্গে রক্তসঞ্চার না হলে কোন দেশ কোন কালে কোথাও উঠেছে দেখেছিস? একটা অঙ্গ পড়ে গেলে, অন্য অঙ্গ সবল থাকলেও ঐ দেহ নিয়ে কোন বড় কাজ আর হবে না—এ নিশ্চয় জানবি।

শিষ্য॥ মহাশয়, এ দেশের লোকের ভিতর এত বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন ভাব। ইহাদের ভিতর সকলের মিল হওয়া যে বড় কঠিন ব্যাপার।

স্বামীজী॥ (সক্রোধে) কোন কাজ কঠিন বলে মনে করলে হেথায় আর আসিসনি। ঠাকুরের ইচ্ছায় সব দিক্‌ সোজা হয়ে যায়। তোর কাজ হচ্ছে দীনদুঃখীর সেবা করা জাতিবর্ণ নির্বিশেষে। তার ফল কি হবে না হবে, ভেবে তোর দরকার কি? তোর কাজ হচ্ছে কাজ করে যাওয়া, পরে সব আপনা-আপনি হয়ে যাবে। আমার কাজের ধারা হচ্ছে—গড়ে তোলা, যা আছে সেটাকে ভাঙা নয়। জগতের ইতিহাস পড়ে দেখ, এক একজন মহাপুরুষ এক-একটা সময়ে এক-একটা দেশে যেন কেন্দ্রস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের ভাবে অভিভূত হয়ে শতসহস্র লোক জগতের হিতসাধন করে গেছে। তোরা সব বুদ্ধিমান্ ছেলে, হেথায় এত দিন আসছিস। কি করলি বল দিকি? পরার্থে একটা জন্ম দিতে পারলিনি? আবার জন্মে এসে তখন বেদান্ত-ফেদান্ত পড়বি। এবার পরসেবায় দেহটা দিয়ে যা, তবে জানব—আমার কাছে আসা সার্থক হয়েছে।

কথাগুলি বলিয়া স্বামীজী এলোথেলোভাবে বসিয়া তামাক খাইতে খাইতে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকিলেন। কিছুক্ষণ বাদে বলিলেনঃ

আমি এত তপস্যা করে এই সার বুঝেছি যে, জীবে জীবে তিনি অধিষ্ঠান হয়ে আছেন; তা ছাড়া ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছুই আর নেই।—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’

বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিল। স্বামীজী দোতলায় উঠিলেন এবং বিছানায় শুইয়া শিষ্যকে বলিলেন, ‘পা দুটো একটু টিপে দে।’ শিষ্য অদ্যকার কথাবার্তায় ভীত ও স্তম্ভিত হইয়া স্বয়ং অগ্রসর হইতে পারিতেছিল না, এখন সাহস পাইয়া প্রফুল্লমনে স্বামীজীর পদসেবা করিতে বসিল। কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘আজ যা বলেছি, সে-সব কথা মনে গেঁথে রাখবি। ভুলিসনি যেন।’

৪২

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—১৯০২

 

আজ শনিবার। সন্ধ্যায় প্রাক্কালে শিষ্য মঠে আসিয়াছে। মঠে এখন সাধন-ভজন জপ-তপস্যার খুব ঘটা। স্বামীজী আদেশ করিয়াছেন—কি ব্রহ্মচারী, কি সন্ন্যাসী সকলকেই অতি প্রত্যুষে উঠিয়া ঠাকুরঘরে জপ-ধ্যান করিতে হইবে। স্বামীজীর নিদ্রা একপ্রকার নাই বলিলেই চলে, রাত্রি তিনটা হইতে শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসিয়া থাকেন। একটা ঘণ্টা কেনা হইয়াছে; শেষরাত্রে সকলের ঘুম ভাঙাইতে ঐ ঘণ্টা মঠের প্রতি ঘরের নিকট সজোরে বাজান হয়।

শিষ্য মঠে আসিয়া স্বামীজীকে প্রণাম করিবামাত্র তিনি বলিলেনঃ

ওরে, মঠে এখন কেমন সাধন-ভজন হচ্ছে! সকলেই শেষরাত্রে ও সন্ধ্যার সময় অনেকক্ষণ ধরে জপধ্যান করে। ঐ দেখ, ঘণ্টা আনা হয়েছে; ঐ দিয়ে সবার ঘুম ভাঙান হয়। সকলকেই অরুণোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ঠাকুর বলতেন, ‘সকাল-সন্ধ্যায় মন খুব সত্ত্বভাবাপন্ন থাকে, তখনই একমনে ধ্যান করতে হয়।’

ঠাকুরের দেহ যাবার পর আমরা বরানগরের মঠে কত জপ ধ্যান করতুম। তিনটার সময় সব সজাগ হতুম। শৌচান্তে কেউ চান করে, কেউ না করে ঠাকুরঘরে গিয়ে বসে জপধ্যানে ডুবে যেতুম। তখন আমাদের ভেতর কি বৈরাগ্যের ভাব! দুনিয়াটা আছে কি নেই, তার হুঁশই ছিল না। শশী৮১ চব্বিশ ঘণ্টা ঠাকুরের সেবা নিয়েই থাকত এবং বাড়ীর গিন্নীর মত ছিল। ভিক্ষাশিক্ষা করে ঠাকুরের ভোগরাগের ও আমাদের খাওয়ান-দাওয়ানর যোগাড় ওই সব করত। এমন দিনও গেছে, যখন সকাল থেকে বেলা ৪।৫টা পর্যন্ত জপ-ধ্যান চলেছে। শশী খাবার নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে শেষে কোনরূপে টেনে-হিঁচড়ে আমাদের জপধ্যান থেকে তুলে দিত। আহা! শশীর কি নিষ্ঠাই দেখেছি!

শিষ্য॥ মহাশয়, মঠের খরচ তখন কি করিয়া চলিত? স্বামীজী॥ কি করে চলবে কিরে? আমরা তো সাধু-সন্ন্যাসী লোক। ভিক্ষাশিক্ষা করে যা আসত, তাতেই সব চলে যেত। আজ সুরেশবাবু বলরামবাবু নেই; তাঁরা দুজনে থাকলে এই মঠ দেখে কত আনন্দ করতেন! সুরেশবাবুর নাম শুনেছিস তো? তিনি এই মঠের এক- রকম প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই বরানগরের মঠের সব খরচপত্র বহন করতেন। ঐ সুরেশ মিত্তিরই আমাদের জন্য তখন বেশী ভাবতেন। তাঁর ভক্তিবিশ্বাসের তুলনা হয় না।

শিষ্য॥ মহাশয়, শুনিয়াছি—মৃত্যুকালে আপনারা তাঁহার সহিত বড় একটা দেখা করিতে যাইতেন না।

স্বামীজী॥ যেতে দিলে তো যাব। যাক, সে অনেক কথা। তবে এইটে জেনে রাখবি, সংসারে তুই বাঁচিস কি মরিস, তাতে তোর আত্মীয়-পরিজনদের বড় একটা কিছু আসে যায় না। তুই যদি কিছু বিষয়-আশয় রেখে যেতে পারিস তো তোর মরবার আগেই দেখতে পাবি, তা নিয়ে ঘরে লাঠালাঠি শুরু হয়েছে। তোর মৃত্যুশয্যায় সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই—স্ত্রী-পুত্র পর্যন্ত নয়। এরই নাম সংসার!

মঠের পূর্বাবস্থা সম্বন্ধে স্বামীজী আবার বলিতে লাগিলেনঃ

খরচপত্রের অনটনের জন্য কখনও কখনও মঠ তুলে দিতে লাঠালাঠি করতুম। শশীকে কিন্তু কিছুতেই ঐ বিষয়ে রাজী করাতে পারতুম না। শশীকে আমাদের মঠে central figure (কেন্দ্রস্বরূপ) বলে জানবি। এক একদিন মঠে এমন অভাব হয়েছে যে, কিছুই নেই। ভিক্ষা করে চাল আনা হল তো নুন নেই। এক একদিন শুধু নুন-ভাত চলেছে, তবু কারও ভ্রূক্ষেপ নেই; জপ-ধ্যানের প্রবল তোড়ে আমরা তখন সব ভাসছি। তেলাকুচোপাতা সেদ্ধ, নুন-ভাত—এই মাসাবধি! আহা, সে-সব কি দিনই গেছে! সে কঠোরতা দেখলে ভূত পালিয়ে যেত—মানুষের কথা কি! এ কথা কিন্তু ধ্রুব সত্য যে, তোর ভেতরে যদি বস্তু থাকে তো যত circumstances against (অবস্থা প্রতিকূল) হবে, তত ভেতরের শক্তির উন্মেষ হবে। তবে এখন যে মঠে খাট-বিছানা, খাওয়া-দাওয়ার সচ্ছল বন্দোবস্ত করেছি তার কারণ—আমরা যতটা সইতে পেরেছি, তত কি আর এখন যারা সন্ন্যাসী হতে আসছে তারা পারবে? আমরা ঠাকুরের জীবন দেখেছি, তাই দুঃখ-কষ্ট বড় একটা গ্রাহ্যের ভেতর আনতুম না। এখনকার ছেলেরা তত কঠোর করতে পারবে না। তাই একটু থাকবার জায়গা ও একমুঠো অন্নের বন্দোবস্ত করা—মোটা ভাত মোটা কাপড় পেলে ছেলেগুলো সাধন-ভজনে মন দেবে এবং জীবহিতকল্পে জীবনপাত করতে শিখবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, মঠের এ-সব খাটবিছানা দেখিয়া বাহিরের লোকে কত কি বলে! স্বামীজী॥ বলতে দে না। ঠাট্টা করেও তো এখানকার কথা একবার মনে আনবে! শত্রুভাবে শীগগীর মুক্তি হয়। ঠাকুর বলতেন, ‘লোক না পোক’। এ কি বললে, ও কি বললে—তাই শুনে বুঝি চলতে হবে? ছিঃ ছিঃ!

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনি কখনও বলেন, ‘সব নারায়ণ, দীন-দুঃখী আমার নারায়ণ’ আবার কখনও বলেন, ‘লোক না পোক’— ইহার অর্থ বুঝিতে পারি না। স্বামীজী॥ সকলেই যে নারায়ণ, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু সকল নারায়ণের তো criticize (সমালোচনা) করে না? কই, দীন-দুঃখীরা এসে মঠের খাট-ফাট দেখে তো criticize (সমালোচনা) করে না। সৎকার্য করে যাব, যারা criticize (সমালোচনা) করবে তাদের দিকে দৃকপাতও করব না—এই sense-এ (অর্থে) ‘লোক না পোক’ কথা বলা হয়েছে। যার ঐরূপ রোক আছে, তার সব হয়ে যায়, তবে কারও কারও বা একটু দেরীতে—এই যা তফাত; কিন্তু হবেই হবে। আমাদের ঐরূপ রোক (জিদ) ছিল, তাই একটু-আধটু যা হয় হয়েছে। নতুবা কি সব দুঃখের দিনই না আমাদের গেছে! এক সময়ে না খেতে পেয়ে রাস্তার ধারে একটা বাড়ীর দাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম, মাথার ওপর দিয়ে এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেল, তবে হুঁশ হয়েছিল! অন্য এক সময়ে সারাদিন না খেয়ে কলিকাতায় একাজ সেকাজ করে বেড়িয়ে রাত্রি ১০।১১টার সময় মঠে গিয়ে তবে খেতে পেয়েছি—এমন এক দিন নয়! কথাগুলি বলিয়া স্বামীজী অন্যমনা হইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। পরে আবার বলিতে লাগিলেনঃ

ঠিক ঠিক সন্ন্যাস কি সহজে হয় রে? এমন কঠিন আশ্রম আর নেই। একটু বেচাল পা পড়লে তো একেবারে পাহাড় থেকে খদে পড়ল—হাত-পা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একদিন আমি আগ্রা থেকে বৃন্দাবন হেঁটে যাচ্ছি। একটা কানাকড়িও সম্বল নেই। বৃন্দাবনের প্রায় ক্রোশাধিক দূরে আছি, রাস্তার ধারে একজন লোক বসে তামাক খাচ্ছে দেখে বড়ই তামাক খেতে ইচ্ছে হল। লোকটাকে বললুম, ‘ওরে ছিলিমটে দিবি?’ সে যেন জড়সড় হয়ে বললে, ‘মহারাজ, হাম্ ভাঙ্গি (মেথর) হ্যায়।’ সংস্কার কিনা!—শুনেই পেছিয়ে এসে তামাক না খেয়ে পুনরায় পথ চলতে লাগলুম। খানিকটা গিয়েই মনে বিচার এল—তাইতো, সন্ন্যাস নিয়েছি; জাত কুল মান—সব ছেড়েছি, তবুও লোকটা মেথর বলাতে পেছিয়ে এলুম! তার ছোঁয়া তামাক খেতে পারলুম না! এই ভেবে প্রাণ অস্থির হয়ে উঠল। তখন প্রায় এক পো পথ এসেছি, আবার ফিরে গিয়ে সেই মেথরের কাছে এলুম; দেখি তখনও লোকটা সেখানে বসে আছে। গিয়ে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘ওরে বাপ, এক ছিলিম তামাক সেজে নিয়ে আয়।’ তার আপত্তি গ্রাহ্য করলুম না। বললুম, ছিলিমে তামাক দিতেই হবে। লোকটা কি করে?—অবশেষে তামাক সেজে দিল। তখন আনন্দে ধূমপান করে বৃন্দাবনে এলুম। সন্ন্যাস নিয়ে জাতিবর্ণের পারে চলে গেছি কিনা—পরীক্ষা করে আপনাকে দেখতে হয়। ঠিক ঠিক সন্ন্যাস-ব্রত রক্ষা করা কঠিন! কথায় ও কাজে একচুল এদিক-ওদিক হবার যো নেই।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনি কখনও গৃহীর আদর্শ এবং কখনও ত্যাগীর আদর্শ আমাদিগের সম্মুখে ধারণ করেন; উহার কোন্‌টি আমাদিগের মত লোকের অবলম্বনীয়? স্বামীজী॥ সব শুনে যাবি; তারপর যেটা ভাল লাগে, সেটা ধরে থাকবি—bulldog-এর (ডালকুত্তার) মত কামড়ে ধরে পড়ে থাকবি।

বলিতে বলিতে, শিষ্যসহ স্বামীজী নীচে নামিয়া আসিলেন এবং কখনও মধ্যে মধ্যে ‘শিব শিব’ বলিতে বলিতে, আবার কখনও বা গুনগুন করিয়া ‘কখন কি রঙ্গে থাক মা, শ্যামা সুধাতরঙ্গিণী’ ইত্যাদি গান করিতে করিতে পদচারণা করিতে লাগিলেন।

 

৪৩

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—১৯০২

 

শিষ্য গত রাত্রে স্বামীজীর ঘরেই ঘুমাইয়াছে। রাত্রি ৪টার সময় স্বামীজী শিষ্যকে জাগাইয়া বলিলেন, ‘যা, ঘণ্টা নিয়ে সব সাধু-ব্রহ্মচারীদের জাগিয়ে তোল।’ আদেশমত শিষ্য প্রথমতঃ উপরকার সাধুদের কাছে ঘণ্টা বাজাইল। পরে তাঁহারা সজাগ হইয়াছেন দেখিয়া নীচে যাইয়া ঘণ্টা বাজাইয়া সব সাধু-ব্রহ্মচারীদের তুলিল। সাধুরা তাড়াতাড়ি শৌচাদি সারিয়া, কেহ বা স্নান করিয়া, কেহ কাপড় ছাড়িয়া ঠাকুর-ঘরে জপধ্যান করিতে প্রবেশ করিলেন।

স্বামীজীর নির্দেশমত স্বামী ব্রহ্মানন্দের কানের কাছে খুব জোরে জোরে ঘণ্টা-বাজানয় তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘বাঙালের জ্বালায় মঠে থাকা দায় হল।’ শিষ্যমুখে ঐ কথা শুনিয়া স্বামীজী খুব হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘বেশ করেছিস।’

অতঃপর স্বামীজীও হাতমুখ ধুইয়া শিষ্যসহ ঠাকুর-ঘরে প্রবেশ করিলেন।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ-প্রমুখ সন্ন্যাসিগণ ঠাকুর-ঘরে ধ্যানে বসিয়াছেন। স্বামীজীর জন্য পৃথক্‌ আসন রাখা ছিল; তিনি তাহাতে উত্তরাস্যে উপবেশন করিয়া শিষ্যকে একখানি আসন দেখাইয়া বলিলেন, ‘যা, ঐ আসনে বসে ধ্যান কর।’ মঠের বায়ুমণ্ডল যেন স্তব্ধ হইয়া গেল! এখনও অরুণোদয় হয় নাই, আকাশে তারা জ্বলিতেছে।

স্বামীজী আসনে বসিবার অল্পক্ষণ পরেই একেবারে স্থির শান্ত নিষ্পন্দ হইয়া সুমেরুবৎ অচলভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং তাঁহার শ্বাস অতি ধীরে ধীরে বহিতে লাগিল। শিষ্য স্তম্ভিত হইয়া স্বামীজীর সেই নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় অবস্থান নির্নিমেষে দেখিতে লাগিল।

প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে স্বামীজী ‘শিব শিব’ বলিয়া ধ্যানোত্থিত হইলেন। তাঁহার চক্ষু তখন অরুণরাগে রঞ্জিত, মুখ গম্ভীর, শান্ত, স্থির। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া স্বামীজী নীচে নামিলেন এবং মঠপ্রাঙ্গণে পদচারণা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে শিষ্যকে বলিলেনঃ

দেখলি, সাধুরা আজকাল কেমন জপ-ধ্যান করে! ধ্যান গভীর হলে কত কি দেখতে পাওয়া যায়! বরানগরের মঠে ধ্যান করতে করতে একদিন ঈড়া পিঙ্গলা নাড়ী দেখতে পেয়েছিলুম। একটু চেষ্টা করলেই দেখতে পাওয়া যায়। তারপর সুষুম্নার দর্শন পেলে যা দেখতে চাইবি, তাই দেখতে পাওয়া যায়। দৃঢ় গুরুভক্তি থাকলে সাধন-ভজন ধ্যান-জপ সব আপনা-আপনি আসে, চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। ‘গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুগুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।’

অনন্তর শিষ্য তামাক সাজিয়া স্বামীজীর কাছে পুনরায় আসিলে তিনি ধূমপান করিতে করিতে বলিলেনঃ ভেতরে নিত্য শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মারূপ সিঙ্গি (সিংহ) রয়েছেন, ধ্যান-ধারণা করে তাঁর দর্শন পেলেই মায়ার দুনিয়া উড়ে যায়। সকলের ভেতরেই তিনি সমভাবে আছেন; যে যত সাধনভজন করে, তার ভেতর কুণ্ডলিনী শক্তি তত শীঘ্র জেগে ওঠেন। ঐ শক্তি মস্তকে উঠলেই দৃষ্টি খুলে যায়—আত্মদর্শন লাভ হয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, শাস্ত্রে ঐ-সব কথা পড়িয়াছি মাত্র। প্রত্যক্ষ কিছুই তো এখনও হইল না। স্বামীজী॥ ‘কালেনাত্মনি বিন্দতি’—সময়ে হতেই হবে। তবে কারও শীগগীর, কারও বা একটু দেরীতে হয়। লেগে থাকতে হয়—নাছোড়বান্দা হয়ে। এর নাম যথার্থ পুরুষকার। তৈলধারার মত মনটা এক বিষয়ে লাগিয়ে রাখতে হয়। জীবের মন নানা বিষয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, ধ্যানের সময়ও প্রথম প্রথম মন বিক্ষিপ্ত হয়। মনে যা ইচ্ছে উঠুক না কেন, কি কি ভাব উঠছে—সেগুলি তখন স্থির হয়ে বসে দেখতে হয়। ঐভাবে দেখতে দেখতেই মন স্থির হয়ে যায়, আর মনে নানা চিন্তাতরঙ্গ থাকে না। ঐ তরঙ্গগুলোই হচ্ছে মনের সঙ্কল্পবৃত্তি। ইতঃপূর্বে যে-সকল বিষয় তীব্রভাবে ভেবেছিস, তার একটা মানসিক প্রবাহ থাকে, ধ্যানকালে ঐগুলি তাই মনে ওঠে। সাধকের মন যে ক্রমে স্থির হবার দিকে যাচ্ছে, ঐগুলি ওঠা বা ধ্যানকালে মনে পড়াই তার প্রমাণ। মন কখনও কখনও কোন ভাব নিয়ে একবৃত্তিস্থ হয়—তারই নাম সবিকল্প ধ্যান। আর মন যখন সর্ববৃত্তিশূন্য হয়ে আসে, তখন নিরাধার এক অখণ্ড বোধস্বরূপ প্রত্যক্‌চৈতন্যে গলে যায়, তার নামই বৃত্তিশূন্য নির্বিকল্প সমাধি। আমরা ঠাকুরের মধ্যে এ উভয় সমাধি মুহুর্মুহুঃ প্রত্যক্ষ করেছি। চেষ্টা করে তাঁকে ঐ-সকল অবস্থা আনতে হত না। আপনা-আপনি সহসা হয়ে যেত। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! তাঁকে দেখেই তো এ-সব ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলুম। প্রত্যহ একাকী ধ্যান করবি। সব আপনা-আপনি খুলে যাবে। বিদ্যারূপিণী মহামায়া ভেতরে ঘুমিয়ে রয়েছেন, তাই সব জানতে পাচ্ছিস না। ঐ কুলকুণ্ডলিনীই হচ্ছেন তিনি। ধ্যান করবার পূর্বে যখন নাড়ী শুদ্ধ করবি, তখন মনে মনে মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনীকে জোরে জোরে আঘাত করবি আর বলবি, ‘জাগো মা, জাগো মা।’ ধীরে ধীরে এ-সব অভ্যাস করতে হয়। Emotional side-টা (ভাবপ্রবণতা) ধ্যানের কালে একেবারে দাবিয়ে দিবি। ঐটেই বড় ভয়। যারা বড় emotional (ভাবপ্রবণ), তাদের কুণ্ডলিনী ফড়ফড় করে ওপরে ওঠে বটে, কিন্তু উঠতেও যতক্ষণ নাবতেও ততক্ষণ। যখন নাবেন, তখন একেবারে সাধককে অধঃপাতে নিয়ে গিয়ে ছাড়েন। এজন্য ভাবসাধনার সহায় কীর্তন-ফীর্তনের একটা ভয়ানক দোষ আছে। নেচেকুঁদে সাময়িক উচ্ছ্বাসে ঐ শক্তির ঊর্ধ্বগতি হয় বটে, কিন্তু স্থায়ী হয় না, নিম্নগামিনী হবার কালে জীবের ভয়ানক কামবৃত্তির আধিক্য হয়। আমার আমেরিকায় বক্তৃতা শুনে সাময়িক উচ্ছ্বাসে অনেকের ভাব হত—কেউ বা জড়বৎ হয়ে যেত। অনুসন্ধানে পরে জানতে পেরেছিলাম, ঐ অবস্থার পরই অনেকের কাম-প্রবৃত্তির আধিক্য হত। ঠিকঠিক ধ্যানধারণার অনভ্যাসেই ওরূপ হয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, এ-সকল গুহ্য সাধন-রহস্য কোন শাস্ত্রে পড়ি নাই। আজ নূতন কথা শুনিলাম। স্বামীজী॥ সব সাধন-রহস্য কি আর শাস্ত্রে আছে? এগুলি গুরু-শিষ্য-পরম্পরায় চলে আসছে। খুব সাবধানে ধ্যানধারণা করবি। সামনে সুগন্ধি ফুল রাখবি, ধুনা জ্বালবি। যাতে মন পবিত্র হয়, প্রথমতঃ তাই করবি। গুরু-ইষ্টের নাম করতে করতে বলবিঃ জীব-জগৎ সকলের মঙ্গল হোক। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম অধঃ ঊর্ধ্ব—সব দিকেই শুভ সঙ্কল্পের চিন্তা ছড়িয়ে তবে ধ্যানে বসবি। এইরূপ প্রথম প্রথম করতে হয়। তারপর স্থির হয়ে বসে—যে-কোন মুখে বসলেই হল—মন্ত্র দেবার কালে যেমনটা বলেছি, সেইরূপ ধ্যান করবি। একদিনও বাদ দিবিনি। কাজের ঝঞ্ঝাট থাকে তো অন্ততঃ পনর মিনিটে সেরে নিবি। একটা নিষ্ঠা না থাকলে কি হয়রে বাপ?

এইবার স্বামীজী উপরে যাইতে যাইতে বলিতে লাগিলেনঃ

তোদের অল্পেই আত্মদৃষ্টি খুলে যাবে। যখন হেথায় এসে পড়েছিস, তখন মুক্তি-ফুক্তি তো তোদের করতলে। এখন ধ্যানাদি করা ছাড়া আর্তনাদ-পূর্ণ সংসারের দুঃখও কিছু দূর করতে বদ্ধপরিকর হয়ে লেগে যা দেখি। কঠোর সাধনা করে এ দেহ পাত করে ফেলেছি। এই হাড়মাসের খাঁচায় আর যেন কিছু নেই। তোরা এখন কাজে লেগে যা, আমি একটু জিরুই। আর কিছু না পারিস, এইসব যত শাস্ত্র-ফাস্ত্র পড়লি, এর কথা জীবকে শোনাগে। এর চেয়ে আর দান নেই। জ্ঞান-দানই সর্বশ্রেষ্ঠ দান।

৪৪

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—১৯০২

 

স্বামীজী মঠেই অবস্থান করিতেছেন। শাস্ত্রালোচনার জন্য মঠে প্রতিদিন প্রশ্নোত্তর-ক্লাস হইতেছে। স্বামী শুদ্ধানন্দ, বিরজানন্দ ও স্বরূপানন্দ এই ক্লাসে প্রধান জিজ্ঞাসু। এরূপ শাস্ত্রালোচনাকে স্বামীজী ‘চর্চা’ শব্দে নির্দেশ করিতেন এবং চর্চা করিতে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণকে সর্বদা বহুধা উৎসাহিত করিতেন। কোন দিন গীতা, কোন দিন ভাগবত, কোন দিন বা উপনিষদ্‌ ও ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের আলোচনা হইতেছে। স্বামীজীও প্রায় নিত্যই তথায় উপস্থিত থাকিয়া প্রশ্নগুলির মীমাংসা করিয়া দিতেছেন। স্বামীজীর আদেশে একদিকে যেমন কঠোর নিয়মপূর্বক ধ্যান-ধারণা চলিয়াছে, অপরদিকে তেমনি শাস্ত্রালোচনার জন্য ঐ ক্লাসের প্রাত্যহিক অধিবেশন হইতেছে। তাঁহার শাসন সর্বদা শিরোধার্য করিয়া সকলেই তৎপ্রবর্তিত নিয়ম অনুসরণ করিয়া চলিতেন। মঠবাসিগণের আহার, শয়ন, পাঠ, ধ্যান—সকলই এখন কঠোর-নিয়মবদ্ধ।

আজ শনিবার। স্বামীজীকে প্রণাম করিয়া উপবেশন করিবামাত্র শিষ্য জানিতে পারিল, তিনি তখনই বেড়াইতে বাহির হইবেন, স্বামী প্রেমানন্দকে সঙ্গে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিয়াছেন। শিষ্যের একান্ত বাসনা—স্বামীজীর সঙ্গে যায়, কিন্তু অনুমতি না পাইলে যাওয়া কর্তব্য নহে—ভাবিয়া বসিয়া রহিল। স্বামীজী আলখাল্লা ও গৈরিক বসনের কান-ঢাকা টুপী পরিয়া একগাছি মোটা লাঠি হাতে করিয়া বাহির হইলেন—পশ্চাতে স্বামী প্রেমানন্দ। যাইবার পূর্বে শিষ্যের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘চল যাবি?’ শিষ্য কৃতকৃতার্থ হইয়া স্বামী প্রেমানন্দের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।

কি ভাবিতে ভাবিতে স্বামীজী অন্যমনে পথ চলিতে লাগিলেন। ক্রমে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শিষ্য স্বামীজীর ঐরূপ ভাব দেখিয়া কথা কহিয়া তাঁহার চিন্তা ভঙ্গ করিতে সাহসী না হইয়া প্রেমানন্দ মহারাজের সহিত নানা গল্প করিতে করিতে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, স্বামীজীর মহত্ত্ব সম্বন্ধে ঠাকুর আপনাদের কি বলিতেন, তাহাই বলুন।’ স্বামীজী তখন কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তী হইয়াছেন।

স্বামী প্রেমানন্দ॥ কত কি বলতেন তা তোকে একদিনে কি বলব? কখনও বলিতেন, ‘নরেন অখণ্ডের ঘর থেকে এসেছে।’ কখনও বলতেন, ‘ও আমার শ্বশুরঘর।’ আবার কখনও বলতেন, ‘এমনটি জগতে কখনও আসেনি—আসবে না।’ একদিন বলেছিলেন, ‘মহামায়া ওর কাছে যেতে ভয় পায়!’ বাস্তবিকই উনি তখন কোন ঠাকুরদেবতার কাছে মাথা নোয়াতেন না। ঠাকুর একদিন সন্দেশের ভেতর করে ওঁকে জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ খাইয়ে দিয়েছিলেন। পরে ঠাকুরের কৃপায় সব দেখে শুনে ক্রমে উনি সব মানলেন।

শিষ্য॥ মহাশয়, বাস্তবিকই কখনও কখনও মনে হয়, উনি মানুষ নহেন। কিন্তু আবার কথাবার্তা বলিবার এবং যুক্তি-বিচার করিবার কালে মানুষ বলিয়া বোধ হয়। এমনি মনে হয় যেন কোন আবরণ দিয়া সে সময় উনি আপনার যথার্থ স্বরূপ বুঝিতে দেন না!

প্রেমানন্দ॥ ঠাকুর বলতেন, ‘ও যখনি জানতে পারবে—ও কে, তখনি আর এখানে থাকবে না, চলে যাবে।’ তাই কাজকর্মের ভেতরে নরেনের মনটা থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকি। ওকে বেশী ধ্যানধারণা করতে দেখলে আমাদের ভয় হয়।

এইবার স্বামীজী মঠাভিমুখে প্রত্যাবৃত্ত হইতে লাগিলেন। ঐ-সময়ে স্বামী প্রেমানন্দ ও শিষ্যকে নিকটে দেখিয়া তিনি বলিলেন, ‘কিরে, তোদের কি কথা হচ্ছিল?’ শিষ্য বলিল, ‘এই ঠাকুরের সম্বন্ধে নানা কথা হইতেছিল।’ উত্তর শুনিয়াই স্বামীজী আবার অন্যমনে পথ চলিতে চলিতে মঠে ফিরিয়া আসিলেন এবং মঠের আমগাছের তলায় যে ক্যাম্পখাটখানি তাঁহার বসিবার জন্য পাতা ছিল, তাহাতে উপবেশন করিলেন এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিবার পরে মুখ ধুইয়া উপরের বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে শিষ্যকে বলিতে লাগিলেনঃ

তোদের দেশে বেদান্তবাদ প্রচার করতে লেগে যা না কেন? ওখানে ভয়ানক তন্ত্রমন্ত্রের প্রাদুর্ভাব। অদ্বৈতবাদের সিংহনাদে বাঙাল-দেশটা তোলপাড় করে তোল দেখি, তবে জানব—তুই বেদান্তবাদী। ওদেশে প্রথম একটা বেদান্তের টোল খুলে দে—তাতে উপনিষদ্‌, ব্রহ্মসূত্র এই সব পড়া। ছেলেদের ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দে। আর বিচার করে তান্ত্রিক পণ্ডিতদের হারিয়ে দে। শুনেছি, তোদের দেশে লোকে কেবল ন্যায়শাস্ত্রের কচকচি পড়ে। ওতে আছে কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান আর অনুমান—এই নিয়েই হয়তো নৈয়ায়িক পণ্ডিতদের মাসাবধি বিচার চলেছে! আত্মজ্ঞানলাভের তাতে আর কি বিশেষ সহায়তা হয় বল? বেদান্ত-সিদ্ধান্ত ব্রহ্মতত্ত্বের পঠন-পাঠন না হলে কি আর দেশের উপায় আছে রে? তোদের দেশেই হোক বা নাগ-মহাশয়ের বাড়ীতেই হোক একটা চতুষ্পাঠী খুলে দে। তাতে এইসব সৎশাস্ত্র-পাঠ হবে, আর ঠাকুরের জীবন আলোচনা হবে। ঐরূপ করলে তোর নিজের কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে কত লোকের কল্যাণ হবে। তোর কীর্তিও থাকবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, আমি নামযশের আকাঙ্ক্ষা রাখি না। তবে আপনি যেমন বলিতেছেন, সময়ে সময়ে আমারও ঐরূপ ইচ্ছা হয় বটে। কিন্তু বিবাহ করিয়া সংসারে এমন জড়াইয়া পড়িয়াছি যে, মনের কথা বোধ হয় মনেই থাকিয়া যাইবে।

স্বামীজী॥ বে করেছিস তো কি হয়েছে? মা-বাপ ভাই-বোনকে অন্নবস্ত্র দিয়ে যেমন পালন করছিস, স্ত্রীকেও তেমনি করবি, বস্। ধর্মোপদেশ দিয়ে তাকেও তোর পথে টেনে নিবি। মহামায়ার বিভূতি বলে সম্মানের চক্ষে দেখবি। ধর্ম-উদযাপনে ‘সহধর্মিণী’ বলে মনে করবি। অন্য সময়ে অপর দশ জনের মত দেখবি। এইরূপ ভাবতে ভাবতে দেখবি মনের চঞ্চলতা একাবারে মরে যাবে। ভয় কি?

স্বামীজীর অভয়বাণী শুনিয়া শিষ্য আশ্বস্ত হইল।

আহারান্তে স্বামীজী নিজের বিছানায় উপবেশন করিলেন। অপর সকলের প্রসাদ পাইবার তখনও সময় হয় নাই। সেজন্য শিষ্য স্বামীজীর পদসেবা করিবার অবসর পাইল। স্বামীজীও তাহাকে মঠের সকলের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইবার জন্য কথাচ্ছলে বলিতে লাগিলেন, ‘এই সব ঠাকুরের সন্তান দেখছিস, এরা সব অদ্ভুত ত্যাগী, এদের সেবা করে লোকের চিত্তশুদ্ধি হবে—আত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ হবে।’ পরিপ্রশ্নেন সেবয়া’—গীতার উক্তি শুনেছিস তো? এদের সেবা করবি, তা হলেই সব হয়ে যাবে। তোকে এরা কত স্নেহ করে, জানিস তো?’

শিষ্য॥ মহাশয়, ইঁহাদের কিন্তু বুঝা বড়ই কঠিন বলিয়া মনে হয়। এক একজনের এক এক ভাব!

স্বামীজী॥ ঠাকুর ওস্তাদ মালী ছিলেন কিনা! তাই হরেক রকম ফুল দিয়ে এই সঙ্ঘরূপ তোড়াটি বানিয়ে গেছেন। যেখানকার যেটি ভাল, সব এতে এসে পড়েছে—কালে আরও কত আসবে। ঠাকুর বলতেন, ‘যে একদিনের জন্যও অকপট মনে ঈশ্বরকে ডেকেছে, তাকে এখানে আসতেই হবে।’ যারা সব এখানে রয়েছে, তারা এক একজন মহাসিংহ; আমার কাছে কুঁচকে থাকে বলে এদের সামান্য মানুষ বলে মনে করিসনি। এরাই আবার যখন বার হবে, তখন এদের দেখে লোকের চৈতন্য হবে। অনন্ত-ভাবময় ঠাকুরের অংশ বলে এদের জানবি। আমি এদের ঐ-ভাবে দেখি। ঐ যে রাখাল রয়েছে, ওর মত spirituality (ধর্মভাব) আমারও নেই। ঠাকুর ছেলে বলে ওকে কোলে করতেন, খাওয়াতেন, একত্র শয়ন করতেন। ও আমাদের মঠের শোভা, আমাদের রাজা। ঐ বাবুরাম, হরি, সারদা, গঙ্গাধর, শরৎ, শশী, সুবোধ প্রভৃতির মত ঈশ্বরবিশ্বাসী দুনিয়া ঘুরে দেখতে পাবি কিনা সন্দেহ। এরা প্রত্যেকে ধর্ম-শক্তির এক একটা কেন্দ্রের মত। কালে ওদেরও সব শক্তির বিকাশ হবে।

শিষ্য অবাক হইয়া শুনিতে লাগিল; স্বামীজী আবার বলিলেন, ‘তোদের দেশ থেকে নাগ-মহাশয় ছাড়া কিন্তু আর কেউ এল না। আর দু-একজন যারা ঠাকুরকে দেখেছিল, তারা তাঁকে ধরতে পারলে না।’ নাগ-মহাশয়ের কথা স্মরণ করিয়া স্বামীজী কিছুক্ষণের জন্য স্থির হইয়া রহিলেন। স্বামীজী শুনিয়াছিলেন, এক সময়ে নাগ-মহাশয়ের বাড়ীতে গঙ্গার উৎস উঠিয়াছিল। সেই কথাটি স্মরণ করিয়া শিষ্যকে বলিলেন, ‘হ্যাঁরে, ঐ ঘটনাটা কিরূপ বল দিকি।’

শিষ্য॥ আমিও ঐ ঘটনা শুনিয়াছি মাত্র, চক্ষে দেখি নাই। শুনিয়াছি, একবার মহাবারুণীযোগে পিতাকে সঙ্গে করিয়া নাগ-মহাশয় কলিকাতা আসিবার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু লোকের ভিড়ে গাড়ী না পাইয়া তিন-চার দিন নারায়ণগঞ্জে থাকিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসেন। অগত্যা নাগ-মহাশয় কলিকাতা যাওয়ার সঙ্কল্প ত্যাগ করেন এবং পিতাকে বলেন, ‘মন শুদ্ধ হলে মা গঙ্গা এখানেই আসবেন।’ পরে যোগের সময় বাড়ীর উঠানের মাটি ভেদ করিয়া এক জলের উৎস উঠিয়াছিল—এইরূপ শুনিয়াছি। যাঁহারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহাদের অনেকে এখনও জীবিত আছেন। আমি তাঁহার সঙ্গলাভ করিবার বহু পূর্বে ঐ ঘটনা ঘটিয়াছিল।

স্বামীজী॥ তার আর আশ্চর্য কি? তিনি সিদ্ধসঙ্কল্প মহাপুরুষ; তাঁর জন্য ঐরূপ হওয়া আমি কিছু আশ্চর্য মনে করি না।

বলিতে বলিতে স্বামীজী পাশ ফিরিয়া শুইয়া একটু তন্দ্রাবিষ্ট হইলেন। শিষ্য প্রসাদ পাইতে উঠিয়া গেল।

 

৪৫

স্থান—কলিকাতা হইতে নৌকাযোগে মঠে
কাল—১৯০২

 

আজ বিকালে কলিকাতার গঙ্গাতীরে বেড়াইতে বেড়াইতে শিষ্য দেখিতে পাইল, কিছুদূরে একজন সন্ন্যাসী আহিরিটোলার ঘাটের দিকে অগ্রসর হইতেছেন। তিনি নিকটস্থ হইলে শিষ্য দেখিল, সাধু আর কেহ নন—তাহারই গুরু, স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজীর বামহস্তে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা; বালকের মত উহা খাইতে খাইতে তিনি আনন্দে পথে অগ্রসর হইতেছেন। শিষ্য তাঁহার চরণে প্রণত হইয়া তাঁহার হঠাৎ কলিকাতা-আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল।

স্বামীজী॥ একটা দরকারে এসেছিলুম। চল, তুই মঠে যাবি? চারটি চানাচুর ভাজা খা না, বেশ নুন-ঝাল আছে।

শিষ্য হাসিতে হাসিতে প্রসাদ গ্রহণ করিল এবং মঠে যাইতে স্বীকৃত হইল।

স্বামীজী॥ তবে একখানা নৌকা দেখ।

শিষ্য দৌড়িয়া নৌকা ভাড়া করিতে গেল। ভাড়া লইয়া মাঝিদের সহিত দরদস্তুর চলিতেছে, এমন সময় স্বামীজীও তথায় আসিয়া পড়িলেন। মাঝি মঠে পৌঁছাইয়া দিতে আট আনা চাহিল। শিষ্য দুই আনা বলিল। ‘ওদের সঙ্গে আবার কি দরদস্তুর করছিস?’ বলিয়া স্বামীজী শিষ্যকে নিরস্ত করিলেন এবং মাঝিকে ‘যা, আট আনাই দেব’ বলিয়া নৌকায় উঠিলেন। ভাটার প্রবল টানে নৌকা অতি ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং মঠে পৌঁছিতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগিল। নৌকামধ্যে স্বামীজীকে একা পাইয়া শিষ্য নিঃসঙ্কোচে সকল বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিবার বেশ সুযোগ লাভ করিল।

গত জন্মোৎসবের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তদিগের মহিমা কীর্তন করিয়া শিষ্য যে স্তব ছাপাইয়াছিল, তৎসম্বন্ধে প্রসঙ্গ উঠাইয়া স্বামীজী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুই তোর রচিত স্তবে যাদের যাদের নাম করেছিস, কি করে জানলি—তাঁরা সকলেই ঠাকুরের সাঙ্গোপাঙ্গ?’

শিষ্য॥ মহাশয়, ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তদিগের নিকট এতদিন যাতায়াত করিতেছি, তাঁহাদেরই মুখে শুনিয়াছি—ইঁহারা সকলেই ঠাকুরের ভক্ত।

স্বামীজী॥ ঠাকুরের ভক্ত হতে পারে, কিন্তু সকল ভক্তই তো তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গের ভেতর নয়?ঠাকুর কাশীপুরের বাগানে আমাদের বলেছিলেন, ‘মা দেখিয়ে দিলেন, এরা সকলেই এখানকার (আমার) অন্তরঙ্গ লোক নয়।’ স্ত্রী ও পুরুষ উভয় প্রকার ভক্তদের সম্বন্ধেও ঠাকুর সেদিন ঐরূপ বলেছিলেন।

অনন্তর ঠাকুর নিজ ভক্তদিগের মধ্যে যে ভাবে উচ্চাবচ শ্রেণী নির্দেশ করিতেন, সেই কথা বলিতে বলিতে স্বামীজী ক্রমে গৃহস্থ ও সন্ন্যাস-জীবনের মধ্যে যে কতদূর প্রভেদ বর্তমান, তাহাই শিষ্যকে বিশদরূপে বুঝাইয়া দিতে লাগিলেন।

স্বামীজী॥ কামিনী-কাঞ্চনের সেবাও করবে, আর ঠাকুরকেও বুঝবে—এ কি কখনও হয়েছে?—না হতে পারে? ও-কথা কখনও বিশ্বাস করবিনি। ঠাকুরের ভক্তদের ভেতর অনেকে এখন ‘ঈশ্বরকোটী’ ‘অন্তরঙ্গ’ ইত্যাদি বলে আপনাদের প্রচার করছে। তাঁর ত্যাগ-বৈরাগ্য কিছুই নিতে পারলে না, অথচ বলে কিনা তারা সব ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্ত। ও-সব কথা ঝেঁটিয়ে ফেলে দিবি। যিনি ত্যাগীর ‘বাদশা’, তাঁর কৃপা পেয়ে কি কেউ কখনও কাম-কাঞ্চনের সেবায় জীবনযাপন করতে পারে?

শিষ্য॥ তবে কি মহাশয়, যাঁহারা দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই ঠাকুরের ভক্ত নন?

স্বামীজী॥ তা কে বলছে? সকলেই ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করে spirituality (ধর্মানুভূতি)-র দিকে অগ্রসর হয়েছে, হচ্ছে ও হবে। তারা সকলেই ঠাকুরের ভক্ত। তবে কি জানিস, সকলেই কিন্তু তাঁর অন্তরঙ্গ নয়। ঠাকুর বলতেন, ‘অবতারের সঙ্গে কল্পান্তরের সিদ্ধ ঋষিরা দেহধারণ করে জগতে আগমন করেন। তাঁরাই ভগবানের সাক্ষাৎ পার্ষদ। তাঁদের দ্বারাই ভগবান্ কার্য করেন বা জগতের ধর্মভাব প্রচার করেন।’ এটা জেনে রাখবি—অবতারের সাঙ্গোপাঙ্গ একমাত্র তাঁরাই, যাঁরা পরার্থে সর্বত্যাগী, যাঁরা ভোগসুখ কাকবিষ্ঠার মত পরিত্যাগ করে ‘জগদ্ধিতায়’ ‘জীবহিতায়’ জীবনপাত করেন। ভগবান্ ঈশার শিষ্যেরা সকলেই সন্ন্যাসী। শঙ্কর, রামানুজ, শ্রীচৈতন্য ও বুদ্ধদেবের সাক্ষাৎ কৃপাপ্রাপ্ত সঙ্গীরা সকলেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। এই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরাই গুরুপরম্পরাক্রমে জগতে ব্রহ্মবিদ্যা প্রচার করে আসছেন। কোথায় কবে শুনেছিস—কামকাঞ্চনের দাস হয়ে থেকে মানুষ মানুষকে উদ্ধার করতে বা ঈশ্বরলাভের পথ দেখিয়ে দিতে পেরেছে? আপনি মুক্ত না হলে অপরকে কি করে মুক্ত করবে? বেদ-বেদান্ত ইতিহাস-পুরাণ সর্বত্র দেখতে পাবি—সন্ন্যাসীরাই সর্বকালে সর্বদেশে লোকগুরুরূপে ধর্মের উপদেষ্টা হয়েছেন। History repeats itself—‘যথা পূর্বং তথা পরম্’—এবারও তাই হবে। মহাসমন্বয়াচার্য ঠাকুরের কৃতী সন্ন্যাসী সন্তানগণই লোকগুরুরূপে জগতের সর্বত্র পূজিত হচ্ছে ও হবে। ত্যাগী ভিন্ন অন্যের কথা ফাঁকা আওয়াজের মত শূন্যে লীন হয়ে যাবে। মঠের যথার্থ ত্যাগী সন্ন্যাসিগণই ধর্মভাব-রক্ষা ও প্রচারের মহাকেন্দ্রস্বরূপ হবে। বুঝলি?

শিষ্য॥ তবে ঠাকুরের গৃহস্থ ভক্তেরা যে তাঁহার কথা নানাভাবে প্রচার করিতেছে, সে-সব কি সত্য নয়?

স্বামীজী॥ একেবারে সত্য নয়—বলা যায় না; তবে তারা ঠাকুরের সম্বন্ধে যা বলে, তা সব partial truth (আংশিক সত্য)। যে যেমন আধার, সে ঠাকুরের ততটুকু নিয়ে তাই আলোচনা করছে। ঐরূপ করাটা মন্দ নয়। তবে তাঁর ভক্তের মধ্যে এরূপ যদি কেহ বুঝে থাকেন যে, তিনি যা বুঝেছেন বা বলেছেন, তাই একমাত্র সত্য, তবে তিনি দয়ার পাত্র। ঠাকুরকে কেউ বলছেন—তান্ত্রিক কৌল, কেউ বলছেন—চৈতন্যদেব ‘নারদীয়া ভক্তি’ প্রচার করতে জন্মেছিলেন, কেউ বলছেন—সাধনভজন করাটা ঠাকুরের অবতারত্বে বিশ্বাসের বিরুদ্ধ, কেউ বলছেন—সন্ন্যাসী হওয়া ঠাকুরের অভিমত নয়, ইত্যাদি কত কথা গৃহী ভক্তদের মুখে শুনবি; ও-সব কথায় কান দিবিনি। তিনি যে কি, কত কত পূর্বগ-অবতারগণের জমাটবাঁধা ভাবরাজ্যের রাজা, তা জীবনপাতী তপস্যা করেও একচুল বুঝতে পারলুম না। তাই তাঁর কথা সংযত হয়ে বলতে হয়। যে যেমন আধার, তাঁকে তিনি ততটুকু দিয়ে ভরপুর করে গেছেন। তাঁর ভাবসমুদ্রের উচ্ছ্বাসের একবিন্দু ধারণা করতে পারলে মানুষ তখনি দেবতা হয়ে যায়। সর্বভাবের এমন সমন্বয় জগতের ইতিহাসে আর কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়? এই থেকেই বোঝ—তিনি কে দেহ ধরে এসেছিলেন। অবতার বললে তাঁকে ছোট করা হয়। তিনি যখন তাঁর সন্ন্যাসী ছেলেদের বিশেষভাবে উপদেশ দিতেন, তখন অনেক সময় নিজে উঠে চারিদিক খুঁজে দেখতেন—কোন গেরস্ত সেখানে আছে কিনা। যদি দেখতেন—কেউ নেই বা আসছে না, তবেই জ্বলন্ত ভাষায় ত্যাগ-তপস্যার মহিমা বর্ণন করতেন। সেই সংসার-বৈরাগ্যের প্রবল উদ্দীপনাতেই তো আমরা সংসারত্যাগী—উদাসীন।

শিষ্য॥ গৃহস্থ ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে তিনি এত প্রভেদ রাখিতেন?

স্বামীজী॥ তা তাঁর গৃহী ভক্তদেরই জিজ্ঞাসা করে দেখিস না। বুঝেই দেখ না কেন—তাঁর যে-সব সন্তান ঈশ্বরলাভের জন্য ঐহিক জীবনের সমস্ত ভোগ ত্যাগ করে পাহাড়ে-পর্বতে, তীর্থে-আশ্রমে তপস্যায় দেহপাত করছে, তারা বড়—না যারা তাঁর সেবা বন্দনা স্মরণ মনন করছে অথচ সংসারের মায়ামোহ কাটিয়ে উঠতে পারছে না, তারা বড়? যারা আত্মজ্ঞানে জীবসেবায় জীবনপাত করতে অগ্রসর, যারা আকুমার ঊর্ধ্বরেতা, যারা ত্যাগ-বৈরাগ্যের মূর্তিমান চলদ্বিগ্রহ, তারা বড়—না যারা মাছির মত একবার ফুলে বসে, পরক্ষণেই আবার বিষ্ঠায় বসছে, তারা বড়? এ-সব নিজেই বুঝে দেখ।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, যাঁহারা তাঁহার (ঠাকুরের) কৃপা পাইয়াছেন, তাঁহাদের আবার সংসার কি? তাঁহারা গৃহে থাকুন বা সন্ন্যাস অবলম্বন করুন, উভয়ই সমান—আমার এইরূপ বলিয়া বোধ হয়।

স্বামীজী॥ তাঁর কৃপা যারা পেয়েছে, তাদের মন বুদ্ধি কিছুতেই আর সংসারে আসক্ত হতে পারে না। কৃপার test (পরীক্ষা) কিন্তু হচ্ছে কাম-কাঞ্চনে অনাসক্তি। সেটা যদি কারও না হয়ে থাকে, তবে সে ঠাকুরের কৃপা কখনই ঠিক ঠিক লাভ করেনি।

পূর্ব প্রসঙ্গ এইরূপে শেষ হইলে শিষ্য অন্য কথার অবতারণা করিয়া স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, আপনি যে দেশবিদেশে এত পরিশ্রম করিয়া গেলেন, ইহার ফল কি হইল?’

স্বামীজী॥ কি হয়েছে, তার কিছু কিছু মাত্র তোরা দেখতে পাবি। কালে পৃথিবীকে ঠাকুরের উদার ভাব নিতে হবে, তার সূচনা হয়েছে। এই প্রবল বন্যামুখে সকলকে ভেসে যেতে হবে।

শিষ্য॥ আপনি ঠাকুরের সম্বন্ধে আরও কিছু বলুন। ঠাকুরের প্রসঙ্গ আপনার মুখে শুনতে বড় ভাল লাগে।

স্বামীজী॥ এই তো কত কি দিনরাত শুনছিস। তাঁর উপমা তিনিই। তাঁর কি তুলনা আছে রে?

শিষ্য॥ মহাশয়, আমরা তো তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই। আমাদের উপায়?

স্বামীজী॥ তাঁর সাক্ষাৎ কৃপাপ্রাপ্ত এইসব সাধুদের সঙ্গলাভ তো করেছিস, তবে আর তাঁকে দেখলিনি কি করে বল? তিনি তাঁর ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে বিরাজ করছেন। তাঁদের সেবাবন্দনা করলে কালে তিনি revealed (প্রকাশিত) হবেন। কালে সব দেখতে পাবি।

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, আপনি ঠাকুরের কৃপাপ্রাপ্ত অন্য সকলের কথাই বলেন। আপনার নিজের সম্বন্ধে ঠাকুর যাহা বলিতেন, সে কথা তো কোন দিন কিছু বলেন না।

স্বামীজী॥ আমার কথা আর কি বলব? দেখছিস তো, আমি তাঁর দৈত্যদানার ভেতরকার একটা কেউ হব। তাঁর সামনেই কখনও কখনও তাঁকে গালমন্দ করতুম। তিনি শুনে হাসতেন।

বলিতে বলিতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল স্থির গম্ভীর হইল। গঙ্গার দিকে শূন্যমনে চাহিয়া কিছুক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন। দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা হইল। নৌকাও ক্রমে মঠে পৌঁছিল। স্বামীজী তখন আপন মনে গান ধরিয়াছেন—

‘(কেবল) আশার আশা, ভবে আসা, আসামাত্র সার হল।

এখন সন্ধ্যাবেলায় ঘরের ছেলে ঘরে নিয়ে চলো।’ ইত্যাদি

গান শুনিয়া শিষ্য স্তম্ভিত হইয়া স্বামীজীর মুখপানে তাকাইয়া রহিল। গান সমাপ্ত হইলে স্বামীজী বলিলেন, ‘তোদের বাঙালদেশে সুকণ্ঠ গায়ক জন্মায় না। মা-গঙ্গার জল পেটে না গেলে সুকণ্ঠ হয় না।’

এইবার ভাড়া চুকাইয়া স্বামীজী নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন এবং জামা খুলিয়া মঠের পশ্চিম বারান্দায় বসিলেন। স্বামীজীর গৌরকান্তি এবং গৈরিকবসন সন্ধ্যার দীপালোকে অপূর্ব শোভা ধারণ করিল।

 

৪৬

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—জুন (শেষ সপ্তাহ), ১৯০২

 

আজ ১৩ আষাঢ়। শিষ্য বালি হইতে সন্ধ্যার প্রাক্কালে মঠে আসিয়াছে। বালিতেই তখন তাহার কর্মস্থান। অদ্য সে অফিসের পোষাক পরিয়াই আসিয়াছে। উহা পরিবর্তন করিবার সময় পায় নাই। আসিয়াই স্বামীজীর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া সে তাঁহার শারীরিক কুশল জিজ্ঞাসা করিল। স্বামীজী বলিলেন, ‘বেশ আছি। (শিষ্যের পোষাক দেখিয়া) তুই কোটপ্যাণ্ট পরিস, কলার পরিসনি কেন?’ ঐ কথা বলিয়াই নিকটস্থ স্বামী সারদানন্দকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘আমার যে-সব কলার আছে, তা থেকে দুটো কলার একে কাল দিস তো।’ সারদানন্দ-স্বামীও স্বামীজীর আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলেন।

অতঃপর শিষ্য মঠের অন্য এক গৃহে উক্ত পোষাক ছাড়িয়া হাতমুখ ধুইয়া স্বামীজীর কাছে আসিল। স্বামীজী তখন তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আহার, পোষাক ও জাতীয় আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করলে ক্রমে জাতীয়ত্ব-লোপ হয়ে যায়। বিদ্যা সকলের কাছেই শিখতে পারা যায়। কিন্তু যে বিদ্যালাভে জাতীয়ত্বের লোপ হয়, তাতে উন্নতি হয় না—অধঃপাতের সূচনাই হয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, অফিস-অঞ্চলে এখন সাহেবদের অনুমোদিত পোষাকাদি না পরিলে চলে না।

স্বামীজী॥ তা কে বারণ করছে? অফিস-অঞ্চলে কার্যানুরোধে ঐরূপ পোষাক পরবি বৈকি। কিন্তু ঘরে গিয়ে ঠিক বাঙালী বাবু হবি—সেই কোঁচা-ঝুলান কামিজ-গায়, চাদর কাঁধে। বুঝলি?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।

স্বামীজী॥ তোরা কেবল শার্ট (কামিজ) পরেই এ-বাড়ী ও-বাড়ী যাস—ওদেশে (পাশ্চাত্যে) ঐরূপ পোষাক পরে লোকের বাড়ী যাওয়া ভারি অভদ্রতা—naked (নেংটো) বলে। শার্টের উপর কোট না পরলে, ভদ্রলোকের বাড়ী ঢুকতেই দেবে না। পোষাকের ব্যাপারে তোরা কি ছাই অনুকরণ করতেই শিখেছিস্! আজকালকার ছেলে-ছোকরারা যেসব পোষাক পরে, তা না এদেশী, না ওদেশী—এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।

এইরূপ কথাবার্তার পর স্বামীজী গঙ্গার ধারে একটু পদচারণা করিতে লাগিলেন। সঙ্গে কেবল শিষ্যই রহিল। শিষ্য সাধন সম্বন্ধে একটি কথা এখন স্বামীজীকে বলিবে কিনা, ভাবিতে লাগিল।

স্বামীজী॥ কি ভাবছিস? বলেই ফেল না।

শিষ্য॥ (সলজ্জভাবে) মহাশয়, ভাবিতেছিলাম যে, আপনি যদি এমন একটা কোন উপায় শিখাইয়া দিতেন, যাহাতে খুব শীঘ্র মন স্থির হইয়া যায়, যাহাতে খুব শীঘ্র ধ্যানস্থ হইতে পারি, তবে খুব উপকার হয়। সংসারচক্রে পড়িয়া সাধন-ভজনের সময়ে মন স্থির করিতে পারা ভার।

শিষ্যের ঐরূপ দীনতা-দর্শনে সন্তোষ লাভ করিয়া স্বামীজী শিষ্যকে সস্নেহে বলিলেন, ‘খানিক বাদে আমি উপরে যখন একা থাকব, তখন তুই যাস। ঐ বিষয়ে কথাবার্তা হবে এখন।’

শিষ্য আনন্দে অধীর হইয়া স্বামীজীকে পুনঃপুনঃ প্রণাম করিতে লাগিল। স্বামীজী ‘থাক্ থাক্’ বলিতে লাগিলেন।

কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী উপরে চলিয়া গেলেন।

শিষ্য ইত্যবসরে নীচে একজন সাধুর সঙ্গে বেদান্তের বিচার আরম্ভ করিয়া দিল এবং ক্রমে দ্বৈতাদ্বৈতমতের বাগবিতণ্ডায় মঠ কোলাহলময় হইয়া উঠিল। গোলযোগ দেখিয়া স্বামী শিবানন্দ মহারাজ তাহাদের বলিলেন, ‘ওরে আস্তে আস্তে বিচার কর; অমন চীৎকার করলে স্বামীজীর ধ্যানের ব্যাঘাত হবে।’ শিষ্য ঐ কথা শুনিয়া স্থির হইল এবং বিচার সাঙ্গ করিয়া উপরে স্বামীজীর কাছে চলিল।

শিষ্য উপরে উঠিয়াই দেখিল—স্বামীজী পশ্চিমাস্যে মেজেতে বসিয়া ধ্যানস্থ হইয়া আছেন। মুখ অপূর্বভাবে পূর্ণ, যেন চন্দ্রকান্তি ফুটিয়া বাহির হইতেছে। তাঁহার সর্বাঙ্গ একেবারে স্থির—যেন ‘চিত্রার্পিতারম্ভ ইবাবতস্থে’। স্বামীজীর সেই ধ্যানস্থ মূর্তি দেখিয়া সে অবাক হইয়া নিকটেই দাঁড়াইয়া রহিল এবং বহুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়াও স্বামীজীর বাহ্য হুঁশের কোন চিহ্ন না দেখিয়া নিঃশব্দে ঐ স্থানে উপবেশন করিল। আরও অর্ধ ঘণ্টা অতীত হইলে স্বামীজীর ব্যবহারিক জগৎসম্বন্ধীয় জ্ঞানের যেন একটু আভাস দেখা গেল; তাঁহার বদ্ধ পাণিপদ্ম কম্পিত হইতেছে, শিষ্য দেখিতে পাইল। উহার পাঁচ-সাত মিনিট বাদেই স্বামীজী চক্ষুরুন্মীলন করিয়া শিষ্যের প্রতি চাহিয়া বলিলেন, ‘কখন এখানে এলি?’

শিষ্য॥ এই কতক্ষণ আসিয়াছি।

স্বামীজী॥ তা বেশ। এক গ্লাস জল নিয়ে আয়।

শিষ্য তাড়াতাড়ি স্বামীজীর জন্য নির্দিষ্ট কুঁজো হইতে জল লইয়া আসিল। স্বামীজী একটু জল পান করিয়া গ্লাসটি শিষ্যকে যথাস্থানে রাখিতে বলিলেন। শিষ্য ঐরূপ করিয়া আসিয়া পুনরায় স্বামীজীর কাছে বসিল।

স্বামীজী॥ আজ খুব ধ্যান জমেছিল।

শিষ্য॥ মহাশয়, ধ্যান করিতে বসিলে মন যাহাতে ঐরূপ ডুবিয়া যায়, তাহা আমাকে শিখাইয়া দিন।

স্বামীজী॥ তোকে সব উপায় তো পূর্বেই বলে দিয়েছি, প্রত্যহ সেই প্রকার ধ্যান করবি। কালে টের পাবি। আচ্ছা, বল দেখি তোর কি ভাল লাগে?

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনি যেরূপ বলিয়াছেন সেরূপ করিয়া থাকি, তথাপি আমার ধ্যান এখনও ভাল জমে না। কখনও কখনও আবার মনে হয়—কি হইবে ধ্যান করিয়া? অতএব বোধ হয় আমার ধ্যান হইবে না, এখন আপনার চিরসামীপ্যই আমার একান্ত বাঞ্ছনীয়।

স্বামীজী॥ ও সব weakness-এর (দুর্বলতার) চিহ্ন। সর্বদা নিত্যপ্রত্যক্ষ আত্মায় তন্ময় হয়ে যাবার চেষ্টা করবি। আত্মাদর্শন একবার হলে সব হল—জন্ম-মৃত্যুর পাশ কেটে চলে যাবি।

শিষ্য॥ আপনি কৃপা করিয়া তাহাই করিয়া দিন। আপনি আজ নিরিবিলিতে আসিতে বলিয়াছিলেন, তাই আসিয়াছি। আমার যাতে মন স্থির হয়, তৎসম্বন্ধে কিছু করিয়া দিন।

স্বামীজী॥ সময় পেলেই ধ্যান করবি। সুষুম্না-পথে মন যদি একবার চলে যায় তো আপনা-আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে—বেশী কিছু আর করতে হবে না।

শিষ্য॥ আপনি তো কত উৎসাহ দেন। কিন্তু আমার সত্য-বস্তু প্রত্যক্ষ হইবে কি? স্বামীজী॥ হবে বৈকি। আকীট-ব্রহ্মা সব কালে মুক্ত হয়ে যাবে—আর তুই হবিনি? ও-সব weakness (দুর্বলতা) মনেও স্থান দিবিনি।

পরে বলিলেনঃ শ্রদ্ধাবান্ হ, বীর্যবান্ হ, আত্মজ্ঞান লাভ কর, আর ‘পরহিতায়’ জীবনপাত কর—এই আমার ইচ্ছা ও আশীর্বাদ।

অতঃপর প্রসাদের ঘণ্টা পড়ায় বলিলেন, ‘যা প্রসাদের ঘণ্টা পড়েছে।’

শিষ্য স্বামীজীর পদপ্রান্তে প্রণত হইয়া কৃপাভিক্ষা করায় স্বামীজী শিষ্যের মস্তকে হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন এবং বলিলেন, ‘আমার আশীর্বাদে যদি তোর কোন উপকার হয় তো বলছি—ভগবান্ রামকৃষ্ণ তোকে কৃপা করুন। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আমি জানি না।’

শিষ্য এইবার আনন্দিত মনে নীচে নামিয়া আসিয়া শিবানন্দ মহারাজকে স্বামীজীর আশীর্বাদের কথা বলিল। স্বামী শিবানন্দ ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, ‘যাঃ বাঙাল, তোর সব হয়ে গেল। এর পর স্বামীজীর আশীর্বাদের ফল জানতে পারবি।’

আহারান্তে শিষ্য আর সে-রাত্রে উপরে যায় নাই। কারণ স্বামীজী আজ সকাল-সকাল নিদ্রা যাইবার জন্য শয়ন করিয়াছিলেন। পরদিন প্রত্যুষে শিষ্যকে কার্যানুরোধে কলিকাতায় ফিরিয়া যাইতেই হইবে। সুতরাং তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়া সে উপরে স্বামীজীর কাছে উপস্থিত হইলে তিনি বলিলেন, ‘এখনি যাবি?’

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।

স্বামীজী॥ আগামী রবিবার আসবি তো?

শিষ্য॥ নিশ্চয়।

স্বামীজী॥ তবে আয়; ঐ একখানি চলতি নৌকাও আসছে।

শিষ্য স্বামীজীর পাদপদ্মে এ-জন্মের মত বিদায় লইয়া চলিল। সে তখনও জানে না যে, তাহার ইষ্টদেবের সঙ্গে স্থূলশরীরে তাহার এই শেষ৮২ দেখা। স্বামীজী তাহাকে প্রসন্নবদনে বিদায় দিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘রবিবারে আসিস।’ শিষ্যও ‘আসিব’ বলিয়া নীচে নামিয়া গেল।

স্বামী সারদানন্দ তাহাকে যাইতে উদ্যত দেখিয়া বলিলেন, ‘ওরে, কলার দুটো নিয়ে যা। নইলে স্বামীজীর বকুনি খেতে হবে।’ শিষ্য বলিল, ‘আজ বড়ই তাড়াতাড়ি, আর একদিন লইয়া যাইব—আপনি স্বামীজীকে এই কথা বলিবেন।’

চলতি নৌকার মাঝি ডাকাডাকি করিতেছে, সুতরাং শিষ্য ঐ কথাগুলি বলিতে বলিতেই নৌকায় উঠিবার জন্য ছুটিল। শিষ্য নৌকায় উঠিয়াই দেখিতে পাইল, স্বামীজী উপরের বারান্দায় পায়চারি করিতেছেন। সে তাঁহার উদ্দেশে প্রণাম করিয়া নৌকার ভিতরে প্রবেশ করিল। নৌকা ভাটার টানে আধ ঘণ্টার মধ্যেই আহিরিটোলার ঘাটে পঁহুছিল।