২৮. স্বামী আসে স্বামী যায়

২৮. স্বামী আসে স্বামী যায়

তখন বয়স আমার বারো বা তেরো। শেরপুরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোববারের হাটের সব দোকান বসে। রবি আর বৃহস্পতিবারে সেখানে ধুম বাজার। বাজারের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল সারিবাধা ছোট ছোট টিনের চালা দেয়া ঘর। এই চালার নিচে দিনের বেলা দোকানপাট, আবার বাজার শেষ হলে রাতের বেলায় এখানে শহরের ফকিরগুলো ওদের বোচকা-বুচকি নিয়ে এসে যার যার নির্দিষ্ট চালার তলায় গিয়ে বসে খুলতো ওদের সারাদিনের সগ্রহ ভাণ্ডার। বোচকার মধ্যেই ওদের তাবৎ সংসার। এর মধ্যে ওদের ছেঁড়া নোংরা পুরোনো গন্ধআলা কাঁথা, পুরোনো কাপড় চোপড়, কারো কারো হয়তো কৃচিৎ একটি ছেঁড়া মশারি। চারপাশে উন্মুক্ত পৃথিবী। আর তার একটুকরো চালার নিচে কুপি জ্বালিয়ে ওরা গল্প করতে করতে বিছানা পাততো। কেউ ধরতো গান। ভিক্ষের ভাগবাটোয়ারা বা জায়গা নিয়ে কেউ নিয়মিত ঝগড়া, এমনকি এই অন্ধকারেও ওরা মাথার উকুন পর্যন্ত বাছতো। কেউ কেউ বাজারের কুড়োনো ঝড়তি-পড়তি জিনিস বেছে, রান্না বসাতো। ওদের সঙ্গে, একটা দুটো করে পাটশোলা, শুকনো পাতা, ভাঙা খড়ির টুকরো আমিও আগুনে দিতাম। ফকিরগুলো এই চালার তলে গান আর ঝগড়ার কলরবে জাগিয়ে দিতো ভিন্ন এক ধরনের জীবন, যা সকালের আলোয় আর দেখা যেতো না। কৌতূহলী আমরা বোনেরা পড়া-শেষে সবাই দল বেঁধে যেতাম এই কলরব শুনতে। যা অন্যরকম, যা নিশ্চিত গোছানো নিরাপদ জীবনের উল্টো। যে জীবন আমাদের নয়।

তবে মধ্যরাতের পর এ জগৎ আলাদা হয়ে যেতো। এই চালার তলায় ফকিরনীদের জগতে শুরু হতো আর একরকমের জীবন। যেন সম্পূর্ণ আলাদা আর এক জগৎ। বৌয়ের বিছানা ফেলে শহরের পুরুষগুলো বের হয়ে ফকিরনীদের কাছে যেত। চালার তলা থেকে নিয়ে ওদের যেতো কখনো বটগাছের তলে, কখনো পুকুরপাড়, কখনো কোনও গলির ভেতরে।

আর এই চালার তলেই, কালু মিয়া আর হাফিজার পাশাপাশি জায়গা। দু’জনেরই মধ্যবয়স। কালু মিয়া একা। হাফিজাও। দিনের বেলায় দু’জনেই ভিক্ষে করে যার যার মতো। রাতের বেলায় ওদের শোবার নির্দিষ্ট জায়গা দুটো ঠিক পাশাপাশি। এক সপ্তাহের মধ্যেই পাশাপাশি শুয়ে থাকা কালু মিয়া আর হাফিজার মধ্যে প্রেম হলো।

একদিন শুনি, ওদের নাকি বিয়ে হয়ে গ্যাছে। পোলাও-মাংস খেয়েছে। খাইয়েছে। নতুন শাড়িও পরেছে। শুনেই গিয়ে দেখি, হাফিজা নতুন লাল শাড়ি পরে কালু মিয়ার মশারির তলায় শুয়ে। ওমা! কখন ওরা স্বামী-স্ত্রী হলো। তার মানে ওদের এক বিছানা। এখন থেকে হাফিজা রান্না করবে আর কালু মিয়া খাবে। এটা-ওটা দিয়ে যত্ন-আত্তি করবে। পায়ের নখ কেটে দেবে। এবং পাঁচ মাসের মধ্যে হাফিজার পেট ফুলে যায়। আট মাসে সে আর হেঁটে ভিক্ষে করতে পারে না। কালু মিয়া যা আনে তাই। পোয়াতি হাফিজাকে কালু আদর করে, বটগাছের তলে বসিয়ে রেখে নিজে.ভিক্ষে করতে যায়। হাফিজা আর হাঁটতেই পারে না। ওর চোখ ভাঙে। চেহারা ভাঙে। শরীর নরম হয়ে ঝুল ঝুলি করে। কয়েকদিন পর চালার তলেই সমস্ত রাত চিৎকার আর দাপড়ানোশেষে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলের নাড়ি কাটা হলো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। নতুন কাপড় পরানো হলো। আমরা দিলাম জামা, খেলনা, কাজল। শখ করে ছেলের নাম রাখা হলো মুহব্বতজান কালু। আমার মনে পড়ে মা। মুহব্বতজানকে কোলে নিয়ে আদর করেছিলেন। দুধ কেনার জন্যে ক’টি টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বাচ্চার দিকে লক্ষ্য রাখিস। জঙ্গলে কিন্তু শিয়াল থাকে।

একদিন, নেই-নেই-নেই। কোথাও নেই। শুনি বাচ্চা আর হাফিজাকে ফেলে কালু মিয়া, চলে গেছে। হাফিজাও জানে না, কোথায়। সে শুধু হাউমাউ করে কাঁদে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বাপকে খোঁজে। সে আর ফিরলো না। কে বললো, দক্ষিণ গ্রামে সে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে আছে। রাবেয়া বললো, সে দক্ষিণ গ্রামেই থাকে। একমাস পর, হাফিজা আর কাঁদলো না। কালু মিয়া গেলে এবার এলো–মইনু মিয়া। চালার তলের জীবনের এমন অনেক গল্পকথা। রূপকথার মতো, স্বামী আছে, স্বামী নেই। স্বামী চলে যায়, স্বামী আসে। এলে দুই-তিন মাস থাকে। খেয়েদেয়ে পেট করে দিয়ে চলে যায়। চলে গেলে মেয়েগুলো গালমন্দ করে বলে আর এ ভুল করবে না। কিন্তু রতির তাড়না এমন যে, নাগর কাছে এলেই ওদের অতীত ভুলতে এক মুহূর্ত সময়ও লাগে না। মেলে দেয় শরীর। ওরা ফের পেট করে দিয়ে ফের গা ঢাকা দেয়। এমন উদাহরণ প্রচুর।

ফকির হোক আর বাদশা–শরীরের তাড়না সবারই এক। মধ্যবয়সে এসে, তাড়না। তুঙ্গে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *