২৪. পরকীয়াবিহীন বিবাহ ক্লান্তিকর

২৪. পরকীয়াবিহীন বিবাহ ক্লান্তিকর

ক.

২০ এপ্রিল, ওয়াশিংটন পোস্ট, ২০০১।

চীনে, বিবাহিতের সহবাস সম্পর্কে প্রথাসিদ্ধ ধারণা ও নীতিবোধ বিষয়ে সামাজিক সমীক্ষার একটি সংবাদ বেরিয়েছে।

লিন্ডা হান, ২৮ বছরের এক চীনা যুবতী, তিনি একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে কর্মরত। উদ্যমী, উন্নতিকামী–এই নারী চান মনের মতো একটি বিবাহ যদিও তার রয়েছে মধ্য বয়স্ক বিবাহিত এক প্রেমিক। যাকে প্রচলিতভাবে লোকে বলে–পরকীয়া। বলেছেন, মরে গেলেও তার পক্ষে পরকীয়া ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আবার এরই মাঝে নতুন স্বামীও তার চাই। এই হলো–একালের প্রেম, প্রীতি, প্রণয় ও ভালোবাসার স্বরূপ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শ্রীমতী হান একা নন বরং মেয়েরা যতদিন সম্ভব আজকাল অনূঢ়া থাকতে চান কিন্তু সঙ্গীহীন শয্যায় অবশ্যই নয়। রিপোর্টে আরো বলা হয়–”পরকীয়াবিহীন বিবাহ ক্লান্তিকর।”

বিবাহ এবং বিবাহ সম্পর্কিত চীনা গবেষণা কেন্দ্র এবং যুগপৎ নিখিল চীন মহিলা সংঘেরও নারী সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থার উপাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত চেন শিনশিন বলেছেন, মেয়েদের কত অংশ এবং কী, জাতীয় জনপদ ও নগরীতে এইভাবে দ্বিচারী সুখভোগের ভাবনা জন্মাচ্ছে তা এখনও ঠিক বলা না গেলেও অস্বীকার করার নয় যে

“পরকীয়াকামী মহিলার সংখ্যা
লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চীনে আর্থিকভাবে প্রতিটি সমর্থ পুরুষ প্রাচীন সংস্কার অনুযায়ী কনকুবাইন’ অর্থাৎ রক্ষিতা রাখতে অভ্যস্ত ছিল। যে বিপ্লব ক্যুনিজমের মাধ্যমেও উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই।

লিন্ডা হানের মতো মেয়েরা যারা দেঙ জিয়াও পেং-এর নতুন অর্থনীতির বিপ্লবে গত দু’দশক ধরে চীনের শহরাঞ্চল বিশেষ করে প্রধান প্রধান শহর যেখানে জীবিকার সম্ভাবনা, সেসব অঞ্চলের চেহারা দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। জনপদ কর্মস্থল, মনমানসিকতা, বৃত্তিপথ ও নারী-পুরুষ সম্পর্ক। এটা মাওয়ের কালের অববাহিকা থেকে ভিন্ন, যেখানে পার্টি নিযুক্ত নৈতিক প্রহরীর হুইসিল বা বাঁশি অনুযায়ী ছেলে ও মেয়েদের জীবন বাধা থাকতো একটি সুনির্দিষ্ট ছন্দ-লয় ও গতিতে। প্রহরের প্রতিটি কিবা দিবা কিবা রাত্রি।

আর দেঙ-এর অববাহিকায় লিন্ডা হানের মতো কর্মজীবী মেয়েরা আধুনিকতার হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছেন এমন জায়গায়, যেখানে তারা খোলাখুলি বলছেন দ্বিধারা জীবনের কথা।

শুধু পুঁজিবাদ নয় বিশ্বায়নের এই যুগে পশ্চিমি খোলামেলা জীবন আজ চীনেও প্রবেশ করেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। এবং মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে ছেলেদের মতো মেয়েদেরও এমন বাসনা জন্মাবে এতে আশ্চর্যের কী আছে?

আধুনিক চীনে গত দু’দশকে দ্রুত গড়ে-ওঠা এই নগরকেন্দ্রিক জীবন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রায় সবদেশেই গড়ে উঠেছে। এর বিবিধ কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটিই হলো সবচেয়ে প্রধান।

বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে নারী ও পুরুষের দ্বিবিধ ধারার জীবন সম্পর্কে নতুন করে জানানোর কিছু নেই। তবে একটি কথা পরিষ্কার যে দ্বিধারা জীবন সেসব দেশেই অধিক স্বাভাবিক ও সাবলীল যেসব দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি রয়েছে। তার মানে এই নয় যে অনুন্নত বা দরিদ্র দেশে দ্বিধারা জীবন নেই বা থাকতে নেই। আছে। বেশ জীবন্ত এবং বেশ জোরালো দাবি নিয়েই আছে, তবে এই দ্বিধারা জীবনের প্রকৃত রূপ, রুচি, প্রক্রিয়া ধনী বা উন্নত দেশের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। দেঙ জিয়াও পেঙ-এর নব্য অর্থনীতির আন্দোলনে আধুনিক চীনের চেহারা ভিন্ন। দরিদ্র আর অনুন্নত চীনেও আজ অঘোষিত পুঁজিবাদ, পশ্চিমি বিশ্বায়নের মওকামাফিক। ফলে মাওয়ের পর, চীনের প্রায় চল্লিশ ভাগ বাজার আজ বিশ্বের জন্যে উন্মুক্ত। ফলে গ্রাম ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে নগরকেন্দ্রিক এ নগরভিক্তিক জীবন যেমন বাড়ছে তেমনই বাড়ছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে যৌন স্বাধীনতার বিষয়টাও। তাহলে মানুষের বৈবাহিক জীবনের পাশাপাশি পরকীয়া জীবনের প্রয়োজনীয়তা কি সেই একই অর্থে ব্যবহার করা যাবে না? অর্থাৎ–

অর্থ+যৌনজীবন = বিবাহ+পরকীয়া জীবন।

.

খ.

চীনের মতো নগরকেন্দ্রিক জীবন, অনুন্নত এবং জনসংখ্যার অভিশম্পাতে জর্জরিত আরেকটি দেশ, যা চীন থেকে তেমন দূরে নয়, যে দেশের যে শহরটির কথা না। লিখলেই নয় সেই দেশটি, সেই শহরটি হলো, বাংলাদেশ এবং তার রাজধানী ঢাকা শহর।

গ্রামভিত্তিক, গ্রাম প্রধান মূলত কৃষিনির্ভর এই দেশ। আর কলকাতার চেয়েও প্রাচীন এবং শিল্পকলা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশের এই ঐতিহাসিক শহরটির আয়তন মোট চার থেকে বেড়ে দশ মাইল ছাড়িয়ে গেলেও, জীবিকার অন্বেষণে গ্রামাঞ্চল থেকে ছুটে আসা বিশেষ করে দীন-দরিদ্র মানুষদের পরিসংখ্যানের সাথে মিলিয়ে বাড়তে পারছে না মোটেও। তাই বাংলাদেশের রাজধানী, এই শহরটি জনসংখ্যায় উপচে পড়ছে শুধু নয়, বরং প্রতিদিনই তা বাড়ছ। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর জনসংখ্যার হিসেবে মেগাসিটির পর্যায়ে পৌঁছতে আর সামান্য বাকি। কুড়ি বছর আগে চার মাইলজুড়ে ছিল কুড়ি লক্ষ মানুষ। আজ দশ মাইলজুড়ে রয়েছে প্রায় কোটির ওপর। জনসংখ্যা, শহরের আয়তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শতকরা একশভাগ বেশিই বেড়েছে। কেন বাড়ছে? কি কারণে বাড়ছে? এতটুকু শহরে এই উপচে পড়া মানুষগুলো কারা? এর কি কোনও উত্তর নেই?

প্রথমেই ধরা যাক শ্রমিক শ্রেণীর কথা। দরিদ্র শ্ৰেণী। এমনকি চীন বা ভারতেও বাংলাদেশের মানুষদের মতো এত সুবোধ বিকল্প কোনও শহর নেই, যেখানে তারা খেটে বেশি না হোক অন্তত জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে থাকবে। স্রেফ আলুসিদ্ধ আর কাঁচা লঙ্কা গালে দিয়ে দু’মুঠো ভাত। কোথাও না হোক রাজধানীতে। গ্রামে কাজ নেই। যা আছে থাকলেও, তা পছন্দের নয়। যেমন ক্ষেতের কাজ। লাঙল চালানো। হাল চাষ। ধানের রোয়া বোনা। এসব কাজ সর্বস্তরের বুভুক্ষুদের ঠিক পছন্দসই হয় না। সুতরাং ক্ষেতের কাজের জন্যে কৃষক পাওয়া বাংলাদেশে দুঃসাধ্য। আর এই মন্দাভাব চলছে বহু বছর ধরে। এবং গ্রামগঞ্জ থেকে অত্যন্ত সাধারণ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলো, যাদের প্রায় সবারই বিশাল পরিবার আছে তবুও গ্রামের এই একঘেয়ে ক্ষেতের কাজ হালচাষ–তাদের কাছে তেমন সুবিধের লাগে না। আর লাগলেও ঠিক মনমতো হয় না বলে তাদের গন্তব্য হয় রাজধানী শহর ঢাকায়। এমনকি কুলি-শ্রমিক বা মজুরশ্রেণী তারাও আর গ্রামে থাকতে চায় না। কারণ, রাজধানীর জীবনের অমোঘ আকর্ষণ তাদেরকে টানে। কারণ নগরজীবন। নগর দর্শন। শহুরে জীবন। যে জীবনে যথেষ্ট কষ্ট থাকলেও পাশাপাশি প্রচুর আনন্দ ভাণ্ডারও রয়েছে তার অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে। গ্রামগঞ্জের এই আপাত নিরীহ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলো ক্রমে তাই ঢাকাকেই বেছে নেয় তাদের জীবিকার অন্বেষণে। জীবিকা ও জীবন যা পাশাপাশি হাত ধরে চলাফেরা করে।

সুতরাং ঢাকার এই দুর্বিষহ যানজটে বলতে পারেন, বলতেই পারেন এই রিকশাওয়ালাগুলো সব জ্বালিয়ে খেলো! শালারা সব কোত্থেকে আসে? কেন আসে? সবাই আসে ক্ষুধার তাড়নায়। ভাগ্য ফেরাবার আশায়। শহরের অলীক কল্প-কাহিনী শুনে। ঢাকার হাওয়ায় নাকি টাকা ওড়াউড়ি। শুধু ধরতে জানা চাই।

ঢাকা শহরের ডাকনাম রিকশা সিটি। বর্তমানে সেখানে রিকশার সংখ্যা লক্ষকেও ছাড়িয়ে গেছে। একেক সময় রিকশা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। মনে হয় শহরটি রিকশাতে রিকশাতে উপচে পড়ছে। জনসংখ্যার পাশাপাশি যেন ভেঙেও পড়ছে। এবং জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাওয়া, মাথা মোটা এই রিবশাওয়ালাগুলো যাদেরকে আমরা সাক্ষাৎ উৎপাত বা উপদ্রব মনে করে না হয় দশটা গালিগালাজ করি। হ্যাঁ, এরাই কিন্তু গ্রামগঞ্জ থেকে আসা দীন-দরিদ্র। যে মানুষ গ্রামে তাদের সম্পূর্ণ পরিবার-পরিজন রেখে ঢাকায় চলে আসে শহরের মোহ আর আপাত চাকচিক্যের আকর্ষণে, তার প্রাথমিক বিভ্রান্তি কেটে গেলেই ওরা রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি বা দিনমজুরে কাজে নেমে গিয়ে অনিবার্যভাবেই বস্তিবাসী হয়ে পড়ে। এদেরই একটা অংশ লেগে যায় এপার্টমেন্ট তৈরির ও যোগালির কাজে। রিকশা সিটি নামের অলঙ্করণের সখে ঢাকা শহরের আরেকটি নাম হতে পারে এপার্টমেন্ট সিটি। যার মানে নিম্ন, মধ্য, উচ্চবিত্তদের আবাসন। এটাও এক ধরনের ব্যবসা। চলতি বাংলায় যাকে বলা হয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। খুবই লাভজনক এবং সময়োপযোগী। এ ব্যবসার মধ্যে জমির মালিক, ডেভেলপার আর প্রোমোটাররা জড়িত থাকে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভূমিকা। মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যেও নানা রকম শ্রেণী বিভাগ থাকে। ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারিত হয় আয়তন, অবস্থান ও পরিবেশের ওপর। এবং এই নিম্নবিত্ত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলোর কিছু অংশ যারা রিকশা চালাবে না চলে যায় ইট ভাঙা, সিমেন্ট মেশানোর কাজে। যার কোনওটাই মেধা নয়। পুরোটাই কায়িক।

রিকশা, বেবি ট্যাক্সি, টেম্পো চালক, নির্মাণ কর্মী এই বিভিন্ন ও বিচিত্র পেশার দীন-দরিদ্র শুধু কায়িক পরিশ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো সত্য। এদেরকে অস্বীকারের উপায় নেই। সংখ্যায় এরা কয়েক লক্ষ। এবং শুধু এই একটুখানি শহর যার কোণায় কোণায় উপচে পড়ে তোক এমনকি যার শ্বাস ফেলার জায়গাটুকুতেও মানুষের উপচে পড়া ভিড়, এই শহরটিতে মানুষ কি করে কে জানে! বা কেমন করে কি এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্রিয়াবলে তা সত্ত্বেও খুঁজে পায় তাদের জীবিকা, আর মাথা গোঁজার জন্য ঢাকার মুক্ত ফুটপাত বা বস্তি সিটি নামে খ্যাত এই শহরের বস্তি আবাসনে এক চিলতে মাটি। পাবেই। আর সেই প্রত্যাশায় প্রতিদিন আরও মানুষ গ্রাম ছাড়ছে গড়ে দিনে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার। তারা জানে এলেই হয় রিকশা, না হয় নির্মাণ।

যথারীতি শহরের ভিড় আরও বাড়ে। আরো রিকশা, আরও ট্যাক্সি, আরও নতুন নতুন বিল্ডিং। শহর তার আয়তনে না বাড়ক মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা বাড়ে। তাই পরিবার-পরিজন গ্রামে রেখে শুধু তাদের শরীরটা নিয়ে মেধাহীন পুরুষগুলো এভাবেই ‘একা’ এই শহরে চলে আসে। এখানে ওদের বিচিত্র জীবন। কঠিন ও করুণ জীবন। মানবেতর দুঃসহ জীবন। যে জীবন কোনও জীবনই নয়। কিন্তু তবুও যারা একবার এই নগর জীবনের স্বাদ পায় সেই যে ওরা একবার একা একা গ্রাম ছাড়লো আর সহজে ফেরে না। কেউ কেউ বছরে একবার যে যায় না তাও নয়। কখনো যায় না।

সর্বত্রই ওদের মানবেতর জীবন। বস্তিতে ঘুমটুকু বাদে সারাদিন রোদ-বৃষ্টিতে নেয়ে-ঘেমে কায়িক শ্রম শুধু। আমি ওদের বিচিত্র জীবনের গল্প শুনি। মাসে গড়ে ওদের আয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কিছুটা তারা দেশে পাঠায়। বাকিটা নিজের জীবিকা নির্বাহ। ওদের বয়স পনেরো থেকে পঞ্চাশ।

এই কয়েক লক্ষ মানুষ যারা নিম্ন মধ্যবিত্তরও ঠিক নয়, বলা যায় বিত্তের শ্রেণী –বিন্যাসে যাদের কোনও ক্লাস নেই অর্থাৎ এই নো-ক্লাস বা ধরা যাক সিক্সথ ক্লাসের এই শ্ৰেণীহীন মানুষগুলো যাদের পরিবার দূরে–তাই বলে যাদের শরীর মরে যায়নি, যাদের রতি-কাম-কামনা সম্পূর্ণ জীবন্ত–এই নগরজীবনে সমস্ত দিন ধরে যন্ত্রের সঙ্গে জীবন ঘষা শেষ হলে রাতের অন্ধকারে তারা বছরের পর বছর কি উপোস থাকতে পারে? সম্ভব? ওরা সংখ্যায় কয়েক লক্ষ। বয়স ওদের পনের থেকে পঞ্চাশ। জীবন, যৌবনে ভরা। দিনের শেষে ক্লান্ত দেহ। হাতে কিছু টাকা। নিঃসঙ্গ তবে কামার্ত শরীর। সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কেউ নেই বাধা দেয়ার। সমাজ নেই বলে সামাজিকতার ভয় নেই। কে দেখলো! কেউ দেখলো, বৌ-ছেলে-মেয়ে…। কেউ? নেই-নেই কেউ নেই, দেখার। বাধা দেয়ার। অপরাধবোধের কোনও বালাই নেই। পাপ-পুণ্য নেই। ধর্ম অধর্ম নেই। বেঁচে থাকা, হ্যাঁ, স্রেফ বেঁচে থাকা। ন্যূনতম বেঁচে থাকতে যতটুকু যেটুকু মানসিক কিংবা মানবিক যা নিতান্তই না হলে চলে না, চলবে না। কতটুকুই-বা জীবন ওদের? এত অমানবিক পরিশ্রমের পর একটি রিকশা বা টেম্পো বা হাড়ভাঙা পরিশ্রমী দিনমজুরের আয়ুই–বা কত? পনের বছর টানা খাটুনির পর সে ভেঙে যায়। শরীর বসে যায়। আর পারে না। এই মাত্ৰ-এইটকুই না জীবন ওদের। যাদের কোনও বাবুগিরি নেই। আছে শুধু বাবুদর্শন। বাবুরা যাদের গাড়িতে বসে। যারা বাবু টানে।

এই কয়েক লক্ষ পুরুষ, যাদের অধিকাংশেরই দিন শুরু হয় ন’টার বদলে সকাল ছ’টায়, চেয়ার-টেবিলে বসে নয় যারা দুই পা কচলে রিকশার চাকায় ঢেলে দেয় তাদের দেহের সমস্ত শক্তি, ঘামতে ঘামতে ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত পরিশ্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হলেও যারা অভিযোগ বা দুঃখ’ এই বর্ণ বা এই ভাষা কোনও উচ্চারণেই যারা বলতে জানে না! জানে না, কারণ তারা অনভ্যস্ত এবং অনভ্যস্ত বলেই নির্বিকার। এবং মেধাহীন বলে নির্বিকার হতে হতে সব অমানবিকতায় অভ্যস্ত এবং বোধহীন, যারা কাজের শেষে সাজানো-গোছানো লিভিং রুমে না ঢুকে ফুটপাতের আবর্জনার সামনে বসে শরীরের বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ করতে করতে গল্প করে আর বিড়ি টানে অন্যদের সঙ্গে। যারা ফ্যানের নিচে শুয়ে রাতের সংবাদ শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর মেলে দিতে পারে না। স্ত্রীর করুণা ও স্নেহের করতলে বা গভীর রাতে শান্তি খুঁজে পেতে নেই বিশাল বক্ষ জুড়ে এক জোড়া স্তন, যেখানে মুখ খুঁজে পড়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়। নেই একখানা গরম ভাত বেড়ে অপেক্ষারত স্নেহময়ী মা কিংবা আদরের ছোট মেয়েটি। ওদের কি আছে? কোন ছাই! কিছু কি আদৌ আছে?

তাই দিনের শেষে ওরা কোথায় ফিরবে? সোজা–নোংরা আবর্জনাভরা বস্তি? সেতো অনিবার্য। ওদের ফেরার দ্বিতীয় জায়গা কোথায়? ওদের স্ত্রী নেই, ঘর নেই, গরম ভাত নেই। তাই ওদের স্থির করতে হয় ফেরার জায়গা। কেননা আর কিছু না থাক, ওদের মন তো আছে! মন থাকলে অনুভূতি আছে। আর অনুভূতি যা এমন সঙ্কটে সবচেয়ে আগে সাড়া দেয় তার দুর্বল জায়গাগুলো। আর এই একাকিত্ব–এই ক্লান্তিতে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা যেখানে মুহূর্তেই খুঁজে পাওয়া যায় অপার আনন্দ, তা ব্যক্তির যৌন আনন্দ। একটি কমনীয় নারী শরীর। তার সঙ্গে, তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা পারস্পরিক বিনোদন। এবং এই আনন্দ সন্ধানে বা অন্য কোনও সুখানুভূতির মধ্যে যা সবচেয়ে আদিম–এইসব পুরুষ এইসব রিকশাওয়ালা বা ইটভাঙা মানুষেরা রক্ত জল করা হাতে সীমিত পয়সা নিয়ে ছুটে যায় পতিতালয়ে কিংবা ভাসমান যেখানে তার প্রবৃত্তিকে প্রসন্নিত করতে পারবে সহজেই। এবং ওদের সংখ্যা কোনমতেই হাজারে নয়।

সে নিজেই ভাসমান। সুতরাং সে ভাসছে সবচেয়ে সহজলভ্য শিল্প, পতিতা পল্লীতে। ভাসমান পতিতারাও আছে। ওরা হাতের নয় শুধু। ওরা নখেরও নাগালে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই ওরা বস্তির আশপাশে এসে ভিড় জমায়। ওরা জানে এবং চেনে কারা ওদের খদ্দের। একঝাক রঙিন পায়রার মতো। বিচিত্র রঙিন পোশাকে ওরা মুখে গাঢ় মেকাপ মেরে ব্যাগে রাখা কনডম নিয়ে প্রতীক্ষা করে বুভুক্ষুদের। অপেক্ষায়, যারা কামার্ত। অস্বাভাবিক যৌনাচারেও তাদের আপত্তি নেই। তাদের প্রয়োজন ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ। একেকটা বস্তি একেকটা অপরাধের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু এই বস্তিবাসীরা এত শিক্ষিত নয় এসব সাফিস্টিকেটেড শব্দ বোঝার মতো। ওরা জানে আনন্দ। নির্মল আনন্দ। জানে, নারী দেহটি দলিত-মথিত করে উপচে পড়া ভাসমান পতিতার দ্রুত এবং সংক্ষেপ এবং অল্প খরচ। আর তাই রাতের অন্ধকারে কামার্ত পুরুষগুলো ছোটে। যে যেখানে যেভাবে পারে, একটু জায়গা করে নেয় আর কোনও রকমে দুই পা বিযুক্ত করে কিছুক্ষণ যৌন আনন্দশেষে স্থলন। ব্যাস্ ভাসমান বা চাইলে পতিতাপল্লী। যেখানে সময় ও আনন্দ দুটোই বেশি। তাই খরচও বেশি। আর রাজধানীর এই কয়েক লক্ষ নো-ক্লাস বা সিক্সথ ক্লাস যারা দিনমজুর, দীন-দরিদ্র হতভাগ্য রিকশা বা বেবি ট্যাক্সিচালক যারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে, তারা মানুষ কিন্তু তারা স্রোতের বাইরের মানুষ। তারা পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, সমাজ-সংস্কারমুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই তারা সরল, সাবলীল জীবনে বিশ্বাসী। তারা খেটে খায়। ফুর্তি করে তাদের ক্রাইসিস অনুযায়ী। যায় মন যেখানে যে জাহান্নামে যেতে চায়। নিজের ভালোমন্দে ওদের ভ্রুক্ষেপ কম। ভাসমান-পতিতাপল্লী, গেস্ট হাউজ, কিংবা কয়েকজন মিলে একজন ভাড়া করে কোথাও গিয়ে–কিন্তু সবই পকেটের রেস্ত বুঝে।

উপসংহারে বলা যেতে পারে–এই কয়েক লক্ষ স্বল্পায়ু শ্ৰেণীহীন হতদরিদ্র মানুষ, ওদের নেই কোনও সেক্স ইনস্পেকটর। রাজধানীতে এই কয়েক লক্ষ স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ যৌনজীবনের ক্ষেত্রে বলতে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। ওদের ক্রাইসিস অন্য দশজনের মতো। শুধু পার্থক্য এই যে, ওরা যৌনজীবনে এত বেশি স্বাধীন ও মুক্ত যে, কামের এই বসন্ত উৎসবে ওরা রাঙিয়ে মাতিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। ওরা স্বল্পায়ু। অমানবিক এবং অসম্ভব কায়িক পরিশ্রম, অযত্ন, অপুষ্টি, বিভিন্ন অসুখ, অবিচার, অবাধ ও অধিক যৌন অত্যাচার ও রোগব্যাধি ইত্যাদিশেষে ওরা দ্রুত আর সংক্ষেপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *