উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

হনোলুলুর মাকুদা

হনোলুলুর মাকুদা

শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আমি বেশ নরম গলায় গান গাইতে চেষ্টা করেছিলুম, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি–আর টেনিদা বেশ উদাস হয়ে একটার পর একটা চীনেবাদাম চিবিয়ে খাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় পাশ থেকে কে যেন গলা খাঁকারি দিয়ে বললে, হু-হুম্।

চেয়ে দেখি লম্বা চেহারার একটি লোক, গায়ে রংচটা হলদে মতন একটা পুরনো ওভারকোট, পরনে তালিমারা ট্রাউজার আর গালভর্তি এলোপাথাড়ি দাড়ির সঙ্গে একমুখ হাসি। দাঁতগুলো আবার পানের ছোপধরা–ঠিক একরাশ কুমড়োর বিচির মতো মনে হল।

লোটা আবার বললে, আমি প্রতিবাদ করছি। এর চাইতে ভালো দেশ পৃথিবীতে অনেক আছে।

টেনিদার চীনেবাদাম চিবানো বন্ধ হয়ে গেল।

–আচ্ছা লোক তো মশাই। আপনি বাঙালী হয়ে বাংলা দেশের নিন্দে করছেন?

–আমি বাঙালী নই। আমি ভারতবর্ষের লোকই নই।

–তবে কি বাঙাল? না পাকিস্তানি?

–না–আমি হনোলুলুর লোক।

–হনোলুলু?–টেনিদার গলায় চীনেবাদাম আটকে গেল। আর আমি কাকের মতো হাঁ করে চেয়ে রইলুম লোকটার মুখের দিকে।

বার কয়েক কেশে-টেশে টেনিদা সামলে নিলে। তারপর বললে, চালিয়াতির আর জায়গা পাননি স্যার? দিব্যি বাঙালী চেহারা আপনার–চমৎকার বাংলায় কথা বলছেন, আপনি হনোলুলুর লোক? তা হলে আমি তো ম্যাডাগাস্কারের লোক আর এই প্যালাটা হচ্ছে আফ্রিকার গরিলা।

আমি দারুণ প্রতিবাদ করে বললুম, কক্ষনো না, আমি মোটেই আফ্রিকার গরিলা নই। বরং তোমাকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু বলা যেতে পারে।

গালভর্তি এলোমেলো দাড়ি আর কুমড়োর বিচির মতো দাঁত নিয়ে আবার হেসে উঠল লোকটা। বললে, ছিঃ খোকারা, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই। আমি হনোলুলুর লোক কি না জানতে চাও? তোমরা অ্যানথ্রপোলজি পড়েছ?

আমরা বললুম, না, পড়িনি।

–পিথেকানথ্রোপাস ইরেকটাসের কথা কিছু জানো?

আমরা আঁতকে উঠে বললুম, না–জানি না।

–সেই জন্যেই বুঝতে পারছ না। এসব পড়লে-টড়লে জানতে, বাঙালী আর হনোলুলুর লোকের চেহারা একই রকম।

 গোটা দুতিন কটকটে নামের ধাক্কাতেই আমরা কাত হয়ে গিয়েছিলুম, তেমনি বোকার মতো চেয়ে রইলুম লোকটার দিকে।

লোকটা তেমনি বলে যেতে লাগল : আর বাংলা শিখলুম কী করে? আমি হচ্ছি ওয়ার্ল্ড-ট্যুরিস্ট–অর্থাৎ ভূ-পর্যটক। আর জানোই তো, টুরিস্টদের দুনিয়ার তামাম ভাষা শিখতে হয়।

–আপনি সব ভাষা জানেন?–টেনিদা এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।

–আলবাত।

জাপানী বলুন তো?

কাই-দু চি নাগাসাকি হিরোহিতো-উচিমিরো-কিচিকিদা বুঝতে পারছ?

আমি বললুম, পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটু জার্মান বলুন!

–ভোলতেনজেন-কুলতুরক্যাম্প-ব্লিৎক্রিগ-গট ইন্ হিম্মেল!

টেনিদা বললে, খুব ইন্টারেস্টিং তো? ফরাসীও নিশ্চয় জানেন?

লোকটা মিটমিট করে হেসে বললে, আঁফাঁ তেরিব্বল–বঁজুর মঁসিয়ো–সিল ভূ প্লে-ক্যাস্ কে সে।

টেনিদা বললে, দারুণ।

আমি চোখ কপালে তুলে বললুম, নিদারুণ।

–আর শুনতে চাও?

না স্যার, এতেই দম আটকে আসছে। আপনার নামটা জানতে পারি?

আমার নাম ম্যাকাদিনি বেনিহিত অ্যাসপারাগাস ডি প্রোফান্ডিস।

কী সর্বনাশ!

লোকটা তালিমারা ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে বেশ কায়দা করে শিস দিলে একটা। বললে, আমাদের হনোলুলুর নাম একটু লম্বাই হয়। তোমাদের বাঙালী নামই বা কিসে কম? এই তো একটু আগেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল–তাঁর নাম নিত্যরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরী।

টেনিদা মাথা চুলকে বলল, যেতে দিন স্যার, কাটাকাটি হয়ে গেল। কিন্তু অত বড় নামে তো আপনাকে ডাকা যাবে না, একটু শর্টকাট করতে পারলে

-আচ্ছা, আচ্ছা, ম্যাকাদিনি বোলো। তোমাদের বাংলা মতে ম্যাকুবাবুও বলতে পারো।

আমি বললুম, মাকু বললে হয় না?

–তাও হয়।-লোকটা একগাল হাসল : মাকুদাই বরং বোলো আমাকে। বেশ একটা ভাই ভাই সম্পর্ক হয়ে যাবে। আর জানোই তো–এটা বিশ্বপ্রেমের যুগ।

টেনিদা বললে, নিশ্চয়। এখন চারিদিকেই তো বিশ্বপ্রেম। তা মাকুদা–আপনি কিন্তু  আমাদের প্রাণে বড় ব্যথা দিয়েছেন।

মাকুদা বললে, দিয়েছি নাকি? গট ইন হিম্মেল। কখন দিলুম?

-একটু আগেই। প্যালা গান গাইছিল, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-আপনি ফস করে বলে বসলেন যে, আপনি তার প্রতিবাদ করছেন।

মাকুদা আমাদের পাশে বসে পড়ল এতক্ষণে। তালিমারা ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটা ধরিয়ে নিলে। তারপর বললে, আঁফাঁ তেরিবল। মানে আমি খুব দুঃখিত। মাত্র তিন দিন আগেই আমি জাপান থেকে এসেছি কিনা। সেখানে যে আদর যত্ন পেয়েছি, তার কথা যখনই মনে পড়ছে–তখনই ভাবছি হিরিসুমা কুচিকিদো–অর্থাৎ কিনা,–আহা সে স্বর্গ।

তাই নাকি।

-কী আর বলব তোমাদের। এলোমেলো দাড়িতে-ভর্তি গালটাকে ছুঁলো করে নিয়ে মাকুদা চোঁ করে বিড়িতে একটা টান দিলে : প্রথম যেদিন জাপানে পা দিলুম কাউকে চিনিটিনি না, সবে দুপা পথে বেরিয়েছি, হঠাৎ দুজন লোক আমাকে স্যালুট করে বললে, ইসিকিমা কিচিকিচি?–মানে, তুমি কি বিদেশী? আমি বললুম, উচি উচি–মানে হ্যা হ্যা। লোক দুটো বললে, ওকাকুরা আসাবুরো–মানে আমাদের সঙ্গে এসো।

টেনিদা জানতে চাইল : তারপর?

-তারপর? নিয়ে গেল একটা ফার্স্ট ক্লাস হোটেলে। কত যে কী খাওয়াল সে আর কী বলব। চাউচাউ, ব্যাঙের রোস্ট–আহা, মনে পড়লে এখনও পেটের ভেতর চনচন করে ওঠে। পেট ভরে খাইয়ে-দাইয়ে হাতে দুশো ইয়েন-মানে জাপানী টাকা দিয়ে বললে, দোজিমুরা কাঁচুমাচু–অর্থাৎ কিনা, তোমায় সামান্য কিছু হাত খরচ দিলুম।

টেনিদা বললে, ইস–একবার তো জাপান যেতে হচ্ছে। ওখাবারগুলো এখানকার চীনে হোটেলে পাওয়া যায়-ই-ই-স্!

–যেয়ো। শুধু জাপান? যেই ফ্রান্সে গেছি, অমনি এক ভদ্রলোক বোঁ করে তাঁর মস্ত মোটরটা আমার পাশে থামালেন। বললেন, মঁসিয়ো, ভেনেজাভেক মোয়া।–মানে আমার সঙ্গে আসুন। গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন তাঁর মস্ত বাড়িতে। তারপর কী যত্ন কী খাওয়া-দাওয়া। বললেন, আ তু দো লাং? মানে-ফরাসী দেশ দেখবেন? ক্রজ্যাত ত্র্যা মেশা–মানে আমার গাড়ি করে যত ইচ্ছে ঘুরুন।

আমি বললুম, টেনিদা, ফ্রান্সেও একবার যাওয়া দরকার।

টেনিদা বললে, হুঁ, কাল-পরশুর মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেই হয়। সে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু মাকুদা, বাংলা দেশে এসে

মাকুন্দা শেষ টান মেরে বিড়িটা সামনের একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিলে! উদাস হয়ে বললে, বাংলা দেশ হচ্ছে এক নম্বরের গেফানজেন–মানে অতিশয় বাজে জায়গা। এক কাপ চা তো দূরের কথা–কেউ একটা বিড়ি পর্যন্ত অফার করে না হে। বিদেশী টুরিস্ট–হনোলুলু থেকে আসছি–আমার দিকে একবার কেউ তাকায় না পর্যন্ত। কাল এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম-ট্রামটা কোন্ দিকে যাবে। যেই বলেছি স্যার–তিনি এক লাফে সাত হাত সরে গিয়ে বললেন, হবে না বাবা-মাপ করো। কেন, আমি ভিখিরি নাকি?–মাকুদার চোখ জ্বলতে লাগল : শেম।

আমি আর টেনিদা একসঙ্গে বললুম, শেম–শেম!

মাকুদা তেমনি জ্বলন্ত চোখে বললে, আমি দেশে গিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনী লিখব। পৃথিবীর সব ভাষায় সে বইয়ের অনুবাদ হবে, লাখ লাখ কপি বিক্রি হবে তার। তাতে লেখা থাকবে, বাঙালী অতি নচ্ছার–মানে গেফানজেন, বাংলাদেশ অতি খারাপ–মানে ল্য শা বোতে–মানে ইতিপুরো তাকাহাঁচি মানে

এই পর্যন্ত শুনেই আমাদের বাঙালী রক্তে আগুন ধরে গেল। দেশকে অপমান–জাতির নামে অপবাদ। টেনিদা হঠাৎ গর্জন করে বললে, থামুন দাদা, আর বলতে হবে না। বাঙালীর পরিচয় এখনও পাননি।–প্যালা!

ইয়েস টেনিদা?

পকেটে হাউ মাচ?

–ছটা টাকা আছে। একটা পড়ার বই কিনব ভেবেছিলুম।

–পড়া? পড়া এখন চুলোয় যাক। জাতির সম্মান বিপন্ন দেখতে পাচ্ছিস না? আমার কাছেও একটা পাঁচ টাকার নোট রয়েছে, কাকিমা তেল-সাবান কিনতে দিয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল প্রেস্টিজই যদি যায় কী হবে তেল-সাবান দিয়ে? চল–মাকুদাকে আমরা এনটারটেন করি। সমস্ত বাঙালী জাতির পক্ষ থেকেই।

বইয়ের টাকা দিয়ে মাকুদাকে এনটারটেন করা! বড়দার মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরে একবার আঁকুপাঁকু করে উঠল। কিন্তু দেশ এবং জাতির এই দারুণ দুর্দিনে কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য, কিসের লজ্জা–মানে–আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা, মানুষ আমরা, নহি তো মেষ।

টেনিদা বললে, চলুন মাকুদা–বাঙালীকেও একবার দেখে যান।

কুমড়োর বিচির মতো দাঁত বের করে মাদা বললেন, কোথায় দেখব?

-দি গ্রেট আবার-খাবো রেস্টুরেন্টে।

মাকুদা দেখলেন, ভালোই দেখলেন। চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও, এক প্লেট পুডিং। তারপর দু প্যাকেট ভালো সিগারেট আর তিনটাকা ট্যাক্সি খরচ আমরা ওঁর হাতে তুলে দিলাম। মানে আরও দিতুম, কিন্তু পকেট ততক্ষণে গড়ের মাঠ হয়ে গিয়েছিল।

–এইবার খুশি হয়েছেন মাকুদা?

ট্যাক্সিতে পা দিয়ে মাকুদা বললেন, বিলক্ষণ।

বাঙালীর কথা লিখবেন তো ভালো করে? আমার আর প্যালারামের কথা?

-সব লিখব, যদি আমার বই কেউ ছাপে।-বলে মাকুন্দা ট্যাক্সিওয়ালাকে বললে, বাগবাজার-জলদি।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, আপনার বই ছাপবে না মানে? আপনি একজন ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট

–জীবনে আমি দমদমের ওপারে যাইনি। আমার নাম বেচারাম গড়গড়ি–বাগবাজারে থাকি। বড্ড খিদে পেয়েছিল–তাই–তা, বেড়ে খাইয়েছ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ, টা টা– আমাদের নাকের ওপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *