০২. রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি

[অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত পুস্তকের সমালোচনা]

অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞদিগের অধিনায়ক। যে ঋগ্বেদ-সংহিতা পূর্বে সমগ্র কেহ চক্ষেও দেখিতে পাইত না, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বিপুল ব্যয়ে এবং অধ্যাপকের বহুবর্ষব্যাপী পরিশ্রমে এক্ষণে তাহা অতি সুন্দররূপে মুদ্রিত হইয়া সাধারণের পাঠ্য। ভারতের দেশদেশান্তর হইতে সংগৃহীত হস্তলিপি-পুঁথির অধিকাংশ অক্ষরগুলিই বিচিত্র এবং অনেক কথাই অশুদ্ধ; বিশেষ, মহাপণ্ডিত হইলেও বিদেশীর পক্ষে সেই অক্ষরের শুদ্ধ্যশুদ্ধি নির্ণয় এবং অতি স্বল্পাক্ষর জটিল ভাষ্যের বিশদ অর্থ বোধগম্য করা কি কঠিন, তাহা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের জীবনে এই ঋগ্বেদ-মুদ্রণ একটি প্রধান কার্য। এতদ্‍ব্যতীত আজীবন প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্যে তাঁহার বসবাস—জীবন-যাপন; কিন্তু তাহা বলিয়াই যে অধ্যাপকের কল্পনার ভারতবর্ষ—বেদ-ঘোষ-প্রতিধ্বনিত, যজ্ঞধূম-পূর্ণাকাশ, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-জনক-যাজ্ঞবল্ক্যাদি-বহুল, ঘরে ঘরে গার্গী-মৈত্রেয়ী-সুশোভিত, শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রের নিয়মাবলী-পরিচালিত, তাহা নহে। বিজাতি-বিধর্মি-পদদলিত, লুপ্তাচার, লুপ্তক্রিয়, ম্রিয়মান, আধুনিক ভারতের কোন্ কোণে কি নূতন ঘটনা ঘটিতেছে, তাহাও অধ্যাপক সদাজাগরূক হইয়া সংবাদ রাখেন। এদেশের অনেক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান—অধ্যাপকের পদযুগল কখনও ভারত-মৃত্তিকা-সংলগ্ন হয় নাই বলিয়া ভারতবাসীর রীতিনীতি আচার ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁহার মতামতে নিতান্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। কিন্তু তাঁহাদের জানা উচিত যে, আজীবন এদেশে বাস করিলেও অথবা এদেশে জন্মগ্রহণ করিলেও যে-প্রকার সঙ্গ সেই সামাজিক শ্রেণীর বিশেষ বিবরণ ভিন্ন অন্য শ্রেণীর বিষয়ে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান রাজপুরুষকে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ থাকিতে হয়। বিশেষ, জাতিবিভাগে বিভক্ত এই বিপুল সমাজে একজাতির পক্ষে অন্য জাতির আচারাদি বিশিষ্টরূপে জানাই কত দুরূহ। কিছুদিন হইল, কোনও প্রসিদ্ধ অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান কর্মচারীর লিখিত ‘ভারতাধিবাস’ নামধেয় পুস্তকে এরূপ এক অধ্যায় দেখিয়াছি—‘দেশীয় পরিবার-রহস্য’। মনুষ্যহৃদয়ে রহস্যজ্ঞানেচ্ছা প্রবল বলিয়াই বোধ হয় ঐ অধ্যায় পাঠ করিয়া দেখি যে, অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান-দিগ‍্গজ তাঁহার মেথর, মেথরানী ও মেথরানীর জার-ঘটিত ঘটনা-বিশেষ বর্ণনা করিয়া স্বজাতিবৃন্দের দেশীয়-জীবন-রহস্য সম্বন্ধে উগ্র কৌতূহল চরিতার্থ করিতে বিশেষ প্রয়াসী এবং ঐ পুস্তকের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সমাজে সমাদর দেখিয়া লেখক যে সম্পূর্ণরূপে কৃতার্থ, তাহাও বোধ হয়। ‘শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ’—আর বলি কি? তবে শ্রীভগবান্ বলিয়াছেন—‘সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে’ ইত্যাদি। যাক অপ্রাসঙ্গিক কথা; তবে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের আধুনিক ভারতবর্ষের, দেশদেশান্তরের রীতিনীতি ও সাময়িক ঘটনাজ্ঞান দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়, ইহা আমাদের প্রত্যক্ষ।

বিশেষতঃ ধর্ম সম্বন্ধে ভারতের কোথায় কি নূতন তরঙ্গ উঠিতেছে, অধ্যাপক সেগুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবেক্ষণ করেন এবং পাশ্চাত্য জগৎ যাহাতে সে বিষয়ে বিজ্ঞপ্ত হয়, তাহারাও বিশেষ চেষ্টা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী-প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ, থিওসফি সম্প্রদায় অধ্যাপকের লেখনী-মুখে প্রশংসিত বা নিন্দিত হইয়াছে। সুপ্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-নামক পত্রদ্বয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও উপদেশের প্রচার দেখিয়া এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার-লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণের বৃত্তান্তপাঠে রামকৃষ্ণ-জীবন তাঁহাকে আকর্ষণ করে। ইতোমধ্যে ‘ইণ্ডিয়া হাউস’-এর লাইব্রেরিয়ান টনি মহোদয়-লিখিত ‘রামকৃষ্ণচরিত’ও ইংলণ্ডীয় প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকায়মুদ্রিত হয়। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা হইতে অনেক বিবরণ সংগ্রহ করিয়া অধ্যাপক ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক ইংরেজী ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন। তাহাতে ব্যক্ত করিয়াছেন যে, বহু শতাব্দী যাবৎ পূর্বমনীষিগণের ও আধুনিক কালে পাশ্চাত্য বিদ্বদ‍্‍বর্গের প্রতিধ্বনিমাত্রকারী ভারতবর্ষে নূতন ভাষায় নূতন মহাশক্তি পরিপূরিত করিয়া নূতন ভাবসম্পাতকারী নূতন মহাপুরুষ সহজেই তাঁহার চিত্তাকর্ষণ করিলেন। পূর্বতন ঋষি-মুনি-মহাপুরুষদিগের কথা তিনি শাস্ত্রপাঠে বিলক্ষণই অবগত ছিলেন; তবে এ যুগে এ ভারতে—আবার তাহা হওয়া কি সম্ভব? রামকৃষ্ণ-জীবনী এ প্রশ্নের যেন মীমাংসা করিয়া দিল। আর ভারতগতপ্রাণ মহাত্মার ভারতের ভাবী মঙ্গলের, ভাবী উন্নতির আশালতার মূলে বারিসেচন করিয়া নূতন প্রাণ সঞ্চার করিল।

পাশ্চাত্য জগতে কতকগুলি মহাত্মা আছেন, যাঁহারা নিশ্চিত ভারতের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু ম্যাক্সমূলারের অপেক্ষা ভারতহিতৈষী ইওরোপখণ্ডে আছেন কিনা, জানি না।ম্যাক্সমূলার যে শুধু ভারতহিতৈষী, তাহা নহেন—ভারতের দর্শন-শাস্ত্রে, ভারতের ধর্মে তাঁহার বিশেষ আস্থা; অদ্বৈতবাদ যে ধর্মরাজ্যের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্ক্রিয়া, তাহা অধ্যাপক সর্বসমক্ষে বারংবার স্বীকার করিয়াছেন। যে সংসারবাদ দেহাত্মবাদী খ্রীষ্টিয়ানের বিভীষিকাপ্রদ, তাহাও তিনি স্বীয় অনুভূতিসিদ্ধ বলিয়া দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেন; এমন কি, বোধ হয় যে, ইতঃপূর্ব-জন্ম তাঁহার ভারতেই ছিল, ইহাই তাঁহার ধারণা এবং পাছে ভারতে আসিলে তাঁহার বৃদ্ধ শরীর সহসা-সমুপস্থিত পূর্বস্মৃতিরাশির প্রবল বেগ সহ্য করিতে না পারে, এই ভয়ই অধুনা ভারতাগমনের প্রধান প্রতিবন্ধক। তবে গৃহস্থ মানুষ, যিনিই হউন, সকল দিক্ বজায় রাখিয়া চলিতে হয়। যখন সর্বত্যাগী উদাসীনকে অতি বিশুদ্ধ জানিয়াও লোকনিন্দিত আচারের অনুষ্ঠানে কম্পিতকলেবর দেখা যায়, ‘শূকরীবিষ্ঠা’ মুখে বলিয়াও যখন ‘প্রতিষ্ঠা’র লোভ, অপ্রতিষ্ঠার ভয় মহা-উগ্রতাপসেরও কার্য-প্রণালীর পরিচালক, তখন সর্বদা লোকসংগ্রহেচ্ছু বহুলোকপূজ্য গৃহস্থের যে অতি সাবধানে নিজের মনোগত ভাব প্রকাশ করিতে হইবে, ইহাতে কি বিচিত্রতা? যোগশক্তি ইত্যাদি গূঢ় বিষয় সম্বন্ধেও যে অধ্যাপক একেবারে অবিশ্বাসী, তাহাও নহেন।

‘দার্শনিক-পূর্ণ ভারতভূমিতে যে-সকল ধর্ম-তরঙ্গ উঠিতেছে’ তাহাদের কিঞ্চিৎ বিবরণ ম্যাক্সমূলার প্রকাশ করেন, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় অনেকে ‘উহার মর্ম বুঝিতে অত্যন্ত ভ্রমে পড়িয়াছেন এবং অত্যন্ত অযথা বর্ণন করিয়াছেন’। ইহা প্রতিবিধানের জন্য এবং ‘এসোটেরিক বৌদ্ধমত, থিওসফি প্রভৃতি বিজাতীয় নামের পশ্চাতে ভারতবাসী সাধুসন্ন্যাসীদের অলৌকিক ক্রিয়াপূর্ণ অদ্ভুত যে-সকল উপন্যাস ইংলণ্ড ও আমেরিকার সংবাদপত্রসমূহে উপস্থিত হইতেছে, তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্য আছে’, ইহা দেখাইবার জন্য অর্থাৎ ভারতবর্ষ যে কেবল পক্ষিজাতির ন্যায় আকাশে উড্ডীয়মান, পদভরে জলসঞ্চরণকারী মৎস্যানুকারী জলজীবী, মন্ত্রতন্ত্র-ছিটাফোঁটা-যোগে রোগাপনয়নকারী, সিদ্ধিবলে ধনীদিগের বংশরক্ষক, সুবর্ণাদি-সৃষ্টিকারী সাধুগণের নিবাসভূমি, তাহা নহে; কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ, প্রকৃত ব্রহ্মবিৎ, প্রকৃত যোগী, প্রকৃত ভক্ত যে ঐ দেশে একেবারে বিরল নহেন এবং সমগ্র ভারতবাসী যে এখনও এতদূর পশুভাব প্রাপ্ত হন নাই যে, শেষোক্ত নরদেবগণকে ছাড়িয়া পূর্বোক্ত বাজীকরগণের পদলেহন করিতে আপামর-সাধারণ দিবানিশি ব্যস্ত—ইহাই ইওরোপীয় মনীষিগণকে জানাইবার জন্য ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের অগষ্টসংখ্যক ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক পত্রিকায় অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার ‘প্রকৃত মহাত্মা’-শীর্ষক প্রবন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিতের অবতারণা করেন।

ইওরোপ ও আমেরিকার বুধমণ্ডলী অতি সমাদরে এ প্রবন্ধটি পাঠ করেন এবং উহার বিষয়ীভূত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রতি অনেকেই আস্থাবান্ হইয়াছেন। আর সুফল হইয়াছে কি?—এই ভারতবর্ষ নরমাংসভোজী, নগ্নদেহ, বলপূর্বক বিধবা-দাহনকারী, শিশুঘাতী, মূর্খ, কাপুরুষ, সর্বপ্রকার পাপ ও অন্ধতা-পরিপূর্ণ, পশুপ্রায় নরজাতিপূর্ণ বলিয়া পাশ্চাত্য সভ্য জাতিরা ধারণা করিয়া রাখিয়াছিলেন; এই ধারণার প্রধান সহায় পাদরী-সাহেবগণ—ও বলিতে লজ্জা হয়, দুঃখ হয়, কতকগুলি আমাদের স্বদেশী। এই দুই দলের প্রবল উদ্যোগে যে একটি অন্ধতামসের জাল পাশ্চাত্যদেশ-নিবাসীদের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়াছিল, সেইটি ধীরে ধীরে খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইতে লাগিল। ‘যে দেশে শ্রীভগবান্ রামকৃষ্ণের ন্যায় লোকগুরুর উদয়, সে দেশ কি বাস্তবিক যে-প্রকার কদাচারপূর্ণ আমরা শুনিয়া আসিতেছি, সেই প্রকার? অথবা কুচক্রীরা আমাদিগকে এতদিন ভারতের তথ্য সম্বন্ধে মহাভ্রমে পাতিত করিয়া রাখিয়াছিল?’—এ প্রশ্ন স্বতই পাশ্চাত্য মনে সমুদিত।

পাশ্চাত্য জগতে ভারতীয় ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সাম্রাজ্যের চক্রবর্তী অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার যখন শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিত অতি ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে ইওরোপ ও আমেরিকার অধিবাসীদিগের কল্যাণের জন্য সংক্ষেপে ‘নাইন‍্‍টিন্থ সেঞ্চুরি’তে প্রকাশ করিলেন, তখন পূর্বোক্ত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভীষণ অন্তর্দাহ উপস্থিত হইল, তাহা বলা বাহুল্য।

মিশনরী মহোদয়েরা হিন্দুদেবদেবীর অতি অযথা বর্ণন করিয়া তাঁহাদের উপাসকদিগের মধ্যে যে যথার্থ ধার্মিক লোক কখনও উদ্ভূত হইতে পারে না—এইটি প্রমাণ করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিলেন; প্রবল বন্যার সমক্ষে তৃণগুচ্ছের ন্যায় তাহা ভাসিয়া গেল, আর পূর্বোক্ত স্বদেশী সম্প্রদায় শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তিসম্প্রসারণরূপ প্রবল অগ্নি নির্বাণ করিবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে হতাশ হইয়া পড়িয়াছেন। ঐশী শক্তির সমক্ষে জীবের শক্তি কি?

অবশ্য দুই দিক্ হইতেই এক প্রবল আক্রমণ বৃদ্ধ অধ্যাপকের উপর পতিত হইল। বৃদ্ধ কিন্তু হটিবার নহেন; এ সংগ্রামে তিনি বহুবার পারোর্ত্তীর্ণ। এবারও হেলায় উর্ত্তীর্ণ হইয়াছেন এবং ক্ষুদ্র আততায়িগণকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করিবার জন্য এবং উক্ত মহাপুরুষ ও তাঁহার ধর্ম যাহাতে সর্বসাধারণে জানিতে পারে, সেইজন্য তাঁহার অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ জীবনী ও উপদেশ সংগ্রহপূর্বক ‘রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি’ নামক পুস্তক প্রকাশ করিয়া উহার ‘রামকৃষ্ণ’ নামক অধ্যায়ে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়াছেনঃ

‘উক্ত মহাপুরুষ ইদানীং ইওরোপ ও আমেরিকার বহুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, তথায় তাঁহার শিষ্যেরা মহোৎসাহে তাঁহার উপদেশ প্রচার করিতেছেন এবং বহু ব্যক্তিকে, এমন কি, খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্য হইতেও রামকৃষ্ণ-মতে আনয়ন করিতেছেন, একথা আমাদের নিকট আশ্চর্যবৎ এবং কষ্টে বিশ্বাসযোগ্য … তথাপি প্রত্যেক মনুষ্যহৃদয়ে ধর্ম-পিপাসা বলবতী, প্রত্যেক হৃদয়ে প্রবল ধর্মক্ষুধা বিদ্যমান, যাহা বিলম্বে বা শীঘ্রই শান্ত হইতে চাহে। এই-সকল ক্ষুধার্ত প্রাণে রামকৃষ্ণের ধর্ম বাহিরের কোন শাসনাধীনে আসে না বলিয়াই অমৃতবৎ গ্রাহ্য হয়। … অতএব রামকৃষ্ণ-ধর্মানুচারীদের যে প্রবল সংখ্যা আমরা শুনিতে পাই, তাহা কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত যদ্যপি হয়, তথাপি যে ধর্ম আধুনিক সময়ে এতাদৃশী সিদ্ধিলাভ করিয়াছে এবং যাহা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে সম্পূর্ণ সত্যতার সহিত জগতের সর্বপ্রাচীন ধর্ম ও দর্শন বলিয়া ঘোষণা করে এবং যাহার নাম ‘বেদান্ত’ অর্থাৎ বেদশেষ বা বেদের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য, তাহা অস্মদাদির অতিযত্নের সহিত মনঃসংযোগার্হ।’

এই পুস্তকের প্রথম অংশে মহাত্মা পুরুষ, আশ্রম-বিভাগ, সন্ন্যাসী, যোগ, দয়ানন্দ সরস্বতী, পওহারী বাবা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাস্বামী সম্প্রদায়ের নেতা রায় শালিগ্রাম সাহেব বাহাদুর প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনীর অবতারণা করা হইয়াছে।

অধ্যাপকের বড়ই ভয়, পাছে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধে যে দোষ আপনা হইতেই আসে—অনুরাগ বা বিরাগাধিক্যে অতিরঞ্জিত হওয়া—সেই দোষ এ জীবনীতে প্রবেশ করে। তজ্জন্য ঘটনাবলী-সংগ্রহে তাঁহার বিশেষ সাবধানতা। বর্তমান লেখক শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষুদ্র দাস—তৎসঙ্কলিত রামকৃষ্ণ-জীবনীর উপাদান যে অধ্যাপকের যুক্তি ও বুদ্ধি-উদূখলে বিশেষ কুট্টিত হইলেও ভক্তির আগ্রহে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত হওয়া সম্ভব, তাহাও বলিতে ম্যাক্সমূলার ভুলেন নাই এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিগণ শ্রীরামকৃষ্ণের দোষোদ্ঘোষণ করিয়া অধ্যাপককে যাহা কিছু লিখিয়াছেন, তাহার প্রত্যুত্তরমুখে দুই চারিটি কঠোর মধুর কথা যাহা বলিয়াছেন, তাহাও পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষাপূর্ণ বাঙ্গালীর বিশেষ মনোযোগের বিষয়, সন্দেহ নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ-কথা অতি সংক্ষেপে সরল ভাষায় পুস্তকমধ্যে অবস্থিত। এ জীবনীতে সভয় ঐতিহাসিকের প্রত্যেক কথাটি যেন ওজন করিয়া লেখা—‘প্রকৃত মহাত্মা’-নামক প্রবন্ধে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মধ্যে মধ্যে দেখা যায়, এবার তাহা অতি যত্নে আবরিত। একদিকে মিশনরী, অন্যদিকে ব্রাহ্ম-কোলাহল—এ উভয় আপদের মধ্য দিয়া অধ্যাপকের নৌকা চলিয়াছে। ‘প্রকৃত মহাত্মা’ উভয় পক্ষ হইতে বহু ভর্ৎসনা, বহু কঠোর বাণী অধ্যাপকের উপর আনে; আনন্দের বিষয়—তাহার প্রত্যুত্তরের চেষ্টাও নাই, ইতরতা নাই, আর গালাগালি সভ্য ইংলণ্ডের ভদ্র লেখক কখনও করেন না; কিন্তু বর্ষীয়ান্ মহাপণ্ডিতের উপযুক্ত ধীর-গম্ভীর, বিদ্বেষ-শূন্য অথচ বজ্রবৎ দৃঢ় স্বরে—মহাপুরুষের অলৌকিক হৃদয়োত্থিত অমানব ভাবের উপর যে আক্ষেপ হইয়াছিল, তাহা অপসারিত করিয়াছেন।

আক্ষেপগুলিও আমাদের বিস্ময়কর বটে। ব্রাহ্ম-সমাজের গুরু স্বর্গীয় আচার্য শ্রীকেশবচন্দ্রের শ্রীমুখ হইতে আমরা শুনিয়াছি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের সরল মধুর গ্রাম্য ভাষা অতি অলৌকিক পবিত্রতা-বিশিষ্ট; আমরা যাহাকে অশ্লীল বলি, এমন কথার সমাবেশ তাহাতে থাকিলেও তাঁহার অপূর্ব বালবৎ কামগন্ধহীনতার জন্য ঐ-সকল শব্দ-প্রয়োগ দোষের না হইয়া ভূষণস্বরূপ হইয়াছে। অথচ ইহাই একটি প্রবল আক্ষেপ!!

অপর আক্ষেপ এই যে, তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাহাতে অধ্যাপক উত্তর দিতেছেন যে, তিনি স্ত্রীর অনুমতি লইয়া সন্ন্যাসব্রত ধারণ করেন এবং যতদিন মর্ত্যধামে ছিলেন, তাঁহার সদৃশী স্ত্রী পতিকে গুরুভাবে গ্রহণ করিয়া স্বেচ্ছায় পরমানন্দে তাঁহার উপদেশ অনুসারে আকুমার ব্রহ্মচারিণীরূপে ভগবৎসেবায় নিযুক্তা ছিলেন। আরও বলেন যে, শরীরসম্বন্ধ না হইলে কি বিবাহে এতই অসুখ? ‘আর শরীরসম্বন্ধ না রাখিয়া ব্রহ্মচারিণী পত্নীকে অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মানন্দের ভাগিনী করিয়া ব্রহ্মচারী পতি যে পরম পবিত্রভাবে জীবন অতিবাহিত করিতে পারেন, এ বিষয়ে উক্ত ব্রতধারণকারী ইওরোপ-নিবাসীরা সফলকাম হয় নাই, আমরা মনে করিতে পারি, কিন্তু হিন্দুরা যে অনায়াসে ঐ প্রকার কামজিৎ অবস্থায় কালাতিপাত করিতে পারে, ইহা আমরা বিশ্বাস করি।’ অধ্যাপকের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক! তিনি বিজাতি, বিদেশী হইয়া আমাদের একমাত্র ধর্মসহায় ব্রহ্মচর্য বুঝিতে পারেন, এবং ভারতবর্ষে যে এখনও বিরল নহে, বিশ্বাস করেন; আর আমাদের ঘরের মহাবীরেরা বিবাহে শরীরসম্বন্ধ বই আর কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না!! যাদৃশী ভাবনা যস্য ইত্যাদি।

আবার অভিযোগ এই যে, তিনি বেশ্যাদিগকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন না। ইহাতে অধ্যাপকের উত্তর বড়ই মধুর; তিনি বলেন, শুধু রামকৃষ্ণ নহেন, অন্যান্য ধর্মপ্রবর্তকেরাও এ অপরাধে অপরাধী।

আহা! কি মিষ্ট কথা—শ্রীভগবান্ বুদ্ধদেবের কৃপাপাত্রী বেশ্যা অম্বাপালী ও হজরত ঈশার দয়াপ্রাপ্তা সামরীয়া নারীর কথা মনে পড়ে। আরও অভিযোগ, মদ্যপানের উপরও তাঁহার তাদৃশ ঘৃণা ছিল না। হরি! হরি! ‘একটু মদ খেয়েছে বলে সে লোকটার ছায়াও স্পর্শ করা হবে না’—এই না অর্থ? দারুণ অভিযোগই বটে! মাতাল, বেশ্যা, চোর, দুষ্টদের মহাপুরুষ কেন দূর দূর করিয়া তাড়াইতেন না, আর চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ছাঁদি ভাষায় সানাইয়ের পোঁ-র সুরে কেন কথা কহিতেন না! আবার সকলের উপর বড় অভিযোগ—আজন্ম স্ত্রী-সঙ্গ কেন করিলেন না!!!

আক্ষেপকারীদের এই অপূর্ব পবিত্রতা এবং সদাচারের আদর্শে জীবন গড়িতে না পারিলেই ভারত রসাতলে যাইবে! যাক রসাতলে, যদি ঐ প্রকার নীতিসহায়ে উঠিতে হয়।

জীবনী অপেক্ষা উক্তি-সংগ্রহ এ পুস্তকের অধিক স্থান অধিকার করিয়াছে। ঐ উক্তিগুলি যে সমস্ত পৃথিবীর ইংরাজী-ভাষী পাঠকের মধ্যে অনেক ব্যক্তির চিত্তাকর্ষণ করিতেছে, তাহা পুস্তকের ক্ষিপ্র বিক্রয় দেখিয়াই অনুমিত হয়। উক্তিগুলি তাঁহার শ্রীমুখের বাণী বলিয়া মহাশক্তিপূর্ণ এবং তজ্জন্যই নিশ্চিত সর্বদেশে আপনাদের ঐশী শক্তি বিকাশ করিবে। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ মহাপুরুষগণ অবতীর্ণ হন—তাঁহাদের জন্ম-কর্ম অলৌকিক এবং তাঁহাদের প্রচারকার্যও অত্যাশ্চর্য।

আর আমরা? যে দরিদ্র ব্রাহ্মণকুমার আমাদিগকে স্বীয় জন্ম দ্বারা পবিত্র, কর্ম দ্বারা উন্নত এবং বাণী দ্বারা রাজজাতিরও প্রীতি-দৃষ্টি আমাদের উপর পাতিত করিয়াছেন, আমরা তাঁহার জন্য করিতেছি কি? সত্য সকল সময়ে মধুর হয় না, কিন্তু সময়বিশেষে তথাপি বলিতে হয়—আমরা কেহ কেহ বুঝিতেছি আমাদের লাভ, কিন্তু ঐ স্থানেই শেষ। ঐ উপদেশ জীবনে পরিণত করিবার চেষ্টা করাও আমাদের অসাধ্য—যে জ্ঞান-ভক্তির মহাতরঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তোলিত করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে অঙ্গ বিসর্জন করা তো দূরের কথা। যাঁহারা বুঝিয়াছেন এ খেলা, বা বুঝিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে শুধু বুঝিলে হইবে কি? বোঝার প্রমাণ কার্যে। মুখে বুঝিয়াছি বা বিশ্বাস করি—বলিলেই কি অন্যে বিশ্বাস করিবে? সকল হৃদ্‍গত ভাবই ফলানুমেয়; কার্যে পরিণত কর—জগৎ দেখুক।

যাঁহারা আপনাদিগকে মহাপণ্ডিত জানিয়া এই মূর্খ দরিদ্র পূজারী ব্রাহ্মণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের নিবেদন এই যে, যে দেশের এক মূর্খ পূজারী সপ্তসমুদ্রপার পর্যন্ত আপনাদের পিতৃপিতামহাগত সনাতন ধর্মের জয়ঘোষণা নিজ শক্তিবলে অত্যল্প কালেই প্রতিধ্বনিত করিল, সেই দেশের সর্বলোকমান্য শূরবীর মহাপণ্ডিত আপনারা—আপনারা ইচ্ছা করিলে আরও কত অদ্ভুত কার্য স্বদেশের, স্বজাতির কল্যাণের জন্য করিতে পারেন। তবে উঠুন, প্রকাশ হউন, দেখান মহাশক্তির খেলা—আমরা পুষ্প-চন্দন-হস্তে আপনাদের পূজার জন্য দাঁড়াইয়া আছি। আমরা মূর্খ, দরিদ্র, নগণ্য, বেশমাত্র-জীবী ভিক্ষুক; আপনারা মহারাজ, মহাবল, মহাকুল-প্রসূত, সর্ববিদ্যাশ্রয়—আপনারা উঠুন, অগ্রণী হউন, পথ দেখান, জগতের হিতের জন্য সর্বত্যাগ দেখান, আমরা দাসের ন্যায় পশ্চাদ্‍গমন করি। আর যাঁহারা শ্রীরামকৃষ্ণনামের প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবে, দাসজাতিসুলভ ঈর্ষা ও দ্বেষে জর্জরিত-কলেবর হইয়া বিনা কারণে বিনা অপরাধে নিদারুণ বৈর প্রকাশ করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে—হে ভাই, তোমাদের এ চেষ্টা বৃথা। যদি এই দিগদিগন্তব্যাপী মহাতরঙ্গ—যাহার শুভ্রশিখরে এই মহাপুরুষমূর্তি বিরাজ করিতেছেন—আমাদের ধন, জন বা প্রতিষ্ঠা-লাভের উদ্যোগের ফল হয়, তাহা হইলে তোমাদের বা অপর কাহারও চেষ্টা করিতে হইবে না, মহামায়ার অপ্রতিহত নিয়মপ্রভাবে অচিরাৎ এ তরঙ্গ মহাজলে অনন্তকালের জন্য লীন হইয়া যাইবে; আর যদি জগদম্বা-পরিচালিত মহাপুরুষের নিঃস্বার্থ প্রেমোচ্ছ্বাসরূপ এই বন্যা জগৎ উপপ্লাবিত করিতে আরম্ভ করিয়া থাকে, তবে হে ক্ষুদ্র মানব, তোমার কি সাধ্য মায়ের শক্তিসঞ্চার রোধ কর?