২৩. পত্রাবলী ৩৩৫-৩৪৪

৩৩৫*

আলমবাজার মঠ (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭

প্রিয় মিস নোব্‌ল্‌,
তোমার প্রীতি ও উৎসাহপূর্ণ পত্রখানি আমার হৃদয়ে কত যে বলসঞ্চার করেছে, তা তোমার কল্পনারও অতীত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন মন একেবারে নৈরাশ্যে ডুবে যায়—বিশেষতঃ কোন আদর্শকে রূপ দেবার জন্য জীবনব্যাপী উদ্যমের পর যখন সাফল্যের ক্ষীণ আলোকরশ্মি দৃষ্টিগোচর হয়, ঠিক সেই সময়ে যদি আসে এক প্রচণ্ড সর্বনাশা আঘাত। দৈহিক অসুস্থতা আমি গ্রাহ্য করি না; দুঃখ হয় এইজন্য যে, আমার আদর্শগুলি কার্যে পরিণত হবার কিছুমাত্র সুযোগ পেল না। আর তুমি তো জানই, অন্তরায় হচ্ছে অর্থাভাব।

হিন্দুরা শোভাযাত্রা এবং আরও কত কিছু করছে; কিন্তু তারা টাকা দিতে পারে না। দুনিয়াতে আর্থিক সাহায্য বলতে আমি পেয়েছি শুধু ইংলণ্ডে মিস — এবং মিঃ —র কাছে। … ওখানে থাকতে আমার ধারণা ছিল যে, এক হাজার পাউণ্ড পেলেই অন্ততঃ কলিকাতার প্রধান কেন্দ্রটি স্থাপন করা যাবে; আমি এই অনুমান করেছিলাম দশ বার বছর আগেকার কলিকাতার অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু ইতোমধ্যে জিনিষের দাম তিন চার গুণ বেড়ে গেছে।

যাই হোক, কাজ আরম্ভ করা গেছে। একটি পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ী ছ-সাত শিলিঙ ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে এবং তাতেই প্রায় ২৪ জন যুবক শিক্ষালাভ করছে। স্বাস্থ্যলাভের জন্য আমাকে এক মাস দার্জিলিঙে থাকতে হয়েছিল। তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি। আর তুমি বিশ্বাস করবে কি যে, কোন ঔষধ ব্যবহার না করেও শুধু ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই এরূপ ফল পেয়েছি!! আগামী কাল আবার আর একটি শৈলনিবাসে যাচ্ছি, কারণ নীচে এখন বেজায় গরম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের ‘সমিতি’ এখনও টিকে আছে। এখানকার কাজের বিবরণী তোমাকে মাসে অন্ততঃ একবার করে পাঠাব। শুনতে পেলাম লণ্ডনের কাজ মোটেই ভাল চলছে না। প্রধানতঃ এই কারণেই আমি এখন লণ্ডনে যেতে চাই না, যদিও জুবিলী১২১ উৎসব উপলক্ষে ইংলণ্ডযাত্রী আমাদের কয়েকজন রাজা আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন; ওখানে গেলেই বেদান্ত-বিষয়ে লোকের আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেজায় খাটতে হত, আর তার ফলে শারীরিক কষ্ট আরও বেশী হত।

যাই হোক অদূর ভবিষ্যতে আমি মাসখানেকের জন্য (ওদেশে) যাচ্ছি। শুধু যদি এখানকার কাজের গোড়াপত্তন দৃঢ় হয়ে যেত, তবে আমি কত আনন্দে ও স্বাধীনভাবেই না ঘুরে বেড়াতে পারতাম!

এ পর্যন্ত তো কেবল কাজের কথা হল। এখন তোমার নিজের কথা পাড়ছি। কল্যাণীয়া মিস নোব্‌ল্‌, তোমার যে অনুরাগ ভক্তি বিশ্বাস ও গুণগ্রাহিতা আছে, তা যদি কেউ পায়, তবে সে জীবনে যত পরিশ্রমই করুক না কেন, ওতেই তার শতগুণ প্রতিদান হয়। তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল হোক। আমার মাতৃভাষায় বলতে গেলে, তোমার কাজে সারা জীবন দিতে পারি।

তোমার এবং ইংলণ্ডের অন্যান্য বন্ধুদের চিঠিপত্র আমার কাছে সর্বদাই খুব আনন্দায়ক ছিল এবং ভবিষ্যতেও তা ছাড়া অন্যরূপ হবে না। মিঃ ও মিসেস হ্যামণ্ড দুখানি অতি সুন্দর ও প্রীতিপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। অধিকন্তু মিঃ হ্যামণ্ড ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় একটি চমৎকার কবিতা পাঠিয়েছেন—যদিও আমি মোটেই এ প্রশস্তির যোগ্য নই। আবার তোমায় হিমালয় থেকে পত্র লিখব; উত্তপ্ত সমভূমির চেয়ে সেখানে তুষারশ্রেণীর সামনে চিন্তা আরও স্বচ্ছ হয়ে যাবে এবং স্নায়ুগুলি আরও শান্ত হবে। মিস মূলার ইতোমধ্যেই আলমোড়ায় পৌঁছেছেন। মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার সিমলা যাচ্ছেন। তাঁরা এতদিন দার্জিলিঙে ছিলেন। দেখ বন্ধু, এইভাবেই জাগতিক ব্যাপারের পরিবর্তন ঘটছে—একমাত্র প্রভুই নির্বিকার, তিনিই প্রেমস্বরূপ। তিনি তোমার হৃদয়সিংহাসনে চির-অধিষ্ঠিত হোন—ইহাই বিবেকানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৩৬*

আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭

প্রিয় সুধীর,
তোমার চিঠি পেয়ে ভারি আনন্দ হল। একটা জিনিষ বোধ হয় তোমাকে বলতে ভুলে গেছি—আমায় যে-সব চিঠি লিখবে, তার নকল রেখো। তা ছাড়া অন্যেরা মঠে যে-সব দরকারী চিঠি লেখে বা মঠ থেকে বিভিন্ন লোকের কাছে যে-সব পত্রাদি যায়, তাও নকল করে রাখা উচিত।

সব জিনিষটা সুচারুভাবে চলছে, ওখানকার কাজে ক্রমে উন্নতি হচ্ছে এবং কলিকাতারও তাই—এই জেনে আমি বড়ই খুশী হয়েছি।

আমি এখন বেশ ভাল আছি; শুধু পথশ্রমটা আছে—তাও দিনকয়েকের মধ্যেই যাবে। সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৩৭

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে বিশেষ সমাচার অবগত হইলাম। সুধীরের এক পত্র পাইলাম এবং মাষ্টার মহাশয়েরও এক পত্র পাই। নিত্যানন্দের (যোগেন চাটুয্যের) দুই পত্র দুর্ভিক্ষ স্থল হইতে পাইয়াছি।

টাকাকড়ি এখনও যেন জলে ভাসছে … যোগাড় নিশ্চিত হবে। হল, বিল্ডিং, জমি ও ফণ্ড—সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই—এবং দু-তিন মাস এক্ষণে আমি তো আর গরম দেশে যাচ্ছি না। তারপর একবার tour (ভ্রমণ) করে টাকা যোগাড় করব নিশ্চিত। এ বিধায় যদি তুমি বোধ কর যে, ঐ আট কাঠা frontage (সামনে খোলা জমি) না হয় …, তাহলে … দালালের বায়না জলে ফেলার মত দিলে ক্ষতি নাই। এ-সব বিষয় নিজে বুদ্ধি করে করবে, আমি অধিক আর কি লিখব? তাড়াতাড়িতে ভুল হওয়ার বিশেষ সম্ভব। … মাষ্টার মহাশয়কে বলিবে, তিনি যে বিষয়ে বলিয়াছেন, তাহা আমার খুব অভিমত।

গঙ্গাধরকে লিখিবে যে, যদি ভিক্ষাই সেখানে (দুর্ভিক্ষ স্থলে) দুষ্প্রাপ্য হয় তো গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া খাইবে এবং সপ্তাহে সপ্তাহে এক একটা পত্র উপেনের কাগজে (‘বসুমতী’তে) প্রকাশ করিবে। তাহাতে অন্য লোকেও সহায়তা করিতে পারে।

শশীর এক পত্রে জানিতেছি, … সে নির্ভয়ানন্দকে চায়। যদি উত্তম বিবেচনা কর, নির্ভয়ানন্দকে মান্দ্রাজে পাঠাইয়া গুপ্তকে আনাইবে। মঠের Rules & Regulations-এর (নিয়মাবলীর) ইংরেজী অনুবাদ বা বাঙলা কপি শশীকে পাঠাইবে এবং সেখানে যেন ঐ প্রকার কার্য হয়, তাহা লিখিবে।

কলিকাতায় সভা বেশ চলিতেছে শুনিয়া সুখী হইলাম। এক দুইজন না আইসে কিছুই দরকার নাই (কিছু আসে যায় না)। ক্রমে সকলেই আসিবে। সকলের সঙ্গে সহৃদয়তা প্রভৃতি রাখিবে। মিষ্ট কথা অনেক দূর যায়, নূতন লোক যাহাতে আসে, তাহার চেষ্টা করাই বিশেষ প্রয়োজন। নূতন নূতন মেম্বর চাই।

যোগেন আছে ভাল। আমি—আলমোড়াও অত্যন্ত গরম হওয়ায় ২০ মাইল দূরে এক উত্তম বাগানে আছি; অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, কিন্তু গরম। গরম কলিকাতা হইতে বিশেষ প্রভেদ কি?

জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়। এখানে হাওয়া এত শুষ্ক যে, দিনরাত্র নাক জ্বালা করছে ও জিভ যেন কাঠের চোকলা। তোমরা আর criticise (সমালোচনা) করো না; নইলে এত দিনে আমি মজা করে ঠাণ্ডা দেশে গিয়ে পড়তুম। … তুমি ও-সব মুখ্যু-ফুখ্যুদের কথা কি শোন? যেমন তুমি আমাকে কলায়ের দাল খেতে দিতে না—starch (শ্বেতসার) বলে!! আবার কি খবর—না, ভাত আর রুটি ভেজে খেলে আর starch (শ্বেতসার) থাকে না!!! অদ্ভুত বিদ্যে বাবা!! আসল কথা আমার পুরানো ধাত আসছেন। … এইটি বেশ দেখতে পাচ্ছি। এ-দেশে এখন এ-দেশী রঙচঙ ব্যামো সব। সে-দেশে সে-দেশী রঙচঙ সব! রাত্রির খাওয়াটা মনে করছি খুব light (লঘু) করব; সকালে আর দুপুরবেলা খুব খাব, রাত্রে দুধ ফল ইত্যাদি। তাই তো ওৎ করে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!!

তুমি ভয় খাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তো বাতি জ্বলল, এখনও সারা রাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার—আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা ওকেও দুরস্ত বনাচ্ছি—ভয় কি? … খুব চুটিয়ে বুক বেঁধে কাজ কর দিকি, একবার তোলপাড় করা যাক। কিমধিকমিতি।

মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে ও next meeting (আগামী সভা)-কে আমার greeting (সাদর সম্ভাষণ) দিও ও কহিও যে, যদিও আমি শরীরের সহিত উপস্থিত নহি, তথাপি আমার আত্মা সেথায়, যেথায় প্রভুর নামকীর্তন হয়। ‘যাবৎ তব কথা রাম সঞ্চরিষ্যতি মেদিনীম্’ ইত্যাদি (হনুমান)—হে রাম, যেথায় তোমার কথা হয়, সেথায় আমি হাজির। আত্মা সর্বব্যাপী কিনা! ইতি

বিবেকানন্দ

৩৩৮*

আলমোড়া
২৯ মে, ১৮৯৭

প্রিয় শশী ডাক্তার,
তোমার পত্র এবং দু-বোতল ঔষধ যথাসময়ে পেয়েছি। কাল সন্ধ্যা হতে তোমার ঔষধ পরীক্ষা করে দেখছি। আশা করি, একটি ঔষধ অপেক্ষা দুটির মিশ্রণে বেশী ফল পাওয়া যাবে।

আমি সকাল-বিকালে ঘোড়ায় চড়ে যথেষ্ট ব্যায়াম করতে শুরু করেছি এবং তার ফলে সত্যই অনেকটা ভাল বোধ করছি। ব্যায়াম শুরু করে প্রথম সপ্তাহে শরীর এতই ভাল বোধ করিতেছিলাম যে, ছেলেবেলায় যখন কুস্তি করতাম, তারপর তেমনটি কখনও বোধ করিনি। আমার তখন সত্যই বোধ হত যে, শরীর থাকা একটা আনন্দের বিষয়। তখন শরীরের প্রতি ক্রিয়াতে আমি শক্তির পরিচয় পেতাম এবং প্রত্যেক পেশীর নড়াচড়াই আনন্দ দিত। সে উৎফুল্ল ভাব এখন অনেকটা কমে গেছে, তবু আমি নিজেকে বেশ শক্তিমান্‌ বোধ করি। শক্তি-পরীক্ষায় জি. জি. এবং নিরঞ্জন দুজনকেই আমি মুহূর্তে ভূমিসাৎ করতে পারতাম। দার্জিলিঙে আমার সবসময় মনে হত, আমি যেন কে আর একজন হয়ে গেছি। আর এখানে আমার মনে হয় যেন আমার কোন ব্যাধিই নেই। কেবল একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু-ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মান্দ্রাজ থেকে দার্জিলিঙ পর্যন্ত (দার্জিলিঙের প্রথম মাস পর্যন্ত) বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ-ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রির আহারের পর গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে। দিনের আহারের পর অবশ্য গরম বোধ করি না।

এখানে একটি ফলের বাগান থাকায় এখানে এসেই বরাবরের চেয়েও আমি বেশী ফল খেতে শুরু করেছি। কিন্তু এখানে এখন খোবানি ছাড়া অন্য কোন ফল পাওয়া যায় না। নৈনীতাল থেকে অন্যান্য ফল আনবার চেষ্টা করছি। এখানকার দিনগুলি যদিও তীব্র গরম, তবু তৃষ্ণা বোধ করি না। … মোটের উপর, এখানে আমার শক্তি স্ফূর্তি এবং স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য আবার ফিরে আসছে বলে অনুভব করছি। তবে খুব বেশী দুগ্ধপানের ফলে বোধ হয় অত্যন্ত চর্বি জমতে শুরু করেছে। যোগেন কি লিখছে, তা ভ্রূক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ! যোগেন বোধ হয় দু-চারদিনের মধ্যেই এখানে আসবে। আমি তার ভার নেব। ভাল কথা, আমি সহজেই ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ি—আলমোড়ায় এসে প্রথম সপ্তাহ যে অসুস্থ ছিলাম, তা হয় তো তরাই অঞ্চল দিয়ে আসার ফলেই হয়ে থাকবে! যা হোক, বর্তমানে আমি নিজেকে খুবই বলবান্‌ বোধ করছি। ডাক্তার, আমি যখন আজকাল তুষারবৃত পর্বতশৃঙ্গের সম্মুখে ধ্যানে বসে আবৃত্তি করি—‘ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ, প্রাপ্তস্য হি যোগাগ্নিময়ং শরীরম্।’১২২—সেই সময় যদি তুমি আমায় একবার দেখতে!

রামকৃষ্ণ মিশনের কলিকাতার সভাগুলি বেশ সাফল্য লাভ করছে জেনে খুব সুখী হয়েছি। এই মহৎ কার্যের সহায়ক যাঁরা, তাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ হোক। … অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি

প্রভুপদাশ্রিত তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৩৯

[শ্রীযুক্ত প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিত]

আলমোড়া
৩০ মে, ১৮৯৭

সুহৃদ্বরেষু,
শুনিতেছি, অপরিহার্য সাংসারিক দুঃখ আপনার উপর পড়িয়াছে। আপনি জ্ঞানবান্, দুঃখ কি করিতে পারে? তথাপি ব্যাবহারিকে বন্ধু-জন-কর্তব্যবোধে এ কথার উল্লেখ। অপিচ, ঐ সকল ক্ষণ অনেক সময় সমধিক অনুভব আনয়ন করে। কিয়ৎকালের জন্য যেন বাদল সরিয়া যায় ও সত্যসূর্যের প্রকাশ হয়। কাহারও বা অর্ধেক বন্ধন খুলিয়া যায়। সকল বন্ধন অপেক্ষা মানের বন্ধন বড় দৃঢ়—লোকের ভয় যমের ভয় অপেক্ষাও অধিক; তাও যেন একটু শ্লথ হইয়া পড়ে; মন যেন অন্ততঃ মুহূর্তের জন্য দেখিতে পায় যে, লোকের কথা—মতামত অপেক্ষা অন্তর্যামী প্রভুর কথা শুনাই ভাল। আবার মেঘ ঢাকে, এই তো মায়া! যদিও বহু দিবস যাবৎ মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পত্রাদি ব্যবহার হয় নাই, তথাপি অন্যের নিকট মহাশয়ের সকল সংবাদই প্রায় প্রাপ্ত হই। মধ্যে মহাশয় কৃপাপূর্বক এক গীতার অনুবাদ ইংলণ্ডে আমায় প্রেরণ করেন। তাহার মলাটে একছত্র ভবৎ-হস্তলিপি মাত্র ছিল। শুনিলাম, তাহার উত্তরপত্রে অতি অল্প কথা থাকায় মহাশয়ের মনে—আপনার প্রতি আমার অনুরাগের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইয়াছে।

উক্ত সন্দেহ অমূলক জানিবেন। অল্প কথা লিখিবার কারণ এই যে, চারি-পাঁচ বৎসরের মধ্যে ইংরেজী-গীতার মলাটে ঐ একছত্র মাত্র আপনার হস্তলিপি দেখিলাম। তাহাতে বোধ হইল যে, আপনার যখন অধিক লিখিবার অবকাশ নাই, তখন পড়িবার অবকাশ কি হইবে?

দ্বিতীয়ত শুনিলাম, গৌরচর্মবিশিষ্ট হিন্দুধর্ম-প্রচারকেরই আপনি বন্ধু, দেশী নচ্ছার কালা আদমী আপনার নিকট হেয়, সে ভয়ও ছিল। তৃতীয়তঃ আমি ম্লেচ্ছ শূদ্র ইত্যাদি, যা-তা খাই, যার-তার সঙ্গে খাই—প্রকাশ্যে সেখানে এবং এখানে। তা ছাড়া মতেরও বহু বিকৃতি উপস্থিত—এক নির্গুণ ব্রহ্ম বেশ বুঝিতে পারি, আর তারই ব্যক্তিবিশেষে বিশেষ প্রকাশ দেখিতে পাইতেছি—ঐ-সকল ব্যক্তিবিশেষের নাম ‘ঈশ্বর’ যদি হয় তো বেশ বুঝিতে পারি—তদ্ভিন্ন কাল্পনিক জগৎকর্তা ইত্যাদি হাস্যকর প্রবন্ধে বুদ্ধি যায় না।

ঐ প্রকার ‘ঈশ্বর’ জীবনে দেখিয়াছি এবং তাঁহারই আদেশে চলিতেছি। স্মৃতি-পুরাণাদি সামান্যবুদ্ধি মনুষ্যের রচনা—ভ্রম, প্রমাদ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তাহার যেটুকু উদার ও প্রীতিপূর্ণ, তাহাই গ্রাহ্য, অপরাংশ ত্যাজ্য। উপনিষদ্ ও গীতা যথার্থ শাস্ত্র—রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীরাদিই যথার্থ অবতার; কারণ ইঁহাদের হৃদয় আকাশের ন্যায় অনন্ত ছিল—সকলের উপর রামকৃষ্ণ; রামানুজ-শঙ্করাদি সঙ্কীর্ণ-হৃদয় পণ্ডিতজী মাত্র। সে প্রীতি নাই, পরের দুঃখে তাঁহাদের হৃদয় কাঁদে নাই—শুষ্ক পাণ্ডিত্যই—আর আপনি তাড়াতাড়ি মুক্ত হইব!! তা কি হয়, মহাশয়? কখনও হয়েছে, না হবে? ‘আমি’র লেশমাত্র থাকতে কি কিছু হবে?

অপর এক মহা বিপ্রতিপত্তি—আমার দিন দিন দৃঢ় ধারণা [হইতেছে] এই যে, জাতি-বুদ্ধিই মহাভেদকারী ও মায়ার মূল—জন্মগত বা গুণগত সর্বপ্রকার জাতিই বন্ধন। কোন কোন বন্ধু বলেন—তা মনে মনে থাক—বাহিরে, ব্যাবহারিকে, জাতি-আদি রাখিতে হইবে বৈকি। … মনে মনে অভেদবুদ্ধি (‘পেটে পেটে’ যার নাম বুঝি), আর বাহিরে পিশাচ-নৃত্য, অত্যাচার, উৎপীড়ন—গরীবের যম; আর চণ্ডালও যদি বড় মানুষ হয়, তিনি ধর্মের রক্ষক!!!

তাতে আমি পড়ে-শুনে দেখছি যে, ধর্মকর্ম শূদ্রের জন্য নহে; সে যদি খাওয়া-দাওয়া বিচার বা বিদেশগমনাদি বিচার করে তো তাতে কোন ফল নাই, বৃথা পরিশ্রম মাত্র। আমি শূদ্র ও ম্লেচ্ছ—আমার আর ও-সব হাঙ্গামে কাজ কি? আমার ম্লেচ্ছের অন্নে বা কি, আর হাড়ীর অন্নে বা কি? আর জাতি ইত্যাদি উন্মত্ততা—যাজকদের লিখিত গ্রন্থেই পাওয়া যায়, ঈশ্বর-প্রণীত গ্রন্থে নাই। যাজকদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাহারাই ভোগ করুন, ঈশ্বরের বাণী আমি অনুসরণ করি, তাহাতেই আমার কল্যাণ হইবে।

আর এক কথা বুঝেছি যে, পরোপকারই ধর্ম, বাকী যাগযজ্ঞ সব পাগলাম—নিজের মুক্তি-ইচ্ছাও অন্যায়। যে পরের জন্য সব দিয়েছে, সে-ই মুক্ত হয়, আর যারা ‘আমার মুক্তি, আমার মুক্তি’ করে দিনরাত মাথা ভাবায়, তাহারা ‘ইতো নষ্টস্ততো ভ্রষ্টঃ’ হয়ে বেড়ায়, তাহাও অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। এই পাঁচ রকম ভেবে মহাশয়কে পত্রাদি লিখিতে ভরসা হয় নাই।

এ সব সত্ত্বেও যদি আপনার প্রীতি আমার উপর থাকে, বড়ই আনন্দের বিষয় বোধ করিব। ইতি

দাস
বিবেকানন্দঃ

৩৪০*

আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭

প্রিয়—,
তুমি বেদ সম্বন্ধে যে আপত্তিগুলি প্রদর্শন করেছ, সেগুলি যথার্থ বলে স্বীকার করতে পারা যেত, যদি ‘বেদ’ শব্দে কেবল সংহিতা বোঝাত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সর্ববাদিসম্মত মতানুসারে সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্‌ এই তিনটির সমষ্টিই বেদ! এদের মধ্যে প্রথম দুটিকে কর্মকাণ্ড বলে এখন একরকম তুলে দেওয়া হয়েছে। কেবল উপনিষদকেই আমাদের সকল দার্শনিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতারা গ্রহণ করেছেন।

কেবল সংহিতা-অংশটিই বেদ, এ মত অতি আধুনিক এবং স্বর্গীয় স্বামী দয়ানন্দই এই মতের প্রথম প্রবর্তক! প্রাচীন হিন্দুসমাজের ভেতর এই মতের প্রভাব কিছুমাত্র বিস্তৃত হয়নি।

স্বামী দয়ানন্দের এই মত অবলম্বন করবার কারণ এই যে, তিনি, ভেবেছিলেন, সংহিতার নূতন ধরনের ব্যাখ্যা করে তিনি একটি পূর্বাপরসঙ্গত মতবাদের সৃষ্টি করবেন, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা-প্রণালীতে গোল সমভাবেই থেকে গেল; শুধু এইটুকু হল যে, তিনি সংহিতার ভেতর যে অসামঞ্জস্য নিবারণের চেষ্টা করলেন, সেই অসামঞ্জস্য—সেই গোলযোগ ‘ব্রাহ্মণে’র উপর গিয়ে পড়ল। আর তাঁর প্রক্ষিপ্তবাদ ও অন্যান্য ব্যাখ্যা-প্রণালী সত্ত্বেও এখনও এমন অনেক স্থল আছে, যার ভেতর গোল তখনও যেমন, এখনও তেমনি রয়েছে।

যদি সংহিতার উপর ভিত্তি করে পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ধর্মপ্রণালী গঠন করা সম্ভব হয়, তবে উপনিষদকে ভিত্তি করে যে আরও অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ ধর্ম স্থাপন করা যেতে পারে, এ-কথা সহস্রগুণে বেশী নিশ্চিত। অধিকন্তু এ পক্ষে সমগ্র জাতির পূর্বপ্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যেতে হয় না। এ পক্ষে প্রাচীন সকল আচার্যই তোমার পক্ষে থাকবেন, আর নূতন নূতন পথে অগ্রগতিরও যথেষ্ট অবকাশ থাকবে।

গীতা নিশ্চয়ই এতদিনে হিন্দুধর্মের বাইবেল-স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং উহা সম্পূর্ণরূপেই ঐ সম্মানের উপযুক্ত; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মূল চরিত্র বর্তমানে এতটা কুয়াশায় ঢেকে আছে যে, তা থেকে জীবনপ্রদ উদ্দীপনা লাভ করা বর্তমান কালে অসম্ভব। বিশেষতঃ বর্তমান যুগে নূতন নূতন চিন্তাপ্রণালী ও নূতন ভাবে জীবনযাত্রা-নির্বাহের প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। আশা করি, আমার এই ক্ষুদ্র পত্র তোমায় আমার প্রদর্শিত পথে চিন্তার সাহায্য করবে। আমার শুভার্শীবাদ জানবে। ইতি

তোমারই
বিবেকানন্দ

৩৪১

[[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]]

ওঁ তৎ সৎ

আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
অবগমং কুশলং তত্রাত্যানাং বার্তাঞ্চ সবিশেষাং মঠস্য তব পত্রিকায়াম্। মমাপি বিশেষোঽস্তি শরীরস্য; সবিশেষঃ জ্ঞাতব্যঃ ভিষক‍্‍প্রবরস্য শশিভূষণস্য সকাশাৎ। ব্রহ্মানন্দেন সংস্কৃতয়া এব রীত্যা চলত্বধুনা শিক্ষা; যদি পশ্চাৎ পরিবর্তনমর্হে তদপি কারয়েৎ। সর্বেষাং সম্মতিং গৃহীত্বা তু করণীয়মিতি ন বিস্মর্তব্যম্‌।

অহমধুনা আলমোড়ানগরস্য কিঞ্চিদুত্তরং কস্যচিদ্‌ বণিজ উপবনোপদেশে নিবসামি। সম্মুখে হিমশিখরাণি হিমালয়স্য প্রতিফলিতদিবাকরকরৈঃ পিণ্ডীকৃতরজতানীব ভান্তি প্রীণয়ন্তি চ। অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীরম্‌। যোগানন্দঃ খলু সমধিকমস্বস্থ ইতি শৃণোমি আমন্ত্রয়ামি তমাগন্তুমত্রৈব। বিভেত্যসৌ পুনঃ পার্বত্যাৎ জলাৎ বায়োশ্চ। ‘উষিত্বা কতিপয়ানি দিবসানি অত্রোপবনে যদি ন তাবদ্‌ বিশেষঃ ব্যাধেঃ গচ্ছ ত্বং কলিকাতায়াম্‌’ ইত্যহমদ্য তমলিখম্‌। যথাভিরুচি করিষ্যতি। অচ্যুতানন্দঃ প্রতিদিনং সায়াহ্ণে আলমোড়ানগর্যাং গীতাদিশাস্ত্রপাঠং জনানাহূয় করোতি। বহূনাং নগরবাসিনাং স্কন্ধাবারস্থানাং সৈন্যানাঞ্চ সমাগমোঽস্তি তত্র প্রত্যহম্‌। সর্বানসৌ প্রীণাতি চেতি শৃণোমি।

‘যাবানর্থঃ ইত্যাদি শ্লোকস্য যো বঙ্গার্থঃ ত্বয়া লিখিতঃ নাসৌ মন্মতে সমীচীনঃ। সতি জলে প্লাবিতে উদপানে নাস্তি অর্থঃ প্রয়োজনম্‌’ ইতি অস্যার্থঃ—বিষমোঽয়ম্‌ উপন্যাসঃ, কিং সংপ্লুতোদকে সতি জীবানাং তৃষ্ণা বিলুপ্তা ভবতি? যদ্যেবং ভবেৎ প্রাকৃতিকো নিয়মঃ জলপ্লাবিতায়াং ভূমৌ জলপানং নিরর্থকং—ক্বচিদপি বায়ুমার্গেণ অথবা অন্যেন কেনাপি গূঢ়েনোপায়েন জীবানাং তৃষ্ণানিবারণং স্যাৎ, তদাঽসৌ অপূর্বং অর্থঃ সার্থকঃ ভবিতুমর্হেৎ। নান্যথা। শাঙ্কর এবাবলম্বনীয়ঃ।

ইয়মপি [ব্যাখ্যা] ভবিতুমর্হতি—সর্বতঃ সংপ্লুতোদকায়ামপি ভূমৌ যাবানুদপানে অর্থঃ তৃষ্ণাতুরাণাম্‌ (অল্পজলমলং ভবেদিত্যর্থঃ) ‘আস্তাং তাবদ্‌ জলরাশিঃ, মম প্রয়োজনং স্বল্পেঽপি জলে সিধ্যতি’ এবং বিজানতঃ ব্রাহ্মণস্য সর্বেষু বেদেষু অর্থঃ প্রয়োজনম্‌। যথা সংপ্লুতোদকে পানমাত্রং প্রয়োজনম্‌ তথা সর্বেষু বেদেষু জ্ঞানমাত্রং প্রয়োজনম্‌।

ইয়মপি ব্যাখ্যা অধিকতরা সন্নিধিমাপন্না গ্রন্থকারাভিপ্রেতা চ। উপপ্লাবিতায়ামপি ভূমৌ পানায় উপাদেয়ং পানায় হিতং জলমেব অন্বিষ্যন্তি লোকাঃ নানাৎ। নানাবিধানি জলানি সন্তি ভিন্নগুণ-ধর্মাণি উপপ্লাবিতায়া অপি ভূমেস্তারতম্যাৎ। এবং বিজানন্ ব্রাহ্মণো্ঽপি বিবিধজ্ঞানোপপ্লাবিতে বেদাখ্যে শব্দসমুদ্রে সংসারতৃষ্ণানিবারণার্থং তদেব গৃহ্নীয়াৎ যদলং ভবতি নিঃশ্রেয়সায়। ব্রহ্মজ্ঞানং হি তৎ।

ইতি শং সাশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য

[বঙ্গানুবাদ]

কল্যাণবরেষু,
তোমার চিঠিতে মঠের সবিশেষ বার্তা ও তত্রত্য সকলের কুশল অবগত হলাম। আমারও শরীরের কিছু উন্নতি হয়েছে। ভিষক‍্‍প্রবর শশিভূষণের কাছে সবিশেষ জানবে। ব্রহ্মানন্দ এখন সংশোধিত প্রস্তাবমতই শিক্ষাকার্য চালিয়ে যাক, পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও যেন করে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, সকলের সম্মতি নিয়েই তা করতে হবে।

আমি বর্তমানে আলমোড়া থেকে কিঞ্চিৎ উত্তরে একজন ব্যবসায়ীর একটি বাগান- বাড়ীতে বাস করছি। আমার সম্মুখে তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়ের চূড়াগুলি প্রতিফলিত সূর্যালোকে রজতস্তূপের মত দেখাচ্ছে এবং আনন্দ প্রদান করছে। মুক্তবায়ু-সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু শুনতে পেলাম যে, যোগানন্দ খুব অসুস্থ। তাকে এখানে আসবার জন্য আমন্ত্রণ করছি। সে অবশ্য পাহাড়ে জলহাওয়ায় ভয় পায়। আজ তাকে লিখলাম, ‘এই বাগানে কিছুদিন থেকে দেখ—যদি অসুখের কোন উপশম বোধ না কর, তবে কলিকাতা ফিরে যেও।’—এখন সে যেমন ভাল মনে করে, তাই করবে। আলমোড়া শহরে অচ্যুতানন্দ প্রতি সন্ধ্যায় বহুলোক একত্র করে তাদের সম্মুখে গীতা এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে। শহরের অনেক অধিবাসী, এমন কি সৈন্যাবাস থেকে সৈন্যেরা পর্যন্ত প্রতিদিন আসে; আর শুনছি, তারা আলোচনা বিশেষ উপভোগ করে।

‘যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ স্বংপ্লুতোদকে’ (গীতা, ২।৪৬)—ইত্যাদি শ্লোকের তুমি যে বঙ্গার্থ লিখেছ, তা আমার মতে সমীচীন নয়। তুমি এই অর্থ দিয়েছ—‘যখন দেশ জলপ্লাবিত হয়, তখন পানের জন্য পুষ্করিণী প্রভৃতির প্রয়োজন নাই’—এটা অদ্ভুত কল্পনা। জলপ্লাবন হলে লোকের তৃষ্ণা বিলুপ্ত হয়ে যায় নাকি? প্রাকৃতিক নিয়ম যদি এরূপ হয় যে, কোন স্থান জলপ্লাবিত হবার পর জল পান নিরর্থক হয়ে যায়, আর বায়ু অথবা কোন অদৃশ্য উপায়ে স্বতই তৃষ্ণা দূরীভূত হয়ে যায়—তবেই ঐ অদ্ভুত ব্যাখ্যা সমীচীন হতে পারে, নতুবা নয়। শঙ্করের ব্যাখ্যাই অনুসরণীয়।

অথবা এ ভাবেও শ্লোকটির ব্যাখ্যা হতে পারেঃ সমস্ত দেশ বন্যাপ্লাবিত হলে তৃষ্ণাতুরের নিকট ক্ষুদ্র জলাশয়ের যতটুকু প্রয়োজন (অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ পানীয় জলই তৃষ্ণার্তের পক্ষে যথেষ্ট)—সে যেমন বলে, ‘বিরাট জলরাশি থাকুক বা না থাকুক, সামান্য একটু পানীয় জলই আমার পক্ষে যথেষ্ট’—জ্ঞানী ব্রাহ্মণের পক্ষে সমগ্র বেদগ্রন্থেও ততটুকুই প্রয়োজন। সর্বব্যাপী বন্যার প্রয়োজন যেমন তৃষ্ণানিবারণ মাত্র, তেমনি সমগ্র বেদের প্রয়োজন কেবল জ্ঞান।

এই ব্যাখ্যাটিও অধিকতর স্পষ্ট ও গ্রন্থকারের অভিপ্রায়ানুরূপ—সমস্ত স্থান জলপ্লাবিত হলে মানুষ কেবল পানের জন্য আহরণীয়, পানের যোগ্য জলেরই অনুসন্ধান করে, অন্য জলের নয়। (কারণ) জলপ্লাবন হলেও মৃত্তিকার তারতম্যানুসারে বিভিন্ন গুণের ও বিভিন্ন ধর্মের জল দেখতে পাওয়া যায়। কৌশলী ব্রাহ্মণও সেরূপ জ্ঞানের শতধারাপ্লাবিত ‘বেদ’ নামে খ্যাত বিরাট শব্দসমুদ্র হতে সেই অংশটুকু আহরণ করবেন, যাতে সংসারের দারুণ তৃষ্ণা দূর হয় এবং যা মুক্তি দান করবার শক্তি ধারণ করে। কেবল ব্রহ্মজ্ঞানই তা করতে সক্ষম। আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৪২*

[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]

আলমোড়া
২ জুন, ১৮৯৭

স্নেহের মেরী,
আমার প্রতিশ্রুত খোশগল্পভরা বড় চিঠিখানি শুরু করছি—আকারে তা সত্যি বড় হয়ে উঠুক, এই সদিচ্ছা নিয়ে। তা যদি না হয়ে ওঠে, সে তোমার কর্মফল। তোমার স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খুব ভাল যাচ্ছে। আমার শরীর খুবই খারাপ; আজকাল কিছুটা উন্নতি বোধ করছি—আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠব।

লণ্ডনের কাজকর্ম কি রকম চলছে? আমার ভয় হচ্ছে, বুঝি বা সেটা একেবারে ভেঙেচুরে যায়। তুমি মাঝে মাঝে লণ্ডন যাও তো? স্টার্ডির একটি শিশুসন্তান হয়েছে, নয় কি?

ভারতে সমতলভূমিতে এখন দাবদাহ। তা সহ্য করতে না পেরে এখানে এই পাহাড়ে এসেছি—জায়গাটা সমতলের চেয়ে কিছু ঠাণ্ডা।

আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি—এর চারিদিকে বহু ক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য। পরশু রাত্রে একটি চিতাবাঘ এই বাগানে এসে পাল থেকে একটি ছাগল নিয়ে গেছে। চাকরদের প্রাণপণ চেঁচামেচি ও পাহারাদার তিব্বতী কুকুরগুলির ঘেউ ঘেউ শব্দ মিলে ভয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা হবার মত অবস্থা ঘটেছিল। আমি এখানে আসা অবধি রোজ রাত্রে এই কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। চিতাবাঘটি তাই সুযোগ বুঝে একটি বেশ ভাল আহার্য জুটিয়ে নিল, সম্ভবতঃ অনেক সপ্তাহ এ-রকম জোটেনি। এতে তার প্রভূত কল্যাণ হোক!

মিস মূলারকে তোমার মনে পড়ে কি? কয়েকদিন থাকবার জন্য তিনি এখানে এসেছেন, কিন্তু চিতাবাঘের বৃত্তান্তটি শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে যে, লণ্ডনে পাকা চামড়ার চাহিদা খুব বেশী, আর অন্য কিছুর চেয়ে এই চাহিদাই আমাদের চিতা ও বাঘগুলির মধ্যে ব্যাপক ধ্বংস নিয়ে এসেছে।

তোমাকে লিখতে লিখতে আমার সামনে সারি সারি দিগন্তবিস্তৃত বরফের চূড়াগুলির উপর অপরাহ্নের রক্তিমাভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সেগুলি এখান থেকে সোজাসুজি কুড়ি মাইল—আর আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথে চল্লিশ মাইল।

আশা করি কাউণ্টেস-এর কাগজে তোমার তর্জমাগুলি সমাদরে গৃহীত হয়েছে। এই জুবিলী-উৎসবের মরসুমে আমাদের দেশীয় কয়েকজন রাজার সঙ্গে আমার ইংলণ্ড যাবার খুব ইচ্ছা ছিল এবং সুযোগও ঘটেছিল, কিন্তু আমার চিকিৎসকেরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইওরোপ যাওয়া মানে কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি মেলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়া-কাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে। যা হোক, আমি এখন বহুপ্রত্যাশিত বিশ্রাম উপভোগ করছি, আশা করি—এতে আমার পক্ষে ভালই হবে।

তোমার কাজ কিরকম চলছে? আনন্দে না দুঃখে? তোমার কি ইচ্ছা হয় না বেশ কয়েক বছর কোন কাজকর্ম না করে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে? নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা—আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি। মিঃ গুডউইন আমার সঙ্গে আছেন। ভারতীয় পোষাকে তুমি যদি তাকে দেখতে! খুব শীঘ্রই মস্তক মুণ্ডন করিয়ে তাকে একটি পূর্ণ-বিকশিত সন্ন্যাসীতে পরিণত করতে যাচ্ছি।

তুমি এখনও কিছু কিছু যোগাভ্যাস করছ নাকি? তাতে কিছু উপকার পেয়েছ কি? খবর পেলাম—মিঃ মার্টিন মারা গিয়েছেন। মিসেস মার্টিন কেমন আছেন—তাঁকে মাঝে মাঝে দেখতে যাও তো?

মিস নোব্‌ল্‌কে তুমি চেন কি? তাঁকে তুমি কখনও দেখেছ? এখানেই আমার চিঠি শেষ করতে হচ্ছে, কারণ বিরাট এক ধূলির ঝড় আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, লেখা আর সম্ভব হচ্ছে না। এ-সবই তোমার কর্মফল, স্নেহের মেরী, কারণ আমার তো ইচ্ছা ছিল—তোমাকে কত না অদ্ভুত ঘটনা লিখব ও মজার গল্প বলব; এখন সেগুলি আমাকে ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতে হবে, আর তোমাকেও অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ইতি

সতত প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৪৩*

আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭

কল্যাণীয়া মিস নোব‍্‌ল্‌,
… আমি নিজে তো বেশ সন্তুষ্ট আছি। আমি আমার স্বদেশবাসীদের অনেককে জাগিয়েছি; আর আমি চেয়েছিলাম তাই। জগৎ আপন ধারায় চলুক এবং কর্মের গতি অপ্রতিরুদ্ধ হোক। এ জগতে আমার আর কোন বন্ধন নেই। সংসারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় হয়েছে, এর সবখানিই স্বার্থপ্রণোদিত—স্বার্থের জন্য জীবন, স্বার্থের জন্য প্রেম, স্বার্থের জন্য মান, সবই স্বার্থের জন্য। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করি এবং দেখতে পাই, আমি এমন কোন কাজ করিনি যা স্বার্থের জন্য—এমন কি আমার কোন অপকর্মও স্বার্থপ্রণোদিত নয়; সুতরাং আমি সন্তুষ্ট আছি। অবশ্য আমার এমন কিছু মনে হয় না যে, আমি কোন বিশেষ ভাল বা মহৎ কাজ করেছি; কিন্তু জগৎটা বড়ই তুচ্ছ, সংসার বড়ই জঘন্য এবং জীবনটা এতই হীন যে, এই ভেবে আমি অবাক হই, মনে মনে হাসি যে, যুক্তিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কেমন করে এই স্বার্থের—এই হীন ও জঘন্য পুরস্কারের পেছনে ছুটতে পারে।

এই হল খাঁটি কথা। আমরা একটা বেড়াজালে পড়ে গেছি এবং যত শীঘ্র কেউ বেরিয়ে যেতে পারে, ততই মঙ্গল। আমি সত্যের সাক্ষাৎ পেয়েছি; এখন দেহটা জোয়ার-ভাটায় ভেসে চলুক—কে মাথা ঘামায়?

আমি এখন যেখানে আছি, সেটি পাহাড়ের উপর এক সুন্দর বাগান। উত্তরে প্রায় সমস্ত দিক‍্‍চক্রবাল জুড়ে স্তরে স্তরে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গাবলী আর নিবিড় বনরাজি। এখানে তেমন শীত নেই, গরমও বেশী নয়। সকাল ও সন্ধ্যাগুলি বড়ই মনোরম। সারা গ্রীষ্মটা আমার এখানে থাকা উচিত; বর্ষা শুরু হলে সমতলে নেমে গিয়ে কাজ করবার ইচ্ছা।

লোকালয় থেকে দূরে—নিভৃতে নীরবে পুঁথিপত্র নিয়ে পড়ে থাকার সংস্কার নিয়েই আমি জন্মেছি, কিন্তু মায়ের ইচ্ছা অন্যরূপ; তবু সংস্কারের অনুবৃত্তি চলেছে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৪৪*

[জনৈক আমেরিকান ভক্তকে লিখিত]

আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭
আমার জন্য তোমাদের এত চিন্তিত হবার কিছুই নেই। আমার দেহ নানাপ্রকার রোগে বার বার আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেই কাল্পনিক পক্ষীবিশেষের (Phoenix) মত আমি আবার বার বার আরোগ্য লাভও করছি। আমার শরীর দৃঢ়বদ্ধ বলে আমি যেমন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করতে পারি, তেমনি আবার অতিরিক্ত শক্তি আমার দেহে রোগ নিয়ে আসে। সব বিষয়েই আমি চরমপন্থী—এমন কি আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তাই; হয় আমি লৌহদৃঢ় বৃষের মত অদম্য বলশালী, নতুবা একেবারে ভগ্নদেহ … ।

অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই এই রোগের সৃষ্টি হয়েছিল—বিশ্রাম নেওয়ার ফলে সে রোগ প্রায় দূর হয়েছে। দার্জিলিঙে থাকতে আমি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছিলাম; কিন্তু এখন আলমোড়াতে এসে আর সব বিষয়ে সুস্থ বোধ করলেও অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছি, এবং তা সারাবার জন্য ‘Christian Science’ (নিজের বিশ্বাসবলে রোগ সারানর) মত অনুযায়ী বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিঙে শুধু মানসিক চিকিৎসা-সহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম। আর এখানে আমার নিত্যকর্ম হচ্ছে—যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করা, পাহাড় চড়াই করা, বহুদূর পর্যন্ত ঘোড়ায় দৌড়ান এবং তারপর আহার ও বিশ্রাম। এখন আমি আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছি এবং শক্তিও বেশ পাচ্ছি। এর পর যখন দেখা হবে, তখন দেখতে পাবে—আমার চেহারা কুস্তিগিরের মত।

তুমি কেমন আছ এবং কি করছ, মিসেস-এর সময় কেমন কাটছে জানিও। ব্যাঙ্কের জমা কিছু কিছু বাড়াচ্ছ তো? আমার জন্য হলেও তা তোমাকে করতে হবে। যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে—কেমন পারবে তো? ইতি

বিবেকানন্দ