মহরম পর্ব
উদ্ধার পর্ব
1 of 2

মহরম পর্ব ০৮ প্রবাহ

মাবিয়া পীড়িত; এক্ষণে নিজবলে আর উঠিবার শক্তি নাই। এজিদের মুখ দেখিবেন না প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। দামেস্করাজ্য যাঁহাদের পৈতৃক রাজ্য, তাঁহাদিগকে দিয়া যাইবেন, মনে মনে স্থির করিয়া হাসান-হোসেনকে আনিবার জন্য কাসেদ্ পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহারা এ পর্যন্ত আসিতেছেন না, সেজন্য মহাব্যস্ত ও চিন্তিত। সেই কাসেদের অদৃষ্টে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এ পর্যন্ত কিছুই জানিতে পারেন নাই। প্রধান উজির হামান্‌কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাসান-হোসেনের এত দিন না-আসিবার কারণ কী?”

হামান্ উত্তর করিলেন, “কাসেদ্ যদি নির্বিঘ্নে মদিনায় যাইয়া থাকে, তবে হাসান-হোসেনের না-আসিবার কারণ আমার বুদ্ধিতে আসিতেছে না। আপনার পীড়ার সংবাদ পাইয়া তাঁহারা যে নিশ্চিন্তভাবে রহিয়াছেন, ইহা কখনোই বিশ্বাস্য নহে। আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, কাসেদের কোন অমঙ্গল ঘটিয়া থাকিবে।”

এজিদ্ সেই রাত্রি হইতে আর মাবিয়ার সম্মুখে যাইতেন না। গুপ্তভাবে অর্থাৎ মাবিয়ার দৃষ্টির অগোচরে কোন স্থানে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তাঁহার প্রতিও বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। হামানের সঙ্গে যে কথা কহিতেছেন, তাহাও তিনি তাঁহার নির্দিষ্ট স্থানে থাকিয়া সমুদয় শুনিতেছেন। মাবিয়া ক্ষণকাল পরে আবার মৃদুস্বরে বলিতে লাগিলেন, “এ রাজ্যে মঙ্গলের আর সম্ভাবনা নাই। নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, কাসেদ্ কোন বিপদে পড়িয়াছে; তাঁহারা মদিনায় না থাকিলে অবশ্যই কাসেদ্ ফিরিয়া আসিত। তাহা যাহাই হউক, আমার চিরবিশ্বাসী বহুদর্শী মোস্‌লেমকেই পুনরায় মদিনায় পাঠাও। আর হাসান-হোসেনের নিকট আমার পক্ষ হইতে একখানি প্রার্থনাপত্র লিখিয়া মোস্‌লেমের সঙ্গে দাও। তাহাতে লিখিয়া দিও যে, আমার বাঁচিবার আশা নাই। পাপময় জগৎ পরিত্যাগের পূর্বে আপনাদের উভয় ভ্রাতাকে একবার স্বচক্ষে দেখিতে ইচ্ছা করি। আরো একটি কথা আমি স্থির সঙ্কল্পে মনস্থ করিয়াছি-আপনাদের এই পৈতৃক দামেস্করাজ্য আপনাদিগকে প্রত্যর্পণ করিব, আমার আর রাখিবার সাধ্য নাই। এ কথাও লিখিয়ো যে, আপনাদিগকে এই সিংহাসনে বসিতে দেখিলেই আমার জীবন সার্থক হইবে। হামান! মোস্‌লেমকে বিশেষ সাবধানে মদিনায় পাঠাইও। নানা প্রকারের সন্দেহ আমার মনে উপস্থিত ও উদয় হইয়াছে। (এজিদ্ এই মাত্র শুনিয়া হামানের অদৃশ্যে তথা হইতে অতি ত্রস্তে প্রস্থান করিলেন।) এত গোপনে মোস্‌লেমকে পাঠাইবে যে, তাহার সন্ধান আর একটি প্রাণীও না জানিতে পারে।” হামান বিদায় হইলেন এবং রাজাদেশ প্রতিপালন করিয়া তখনি মোস্‌লেমকে মদিনায় পাঠাইলেন।

ইমামভক্ত মোস্‌লেম ঊর্ধ্বশ্বাসে মদিনাভিমুখে চলিলেন। মোস্‌লেম পাঠকগণের অপরিচিত নহেন। ক্রমে রাজধানী ছাড়িয়া তিনি একটি প্রশস্ত বালুকাময় প্রান্তরের মধ্য দিয়া যাইতেছেন। বালুকাময় ভূমি রৌদ্রের উত্তাপে অগ্নিময় হইয়া মোস্‌লেমর গমনে বিশেষ বাধা দিতেছে। কি করেন শীঘ্র যাইতে হইবে, কোন দিকে লক্ষ্য নাই, অবিশ্রান্ত যাইতেছেন। অনেক স্থলেই ভূমি সমতল নহে, স্থানে স্থানে প্রস্তরকণার ন্যায় স্তূপাকার বালুকারাশি, পরিণামে প্রস্তরে পরিণত হইবে বলিয়া ভূমি হইতে শিরোত্তোলন করিয়া রহিয়াছে। মোস্‌লেম দেখিলেন তাঁহার দণি পার্শ্বস্থ স্তূপাকারের আড়াল হইতে চারিজন অস্ত্রধারী পুরুষ বেগে আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ঐ আক্রমণকারীদিগের মুখ বস্ত্র দ্বারা এরূপে আবৃত যে, তাহাদের স্বরূপ, রূপ ও আকৃতি কিছুই দেখা যাইতেছে না।

মোস্‌লেম জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “তোমরা কে? কেনই বা আমার গমনে বাধা দিতেছ?”

তাহাদের মধ্য হইতে একজন গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিল, “মোস্‌লেম! তোমার সৌভাগ্য যে আজ তুমি কাসেদ্ পদে বরিত হইয়াছ। তাহা না হইলে জিজ্ঞাসা করার অবসর পাইতে না, ‘তোমরা কে?’ এ কথা উচ্চারিত হওয়ার পূর্বেই তোমার শির বালুকায় গড়াগড়ি যাইত, দেহটিও দিব্বি লোহিত রঙ্গে রঞ্জিত হইয়া ধরাশায়ী হইয়া থাকিত। পরিশ্রম করিয়া আর হাঁটিয়া কষ্ট করিতে হইত না। যাহা হউক, যদি কিছুদিন জগতের মুখ দেখিতে চাও, তবে আর এক পদও অগ্রসর হইও না।”

“কেন হইব না? আমি রাজ-কাসেদ্ হজরত মাবিয়ার পীড়ার সংবাদ লইয়া মদিনা শরিফে ইমাম হাসান-হোসেনের নিকট যাইতেছি, কাহার সাধ্য আমার গতি রোধ করে?”

এই বলিয়াই মোস্‌লেম যাইতে অগ্রসর হইলেন। তাহারাও বাধা দিতে লাগিল।

মোস্‌লেম অসি নিষ্কোষিত করিয়া বলিলেন, “কার সাধ্য? কে মোস্‌লেমর পথরোধ করে? গমনে কে বাধা দেয়?” এই বলিয়া মোস্‌লেম চলিলেন; এত দ্রুতবেগে মোস্‌লেমর তরবারি সঞ্চালিত হইতে লাগিল যে, পরিষ্কৃত অসির চাক্চিক্যে সকলের চক্ষে ধাঁধা লাগিয়া গেল, এক পদও আর মোস্‌লেমের দিকে কেহ অগ্রসর হইতে পারিল না।

উহার মধ্য হইতে একজন হঠাৎ মুখের বস্ত্র খুলিয়া বলিতে লাগিল, “মোস্‌লেম তোমার চক্ষু কোথায়?”

মোস্‌লেমের চক্ষু যেমন তাহার মুখের প্রতি পড়িল, অমনি তরবারি হস্ত হইতে নিক্ষেপ করিয়া অভিবাদনপূর্বক করজোড়ে দণ্ডায়মান রহিলেন। এজিদের আদেশে সঙ্গীরা মোস্‌লেমের অঙ্গ হইতে অস্ত্রশস্ত্র কাড়িয়া লইল। মাবিয়ার পত্রখানি এজিদ্ স্বহস্তে খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন, বলিলেন, “যতদিন মাবিয়ার মৃত্যু না হয়, ততদিন তোমাকে বন্দি অবস্থায় নির্জন কারাবাসে থাকিতে হইবে। তুমি তো বড় ঈশ্বরভক্ত, মাবিয়ার মৃত্যু কামনাই তোমার আজ হইতে প্রার্থনার এক প্রধান অঙ্গ করিয়া দিলাম। যাও, ঐ লৌহশৃঙ্খল পরিয়া অনুচরদিগের সহিত মহানন্দে নাচিতে নাচিতে যেখানে উহারা লইয়া যায়, সেখানে গমন কর।”

মোস্‌লেম কিছুই বলিলেন না। দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া যেন কাষ্ঠ-পুত্তলিকার ন্যায় এজিদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনুচরেরা লৌহশৃঙ্খলে মোস্‌লেমর হস্তপদ বন্ধন, শেষে গলদেশে শিকল বাঁধিয়া লইয়া চলিল।-হায় রে স্বার্থ!! এজিদ্ বংশীবাদন করিয়া সঙ্কেত করিবামাত্র একটি বৃহৎ বালুকাস্তূপের পার্শ্ব হইতে এক ব্যক্তি অশ্ব লইয়া উপস্থিত হইল। এজিদ্ অশ্বারোহণে নগরাভিমুখে চলিয়া আসিলেন। চারিজন প্রহরী মোস্‌লেমকে বন্দি করিয়া ঘিরিয়া লইয়া চলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *