২৩. বয়স পঁয়ত্রিশ

২৩. বয়স পঁয়ত্রিশ

বিভিন্ন যাচিত আয়োজনে বোঝার আগেই হৈ-চৈ করে ফুরিয়ে যায়, শৈশব-কৈশোর যৌবন। সর্বত্রই বসন্তের বিচিত্র রঙ। মালার মতো অফুরন্ত আনন্দ কত স্বপ্ন, কত আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে ওঠে কৈশোর থেকে। নেই, কোন দুঃখ বলে এখানে কিছু নেই। থাকলেও তার অনুভূতি নেই। নতুন রুপোর টাকার মতো চকচকে মন। দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের আলো সেই মন জুড়ে। উঠতি বয়সের স্বাভাবিক সাবলীল আনন্দ, প্রেরণা, উৎসাহ আর মনোবল, বর্তমানের যে-কোনও হতাশা আর দুঃখের তিমিরে জ্বেলে দিতে পারে আলো।

কাম্য অতিথি বা পছন্দের ইষ্টিকুটুমের মতো জীবনের অর্ধেক সময় অর্থাৎ প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর এসে চলে যায় সই-সাই যথেষ্ট দর্শন বাক্যালাপ বা ভোজনরস না তৃপ্তি বা হাস্যরসে পরিতৃপ্ত হওয়ার আগেই চলে যায়। দেখতে না দেখতে না জানতেই বুঝতে পারার আগেই এসে চলে যায় জীবনের প্রথম পঁয়ত্রিশ বসন্ত উন্মত্ততায়, রঙে রসে এতই পরিপূর্ণ যে শূন্যতা, একাকিত্ব হতাশা বলে জীবনের এই অর্ধেক অভিধানে কোনও শব্দ খুঁজে পাবার নয়। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় এই সময়গুলোতে কেউ একা নয়। অন্যেরা তাকে ঘিরে, সে অন্যকে ঘিরে ব্যস্ত। মুহূর্ত সময় নেই জীবনের কতত অকারণ, অহেতুক, অস্থায়ী, অপ্রয়োজনকে প্রাণবন্ত করে তুলে বাস্তবে রূপ দিতে জেনেও এর সবকিছুই ক্ষুদ্র! সব মিছে! একদিন সব শেষ হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। নিশ্চিহ্ন। সুখী হতে মানুষ মিছিমিছি কত ব্যস্ত থাকে। সুখকে ঘিরে মানুষ কত ব্যস্ত।

প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর সখের অভিযানের এই যাত্রায় ধাপে ধাপে মানুষ খুঁজে পায় চিরাচরিত কত বিধিবদ্ধ সুন্দর! সুন্দর নিজেকে ঘিরে, সুন্দর অন্যকে ঘিরে।

সুখের শুরুতেই প্রথমে মানুষ খুঁজে পায় শরীরের অনুভূতি, যখন শরীর জুড়ে নামে কৈশোর। সুখানুভূতি, রতি, কামের অনুভূতি। শরীরে বিভিন্ন চাক্ষুষ পরিবর্তন। আর

জীবন গঠনের প্রক্রিয়ায় চলে লেখাপড়া। কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিতেই এই। চলমান প্রক্রিয়া গভীরতর রূপ নেয়, যার শেকড় বিদীর্ণ করে যায় জীবনের উর্বর আর গভীর পরিপূর্ণ মাটি। যৌবন এগিয়ে যেতে যেতে ছেলেদের মাঝ কুড়ি আর মেয়েদের কুড়ির শুরুতে জীবন তার গতি পাল্টায়। পাল্টাবেই। বিবাহ বন্ধন। অর্থাৎ প্রজাপতয়ে নমঃ। শুরু হলো সংসার। সং’ সর্বস্বতাই যার মূল চরিত্র। সং-সাজা। সব-সং, সংসার।

জীবনের প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই যে অভিমান এর প্রাপ্তি সংসার-সন্তান ও স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পত্তি।

আর এই পঁয়ত্রিশ বছরের সমূহ অর্জন যা এলো হেসেখেলে পূর্ণিমার উঠতি চাঁদের মতো আলেকিত জ্যোৎস্নায়, অসম্ভব তৃপ্ততায় জীবন যখন ভরা বরষার পূর্ণ নদী-গভীর ভালোবাসা। ভালোবাসা ছড়িয়ে-ভরিয়ে থাকে সহসা সর্বত্রই, এই কি সব? এইটুকু সত্য? এই কি সেই প্রদীপশিখা, যার তলায় জমাট বাঁধে সমান অন্ধকার?

এই অর্জন যার সমান নিকটে বাজে বিসর্জনের বাদ্যি-বাজনা। এই পঁয়ত্রিশ, এখানেই শেষ। এই অর্জনের উল্টোটারও শুরু এখানেই। যত সন্তান-সংসার, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, সব সবকিছুর মূল উপলব্ধি, এখানেই।

নতুন করে অর্জনের আর কি থাকে? তাই নতুন করে সুখী হওয়ার আর কি আছে, চলে সেই সন্ধান। হাতড়ে, হাতড়ে এখান থেকে যা পাওয়া যাবে তা হতাশা, শূন্যতা আর একাকিত্ব, নতুন করে অর্জনের কিছু নেই। এরপর কিছু অর্জনের মানে–পুনরাবৃত্তি বৈ কিছু নয়। সুতরাং নতুন কোনও সুখের রঙ এখানে লাগবে না।

পঁয়ত্রিশের পর, পুনরাবৃত্তি কখনো সমান সুখ দেবে না। সময়, উদয়ের বদলে অস্তমিত হয়। বয়স অর্জনের বদলে কমতে থাকে।

এবং এই করে করে পঁয়তাল্লিশে পা দিয়ে মানুষ জীবনের এমন একটা অন্ধকার সময়ে পৌঁছায় যখন সে নিজেই নিজের জন্যে একটা বোঝা। নিজের কাছে একটা দায়িত্ব। পথ হারানো মানুষ সে। একজন অপ্রকাশিত লুকিয়ে থাকা মানসিক রোগী। অর্জনের কিছু নেই, শুধু বিসর্জনের প্রস্তুতি। বিসর্জন, যা কখনো সুখের নয়। বিদায় কখনো হাসির মুক্ত-ঝরিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার পথ আলোকিত করে না। দুঃসময়, ভীষণ দুঃসময়, নতুন করে পাওয়ার, জীবনদর্শনের, সুখী হওয়ার সব, সব শেষ। জীবনের এই এমন একটা সময় যখন মানুষ দিনের অধিকাংশ সময়–অসুখী। প্রথম পঁয়ত্রিশ থেকে প্রথম পঁয়তাল্লিশের –ঠিক উল্টো মনমানসিকতা, অনুভূতির শুরু এখানেই। পঁয়তাল্লিশের পর বাকি জীবনটুকুতে অর্থহীনতা থাকে। এর পুরোটাই অপব্যবহার। মানুষ এই অপব্যবহারে অভ্যস্ত হতে থাকে,-যা দিনদিন বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে গভীর থেকে আরও গভীরে যায়। হয়তো আমরা তা বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝলেও পরোয়া করি না। হয়তো-বা এর কারণ সময়, যা পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না, তাই এর অপব্যবহারও এতটা তীব্র বলে বোধ হয় না।

এরপর! নিজেকে দিয়ে কি করা! খাওয়ানো, ঘুমোনো, ঘুম থেকে ওঠানো, ব্যায়াম, নাতি-নাতনি, বিত্তের তদারকি, সমান পুনরাবৃত্তি! পুনরাবৃত্তি ছাড়া কোনও ব্যতিক্রম সম্ভব কী? যদি না হয় তবে, নিজের জীবন কি একটা সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হয় না যখন প্রতিটি মানুষ নিজের কাছে নিজে একটা অঘোষিত অপদার্থ এবং মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ!

বাকি সবকিছুতেই ফিরে যাওয়া যায়। দেশ গ্রাম, বাবা-মা, স্বামী, ছোটবেলাকার স্কুল, উল্টো সাঁতার কাটা সেই ছেলেবেলার পুষ্করিণী। শুধু ফেরা যায় না বয়সে। যা, অতীত তা অতীত। যা গ্যাছে তা গ্যাছে। খরচ হয়ে গ্যাছে।

ছেচল্লিশ থেকে চৌষট্টিতে সম্ভব। কিন্তু চৌষট্টি থেকে ছেচল্লিশে আর কখনোই সম্ভব নয়। সাঁইত্রিশ থেকে তেয়াত্তর সম্ভব। চুয়ান্ন থেকে চল্লিশ, অসম্ভব।

মানুষ তার জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রথম পঁয়ত্রিশ থেকে প্রথম চল্লিশ পর্যন্ত। এরপরের জীবন প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত। নিজেকে খুঁজে না পাওয়া দুষ্কর জীবন। অর্থহীনতায় পরিপূর্ণ। নিঃসন্দেহে পঁয়তাল্লিশের পরের বাকি জীবন যত দীর্ঘ হয় মানুষ ততই নিজেকে আবিষ্কার করে, অপচয়। আর এই অপচয় এই ক্ষয়ে পড়া আমরা যারা মানুষ, তারা শুধু তার

–ধারক –

–বাহক –

–সেবক -।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *