১৯. পত্রাবলী ২৯৫-৩০৪

২৯৫*

[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]

সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
আমি এখন বিশ্রাম ভোগ করছি। বিভিন্ন চিঠিতে কৃপানন্দের১০১ সম্বন্ধে অনেক কথা পড়েছি। আমি তার জন্য দুঃখিত। … তার ভাবে তাকে চলতে দাও; তার জন্য তোমাদের কারও উদ্বেগ অনাবশ্যক।

আমায় ব্যথা দেওয়ার কথা বলছ?—তা দেব বা দানবের সাধ্যাতীত। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাক। অটল ভালবাসা ও একান্ত নিঃস্বার্থ ভাবই সর্বত্র জয়লাভ করে। প্রত্যেক প্রতিকূল অবস্থায় বেদান্তীর উচিত নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করা, ‘আমি এরূপ দেখি কেন? আমি কেন ভালবাসা দিয়ে এর প্রতিকার করতে পারি না?’

স্বামী সারদানন্দ যে অভ্যর্থনা পেয়েছেন, এবং তিনি যে ভাল কাজ করেছেন, আমি তাতে খুশী হয়েছি। বড় কাজ করতে হলে দীর্ঘকাল ধরে লেগে পড়ে থাকতে হয়। জনকয়েক বিফল হলেও আমাদের চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। জগতের ধারাই এই যে, অনেকের পতন হবে, বহু বাধা আসবে, দুর্লঙ্ঘ্য বিপদ উপস্থিত হবে এবং আধ্যাত্মিকতার আগুনে ভস্মীভূত হবার সময়েও মানুষের ভিতরের স্বার্থপরতা ও অন্যান্য দানবীয় ভাব প্রাণপণে লড়াই করে। ‘ভাল’র দিকে যাবার পথটি সবচেয়ে দুর্গম ও বন্ধুর। এটাই আশ্চর্যের কথা যে, এত লোক সফল হয়; অনেকে যে পড়ে যায়, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। সহস্র পদস্খলনের ভেতর দিয়েই চরিত্র গড়ে তুলতে হবে।

এখন আমি অনেকটা চাঙ্গা হয়েছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠিক সামনেই বিরাট তুষার প্রবাহগুলি দেখি আর অনুভব করি, যেন হিমালয়ে আছি। এখন আমি সম্পূর্ণ শান্ত। আমার স্নায়ুগুলিতে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে এসেছে, এবং তুমি যে-জাতীয় বিরক্তিকর ব্যাপারের কথা লিখেছ, তা আমাকে একেবারেই স্পর্শ করে না। এই ছেলেখেলা আমাকে উদ্বিগ্ন করবে কি করে? সারা দুনিয়াটা একটা নিছক ছেলেখেলা—প্রচার, শিক্ষাদান, সবই। ‘যিনি দ্বেষও করেন না, আকাঙ্ক্ষাও করেন না, তাঁকেই সন্ন্যাসী বলে জেনো।’১০২ আর রোগ শোক ও মৃত্যুর চির লীলাভূমি এই সংসাররূপ পঙ্কিল ডোবাতে কি কাম্য বস্তু থাকতে পারে?—‘যিনি সকল বাসনা ত্যাগ করেছেন, তিনিই সুখী।’

সেই শান্তি, সেই অনন্ত অনাবিল শান্তির কিছু আভাস আমি এখন এই মনোরম স্থানে পাচ্ছি। ‘একবার যদি মানুষ জানে যে, আত্মাই আছেন—আর কিছু নেই, তাহলে কিসের কামনায় কার জন্য এই শরীরের দুঃখতাপে দগ্ধ হতে হবে?’১০৩

আমার মনে হয়, লোকে যাকে ‘কাজ’ বলে, তা দ্বারা যতটুকু অভিজ্ঞতা হবার তা আমার হয়ে গেছে। আমার কাজ শেষ হয়েছে, এখন আমি বেরিয়ে যাবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছি। ‘সহস্র সহস্র লোকের মধ্যে ক্বচিৎ কেউ সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে; যত্নপরায়ণ বহুর মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ আমাকে যথাযথভাবে জানে।’১০৪ কারণ ইন্দ্রিয়গুলি বলবান্‌, তারা সাধকের মনকে জোর করে নাবিয়ে দেয়।

‘মনোরম জগৎ’, ‘সুখের সংসার’, ‘সামাজিক উন্নতি’—এসব কথা ‘তপ্ত বরফ’, ‘অন্ধকার আলো’ প্রভৃতি কথার মতই। ভালই যদি হত, তবে এটা আর সংসারই হত না। অজ্ঞানবশতঃ জীব অসীমকে সসীম বিষয়ের মধ্যে, অখণ্ড চৈতন্যকে জড় অণুর মধ্যে প্রকাশ করবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু শেষে নিজের ভুল ধরতে পেরে পালাতে চায়। এই প্রত্যাবর্তন—এই হল ধর্মের আরম্ভ; আর এর সাধনা হচ্ছে অহং-এর নাশ অর্থাৎ প্রেম। স্ত্রী, পুত্র বা আর কারও জন্য ভালবাসা নয়, পরন্তু নিজের ক্ষুদ্র ‘অহং’কে ছাড়া অপর সকলের জন্য ভালবাসা। আমেরিকায় ‘মানবজাতির উন্নতি’ ইত্যাদি যে-সব বড় বড় বুলি অহরহ শুনতে পাবে, সে-সব বাজে কথা ভুলো না। এক দিকে অবনতি না হলে অন্যদিকে উন্নতি হতে পারে না। এক সমাজে এক রকমের ত্রুটি আছে, অন্য সমাজে অন্য রকমের। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ সম্বন্ধেও তাই বলা চলে। মধ্যযুগে ডাকাতের প্রাধান্য ছিল, এখন জোচ্চোরের দল বেশী। কোন যুগে দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে ধারণা কম থাকে, অন্য যুগে বেশ্যাবৃত্তির আধিক্য দেখা যায়। কোন সময় শারীরিক দুঃখের আধিক্য, আবার অন্য সময় মানসিক দুঃখ সহস্রগুণ। জ্ঞান সম্বন্ধেও তাই। আবিষ্কার ও নামকরণের পূর্বেও কি মাধ্যাকর্ষণ প্রকৃতিতে ছিল না? যদি ছিলই, তবে তার অস্তিত্ব জানাতে তফাতটা কি হল? আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের চেয়ে তোমরা কি বেশী সুখী?

একমাত্র মূল্যবান জ্ঞান হচ্ছেঃ এইটি জানা যে, সবই প্রতারণা—ভান মাত্র। কিন্তু কম লোকই কদাচিৎ তা জানতে পারে। ‘সেই একমাত্র আত্মাকেই জান, আর অন্য সব বাক্য ত্যাগ কর।’১০৫ জগতের দিকে দিকে ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত আমাদের এইটুকু শিক্ষা লাভ হয়। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, সমগ্র মানবজাতিকে এই বলে ডাকা—‘ওঠ’ জাগো, যে পর্যন্ত না লক্ষ্যস্থলে পৌঁছচ্ছ, ততক্ষণ থেমো না।’ ধর্ম মানে ত্যাগ—তা ছাড়া আর কিছু নয়।

জীবসমষ্টিকে নিয়েই ঈশ্বর; মানবদেহের প্রত্যেক কোষ (cell)-এর একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও দেহ যেমন একটি অখণ্ড বস্তু, ঈশ্বরও ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি। সমষ্টিই ঈশ্বর এবং ব্যষ্টি বা অংশই জীব বা আত্মা। ঈশ্বরের অস্তিত্ব জীবের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করছে, দেহ যেমন কোষের ওপর নির্ভর করে; বিপরীতও সত্য। জীব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরসাপেক্ষ; একজন যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ অন্যকেও থাকতে হবে। আবার, এই পৃথিবী ছাড়া সব উচ্চতর লোকেই যেহেতু মন্দ অপেক্ষা ভালর ভাগ অনেকগুণ বেশী, সমষ্টি পুরুষ বা ঈশ্বরকে সর্বগুণশালী সর্বশক্তিমান্‌ ও সর্বজ্ঞ বলা চলে। ঈশ্বরের পূর্ণত্ব মানলেই এই সব গুণ স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়; সেজন্য আর বিচারের প্রয়োজন হয় না।

ব্রহ্ম এই উভয়ের অতীত, কিন্তু কোন অবস্থাবিশেষ নহেন। ব্রহ্মই একমাত্র অদ্বৈত বস্তু; বহুবস্তুসম্ভূত নন। এই সর্বব্যাপী তত্ত্বই দেহ-কোষ থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত সর্বত্র অনুস্যূত, এবং একে বাদ দিয়ে কেউ থাকতে পারে না। যা কিছু সত্য, তা এই ব্রহ্মতত্ত্ব ভিন্ন আর কিছু নয়। যখন ভাবি—‘আমি ব্রহ্ম’, তখন শুধু ‘আমিই’ থাকি। তুমি যখন এই চিন্তা কর, তখন তোমার পক্ষেও তাই; এইরূপ সর্বত্র। প্রত্যেকেই ঐ পূর্ণ তত্ত্ব।

দিন কয়েক আগে হঠাৎ কৃপানন্দকে চিঠি লেখবার একটা অদম্য ইচ্ছা হয়েছিল। হয়তো সে আনন্দ পাচ্ছিল না এবং আমাকে স্মরণ করছিল। সুতরাং আমি তাকে খুব স্নেহপূর্ণ একখানি চিঠি লিখেছিলাম। আজ আমেরিকার সংবাদ পেয়ে তার কারণ বুঝতে পারলাম। আমি তুষার প্রবাহের কাছ থেকে তোলা গোটাকয়েক ফুল তাকে পাঠিয়েছি। মিস ওয়াল্ডোকে বলবে, তাকে যেন যথেষ্ট স্নেহ জানিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন। প্রেম কখনও মরে না। সন্তানেরা যাই করুক বা যেমনই হোক না কেন, পিতৃস্নেহের মরণ নেই। সে আমার সন্তান—সে আজ দুঃখে পড়ায় আমার স্নেহ ও সাহায্যের উপর তার দাবী ঠিক তেমনি বা আরও বেশী। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

২৯৬*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

Grand Hotel, Saas Fee
Valais, Switzerland ৮ অগষ্ট,১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
তোমার চিঠির সঙ্গে একটি চিঠির তাড়া এসেছে। এইসঙ্গে ম্যাক্সমূলারের লেখা চিঠিখানা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা তাঁর সহৃদয়তা ও সৌজন্য।

মিস মূলার খুব শীঘ্রই ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন। সেক্ষেত্রে পূর্ব-প্রতিশ্রুতিমত সেই ‘পিওরিটি কংগ্রেস’ (Purity Congress) উপলক্ষে বার্নে যেতে পারব না। যদি সেভিয়ার-রা আমাকে সঙ্গে নিতে রাজী হন, তবেই আমি কিয়েল (Kiel) যাব এবং যাবার আগে তোমাকে লিখব। সেভিয়ার-রা মহৎ এবং সহৃদয়, কিন্তু তাঁদের বদান্যতার অযথা সুযোগ নেবার কোন অধিকার আমার নেই। মিস মূলারের ওপরও সে-দাবী করতে পারি না, কারণ সেখানকার খরচের বহর ভয়াবহ। অতএব বার্ন কংগ্রেসের আশা ত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করলাম, কারণ সেটা শুরু হতে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি, তার এখনও অনেক দেরী।

তাই ভাবছি জার্মানীর দিকেই যাব, যাত্রা শেষ করব কিয়েল-এ, এবং সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব।

তাঁর নাম হচ্ছে বালগঙ্গাধর তিলক (মিঃ তিলক) এবং বইয়ের নাম ‘ওরায়ন’ (Orion)।

তোমাদের বিবেকানন্দ

পুনঃ—জেকবীর (Jacobi) লেখাও একখানা আছে—সম্ভবতঃ একই ধারায় ও একই সিদ্ধান্ত সহ অনূদিত।

পুনঃ—আশা করি থাকবার বাড়ী ও হলঘরটি সম্বন্ধে তুমি মিস মূলারের অভিমত জিজ্ঞেস করবে, তাঁর সঙ্গে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা না হলে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হবেন।

—বি

গত রাত্রে মিস মূলার অধ্যাপক ডয়সনকে তার করেছিলেন, আজ ৯ অগষ্ট সকালে উত্তর এসেছে—আমাকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে; ১০ সেপ্টেম্বর আমি কিয়েল-এ ডয়সনের বাড়ীতে উঠব। তাহলে তুমি আমার সঙ্গে কোথায় দেখা করবে? কিয়েল-এ? মিস মূলার সুইজরলণ্ড থেকে ইংলণ্ডে যাচ্ছেন। আমি সেভিয়ারদের সঙ্গে কিয়েল যাচ্ছি। আমি ১০ সেপ্টেম্বর সেখানে পৌঁছব।

পুনঃ—বক্তৃতার বিষয়ে এখনও কিছু স্থির করিনি। আমার পড়াশুনো করার সময় একেবারে নেই। সেলেম সোসাইটি (Salem Society) খুব সম্ভবতঃ একটি হিন্দু সম্প্রদায়—কোন খেয়ালী দল নয়।

—বি

২৯৭*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

সুইজরলণ্ড
১২ অগষ্ট, ১৮৯৬

প্রেমাস্পদেষু,
আজ আমেরিকা থেকে একখানা চিঠি পেলাম, তা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাদের আমি লিখেছি, আমার অভিপ্রায় এককেন্দ্রীকরণ—বর্তমান কার্যারম্ভে তো বটেই। আমি তাদের এ পরামর্শ দিয়েছি যে, অনেকগুলি কাগজ ছাপাবার বদলে তারা ‘ব্রহ্মবাদিনে’র সঙ্গে আমেরিকার লেখা কয়েক পাতা জুড়ে শুরু করুক এবং কিছু চাঁদা তুলে আমেরিকার খরচটা পুষিয়ে নিক। জানি না, তারা কি করবে।

আগামী সপ্তাহে আমরা এখান থেকে জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা হব। আমরা সীমান্ত পার হয়ে জার্মানীতে পা দিতে না দিতে মিস মূলার ইংলণ্ডে চলে যাবেন। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং আমি তোমাকে কিয়েল-এ আশা করব।

আমি এখন পর্যন্ত কিছু লিখিওনি, পড়িওনি। বস্তুতঃ আমি নিছক বিশ্রাম নিচ্ছি। ভাবনার কারণ নেই, তুমি শীঘ্রই প্রবন্ধটি প্রস্তুত পাবে। আমি মঠ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে জানলাম যে, অপর স্বামীটি১০৬ রওনা হবার জন্য তৈরী। আমি নিশ্চিত যে, তোমরা যে ধরনের লোক চাও, তিনি সেই ধরনের উপযুক্ত হবেন। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের সংস্কৃতে বিশেষ অধিকার আছে, তিনি তাদের অন্যতম … এবং শুনলাম তাঁর ইংরেজী বেশ দুরস্ত হয়েছে। আমেরিকা থেকে সারদানন্দ সম্বন্ধে অনেকগুলি খবরের কাগজের অংশ পেয়েছি—তা থেকে জানলাম যে, তিনি সেখানে খুব সাফল্য অর্জন করেছেন। মানুষের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ফুটিয়ে তোলার পক্ষে আমেরিকা একটি সুন্দর শিক্ষাকেন্দ্র। ওখানকার হাওয়া কি সহানুভূতিতে পূর্ণ! গুডউইন এবং সারদানন্দের কাছ থেকে আমি চিঠি পেয়েছি।

চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ

২৯৮*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
আজ ভারত থেকে লেখা অভেদানন্দের একখানা চিঠি পেলাম, খুব সম্ভবতঃ তিনি ১১ অগষ্ট B. I. S. N-এর ‘S. S. Mombassa’তে রওনা হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি কোন জাহাজ পাননি, তা না হলে আরও আগে রওনা হতে পারতেন। খুব সম্ভব তিনি ‘মোম্বাসা’ জাহাজে স্থান পেয়ে যাবেন। ‘মোম্বাসা’ লণ্ডনে পৌঁছবে ১৫ সেপ্টেম্বর নাগাদ। তুমি জেনেছ যে, আমার ডয়সনের কাছে যাবার দিন—মিস মূলার পরিবর্তিত করে ১৯ সেপ্টেম্বর করেছেন। অভেদানন্দকে অভ্যর্থনা করার জন্য আমি লণ্ডনে থাকতে পারব না। তিনি কোন গরম পোষাক ছাড়াই আসছেন; মনে হচ্ছে সে সময়ে ইংলণ্ডে ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এবং তাঁর অন্ততঃ কয়েকটি অন্তর্বাস ও একটি ওভারকোট দরকার হবে। এ সব ব্যাপার আমার চেয়ে তুমি অনেক ভাল জান। সুতরাং দয়া করে এই ‘মোম্বাসা’র দিকে একটু নজর রেখো। আমি তার কাছ থেকে আর একটি চিঠি আশা করছি।

বস্তুতঃ আমি বিশ্রী-রকম সর্দিতে ভুগছি। আশা করি রাজার নিকট হতে মহিনের টাকা ইতোমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলে আমি তাকে যে টাকা দিয়েছিলাম ফেরত চাই না। তুমি তার সবটাই ওকে দিতে পার।

গুডউইন ও সারদানন্দের কাছ থেকে আমি কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। তারা ভাল আছে। মিসেস বুলের কাছ থেকেও একখানা চিঠি পেয়েছি; তিনি কেম্ব্রিজে যে সমিতিটি গঠন করেছেন, আমি ও তুমি ডাক মাধ্যমে তার সভ্য হইনি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমার বেশ মনে আছে যে, আমি তাঁকে লিখেছিলাম, তোমার ও আমার পক্ষে তার সভ্যপদ গ্রহণ করতে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়। আমি এখন পর্যন্ত একটি লাইনও লিখে উঠতে পারিনি। এমন কি পড়বার জন্যও একমুহূর্ত সময় পাইনি, পাহাড়ের উপত্যকায় চড়াই উতরাই করতে করতে সবটা সময় কাটছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আমাদের যাত্রা আরম্ভ হবে। মহিন ও ফক্সের সঙ্গে এর পর যখন দেখা হবে, দয়া করে তাদের আমার ভালবাসা জানিও।

আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।

তোমার চিরন্তন
বিবেকানন্দ

২৯৯*

লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬

প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার শেষ চিঠিখানি আজ পেয়েছি; ইতোমধ্যে আপনার প্রেরিত ৫ পাউণ্ডের রসিদ পেয়ে থাকবেন। আপনি সভ্য হওয়ার কথা, কি লিখেছেন, তা বুঝতে পারলাম না; তবে কোন সমিতির তালিকায় আমার নাম যুক্ত করা বিষয়ে আমার আপত্তি নাই। স্টার্ডির নিজের এ বিষয়ে কি মতামত, তা কিন্তু আমি জানি না। আমি এখন সুইজরলণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখান থেকে জার্মানীতে যাব, তারপর ইংলণ্ডে এবং পরের শীতে ভারতে যাব। সারদানন্দ ও গুডউইন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকার্য সুন্দররূপে করছে শুনে খুব খুশী হলাম। আমার নিজের কথা এই যে, আমি কোন কাজের প্রতিদানে ঐ ৫০০ পাউণ্ডের ওপর কোন দাবী রাখি না। আমার বোধ হয়, আমি যথেষ্ট খেটেছি। এখন আমি অবসর নেব। আমি ভারত থেকে আর একজন লোক চেয়ে পাঠিয়েছি; তিনি আগামী মাসে আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি, এখন অন্যে এটাকে চালাক। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কাজটা চালিয়ে দেবার জন্য কিছুদিন টাকাকড়ি ও বিষয়-সম্পত্তির সংস্পর্শে আমাকে আসতে হয়েছে। আমার স্থির বিশ্বাস যে, আমার যতটুকু করবার তো শেষ হয়েছে; এখন আমার আর বেদান্ত বা জগতের অন্য কোন দর্শন এমন কি ঐ কাজটার ওপরও কোন টান নেই। আমি চলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি—পৃথিবীর এই নরককুণ্ডে আর ফিরে আসছি না। এমন কি, এই কাজের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার দিকটার ওপরও আমার অরুচি হয়ে আসছে। মা শীঘ্রই আমাকে তার কাছে টেনে নিন! আর যেন কখনও ফিরে আসতে না হয়।

এই সব কাজ করা, উপকার ইত্যাদি শুধু চিত্তশুদ্ধির সাধনা মাত্র। তা আমার যথেষ্ট হয়ে গেছে। জগৎ চিরকাল অনন্তকাল ধরে জগৎই থাকবে। আমরা যে যেমন সে তেমন ভাবেই জগৎটা দেখি। কে কাজ করে, আর কার কাজ? জগৎ বলে কিছু নেই—এ সবই তো স্বয়ং ভগবান্। ভ্রমে আমরা একে জগৎ বলি। এখানে আমি নেই, তুমি নেই, আপনি নেই—আছেন শুধু তিনি, আছেন প্রভু—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’।

সুতরাং এখন থেকে টাকাকড়ি সম্বন্ধে আমি আর কিছুই জানি না। এ আপনাদের টাকা, আপনারা ইচ্ছামত খরচ করবেন।

শুভানুধ্যায়ী

সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—ডাক্তার জেনসের কাজে আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে, আমি তাঁকে তা জানিয়েছি। গুডউইন ও সারদানন্দ যদি আমেরিকায় কাজের প্রসার করতে পারে তো ভগবৎকৃপায় তারা তাই করতে থাকুক। স্টার্ডি, আমার বা অন্য কারও কাছে তো আর তারা নিজেদের বাঁধা দেয়নি! গ্রীনএকারের প্রোগ্রামে একটা ভয়ানক ভুল হয়েছে—ওতে ছাপা হয়েছে, স্টার্ডি কৃপা করে অনুমতি দেওয়ায় সারদানন্দ সেখানে রয়েছে। স্টার্ডি বা অপর কেহ—একজন সন্ন্যাসীকে অনুমতি দেবার কে? স্টার্ডি এটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এবং এজন্য দুঃখও করেছে। … এতে স্টার্ডিকে অপমানিত করা হয়েছে; আর এটা যদি ভারতে পৌঁছাত, তবে আমার কাজের পক্ষে সাঙ্ঘাতিক হত। ভাগ্যক্রমে আমি বিজ্ঞাপনগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছি। … আমি জগতের কোন সন্ন্যাসী বা প্রভুর চালক নই। যে কাজটা তাঁদের ভাল লাগে, সেইটে তাঁরা করেন এবং আমি যদি তাঁদের সাহায্য করতে পারি—বস্, এইমাত্র তাঁদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ। আমি পারিবারিক বন্ধনরূপ লোহার শেকল ভেঙেছি—আর ধর্মসঙ্ঘের সোনার শেকল পরতে চাই না। আমি মুক্ত, সর্বদা মুক্ত থাকব। আমার ইচ্ছা সকলেই মুক্ত হয়ে যাক—বাতাসের মত মুক্ত। যদি নিউ ইয়র্ক, বোষ্টন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোন স্থান বেদান্তের আচার্য চায়, তবে তাদের উচিত এই আচার্যদের সাদরে গ্রহণ করা, তাঁদের বাসস্থান ও ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। আর আমার কথা—আমি তো অবসর গ্রহণ করছি বললেই চলে। জগৎ-রঙ্গমঞ্চে আমার যেটুকু অভিনয় করবার ছিল, তা আমি শেষ করেছি। ইতি

আপনাদের
—বি

৩০০

[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

Lake Lucerne, সুইজরলণ্ড
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬

কল্যাণবরেষু,
অদ্য রামদয়ালবাবুর এক পত্র পাইলাম। তাহাতে তিনি লিখিতেছেন যে, দক্ষিণেশ্বরের মহোৎসবে অনেক বেশ্যা যাইয়া থাকে এবং সেজন্য অনেক ভদ্রলোকের তথায় যাইবার ইচ্ছা কম হইতেছে। পুনশ্চ—তাঁহার মতে পুরুষদিগের একদিন এবং মেয়েদের আর একদিন হওয়া উচিত। তদ্বিষয়ে আমার বিচার এইঃ

আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।

১। বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মহাতীর্থে যাইতে না পায় তো কোথায় যাইবে? পাপীদের জন্য প্রভুর বিশেষ প্রকাশ, পুণ্যবানের জন্য তত নহে।

২। মেয়েপুরুষ-ভেদাভেদ, জাতিভেদ, ধনভেদ, বিদ্যাভেদ ইত্যাদি নরক-দ্বাররূপ বহুভেদ সংসারের মধ্যেই থাকুক। পবিত্র তীর্থস্থলে ঐরূপ ভেদ যদি হয়, তাহা হইলে তীর্থ আর নরকে ভেদ কি?

৩। আমাদের মহা জগন্নাথপুরী—যথায় পাপী-অপাপী, সাধু-অসাধু, আবালবৃদ্ধবনিতা নরনারী সকলের অধিকার। বৎসরের মধ্যে একদিন অন্ততঃ সহস্র সহস্র নরনারী পাপবুদ্ধি ও ভেদবুদ্ধির হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া হরিনাম করে ও শোনে, ইহাই পরম মঙ্গল।

৪। যদি তীর্থস্থলেও লোকের পাপবৃত্তি একদিনের জন্য সঙ্কুচিত না হয়, তাহা তোমাদের দোষ, তাহাদের নহে। এমন মহা ধর্মস্রোত তোল যে, যে জীব তাহার নিকট আসবে, সে-ই ভেসে যাক।

৫। যাহারা ঠাকুরঘরে গিয়াও ঐ বেশ্যা, ঐ নীচ জাতি, ঐ গরীব, ঐ ছোটলোক ভাবে, তাহাদের (অর্থাৎ যাহাদের তোমরা ভদ্রলোক বল) সংখ্যা যতই কম হয়, ততই মঙ্গল। যাহারা ভক্তের জাতি বা যোনি বা ব্যবসায় দেখে, তাহারা আমাদের ঠাকুরকে কি বুঝিবে? প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি যে, শত শত বেশ্যা আসুক তার পায়ে মাথা নোয়াতে, বরং একজনও ভদ্রলোক না আসে নাই আসুক। বেশ্যা আসুক, মাতাল আসুক, চোর ডাকাত সকলে আসুক তাঁর অবারিত দ্বার। ‘It is easier for a camel to pass through the eye of a needle than for a rich man to enter the kingdom of God.’১০৭ এ সকল নিষ্ঠুর রাক্ষসীভাব মনেও স্থান দিবে না।

৬। তবে কতকটা সামাজিক সাবধানতা চাই—সেটা কি প্রকারে করিতে হইবে? জনকতক লোক (বৃদ্ধ হইলেই ভাল হয়) ছড়িদারের কার্য ঐ দিনের জন্য লইবেন। তাঁহারা মহোৎসবস্থলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবেন, কোন পুরুষ বা স্ত্রীকে কদাচার বা কুকথা ইত্যাদিতে নিযুক্ত দেখিলে তাহাদিগকে উদ্যান হইতে তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দিবেন। কিন্তু যতক্ষণ তাহারা ভালমানুষের মত ব্যবহার করে, ততক্ষণ তারা ভক্ত ও পূজ্য—মেয়েই হউক বা পুরুষই হউক, গৃহস্থ হউক বা অসতী হউক।

আমি এক্ষণে সুইজরলণ্ডে ভ্রমণ করিতেছি—শীঘ্র জার্মানীতে যাইব অধ্যাপক ডয়সনের সহিত দেখা করিতে। তথা হইতে ইংলণ্ডে প্রত্যাগমন ২৩।২৪ সেপ্টেম্বর নাগাত এবং আগামী শীতে দেশে প্রত্যাবর্তন।

আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি

 

বিবেকানন্দ

৩০১*

সুইজরলণ্ড
২৬ অগষ্ট, ১৮৯৬

প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
এইমাত্র আপনার চিঠি পেলাম। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আল্পস্ পর্বতে খুব চড়াই করছি আর তুষারপ্রবাহ পার হচ্ছি। এখন যাচ্ছি জার্মানীতে। অধ্যাপক ডয়সন কিয়েলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমায় নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব। সম্ভবতঃ এই শীতে ভারতে ফিরব।

মলাটের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমার আপত্তি এই যে, ওটি বড্ড রঙচঙে, চটকদার (tawdry); আর তাতে অনাবশ্যক এক গাদা মূর্তির সমাবেশ করা হয়েছে। নক‍্‍সা হওয়া চাই সাদাসিধে, ভাবদ্যোতক অথচ সংক্ষিপ্ত (condensed)।

আমি সানন্দে জানাচ্ছি যে, কাজ সুন্দর চলছে। … যা হোক, একটা পরামর্শ দিচ্ছি—ভারতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আমরা যত কাজ করি, তার সব একটা দোষে পণ্ড হয়ে যায়। আমরা এখনও কাজের ধারা ঠিক ঠিক শিখিনি। কাজকে ঠিক ঠিক কাজ বলেই ধরতে হবে—এর ভেতর বন্ধুত্বের অথবা চক্ষুলজ্জার স্থান নেই। যার ওপর ভার থাকবে, সে সব টাকাকড়ির অতি পরিষ্কার হিসেব রাখবে; এমন কি যদি কাউকে পরমুহূর্তে না খেয়ে মরতে হয়, তবুও ‘শাকের কড়ি মাছে’ দেবে না। একেই বলে বৈষয়িক সততা। তারপর চাই—অদম্য উৎসাহ। যখন যা কর, তখনকার মত তাই হবে ভগবৎ-সেবা। এই পত্রিকাটি১০৮ এখনকার মত আপনার আরাধ্য দেবতা হোক, তাহলেই সফল হবেন।

যখন এই পত্রিকাটি দাঁড় করিয়ে দিতে পারবেন, তখন তামিল, তেলুগু, কানাড়া প্রভৃতি দেশীয় ভাষায় ঠিক ঐ ভাবের কাগজ বের করুন। মান্দ্রাজীরা খুব সৎ, উৎসাহী ইত্যাদি; তবে আমার মনে হয়, শঙ্করের জন্মভূমি ত্যাগের ভাব হারিয়ে ফেলেছে। নানা বাধা বিপদের মাঝে আমার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, সংসার ত্যাগ করবে; তবেই তো ভিত্তি শক্ত হবে!

বীরের মত কাজ করে চলুন; (মলাটের) নক্‌সা-টক্‌সার চিন্তা এখন থাক, ঘোড়া হলে লাগামের জন্য আটকাবে না। আমরণ কাজ করে যান—আমি আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছি আর আমার শরীর চলে গেলেও আমার শক্তি আপনাদের সঙ্গে কাজ করবে। জীবন তো আসে যায়—ধন, মান, ইন্দ্রিয়ভোগ সবই দুদিনের জন্য। ক্ষুদ্র সংসারী কীটের মত মরার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে সত্য প্রচার করে মরা ভাল—ঢের ভাল। চলুন—এগিয়ে চলুন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহণ করুন। ইতি

আপনাদের
বিবেকানন্দ

৩০২*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

Kiel
১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… অবশেষে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। … অধ্যাপকের সঙ্গে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে ও বেদান্ত আলোচনা করে কালকের দিনটা খুব চমৎকার কাটান গেছে।

আমার মতে তিনি যেন একজন ‘যুধ্যমান (warring) অদ্বৈতবাদী’। অপর কিছুর সঙ্গে তিনি আপস করতে নারাজ। ‘ঈশ্বর’ শব্দে তিনি আঁতকে উঠেন। ক্ষমতায় কুলালে তিনি এ- সব কিছুই রাখতেন না। তোমার মাসিক পত্রিকার পরিকল্পনায় তিনি খুব আনন্দিত এবং এ- সব বিষয়ে লণ্ডনে তোমার সঙ্গে আলোচলা করতে চান; শীঘ্রই তিনি সেখানে যাচ্ছেন।

৩০৩*

[মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]

উইম্বল‍্‍ডন, ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনী,
সুইজরলণ্ড থেকে ফিরে এসে এইমাত্র তোমার অতি মনোজ্ঞ খবরটি পেলাম। ‘Old Maids Home’ (আইবুড়ীদের আশ্রম)-এ লভ্য আরাম সম্বন্ধে তুমি যে অবশেষে মত পরিবর্তন করেছ, তাতে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। তুমি এখন ঠিক পথ ধরেছ, শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের পক্ষে বিবাহই জীবনের সর্বোত্তম লক্ষ্য। আর যে মুহূর্তে এই চিরন্তন সত্যটি মানুষ শিখে নেবে এবং মেনে চলতে প্রস্তুত হবে যে, পরস্পরের দোষত্রুটি সহ্য করা অবশ্য কর্তব্য এবং জীবনে আপস করে চলাই রীতি, তখনই তারা সবচেয়ে সুখের জীবন যাপন করতে পারবে।

স্নেহের হ্যারিয়েট, তুমি ঠিক জেনো ‘সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন’—একটা স্ববিরোধী কথা; সুতরাং সংসারের কোন কিছু আমাদের উচ্চতম আদর্শের কাছাকাছি নয়—এটা দেখবার জন্য আমাদের সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে, এবং এটা জেনে সব জিনিষের যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করতে হবে।

বর্তমান অবস্থায় আমাদের একখানি পুস্তক থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করাই আমার পক্ষে সব চেয়ে ভাল বলে মনে হচ্ছেঃ

‘স্বামীকে ইহজীবনে সমস্ত কাম্যলাভে সহায়তা করে তুমি সর্বদা তাঁহার ঐকান্তিক প্রেমের অধিকারিণী হও; অতঃপর পৌত্র পৌত্রী প্রভৃতির মুখদর্শনের পরে যখন জীবন-নাট্য শেষ হয়ে আসবে, তখন যে সচ্চিদানন্দ-সাগরের জলস্পর্শে সর্বপ্রকার বিভেদ দূর হয়ে যায় এবং আমরা এক হয়ে যাই, সেই সচ্চিদানন্দ-লাভে যেন তোমরা পরস্পরের সহায় হও।’১০৯

আমি তোমাকে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয়, তোমার মধ্যে এমন প্রভূত ও সুসংযত শক্তি রয়েছে, যা ক্ষমা ও সহনশীলতায় পূর্ণ। সুতরাং আমি নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, তোমার দাম্পত্য-জীবন খুব সুখের হবে।

তোমাকে ও তোমার ভাবী বরকে আমার অনন্ত আশীর্বাদ। ভগবান্ যেন তাকে সর্বদা এ-কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তোমার মত পবিত্র, সুচরিত্রা, বুদ্ধিমতী, স্নেহময়ী ও সুন্দরী সহধর্মিণী লাভ করে সে কৃতার্থ হয়েছে।

আমি এত শীঘ্র আটলাণ্টিক পাড়ি দেবার ভরসা রাখি না, যদিও তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকতে আমার খুবই সাধ।

তুমি সারাজীবন উমার মত পবিত্র ও নিষ্কলুষ হও, আর তোমার স্বামীর জীবন যেন উমাগতপ্রাণ শিবের মতই হয়। ইতি

তোমার স্নেহের ভাই
বিবেকানন্দ

৩০৪*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

Airlie Lodge
Wimbledon, England
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬

স্নেহের ভগিনী,
সুইজরলণ্ডে দু-মাস পাহাড় চড়ে, পর্যটন করে ও হিমবাহ দেখে আজ লণ্ডনে এসে পৌঁছেছি। এতে আমার একটা উপকার হয়েছে—কয়েক পাউণ্ড অপ্রয়োজনীয় মেদ বাষ্পীয় অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। তথাপি তাতেও কোন নিরাপত্তা নেই, কারণ এ জন্মের স্থূল দেহটির খেয়াল হয়েছে মনকে অতিক্রম করে অনন্তে প্রসারিত হবে। এ ভাবে চলতে থাকলে আমাকে অচিরেই সমস্ত ব্যক্তিগত সত্তা হারাতে হবে—এই রক্তমাংসের দেহে থেকেও—অন্ততঃ বাইরের জগৎটার কাছে।

হ্যারিয়েটের চিঠিতে যে শুভ সংবাদটি এসেছে, তাতে যা আনন্দ হল—তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আজ তাকে চিঠি দিলাম। দুঃখ এই যে, তার বিবাহের সময় যেতে পারছি না, তবে সর্বাধিক শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ নিয়ে আমি ‘সূক্ষ্ম দেহে’ উপস্থিত থাকব। ভাল কথা, আমার আনন্দ পূর্ণাঙ্গ করার জন্য আমি তোমার এবং অপর ভগিনীদের নিকট হতেও অনুরূপ সংবাদ আশা করছি। এবার স্নেহের মেরী, আমি জীবনে যে এক মহৎ শিক্ষা লাভ করেছি, তার কথা তোমাকে বলব। সেটা হল এইঃ ‘তোমার আদর্শ যত উচ্চ হবে, তুমি তত দুঃখী’, কারণ ‘আদর্শ’ বলে বস্তুটিতে পৌঁছান এ সংসারে সম্ভব নয়—অথবা এ জীবনেও নয়। যে এ জগতে পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা করে, সে উন্মাদ বৈ নয়, কারণ তা হবার যো নেই।

সসীম জগতে তুমি কি করে অনন্তের সন্ধান পাবে? সুতরাং আমি তোমাকে বলছি— হ্যারিয়েট বেশ সুখের ও শান্তির জীবন লাভ করবে, কারণ কল্পনাবিলাস ও ভাবপ্রবণতার বশবর্তী হয়ে চলার মত বোকা সে মোটেই নয়। যেটুকু ভাবাবেগ থাকলে জীবন মধুর হয় এবং যেটুকু সাধারণ বুদ্ধি ও কোমলতা থাকলে জীবনের অবশ্যম্ভাবী কাঠিন্যগুলি নরম হয়ে যায়—সেটুকু তার আছে। হ্যারিয়েট ম্যাক্‌কিণ্ডলিরও ঐ গুণটি আরও বেশী পরিমাণেই আছে। একজন সেরা গৃহিণী হবার মত মেয়ে সে, শুধু এ জগৎটা আহাম্মকদের দ্বারা এতই পরিপূর্ণ যে, খুব কম লোক রক্তমাংসের দেহকে অতিক্রম করে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তোমার ও ইসাবেল-এর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমি তোমাকে সত্য কথাটি বলব এবং আমার ‘ভাষা সোজা—স্পষ্ট’।

মেরী, তুমি হলে একটি তেজী আরবী ঘোড়ার মত—মহীয়সী ও দীপ্তিময়ী। তোমাকে রাণী হিসেবে চমৎকার মানাবে—দেহে ও মেজাজে। তুমি একজন তেজস্বী, বীর, দুঃসাহসী, নির্ভীক স্বামীর পাশে উজ্জ্বল দীপ্তিতে শোভা পাবে; কিন্তু স্নেহের ভগিনী, গৃহিণী হিসেবে তুমি হবে একেবারেই নিকৃষ্ট। তুমি আমাদের দৈনন্দিন জগতের স্বচ্ছন্দচারী, সাংসারিক, পরিশ্রমী অথচ ঢিলেঢালা স্বামী বেচারাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। ভগিনী, মনে রেখো, যদিও এ-কথা সত্যি যে বাস্তব জীবন উপন্যাসের চেয়ে বেশী রোমাঞ্চকর, কিন্তু সে-রকম ঘটে ক্বচিৎ কখনও। তাই তোমার প্রতি আমার উপদেশ, যতদিন না তোমার আদর্শকে বাস্তব ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারছ, ততদিন তোমার বিয়ে করা ঠিক হবে না। যদি কর, তবে তা তোমাদের উভয়ের অশান্তি ডেকে আনবে। কয়েক মাসের মধ্যেই তুমি একজন সাধারণ ভালমানুষ মার্জিত রুচি যুবা পুরুষের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে, তখন তোমার কাছে জীবন নীরস বলে বোধ হবে। ভগিনী ইসাবেল-এর মেজাজটাও তোমারই মতন, শুধু কিণ্ডারগার্টেনটি তাকে বেশ কিছুটা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছে। সম্ভবতঃ সে ভাল গৃহিণীই হতে পারবে।

জগতে দু-রকমের লোক আছে। একরকম হল—বলিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার করে, বেশী কল্পনার ধার ধারে না, কিন্তু সৎ সহৃদয় মধুরস্বভাব ইত্যাদি। তাদেরই জন্য এই পৃথিবী; তারাই সুখী হতে জন্মেছে। আবার অন্য রকমের লোক আছে, যাদের স্নায়ুগুলি উত্তেজনাপ্রবণ, যারা ভয়ানক রকম কল্পনাপ্রিয়, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন এবং সর্বদা এই মুহূর্তে উঁচুতে উঠছে এবং পরের মুহূর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের বরাতে সুখ নেই। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা মাঝামাঝি একটা সুখের সুরে ভেসে যায়। শেষোক্তেরা আনন্দ ও বেদনার মধ্যে ছুটোছুটি করে। কিন্তু এরাই হল প্রতিভার উপাদান। ‘প্রতিভা এক রকমের পাগলামি’—আধুনিক এই মতবাদের মধ্যে অন্ততঃ কিছু সত্য নিহিত আছে।

এখন এই শ্রেণীর লোকেরা যদি বড় হতে চায়, তবে তাদের তা চরিতার্থ করবার জন্য লড়াই করতে হবে—লড়াই-এর জন্যেই, আর বাইরে বেরিয়ে এসে। তাদের কোন দায় থাকবে না—বিবাহ নয়, সন্তান নয়, সেই এক চিন্তা ছাড়া আর কোন অনাবশ্যক আসক্তি নয়; সেই আদর্শের জন্যই জীবনধারণ এবং সেই আদর্শের জন্যই মৃত্যুবরণ। আমি এই শ্রেণীর মানুষ। আমার একমাত্র ভাবাদর্শ হল ‘বেদান্ত’, এবং আমি ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত’। তুমি ও ইসাবেল এই ধাতুতে গড়া; কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যদিও কথাটা রূঢ়, তোমরা তোমাদের জীবনের বৃথাই অপচয় করছ। হয় একটা আদর্শকে ধর, বাইরে ঝাঁপিয়ে পড় এবং তার জন্য জীবন উৎসর্গ কর; কিম্বা অল্পে সন্তুষ্ট থাক ও বাস্তববাদী হও; আদর্শকে খাটো করে বিয়ে কর ও সুখের জীবন যাপন কর। হয় ‘ভোগ’ নয় ‘যোগ’—হয় এই জীবনটাকে উপভোগ কর, অথবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে যোগী হও; দুটি একসঙ্গে লাভ করার সাধ্য কারও নেই। এইবেলা না হলে কোনকালেই হবে না, ঝটপট একটাকে বেছে নাও। কথায় বলে, ‘যে খুব বাছবিচার করে, তার বরাতে কিছুই জোটে না’। তাই আন্তরিকভাবে, খাঁটিভাবে আমরণ সংকল্প নিয়ে ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হও’; দর্শন বা বিজ্ঞান, ধর্ম বা সাহিত্য—যে-কোন একটিকে অবলম্বন কর এবং অবশিষ্ট জীবনে সেইটিই তোমার উপাস্য দেবতা হোক। হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও। তোমার ও ইসাবেলের প্রতি আমার এতটুকু সহানুভূতি নেই; তোমরা না এটায়, না ওটায়। তোমরাও হ্যারিয়েটের মত ঠিক পথটি বেছে নিয়ে সুখী হও, কিম্বা মহীয়সী হও—এই আমি দেখতে চাই। পান ভোজন সজ্জা ও যত বাজে সামাজিক চালচলনের ছেলেমানুষীর জন্য একটা জীবন দেওয়া চলে না—বিশেষতঃ মেরী, তোমার। অদ্ভুত মস্তিষ্ক ও কর্মকুশলতাকে তুমি মরচে পড়তে দিয়ে নষ্ট করে ফেলছ, যার কোন অজুহাত নেই। বড় হবার উচ্চাশা তোমাকে রাখতে হবে। আমি জানি, আমার এই রূঢ় মন্তব্যগুলো তুমি ঠিকভাবে নেবে, কারণ তুমি জান, আমি তোমাদের যে ‘বোন’ বলে ডাকি—তার চেয়েও বেশীই আমি তোমাদের মনে করি। আমার অনেকদিন থেকেই এই কথাটি তোমাকে বলার ইচ্ছা ছিল, এবং অভিজ্ঞতা জমছে, তাই বলার আবেগে বলে ফেললাম। হ্যারিয়েটের আনন্দসংবাদ আমাকে এ-কথা বলতে প্ররোচিত করেছে। আমি শুনতে পেলে খুবই আনন্দিত হব যে, তুমিও বিয়ে করেছ এবং সংসারে যতটা সুখী হওয়া যায় ততটা সুখী হয়েছ, অথবা এ-কথা শুনতে চাই যে তুমি বড় বড় কাজ করছ।

জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের কাছে গিয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই এই শ্রেষ্ঠ জার্মান দার্শনিকের নাম শুনেছ। তিনি ও আমি একসঙ্গে ইংলণ্ড ভ্রমণ করেছি ও আজ উভয়ে এখানে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি—আমার ইংলণ্ড বাসের অবশিষ্ট দিনগুলি তাঁর কাছেই কাটাব। ডয়সন সংস্কৃত বলতে খুব ভালবাসেন এবং পাশ্চাত্য দেশে সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি সেটা অভ্যাস করতে চান বলে আমার সঙ্গে সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলেন না।

আমি এখানে বন্ধুদের মধ্যে এসে জুটেছি, কয়েক সপ্তাহ এখানে কাজ করব এবং তারপর শীতকালে ভারতবর্ষে ফিরে যাব।

সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ