০৫. স্বামী-শিষ্য-সংবাদ ২১-২৫

২১

স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল—১৮৯৮৮

 

আজ বেলা প্রায় দুইটার সময় শিষ্য পদব্রজে মঠে আসিয়াছে। নীলাম্বরবাবুর বাগানবাটীতে এখন মঠ উঠাইয়া আনা হইয়াছে এবং বর্তমান মঠের জমিও অল্পদিন হইল খরিদ করা হইয়াছে। স্বামীজী শিষ্যকে সঙ্গে লইয়া বেলা চারিটা আন্দাজ মঠের নূতন জমিতে বেড়াইতে বাহির হইয়াছেন। মঠের জমি তখনও জঙ্গলপূর্ণ। জমিটির উত্তরাংশে তখন একখানি একতলা কোঠাবাড়ী ছিল; উহারই সংস্কার করিয়া বর্তমান মঠ-বাড়ী নির্মিত হইয়াছে। মঠের জমিটি যিনি খরিদ করাইয়া দেন, তিনিও স্বামীজীর সঙ্গে কিছুদূর পর্যন্ত আসিয়া বিদায় লইলেন। স্বামীজী শিষ্যসঙ্গে মঠের জমিতে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন এবং কথাপ্রসঙ্গে ভাবী মঠের কার্যকারিতা ও বিধিবিধান পর্যালোচনা করিতে লাগিলেন।

ক্রমে একতলা ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় পৌঁছিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে স্বামীজী বলিলেনঃ

এইখানে সাধুদের থাকবার স্থান হবে। সাধন-ভজন ও জ্ঞানচর্চায় এই মঠ প্রধান কেন্দ্রস্থান হবে, এই আমার অভিপ্রায়। এখান থেকে যে শক্তির অভ্যুদয় হবে, তা জগৎ ছেয়ে ফেলবে; মানুষের জীবনগতি ফিরিয়ে দেবে; জ্ঞান ভক্তি যোগ ও কর্মের একত্র সমন্বয়ে এখান থেকে ideals (উচ্চাদর্শসকল) বেরোবে; এই মঠভুক্ত সাধুদের ইঙ্গিতে কালে দিগ‍্‍দিগন্তরে প্রাণের সঞ্চার হবে; যথার্থ ধর্মানুরাগিগণ সব এখানে কালে এসে জুটবে—মনে এরূপ কত কল্পনার উদয় হচ্ছে।

মঠের দক্ষিণ ভাগে ঐ যে জমি দেখছিস, ওখানে বিদ্যার কেন্দ্রস্থল হবে। ব্যাকরণ দর্শন বিজ্ঞান কাব্য অলঙ্কার স্মৃতি ভক্তি শাস্ত্র আর রাজকীয় ভাষা ঐ স্থানে শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রাচীন টোলের ধরনে ঐ ‘বিদ্যামন্দির’ স্থাপিত হবে। বালব্রহ্মচারীরা ঐখানে বাস করে শাস্ত্রপাঠ করবে। তাদের অশন-বসন সব মঠ থেকে দেওয়া হবে। এ-সব ব্রহ্মচারীরা পাঁচ বৎসর training (শিক্ষালাভ)-এর পর ইচ্ছে হলে গৃহে ফিরে গিয়ে সংসারী হতে পারবে। মঠে মহাপুরুষগণের অভিমতে সন্ন্যাসও ইচ্ছে হলে নিতে পারবে। এই ব্রহ্মচারিগণের মধ্যে যাদের উচ্ছৃঙ্খল বা অসচ্চরিত্র দেখা যাবে, মঠস্বামিগণ তাদের তখনি বহিষ্কৃত করে দিতে পারবেন। এখানে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে অধ্যয়ন করান হবে। এতে যাদের objection (আপত্তি) থাকবে, তাদের নেওয়া হবে না। তবে নিজের জাতিবর্ণাশ্রমাচার মেনে যারা চলতে চাইবে, তাদের আহারাদির বন্দোবস্ত নিজেদের করে নিতে হবে। তারা অধ্যয়ন-মাত্র সকলের সঙ্গে একত্র করবে। তাদেরও চরিত্র-বিষয়ে মঠস্বামিগণ সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। এখানে trained (শিক্ষিত) না হলে কেউ সন্ন্যাসের অধিকারী হতে পারবে না। ক্রমে এরূপে যখন এই মঠের কাজ আরম্ভ হবে, তখন কেমন হবে বল দেখি?

শিষ্য॥ আপনি তবে প্রাচীনকালের মত গুরুগৃহে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অনুষ্ঠান পুনরায় দেশে চালাইতে চান?

স্বামীজী॥ নয় তো কি? Modern system of education-এ (বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিতে) ব্রহ্মবিদ্যা-বিকাশের সুযোগ কিছুমাত্র নেই। পূর্বের ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে এখন broad basis (উদারভাব)-এর উপর তার foundation (ভিত্তিস্থাপন) করতে হবে, অর্থাৎ কালোপযোগী অনেক পরিবর্তন তাতে ঢোকাতে হবে। সে সব পরে বলব।

স্বামীজী আবার বলিতে লাগিলেনঃ

মঠের দক্ষিণে ঐ যে জমিটা আছে, ঐটিও কালে কিনে নিতে হবে। ঐখানে মঠের ‘অন্নসত্র’ হবে। ঐখানে যথার্থ দীনদুঃখিগণকে নারায়ণজ্ঞানে সেবা করবার বন্দোবস্ত থাকবে। ঐ অন্নসত্র ঠাকুরের নামে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেমন funds (টাকা) জুটবে, সেই অনুসারে ঐ অন্নসত্র প্রথম খুলতে হবে। চাই কি প্রথমে দু-তিনটি লোক নিয়ে start (আরম্ভ) করতে হবে। উৎসাহী ব্রহ্মচারীদের এই অন্নসত্র চালাতে train করতে (শেখাতে) হবে! তাদের যোগাড়-সোগাড় করে, চাই কি ভিক্ষা করে এই অন্নসত্র চালাতে হবে। মঠ এ-বিষয়ে কোন রকম অর্থসাহায্য করতে পারবে না। ব্রহ্মচারীদের ওর জন্য অর্থসংগ্রহ করে আনতে হবে। সেবাসত্রে ঐভাবে পাঁচ বৎসর training (শিক্ষালাভ) সম্পূর্ণ হলে তবে তারা ‘বিদ্যামন্দির’-শাখায় প্রবেশাধিকার লাভ করতে পারবে। অন্নসত্রে পাঁচ বৎসর আর বিদ্যাশ্রমে পাঁচ বৎসর—একুনে দশ বৎসর training (শিক্ষার) পর মঠের স্বামিগণের দ্বারা দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবেশ করতে পারবে—অবশ্য যদি তাদের সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছে হয় এবং উপযুক্ত অধিকারী বুঝে মঠাধ্যক্ষগণ তাদের সন্ন্যাসী করা অভিমত করেন। তবে কোন কোন বিশেষ সদগুণসম্পন্ন ব্রহ্মচারী সম্বন্ধে ঐ নিয়মের ব্যতিক্রম করে মঠাধ্যক্ষ তাকে যখন ইচ্ছে সন্ন্যাসদীক্ষা দিতেও পারবেন। সাধারণ ব্রহ্মচারিগণকে কিন্তু পূর্বে যেমন বললুম, সেইভাবে ক্রমে ক্রমে সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবেশ করতে হবে। আমার মাথায় এই-সব idea (ভাব) রয়েছে।

শিষ্য॥ মহাশয়, মঠে এরূপ তিনটি শাখা স্থাপনের উদ্দেশ্য কি হবে?

স্বামীজী॥ বুঝলিনি? প্রথমে অন্নদান, তারপর বিদ্যাদান, সর্বোপরি জ্ঞানদান। এই তিন ভাবের সমন্বয় এই মঠ থেকে করতে হবে। অন্নদান করবার চেষ্টা করতে করতে ব্রহ্মচারীদের মনে পরার্থকর্মতৎপরতা ও শিবজ্ঞানে জীবসেবার ভাব দৃঢ় হবে। ও থেকে তাদের চিত্ত ক্রমে নির্মল হয়ে তাতে সত্ত্বভাবের স্ফুরণ হবে। তা হলেই ব্রহ্মচারিগণ কালে ব্রহ্মবিদ্যালাভের যোগ্যতা ও সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবেশাধিকার লাভ করবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, জ্ঞানদানই যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আর অন্নদান ও বিদ্যাদানের শাখা স্থাপনের প্রয়োজন কি?

স্বামীজী॥ তুই এতক্ষণেও কথাটা বুঝতে পারলিনি! শোন—এই অন্ন-হাহাকারের দিনে তুই যদি পরার্থে সেবাকল্পে ভিক্ষা-শিক্ষা করে যেরূপে হোক দুমুঠো অন্ন দীনদুঃখীকে দিতে পারিস, তা হলে জীব-জগতের ও তোর মঙ্গল তো হবেই—সঙ্গে সঙ্গে তুই এই সৎকাজের জন্য সকলের sympathy (সহানুভূতি) পাবি। ঐ সৎকাজের জন্য তোকে বিশ্বাস করে কামকাঞ্চনবদ্ধ সংসারীরা তোর সাহায্য করতে অগ্রসর হবে। তুই বিদ্যাদানে বা জ্ঞানদানে যত লোক আকর্ষণ করতে পারবি, তার সহস্রগুণ লোক তোর এই অযাচিত অন্নদানে আকৃষ্ট হবে। এই কাজে তুই public sympathy (সাধারণের সহানুভূতি) যত পাবি, তত আর কোন কাজে পাবিনি। যথার্থ সৎকাজে মানুষ কেন, ভগবান্‌ও সহায় হন। এরূপে লোক আকৃষ্ট হলে তখন তাদের মধ্যে দিয়া বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনের স্পৃহা উদ্দীপিত করতে পারবি। তাই আগে অন্নদান।

শিষ্য॥ মহাশয়, অন্নসত্র করিতে প্রথম-স্থান চাই, তারপর ঐজন্য ঘর-দ্বার নির্মাণ করা চাই, তারপর কাজ চালাইবার টাকা চাই। এত টাকা কোথা হইতে আসিবে?

স্বামীজী॥ মঠের দক্ষিণ দিক্‌টা আমি এখনি ছেড়ে দিচ্ছি এবং ঐ বেলতলায় একখানা চালা তুলে দিচ্ছি। তুই একটি কি দুটি অন্ধ আতুর সন্ধান করে নিয়ে এসে কাল থেকেই তাদের সেবায় লেগে যা দেখি। নিজে ভিক্ষা করে তাদের জন্য নিয়ে আয়। নিজে রেঁধে তাদের খাওয়া। এইরূপে কিছু দিন করলেই দেখবি—তোর এই কাজে কত লোক সাহায্য করতে অগ্রসর হবে, কত টাকা-কড়ি দেবে! ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাতে গচ্ছতি।’৫১

শিষ্য॥ হাঁ, তা বটে। কিন্তু ঐরূপে নিরন্তর কর্ম করিতে করিতে কালে কর্মবন্ধন তো ঘটিতে পারে?

স্বামীজী॥ কর্মের ফলে যদি তোর দৃষ্টি না থাকে এবং সকল প্রকার কামনা-বাসনার পারে যাবার যদি তোর একান্ত অনুরাগ থাকে, তা হলে ঐ সব সৎকাজ তোর কর্মবন্ধন-মোচনেই সহায়তা করবে। ঐরূপ কর্মে বন্ধন আসবে!—ও-কথা তুই কি বলছিস? এরূপ পরার্থ কর্মই কর্মবন্ধনের মূলোৎপাটনের একমাত্র উপায়। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’

শিষ্য॥ আপনার কথায় অন্নসত্র ও সেবাশ্রম সম্বন্ধে আপনার মনোভাব বিশেষ করিয়া শুনিতে প্রাণে উৎসাহ হইতেছে।

স্বামীজী॥ গরীব-দুঃখীদের জন্য well-ventilated (বায়ু-চলাচলের পথযুক্ত) ছোট ছোট ঘর তৈরী করতে হবে। এক এক ঘরে তাদের দু-জন কি তিন জন মাত্র থাকবে। তাদের ভাল বিছানা, পরিষ্কার কাপড়-চোপড় সব দিতে হবে। তাদের জন্য একজন ডাক্তার থাকবেন। হপ্তায় একবার কি দুবার সুবিধামত তিনি তাদের দেখে যাবেন। সেবাশ্রমটি অন্নসত্রের ভেতর একটা ward (বিভাগ)-এর মত থাকবে, তাতে রোগীদের শুশ্রূষা করা হবে। ক্রমে যখন fund (টাকা) এসে পড়বে, তখন একটা মস্ত kitchen (রন্ধনশালা) করতে হবে। অন্নসত্রে কেবল ‘দীয়তাং নীয়তাং ভুজ্যতাম্’ এই রব উঠবে। ভাতের ফেন গঙ্গায় গড়িয়ে পড়ে গঙ্গার জল সাদা হয়ে যাবে। এই রকম অন্নসত্র হয়েছে দেখলে তবে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়।

শিষ্য॥ আপনার যখন ঐরূপ ইচ্ছা হইতেছে, তখন বোধ হয় কালে ঐ বিষয়টি বাস্তবিকই হইবে।

শিষ্যের কথা শুনিয়া স্বামীজী গঙ্গার দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিলেন। পরে প্রসন্নমুখে সস্নেহে শিষ্যকে বলিলেনঃ

তোদের ভেতর কার কবে সিংহ জেগে উঠবে, তা কে জানে? তোদের একটার মধ্যে মা যদি শক্তি জাগিয়ে দেন তো দুনিয়াময় অমন কত অন্নসত্র হবে। কি জানিস, জ্ঞান শক্তি ভক্তি—সকলই সর্বজীবে পূর্ণভাবে আছে। এদের বিকাশের তারতম্যটাই কেবল আমরা দেখি এবং একে বড়, ওকে ছোট বলে মনে করি। জীবের মনের ভেতর একটা পর্দা যেন মাঝখানে পড়ে পূর্ণ বিকাশটাকে আড়াল করে রয়েছে। সেটা সরে গেলেই বস্‌, সব হয়ে গেল! তখন যা চাইবি, যা ইচ্ছে করবি, তাই হবে।

স্বামীজী আবার বলিতে লাগিলেনঃ

ঈশ্বর করেন তো এ মঠকে মহাসমন্বয়ক্ষেত্র করে তুলতে হবে। ঠাকুর আমাদের সর্বভাবের সাক্ষাৎ সমন্বয়মূর্তি। ঐ সমন্বয়ের ভাবটি এখানে জাগিয়ে রাখলে ঠাকুর জগতে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। সর্বমতের সর্বপথের আচণ্ডাল ব্রাহ্মণ—সকলে যাতে এখানে এসে আপন আপন ideal (আদর্শ) দেখতে পায়, তা করতে হবে। সেদিন যখন মঠের জমিতে ঠাকুরকে স্থাপন করলুম তখন মনে হল, যেন এখান হতে তার ভাবের বিকাশ হয়ে চরাচর বিশ্ব ছেয়ে ফেলছে! আমি তো যথাসাধ্য করছি ও করব—তোরাও ঠাকুরের উদার ভাব লোকদের বুঝিয়ে দে। বেদান্ত কেবল পড়ে কি হবে? Practical life (কর্মজীবন)-এ শুদ্ধদ্বৈতবাদের সত্যতা প্রমাণিত করতে হবে। শঙ্কর এ অদ্বৈতবাদকে জঙ্গলে পাহাড়ে রেখে গেছেন; আমি এবার সেটাকে সেখান থেকে সংসারে ও সমাজের সর্বত্র রেখে যাব বলে এসেছি। ঘরে ঘরে, মাঠে ঘাটে, পর্বতে প্রান্তরে এই অদ্বৈতবাদের দুন্দুভিনাদ তুলতে হবে। তোরা আমার সহায় হয়ে লেগে যা।

শিষ্য॥ মহাশয়, ধ্যানসহায়ে ঐ ভাব অনুভূতি করিতেই যেন আমার ভাল লাগে। লাফাতে ঝাঁপাতে ইচ্ছা হয় না।

স্বামীজী॥ সেটা তো নেশা করে অচেতন হয়ে থাকার মত; শুধু ঐরূপ থেকে কি হবে? অদ্বৈতবাদের প্রেরণায় কখনও বা তাণ্ডব নৃত্য করবি, কখনও বা বুঁদ হয়ে থাকবি। ভাল জিনিষ পেলে কি একা খেয়ে সুখ হয়? দশ জনকে দিতে হয় ও খেতে হয়। আত্মানুভূতি লাভ করে না-হয় তুই মুক্ত হয়ে গেলি—তাতে জগতের এল গেল কি? ত্রিজগৎ মুক্ত করে নিয়ে যেতে হবে। মহামায়ার রাজ্যে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে! তখনই নিত্য-সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবি। সে আনন্দের কি তুলনা আছে রে! ‘নিরবধি গগনাভম্’—আকাশকল্প ভূমানন্দে প্রতিষ্ঠিত হবি। জীবজগতের সর্বত্র তোর নিজ সত্তা দেখে অবাক হয়ে পড়বি! স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত তোর আপনার সত্তা বলে বোধ হবে। তখন সকলকে আপনার মত যত্ন না করে থাকতে পারবিনি। এরূপ অবস্থাই হচ্ছে Practical Vedanta (কর্মে পরিণত বেদান্তের অনুভূতি)—বুঝলি। তিনি (ব্রহ্ম) এক হয়েও ব্যবহারিকভাবে বহুরূপে সামনে রয়েছেন। নাম ও রূপ এই ব্যবহারের মূলে রয়েছে। যেমন ঘটের নাম-রূপটা বাদ দিয়ে কি দেখতে পাস?—একমাত্র মাটি, যা এর প্রকৃতি সত্তা। সেরূপ ভ্রমে ঘট পট মঠ—সব ভাবছিস ও দেখছিস। জ্ঞান-প্রতিবন্ধক এই যে অজ্ঞান, যার বাস্তব কোন সত্তা নেই, তাই নিয়ে ব্যবহার চলছে। মাগ-ছেলে, দেহ-মন—যা কিছু সবই নামরূপসহায়ে অজ্ঞানের সৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া যায়। অজ্ঞানটা যেই সরে দাঁড়াল, তখনি ব্রহ্ম-সত্তার অনুভূতি হয়ে গেল।

শিষ্য॥ এই অজ্ঞান কোথা হইতে আসিল?

স্বামীজী॥ কোত্থেকে এল তা পরে বলব। তুই যখন দড়াকে সাপ ভেবে ভয়ে দৌড়ুতে লাগলি, তখন কি দড়াটা সাপ হয়ে গিয়েছিল?—না, তোর অজ্ঞতাই তোকে অমন করে ছুটিয়েছিল?

শিষ্য॥ অজ্ঞতা হইতেই ঐরূপ করিয়াছিলাম।

স্বামীজী॥ তা হলে ভেবে দেখ—তুই যখন আবার দড়াকে দড়া বলে জানতে পারবি, তখন নিজের পূর্বকার অজ্ঞতা ভেবে হাসি পাবে কিনা? তখন নামরূপ মিথ্যা বলে বোধ হবে কি না?

শিষ্য॥ তা হবে।

স্বামীজী॥ তা যদি হয়, তবে নাম-রূপ মিথ্যা হয়ে দাঁড়াল। এরূপে ব্রহ্মসত্তাই একমাত্র সত্য হয়ে দাঁড়াল। এই অনন্ত সৃষ্টিবৈচিত্র্যেও তাঁর স্বরূপের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। কেবল তুই এই অজ্ঞানের মন্দান্ধকারে এটা মাগ, এটা ছেলে, এটা আপন, এটা পর ভেবে সেই সর্ব-বিভাসক আত্মার সত্তা বুঝতে পারিসনে। যখন গুরুর উপদেশ ও নিজের বিশ্বাস দ্বারা এই নামরূপাত্মক জগৎটা না দেখে এর মূল সত্তাটাকে কেবল অনুভব করবি, তখনি আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকল পদার্থে তোর আত্মানুভূতি হবে—তখনি ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ৫২

শিষ্য॥ মহাশয়, এই অজ্ঞানের আদি-অন্তের কথা জানিতে ইচ্ছা হয়।

স্বামীজী॥ যে জিনিষটা পরে থাকে না—সে জিনিষটা যে মিথ্যা, তা তো বুঝতে পেরেছিস? যে যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞ হয়েছে সে বলবে, অজ্ঞান আবার কোথায়? সে দড়াকে দড়াই দেখে—সাপ বলে দেখতে পায় না। যারা দড়াকে সাপ বলে দেখে, তাদের ভয়-ভীতি দেখে তার হাসি পায়! সেজন্য অজ্ঞানের বাস্তব স্বরূপ নেই। অজ্ঞানকে সৎও বলা যায় না—অসৎও বলা যায় না—‘সন্নাপ্যসন্নাপ্যুভয়াত্মিকা নো’। যে জিনিষটা এরূপে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে, তার বিষয়ে প্রশ্নই বা কি, আর উত্তরই বা কি? ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করাটা যুক্তিযুক্তও হতে পারে না। কেন, তা শোন।—এই প্রশ্নোত্তরটাও তো সেই নাম-রূপ বা দেশকাল ধরে করা হচ্ছে। যে ব্রহ্মবস্তু নাম-রূপ-দেশ-কালের অতীত, তাকে প্রশ্নোত্তর দিয়ে কি বোঝান যায়? এইজন্য শাস্ত্র মন্ত্র প্রভৃতি ব্যবহারিকভাবে সত্য—পারমার্থিকরূপে সত্য নয়। স্বরূপতঃ অজ্ঞানের অস্তিত্বই নেই, তা আবার বুঝবি কি? যখন ব্রহ্মের প্রকাশ হবে, তখন আর ঐরূপ প্রশ্ন করবার অবসরই থাকবে না। ঠাকুরের সেই ‘মুচি-মুটের গল্প’ শুনেছিস না?—ঠিক তাই। অজ্ঞানকে যেই চেনা যায়, অমনি সে পালিয়ে যায়।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, অজ্ঞানটা আসিল কোথা হইতে?

স্বামীজী॥ যে জিনিষটাই নেই, তা আবার আসবে কি করে?—থাকলে তো আসবে?

শিষ্য॥ তবে এই জীব-জগতের কি করিয়া উৎপত্তি হইল?

স্বামীজী॥ এক ব্রহ্মসত্তাই তো রয়েছেন! তুই মিথ্যা নাম-রূপ দিয়ে তাকে রূপান্তরে নামান্তরে দেখছিস।

শিষ্য॥ এই মিথ্যা নাম-রূপই বা কেন? কোথা হইতে আসিল?

স্বামীজী॥ শাস্ত্রে এই নামরূপাত্মক সংস্কার বা অজ্ঞতাকে প্রবাহরূপে নিত্যপ্রায় বলেছে, কিন্তু ওটা সান্ত। ব্রহ্মসত্তা কিন্তু সর্বদা দড়ার মত স্ব-স্বরূপেই রয়েছেন। এইজন্য বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, এই নিখিল ব্রহ্মাণ্ড ব্রহ্মে অধ্যস্ত ইন্দ্রজালবৎ ভাসমান। তাতে ব্রহ্মের কিছুমাত্র স্বরূপ-বৈলক্ষণ্য ঘটেনি। বুঝলি?

শিষ্য॥ একটা কথা এখনও বুঝিতে পারিতেছি না।

স্বামীজী॥ কি বল্ না? শিষ্য॥ এই যে আপনি বলিলেন, এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়াদি ব্রহ্মে অধ্যস্ত, তাহাদের কোন স্বরূপ-সত্তা নাই—তা কি করিয়া হইতে পারে? যে যাহা পূর্বে দেখে নাই, সে জিনিষের ভ্রম তাহার হইতেই পারে না। যে কখনও সাপ দেখে নাই, তাহার দড়াতে যেমন সর্পভ্রম হয় না; সেইরূপ যে এই সৃষ্টি দেখে নাই, তার ব্রহ্মে সৃষ্টিভ্রম হইবে কেন? সুতরাং সৃষ্টি ছিল বা আছে, তাই সৃষ্টিভ্রম হইয়াছে! ইহাতেই দ্বৈতাপত্তি উঠিতেছে।

স্বামীজী॥ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ তোর প্রশ্ন এইরূপে প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করবেন যে, তাঁর দৃষ্টিতে সৃষ্টি প্রভৃতি একেবারেই প্রতিভাত হচ্ছে না। তিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্তাই দেখছেন। রজ্জুই দেখছেন, সাপ দেখছেন না। তুই যদি বলিস, ‘আমি তো এই সৃষ্টি বা সাপ দেখছি’, তবে তোর দৃষ্টিদোষ দূর করতে তিনি তোকে রজ্জুর স্বরূপ বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন। যখন তাঁর উপদেশে ও বিচার-বলে তুই রজ্জুসত্তা বা ব্রহ্মসত্তা বুঝতে পারবি, তখন এই ভ্রমাত্মক সর্পজ্ঞান বা সৃষ্টিজ্ঞান নাশ হয়ে যাবে। তখন এই সৃষ্টিস্থিতিলয়রূপ ভ্রমজ্ঞান ব্রহ্মে আরোপিত ভিন্ন আর কি বলতে পারিস? অনাদি প্রবাহরূপে এই সৃষ্টিভানাদি চলে এসে থাকে তো থাকুক, তার নির্ণয়ে লাভালাভ কিছুই নেই। ব্রহ্মতত্ত্ব ‘করামলকবৎ’ প্রত্যক্ষ না হলে এ প্রশ্নের পর্যাপ্ত মীমাংসা হতে পারে না এবং হলে আর প্রশ্নও উঠে না, উত্তরেরও প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্মতত্ত্বাস্বাদ তখন ‘মূকাস্বাদনবৎ’ হয়।

শিষ্য॥ তবে আর এত বিচার করিয়া কি হইবে?

স্বামীজী॥ ঐ বিষয়টি বোঝাবার জন্য বিচার। সত্য বস্তু কিন্তু বিচারের পারে—‘নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া।’৫৩

এইরূপ কথা চলিতে চলিতে শিষ্য স্বামীজীর সঙ্গে মঠে৫৪ আসিয়া উপস্থিত হইল। মঠে আসিয়া স্বামীজী মঠের সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণকে অদ্যকার ব্রহ্মবিচারের সংক্ষিপ্ত মর্ম বুঝাইয়া দিলেন। উপরে উঠিতে উঠিতে শিষ্যকে বলিতে লাগিলেন, ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’

 

২২

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮

 

শিষ্য॥ স্বামীজী, আপনি এদেশে বক্তৃতা দেন না কেন? বক্তৃতাপ্রভাবে ইওরোপ-আমেরিকা মাতাইয়া আসিলেন, কিন্তু ভারতে ফিরিয়া আপনার ঐ বিষয়ে উদ্যম ও অনুরাগ যে কেন কমিয়া গিয়াছে, তাহার কারণ বুঝিতে পারি না। পাশ্চাত্যদেশগুলি অপেক্ষা—আমাদের বিবেচনায় এখানেই ঐরূপ উদ্যমের অধিক প্রয়োজন।

স্বামীজী॥ এদেশে আগে ground (জমি) তৈরী করতে হবে, তবে বীজ ফেললে গাছ হবে। পাশ্চাত্যের মাটিই এখন বীজ ফেলবার উপযুক্ত, খুব উর্বর। ওদেশের লোকেরা এখন ভোগের শেষ সীমায় উঠেছে। ভোগে তৃপ্ত হয়ে এখন তাদের মন তাতে আর শান্তি পাচ্ছে না। একটা দারুণ অভাব বোধ করছে। তোদের দেশে না আছে ভোগ, না আছে যোগ। ভোগের ইচ্ছা কতকটা তৃপ্ত হলে তবে লোকে যোগের কথা শোনে ও বোঝে। অন্নাভাবে ক্ষীণদেহ ক্ষীণমন, রোগশোক-পরিতাপের জন্মভূমি ভারতে লেকচার-ফেকচার দিয়ে কি হবে?

শিষ্য॥ কেন, আপনিই তো কখনও কখনও বলিয়াছেন এদেশ ধর্মভূমি। এদেশে লোকে যেমন ধর্মকথা বুঝে ও কার্যতঃ ধর্মানুষ্ঠান করে, অন্যদেশে তেমন নহে। তবে আপনার জ্বলন্ত বাগ্মিতায় দেশ কেন না মাতিয়া উঠিবে—কেন না ফল হইবে?

স্বামীজী॥ ওরে ধর্মকর্ম করতে গেলে আগে কূর্মাবতারের পূজা চাই—পেট হচ্ছেন সেই কূর্ম। এঁকে আগে ঠাণ্ডা না করলে, তোর ধর্মকর্মের কথা কেউ নেবে না। দেখতে পাচ্ছিস না, পেটের চিন্তাতেই ভারত অস্থির! বিদেশীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বাণিজ্যে অবাধ রপ্তানী, সবচেয়ে তোদের পরস্পরের ভেতর ঘৃণিত দাসসুলভ ঈর্ষাই তোদের দেশের অস্থিমজ্জা খেয়ে ফেলেছে। ধর্মকথা শোনাতে হলে আগে এদেশের লোকের পেটের চিন্তা দূর করতে হবে। নতুবা শুধু লেকচার-ফেকচারে বিশেষ কোন ফল হবে না।

শিষ্য॥ তবে আমাদের এখন কি করা প্রয়োজন?

স্বামীজী॥ প্রথমতঃ কতকগুলি ত্যাগী পুরুষের প্রয়োজন—যারা নিজেদের সংসারের জন্য না ভেবে পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে। আমি মঠ স্থাপন করে কতকগুলি বাল-সন্ন্যাসীকে তাই ঐরূপে তৈরী করছি। শিক্ষা শেষ হলে এরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে সকলকে তাদের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার বিষয় বুঝিয়ে বলবে, ঐ অবস্থার উন্নতি কিভাবে হতে পারে, সে বিষয়ে উপদেশ দেবে আর সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের মহান্ সত্যগুলি সোজা কথায় জলের মত পরিষ্কার করে তাদের বুঝিয়ে দেবে। তোদের দেশের mass of people (জনসাধারণ) যেন একটা sleeping leviathan (ঘুমন্ত বিরাট জলজন্তু)! এদেশের এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, এতে শতকরা বড়জোড় একজন কি দুজন দেশের লোক শিক্ষা পাচ্ছে। যারা পাচ্ছে—তারাও দেশের হিতের জন্য কিছু করে উঠতে পারছে না। কি করেই বা বেচারি করবে বল্? কলেজ থেকে বেরিয়েই দেখে সে সাত ছেলের বাপ! তখন যা তা করে একটা কেরানীগিরি, বড়জোর একটা ডেপুটিগিরি জুটিয়ে নেয়। এই হল শিক্ষার পরিণাম! তারপর সংসারের ভারে উচ্চকর্ম উচ্চচিন্তা করবার তাদের আর সময় কোথায়? তার নিজের স্বার্থই সিদ্ধ হয় না; পরার্থে সে আবার কি করবে?

শিষ্য॥ তবে কি আমাদের উপায় নাই?

স্বামীজী॥ অবশ্য আছে। এ সনাতন ধর্মের দেশ। এদেশ পড়ে গেছে বটে, কিন্তু নিশ্চয় আবার উঠবে। এমন উঠবে যে, জগৎ দেখে অবাক হয়ে যাবে। দেখিসনি নদী বা সমুদ্রে তরঙ্গ যত নামে, তারপর সেটা তত জোরে ওঠে? এখানেও সেইরূপ হবে। দেখছিসনি—পূর্বাকাশে অরুণোদয় হয়েছে, সূর্য ওঠার আর বিলম্ব নেই? তোরা এই সময়ে কোমর বেঁধে লেগে যা—সংসার-ফংসার করে কি হবে? তোদের এখন কাজ হচ্ছে দেশে-দেশে গাঁয়ে-গাঁয়ে গিয়ে দেশের লোকদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, আর আলিস্যি করে বসে থাকলে চলছে না। শিক্ষাহীন ধর্মহীন বর্তমান অবনতিটার কথা তাদের বুঝিয়ে দিয়ে বলগে, ‘ভাই সব, ওঠ, জাগো। কতদিন আর ঘুমুবে?’ আর শাস্ত্রের মহান্ সত্যগুলি সরল করে তাদের বুঝিয়ে দিগে। এতদিন এদেশের ব্রাহ্মণেরা ধর্মটা একচেটে করে বসেছিল। কালের স্রোতে তা যখন আর টিকল না, তখন সেই ধর্মটা দেশের সকল লোকে যাতে পায়, তার ব্যবস্থা করগে। সকলকে বোঝাগে ব্রাহ্মণদের মত তোমাদেরও ধর্মে সমান অধিকার। আচণ্ডালকে এই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত কর। আর সোজা কথায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষি প্রভৃতি গৃহস্থজীবনের অত্যাবশ্যক বিষয়গুলি উপদেশ দিগে। নতুবা তোদের লেখাপড়াকেও ধিক, আর তোদের বেদবেদান্ত পড়াকেও ধিক।

শিষ্য॥ মহাশয়, আমাদের সে শক্তি কোথায়? আপনার শতাংশের একাংশ শক্তি থাকিলে নিজেও ধন্য হইতাম, অপরকেও ধন্য করিতে পারিতাম।

স্বামীজী॥ দূর মূর্খ! শক্তি-ফক্তি কেই কি দেয়? ও তোর ভেতরেই রয়েছে, সময় হলেই আপনা-আপনি বেরিয়ে পড়বে। তুই কাজে লেগে যা না; দেখবি এত শক্তি আসবে যে সামলাতে পারবিনি। পরার্থে এতটুকু কাজ করলে ভেতরের শক্তি জেগে ওঠে। পরের জন্য এতটুকু ভাবলে ক্রমে হৃদয়ে সিংহবলের সঞ্চার হয়। তোদের এত ভালবাসি, কিন্তু ইচ্ছা হয়, তোরা পরের জন্য খেটে খেটে মরে যা—আমি দেখে খুশী হই।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, যাহারা আমার উপর নির্ভর করিতেছে, তাহাদের কি হইবে?

স্বামীজী॥ তুই যদি পরের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হস তো ভগবান্ তাদের একটা উপায় করবেনই করবেন। ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি’—গীতায় পড়েছিস তো?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।

স্বামীজী॥ ত্যাগই হচ্ছে আসল কথা—ত্যাগী না হলে কেউ পরের জন্য ষোল আনা প্রাণ দিয়ে কাজ করতে পারে না। ত্যাগী সকলকে সমভাবে দেখে, সকলের সেবায় নিযুক্ত হয়। বেদান্তেও পড়েছিস, সকলকে সমানভাবে দেখতে হবে। তবে একটি স্ত্রী ও কয়েকটি ছেলেকে বেশী আপনার বলে ভাববি কেন? তোর দোরে স্বয়ং নারায়ণ কাঙালবেশে এসে অনাহারে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছেন, তাঁকে কিছু না দিয়ে খালি নিজের ও নিজের স্ত্রী-পুত্রদেরই উদর নানাপ্রকার চর্ব্য-চুষ্য দিয়ে পূর্তি করা—সে তো পশুর কাজ।

শিষ্য॥ মহাশয়, পরার্থে কার্য করিতে সময়ে সময়ে বহু অর্থের প্রয়োজন হয়; তাহা কোথায় পাইব?

স্বামীজী॥ বলি, যতটুকু ক্ষমতা আছে ততটুকুই আগে কর না। পয়সার অভাবে যদি কিছু নাই দিতে পারিস একটা মিষ্টি কথা বা দুটো সৎ উপদেশও তো তাদের শোনাতে পারিস। না—তাতেও তোর টাকার দরকার?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ, তা পারি।

স্বামীজী॥ ‘হাঁ পারি’ কেবল মুখে বললে হচ্ছে না। কি পারিস—তা কাজে আমায় দেখা, তবে তো জানব আমার কাছে আসা সার্থক। লেগে যা। কদিনের জন্য জীবন? জগতে যখন এসেছিস, তখন একটা দাগ রেখে যা। নতুবা গাছ-পাথরও তো হচ্ছে মরছে—ঐরূপ জন্মাতে মরতে মানুষের কখনও ইচ্ছা হয় কি? আমায় কাজে দেখা যে, তোর বেদান্ত পড়া সার্থক হয়েছে। সকলকে এই কথা শোনাগে—‘তোমাদের ভেতরে অনন্ত শক্তি রয়েছে, সে শক্তিকে জাগিয়ে তোল।’ নিজের মুক্তি নিয়ে কি হবে? মুক্তিকামনাও তো মহা স্বার্থপরতা। ফেলে দে ধ্যান, ফেলে দে মুক্তি-ফুক্তি। আমি যে কাজে লেগেছি, সেই কাজে লেগে যা।

শিষ্য অবাক হইয়া শুনিতে লাগিল। স্বামীজী বলিতে লাগিলেনঃ

তোরা ঐরূপে আগে জমি তৈরী করগে। আমার মত হাজার হাজার বিবেকানন্দ পরে বক্তৃতা করতে নরলোকে শরীর ধারণ করবে; তার জন্য ভাবনা নেই। এই দেখ্ না, আমাদের (শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যদের) ভেতর যারা আগে ভাবত তাদের কোন শক্তি নেই, তারাই এখন অনাথ-আশ্রম, দুর্ভিক্ষ-ফণ্ড কত কি খুলছে! দেখছিস না—নিবেদিতা ইংরেজের মেয়ে হয়েও তোদের সেবা করতে শিখেছে। আর তোরা তোদের নিজের দেশের লোকের জন্য তা করতে পারবিনি? যেখানে মহামারী হয়েছে, যেখানে জীবের দুঃখ হয়েছে, যেখানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে—চলে যা সেদিকে। নয়—মরেই যাবি। তোর আমার মত কত কীট হচ্ছে মরছে। তাতে জগতের কি আসছে যাচ্ছে? একটা মহান্ উদ্দেশ্য নিয়ে মরে যা। মরে তো যাবিই; তা ভাল উদ্দেশ্য নিয়েই মরা ভাল। এই ভাব ঘরে ঘরে প্রচার কর, নিজের ও দেশের মঙ্গল হবে। তোরাই দেশের আশা-ভরসা। তোদের কর্মহীন দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। লেগে যা—লেগে যা। দেরী করিসনি —মৃত্যু তো দিন দিন নিকটে আসছে। পরে করবি বলে আর বসে থাকিসনি—তা হলে কিছুই হবে না।

 

২৩

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮

 

শিষ্য॥ স্বামীজী, ব্রহ্ম যদি একমাত্র সত্য বস্তু হন, তবে জগতে এত বিচিত্রতা দেখা যায় কেন?

স্বামীজী॥ সত্যই হন বা আর যাই হন, ব্রহ্মবস্তুকে কে জানে বল্? জগৎটাকেই আমরা দেখি ও সত্য বলে দৃঢ় বিশ্বাস করে থাকি। তবে সৃষ্টিগত বৈচিত্র্যটাকে সত্য বলে স্বীকার করে বিচারপথে অগ্রসর হলে কালে একত্বমূলে পৌঁছান যায়। যদি সেই একত্বে অবস্থিত হতে পারতিস, তা হলে এই বিচিত্রতাটা দেখতে পেতিস না।

শিষ্য॥ মহাশয়, যদি একত্বেই অবস্থিত হইতে পারিব, তবে এই প্রশ্নই বা কেন করিব? আমি বিচিত্রতা দেখিয়াই যখন প্রশ্ন করিতেছি, তখন উহাকে সত্য বলিয়া অবশ্য মানিয়া লইতেছি।

স্বামীজী॥ বেশ কথা। সৃষ্টির বিচিত্রতা দেখে তাকে সত্য বলে মেনে নিয়ে একত্বের মূলানুসন্ধান করাকে শাস্ত্রে ‘ব্যতিরেকী বিচার’ বলে। অর্থাৎ অভাব বা অসত্য বস্তুকে ভাব বা সত্য বস্তু বলে ধরে নিয়ে বিচার করে দেখান যে, সেটা ভাব নয়—অভাব বস্তু। তুই ঐরূপে মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে সত্যে পৌঁছানর কথা বলছিস—কেমন?

শিষ্য॥ আজ্ঞা হাঁ, তবে আমি ভাবকেই সত্য বলি এবং ভাবরাহিত্যটাকেই মিথ্যা বলিয়া স্বীকার করি।

স্বামীজী॥ আচ্ছা। এখন দেখ, বেদ বলছে, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’, যদি বস্তুতঃ এক ব্রহ্মই থাকেন, তবে তোর নানাত্ব তো মিথ্যা হচ্ছে। বেদ মানিস তো?

শিষ্য॥ বেদের কথা আমি মানি বটে। কিন্তু যদি না মানে, তাহাকেও তো নিরস্ত করিতে হইবে?

স্বামীজী॥ তা ঠিক। জড়-বিজ্ঞান সহায়ে তাকে প্রথম বেশ করে বুঝিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় যে, ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষকেও আমরা বিশ্বাস করতে পারি না; ইন্দ্রিয়গুলিও ভুল সাক্ষ্য দেয় এবং যথার্থ সত্য বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির বাইরে রয়েছে। তারপর তাকে বলতে হয় মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়ের পারে যাবার উপায় আছে। তাকেই ঋষিরা ‘যোগ’ বলেছেন। যোগ অনুষ্ঠান-সাপেক্ষ, হাতে-নাতে করতে হয়। বিশ্বাস কর আর নাই কর, করলেই ফল পাওয়া যায়। করে দেখ—হয়, কি না হয়। আমি বাস্তবিকই দেখেছি—ঋষিরা যা বলছেন, সব সত্য। এই দেখ—তুই যাকে বিচিত্রতা বলছিস, তা এক সময় লুপ্ত হয়ে যায়—অনুভব হয় না। তা আমি নিজের জীবনে ঠাকুরের কৃপায় প্রত্যক্ষ করেছি।

শিষ্য॥ কখন ঐরূপ করিয়াছেন?

স্বামীজী॥ একদিন ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরের বাগানে আমায় ছুঁয়ে দিয়েছিলেন; দেবামাত্র দেখলুম ঘরবাড়ী, দোর-দালান, গাছপালা, চন্দ্র-সূর্য—সব যেন আকাশে লয় পেয়ে যাচ্ছে। ক্রমে আকাশও যেন কোথায় লয় পেয়ে গেল। তারপর কি যে প্রত্যক্ষ হয়েছিল, কিছুই স্মরণ নেই; তবে মনে আছে, ঐরূপ দেখে বড় ভয় হয়েছিল—চীৎকার করে ঠাকুরকে বলেছিলুম, ‘ওগো, তুমি আমার কি করছ গো, আমার যে বাপ-মা আছে!’ ঠাকুর তাতে হাসতে হাসতে ‘তবে এখন থাক্’ বলে ফের ছুঁয়ে দিলেন। তখন ক্রমে আবার দেখলুম—ঘরবাড়ী দোর-দালান যা যেমন সব ছিল, ঠিক সেই রকম রয়েছে! আর একদিন আমেরিকার একটি lake-এর (হ্রদের) ধারে ঠিক ঐরূপ হয়েছিল। শিষ্য॥ (অবাক হইয়া) আচ্ছা মহাশয়, ঐরূপ অবস্থা মস্তিষ্কের বিকারেও তো হইতে পারে? আর এক কথা, ঐ অবস্থাতে আপনার বিশেষ আনন্দ উপলব্ধি হইয়াছিল কি?

স্বামীজী॥ যখন রোগের খেয়ালে নয়, নেশা করে নয়, রকম-বেরকমের দম টেনেও নয়, সহজ মানুষের সুস্থাবস্থায় এ অবস্থা হয়ে থাকে, তখন তাকে মস্তিষ্কের বিকার কি করে বলবি, বিশেষতঃ যখন আবার ঐরূপ অবস্থালাভের কথা বেদের সঙ্গে মিলছে, পূর্ব পূর্ব আচার্য ও ঋষিগণের আপ্তবাক্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? আমায় কি শেষে তুই বিকৃতমস্তিষ্ক ঠাওরালি?

শিষ্য॥ না মহাশয়, আমি তাহা বলিতেছি না। শাস্ত্রে যখন শত শত এরূপ একত্বানুভূতির দৃষ্টান্ত রহিয়াছে, আপনি যখন বলিতেছেন যে ইহা করামলকবৎ প্রত্যক্ষসিদ্ধ, আর আপনার অপরোক্ষানুভূতি যখন বেদাদি শাস্ত্রোক্ত বাক্যের অবিসংবাদী, তখন ইহাকে মিথ্যা বলিতে সাহস হয় না। শ্রীশঙ্করাচার্যও বলিয়াছেন—‘ক্ব গতং কেন বা নীতং’৫৫ ইত্যাদি।

স্বামীজী॥ জানবি, এই একত্বজ্ঞান—যাকে তোদের শাস্ত্রে ব্রহ্মানুভূতি বলে—তা হলে জীবের আর ভয় থাকে না, জন্মমৃত্যুর পাশ ছিন্ন হয়ে যায়। এই হেয় কামকাঞ্চনে বদ্ধ হয়ে জীব সে ব্রহ্মানন্দ লাভ করতে পারে না। সেই পরমানন্দ পেলে জগতের সুখদুঃখে জীব আর অভিভূত হয় না।

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, যদি তাহাই হয় এবং আমরা যদি যথার্থ পূর্ণব্রহ্মস্বরূপই হই, তাহা হইলে ঐরূপে সমাধিতে সুখলাভে আমাদের যত্ন হয় না কেন? আমরা তুচ্ছ কামকাঞ্চনের প্রলোভনে পড়িয়া বারবার মৃত্যুমুখে ধাববান হইতেছি কেন?

স্বামীজী॥ তুই মনে করছিস, জীবের সে শান্তিলাভে আগ্রহ নেই বুঝি? একটু ভেবে দেখ—বুঝতে পারবি, যে যা করছে, সে তা ভূমা সুখের আশাতেই করছে। তবে সকলে ঐ কথা বুঝে উঠতে পারছে না। সে পরমানন্দলাভের ইচ্ছা আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলের ভেতর পূর্ণভাবে রয়েছে। আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মও সকলের অন্তরের অন্তরে রয়েছেন। তুইও সেই পূর্ণব্রহ্ম। এই মুহূর্তে—ঠিক ঠিক ভাবলেই ঐ কথার অনুভূতি হয়। কেবল অনুভূতির অভাব মাত্র। তুই যে চাকরি করে স্ত্রী-পুত্রের জন্য এতে খাটছিস, তার উদ্দেশ্যও সেই সচ্চিদানন্দলাভ। সেই মোহের মারপেঁচে পড়ে ঘা খেয়ে ক্রমশঃ স্ব-স্বরূপে নজর আসবে। বাসনা আছে বলেই ধাক্কা খাচ্ছিস ও খাবি। ঐরূপে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি পড়বে—সকলেরই এক সময় পড়বেই পড়বে। তবে কারও এ জন্মে, কারও বা লক্ষ জন্ম পরে।

শিষ্য॥ সে চৈতন্য হওয়া—মহাশয়, আপনার আশীর্বাদ ও ঠাকুরের কৃপা না হইলে কখনও হইবে না।

স্বামীজী॥ ঠাকুরের কৃপা-বাতাস তো বইছেই। তুই পাল তুলে দে না। যখন যা করবি, খুব একান্তমনে করবি। দিনরাত ভাববি, আমি সচ্চিদানন্দস্বরূপ—আমার আবার ভয়-ভাবনা কি? এই দেহ মন বুদ্ধি—সবই ক্ষণিক; এর পারে যা, তাই আমি।

শিষ্য॥ ঐ ভাব ক্ষণিক আসিলেও আবার তখনই উড়িয়া যায় এবং ছাইভস্ম সংসার ভাবি।

স্বামীজী॥ ও-রকম প্রথম প্রথম হয়ে থাকে; ক্রমে শুধরে যাবে। তবে মনের খুব তীব্রতা, ঐকান্তিক ইচ্ছা চাই। ভাববি—যে আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব, আমি কি কখনও অন্যায় কাজ করতে পারি? আমি কি সামান্য কামকাঞ্চনলোভে পড়ে সাধারণ জীবের মত মুগ্ধ হতে পারি? মনে এমনি করে জোর করবি; তবে তো ঠিক কল্যাণ হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, এক একবার মনের বেশ জোর হয়। আবার ভাবি, ডেপুটিগিরির জন্য পরীক্ষা দিব—ধন মান হবে, বেশ মজায় থাকব।

স্বামীজী॥ মনে যখন ও-সব আসবে, তখন বিচার করবি। তুই তো বেদান্ত পড়েছিস? ঘুমুবার সময়ও বিচারের তরোয়ালখানা শিয়রে রেখে ঘুমুবি, যেন স্বপ্নেও লোভ সামনে না এগোতে পারে। এইরূপে জোর করে বাসনা ত্যাগ করতে করতে ক্রমে যথার্থ বৈরাগ্য আসবে, তখন দেখবি স্বর্গের দ্বার খুলে গেছে।

শিষ্য॥ আচ্ছা স্বামীজী, ভক্তিশাস্ত্রে যে বলে বেশী বৈরাগ্য হলে ভাব থাকে না।

স্বামীজী॥ আরে ফেলে দে তোর সে ভক্তিশাস্ত্র, যাতে ও-রকম কথা আছে। বৈরাগ্য-বিষয়বিতৃষ্ণা না হলে, কাকবিষ্ঠার ন্যায় কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ না করলে ‘ন সিধ্যতি ব্রহ্মশতান্তরেঽপি’—ব্রহ্মার কোটিকল্পেও জীবের মুক্তি নেই। জপ, ধ্যান, পূজা, হোম, তপস্যা কেবল তীব্র বৈরাগ্য আনবার জন্য। তা যার হয়নি, তার জানবি—নোঙর ফেলে নৌকায় দাঁড় টানার মত হচ্ছে! ‘ন ধনেন ন চেজ্যয়া, ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ।’

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, কামকাঞ্চনত্যাগ হইলেই কি সব হইল?

স্বামীজী॥ ও দুটো ত্যাগের পরও অনেক লেঠা আছেন! এই যেমন, তারপর আসেন লোকখ্যাতি! সেটা যে-সে লোক সামলাতে পারে না। লোকে মান দিতে থাকে, নানা ভোগ এসে জোটে। এতেই ত্যাগীদের মধ্যে বার আনা লোক বাঁধা পড়ে। এই যে মঠ-ফঠ করছি, নানা রকমের পরার্থে কাজ করে সুখ্যাতি হচ্ছে—কে জানে, আমাকেই বা আবার ফিরে আসতে হয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনিই ঐ কথা বলিতেছেন, তবে আমরা আর যাই কোথায়?

স্বামীজী॥ সংসারে রয়েছিস, তাতে ভয় কি? ‘অভীরভীরভীঃ’—ভয় ত্যাগ কর। নাগ-মহাশয়কে দেখেছিস তো?—সংসারে থেকেও সন্ন্যাসীর বাড়া! এমনটি বড় একটা দেখা যায় না। গেরস্ত যদি কেউ হয় তো যেন নাগ-মহাশয়ের মত হয়। নাগ-মহাশয় পূর্ববঙ্গ আলো করে বসে আছেন। ওদেশের লোকদের বলবি—যেন তাঁর কাছে যায়, তা হলে তাদের কল্যাণ হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, যথার্থ কথাই বলিয়াছেন; নাগ-মহাশয় শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলাসহচর, তাঁকে জীবন্ত দীনতা বলিয়া বোধ হয়!

স্বামীজী॥ তা একবার বলতে? আমি তাঁকে একবার দর্শন করতে যাব। তুইও যাবি? জলে ভেসে গেছে, এমন মাঠ দেখতে আমার এক এক সময়ে বড় ইচ্ছা হয়। আমি যাব, দেখব। তুই তাঁকে লিখিস।

শিষ্য॥ আমি লিখিয়া দিব। আপনার দেওভোগ যাইবার কথা শুনিলে তিনি আনন্দে উন্মাদপ্রায় হইবেন। বহুপূর্বে আপনার একবার যাইবার কথা হইয়াছিল, তাহাতে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গ আপনার চরণধূলিতে তীর্থ হইয়া যাইবে।’

স্বামীজী॥ জানিস তো, নাগ-মহাশয়কে ঠাকুর বলতেন, ‘জ্বলন্ত আগুন।’

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ, তা শুনিয়াছি।

স্বামীজী॥ অনেক রাত হয়েছে, তবে এখন আয়—কিছু খেয়ে যা।

শিষ্য॥ যে আজ্ঞা।

অনন্তর কিছু প্রসাদ পাইয়া শিষ্য কলিকাতা যাইতে যাইতে ভাবিতে লাগিলঃ স্বামীজী কি অদ্ভুত পুরুষ—যেন সাক্ষাৎ জ্ঞানমূর্তি আচার্য শঙ্কর!

 

২৪

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮

 

শিষ্য॥ স্বামীজী, জ্ঞান ও ভক্তির সামঞ্জস্য কিরূপে হইতে পারে? দেখিতে পাই, ভক্তিপথাবলম্বিগণ আচার্য শঙ্করের নাম শুনিলে কানে হাত দেন, আবার জ্ঞানমার্গীরা ভক্তদের আকুল ক্রন্দন, উল্লাস ও নৃত্যগীতাদি দেখিয়া বলেন, ওরা পাগলবিশেষ।

স্বামীজী॥ কি জানিস, গৌণ জ্ঞান ও গৌণ ভক্তি নিয়েই কেবল বিবাদ উপস্থিত হয়। ঠাকুরের সেই ভূত-বানরের গল্প শুনেছিস

তো?৫৬

শিষ্য॥ আজ্ঞা

স্বামীজী॥ কিন্তু মুখ্যা ভক্তি ও মুখ্য জ্ঞানে কোন প্রভেদ নেই। মুখ্যা ভক্তি মানে হচ্ছে—ভগবান্‌কে প্রেমস্বরূপ উপলব্ধি করা। তুই যদি সর্বত্র সকলের ভেতরে ভগবানের প্রেমমূর্তি দেখতে পাস তো কার ওপর আর হিংসাদ্বেষ করবি? সেই প্রেমানুভূতি এতটুকু বাসনা—ঠাকুর যাকে বলতেন ‘কামকাঞ্চনাসক্তি’—থাকতে হবার যো নেই। সম্পূর্ণ প্রেমানুভূতিতে দেহবুদ্ধি পর্যন্ত থাকে না। আর মুখ্য জ্ঞানের মানে হচ্ছে সর্বত্র একত্বানুভূতি, আত্মস্বরূপের সর্বত্র দর্শন। তাও এতটুকু অহংবুদ্ধি থাকতে হবার যো নেই।

শিষ্য॥ তবে আপনি যাহাকে প্রেম বলেন, তাহাই কি পরমজ্ঞান?

স্বামীজী॥ তা বৈকি! পূর্ণপ্রজ্ঞ না হলে কারও প্রেমানুভূতি হয় না। দেখছিস তো বেদান্তশাস্ত্রে ব্রহ্মকে ‘সচ্চিদানন্দ’ বলে। ঐ সচ্চিদানন্দ শব্দের মানে হচ্ছে—‘সৎ’ অর্থাৎ অস্তিত্ব, ‘চিৎ’ অর্থাৎ চৈতন্য বা জ্ঞান, আর ‘আনন্দ’ই প্রেম। ভগবানের সৎ-ভাবটি নিয়ে ভক্ত ও জ্ঞানীর মধ্যে কোন বিবাদ-বিসংবাদ নেই। কিন্তু জ্ঞানমার্গী ব্রহ্মের চিৎ বা চৈতন্য-সত্তাটির ওপরেই সর্বদা বেশী ঝোঁক দেয়, আর ভক্তগণ আনন্দ-সত্তাটিই সর্বক্ষণ নজরে রাখে। কিন্তু চিৎস্বরূপ অনুভূতি হবামাত্র আনন্দস্বরূপেরও উপলব্ধি হয়। কারণ যা চিৎ, তা-ই যে আনন্দ।

শিষ্য॥ তবে ভারতবর্ষে এত সাম্প্রদায়িক ভাব প্রবল কেন এবং ভক্তি ও জ্ঞান-শাস্ত্রেই বা এত বিরোধ কেন?

স্বামীজী॥ কি জানিস, গৌণভাব নিয়েই অর্থাৎ যে ভাবগুলো ধরে মানুষ ঠিক জ্ঞান বা ঠিক ভক্তি লাভ করতে অগ্রসর হয়, সেইগুলো নিয়েই যত লাঠালাঠি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তোর কি বোধ হয়? End (উদ্দেশ্য) বড়, কি means (উপায়গুলো) বড়? নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য থেকে উপায় কখনও বড় হতে পারে না। কেন না, অধিকারিভেদে একই উদ্দেশ্যলাভ নানবিধ উপায়ে হয়। এই যে দেখছিস—জপ ধ্যান পূজা হোম ইত্যাদি ধর্মের অঙ্গ, এগুলি সবই হচ্ছে উপায়। আর পরাভক্তি বা পরব্রহ্মস্বরূপকে দর্শনই হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। অতএব একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবি—বিবাদ হচ্ছে কি নিয়ে। একজন বলছেন—পুবমুখো হয়ে বসে ভগবান্‌কে ডাকলে তবে তাঁকে পাওয়া যায়; আর একজন বলছেন—না, পশ্চিমমুখো হয়ে বসতে হবে, তবেই তাঁকে পাওয়া যাবে। হয়তো একজন বহুকাল পূর্বে পুবমুখো হয়ে বসে ধ্যানভজন করে ঈশ্বরলাভ করেছিলেন; তাঁর চেলারা তাই দেখে অমনি ঐ মত চালিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, পুবমুখো হয়ে না বসলে ঈশ্বরলাভ কখনই হবে না। আর একদল বললে—সে কি কথা? পশ্চিমমুখো বসে অমুক ভগবান্‌ লাভ করেছে, আমরা শুনেছি যে! আমরা তোদের ঐ মত মানি না। এইরূপে সব দল বেঁধেছে। একজন হয়তো হরিনাম জপ করে পরাভক্তি লাভ করেছিলেন; অমনি শাস্ত্র তৈরী হল—‘নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।’ কেউ আবার ‘আল্লা’ বলে সিদ্ধ হলেন, তখনি তার আর এক মত চলতে লাগল। আমাদের এখন দেখতে হবে—এই সকল জপ-পূজাদির খেই (আরম্ভ) কোথায়। সে খেই হচ্ছে শ্রদ্ধা; সংস্কৃতভাষায় ‘শ্রদ্ধা’ কথাটি বোঝাবার মত শব্দ আমাদের ভাষায় নেই। উপনিষদে আছে, ঐ শ্রদ্ধা নচিকেতার হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। ‘একাগ্রতা’ কথাটির দ্বারাও শ্রদ্ধা-কথার সমুদয় ভাবটুকু প্রকাশ করা যায় না। বোধ হয় ‘একাগ্রনিষ্ঠা’ বললে সংস্কৃত শ্রদ্ধা-কথাটার অনেকটা কাছাকাছি মানে হয়। নিষ্ঠার সহিত একাগ্রমনে যে-কোন তত্ত্ব হোক না, ভাবতে থাকলেই দেখতে পাবি, মনের গতি ক্রমেই একত্বের দিকে চলছে বা সচ্চিদানন্দ-স্বরূপের অনুভূতির দিকে যাচ্ছে। ভক্তি এবং জ্ঞান-শাস্ত্র উভয়েই ঐরূপ এক একটি নিষ্ঠা জীবনে আনবার জন্য মানুষকে বিশেষভাবে উপদেশ করছে। যুগ-পরম্পরায় বিকৃত ভাব ধারণ করে সেইসব মহান্ সত্য ক্রমে দেশাচারে পরিণত হয়েছে। শুধু যে তোদের ভারতবর্ষে ঐরূপ হয়েছে তা নয়-পৃথিবীর সকল জাতিতে ও সকল সমাজেই ঐরূপ হয়েছে। আর বিচারবিহীন সাধারণ জীব ঐগুলো নিয়ে সেই অবধি বিবাদ করে মরছে, খেই হারিয়ে ফেলেছে; তাই এত লাঠালাঠি চলেছে।

শিষ্য॥ মহাশয়, তবে এখন উপায় কি?

স্বামীজী॥ পূর্বের মত ঠিক ঠিক শ্রদ্ধা আনতে হবে। আগাছাগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। সকল মতে সকল পথেই দেশকালাতীত সত্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেগুলোর উপর অনেক আবর্জনা পড়ে গেছে। সেগুলো সাফ করে ঠিক ঠিক তত্ত্বগুলি লোকের সামনে ধরতে হবে; তবেই তোদের ধর্মের ও দেশের মঙ্গল হবে।

শিষ্য॥ কেমন করিয়া উহা করিতে হইবে?

স্বামীজী॥ কেন? প্রথমতঃ মহাপুরুষদের পূজা চালাতে হবে। যাঁরা সেইসব সনাতন তত্ত্ব প্রত্যক্ষ করে গেছেন, তাঁদের—লোকের কাছে ideal (আদর্শ বা ইষ্ট)-রূপে খাড়া করতে হবে। যেমন ভারতবর্ষে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, মহাবীর ও শ্রীরামকৃষ্ণ। দেশে শ্রীরামচন্দ্র ও মহাবীরের পূজা চালিয়ে দে দিকি। বৃন্দাবনলীলা-ফীলা এখন রেখে দে। গীতাসিংহনাদকারী শ্রীকৃষ্ণের পূজা চালা, শক্তিপূজা চালা।

শিষ্য॥ কেন, বৃন্দাবনলীলা মন্দ কি?

স্বামীজী॥ এখন শ্রীকৃষ্ণের ঐরূপ পূজায় তোদের দেশে ফল হবে না। বাঁশী বাজিয়ে এখন আর দেশের কল্যাণ হবে না। এখন চাই মহাত্যাগ, মহানিষ্ঠা, মহাধৈর্য এবং স্বার্থগন্ধশূন্য শুদ্ধবুদ্ধি-সহায়ে মহা উদ্যম প্রকাশ করে সকল বিষয় ঠিক ঠিক জানবার জন্য উঠে পড়ে লাগা।

শিষ্য॥ মহাশয়, তবে আপনার মতে বৃন্দাবন-লীলা কি সত্য নহে?

স্বামীজী॥ তা কে বলছে? ঐ লীলার ঠিক ঠিক ধারণা ও উপলব্ধি করতে বড় উচ্চ সাধনার প্রয়োজন। এই ঘোর কাম-কাঞ্চনাসক্তির সময় ঐ লীলার উচ্চ ভাব কেউ ধারণা করতে পারবে না।

শিষ্য॥ মহাশয়, তবে কি আপনি বলতে চাহেন, যাহারা মধুর-সখ্যাদি ভাব-অবলম্বনে এখন সাধনা করিতেছে, তাহারা কেহই ঠিক পথে যাইতেছে না?

স্বামীজী॥ আমার তো বোধ হয় তাই—বিশেষতঃ আবার যারা মধুরভাবের সাধক বলে পরিচয় দেয়, তারা; তবে দু-একটি ঠিক ঠিক লোক থাকলেও থাকতে পারে। বাকী সব জানবি ঘোর তমোভাবাপন্ন—full of morbidity (মানসিক দুর্বলতা-সমাচ্ছন্ন)! তাই বলছি, দেশটাকে এখন তুলতে হলে মহাবীরের পূজা চালাতে হবে, শক্তিপূজা চালাতে হবে, শ্রীরামচন্দ্রের পূজা ঘরে ঘরে করতে হবে। তবে তোদের এবং দেশের কল্যাণ। নতুবা উপায় নেই।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, শুনিয়াছি ঠাকুর (শ্রীরামকৃষ্ণদেব) তো সকলকে লইয়া সংকীর্তনে বিশেষ আনন্দ করিতেন।

স্বামীজী॥ তার কথা স্বতন্ত্র। তাঁর সঙ্গে জীবের তুলনা হয়? তিনি সব মতে সাধন করে দেখিয়েছেন—সকলগুলিই এক তত্ত্বে পৌঁছে দেয়। তিনি যা করেছেন, তা কি তুই আমি করতে পারব? তিনি যে কে ও কত বড়, তা আমরা কেউই এখনও বুঝতে পারিনি! এজন্যই আমি তাঁর কথা যেখানে সেখানে বলি না। তিনি যে কি ছিলেন, তা তিনিই জানতেন; তাঁর দেহটাই কেবল মানুষের মত ছিল. কিন্তু চালচলন সব স্বতন্ত্র অমানুষিক ছিল!

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, আপনি তাঁহাকে অবতার বলিয়া মানেন কি?

স্বামীজী॥ তোর অবতার কথাটার মানেটা কি? তা আগে বল?

শিষ্য॥ কেন? যেমন শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীগৌরাঙ্গ, বুদ্ধ, ঈশা ইত্যাদি পুরুষের মত পুরুষ।

স্বামীজী॥ তুই যাঁদের নাম করলি, আমি ঠাকুর (শ্রীরামকৃষ্ণ)-কে তাঁদের সকলের চেয়ে বড় বলে জানি—মানা তো ছোট কথা। থাক এখন সে কথা, একটুকুই এখন শুনে রাখ—সময় ও সমাজ-উপযোগী এক এক মহাপুরুষের আসেন ধর্ম উদ্ধার করতে। তাঁদের মহাপুরুষ বল বা অবতার বল, তাতে কিছুই আসে যায় না। তাঁরা সংসারে এসে জীবনকে নিজ জীবন গঠন করবার ideal (আদর্শ) দেখিয়ে যান। যিনি যখন আসেন, তখন তাঁর ছাঁচে গড়ন চলতে থাকে, মানুষ তৈরী হয় এবং সম্প্রদায় চলতে থাকে। কালে ঐ-সকল সম্প্রদায় বিকৃত হলে আবার ঐরূপ অন্য সংস্কারক আসেন। এই প্রথা প্রবাহরূপে চলে আসছে।

শিষ্য॥ মহাশয়, তবে আপনি ঠাকুরকে অবতার বলে ঘোষণা করেন না কেন? আপনার তো শক্তি—বাগ্মিতা যথেষ্ট আছে।

স্বামীজী॥ তার কারণ, আমি তাঁকে অল্পই বুঝেছি। তাঁকে এত বড় মনে হয় যে, তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে আমার ভয় হয়—পাছে সত্যের অপলাপ হয়, পাছে আমার এই অল্পশক্তিতে না কুলোয়, বড় করতে গিয়ে তাঁর ছবি আমার ঢঙে এঁকে তাঁকে পাছে ছোট করে ফেলি!

শিষ্য॥ আজকাল অনেকে তো তাঁহাকে অবতার বলিয়া প্রচার করিতেছে!

স্বামীজী॥ তা করুক। যে যেমন বুঝেছে, সে তেমন করছে। তোর ঐরূপ বিশ্বাস হয় তো তুইও কর।

শিষ্য॥ আমি আপনাকেই সম্যক বুঝিতে পারি না, তা আবার ঠাকুরকে! মনে হয়, আপনার কৃপাকণা পাইলেই আমি এ জন্মে ধন্য হইব।

অদ্য এইখানেই কথার পরিসমাপ্তি হইল এবং শিষ্য স্বামীজীর পদধূলি লইয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলে।

 

২৫

স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮

 

শিষ্য॥ স্বামীজী! ঠাকুর বলিতেন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করিলে ধর্মপথে অগ্রসর হওয়া যায় না। তবে যাহারা গৃহস্থ, তাহাদের উপায় কি? তাহাদের তো দিনরাত ঐ উভয় লইয়াই ব্যস্ত থাকিতে হয়।

স্বামীজী॥ কাম-কাঞ্চনের আসক্তি না গেলে ঈশ্বরে মন যায় না, তা গেরস্তই হোক আর সন্ন্যাসীই হোক। ঐ দুই বস্তুতে যতক্ষণ মন আছে, জানবি—ততক্ষণ ঠিক ঠিক অনুরাগ, নিষ্ঠা বা শ্রদ্ধা কখনই আসবে না।

শিষ্য॥ তবে গৃহস্থদিগের উপায়?

স্বামীজী॥ উপায় হচ্ছে ছোটখাট বাসনাগুলিকে পূর্ণ করে নেওয়া, আর বড় বড়গুলিকে বিচার করে ত্যাগ করা। ত্যাগ ভিন্ন ঈশ্বরলাভ হবে না, ‘যদি ব্রহ্মা স্বয়ং বদেৎ’—বেদকর্তা ব্রহ্মা স্বয়ং তা বললেও হবে না।

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেই কি বিষয়-ত্যাগ হয়?

স্বামী। তা কি কখনও হয়? তবে সন্ন্যাসীরা কাম-কাঞ্চন সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে প্রস্তুত হচ্ছে, চেষ্টা করছে; আর গেরস্তরা নোঙর ফেলে নৌকায় দাঁড় টানছে—এই প্রভেদ। ভোগের সাধ কখনও মেটে কি রে? ‘ভূয় এবাভিবর্ধতে’—দিন দিন বাড়তেই থাকে।

শিষ্য॥ কেন? ভোগ করিয়া করিয়া বিরক্ত হইলে শেষে তো বিতৃষ্ণা আসিতে পারে?

স্বামীজী॥ দূর ছোঁড়া, তা ক-জনের আসতে দেখেছিস? ক্রমাগত বিষয়ভোগ করতে থাকলে, মনে সেই-সব বিষয়ের ছাপ পড়ে যায়, দাগ পড়ে যায়, মন বিষয়ের রঙে র’ঙে যায়। ত্যাগ, ত্যাগ—এই হচ্ছে মূলমন্ত্র।

শিষ্য॥ কেন মহাশয়, ঋষিবাক্য তো আছে—‘গৃহেষু পঞ্চেন্দ্রিয়-নিগ্রহস্তপঃ, নিবৃত্তরাগস্য গৃহং তপোবনম্’—গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া ইন্দ্রিয়সকলকে বিষয় অর্থাৎ রূপরসাদি-ভোগ হইতে বিরত রাখাকেই তপস্যা বলে; বিষয়ের প্রতি অনুরাগ দূর হইলে গৃহই তপোবনে পরিণত হয়।

স্বামীজী॥ গৃহে থেকে যারা কাম-কাঞ্চন ত্যাগ করতে পারে, তারা ধন্য; কিন্তু তা ক-জনের হয়?

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, আপনি তো ইতঃপূর্বেই বলিলেন যে, সন্ন্যাসীদের মধ্যেও অধিকাংশের সম্পূর্ণরূপে কামকাঞ্চন-ত্যাগ হয় নাই।

স্বামীজী॥ তা বলেছি; কিন্তু এ-কথাও বলেছি যে, তারা ত্যাগের পথে চলেছে; তারা কামকাঞ্চনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। গেরস্তদের এখনও কামকাঞ্চনাসক্তিটাকে বিপদ বলেই ধারণা হয়নি, আত্মোন্নতির চেষ্টাই হচ্ছে না। ওটার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করতে হবে, এ ভাবনাই এখনও আসেনি।

শিষ্য॥ কেন মহাশয়, তাহাদিগের মধ্যেও তো অনেকেই ঐ আসক্তি ত্যাগ করিতে চেষ্টা করিতেছে?

স্বামীজী॥ যারা করছে, তারা অবশ্য ক্রমে ত্যাগী হবে; তাদেরও কামকাঞ্চনাসক্তি ক্রমে কমে যাবে। কিন্তু কি জানিস—‘যাচ্ছি যাব, হচ্ছে হবে’ যারা এইরূপে চলেছে, তাদের আত্মদর্শন এখনও অনেক দূর। ‘এখনই ভগবান্‌ লাভ করব, এই জন্মেই করব’—এই হচ্ছে বীরের কথা। ঐরূপ লোকে এখনই সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়; শাস্ত্র তাদের সম্বন্ধেই বলেছেন, ‘যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্রব্রজেৎ’—যখনই বৈরাগ্য আসবে, তখনই সংসার ত্যাগ করবে।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, ঠাকুর তো বলিতেন—ঈশ্বরের কৃপা হইলে, তাঁহাকে ডাকিলে তিনি এইসকল আসক্তি এক দণ্ডে কাটাইয়া দেন।

স্বামীজী॥ হাঁ, তাঁর কৃপা হলে হয় বটে, কিন্তু তাঁর কৃপা পেতে হলে আগে শুদ্ধ পবিত্র হওয়া চাই; কায়মনোবাক্যে পবিত্র হওয়া চাই, তবেই তাঁর কৃপা হয়।

শিষ্য॥ কিন্তু কায়মনোবাক্যে সংযম করিতে পারিলে কৃপার আর দরকার কি? তাহা হইলে তো আমি নিজেই নিজের চেষ্টায় আত্মোন্নতি করিলাম।

স্বামীজী॥ তুই প্রাণপণে চেষ্টা করছিস দেখে তবে তাঁর কৃপা হয়। Struggle (উদ্যম বা পুরুষকার) না করে বসে থাক, দেখবি কখনও কৃপা হবে না।

শিষ্য॥ ভাল হইব, ইহা বোধ হয় সকলেরই ইচ্ছা; কিন্তু কি দুর্লক্ষ্য সূত্রে যে মন নীচগামী হয়, তাহা বলিতে পারি না; সকলেরই কি মনে ইচ্ছা হয় না যে, আমি সৎ হইব, ভাল হইব, ঈশ্বর লাভ করিব?

স্বামীজী॥ যাদের ভেতর ওরূপ ইচ্ছা হয়েছে, তাদের ভেতর জানবি Struggle (উদ্যম বা চেষ্টা) এসেছে এবং ঐ চেষ্টা করতে করতেই ঈশ্বরের দয়া হয়।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, অনেক অবতার-জীবনে তো ইহাও দেখা যায়—যাহাদের আমরা ভয়ানক পাপী ব্যভিচারী ইত্যাদি মনে করি, তাহারাও সাধনভজন না করিয়া তাঁহাদের কৃপায় অনায়াসে ঈশ্বরলাভে সক্ষম হইয়াছিল—ইহার অর্থ কি?

স্বামীজী॥ জানবি—তাদের ভেতর ভয়ানক অশান্তি এসেছিল, ভোগ করতে করতে বিতৃষ্ণা এসেছিল, অশান্তিতে তাদের হৃদয় জ্বলে যাচ্ছিল; হৃদয়ে এত অভাব বোধ হচ্ছিল যে, একটা শান্তি না পেলে তাদের দেহ ছুটে যেত। তাই ভগবানের দয়া হয়েছিল। তমোগুণের ভেতর দিয়ে ঐ-সকল লোক ধর্মপথে উঠেছিল।

শিষ্য॥ তমোগুণ বা যাহাই হউক, কিন্তু ঐ ভাবেই তো তাহাদের ঈশ্বরলাভ হইয়াছিল?

স্বামীজী॥ হাঁ, তা হবে না কেন? কিন্তু পায়খানার দোর দিয়ে না ঢুকে সদর দোর দিয়ে বাড়ীতে ঢোকা ভাল নয় কি? এবং ঐ পথেও তো ‘কি করে মনের এ অশান্ত দূর করি’—এইরূপ একটা বিষম হাঁকপাকানি ও চেষ্টা আছে।

শিষ্য॥ তাহা ঠিক, তবে আমার মনে হয়, যাহারা ইন্দ্রিয়াদি দমন ও কাম-কাঞ্চন ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরলাভ করিতে উদ্যত, তাহারা পুরুষকারবাদী ও স্বাবলম্বী; এবং যাহারা কেবলমাত্র তাঁহার নামে বিশ্বাস ও নির্ভর করিয়া পড়িয়া আছে, তাহাদের কাম-কাঞ্চনাসক্তি তিনিই কালে দূর করিয়া অন্তে পরম পদ দেন।

স্বামীজী॥ হাঁ, তবে ঐরূপ লোক বিরল; সিদ্ধ হবার পর লোকে এদেরই ‘কৃপাসিদ্ধ’ বলে। জ্ঞানী ও ভক্ত—এ উভয়েরই মতে কিন্তু ত্যাগই হচ্ছে মূলমন্ত্র।

শিষ্য॥ তাহাতে আর সন্দেহ কি! শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় একদিন আমায় বলিয়াছিলেন, ‘কৃপাপক্ষে কোন নিয়ম নেই; যদি থাকে তবে তাকে কৃপা বলা যায় না। সেখানে সবই বে-আইনী কারখানা।’

স্বামীজী॥ তা নয় রে, তা নয়; ঘোষজ যেখানকার কথা বলেছে, সেখানেও আমাদের অজ্ঞাত একটা আইন বা নিয়ম আছেই আছে। বে-আইনী কারখানাটা হচ্ছে শেষ কথা, দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত স্থানের কথা; সেখান Law of Causation (কার্য-কারণ-সম্বন্ধে) নেই, কাজেই সেখানে কে কারে কৃপা করবে? সেখানে সেব্য-সেবক, ধ্যাতা-ধ্যেয়, জ্ঞাতা-জ্ঞেয় এক হয়ে যায়—সব সমরস।

শিষ্য॥ আজ তবে আসি। আপনার কথা শুনিয়া আজ বেদ-বেদান্তের সার বুঝা হইল; এতদিন কেবল বাগাড়ম্বর মাত্র করা হইতেছিল।

স্বামীজীর পদধূলি লইয়া শিষ্য কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইল।