২২. পত্রাবলী ৩২৫-৩৩৪

৩২৫*

ড্যাম্পিয়ার, ‘প্রিন্স-রিজেণ্ট লিওপোল্ড’
৩ জানুআরী, ১৮৯৭

প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি লণ্ডন থেকে ঠিকানা বদল হয়ে রোমে আমার কাছে পৌঁছেছে। তোমার অশেষ সৌজন্য যে, অমন সুন্দর একখানি চিঠি লিখেছ, তার প্রতিটি ছত্র আমি উপভোগ করছি। ইওরোপে অর্কেষ্ট্রার ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। নেপল‍্স‍্ থেকে চারদিন ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রার পর পোর্ট সৈয়দের কাছে এসে পড়েছি। জাহাজ খুব দুলছে—অতএব এই অবস্থায় লেখা আমার এই হিজিবিজি তুমি ক্ষমা করো।

সুয়েজ থেকে এশিয়া। আবার এশিয়ায়! আমি কি এশিয়াবাসী, ইওরোপীয় না আমেরিকান? আমার মধ্যে ব্যক্তিত্বের একটা অদ্ভুত সংমিশ্রণ অনুভব করছি। ধর্মপালের গতিবিধি বা কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছু লেখনি। গান্ধীর চেয়ে তার সম্বন্ধেই আমার অনেক বেশী আগ্রহ।

কয়েকদিন পরেই কলম্বোতে নামছি, এবং সিংহলে কিছু একটা করব ভাবছি। এক সময় সিংহলে দু-কোটি অধিবাসী ছিল—তাদের বিরাট রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ প্রায় এক-শ বর্গমাইল জুড়ে পড়ে রয়েছে।

সিংহলীরা দ্রাবিড়জাতি নয়—খাঁটি আর্য। প্রায় ৮০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে বাঙলাদেশ থেকে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপিত হয় এবং সেই সময় থেকে তারা তাদের পরিষ্কার ইতিহাস রেখেছে। এখানেই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র, আর অনুরাধাপুর ছিল সেকালের লণ্ডন।

পাশ্চাত্যের সব কিছুর মধ্যে আমি রোমকেই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি, পম্পিয়াই দেখার পর তথাকথিত ‘আধুনিক সভ্যতা’র ওপর আমি একেবারে শ্রদ্ধা হারিয়েছি। বাষ্প আর বিদ্যুৎ বাদ দিলে ওদের আর সব কিছু ছিল—এবং আধুনিকদের চেয়ে ওদের চারুকলার ধারণা এবং রূপায়ণের শক্তিও অনন্তগুণে বেশী ছিল। মিস লককে বলো, আমি যে তাকে বলেছিলাম ‘মানবমূর্তির ভাস্কর্য গ্রীসে যতটা উন্নত হয়েছিল, ভারতে ততটা হয়নি’—এ মত আমার ভুল।

ফার্গুসন প্রভৃতির প্রামাণিক গ্রন্থে পড়েছি উড়িষ্যার অথবা জগন্নাথে—যেখানে আমার যাওয়া হয়নি, সে-সব জায়গায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যে-সব মানব-মূর্তি রয়েছে, সেগুলি সৌন্দর্যে এবং অবয়বসংস্থানের চাতুর্যে গ্রীসের যে-কোন শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয়। সেখানে মৃত্যুর একটি বিশাল মূর্তি আছে—প্রকাণ্ড একটি লোলচর্ম নারীকঙ্কাল—তার প্রতিটি অবয়বের নিখুঁত সংস্থান ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। গ্রন্থকার বলেছেন—অলিন্দে স্থিত একটি নারীমূর্তি ঠিক মেডিচির ভেনাসের মত! এমন আরও কত কি!

মনে রেখো মূর্তিবিদ্বেষী মুসলমানরা প্রায় সবই ধ্বংস করেছে, তবু যা আছে—তা সমগ্র ইওরোপীয় ধ্বংসস্তূপের চেয়ে বেশী! আট বছর ঘুরেছি, তবু শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের অনেকগুলিই দেখা হয়নি।

ভগিনী লককেও বলো—ভারতের অরণ্যে একটি বিধ্বস্ত মন্দির রয়েছে; ফার্গুসন মনে করেন, সেটি আর গ্রীসের পার্থিনন স্থাপত্যশিল্প, যে যার নিজ আদর্শের শিখরসীমা; একটি হল ভাবের, আর একটি হল ভাব ও খুঁটিনাটির। পরবর্তী মোগল সৌধাবলী প্রভৃতি ইন্দো-সারাসেন স্থাপত্যশিল্প প্রাচীনকালের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলির সামনে তুলনায় একদম দাঁড়াতে পারে না। … স্নেহ ভালবাসা জেনো। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনঃ—ফ্লোরেন্সে হঠাৎ মাদার চার্চ ও ফাদার পোপের সঙ্গে দেখা। সে তো তুমি জেনেছ।

—বি

৩২৬*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

রামনাদ
শনিবার, ৩০ জানুআরী, ১৮৯৭

স্নেহের মেরী,
চারিদিকের অবস্থা অতি আশ্চর্যরূপে আমার অনুকূল হয়ে আসছে। সিংহলে—কলম্বোয় আমি জাহাজ থেকে নেমেছি এবং এখন ভারতবর্ষের প্রায় শেষ দক্ষিণপ্রান্ত রামনাদে সেখানকার রাজার অতিথিরূপে রয়েছি। এই কলম্বো থেকে রামনাদ পর্যন্ত আমার পর্যটন যেন একটা বিরাট শোভাযাত্রা—হাজার হাজার লোকের ভিড়, আলোকসজ্জা, অভিনন্দন ইত্যাদি! ভারতভূমির যেখানে আমি প্রথম পদার্পণ করি, সেই স্থানে ৪০ ফুট উচ্চ একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী হচ্ছে। রামনাদের রাজা একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত খাঁটি সোনার তৈরী বৃহৎ পেটিকায় তাঁর অভিনন্দনপত্র আমাকে দিয়েছেন; তাতে আমাকে His Most Holiness (মহাপবিত্রস্বরূপ) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা আমার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে, যেন সমগ্র দেশটা আমাকে অভিনন্দন করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সুতরাং তুমি দেখতে পাচ্ছ, মেরী, আমি আমার সৌভাগ্যের উচ্চতম শিখরে উঠেছি। তবু আমার মন চিকাগোর সেই নিস্তব্ধ, প্রশান্ত দিনগুলির দিকেই ছুটছে—কি বিশ্রাম-শান্তি ও প্রেমপূর্ণ দিনগুলি! তাই এখনি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। আশা করি, তোমরা সকলে বেশ ভাল আছ ও আনন্দে আছ। ডক্টর ব্যারোজকে সাদর অভ্যর্থনা করবার জন্য আমি লণ্ডন থেকে আমার স্বদেশবাসীদের নিকট চিঠি লিখেছিলাম। তারা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা করেছিল। কিন্তু তিনি লোকের মনের উপর কোন রেখাপাত করতে পারেননি, তার জন্য আমি দোষী নই। কলিকাতার লোকের ভিতর নূতন কিছু ভাব ঢোকান বড় কঠিন। ডক্টর ব্যারোজ আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু ভাবছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি; এই তো সংসার! মা, বাবা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ

৩২৭

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মান্দ্রাজ
১২ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭

প্রিয় রাখাল,
আগামী রবিবার ‘মোম্বাসা’ জাহাজে আমার রওনা হবার কথা। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় পুণার এবং আরও অনেক স্থানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ও গরমে আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।

থিওসফিষ্টরা ও অন্যান্য সকলে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল; সুতরাং আমাকেও দু-চারটি কথা—খোলাখুলিভাবে তাদের শোনাতে হয়েছিল। তুমি জান, তাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাকে আমেরিকায় বরাবর নির্যাতিত করেছে। এখানেও তারা তাই শুরু করতে চেয়েছিল। কাজেই আমার মত পরিষ্কার করে বলতে হয়েছিল। এতে আমার কলিকাতার বন্ধুদের কেউ যদি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তো ভগবান্ তাঁদের কৃপা করুন। তোমার ভয় পাবার কারণ নেই; আমি নিঃসঙ্গ নই—প্রভু সর্বদাই আমার সঙ্গে আছেন। অন্য কীই বা করতে পারতুম। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—উপযুক্ত আসবাব থাকলে বাড়ীখানি নিও।

—বি

৩২৮*

আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭

প্রিয় মিসেস বুল,
সারদানন্দ ভারতের দুর্ভিক্ষ-মোচনের জন্য ২০ পাউণ্ড পাঠিয়েছে। কিন্তু কথায় বলে, ‘আগে নিজের ঘর সামলাও’, সুতরাং প্রথমে সেই দুর্ভিক্ষ দূর করাই আমি শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলে মনে করলাম। অতএব ঐ অর্থ যথাযথ কাজেই লাগান হয়েছে।

লোকে যেমন বলে, ‘আমার মরবারও সময় নেই’, সমগ্র দেশময় শোভাযাত্রা, বাদ্যভাণ্ড ও সম্বর্ধনার রকমারী আয়োজনে আমি এখন মৃতপ্রায়। জন্মোৎসব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাহাড়ে পালিয়ে যাব। আমি ‘কেম্ব্রিজ সম্মেলন’ থেকে একটি এবং ‘ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশন’ থেকে আর একটি মানপত্র পেয়েছি। ‘নিউ ইয়র্ক বেদান্ত এসোসিয়েশনে’র যে মানপত্রের কথা ডাঃ জেন‍্‍স্ লিখেছেন, তা এখনও পৌঁছয়নি।

ডাঃ জেন‍্‍সের আর একখানি চিঠিও এসেছে, তাতে ভারতবর্ষে আপনাদের সম্মেলনের অনুরূপ কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ-সব বিষয়ে মনযোগ দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি ক্লান্ত—এতই ক্লান্ত যে, যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ-মাসও বাঁচব কিনা সন্দেহ!

বর্তমানে আমাকে দুটি কেন্দ্র খুলতে হবে—একটি কলিকাতায়, আর একটি মান্দ্রাজে। মান্দ্রাজীদের গাম্ভীর্য বেশী, আর তারা অনেক বেশী অকপট এবং আমার বিশ্বাস তারা মান্দ্রাজ থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। কলিকাতার লোক, বিশেষতঃ কলিকাতার অভিজাত সম্প্রদায় দেশপ্রেমের হুজুগের বেলায় উৎসাহী; কিন্তু তাদের সহানুভূতি কখনও বাস্তবে পরিণত হবে না। প্রত্যুত, এদেশে হিংসুক ও নির্দয় প্রকৃতির লোকের সংখ্যা বড় বেশী—তারা আমার সব কাজকে লণ্ডভণ্ড করে নষ্ট করতে কোন চেষ্টার ত্রুটি করবে না।

তবে আপনি তো বেশ জানেন, বাধা যত বাড়ে, আমার ভেতরের দৈত্যটাও তত বেশী জেগে ওঠে। সন্ন্যাসীদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আমার মৃত্যু হলে আমার জীবনব্রত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

আমি ইংলণ্ড থেকে ৫০০ পাউণ্ড এবং মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে ৫০০ পাউণ্ড পূর্বেই পেয়েছি। ঐ সঙ্গে আপনার দেওয়া অর্থ যোগ করলে দুটো কেন্দ্রই আরম্ভ করতে পারব নিশ্চয়। সুতরাং যথাসম্ভব সত্বর আপনার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সবচেয়ে নিরাপদ উপায় মনে হচ্ছে—আমেরিকার কোন ব্যাঙ্কে আপনার ও আমার দুজনের নামে টাকাটা জমা দেওয়া, যাতে আমাদের যে-কেউ টাকাটা তুলতে পারে। যদি টাকা তোলবার আগেই আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনি ঐ টাকার সবটা তুলে আমার অভিপ্রায় অনুসারে খরচ করতে পারবেন। তাহলে আমার মৃত্যুর পর আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ আর ঐ টাকা নিয়ে গোলমাল করতে পারবে না। ইংলণ্ডের টাকাও ঐভাবে আমার ও মিঃ স্টার্ডির নামে ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে।

সারদানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আপনিও আমার অসীম প্রীতি ও চিরকৃতজ্ঞতা জানবেন। ইতি

আপনাদের
বিবেকানন্দ

৩২৯

[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

দার্জিলিঙ
১৯ মার্চ, ১৮৯৭

শুভমস্তু। আশীর্বাদপ্রেমালিঙ্গনপূর্বকমিদং ভবতু তব প্রীতয়ে। পাঞ্চভৌতিকং মে পিঞ্জরমধুনা কিঞ্চিৎ সুস্থতরম্। অচলগুরোর্হিমানিমণ্ডিতশিখরাণি পুনরুজ্জীবয়ন্তি মৃতপ্রায়ানপি জনান্ ইতি মন্যে। শ্রমবাধাপি কথঞ্চিৎ দূরীভূতেত্যনুভবামি। যত্তে হৃদয়োদ্বেগকরং মুমুক্ষুত্বং লিপিভঙ্গ্যা ব্যঞ্জিতং, তন্ময়া অনুভূতং পূর্বম্। তদেব শাশ্বতে ব্রহ্মণি মনঃ সমাধাতুং প্রসরতি। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ জ্বলতু সা ভাবনা অধিকমধিকং যাবন্নাধিগতানামেকান্তক্ষয়ঃ কৃতাকৃতানাম্। তদনু সহসৈব ব্রহ্মপ্রকাশঃ সহ সমস্তবিষয়প্রধ্বংসৈঃ। আগামিনী সা জীবন্মুক্তিস্তব হিতায় তবানুরাগদার্ঢ্যেনৈবানুমেয়া। যাচে পুনস্তং লোকগুরুং মহাসমন্বয়াচার্য-শ্রী১০৮রামকৃষ্ণং আবির্ভবিতং তব হৃদয়োদ্দেশং যেন বৈ কৃতকৃতার্থস্ত্বম আবিষ্কৃতমহাশৌর্যঃ লোকান্ সমুদ্ধর্তুং মহামোহসাগরাৎ সম্যগ্ যতিষ্যসে। ভব চিরাধিষ্ঠিত ওজসি। বীরাণামেব করতলগত মুক্তির্ন কাপুরুষাণাম্। হে বীরাঃ, বদ্ধপরিকরাঃ ভবত; সম্মুখে শত্রবঃ মহামোহরূপাঃ। ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ ইতি নিশ্চিতেঽপি সমধিকতরং কুরুত যত্নম্। পশ্যত ইমান্ লোকান্ মোহগ্রাহগ্রস্তান্। শৃণুত অহো তেষাং হৃদয়ভেদকরং কারুণ্যপূর্ণং শোকনাদম্। অগ্রগাঃ ভবত, অগ্রগাঃ হে বীরাঃ, মোচয়িতুং পাশং বদ্ধানাং, শ্লথয়িতুং ক্লেশভারং দীনানাং, দ্যোতয়িতুং হৃদয়ান্ধকূপম্ অজ্ঞানাম্। অভীরভীরিতি ঘোষয়তি বেদান্তডিণ্ডিমঃ। ভূয়াৎ স ভেদায় হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বেষাং জগন্নিবাসিনামিতি—

তবৈকান্তশুভভাবুকঃ
বিবেকানন্দঃ

(বঙ্গানুবাদ)

শুভ হউক। আশীর্বাদ ও প্রেমালিঙ্গনপূর্ণ পত্রখানি তোমাকে সুখী করুক। অধুনা আমার পাঞ্চভৌতিক দেহপিঞ্জর পূর্বাপেক্ষা কিছু সুস্থ আছে। আমার মনে হয়, পর্বতরাজ হিমালয়ের হিমানীমণ্ডিত শিখরগুলি মৃতপ্রায় মানবদিগকেও সজীব করিয়া তোলে। পথশ্রমের কথঞ্চিৎ লাঘব হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। লিখনভঙ্গীতে তোমার হৃদয়োদ্বেগকর যে মুমুক্ষুত্ব প্রকটিত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বেই অনুভব করিয়াছি। সেই মুমুক্ষুত্বই ক্রমশঃ নিত্যস্বরূপ ব্রহ্মে মনের একাগ্রতা আনিয়া দেয়। মুক্তিলাভের আর অন্য পন্থা নাই। সেই ভাবনা তোমার উত্তরোত্তর বর্ধিত হউক, যতদিন না সমুদয় কৃতকর্ম সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তখন তোমার হৃদয়ে সহসা ব্রহ্মের প্রকাশ হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে সমুদয় বিষয়বাসনা নষ্ট হইয়া যাইবে। তোমার অনুরাগের দৃঢ়তা দ্বারা জানা যাইতেছে, পরমকল্যাণকর সেই জীবন্মুক্তি অবস্থা তুমি শীঘ্রই লাভ করিবে। এক্ষণে সেই লোকগুরু মহাসমন্বয়চার্য শ্রী১০৮রামকৃষ্ণদেবের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তিনি তোমার হৃদয়ে আবির্ভূত হন, যাহাতে তুমি কৃতকৃতার্থ ও মহাশৌর্যশালী হইয়া মহামোহসাগর হইতে লোকদিগেরও উদ্ধারের জন্য সম্যক্ যত্ন করিতে পার। চিরতেজস্বী হও। মুক্তি বীরদিগেরই করতলগত, কাপুরুষদিগের নহে। হে বীরগণ! বদ্ধপরিকর হও, মহামোহরূপ শত্রুগণ সম্মুখে। শ্রেয়োলাভে বহু বিঘ্ন ঘটে; ইহা নিশ্চিত হইলেও তাহা লাভ করিতে সমধিক যত্ন কর। দেখ, জীবগণ মোহরূপ কুম্ভীরের কবলে পড়িয়া কি কষ্ট পাইতেছে! আহা! তাহাদের হৃদয়বিদারক করুণ আর্তনাদ শ্রবণ কর। হে বীরগণ, বদ্ধদিগের পাশ মোচন করিতে, দরিদ্রের ক্লেশভার লঘু করিতে ও অজ্ঞজনগণের হৃদয়ান্ধকার দূর করিতে অগ্রসর হও—অগ্রসর হও। ঐ শুন, বেদান্তদুন্দুভি ঘোষণা করিতেছে—‘ভয় নাই, ভয় নাই।’ সেই দুন্দুভিধ্বনি নিখিল জগদ্বাসিগণের হৃদয়গ্রন্থি ভেদ করিতে সমর্থ হউক।

তোমাদের পরমশুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

৩৩০

C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২০ মার্চ (এপ্রিল?), ১৮৯৭

প্রিয় শশী,
তোমরা অবশ্যই এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছ। বিলিগিরি অবশ্যই অতি যত্ন করিতেছে এবং সদানন্দ তোমার সেবা করিতেছে। পূজা-অর্চা পূর্ণ সাত্ত্বিকভাবে মান্দ্রাজে করিতে হইবে। রজোগুণের লেশমাত্র যেন না থাকে। আলাসিঙ্গা বোধ হয় এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছে। কাহারও সহিত বাদ-বিবাদ করিবে না—সদা শান্তিভাব আশ্রয় করিবে। আপাততঃ বিলিগিরির বাটীতেই ঠাকুর স্থাপনা করিয়া পূজাদি হউক, তবে পূজার ঘটা একটু কমাইয়া সে সময়টা পাঠাদি ও লেক‍চার প্রভৃতি কিছু কিছু যেন হয়। কান ফুঁকতে যত পার, ততই মঙ্গল জানিবে। কাগজ দুটোর তত্ত্বাবধান করিবে ও যাহা পার সহায়তা করিবে। বিলিগিরির দুটি বিধবা কন্যা আছেন। তাঁদের শিক্ষা দিবে এবং তাঁদের দ্বারা ঐ প্রকার আরও বিধবারা যাহাতে স্বধর্মে থাকিয়া সংস্কৃত ও ইংরেজী শিক্ষা পায়, এ বিষয়ে যত্ন সবিশেষ করিবে। কিন্তু এ সব কার্য তফাৎ হইতে। যুবতীর সাক্ষাতে অতি সাবধান। একবার পড়িলে আর গতি নাই এবং ও অপরাধের ক্ষমা নাই।

গুপ্তকে কুকুরে কামড়াইয়াছে শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম; কিন্তু শুনিতেছি যে, ঐ কুকুর হন্যা নহে—তাহা হইলে ভয়ের কারণ নাই। যাহা হউক, গঙ্গাধরের প্রেরিত ঔষধ সেবন করান যেন হয়। প্রাতঃকালে পূজাদি অল্পে সারা করিয়া সপরিবার বিলিগিরিকে ডাকাইয়া কিঞ্চিৎ গীতাদি পাঠ করিবে। রাধাকৃষ্ণ-প্রেম শিক্ষার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। শুদ্ধ সীতারাম ও হরপার্বতীতে ভক্তি শিখাইবে। এ বিষয়ে কোন ভুল না হয়। যুবক-যুবতীদের [পক্ষে] রাধাকৃষ্ণলীলা একেবারেই বিষের ন্যায় জানিবে। বিশেষ বিলিগিরি প্রভৃতি রামানুজীরা রামোপাসক, তাঁদের শুদ্ধ ভাব যেন কদাচ বিনষ্ট না হয়।

বৈকালে ঐ প্রকার সাধারণ লোকের জন্য কিছু শিক্ষাদি দিবে। এই প্রকার ধীরে ‘পর্বতমপি লঙ্ঘয়েৎ’।

পরমশুদ্ধ ভাব যেন সর্বদা রক্ষিত হয়। ঘুণাক্ষরেও যেন বামাচার না আসে। বাকী প্রভু সকল বুদ্ধি দিবে ভয় নাই। বিলিগিরিকে আমার বিশেষ দণ্ডবৎ ও আলিঙ্গনাদি দিবে। ঐ প্রকার সকল ভক্তদের আমার প্রণামাদি দিও। আমার রোগ অনেকটা এক্ষণে শান্ত হইয়াছে—একেবারে সারিয়া গেলেও যাইতে পারে—প্রভুর ইচ্ছা। আমার ভালবাসা, নমস্কার, আশীর্বাদাদি জানিবে। কিমধিকমিতি

বিবেকানন্দ

পুনঃ—ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাওকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন ও আশীর্বাদ দিবে ও তাঁহাকে যতদূর পার সহায়তা করিও। তামিল অর্থাৎ ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে যাহাতে সংস্কৃত বিদ্যার বিশেষ চর্চা হয়, তাহা করিবে। ইতি

—বি

৩৩১

[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে ১১৫ লিখিত]

ওঁ তৎ সৎ

রোজ ব্যাঙ্ক
বর্ধমান রাজবাটী, দার্জিলিঙ
৬ এপ্রিল, ১৮৯৭

মান্যবরাসু,
মহাশয়ার প্রেরিত ‘ভারতী’ পাইয়া বিশেষ অনুগৃহীত বোধ করিতেছি এবং যে উদ্দেশ্যে আমার ক্ষুদ্র জীবন ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা যে ভবদীয়ার ন্যায় মহানুভবাদের সাধুবাদ সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহাতে আপনাকে ধন্য মনে করিতেছি।

এ জীবনসংগ্রামে নবীন ভাবের সমুদ্গাতার সমর্থক অতি বিরল, উৎসাহয়িত্রীর কথা তো দূরে থাকুক; বিশেষতঃ আমাদের হতভাগ্য দেশে। এজন্য বঙ্গ-বিদুষী নারীর সাধুবাদ সমগ্র ভারতীয় পুরুষের উৎকণ্ঠ ধন্যবাদাপেক্ষাও অধিক শ্লাঘ্য।

প্রভু করুন, যেন আপনার মত অনেক রমণী এদেশে জন্মগ্রহণ করেন ও স্বদেশের উন্নতি-কল্পে জীবন উৎসর্গ করেন।

আপনার লিখিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় মৎসম্বন্ধী প্রবন্ধ বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ মন্তব্য আছে; তাহা এইঃ

পাশ্চাত্যদেশে ধর্মপ্রচার ভারতের মঙ্গলের জন্যই করা হইয়াছে এবং হইবে। পাশ্চাত্যরা সহায়তা না করিলে যে আমরা উঠিতে পারিব না, ইহা চির ধারণা। এদেশে এখনও গুণের আদর নাই, অর্থবল নাই, এবং সর্বাপেক্ষা শোচনীয় এই যে, কৃতকর্মতা (practicality) আদৌ নাই।

উদ্দেশ্য অনেক আছে, উপায় এদেশে নাই। আমাদের মস্তক আছে, হস্ত নাই। আমাদের বেদান্ত-মত আছে, কার্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা নাই। আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে, আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি। মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম ভারতেই প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু কার্যে আমরা অতি নির্দয়, অতি হৃদয়হীন, নিজের মাংসপিণ্ড-শরীর ছাড়া অন্য কিছুই ভাবিতে পারি না।

তথাপি উপস্থিত অবস্থার মধ্য দিয়াই কেবল কার্যে অগ্রসর হইতে পারা যায়, অন্য উপায় নাই। ভাল-মন্দ-বিচারের শক্তি সকলের আছে। কিন্তু তিনিই বীর, যিনি এই সমস্ত ভ্রম-প্রমাদ-ও দুঃখপূর্ণ সংসারের তরঙ্গে পশ্চাৎপদ না হইয়া একহস্তে অশ্রুবারি মোচন করেন ও অপর অকম্পিত হস্তে উদ্ধারের পথ প্রদর্শন করেন। একদিকে গতানুগতিক জড়পিণ্ডবৎ সমাজ, অন্যদিকে অস্থির ধৈর্যহীন অগ্নিবর্ষণকারী সংস্কার; কল্যাণের পথ এই দুইয়ের মধ্যবর্তী। জাপানে শুনিয়াছিলাম, সে দেশের বালিকাদিগের বিশ্বাস এই যে, যদি ক্রীড়াপুত্তলিকাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসা যায়, সে জীবিত হইবে। জাপানী বালিকা কখনও পুতুল ভাঙে না। হে মহাভাগে, আমারও বিশ্বাস যে, যদি কেউ এই হতশ্রী বিগতভাগ্য লুপ্তবুদ্ধি পরপদবিদলিত চিরবুভুক্ষিত কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তবে ভারত আবার জাগিবে। যবে শত শত মহাপ্রাণ নরনারী সকল বিলাসভোগসুখেচ্ছা বিসর্জন করিয়া কায়মনোবাক্যে দারিদ্র্য ও মূর্খতার ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশঃ উত্তরোত্তর নিমজ্জনকারী কোটি কোটি স্বদেশীয় নরনারীর কল্যাণ কামনা করিবে, তখন ভারত জাগিবে। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র জীবনেও ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে, সদুদ্দেশ্য অকপটতা ও অনন্ত প্রেম বিশ্ব বিজয় করিতে সক্ষম। উক্ত গুণশালী একজন কোটি কোটি কপট ও নিষ্ঠুরের দুর্বুদ্ধি নাশ করিতে সক্ষম।

আমার পুনর্বার পাশ্চাত্যদেশে গমন অনিশ্চিত; যদি যাই, তাহাও জানিবেন ভারতের জন্য। এদেশে লোকবল কোথায়, অর্থবল কোথায়? অনেক পাশ্চাত্য নরনারী ভারতের কল্যাণের জন্য ভারতীয় ভাবে ভারতীয় ধর্মের মধ্য দিয়া অতি নীচ চণ্ডালাদিরও সেবা করিতে প্রস্তুত আছেন। দেশে কয়জন? আর অর্থবল!! আমাকে অভ্যর্থনা করিবার ব্যয়নির্বাহের জন্য কলিকাতাবাসীরা টিকিট বিক্রী করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সঙ্কুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!! ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না, কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব, ইহারই পোষণ করিতেছি। ইতি

চিরকৃতজ্ঞ ও সদা প্রভুসন্নিধানে
ভবৎ-কল্যাণ-কামনাকারী
বিবেকানন্দ

৩৩২

[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে লিখিত]

C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৭

মহাশয়াসু,
আপনার সহানুভূতির জন্য হৃদয়ের সহিত আপনাকে ধন্যবাদ দিতেছি, কিন্তু নানা কারণবশতঃ এ সম্বন্ধে আপাততঃ প্রকাশ্য আলোচনা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। তন্মধ্যে প্রধান কারণ এই যে, যে-টাকা আমার নিকট চাওয়া হয়, তাহা ইংলণ্ড হইতে আমার সমভিব্যাহারী ইংরেজ বন্ধুদিগের আহ্বানের নিমিত্তই অধিকাংশ খরচ হইয়াছিল। অতএব এ কথা প্রকাশ করিলে যে অপযশের ভয় আপনি করেন, তাহাই হইবে। দ্বিতীয়তঃ তাঁহারা—আমি উক্ত টাকা দিতে অপারগ হওয়ায়—আপনা-আপনির মধ্যে উহা সারিয়া লইয়াছেন, শুনিতেছি।

আপনি কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—তদ্বিষয়ে প্রথমে বক্তব্য এই যে, ‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ’ই হওয়া উচিত; তবে আমার অতি প্রিয়বন্ধু মিস মূলারের প্রমুখাৎ আপনার উদারবুদ্ধি, স্বদেশবাৎসল্য ও দৃঢ় অধ্যাবসায়ের অনেক কথা শুনিয়াছি এবং আপনার বিদুষীত্বের প্রমাণ প্রত্যক্ষ। অতএব আপনি যে আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টার কথা জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহা পরম সৌভাগ্য মনে করিয়া অত্র ক্ষুদ্র পত্রে যথাসম্ভব নিবেদন করিলাম। কিন্তু প্রথমতঃ আপনার বিচারের জন্য আমার অনুভবসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ভবৎসন্নিধানে উপস্থিত করিতেছিঃ আমরা চিরকাল পরাধীন, অর্থাৎ এ ভারতভূমে সাধারণ মানবের আত্মস্বত্ববুদ্ধি কখনও উদ্দীপিত হইতে দেওয়া হয় নাই। পাশ্চাত্যভূমি আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া দ্রুতপদে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হইতেছে। এ ভারতে কৌলীন্যপ্রথা হইতে ভোজ্যাভোজ্য পর্যন্ত সকল বিষয় রাজাই নির্ধারণ করিতেন। পাশ্চাত্যদেশে সমস্তই প্রজারা আপনারা করেন।

এক্ষণে রাজা সামাজিক কোন বিষয়ে হাত দেন না, অথচ ভারতীয় জনমানবের আত্মনির্ভরতা দূরে থাকুক, আত্মপ্রত্যয় পর্যন্ত এখনও অণুমাত্র হয় নাই। যে আত্মপ্রত্যয় বেদান্তের ভিত্তি, তাহা এখনও ব্যাবহারিক অবস্থায় কিছুমাত্রও পরিণত হয় নাই। এইজন্যই পাশ্চাত্য প্রণালী অর্থাৎ প্রথমতঃ উদ্দিষ্ট বিষয়ের আন্দোলন পরে সকলে মিলিয়া কর্তব্যসাধন, এ দেশে এখনও ফলদায়ক হয় না; এইজন্যই আমরা বিজাতীয় রাজার অধীনে এত অধিক স্থিতিশীল বলিয়া প্রতীত হই। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে সাধারণে আন্দোলনের দ্বারা কোন মহৎকার্য করার চেষ্টা বৃথা, ‘মাথা নেই তার মাথা ব্যথা’—সাধারণ কোথা? তাহার উপর আমরা এতই বীর্যহীন যে, কোন বিষয়ের আন্দোলন করিতে গেলে তাহাতেই আমাদের বল নিঃশেষিত হয়, কার্যের জন্য কিছুমাত্রও বাকী থাকে না; এইজন্যই বোধ হয় আমরা প্রায়ই বঙ্গভূমে ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’ সতত প্রত্যক্ষ করি। দ্বিতীয়তঃ যে প্রকার পূর্বেই লিখিয়াছি—ভারতবর্ষের ধনীদিগের নিকট কোন আশা করি না। যাহাদের উপর আশা, অর্থাৎ যুবক সম্প্রদায়—ধীর, স্থির অথচ নিঃশব্দে তাহাদিগের মধ্যে কার্য করাই ভাল। এক্ষণে কার্যঃ ‘আধুনিক সভ্যতা’ পাশ্চাত্যদেশের ও ‘প্রাচীন সভ্যতা’ ভারত, মিসর, রোমকাদি দেশের মধ্যে সেইদিন হইতেই প্রভেদ আরম্ভ হইল, যেদিন হইতে শিক্ষা, সভ্যতা প্রভৃতি উচ্চজাতি হইতে ক্রমশঃ নিম্নজাতিদিগের মধ্যে প্রসারিত হইতে লাগিল। প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধি যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। ভারতবর্ষের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি—রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া। আজ অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া সমাজসংস্কারের ধুম উঠিয়াছে। দশ বৎসর যাবৎ ভারতের নানা স্থল বিচরণ করিয়া দেখিলাম, সমাজসংস্কারসভায় দেশ পরিপূর্ণ। কিন্তু যাহাদের রুধিরশোষণের দ্বারা ‘ভদ্রলোক’ নামে প্রথিত ব্যক্তিরা ‘ভদ্রলোক’ হইয়াছেন এবং রহিতেছেন, তাহাদের জন্য একটি সভাও দেখিলাম না! মুসলমান কয়জন সিপাহী আনিয়াছিল? ইংরেজ কয়জন আছে? ছ-টাকার জন্য পিতা নিজের ভ্রাতার গলা কাটিতে পারে, এমন লক্ষ লক্ষ লোক ভারত ছাড়া কোথায় পাওয়া যায়? সাত-শ বৎসর মুসলমান রাজত্বে ছ-কোটি মুসলমান, এক-শ বৎসর ক্রিশ্চান রাজত্বে কুড়ি লক্ষ ক্রিশ্চান—কেন এমন হয়? Originality (মৌলিকতা) একেবারে দেশকে কেন ত্যাগ করিয়াছে? আমাদের দক্ষহস্ত শিল্পী কেন ইওরোপীয়দের সহিত সমকক্ষতা করিতে না পারিয়া দিন দিন উৎসন্ন যাইতেছে? কি বলেই বা জার্মান শ্রমজীবী ইংরেজ শ্রমজীবীর বহুশতাব্দীপ্রোথিত দৃঢ় আসন টলমলায়মান করিয়া তুলিয়াছে?

কেবল শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা! ইওরোপের বহু নগর পর্যটন করিয়া তাহাদের দরিদ্রেরও সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও বিদ্যা দেখিয়া আমাদের গরীবদের কথা মনে পড়িয়া অশ্রুজল বিসর্জন করিতাম। কেন এ পার্থক্য হইল? শিক্ষা—জবাব পাইলাম। শিক্ষাবলে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়বলে অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠিতেছেন; আর আমাদের—ক্রমেই তিনি সঙ্কুচিত হচ্ছেন। নিউ ইয়র্কে দেখিতাম, Irish colonists (আইরিশ ঔপনিবেশিকগণ) আসিতেছে—ইংরেজ-পদ-নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্বস্ব, মহাদরিদ্র, মহামূর্খ—সম্বল একটি লাঠি ও তার অগ্রবিলম্বিত একটি ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলি। তার চলন সভয়, তার চাউনি সভয়। ছ-মাস পরে আর এক দৃশ্য—সে সোজা হয়ে চলছে, তার বেশভূষা বদলে গেছে; তার চাউনিতে, তার চলনে আর সে ‘ভয় ভয়’ ভাব নাই। কেন এমন হল? আমার বেদান্ত বলছেন যে, ঐ Irishma-কে তাহার স্বদেশে চারিদিকে ঘৃণার মধ্যে রাখা হয়েছিল—সমস্ত প্রকৃতি একবাক্যে বলছিল, ‘প্যাট(Pat),১১৬ তোর আর আশা নাই, তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম।’ আজন্ম শুনিতে শুনিতে প্যাট-এর তাই বিশ্বাস হল, নিজেকে প্যাট হিপনটাইজ (সম্মোহিত) করলে যে, সে অতি নীচ; তার ব্রহ্ম সঙ্কুচিত হয়ে গেল। আর আমেরিকায় নামিবামাত্র চারিদিক থেকে ধ্বনি উঠিল—‘প্যাট, তুইও মানুষ, আমরাও মানুষ, মানুষেই তো সব করেছে, তোর আমার মত মানুষ সব করতে পারে, বুকে সাহস বাঁধ!’ প্যাট ঘাড় তুললে, দেখলে ঠিক কথাই তো; ভিতরের ব্রহ্ম জেগে উঠলেন, স্বয়ং প্রকৃতি যেন বললেন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ ইত্যাদি।

ঐ প্রকার আমাদের বালকদের যে বিদ্যাশিক্ষা হচ্ছে, তাও একান্ত negative (নেতিভাবপূর্ণ)—স্কুল-বালক কিছুই শিখে না, কেবল সব ভেঙেচুরে যায়—ফল ‘শ্রদ্ধাহীনত্ব’। যে শ্রদ্ধা বেদবেদান্তের মূলমন্ত্র, যে শ্রদ্ধা নচিকেতাকে যমের মুখে যাইয়া প্রশ্ন করিতে সাহসী করিয়াছিল, যে শ্রদ্ধাবলে এই জগৎ চলিতেছে, সে ‘শ্রদ্ধা’র লোপ। ‘অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি’—গীতা। তাই আমরা বিনাশের এত নিকট। এক্ষণে উপায়—শিক্ষার প্রচার। প্রথম আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার মন্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্ধন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ—এ সকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপাস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।’ দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, অদ্বৈত, শৈবসিদ্ধান্ত, বৈষ্ণব, শাক্ত, এমন কি বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি যে-কোন সম্প্রদায় এ ভারতে উঠিয়াছে, সকলেই এইখানে একবাক্য যে, এই ‘জীবাত্মা’তেই অনন্ত শক্তি নিহিত আছে, পিপীলিকা হতে উচ্চতম সিদ্ধপুরুষ পর্যন্ত সকলের মধ্যে সেই ‘আত্মা’,—তফাৎ কেবল প্রকাশের তারতম্যে, ‘বরণভেদস্তু ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ’— (পাতঞ্জলযোগসূত্রম্)। অবকাশ ও উপযুক্ত দেশ কাল পেলেই সেই শক্তির বিকাশ হয়। কিন্তু বিকাশ হোক বা না হোক, সে শক্তি প্রত্যেক জীবে বর্তমান—আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত। এই শক্তির উদ্বোধন করতে হবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়, এই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হবে। কথা তো হল সোজা, কিন্তু কার্যে পরিণত হয় কি প্রকারে? এই আমাদের দেশে সহস্র সহস্র নিঃস্বার্থ, দয়াবান, ত্যাগী পুরুষ আছেন; ইঁহাদের মধ্যে অন্ততঃ (এক) অর্ধেক ভাগকে—যেমন তাঁহারা বিনা বেতনে পর্যটন করে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছেন—ঐ প্রকার বিদ্যাশিক্ষক করান যেতে পারে। তাহার জন্য চাই, প্রথমতঃ এক এক রাজধানীতে এক এক কেন্দ্র ও সেথা হইতে ধীরে ধীরে ভারতের সর্বস্থানে ব্যাপ্ত হওয়া। মান্দ্রাজ ও কলিকাতায় সম্প্রতি দুটি কেন্দ্র হইয়াছে; আরও শীঘ্র হইবার আশা আছে। তারপর দরিদ্রদের শিক্ষা অধিকাংশই শ্রুতির দ্বারা হওয়া চাই। স্কুল ইত্যাদির এখনও সময় আইসে নাই। ক্রমশঃ ঐ সকল প্রধান কেন্দ্রে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি শিখান যাবে এবং শিল্পাদিরও যাহাতে এদেশে উন্নতি হয়, তদুপায়ে কর্মশালা খোলা যাবে। ঐ কর্মশালার মালবিক্রয় যাহাতে ইওরোপে ও আমেরিকায় হয়, তজ্জন্য উক্ত দেশসমূহেও সভা স্থাপনা হইয়াছে ও হইবে। কেবল মুশকিল এক, যে প্রকার পুরুষদের জন্য হইবে, ঠিক ঐ ভাবেই স্ত্রীলোকদের জন্য চাই; কিন্তু এদেশে তাহা অতীব কঠিন, আপনি বিদিত আছেন। পুনশ্চ এই সমস্ত কার্যের জন্য যে অর্থ চাই, তাহাও ইংলণ্ড হইতে আসিবে। যে-সাপে কামড়ায়, সে নিজের বিষ উঠাইয়া লইবে, ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং তজ্জন্য আমাদের ধর্ম ইওরোপ ও আমেরিকায় প্রচার হওয়া চাই! আধুনিক বিজ্ঞান খ্রীষ্টাদি ধর্মের ভিত্তি একেবারে চূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাহার উপর বিলাস—ধর্মবৃত্তিই প্রায় নষ্ট করিয়া ফেলিল। ইওরোপ ও আমেরিকা আশাপূর্ণনেত্রে ভারতের দিকে তাকাইতেছে—এই সময় পরোপকারের, এই সময় শত্রুর দুর্গ অধিকার করিবার।

পাশ্চাত্যদেশে নারীর রাজ্য, নারীর বল, নারীর প্রভুত্ব। যদি আপনার ন্যায় তেজস্বিনী বিদুষী বেদান্তজ্ঞা কেউ এই সময়ে ইংলণ্ডে যান আমি নিশ্চিত বলিতেছি, এক এক বৎসরে অন্ততঃ দশ হাজার নরনারী ভারতের ধর্ম গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ হইবে। এক রমাবাঈ অস্মদ্দেশ হইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার ইংরেজী ভাষা বা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিল্পাদিবোধ অল্পই ছিল, তথাপি তিনি সকলকে স্তম্ভিত করিয়াছিলেন। যদি আপনার ন্যায় কেউ যান তো ইংলণ্ড তোলপাড় হইয়া যাইতে পারে, আমেরিকার কা কথা। দেশীয় নারী দেশীয় পরিচ্ছদে ভারতের ঋষিমুখাগত ধর্ম প্রচার করিলে আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, এক মহান্ তরঙ্গ উঠিবে, যাহা সমগ্র পাশ্চাত্যভূমি প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। এ মৈত্রেয়ী, খনা, লীলাবতী, সাবিত্রী ও উভয়-ভারতীর জন্মভূমিতে কি আর কোন নারীর এ সাহস হইবে না? প্রভু জানেন। ইংলণ্ড, ইংলণ্ড, ইংলণ্ড-—আমরা ধর্মবলে অধিকার করিব, জয় করিব—‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ এ দুর্দান্ত অসুরের হস্ত হইতে কি সভাসমিতি দ্বারা উদ্ধার হয়? অসুরকে দেবতা করিতে হইবে। আমি দীন ভিক্ষুক পরিব্রাজক কি করতে পারি? আমি একা, অসহায়! আপনাদের ধন-বল, বুদ্ধি-বল, বিদ্যা-বল—আপনারা এ সুযোগ ত্যাগ করিবেন কি? এই এখন মহামন্ত্র—ইংলণ্ড-বিজয়, ইওরোপ বিজয় আমেরিকা-বিজয়! তাহাতেই দেশের কল্যাণ। Expansion is the sign of life and we must spread the world over with our spiritual ideals.১১৭ হায় হায়! শরীর ক্ষুদ্র জিনিষ, তায় বাঙালীর শরীর; এই পরিশ্রমেই অতি কঠিন প্রাণহর ব্যাধি আক্রমণ করিল! কিন্তু আশা এই—‘উৎপৎস্যতেঽস্তি মম কোঽপি সমানধর্মা, কালো হ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী।’১১৮

নিরামিষ ভোজন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই—প্রথমতঃ আমার গুরু নিরামিষাশী ছিলেন; তবে দেবীর প্রসাদ মাংস কেহ দিলে অঙ্গুলি দ্বারা মস্তকে স্পর্শ করিতেন। জীবহত্যা পাপ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই; তবে যতদিন রাসায়নিক উন্নতির দ্বারা উদ্ভিজ্জাদি মনুষ্যশরীরের উপযোগী খাদ্য না হয়, ততদিন মাংসভোজন ভিন্ন উপায় নাই। যতদিন মনুষ্যকে আধুনিক অবস্থার মধ্যে থাকিয়া রজোগুণের কৃপা করিতে হইবে, ততদিন মাংসাদন বিনা উপায় নাই। মহারাজ অশোক তরবারির দ্বারা দশ-বিশ লক্ষ জানোয়ারের প্রাণ বাঁচাইলেন বটে, কিন্তু হাজার বৎসরের দাসত্ব কি তদপেক্ষা আরও ভয়ানক নহে? দু-দশটা ছাগলের প্রাণনাশ বা আমার [অর্থাৎ নিজের] স্ত্রী-কন্যার মর্যাদা রাখিতে অক্ষমতা ও আমার বালকবালিকার মুখের গ্রাস পরের হাত হইতে রক্ষা করিতে অক্ষমতা, এ কয়েকটির মধ্যে কোন‍্‍টি অধিকতর পাপ? যাঁহারা উচ্চশ্রেণীর, এবং শারীরিক পরিশ্রম করিয়া অন্ন সংগ্রহ করেন না, তাঁহারা বরং [মাংসাদি] না খান; যাহাদের দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া অন্নবস্ত্রের সংস্থান করিতে হইবে, বলপূর্বক তাহাদিগকে নিরামিষাশী করা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা-বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য কি করিতে পারে, জাপান তাহার নিদর্শন। সর্বশক্তিমতী বিশ্বেশ্বরী আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণা হউন। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৩৩*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

(দার্জিলিঙ)১১৯
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৭

স্নেহের মেরী,
কয়েকদিন পূর্বে তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়েছি। গতকাল হ্যারিয়েটের বিবাহের সংবাদ বহন করে চিঠি এসেছে। প্রভু নবদম্পতিকে সুখে রাখুন।

এখানে সমস্ত দেশবাসী আমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য যেন একপ্রাণ হয়ে সমবেত হয়েছিল। শত সহস্র লোক—যেখানে যাই সেখানেই উৎসাহসূচক আনন্দধ্বনি করছিল, রাজা-রাজড়ারা আমার গাড়ী টানছিলেন, বড় বড় শহরের সদর রাস্তার উপর তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং তাতে নানা রকম মঙ্গলবাক্য (motto) জ্বলজ্বল করছিল। সমস্ত ব্যাপারটিই শীঘ্র পুস্তকাকারে বেরুবে এবং তুমিও একখানা পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি ইতোপূর্বেই ইংলণ্ডে কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়েছি, আবার এখানে দাক্ষিণাত্যের ভীষণ গরমে অতিরিক্ত পরিশ্রম করায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। কাজেই আমাকে ভারতের অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করবার পরিকল্পনা ছেড়ে নিকটতম শৈলনিবাস দার্জিলিঙে চোঁচা দৌড় দিতে হল। সম্প্রতি আমি অনেকটা ভাল আছি এবং আবার মাসখানেক আলমোড়ায় থাকলেই সম্পূর্ণ সেরে যাব। ভাল কথা, সম্প্রতি আমার ইওরোপে যাবার একটা সুবিধা চলে গেল। রাজা অজিত সিং এবং আরও কয়েকজন রাজা আগামী শনিবার ইংলণ্ড যাত্রা করছেন। তাঁরা অবশ্য আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাক্তারেরা রাজী নন। তাঁরা চান না আমি এখন কোন শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রম করি, সুতরাং অত্যন্ত ক্ষুণ্ণহৃদয়ে আমাকে এই সুযোগ ছেড়ে দিতে হচ্ছে; তবে যত শীঘ্র পারি যাবার চেষ্টা করব।

আশা করি ডাঃ ব্যারোজ এতদিনে আমেরিকায় পৌঁছেছেন। আহা বেচারা! তিনি অত্যন্ত গোঁড়া মনোভাব নিয়ে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন, সুতরাং যা সাধারণতঃ হয়ে থাকে—কেউ তাঁর কথা শুনল না। অবশ্য লোকে তাঁকে খুব সাদর অভ্যর্থনা করেছিল; তাও আমি চিঠি লিখেছিলাম বলেই। কিন্তু আমি তো আর তাঁর ভিতরে বুদ্ধি ঢোকাতে পারি না! অধিকন্তু, তিনি যেন কি-এক অদ্ভুত ধরনের লোক! শুনলাম, আমি দেশে ফিরে আসলে সমগ্র জাতিটা আনন্দে যে মেতে উঠেছিল, তাতে তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন। যে করেই হোক, আরও বেশী মাথাওয়ালা একজনকে পাঠান উচিত ছিল, কারণ ডাঃ ব্যারোজ যা বলে গেছেন, তাতে হিন্দুরা বুঝেছে ধর্মমহাসভা ছিল একটা তামাশার ব্যাপারে (farce)। দার্শনিক বিষয়ে জগতের কোন জাতই হিন্দুদের পথপ্রদর্শক হতে পারবে না।

একটা বড় মজার কথা এই যে, খ্রীষ্টান দেশ থেকে যত লোক এদেশে এসেছে, তাদের সকলেরই সেই এক মান্ধাতার আমলে নির্বোধ যুক্তিঃ যেহেতু খ্রীষ্টানরা শক্তিশালী ও ধনবান্ এবং হিন্দুরা তা নয়, সেই হেতুই খ্রীষ্টধর্ম হিন্দুধর্মের চেয়ে ভাল। এরই উত্তরে হিন্দুরা ঠিক জবাব দেয় যে, সেইজন্যই তো হিন্দুধর্মই হচ্ছে ধর্ম, আর খ্রীষ্টানধর্ম ধর্মই নয়। কারণ, এই পশুভাবাপন্ন জগতে পাপেরই জয়জয়কার আর পুণ্যের সর্বদা নির্যাতন! এটা দেখা যাচ্ছে যে, পাশ্চাত্য জাতি জড়বিজ্ঞানের চর্চায় যতই উন্নত হোক না কেন, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তারা শিশুমাত্র। জড়বিজ্ঞান শুধু ঐহিক উন্নতি বিধান করতে পারে; কিন্তু অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান থেকে আসে অনন্ত জীবন। যদি অনন্ত জীবন নাও থাকে, তাহলেও আদর্শ হিসাবে আধ্যাত্মিক চিন্তাপ্রসূত আনন্দ অধিকতর তীব্র এবং এ-চিন্তা মানুষকে অধিকতর সুখী করে, আর জড়বাদপ্রসূত নির্বুদ্ধিতা থেকে আসে প্রতিযোগিতা, অযথা উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিণামে ব্যষ্টি ও সমষ্টির মৃত্যু।

এই দার্জিলিঙ অতি সুন্দর জায়গা। এখান থেকে মাঝে মাঝে যখন মেঘ সরে যায়, তখন ২৮‚১৪৬ ফুট উচ্চ মহিমামণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এবং নিকটের একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে মাঝে মাঝে ২৯‚০০২ ফুট উচ্চ গৌরীশঙ্করের চকিত দর্শন পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীরা—তিব্বতীরা, নেপালীরা এবং সর্বোপরি সুন্দরী লেপ‍্‍চা মেয়েরা—যেন ছবিটির মত।

তুমি চিকাগোর কল‍্‌স্টন টার্নবুল নামে কাউকে চেন কি? আমি ভারতবর্ষে পৌঁছবার পূর্বে কয়েক সপ্তাহ তিনি এখানে ছিলেন। তিনি দেখছি, আমাকে খুব পছন্দ করতেন, আর তার ফলে হিন্দুরা সকলেই তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করত! জো, মিসেস অ্যাডাম‍্‍স্‌, সিষ্টার জোসেফিন এবং আমাদের আর আর বন্ধুদের খবর কি? আমাদের প্রিয় মিল‍্‍রা (Mills) কোথায়? তারা ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ‘পিষে’ চলেছে১২০ বোধ হয়? আমি হ্যারিয়েটকে তার বিবাহে কয়েকটি প্রীতি-উপহার পাঠাব মনে করেছিলাম; কিন্তু তোমাদের যে ভীষণ জাহাজের মাশুল—তাই উপস্থিত পাঠান স্থগিত রাখতে হচ্ছে। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার শীঘ্রই ইওরোপে দেখা হবে। এই চিঠিতে যদি তোমারও বিবাহের কথাবার্তা চলছে লিখতে, তাহলে আমি অবশ্য আহ্লাদিত হতাম এবং আধ ডজন কাগজের একখানি চিঠি লিখে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতাম।

আমার চুল গোছা গোছা পাকতে আরম্ভ করেছে এবং আমার মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে—দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে—রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমন কি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!! আমি এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বাস করছি—তারা সকলেই নিকার-বোকার পরে, অবশ্য স্ত্রীলোকেরা নয়। আমিও নিকার-বোকার পরে আছি। তুমি যদি আমাকে পাহাড়ী হরিণের মত পাহাড় থেকে পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াতে দেখতে অথবা ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ে-রাস্তায় চড়াই উতরাই করতে দেখতে, তাহলে খুব আশ্চর্য হয়ে যেতে।

আমি এখানে বেশ ভাল আছি। কারণ সমতলভূমিতে বাস করা আমার পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে; সেখানে আমার রাস্তায় পা-টি বাড়াবার যো নেই—অমনি একদল লোক আমায় দেখবে বলে ভিড় করবে!! নামযশটা সব সময়েই বড় সুখের নয়। আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ করেছে—এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায় এবং লোককে আমেরিকান কুৎসা-রটনাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে! হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিষই না ঢেকে রাখতে পার! তোমারই জয়জয়কার।

ডাক যাবার সময় হয়ে এল, তাই শেষ করলাম। তোমার স্বপ্ন সুখকর হোক, তোমার স্বাস্থ্য সুন্দর হোক এবং তোমার অশেষ কল্যাণ হোক। বাবা, মা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৩৪*

আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭

প্রিয় মিসেস বুল,
ভগ্ন স্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য একমাস দার্জিলিঙে ছিলাম। আমি এখন বেশ ভাল হয়ে গেছি। ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিঙে একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলবাসে যাচ্ছি—স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য।

আমি আগেই আপনাকে লিখেছি যে, এখানকার অবস্থা বেশ আশাজনক বলে বোধ হচ্ছে না—যদিও সমস্ত জাতটা একযোগে আমাকে সম্মান করেছে এবং আমাকে নিয়ে প্রায় পাগল হয়ে যাবার মত হয়েছিল! কোন বিষয়ে কার্যকারিতার দিকটা ভারতবর্ষে আদৌ দেখতে পাবেন না। কলিকাতার কাছাকাছি জমির দাম আবার খুব বেড়ে গেছে। আমার বর্তমান অভিপ্রায় হচ্ছে তিনটি রাজধানীতে তিনটি কেন্দ্র স্থাপন করা। ঐগুলি আমার শিক্ষকদের শিক্ষণকেন্দ্রস্বরূপ হবে—সেখান থেকেই আমি ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে চাই।

আমি আরও বছর-কয়েক বাঁচি আর নাই বাঁচি, ভারতবর্ষ ইতোমধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে।

অধ্যাপক জেম‍্‍সের একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছিলাম; তাতে তিনি অবনত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আমার মন্তব্যগুলির উপর বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। আপনিও লিখেছেন যে, ধর্মপাল এতে খুব রেগে গেছেন। ধর্মপাল অতি সজ্জন এবং আমি তাঁকে ভালবাসি। কিন্তু ভারতীয় কোন ব্যাপারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ অন্যায় হবে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যেটাকে নানাবিধ কুরুচিপূর্ণ আধুনিক হিন্দুধর্ম বলা হয়, তা হচ্ছে অচল অবস্থায় পতিত বৌদ্ধধর্ম মাত্র। এটা স্পষ্ট বুঝলে হিন্দুদের পক্ষে তা বিনা আপত্তিতে ত্যাগ করা সহজ হবে। বৌদ্ধধর্মের যেটি প্রাচীনভাব—যা শ্রীবুদ্ধ নিজে প্রচার করে গেছেন, তার প্রতি এবং শ্রীবুদ্ধের প্রতি আমার গভীরতম শ্রদ্ধা। আর আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আমরা হিন্দুরা তাঁকে অবতার বলে পূজা করি। সিংহলের বৌদ্ধধর্মও তত সুবিধার নয়। সিংহলে ভ্রমণকালে আমার ভ্রান্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। সিংহলে যদি প্রাণবন্ত কেউ থাকে তো এক হিন্দুরাই। বৌদ্ধরা অনেকটা পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে—এমন কি ধর্মপাল ও তাঁর পিতার ইওরোপীয় নাম ছিল, এখন তাঁরা সেটা বদলেছেন। আজকাল বৌদ্ধেরা ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ এই শ্রেষ্ঠ উপদেশের এইমাত্র খাতির করেন যে, যেখানে-সেখানে কষাইয়ের দোকান খোলেন! এমন কি পুরোহিতরা পর্যন্ত ঐ কার্যে উৎসাহ দেন। আমি এক সময়ে ভাবতাম, আদর্শ বৌদ্ধধর্ম বর্তমানকালেও অনেক উপকার করবে। কিন্তু আমি আমার ঐ মত একেবারে ত্যাগ করেছি এবং স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কি কারণে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।

থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে তোমার প্রথমেই স্মরণ রাখা উচিত যে, ভারতবর্ষে থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের সংখ্যা নামমাত্র—নেই বললেই হয়। তারা দুচারখানা কাগজ বের করে খুব একটা হুজুগ করে দুচারজন পাশ্চাত্য-দেশবাসীকে নিজেদের মত শোনাতে পারে; কিন্তু হিন্দুদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে, এমন দুজন বৌদ্ধ বা দশজন থিওসফিষ্ট আমি তো দেখি না।

আমি আমেরিকায় এক মানুষ ছিলাম, এখানে আর এক মানুষ হয়ে গেছি। এখানে সমস্ত (হিন্দু) জাতটা আমাকে যেন তাদের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি (authority) বলে মনে করছে; আর সেখানে ছিলাম অতিনিন্দিত প্রচারক মাত্র। এখানে রাজারা আমার গাড়ী টানে—আর সেখানে আমাকে একটা ভাল হোটেলে পর্যন্ত ঢুকতে দিত না। সেইজন্য এখানে যা কিছু বলব, তাতে সমস্ত জাতটার—আমার সমস্ত স্বদেশবাসীর—মঙ্গল হওয়া আবশ্যক, তা সেগুলো দুচারজনের যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন। কপটতাকে কখনই নয়, যা কিছু খাঁটি ও সৎ, সেগুলিকে গ্রহণ করতে হবে, সেগুলির প্রতি উদারভাব পোষণ করতে হবে। থিওসফিষ্টরা আমায় খাতির ও খোসামোদ করতে চেষ্টা করেছিল, কারণ এখন আমি ভারতের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছি। আর সেইজন্য আমার কাজের দ্বারা যাতে তাঁদের আজগুবিগুলো সমর্থিত না হয় এই উদ্দেশ্যে দু-চারটে কড়া স্পষ্ট কথা বলতে হয়েছিল, আর ঐ কাজ হয়ে গেছে। এতে আমি খুব খুশী। আমি যতদূর যা দেখেছি, তাতে ভারতে ইংলিশ চার্চের যে সব পাদ্রী আছে, তাঁদের উপর বরং আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের উপর আদৌ নেই। আমি আবার তোমাকে বলছি, ভারতবর্ষ ইতোপূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে, এবং বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মের জন্য এখানকার কাজ একটু সংগঠিত করে নিয়েছি। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ