২৫. পরকীয়া

২৫. পরকীয়া

বাইশ বছর আমি প্রবাসে। খোদ নিউইয়র্ক শহরে। বিগ এ্যাপেল সিটির একেবারে হার্ট বরাবর আমার বাসা। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায় যে, প্রবাসের বাংলাদেশিদের জীবনে পরকীয়া, বিলাসিতার বদলে একান্ত প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। পরকীয়া মূলত হয় প্রবাসের একাকিত্ব নিঃসঙ্গতাকে ঘোচাতে। নিঃসঙ্গতা, প্রবাসের একটি লাগোয়া অসুখ। এত সুখ, এত আছে তবুও, নিঃসঙ্গতা। যার সংসার আছে সেও ফিরে ফিরে বেলতলায় যায়, যেতে পারে, যায়ও। যার নেই, তার যাওয়া তো অনিবার্য। পরকীয়া–যা দেশের পরিবেশ থেকে দূরত্ব–প্রবাসের হতাশা আর শূন্যতা থেকে সৃষ্ট অনেক যন্ত্রণাদায়ক, নিঃসঙ্গ যান্ত্রিক জীবনে বেঁচে থাকার বিকল্প ব্যবস্থা। প্রবাসজীবনে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। আলোর গভীরেও লুকিয়ে থাকে অনেক কালো গর্ত। আমরা বলি চাঁদের কলঙ্ক। ”জ্বলজ্বল বা চকচক করলেই সোনা হয় না” চাঁদ, এক পিঠে যার আলো, অন্য পিঠে অন্ধকার! প্রবাসও ঠিক তাই। স্বর্গ-নরক। চিত্ত এবং বিত্তের সুখ বিড়ম্বনা। হাসি-কান্না। জীবন-মৃত্যু। সব–সবই, একসঙ্গে এখানে লঙ্গরখানার খিচুড়ির মতো মিটে যায়। মানুষ খায় গোগ্রাসে।

প্রবাসের জটিল জীবন, অনেক দাম্পত্য জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। বিত্ত আর নিরাপত্তার পাশাপাশি শূন্যতা আর হতাশা। সেই শূন্যতা আর হতাশা থেকে শান্তির সমাধান খুঁজতে প্রবাসে পরকীয়ার যেমন জুড়ি নেই, তেমনি নেই কোনও বিকল্পও। মনে, হৃদয়ে, ঘরে শান্তি না থাকলেও আছে কোথাও না কোথাও! দু’দণ্ড প্রাণ জুড়ানোর জায়গা, আছে! আজকের ব্যতিব্যস্ত নাগরিক জীবনে জীবনানন্দ দাশের মুখোমুখি বসবার মতো, বনলতা সেনদের অভাব, কী? তারা আজ আর শুধু নাটকেই আর সীমাবদ্ধ নেই। সময় কাটাবার জন্য তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। বিকল্প স্বামী-স্ত্রীর অভাব অন্তত প্রবাসে নেই। বিবাহিত নয়, আবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ফেলে দেয়ার মতনও নয়। কেউ দেখছে না। কেউ জানছে না। কারো কারো জানাজানি হলেও কিছু যায় আসে না। প্রবাসে অবাধ স্বাধীনতা। ডলারের অফুরন্ত শক্তি যা সব সামাজিক প্রশ্ন ধুয়েমুছে একাকার করে দিতে পারে। প্রবাসে পরকীয়ার পথ বড় খোলামেলা। পরকীয়া যা সবচেয়ে বেশি হয় মধ্য বয়সী প্রবাসী পুরুষদের বেলায়, যাদের স্ত্রীকে সন্তান নিয়ে দেশে থাকতে হয় কিংবা অপেক্ষায়, গ্রিনকার্ডের। প্রবাসের শ্লোগান–স্বল্পায়ু জীবনটাকেই যদি যথার্থভাবে উপভোগ করা না গেল তাহলে মানুষ জীবনের কোন মানেই থাকে না।

যাদের দেশে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সবই আছে, অথচ নিরুপায় স্বামী বেচারা। তাকে একা একা বছরের পর বছর জীবন সংগ্রাম করে যেতে হয়। নিয়মিত ডলার পাঠাচ্ছে দেশে। খরচা এখানেও কিছু করতে হয়। অনেক সময় এর মধ্যে গড়ে ওঠে দুটো সংসার। যার মধ্যে অবশ্যই একটা পরকীয়া। আর অন্যটা বৈধ স্বত্ব দেশে। যারা রক্ত-মাংসের মানুষ, তারা কি করে আশা করতে পারে যে, নিঃসঙ্গতা আর শারীরিক চাহিদা নিয়ে এই মানুষগুলো ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে শুধু পরিবারের অন্ন জোগাতেই বিদেশ বিভুয়ে নিজেকে নিঃশেষিত করে যাবে! আমার অভিজ্ঞতা বলে–এমতাবস্থায় শতকরা পঞ্চাশভাগ নারী ও পঁচানব্বই জন প্রবাসী পুরুষই অন্যের সঙ্গে একটা স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদেরও ন্যায্য যুক্তি, আমরাও মানুষ, পাথর তো নই। আপনারা কি চান আমরা চরিত্রবান থেকে থেকে হতাশায় শেষ হয়ে যাই? কি মূল্য এই মানবেতর জীবনের। তার চেয়ে কলঙ্কের ছিটেফোঁটা থাকা জীবন ঢের উপভোগ্য। আর আমিও ভাবি, তাইতো! আমি কি চাই না তা বড় নয়, পরকীয়া যাদের জীবনে ঘটছে, যারা নিঃসঙ্গ তাদেরটাই বড় কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সঙ্কট, অধিকাংশ সময়েই যা জীবন মধ্যাহ্নের।

প্রবাসজীবন, একটা ট্রেনের মতো একটা যন্ত্র। ট্রেন যা চলমান এবং একই সাথে অন্যের প্রয়োজনকেও নিজের শরীরে বহন করে চলে। প্রবাস। যেখানে একচুল ক্ষমা নেই, দয়া, মায়া কোনও অজুহাত নেই। এখানে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব থেকে কোনও রকম বিচ্যুতির অবকাশ নেই। তবে দায়িত্ব তারা পালন করলেও পরিবারের কাছে তাদের এই পরকীয়া কোনওরকমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। শুধু পুরুষেরাই-বা কেন জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে? এ তো আর সচল মুদ্রা নয় যে চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিব। তারা কষ্টার্জিত দেশে ডলার পাঠাচ্ছে! ডলার, যার অন্য নাম হতে পারে সোনার কুলুপ, যা মুখে সেঁটে দিলেই, অন্য প্রসঙ্গ চুপ মেরে যায়। তাই ঘরের বৌকে এ ধরনের দুঃসংবাদ জেনেও হজম করতে হয়। তার স্বামী, যদি নিঃসঙ্গতার কারণে অন্য একটি মেয়েকে ঘরেই শুধু নয় বুকেও তুলে নিয়ে দিনাতিপাত করে তাহলে আটলান্টিকের দূরত্বে থেকে তার আর কি-ই-বা করার থাকে? বড়জোর টেলিফোনে কিছুক্ষণ গালমন্দ। খানিকটা কান্নাকাটি। হাত-পা যে সবদিক থেকে বাঁধা। খরচের কি শেষ আছে? স্বামীর চেয়েও বড় প্রয়োজন ডলারের! তাহলে ডলারই কি ওদের স্বামী? হয়তো-বা ফোনে কিছুক্ষণ গায়ের ঝাল মিটিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করে, ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক সময় চুপ হয়ে যায়। এমনকি কান্নাকাটিও আর করে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি ডলার পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ডলার ওদের মুখে সোনার কুলুপ সেঁটে দেয়। বাধ্য হয়েই স্বামীর পরকীয়া হজম করে যেতে হয়।

এই সমস্যা শুধু কি ছেলেদেরই! অনেক প্রবাসী নারীর জীবনেও পরকীয়া ঘটতে পারে। সন্তানতুল্য ছেলের সঙ্গে বয়স্কা মামির প্রেম। গড়ে উঠেছে শারীরিক সম্পর্ক। পরকীয়ার কি কোনও বিপরীতার্থক শব্দ আছে? সুতরাং দেশে থাকা সোনার ফ্রেমে বাধাই করা চরিত্রবান স্বামী ও স্ত্রীদের বলছি, পরকীয়ার কথা শুনে ওদের আজ আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং অভ্যস্ত হলেই স্বস্তি পাওয়া যাবে এবং অভ্যস্ত হওয়াই ভালো। কেননা ওরা শুধু পরিবারের আর অন্ন জোগানোর মানুষ নয়। ওরা পাথরেরও। নয়। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে তাই ওদেরকে পরকীয়ার এই ছাড়টুকু দিতেই হয়। তবে পরিবার এ দেশে আসার আগেই ওরা নিজেকে পরকীয়া–মুক্ত করে ফেলে। সেই অর্থে প্রবাসজীবনটা যেন ম্যাজিক। মুহূর্তেই বদলে ফেলা যায় জীবনের চেহারা। ঝেড়ে ফেলা যায় পরকীয়া। যেন কিছুই হয়নি। কিছুই ছিল না। বেলা–মতিন, শাহীন, নিতু ওরা যেন ধুলো-বালি। স্রেফ হাত-পা ঝেড়ে নিলেই হয়। কিন্তু চাইলে কি সবকিছু এত সহজে মুছে ফেলা যায়? যেমন অনেক সময় পরকীয়ায় অভ্যস্ত, ওরা চাইলেও, দু’জন দু’জনকে ভুলতে পারে না। পারে না কারণ ওরাও তো রক্তমাংসেরই মানুষ। অনুভূতি আর দাম্পত্য এক নয়। এই যে এতকাল বৌ ছিল না বলে দশ বছর একসঙ্গে এক ঘরে, এক বিছানায় কাটিয়ে দিলো রীতি আর মাসুম। মাসুমের স্ত্রী দেশ থেকে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কি এই দশ বছর জলে ভেসে যাবে? দৈবাৎ কি এতই সহসা!

বিয়ের বাইরের সম্পর্কের নাম শুধু পরকীয়া নয়। আসল পরকীয়া সঠিক অর্থে অবৈধ প্রণয়। বিয়ে করা স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি যে মমতা বন্ধন পরকীয়া মমতা কখনো কখনো আরও অনেক বেশি গাঢ় এবং গম্ভীর হতে পারে। যেহেতু সেখানে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা থেকে প্রেম আরো আকর্ষণীয় ও গম্ভীর হতে পারে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু শেষ হলেও, শেষ হয় না চার অক্ষরের ভালোবাসা। ফলে অনেক দোটানার সংসারেই নেমে আসে ধস। পরকীয়া হোক আর যাই হোক এই যে সোনার কুলুপ, এই ডলার, পাওয়ার, এই পুঁজিবাদ অনেক রকম তেলেসমাতি দেখানোর ক্ষমতা রাখে। এমনকি, দূরে বসে সবরকম কুকীর্তিও। যা অর্থনৈতিক বন্ধন, স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনকেও ছাড়িয়ে যায়। বৈধর চেয়েও অবৈধের টান প্রবল। অর্থ, বিত্ত, বিবাহ সামাজিকতাকে তুচ্ছ করে, পরকীয়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *