২৫. পত্রাবলী ৩৫৫-৩৬৪

৩৫৫

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

দেউলধার, আলমোড়া
১৩ জুলাই, ১৮৯৭

প্রেমাস্পদেষু,
এখান হইতে আলমোড়ায় যাইয়া যোগেন-ভায়ার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ভায়া একটু আরাম বোধ করিয়াই দেশে যাত্রা করিলেন। সুভালা-ভ্যালি পৌঁছে সংবাদ দিবেন।… ডাণ্ডি আদি পাওয়া অসম্ভব বিধায় লাটুর যাওয়া হইল না। আমি ও অচ্যুত পুনরায় এ স্থানে আসিয়াছি। আমার শরীর এই ঘোড়ার পিঠে রৌদ্রে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ের দরুন একটু আজ খারাপ আছে। শশীবাবুর ঔষধ প্রায় দুই সপ্তাহ খাইলাম—বিশেষ কিছুই দেখি না।—লিভারের বেদনাটা গিয়াছে ও খুব কসরত করার দরুন হাত-পা বিশেষ muscular (পেশীবহুল) হইয়াছে, কিন্তু পেটটা বিষম ফুলিতেছেঃ উঠতে বসতে হাঁপ ধরে। বোধ হয় দুধ খাওয়াই তার কারণ। শশীকে জিজ্ঞাসা করিবে যে, দুগ্ধ ছাড়িয়া দেওয়া যায় কিনা। পূর্বে আমার দুইবার sun-stroke (সর্দি-গরমি) হয়। সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই-তিন দিন শরীর খারাপ যায়।

মঠের খবর শুনিয়া বিশেষ সুখী হইলাম ও দুর্ভিক্ষের কার্য উত্তমরূপে হইতেছে শুনিলাম। দুর্ভিক্ষের জন্য ‘ব্রহ্মবাদিন্’ আফিস হইতে টাকা আসিয়াছে কিনা লিখিবে এবং এখান হইতেও শীঘ্র টাকা যাইবে। দুর্ভিক্ষ আরও অনেক স্থানে তো আছে। একটি গ্রামে এতদিন থাকিবার আবশ্যক নাই। উহাদিগকে অন্যত্র যাইতে বলিবে এবং এক এক জনকে এক এক জায়গায় যাইতে লিখিবে। ঐ সকল কাজই আসল কাজ; ঐরূপ ক্ষেত্র কর্ষিত হইলে পর ধর্মের বীজ রোপণ করা যাইতে পারে। ঐ যে গোঁড়ারা আমাদের গালি করিতেছে, ঐ রকম (সেবা) কার্যই তাহার একমাত্র উত্তর—এইটি সদা মনে রাখিবে। শশী ও সারদা যে প্রকার বলিতেছে, সেই প্রকার ছাপাইতে আমার কোন আপত্তি নাই।

মঠের নাম কি হইবে এইটা স্থির তোমরাই কর। … টাকা সাত সপ্তাহের মধ্যেই পৌঁছিবে; জমির তো কোন খবর নাই। এ বিষয়ে কাশীপুরের কেষ্টগোপালের বাগানটা নিলে ভাল হয় না? পরে বড় কার্য ক্রমে হবে। যদি মত হয়, এ বিষয় কাহাকেও—মঠস্থ বা বাহিরের—না বলিয়া চুপি চুপি অনুসন্ধান করিও। দুই-কান হইলেই কাজ খারাপ হয়। যদি ১৫|১৬ হাজারের ভিতর হয় তো তৎক্ষণাৎ কিনিবে (যদি ভাল বোঝ)। যদি কিছু বেশী হয় তো বায়না করিয়া ঐ সাত সপ্তাহ অপেক্ষা করিও। আমার মতে আপাততঃ ওটা লওয়াই ভাল। বাকী ধীরে ধীরে হবে। ও বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association (স্মৃতি জড়িত)। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ। অতি গোপনে—‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ সাংস্কারাঃ প্রাক্তনা ইব’।১২৬

কাশীপুরের বাগানের অবশ্য জমির দাম বেড়ে গেছে; কিন্তু কড়ি তেমনি কমে গেছে। যা হয় একটা করো ও শীঘ্র করো। গয়ং গচ্ছ করতে করতে যত কাজ মাটি হয়। ওটাও তো নিতেই হবে, আজ না হয় কাল—আর যত বড়ই গঙ্গাতীরে মঠ হউক না। অন্য লোক দিয়ে কথা পাড়লে আরও ভাল হয়। আমাদের কেনা টের পেলে লম্বা দর হাঁকবে। চেপে কাজ করে চল। অভীঃ, ঠাকুর সহায়। ভয় কি? সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।

বিবেকানন্দ

(খামের উপরে লিখিত)

… কাশীপুরের বিশেষ চেষ্টা দেখ। … বেলুড়ের জমি ছেড়ে দাও।
হুজুরদের নামের জ্বালায় কি গরীবগুলো শুকিয়ে মরবে? সব নাম ‘মহাবোধি’ নেয় তো নিক। গরীবদের উপকার হোক। কাজ বেশ চলছে—উত্তম কথা। আরও লেগে যাও। আমি প্রবন্ধ পাঠাতে আরম্ভ করছি। Saccharine & lime (স্যাকারিন ও নেবু) এসেছে।

বি

৩৫৬*

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

আলমোড়া
২৩ জুলাই, ১৮৯৭

প্রিয় মিস নোব্‌ল্,
আমার সংক্ষিপ্ত চিঠির জন্য কিছু মনে করো না। আমি এখন পাহাড় থেকে সমতলের দিকে চলেছি, কোন একটা জায়গা পৌঁছে তোমাকে বিস্তারিত চিঠি দেব।

ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও সরলতা থাকতে পারে—তোমার এ কথার যে কি অর্থ, তা তো আমি বুঝি না। আমার দিক্ থেকে আমি বলতে পারি যে, প্রাচ্য লৌকিকতার সামান্য যা এখনও আমার আছে, তার শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত মুছে ফেলে দিয়ে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে কথা বলার জন্য আমি প্রস্তুত। আহা, যদি একটি দিনের জন্যও স্বাধীনতার পূর্ণ আলোকে বাস করা যায়, এবং সরলতার মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করা যায়! তাই কি শ্রেষ্ঠ পবিত্রতা নয়?

এ সংসারে অন্যের ভয়ে আমরা কাজ করি, ভয়ে কথা বলি, ভয়ে, চিন্তা করি। হায়, শত্রুপরিবেষ্টিত জগতে আমাদের জন্ম! ‘শত্রুর গুপ্তচর বিশেষভাবে আমাকেই লক্ষ্য করে ফিরছে’—এমনি একটা ভীতির হাত থেকে কে নিষ্কৃতি পেয়েছে? আর যে জীবনে এগিয়ে যেতে চায়, তার ভাগ্যে আছে দুর্গতি! এ সংসার কখনও কি আপনার জনে পূর্ণ হবে? কে জানে? আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি।

কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দুর্ভিক্ষনিবারণই আমাদের কাছে প্রধান কর্তব্য। কয়েকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কাজ চলছে—দুর্ভিক্ষসেবা, প্রচার এবং সামান্য শিক্ষাদান। এখন পর্যন্ত অবশ্য খুব সামান্য ভাবেই চলছে, যে-সব ছেলেরা শিক্ষাধীন, তাদের সুবিধামত কাজে লাগান হচ্ছে।

বর্তমানে মান্দ্রাজ ও কলিকাতাই আমাদের কাজের জায়গা। গুডউইন মান্দ্রাজে কাজ করছে। কলম্বোতেও একজন গেছে। যদি ইতোমধ্যেই পাঠান না হয়ে থাকে, তবে আগামী সপ্তাহ থেকে তোমাকে সমস্ত কাজের একটি করে মাসিক বিবৃতি পাঠান হবে। আমি বর্তমানে কর্মকেন্দ্র থেকে দূরে আছি; তাই সবই একটু ঢিলে চলছে, তা দেখতেই পাচ্ছ। কিন্তু মোটের উপর কাজ সন্তোষজনক।

তুমি এখানে না এসে ইংলণ্ডে থেকেই আমাদের জন্য বেশী কাজ করতে পারবে। দরিদ্র ভারতবাসীর কল্যাণে তোমার বিপুল আত্মত্যাগের জন্য ভগবান্ তোমাকে আশীর্বাদ করুন!

আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানকার কাজ অনেকটা জেঁকে উঠবে, তোমার মত আমিও তা বিশ্বাস করি। তথাপি এখানকার কর্মচক্র খানিক ঘুরতে আরম্ভ না করলে এবং আমার অনুপস্থিতিতে কাজ চালাবার মত অনেকে আছে, এটি না জেনে আমার পক্ষে ভারতবর্ষ ত্যাগ করা ঠিক হবে না। মুসলমানরা যেমন বলে, ‘খোদার মর্জিতে’—তা কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মী খেতড়ির রাজা এখন ইংলণ্ডে আছেন। তিনি শীঘ্র ভারতে আসবেন, এবং তিনি অবশ্যই আমার বিশেষ সহায়ক হবেন।

আমার অনন্ত ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৫৭

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

আলমোড়া
২৪ জুলাই, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। Orphanage (অনাথাশ্রম) সম্বন্ধে তোমার যে অভিপ্রায় অতি উত্তম ও শ্রী-মহারাজ তাহা অচিরাৎ পূর্ণ করিবেন নিশ্চিত। একটা স্থায়ী centre (কেন্দ্র) যাহাতে হয়, তাহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে। … টাকার চিন্তা নাই—কল্য আমি আলমোড়া হইতে plain-এতে (সমতল প্রদেশে) নামিব, যেখানে হাঙ্গাম হইবে সেইখানে একটা চাঁদা করিব—famine-এর (দুর্ভিক্ষের) জন্য—ভয় নাই। যে প্রকার আমাদের কলিকাতার মঠ, ঐ নমুনায় প্রত্যেক জেলায় যখন এক-একটি মঠ হইবে, তখনই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হইবে। প্রচারের কার্যও যেন বন্ধ না হয় এবং প্রচারাপেক্ষাও বিদ্যাশিক্ষাই প্রধান কার্য; গ্রামের লোকদের lecture (বক্তৃতা) আদি দ্বারা ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদি শিক্ষা দিতে হইবে—বিশেষ ইতিহাস। ইংলণ্ডে আমাদের এই শিক্ষাকার্যের সহায়তার জন্য একটি সভা আছে; ঐ সভার কার্য অতি উত্তম চলিতেছে, সংবাদ পাইয়া থাকি। এই প্রকার চতুর্দিক হইতে ক্রমশঃ সহায় আসিবে। ভয় কি? যারা ভাবে যে, সহায়তা এলে তারপর কার্য করব, তাদের দ্বারা কোন কার্য হয় না। যারা ভাবে যে, কার্যক্ষেত্রে নামলেই সহায় আসবে, তারাই কার্য করে।

সব শক্তি তোমাতে আছে বিশ্বাস কর, প্রকাশ হতে বাকী থাকবে না। আমার প্রাণের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও ব্রহ্মচারীকে জানাইবে। তুমি মঠে খুব উৎসাহপূর্ণ চিঠি মধ্যে মধ্যে লিখিবে, যাহাতে সকলে উৎসাহিত হয়ে কার্য করে। ওয়া গুরুকী ফতে। কিমধিকমিতি

বিবেকানন্দ

৩৫৮*

[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]

আলমোড়া
২৫ জুলাই, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
এবার আমার প্রতিশ্রুতি পালনের সময়, ইচ্ছা ও সুযোগ হয়েছে। তাই এ চিঠি লিখতে বসেছি। কিছুকাল আমার শরীরটা খুব দুর্বল ছিল, এবং নানা কারণে এই (জুবিলী) উৎসবের মরসুমে আমার ইংলণ্ড যাওয়া স্থগিত রাখতে হল।

আমার অকপট ও প্রেমাস্পদ বন্ধুদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পারলাম না বলে প্রথমটায় মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দেখলাম কর্মফল এড়াবার যো নেই, তাই আমার এই হিমালয়কে নিয়েই পরিতুষ্ট থাকতে হল। তবে এ বিনিময়ে মোটেই খুশী হতে পারিনি, কারণ মানুষের মুখচ্ছবিতে জীবন্ত আত্মার প্রতিফলনে যে সৌন্দর্য, জড় জগতের যাবতীয় সৌন্দর্যের চেয়ে তা অনেক বেশী আনন্দদায়ক।

আত্মাই কি জগতের আলোকস্বরূপ নয়?

নানা কারণে লণ্ডনের কাজ একটু ঢিমে-তেতালায় চলেছে; তার একটি মুখ্য কারণ হল—কাঞ্চন, বুঝলে? আমি সেখানে থাকলে টাকাকড়ি যে-কোন উপায়ে জুটে যায়, এবং কাজ এগিয়ে যায়। এখন কেউই কাঁধ পাতছে না। আমাকে আবার যেতেই হবে, এবং কাজটাকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করতে হবে।

আজকাল বেশ খানিকটা ব্যায়াম করছি ও ঘোড়ায় চড়ছি, কিন্তু চিকিৎসকের ব্যবস্থা মত আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সর-তোলা দুধ খেতে হয়েছিল আর তারই ফলে আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশী এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান কিন্তু এখনই এতটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

জেনে খুশী হলাম খাবার সময় তোমার বেশ ক্ষুধা হয়।

উইম্বল‍্‍ডনের মিস মার্গারেট নোব্‌ল‍্‍কে তুমি জান কি? সে আমার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। যদি পার তো তার সঙ্গে ডাকে যোগাযোগ করো, তা হলে সেখানে তুমি আমার কাজে অনেকটা সহায়তা করতে পারবে। তার ঠিকানা—Brantwood, Worple Road, Wimbledon.

তাহলে আমার ছোট বন্ধু মিস অর্চার্ড (Miss Orchard)-কে তুমি দেখেছ এবং তাকে তোমার বেশ ভালও লেগেছে—বেশ কথা। তার সম্বন্ধে আমার অনেক আশা। যখন আমি খুব বুড়ো হয়ে যাব, তখন তোমার বা মিস অর্চার্ডের মত আমার বিশেষ প্রিয় ছোট ছোট বন্ধুদের জয়বার্তা পৃথিবীর বুকে ঘোষিত হচ্ছে দেখে কতই না আনন্দের সঙ্গে জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম থেকে চিরদিনের মত অবসর গ্রহণ করব!

কথায় কথায় বলে রাখি, আমার চুল পাকতে শুরু করেছে—এত তাড়াতাড়ি যে বুড়ো হতে চলেছি, তাতে আনন্দই হচ্ছে। সোনালীর মধ্যে—অর্থাৎ কালোর মধ্যে—রূপালী কেশ অতি দ্রত এসে যাচ্ছে।

ধর্মপ্রচারকের অল্পবয়সী হওয়া ভাল নয়, তোমার তাই মনে হয় না কি? আমি কিন্তু তাই মনে করি, সারা জীবন ধরেই মনে করেছি। একজন বৃদ্ধের প্রতি মানুষ অনেক বেশী আস্থা এবং তাঁকে দেখে অনেক বেশী শ্রদ্ধা জাগে। তথাপি এ জগতে বুড়ো বদমাসগুলিই সবচেয়ে মারাত্মক, তাই নয় কি? এই দুনিয়ার বিচারের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে, এবং হায়, সত্য থেকে তা কতই না স্বতন্ত্র!

তাহলে তোমার ‘বিশ্বজনীন ধর্ম’ (প্রবন্ধ) রিভিউ দ্য দ্যো মোঁদে (Revue de deux Mondes) পত্রিকা নাকচ করে দিয়েছে। মুষড়ে পড়ো না, আবার অন্য কোন কাগজে চেষ্টা কর। আমি নিশ্চিত যে একবার গৃহীত হলে তুমি খুব দ্রুত প্রবেশাধিকার পাবে। আমি খুবই আনন্দিত যে, কাজটিকে তুমি খুব ভালবাস; কাজ তার নিজের পথ তৈরী করে নেবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। স্নেহের মেরী, আমাদের ভাবাদর্শের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং অদূর ভবিষ্যতেই তার সার্থক রূপায়ণ হবে।

মনে হয় এ চিঠিখানা পারি-তে গিয়ে তোমার সঙ্গে মিলিত হবে—তোমার সৌন্দর্যময় পারি—এবং আশা করি ফরাসী দেশের সাংবাদিকতা ও সেখানকার আসন্ন ‘বিশ্ব মেলা’ সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছু লিখবে।

বেদান্ত ও যোগের সাহায্যে তুমি উপকৃত হয়েছ, এ-কথা জেনে আমি খুবই খুশী। দুর্ভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে সার্কাস-দলের ক্লাউনের মত মনে হয়, সে কেবল অন্যকে হাসায়, কিন্তু তার নিজের দশা সকরুণ।

স্বভাবতই তোমার বেশ হাসিখুশী মেজাজ। তোমার মনে কোন কিছুরই যেন প্রভাব পড়ে না। তা ছাড়া তুমি খুবই পরিণামদর্শী, কারণ খুব সাবধানে তুমি ‘প্রেম’ বা প্রেমঘটিত যাবতীয় বাজে জিনিষ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছ। তাহলেই দেখতে পাচ্ছ, তুমি শুভকর্ম করেছ এবং তোমার জীবনব্যাপী কল্যাণের বীজ বপন করেছ। আমাদের জীবনের ত্রুটি হল এই যে, আমরা বর্তমানের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হই—ভবিষ্যতের দ্বারা নয়। যা এই মুহূর্তে আমাদের ক্ষণিক আনন্দ দেয়, তারই পিছনে আমরা ছুটি; ফলে দেখা যায়, বর্তমানের ক্ষণিক আনন্দের বিনিময়ে আমরা ভবিষ্যতের বিপুল দুঃখ সঞ্চার করে বসি।

যদি ভালবাসবার মত কেউ আমার না থাকত! যদি আমি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হতাম! আমার আপনার লোকেরাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশী দুঃখের কারণ হয়েছে—আমার ভ্রাতা, ভগ্নী, জননী ও অন্য সব আপন জন। আত্মীয়স্বজনরাই মানুষের উন্নতির পথে কঠিন বাধাস্বরূপ। আর এটা খুব আশ্চর্য নয় কি যে, মানুষ তৎসত্ত্বেও বিবাহ করবে ও নূতন মানুষের জন্ম দিতে থাকবে!!!

যে মানুষ একাকী, সে-ই সুখী। সকলের কল্যাণ কর, সকলকে তোমার ভাল লাগুক, কিন্তু কাউকে ভালবাসতে যেও না। এটা একটা বন্ধন, আর বন্ধন শুধুই দুঃখ ডেকে আনে। তোমার অন্তরে তুমি একাকী বাস কর—তাতে সুখী হবে। যার দেখাশুনো করবার কেউ নেই এবং কারও তত্ত্বাবধান নিয়ে যে মাথা ঘামায় না, সেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।

তোমার মনের গঠন দেখে আমার ঈর্ষা হয়—শান্ত, নম্র, হাসিখুশী অথচ গভীর ও বন্ধনহীন। তুমি মুক্ত হয়ে গেছ, মেরী, তুমি মুক্ত হয়ে আছ; তুমি তো জীবন্মুক্ত। আমার প্রকৃতিতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের গুণ বেশী, আর তোমার মধ্যে মেয়েদের চাইতে পুরুষের গুণ বেশী। আমি সব সময়ই অন্যের দুঃখ-বেদনা শুধু-শুধুই নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছি, অথচ কারও কোন কল্যাণ করতেও পারছি না—ঠিক যেমন মেয়েদের সন্তান না হলে একটি বেড়াল পুষে তার প্রতি সকল ভালবাসা ঢেলে দেয়।

তোমার কি মনে হয়, তার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা আছে? একদম না, এগুলি হল জড় স্নায়বিক বন্ধন—হ্যাঁ, ঠিক তাই। হায়, পঞ্চভূতে গড়া এই দেহের দাসত্ব ঘোচান—সে কি সহজ কথা!

তোমার বন্ধু মিসেস মার্টিন প্রতি মাসে অনুগ্রহ করে তাঁর পত্রিকাটি আমাকে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে, স্টার্ডির থার্মোমিটার এখন শূন্য ডিগ্রীর নীচে। এই গ্রীষ্মে আমার ইংলণ্ডে যাওয়া হল না বলে তিনি খুবই নিরাশ হয়ে পড়েছেন। আমার কি-ই বা করার ছিল?

আমরা এখানে দুটি মঠের পত্তন করেছি—একটি কলিকাতায়, অপরটি মান্দ্রাজে। কলিকাতার মঠটি (একটি জীর্ণ ভাড়াটে বাড়ী) সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভয়ানক আন্দোলিত হয়েছে।

আমরা বেশ কয়েকটি যুবককে পেয়েছি, তাদের এখন শিক্ষানবিশী চলছে। তা ছাড়া আমরা বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের জন্য সেবাকেন্দ্র খুলেছি, এবং কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে আমরা ঐরকম কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করব।

কয়েকদিন বাদেই আমি সমতলে যাচ্ছি এবং সেখান থেকে যাব—এই পর্বতের পশ্চিম খণ্ডে। সমভূমিতে যখন একটু ঠাণ্ডা পড়বে, তখন দেশময় একবার বক্তৃতা দিয়ে বেড়াব—দেখব কি পরিমাণ কাজ করা যায়।

এখন আর লিখবার সময় নেই, অনেক লোক অপেক্ষা করছে—তাই স্নেহের মেরী, তোমার জন্য সর্ববিধ আনন্দ ও সুখ কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। হাড়মাসের দেহ কখনও যেন তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে, সতত এই প্রার্থনা।

সর্বদা প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৫৯*

[মিসেস লেগেটকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

আলমোড়া
২৮ জুলাই, ১৮৯৭

মা,
আপনার সুন্দর ও সহৃদয় লিপিখানির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার কতই না ইচ্ছা ছিল খেতড়ির রাজার সঙ্গে লণ্ডনে গিয়ে সেখানকার আমন্ত্রণ গ্রহণ করার। গত মরসুমে লণ্ডনে আমার অনেকগুলি ভোজের নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু কপালে তা নেই; আমার ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যই রাজার সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হল না।

এলবার্টা তাহলে আবার আমেরিকায় স্বগৃহে ফিরে এসেছে। রোমে আমার জন্য সে যা করেছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ। হলি (Hollister) কেমন আছে? তাদের উভয়কে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আমার সর্বকনিষ্ঠ নবজাত ভগিনীটিকে আমার হয়ে চুম্বন দেবেন।

ন-মাস হল আমি হিমালয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি। এবার আবার কাজের লাগাম ধরতে সমতলে ফিরে যাচ্ছি।

ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, জো জো ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা এবং আপনাকেও চিরন্তনভাবে।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ

৩৬০*

আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭

প্রিয় মিস নোব্‌ল্‌,
স্টার্ডির একখানি চিঠি কাল পেয়েছি। তাতে জানলাম যে, তুমি ভারতে আসতে এবং সব কিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। কাল তার উত্তর দিয়েছি। কিন্তু মিস মূলারের কাছ থেকে তোমার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম, তাতে এ পত্রখানিও আবশ্যক হয়ে পড়েছে; মনে হচ্ছে, সরাসরি তোমাকে লেখা ভাল।

তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষতঃ ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর—একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখনও মহীয়সী মহিলার জন্মদান করতে পারছে না, তাই অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা—সর্বোপরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন।

কিন্তু বিঘ্নও আছে বহু। এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কি ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পার না। এদেশে এলে তুমি নিজেকে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নর-নারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা; ভয়েই হোক বা ঘৃণাতেই হোক—তারা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের খুব ঘৃণা করে। পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গেরা তোমাকে খামখেয়ালী মনে করবে এবং তোমার প্রত্যেকটি গতিবিধি সন্দেহের চক্ষে দেখবে।

ভারতে তা ছাড়া, জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান। এদেশের প্রায় সব জায়গার শীতই তোমাদের গ্রীষ্মের মত; আর দক্ষিণাঞ্চলে তো সর্বদাই আগুনের হল‍্‍কা চলছে।

শহরের বাইরে কোথাও ইওরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই। এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি। সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমনি আমি কেউ নই; তবু আমার যেটুকু প্রভাব আছে, সেটুকু দিয়ে আমি অবশ্যই তোমায় সাহায্য করব।

কর্মে ঝাঁপ দেবার পূর্বে বিশেষভাবে চিন্তা করো এবং কাজের পরে যদি বিফল হও কিম্বা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক্ থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে—তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাক। ‘মরদ‍্‍কী বাত হাতীকা দাঁত’—একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা। আবার তোমাকে একটু সাবধান করা দরকার—তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মিস মূলার কিম্বা অন্য কারও পক্ষপুটে আশ্রয় নিলে চলবে না। তাঁর নিজের ভাবে মিস মূলার চমৎকার মহিলা; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। এই মনোভাব তাঁর অজ্ঞাতসারেই বারবার মাথা তুলছে এবং দিন কয়েকের মধ্যেই তুমি বুঝতে পারবে যে, তাঁর সঙ্গে বনিয়ে চলা অসম্ভব। তাঁর বর্তমান সঙ্কল্প এই যে, তিনি কলিকাতায় একটি বাড়ী ভাড়া নেবেন—তোমার ও নিজের জন্য, এবং ইওরোপ ও আমেরিকা থেকে যে-সব বন্ধুদের আসার সম্ভাবনা আছে তাঁদেরও জন্য। এটা অবশ্য তাঁর সহৃদয়তা ও অমায়িকতার পরিচায়ক; কিন্তু তাঁর মঠাধ্যক্ষাসুলভ সঙ্কল্পটি দুটি কারণে সফল হবে না—তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততা। কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভাল; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।

মিসেস সেভিয়ার নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভাল, এত স্নেহময়ী তিনি! সেভিয়ার-দম্পতিই একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমন কি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি। কিন্তু তাঁদের এখনও কোন নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই। তুমি এলে তোমার সহকর্মীরূপে তাঁদের পেতে পার এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে। কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।

আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড ও বোষ্টনের মিসেস বুল এই শরৎকালেই ভারত-পরিভ্রমণে আসছেন। মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লণ্ডনেই দেখছ—সেই পারি-ফ্যাশনের পোষাক-পরিহিতা মহিলাটি! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ইওরোপের হয়ে এদেশে আসছেন; সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে।

মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি। কিন্তু চিঠিটি বড় শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লণ্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয়।

অনন্ত ভালবাসা জানবে। ইতি

সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

৩৬১

[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭

প্রিয় শশী,
তোমার কাজকর্ম বেশ চলছে, খবর পাইলাম। তিনটি ভাষ্য বেশ করে পড়ে রাখবে, আর ইওরোপীয় দর্শনাদিও বেশ করে পড়বে, ইহাতে অন্যথা না হয়। পরকে মারতে গেলে ঢাল-তলওয়ার চাই, এ কথা যেন ভুল একদম না হয়। সুকুল এক্ষণে পৌঁছিয়াছে, তোমার সেবাদিও বেশ চলছে বোধ হয়। সদানন্দ যদি সেখানে থাকিতে না চায়, কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবে, এবং প্রতি সপ্তাহে একটা রিপোর্ট—আয়-ব্যয় প্রভৃতি সব সমেত মঠে পাঠাইতে ভুল যেন না হয়। আলাসিঙ্গার বোনাই এখানে বদ্রী শা-র নিকট হতে চারিশত টাকা ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে; পৌঁছিবামাত্র পাঠাইবার কথা, এখনও কেন পাঠাইল না। আলাসিঙ্গাকে জিজ্ঞাসিবে এবং সত্বর পাঠাইতে কহিবে; কারণ আমি পরশুদিন এখান হতে যাচ্ছি—মসূরী পাহাড় বা অন্য কোথাও যাই পরে ঠিক করব। কাল এখানে ইংরেজ-মহলে এক লেকচার হয়েছিল, তাতে বড়ই খুশী। কিন্তু তার আগের দিন হিন্দীতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী—হিন্দীতে যে oratory (বাগ্মিতা) করতে পারব তা তো আগে জানতাম না। মঠে ছেলেপুলে যোগাড় হচ্ছে কি? যদি হয় তো কলিকাতায় যেভাবে কার্য হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে করে যাও। নিজের বুদ্ধি এখন কিছুদিন বেশী খরচ করবে না, পাছে ফুরিয়ে যায়—কিছুদিন পরে করো।

তোমার শরীরের উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে—তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টা আরও খারাপ হয়ে যায়। বিদ্যের জোর না থাকলে কেউ ঘণ্টা-ফণ্টা মানবে না—এ-কথাটা নিশ্চিত, এবং এইটি মনে স্থির রেখে কার্য করবে।

আমার হৃদয়ের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও গুডউইন প্রভৃতিকে জানাইবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৬২

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

আলমোড়া
৩০ জুলাই, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
তোমার কথামত ডিষ্ট্রীক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট লেভিঞ্জ সাহেবকে এক পত্র লিখিলাম। অপিচ তুমি তাঁহার বিশেষ বিশেষ কার্যকলাপ বিবৃত করিয়া শশী-ডাক্তারকে দিয়া দেখাইয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ একটি লম্বাচওড়া পত্র লিখিবে ও তাহার এক কপি উক্ত মহোদয়কে পাঠাইবে। আমাদের মূর্খগুলো খালি দোষ অনুসন্ধান করে, গুণও কিঞ্চিৎ দেখুক।

আমি আগামী সোমবার এস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি।

Orphan (অনাথ বালক) যোগাড়ের কি করছ? মঠ হতে চারি-পাঁচজনকে না হয় ডাকিয়া লও, গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজিলে দুদিনেই মিলিবার সম্ভাবনা।

Permanent Centre (স্থায়ী কেন্দ্র) করিতে হইবে বৈকি। আর—দেবকৃপা না হলে এদেশে কি কাজ হয়? রাজনীতি ইত্যাদিতে কোন যোগ দিবে না অথবা সংস্রব রাখিবে না। অথচ তাদের সহিত কোন বিবাদাদিতেও কাজ নাই। একটা কার্যে তন্‌ মন ধন। এখানে একটি—সাহেবমহলে-ইংরেজী বক্তৃতা হইয়াছিল, ও একটি—দেশী লোকদিগকে হিন্দীতে। হিন্দীতে আমার এই প্রথম, কিন্তু সকলের তো খুব ভাল লাগল। সাহেবরা অবশ্যই যেমন আছে, নাল গড়িয়ে গেল, ‘কালো মানুষ!’ ‘তাই তো কি আশ্চর্য’ ইত্যাদি। আগামী শনিবার আর একটি বক্তৃতা ইংরেজীতে, দেশী লোকের জন্য। এখানে একটি বৃহৎ সভা স্থাপন করা গেল—ভবিষ্যতে কতদূর কার্য হয় দেখা যাক। সভার উদ্দেশ্য বিদ্যা ও ধর্ম শিক্ষা দেওয়া।

সোমবার বেরেলি-যাত্রা, তারপর সাহারানপুর, তারপর আম্বালা, সেখান হইতে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের সঙ্গে বোধ হয় মসূরী, আর একটু ঠাণ্ডা পড়লেই দেশে পুনরাগমন ও রাজপুতানায় গমন ইত্যাদি।

তুমি খুব চুটিয়ে কাজ করে যাও, ভয় কি? আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? It is better to wear out than rust out. (মরচে পড়ে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ভাল)। মরে গেলেও হাড়ে হাড়ে ভেল্কি খেলবে, তার ভাবনা কি? দশ বৎসরের ভেতর ভারতবর্ষটাকে ছেয়ে ফেলতে হবে—‘এর কমে হবেই না।’ তাল ঠুকে লেগে যাও—‘ওয়া গুরুকী ফতে!’ টাকা-ফাকা সব আপনা-আপনি আসবে। মানুষ চাই, টাকা চাই না। মানুষ সব করে, টাকায় কি করতে পারে? মানুষ চাই—যত পাবে ততই ভাল। … এই—তো ঢের টাকা যোগাড় করেছিল, কিন্তু মানুষ নাই—কি কাজ করলে বল? কিমধিকমিতি।

বিবেকানন্দ

৩৬৩*

[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]

আলমোড়া
১১ অগষ্ট, ১৮৯৭

প্রিয় জো,
… হ্যাঁ, জগন্মাতার কার্য পড়ে থাকবে না, কারণ তা সত্য, আন্তরিকতা ও পবিত্রতার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এখনও তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি। ঐকান্তিক অকপটতাই হল এর মূলনীতি।

ভালবাসা সহ তোমার
বিবেকানন্দ

৩৬৪

[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

আম্বালা
১৯ অগষ্ট, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
মান্দ্রাজের কাজ অর্থাভাবে উত্তমরূপে চলিতেছে না শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। আলাসিঙ্গা ও তাহার ভগিনীপতির টাকা আলমোড়ায় পৌঁছিয়াছে শুনিয়া সুখী হইয়াছি। গুডউইন লিখিতেছে, যে টাকা বাকী আছে লেকচার-এর দরুন—তাহা হইতে কিছু লইবার জন্য, Reception Committee (অভ্যর্থনা সমিতি)-কে চিঠি লিখিতে বলিতেছে। … উক্ত লেকচার-এর টাকা Reception-এ (অভ্যর্থনায়) খরচ করা অতি নীচ কার্য—তাহার বিষয়ে আমি কোন কথা কাহাকেও বলিতে ইচ্ছা করি না। টাকা সম্বন্ধে আমাদের দেশীয় লোক যে কিরূপ, তাহা আমি বিলক্ষণ বুঝিয়াছি। … তুমি নিজে বন্ধুদের—আমার তরফ হইতে এ-কথা বুঝাইয়া বলিবে এবং তাঁহারা যদি খরচ চালান ভাল, নতুবা তোমরা কলিকাতার মঠে চলিয়া আসিবে, অথবা রামনাদে মঠ উঠাইয়া লইয়া যাইবে।

আমি এক্ষণে ধর্মশালার পাহাড়ে যাইতেছি। নিরঞ্জন, দীনু, কৃষ্ণলাল, লাটু ও অচ্যুত অমৃতসরে থাকিবে। সদানন্দকে এতদিন মঠে কেন পাঠাও নাই? যদি সেখানে এখনও থাকে, পরে অমৃতসর হইতে নিরঞ্জন পত্র লিখিলেই তাহাকে পাঞ্জাবে পাঠাইবে। আমি কিছুদিন আরও পাঞ্জাবী পাহাড়ে বিশ্রাম করিয়া পাঞ্জাবে কার্য আরম্ভ করিব। পাঞ্জাব ও রাজপুতানাই কার্যের ক্ষেত্র। কার্য আরম্ভ করিয়াই তোমাদের পত্র লিখিব।

আমার শরীর মধ্যে বড় খারাপ হইয়াছিল। এক্ষণে ধীরে ধীরে শুধরাইতেছে। পাহাড়ে দিনকতক থাকিলেই ঠিক হইয়া যাইবে। আলাসিঙ্গা, জি. জি, গুডউইন, গুপ্ত, সুকুল প্রভৃতি সকলকে আমার ভালবাসা দিও, তুমিও জানিও। ইতি

বিবেকানন্দ