৩১. নির্বোধের অনেক দোষ

৩১. নির্বোধের অনেক দোষ

পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই বাঁচার অধিকার তার নিজস্ব, পৃথিবীর প্রতিটি নারীর স্বাধীনতা তার ব্যক্তিগত। আমি অনুভব করি, আমার অনুভূতিগুলো কোনও রকমেই পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নয়। সোজা কথা এটা জীবনের অভিজ্ঞতা। এর চেয়ে বেশি কিছু কি আর বলার আছে! নারীর শরীরে অভ্যস্ত পুরুষ, নিজেই কি তা বোঝে না? সত্যিই বোঝে না! নারী ছাড়া কি পুরুষ, হয়? বনের পশুও তাড়না বোঝে। নদীর তৃষ্ণা হলে নদী, আকাশ বোঝে। পৃথিবী উত্তপ্ত হলে, পাহাড়ের নির্বাক গাছে বাতাস ফোটে। কামার্ত ঝিনুক পেটে বালির কনা ঘষে সঙ্গম মিটিয়ে তবে–গর্ভে ধরে, মুক্তো। আর নারী-পুরুষের সমান চাহিদা আছে বলেই দুটি হৃদয়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যোনি আর লিঙ্গে ঘটে সঙ্গমের মতো একটা সুন্দর প্রক্রিয়ায়। সেখানে ঠিক সেই মুহূর্তে দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সম্পূর্ণ এক হয়ে, দু’জনেই একই সমতলে, এক সমান হয়ে যায়। মাস্টার অ্যান্ড স্লেইভ, সখিনা আর মনু মিয়ার কামের অনাবিল এই মুহূর্ত, কোনওরকম বিত্ত, মর্যাদা, অবস্থান ও যুক্তিতর্কের বাইরে। স্বর্গসুখতুল্য এই প্রক্রিয়া, এই অনুভব কোনও রকমেই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। এতদসত্বেও নারীর অবস্থান কেন পুরুষের নিচে হবে তা আমাদের মাথায় আসে না। বহুবিবাহ কেন শুধু পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য তাও আমাদের বোধগম্য নয়।

ইসলাম ধর্মে, পুরুষ মাত্রই একই সাথে চার চারজন স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারে। প্রয়োজনে তালাকের বিষয়টি শুধু তিনবার উচ্চারণের এখতিয়ারে পুরুষের জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিন তালাকের খড়গ ব্যবহার করে প্রতিবারই শুধু একজনকে হেঁটে দিয়ে সেই জায়গায় অন্য একজনকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার পর একাধিক নারী সম্ভোগও আইনসিদ্ধ। অনেক মুসলিম দেশ বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ পুণ্যভূমি আরব দেশে তো একেকজন পুরুষ এমনি করে করে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা নারীদেহ আজও ভোগ করে থাকে হেরেম প্রতি পালনের সুবাদে। এবং দুর্ভিক্ষকবলিত আফ্রিকাতেও দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে একেক সংসারে নারীর বাজার। এবং আফ্রিকাতে ইসলাম ধর্মের দ্রুত প্রসারের মূল কারণই ছিল চারটে বিয়ে। ধর্মের জনপ্রিয়তার কারণও তাই। চারটে বিয়ে। আজও, এখনও, আফ্রিকা-আরব। বিত্তে উল্টো কিন্তু নারীদেহ ভোগের প্রশ্নে, এক। ধর্মের জনপ্রিয়তা, যা ভৌগোলিক কারণে ও সংস্কৃতির প্রভাবে সব কন্টিনেন্টে ঠিক এক জনপ্রিয়তা পায়নি। পূর্বে, আমাদের তালুকে ও মুলুকে। পায়নি। তবুও প্রশ্ন থাকে। অনেক প্রশ্নই থাকে। থেকে যায়। নারী তার জৈবিক প্রয়োজনে অন্য পুরুষের সাথে সঙ্গম তো দূরের কথা সামান্যতম আসক্তি প্রকাশ করলেও, অনেক দেশেই ধর্মীয় মতে তাকে জ্বেনার অপরাধে দোররা মেরে হত্যা করা হয় এবং হচ্ছে। এবং রায়ের পর অপরাধিনীকে দু’এক মাসের বেশি সময়ও দেয়া হয় না। ফলে কোনওরকম আপিল বা অন্য কোন ধরনের হস্তক্ষেপের আগেই তাকে চলে যেতে হয় এই প্রিয় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এ ব্যাপারে সরকারি কোর্ট বা ইসলামিক কোর্ট, কারো কথা শোনে না। প্রশ্ন, কেন, নারীর বিরুদ্ধে এই বৈষম্য? পুরুষের লিঙ্গের অবাধ স্বাধীনতামতো কেন নারীর যোনির অনুভূতি ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হবে না বা হয় না। এধরনের সঙ্কট বা ক্রাইসিস কি শুধু পুরুষের বেলাতেই সিদ্ধ আর নারীর বেলাতে হলেই যাবতীয় অশুদ্ধ। এ কেমন ধর্মাচার প্রশ্ন তোলা এবং জানার অধিকার মানুষ মাত্রেরই আছে।

পুরুষের মতো নারীকেও কেন দেয়া হয়নি একসাথে চারজন স্বামী রাখার অধিকার। এবং এই না দেয়ার পেছনে কোনও যুক্তিই যথেষ্ট নয়, যেখানে শরীর একাকি কথা বলার অধিকারী। শরীর যেখানে নির্দেশ করে। শরীর যখন বিদ্রোহ করে। তখন তার সমুচিত জবাব–শুধু শরীর ছাড়া না ধর্ম, না সমাজ, কেউ দিতে পারে কী? যাকে সহজ করে বলা যায় লিঙ্গের উত্তর দিতে পারে একমাত্র লিঙ্গই। পুরুষ যদি নারী চায়, তবে নারীও চাইতে পারে, পুরুষ। তাদের লোভ-লালসা, চাহিদা-ক্ষুধা এক। এবং এই নারী পুরুষই হলো, লিঙ্গ আর যোনি। ব্যক্তি নয় তাদের লিঙ্গ।

নারী কখন অন্য পুরুষের কাছে যায়!

ক. নপুংসক স্বামী : একজন সুস্থ শরীর এবং স্বাভাবিক অনুভূতিসম্পন্ন মেয়ের স্বামী যদি নপুংসক হয়, তখন যদি, তার শরীরে কামাবেগ সঞ্চারিত হলে স্বাভাবিক নিয়মে তা প্রশমিত না হলে নারীটির দৈহিক-মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বছরের পর বছর যদি এই একই অবস্থা চলতে থাকে তখন প্রশ্ন জাগে যৌবনবতী অতৃপ্ত সে মেয়েটির সামনে কোন পথটি থাকবে। সমাজপতিরা বলবেন আত্মসংযমের কথা। তখন ঐ ভণ্ড প্রতারকদের মুখে ঝটা মেরে বলতে ইচ্ছে করে কোন দোষে একটি সুস্থ সবল মেয়ের জীবন যৌবন এভাবে ব্যর্থ হবে? আর ব্যাপারটা যদি উল্টোটা হতো কথার কথা হিসেবে ধরা যাক মেয়েটি কামশীতল কিংবা গর্ভধারণের অনুপযুক্ত তখন সেক্ষেত্রে তারা কি বিধান দিতেন। পুং গর্দভটিকে নিশ্চয় আবার বিয়ে করানোর তোড়জোড়ে মেতে উঠতেন খোদ ছেলে পক্ষের মা-বোনেরা পর্যন্ত। অথচ এখন বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে অতি সহজেই সঠিক নির্ণয় করা সম্ভব সমস্যাটা কোথায় এবং কারণটাই-বা কি। -বোধহীন সমাজে সন্তানের আশায়, যা জেনেশুনে নপুংসক পুরুষকে একাধিক বিয়ে দিয়ে, একাধিক নারীর জীবন ব্যর্থ করার দৃষ্টান্ত কি কিছু কম? যেন সব দোষ নারীর।

নিরীহ মেয়েটাকেই পুরুষপ্রধান সমাজে বলি হতে হয়। এদিকে পূর্ণ সঙ্গম তো দূরের কথা স্বামী নটবরের পুরুষাঙ্গই উত্থান রহিত। দিনের পর দিন রাতের পর রাত অসুখী যুবতী স্ত্রীকে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হয় তোকলজ্জার ভয়ে। মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারে না। বলতেও যে পারে না তাও নয় আসলে সাহস পায় না। তাই বলে মেয়েটির শারীরিক চাহিদার কথা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এই সঙ্গে দাম্পত্য জ্বালা, সন্তান বাসনা, মাতৃত্বের মাধুর্য সবই কি বিসর্জন দিতে হয় একটি মানুষের অক্ষমতার জন্য। সুতরাং সে অবস্থায় মেয়েটি যদি সবাক হয়, আর জাতি ধর্ম নামক যাবতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে কপট নিয়তি নির্ভর না হয়ে তার নিজের নারী জীবনের পূর্ণতা অর্জনে প্রয়াসী হয়; ভিন্ন পথ অবলম্বন করে তাহলে কে

বা কোন সমাজ তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। দেশে দেশে, যুগে যুগে নারীকে নষ্ট করে দেয়ার এরকম কত ঘটনা যে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় তার ইয়ত্তা বোধ নেই।

খ. প্রথম দৃষ্টিতে তাকে ভালো লাগেনি হতেই পারে। ভিন্নরুচির লোক। বিয়ের আগে লোকটিকে হয়তো সে দেখেওনি। প্রথম রাতে দেখেই মনে হলো, কি কুৎসিত! তাহলে এই মেয়েটি কি করবে! যাকে দেখলেই বিশ্রী লাগে এমন একজন পুরুষ সঙ্গীকে তার এই অনুভূতি নিয়ে কি করে তার সঙ্গে সহবাস করবে?

গ. কামুক নারী হতেই পারে তার শারীরিক চাহিদা, পুরুষটির স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি। নারীর চেয়ে এই সমস্যা বেশি অবশ্য পুরুষেরই। কিন্তু এমন নারী আছে যার যৌন চাহিদা ঠিক মিটছে না। তারপরও বছরের পর বছর সে অতৃপ্ত যৌন জীবনযাপন করতে করতে একসময় যদি তার শরীর এবং দেহ মন বিদ্রোহ করে ওঠে তখন কি তার করণীয়। এমতাবস্থায় সে যদি কোনও পর পুরুষের সাথে দেহ মিলনে লিপ্ত হয় তাহলে তার অন্যায়টা কোথায়? স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতির এই প্রয়োজনীয়তায় সাড়া দেয়াটাই কি তার অপরাধ! -ভাত কি কেউ মেপে খায়? যতবড় পেট, যত ক্ষুধা, ভাত, ততখানি লাগে।

মধ্য জীবনের সঙ্কট, বিদ্রোহ বিপ্লব কি শুধু স্বাধীনতা কিংবা নুন-পেঁয়াজ গ্যাসোলিনের দাম কমানোর বেলাতেই প্রযোজ্য?

শরীরী প্রয়োজন কেন বিপ্লব বিদ্রোহের বাইরে থাকবে? শরীরে যখন উত্তাল হরমোন এসে বয়ঃসন্ধিকালের টিনএজ শরীরটিকে টলিয়ে নড়িয়ে দিয়ে যায়, যখন কিশোরদের কচি মুখে গোঁফের হালকা রেখা কিংবা কিশোরীদের শরীরে কচি পেয়ারার মতো স্তনের উদ্দাম ঘটে, তখন এই শারীরিক পরিবর্তন কি প্রকৃতির ন্যায্য বিপ্লব নয়? যৌবনে, যখন নারী-পুরুষ রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় পরস্পর পরস্পরের সাথে, সেটা কি অনুভূতি বদলা-বদলির হার্দিক বিপ্লব নয়? দশ থেকে কুড়ি বছর বিবাহিত জীবনযাপনের পর মন-শরীর-অনুভূতি যখন বিগত কুড়ি বছর থেকে আলাদা হয়ে অন্য অনুভূতির পোশাক গায়ে চড়ায়, অন্যরকম কুড়ি বছরের জন্য তৈরি হয়, তাকে কি আমরা সময়ের বিপ্লব বলবো না!

মানুষ এক বাড়িতে চিরদিন বাস করে না। পোশাক, আহারের রুচি, অভ্যেস সবই পাল্টায়। এটাই নিয়ম। এটাই শাশ্বত। পুরুষ একাধিক নারীর কাছে যেতে রুচিবোধ করে। কিন্তু সমস্যা হলো নারীর মন-শরীর-অনুভূতি নিয়ে। এই ত্রয়ী’ যখন একসঙ্গে বিদ্রোহ করে বসে, সমাজ-ধর্ম এবং সংস্কার, তখন একযোগে বলে ওঠে–সর্বনাশ!

সর্বনাশ হোক আর বিপ্লব হোক একথা মিথ্যা নয় যে মধ্য জীবনের সঙ্কটে আক্রান্ত হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বিবাহিত নারী ও পুরুষ। পশ্চিমে বিবাহ বিচ্ছেদের হার যে পঞ্চাশ শতাংশ, এটিও তার একটি অন্যতম প্রধান প্রমাণ। কিন্তু পূর্বে, যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ –নারী স্বাধীনতা ইত্যাদির বালাই কম, কিংবা নেই বললেই চলে, সেসব দেশে এই সঙ্কটের আবর্তে পড়ে মুক্তচিন্তা বর্জিত অল্প ও অর্ধশিক্ষিত নারীরা কূপমণ্ডুক সমাজে এই বিপ্লব, না বুঝতে পারে, কিংবা বুঝলেও না তার কোনও সঙ্গত জবাব দিতে পারে। ফলে একগাদা সন্তানের জন্ম দিয়ে অকালে জীবন-যৌবন হারিয়ে আমাদের মধ্য বয়সী মা-মাসি-চাচি-মামি তারা নিজেদের অজান্তেই মধ্য জীবনের সঙ্কটে অনিবার্যতায় পড়ে যায়। শতকরা পঞ্চাশ ভাগই অল্প কিংবা বিস্তর মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগে। এই অসুস্থ মা-মাসি-চাচি মিলে আমাদের মেয়েদের জগৎটা আজও উপচে পড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের এই মা-মাসিদের মধ্য বয়েসের নিঃসঙ্গতা-মানসিক কষ্ট-হতাশা-ব্যথা-বেদনা বোঝার মতন আশপাশে কাউকে দেখা যায় না।

অন্যদিক পুরুষের ক্ষেত্রে এই সব সঙ্কটের তেমন কোনও বালাই আছে বলে মনেই হয় না। পুরুষটির কাছে কেউ জানতে চাইবে না কেন তার ঘরে ফিরতে এত রাত হলো। কোথায় গিয়েছিল! কোন কাজে! কেউ অনুসরণও করবে না তার গতিবিধি। কারণ সে পুরুষ। তার জগৎটাই ঘরের সীমানার ঠিক বাইরে থেকে শুরু হয়। আর নারীর বেলায় পুরোপুরি উল্টোটা। তার সীমানা শেষ হয়, যেখানে পুরুষের শুরু।

যে-সব নারী জীবন মধ্যাহ্নের তাড়নায় আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে সেটাকে স্বীকার করে নেয়ার মতো সাহস দেখাতে পারে, সমস্যা সেই সব নারীদের নিয়ে। সে যাবে তার কাছে, যাকে তার ভালো লাগে। সেজন্যে সে সবরকম মিথ্যাচার-অনাচারের মুখোমুখি হতে পারে, পথেঘাটে। যত শ্বাপদসঙ্কুল সাহায্য-সহযোগিতা নিতেও কুণ্ঠিত বোধ করবে না। হোক না কন্টক যেতে হলে সে যাবে। কারণ এই নারী আত্মঘাতী কোনও নারী নয়। এই নারী-সত্য। এই নারীকে আমার স্যালুট। কিন্তু সমাজ এই নারীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তাতে নারীর কি কিছু আসে যায়? যায়। কোনও কোনও বর্বর সমাজে, যায়। এবং ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। ধর্ম আবার সর্বাগ্রে কোণঠাসা করে নারীর অধিকার। অপচয় করে নারীর জীবন। সমাজ যা ধর্মভিত্তিক ধর্ম যা সমাজভিত্তিক দুটোই নারীর চরম শত্রু। এবং ধর্ম, সমাজ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে। মধ্য বয়সের এই সমস্যার কারণ, প্রকৃতি! প্রকৃতির তাড়না। হরমোনের কেমিস্ট্রি। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি। পুরুষ পারে–নারী পারে না। নারী নানান সঙ্কট শরীরে পুষে নিজে নিজে দগ্ধ হয়, পাকানো দড়ির আগুনের মতো ধীরে ধীরে, সে পুড়ে যাবে জানে বলেই, পুড়তে থাকে, নিঃশেষ না হওয়া অবধি।

1 Comment
Collapse Comments

এককথায় বলতে চাই
অসাধারন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *