৩২. হাত নয় যেন, সাপ

৩২. হাত নয় যেন, সাপ

কখনো কোনও কাক্ষিত আনন্দ কি হঠাৎ বিষাদে পরিণত হতে পারে না? কখন, কার নিষ্ঠুরতায়, কিভাবে, সে আনন্দ যে ধুলোয় লুটায় তা কি কেউ অগ্রিম বলতে পারে? পারলে, পৃথিবীর সব আনন্দই কেন স্থায়ী হয় না? কেন নিশ্চিত হয় না? কখনো কখনো কোনও স্মৃতি কেন হয় আজীবন পরিতাপের? অভিজ্ঞতা হয় অসুন্দর।

বছরে একবার মার সাথে দাদুবাড়ি যেতে হতো শীতের ছুটিতে। দাদুবাড়ি পাবনা ছাড়িয়ে এক গহিন গ্রামে। সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থাটি ছিল খুব দুর্গম। প্রথমে ব্ৰহ্মপুত্র পার হয়ে ট্রেন। ট্রেন থেকে লঞ্চে নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী। সেখান থেকে বাস নিয়ে মাসুন্দিয়ার দাদুবাড়ির ঠিক চার মাইল আগে। বাসটি থামতো। কাঁচা রাস্তা। এই চার মাইল বাস আর যাবে না। বাধ্য হয়ে হাঁটতে হতো গ্রামের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, দীর্ঘ পথ। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ফুটতো ছোট ছোট কাঁটা। কাঁটা টেনে ধরতো জামা, প্যান্ট। আমার তখন হাফ প্যান্ট আর ফ্রক পরার বয়েস। মা কেঁচড় ভর্তি গুড় আর মুড়ি দিয়ে দিতেন। মুঠোভর্তি করে গুড়-মুড়ি খেতে খেতে হাঁটতে থাকতাম বাড়ির দিকে। চার মাইল পথ। মা, কাকা, আর আমরা তিন বোন।

মার মাথার চুল তখনও কালো। দাঁত খুব একটা পড়েনি। মনে পড়ে মা তখন এক তেজী ঘোড়ার মতো। এইতো আরেকটু, এই তো। এই করতে করতে একসময় দেখতাম সত্যিই দাদুবাড়ি পৌঁছে গেছি। দিদিমা, বসে অপেক্ষা করছেন দুপুর থেকে ছোট মাছের চচ্চড়ি, দুধের ক্ষীর, ননী নিয়ে। দাদু, বারান্দায় বসে টাকার বস্তা নিয়ে সুদের হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত। এই পৃথিবীতে কারো জন্যেই তার সময় নেই। দিদিমার জন্যে তো নয়ই। এই দুঃখ দিদিমার সারা জীবনের। এই দুঃখে দিদিমা–নিঃসঙ্গ পেঁচা। হতবাক-হতাশা-হৃদয়। তিন ‘হ’তে আক্রান্ত দিদিমা খুশি হন আমরা গেলে। দাদু আমাদের এসে শুধু একবার দেখে কাজে চলে গেলেন। চার মাইল পথ হাঁটার পর পেটে ভীষণ খিদে। দাদুবাড়িতে পৌঁছেই মনে হলো, ইস্ ভাত খেতে না জানি কত মজা! আজ অনেক ভাত খাবো। সন্ধ্যেবেলাকার ফুরফুরে বাতাস আসছিল বাড়ির চারপাশের গাছ আর দুয়ারের উল্টো দিকে বিশাল বাঁশ বাগান থেকে। মা বাগানটা দেখিয়ে বললেন, তার আড়াই বছর বয়সের সময়, ঠিক ঐখানেই একটা বিশাল বাঘ বসে ছিল। মা, বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে দুয়ারে বসে। সেদিন বাঘ যে কেন মাকে খেলো না আজো তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। বাঘের গল্প শুনতে শুনতে সেই ফুরফুরে হাওয়ায় কুপির আলোতে, বাঘের ভয়ে, দুই পায়ে পা আড়াআড়ি চেপে, তবুও ভাত খেতে বসলাম রান্নাঘরের দুয়ার বরাবর। আমার চোখ-মুখ দেখে দিদিমা বললেন, ভয়ের কিছু নাই, ভাত খাও। ভাত এলো বড় বড় কাঁসার থালায়। এলো কাসার গ্লাসে জল। আর বসার জন্যে পুরু কাঠের পিড়ি যা এমনকি আমি শেরপুরেও দেখিনি।

রাতের বেলায় দিদিমার সাথে শুতে কাঠের পালঙ্কে গেলাম, তিনটে সিঁড়ি বেয়ে। খাটটি জমিদারদের থেকে কেনা। দাদুবাড়ির নতুন কেনা পালঙ্কের গল্প মার মুখে শুনেছি। উঁচু পালঙ্কে শুয়ে এবার মনে হলো, একি! কোন স্বর্গে এলাম! আসলে পালঙ্কটা সেভাবেই গড়া। মেহগনি কাঠে তৈরি খাট। অদ্ভুত হাতের কাজে তার চারটে দেয়াল। কি অপূর্ব জিনিস! জানি না এই পালঙ্কে দাদুর আগে কোনও রাজবাড়ির রাজকন্যা শুয়েছিল কিনা! যেখানে শুয়ে, সে প্রেম করেছিল তার রাজপুত্রের সঙ্গে। সেই পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে দিদিমার কাছে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে শুনি, রাতের বেলায় বেড়ার ওপাশ থেকে আসা শেয়ালের চিৎকার। ভয়ে আমরা জুবুথুবু। দিদিমা গল্প করেই যান, ভূত গান ধরলো। তারপর ভূত কি করলো,কারে ধরলো …। শেয়াল এবার আরো কাছ থেকে ডাকে, বেড়ার গা ঘেঁষে। দিদিমা বলেই চলেন, ভূতের পাঁচ পা! আমরা ভয়ে, বোনেরা সেদিন দিদিমার আরো কাছাকাছি জড়ো হতে থাকি।

তিনদিন পরে যেতে হবে মাসির বাড়ি সন্ন্যাসীবাধায়। এবারও পায়ে হেঁটে চার মাইল। যাবো মাসিকে আনতে। শুধু আমি আর কাকা। মা কোঁচড়ে আবার গুড়-মুড়ি দিলেন। মাসির বাড়ি একেবারেই ধুম পাড়া গাঁয়ে। মানুষ যে কি করে সেখানে বাস করে। যেতে যেতে সেটাই অবাক লাগলো। থাকার মধ্যে ফাঁকে ফোকরে দু’দশটা টিন আর মাটির বাড়ি আর ক্ষেতের পর ক্ষেত। আদিঅন্ত ক্ষেতে, ধান, মটর, ফুলকপি, সর্ষে শাক। চার মাইল হেঁটে মাসির বাড়িতে পৌঁছুলাম যখন, পা দুটো ফুলে ঢোল। মাসির সাথে কতদিন পর দেখা! আদুরে মাসি। নিজেও প্রচণ্ড আদর করলো তার আদুরে ভাগ্নীটিকে। খাওয়া-দাওয়া গল্প শেষে, গেলাম শুতে। মাসির কাঠের চৌকি। চৌকিতে ঘুমোতে গেছি, মাসি, মেসো, আমি। কাকা মাসির গদিঘরে। চৌকিতে একপাশে মাসি, মধ্যেখানে আমি, আর অন্যপাশে মেসো।

মাসি দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তার কোনওদিন বাচ্চা হয়নি, হবেও না। ডাক্তার বলেছে ওর জরায়ু নেই। মেসো, মাসির সঙ্গে অতৃপ্ত জীবন সত্ত্বেও মাসিকে ফেলে দেননি বা দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। আত্মীয়দের অনেকেই তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলেছিল। কিন্তু মেসো কিছুতেই বিয়ে করলো না। সে জন্যে গ্রামসুদ্ধ মানুষ, মেসোর প্রশংসা করে নিজেদের ভাষায় বলতো, সত্যই কি ভালো! -হা সত্যি! নীলু সারাটি জীবনই দিলো পাগলি বৌয়ের জন্যে। অমন সোনার পুরুষ দেবতা কুলেই মেলে। নীলরতনের সুনাম, সমস্ত গ্রাম জুড়ে। আর নীলরতনের জন্যে। ঘরের বৌয়ের কাছে জব্দ হয় অনেক পুরুষ, তাদের কু-অভ্যেসের কারণে।

তখন গভীর রাত। মাসি ঘুমে অচেতন। বাইরে ঝিঁঝি আর শেয়ালের সরব উপস্থিতি, ঘরে কালো কুচকুচে অন্ধকার। আর এই গভীর আকাশ কালো রাতে, আমি ঘুমাতে পারছি না। পারছি না কারণ, কার সঙ্গে যেন আমার যুদ্ধ হচ্ছে। কিসের যেন এক প্রতিযোগিতা অথচ প্রতিযোগীকে আমি দেখতে পারছি না। সে হাত দিয়ে কিছু ধরতে চায়। হাতের সঙ্গে যুদ্ধ করে হাত ফেরাই। মাসির ওপাশ থেকে, মাসিকে ডিঙিয়ে আমার বুকের ওপর দিয়ে হাত হাটে। যতবারই সরিয়ে দিই, হাত সরে না। বরং ফিরে ফিরে বুকের উপর মুঠি পাকিয়ে এলেই হাতটা জাপটে ধরি। ফিরে যায়। আবার ফিরে আসে। হাত দুটো, আমার হাত এড়িয়ে, বুকের ওপর দিয়ে, এঁকেবেঁকে যায়। বুকে বাধা খেয়ে হাত যায় তলপেটে। পেট থেকে যায় আরো গভীরে-নিচে। কি করে একে থামাই! মনে তখন শুধু লজ্জাই নয়, ভয়ও। যদি সবাই জেনে যায়! এবার মেসো শুলো ঘুরে। আমার দিকে আরো এগিয়ে মাথাটি উল্টো করে দিয়ে। ওপাশ থেকে এবার একটা শক্ত লাঠির মতো কি যেন আমাকে তো দেয়। সারারাত যুদ্ধ এবং এমনি যুদ্ধ করে করে না ঘুমিয়ে সকাল হলো। মাসি উঠে দুয়ারে গেল। মেশো আগেই। উঠে গেছে। আমার মন ভীষণ খারাপ।

সকাল হতেই দাদুবাড়ি ফিরে আসার জন্য জেদ ধরলাম। মাসি বললেন, আজ না, কাল যাবি। আমি বলি, না। মেসো দাঁড়িয়ে। ওর দিকে তাকাতে ঘেন্না হচ্ছে। মনে হলো পা থেকে জুতো খুলে মারি! কিন্তু চুপ করেই রইলাম। বলার ভাষা জানা নেই। মাসি দুঃখ করে বলল, আমি না তোর মাসি! কেন যাবি এত তাড়াতাড়ি! মাসিকে আমি তবুও বললাম না, কেন চলে যেতে চাইছি। মেসো একটি টাকা হাতে দিয়ে লোকটি বললো, এই নেও। রাস্তায় তিলে খাজা কিনা খাইও। আমি টাকাটা নিলাম না। অনেক সাধলো। শেষ পর্যন্ত জোর করে খুঁজে দিলো। আমি ফেলে দিলাম। মাসি আমার দুর্ব্যবহারে কাঁদতে শুরু করলো। আমার বুকে টনটনে ব্যথা। আর মুহূর্তও বেশি দেরি না করে রওনা দিলাম। কাকা আর আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। চার মাইল পথ কি সেদিন আমার আর শেষ হয়? যেতে যেতে পায়ে আটকে ধরে ছোট ছোট কাঁটা। আমি কাঁটার সাথে যুদ্ধ করে দাদুবাড়ির দিকে এগোই আর ভাবি গেল রাতের দুঃস্বপ্নের কথা। একটা হাত। হাত নয় যেন, সাপ। এঁকেবেঁকে হাঁটে সমস্ত শরীরে। দাদু বাড়ির আনন্দ, এভাবেই সেদিন বিষাদসিন্ধু হলো।

মাসি সারাজীবনই অসুস্থ। মেসো, তবুও বিয়ে করলো না। যার মাসুল জানি না, আমার মতো গ্রামের কত নাবালিকা-সাবালিকাকে দিতে হয়েছে! আজ ভাবি, ভালো ছেলে নীলরতনের কথা যার ত্যাগে সমস্ত গ্রাম প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি জানি সে কেমন ত্যাগী পুরুষ। বরং সে যদি ফের বিয়ে করতো, সেটাই ভালো ছিল। অনেক অনেক পরে জানলাম, গ্রামের একাধিক ছেলেমেয়ের চেহারা ছিল নাকি অবিকল মেসোর মতো। এবং মেসো সেসব গরিব পরিবারে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য দিতো। নিন্দুকেরা গোপনে বলতো, ওগুলো সব নীলরতনের সন্তান।

আমি জানি, এমন অভিজ্ঞতা আমার একার নয়। নাবালিকা-সাবালিকা, শিশু কিশোর, যুবতী মেয়েরা সবসময়ের জন্যেই, পুরুষদের বিকারের শিকার। নাসিমা, আকলিমা, ইন্দিরা, ললিতা, মিলি, শশী…। ওদের মধ্যে ললিতার বয়স আট বছর, যেদিন ওর এক দূর আত্মীয় ওর প্যান্ট খুলে আঙুল ঢুকিয়েই ক্ষান্ত হলো না। ওকে, ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে ফেললো। এ ধরনের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি আমার উপচে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *