২১. নীলাঞ্জনা মেয়েটি

২১. নীলাঞ্জনা মেয়েটি

শনিবারের রাত। উইক এন্ডের পার্টি নাইট। ম্যানহাটানের ইটালিয়ান বারে পলাশ যে টেবিলটায় বসে, ঠিক তার উল্টোদিকেই, সুনয়না এক শ্বেতাঙ্গিনী মদের গ্লাসটা ডান হাতের তিন আঙুলে ধরে হালকা সিপ দিতে দিতে ওর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। পাশেই হাতের চামড়ায় আঁকা লাল-কালো জোড়া ঘোড়ার টাটু! স্লিভলেস কালো গেঞ্জি পরা ঘাড় অবধি কালো চুলের তরঙ্গ। স্বাস্থ্যবান এই সাদা পুরুষটি মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড, নাকি শুধু বারের ক্ষণকালীন কোম্পানি, পলাশ তা নিশ্চিত নয়। তবে খুব ভালো লাগছে মেয়েটির তাকানোর ভঙ্গিটি। সুন্দরী আর কাকে বলে। এককথায়, অপূর্ব। গলার দু’পাশে কলার বোন দুটো তীরের মতো খাড়া। চিবুকের মাঝখানে গাঢ় তিল। গালে টোল। কালো স্কিনটাইট গেঞ্জির ভেতর দিয়ে হাতের মুঠির মাপে সুডোল একজোড়া স্তনের উঁকিঝুঁকি। জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জির মাঝখানে ছ’আঙুল মাপের মেদবিহীন সমতল নাভিমূল। মেনিকিওরড হাতের আঙুলে দু’রঙের নেইল পলিশ দিয়ে ডিজাইন করা নোখ। ক্ষীণ কটিদেশ। কাম জাগানো ভারি নিতম্ব আর পাকা কামরাঙার মতো রসালো পুরু দুটো ঠোঁট। সব মিলিয়ে তন্বী মেয়েটির তত শরীরে যাদুকরী সৌন্দর্য। এত সুন্দরী মেয়ের তো পুরুষের অভাব হওয়ার কথা নয়। টেবিলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রায় সবাই এই গভীর নীল চোখের নীলাঞ্জনার দিকে একটু হলেও আড়চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু সোনালি চুলের এই নীলাঞ্জনা কেন শুধু তার দিকেই তাকিয়ে মুচকি হাসছে! আবারো! হ্যাঁ, সে আবারো দু’বার তিনবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো! পলাশ মদের গ্লাস হাতে, একা বসে। সেও তাকিয়ে দেখছে, নীলাঞ্জনা মেয়েটির মতিগতি। এইতো আবার সে তাকালো! আড় চোখে, না তেরচা চোখে বোঝার উপায় নেই।

সমস্ত দিন ক্যাব চালিয়ে শরীর ক্লান্ত হলেও শুধু রোববার রাতেই সে বারে মদ খেতে আসে। কোনওদিন দল বেঁধে। কোনও দিন একা। আজ রাতে সে একা। বারে। এসে মদ খেতে আড্ডা দিতে ভালো লাগে। লাইট আর ওয়েস্টার্ন মিউজিকের এ্যাফেক্টে মন চাঙ্গা মচমচে মুড়ির মতো হয়ে যায়। মনে হয়, গান আর মদের এই। পৃথিবীটাই আলাদা। বলা চলে, ক্ষণিকের বেহেশত। প্রবাসের নিঃসঙ্গতা ভোলার বেহেশত। এ বেহেশত দেশে যেতে না পারায় রিতা এবং ছোট দুটো মেয়ের বেদনাবিধুর আর্তনাদের বাইরের বেহেশত। এ বেহেশত রুমনোকে ভুলে যাবার …।

ম্যারেড ব্যাচেলর, জেনুইন ব্যাচেলর, উইন্ডো ব্যাচেলর, সব ধরনের বাংলাদেশি ক্যাবি ব্যাচেলর, বন্ধুগুলোর সাথে বারে উইক এন্ডে বসে প্রবাসী পলাশেরা আড্ডা দেয়। সারা সপ্তাহ ওরা নিজের শরীরের চামড়া পিটিয়ে, হাড্ডি মাংস খুইয়ে পরিবারের দায়িত্ব পালন করে। দেশে প্রায় সবারই পরিবার আছে। পরিবার থাকলে স্বপ্ন আছে। ওরা পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে এ দেশে থাকে। বাবার জন্যে কমোডসহ দালান বাড়ি। দশ বিঘে বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে অতিরিক্ত আরো বিঘে দশেক কেনা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে যৌতুকের রসদ জোগানো। জামাইয়ের জন্যে লার্জ স্ক্রিন টিভি, ডিভিডি, রোলেক্স ঘড়ি। বেকার দুটো ভাইয়ের বিয়ে। ওরা অর্থাৎ পলাশ নামের এই তরুণ যুবকগুলো পরিবারের স্বপ্ন পুরো করতে স্টুডেন্ট ভিসা, ভিজিটর ভিসা, বিজনেস ভিসা, ডিপ্লোমেট ভিসা ইত্যাদি নিয়ে নিউইয়র্কের এই মেট্রোপলিটন শহরে এসে অধিকাংশই ইল্লিগ্যাল, লিগ্যাল ক্যাব ড্রাইভার কিংবা নির্মাণ কর্মী ইত্যাদি হতে বাধ্য হয়। ওদের পাঠানো অর্থ দিয়ে পরিবারের অবস্থা ভালো হয়। দেশে আর কোনও অভাব-অভিযোগ থাকে না। তবে চাহিদাটা স্থায়ী। পলাশ এবং ওরা দেশে বাবা-মা ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তান-বন্ধু-আত্মীয় পরিচিতদের এই অন্তহীন চাওয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে, আটকে গেছে হলুদ রঙের ট্যাক্সিগুলোর ড্রাইভার সিটে। দূর থেকে যাত্রীরা হাত দেখিয়ে বলে ট্যাক্সি! পলাশ এবং ওরা প্রতিদিন বারো ঘণ্টা মিডটাউনে ওদের ডাকে সাড়া দিয়ে এভাবেই কাটিয়ে দেয়। যতবার যাত্রী বদলায়, ততবার টিপস। দিনশেষে খাইখরচা বাদে থাকে দেড় থেকে দুশো ডলার। অর্থাৎ ষাট দিয়ে গুণ দিলে দিনে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। এমন বেহেশত কি বেহেশতেও আছে? শাহীন বলে, না। পলাশ এবং ওরা মোল্লাদের খোতবার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে বলে, বেহেশত যদি কোথাও থাকে তাহলে সেটা আছে আমেরিকাতেই।

পলাশ বিবাহিত। দেশে আছে দুই মেয়ে এবং স্ত্রী। এক ভাই, তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে। তিন বোন তাদের স্বামী এবং ছেলেমেয়েরা, গ্রামের বাড়ি ভোলা, বরিশাল। নদী-নালার শহর। পলাশের বাবা রিটায়ার্ড পোস্টাল ক্লার্ক। মা ধর্মভীরু গৃহিণী।

পলাশ এসেছিল লায়ন্স ক্লাবের মেম্বার হিসেবে কনভেনশনে যোগ দিতে। দেশে অনার্সসহ বি.এসসি পাস করে দর্জির কাজ কিংবা কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের অ-আ শেখাতে সে রাজি হলো না বলে বাবা অসন্তুষ্ট। তিনি বললেন একটা কিছু করে টাকা তো আনতে হবে! বাচ্চা পড়াতে দোষ কী? বাচ্চা তো বাচ্চা। ওরা তো কাঁদবেই। পলাশ সেসব কিছুই করবে না। রাগ করে বাবা একদিন বললেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। বেকার হারামজাদা। যে অবধি কাজ করে টাকা আয় না করতে পারবি তদ্দিন। বাড়ির কথা ভুলেও মনে করবি না। এরপর পলাশ প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলে একলোক তাকে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে ভিসার খবর দিলো। দু’লক্ষ টাকা হলে আমেরিকার ভিসা পাওয়া যাবে। পলাশ বাড়ি ফিরে বাবা-মা-স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললো দু’লক্ষ টাকার কথা।

পলাশ এবং তার পরিবার জানে পলাশ আমেরিকাতে গিয়ে ইল্লিগ্যাল হয়ে যাবে এবং অন্য আরো অনেকের মতো আর হয়তো দেশে নাও ফিরতে পারে। জেনেশুনেই পলাশকে প্লেনে তুলে দিলো ভিসার জন্যে নগদ দু’লক্ষ টাকায় জমি বিক্রি করে। সে নিউইয়র্কে এসে উঠলো এক বন্ধুর বাড়িতে।

পলাশ, ওর বন্ধুর ওখানে থাকা অবস্থাতে প্রায় দু’মাস পর ব্রুকলিনের একটা বাংলাদেশি গ্রোসারি স্টোরে কাজ পেলো। মিট কাটারের চাকরি। গরুর বিশাল দেহ কাটা ওর কাজ নয়। দু’চারদিন পরই সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকরি খুঁজে নিলো। এভাবেই সে গ্রোসারি স্টোর, নির্মাণ, রেস্তরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ পরিবর্তন করতে থাকলো। কোনওটাই ওর ভালো লাগছে না। ইতোমধ্যেই নিউইয়র্কের অনেক বাংলাদেশির সাথে পরিচয় হলো। অধিকাংশই বললো ট্যাক্সি চালানোর কথা। চালাবে কি করে! ওর তো লাইসেন্স নেই! পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে ভুয়া আন্তর্জাতিক লাইসেন্স আনিয়ে সে গেল ওয়াশিংটনে। সেখানে দু’শ ডলার দিলে কুড়িটি গত্যাধা আররি প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় মোটর ভেহিকল ডিপার্টমেন্টে। নিজেকে আররি ভাষাভাষী বলে পরিচয় দিয়ে, সেগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করলো। তারপর ভুয়া গ্রিনকার্ড হলো। ধরা পড়লে জেল। পলাশ ফেইক গ্রিনকার্ডটি তোশকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, যদি কখনো কাজে লাগে। এতসব ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আজ পার্টি, কাল বিয়ের দাওয়াত, পরশু সোসাইটির মিটিং এই করে এরই মধ্যে পলাশের অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়। নিঃসঙ্গতা কাটাতে উইকএন্ডে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করতে করতে হঠাৎ করে একদিন বন্ধুত্ব হয়ে গেল রুমনোর সঙ্গে।

রুমনো ওরফে রুমা, বাংলাদেশের মেয়ে। ডিভোর্সি। একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে সেলস গার্লের চাকরি করে। রুমনো স্মার্ট, সুন্দরী। মজিদ সাহেবের বিয়ের পার্টিতে রুমনো যেচে এসে পলাশের হাতে একটা পেপার প্লেট দিয়ে বললো”খাবেন না? সবাই খাচ্ছে!” পলাশ নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ এত সুন্দরী চকমকে একটা মেয়ে এসে খেতে বলছে! আসলে পলাশ তখন দেশে ওর স্ত্রী রিনার কথা ভাবছিল। চোখে দু’ফোঁটা জল। মুছতে না পেরে গিলে খেল। ”নিন, ধরুন। ঐ যে কত সব খাবার পড়ে আছে। কি ভাবছেন এত!” বলে রুমনো পলাশের প্লেটটা নিয়ে চোখ দিয়ে বড়শির মতো ওকে টেনে নিয়ে গেল। কি খাবেন বলুন!’ পলাশ অবাক হয়ে মেয়েটার স্বতঃস্ফূর্ততা আর স্মার্টনেস দেখে। ‘কি নাম আপনার?’ ‘পলাশ। পলাশ রায়হান।’ ‘বৌ ছেলেমেয়ে!’ পলাশ ঢোক গিলে হঠাৎ কি ভাবলো। তাৎক্ষণিক উত্তরে বললো, ‘নেই। কেউই নেই।‘ রুমনো মুচকি হেসে খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে বললো, ”যাবার আগে একবার দেখা করে যাবেন, কেমন!”

রূপের কি বাহার কি মাদকতা মেয়েটির সমস্ত শরীর আর চেহারায়! কত কমনীয় সে! কে সে!”ওহ ভুলেই গেছি। পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম রুমনো। এই নিন আমার কার্ড।” বলে, মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। কার্ডটা হাতে নিয়ে পলাশ খাবার প্লেট হাতে বাড়ির কোণায় গিয়ে বসলো, একা। রিনার মুখটা আর মনে এলো না। অপরূপা সুন্দরী, রহস্যময়ী, স্মার্ট রুমনো নামের এই মেয়েটিকে ভালো করে জানতে হবে। কার্ডটা প্যান্টের পকেটে ভালো করে ঢুকিয়ে রেখে তাকিয়ে রইলো ভিড়ের মধ্যে। রুমনো বেশ ক’বার তাকালো ওর দিকে।

রাত গম্ভীর হলো। বিয়ের পার্টিতে রুমনোকে সে শুধু আরেকবার দেখছিল খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে। কি এতো তাড়াহুড়ো করে চলে এলেন কেন! কার্ডটা দিয়ে কোথায় উধাও হলেন। কত খুঁজলাম! পরদিন ঘুম থেকে উঠেই পলাশ রুমনোকে ফোন করলো। সারারাত সে ছটফট করেছিল এই সকালটুকুর জন্যে।

–ব্যাগ খুলে দেখি চাবি নেই। ভাবলাম, ঘরের দরজায় হয়তো ভুলে ফেলে এসেছি। সর্বনাশ! ভেবে, ভয়ে ছুট দিলাম। কিন্তু কি জানেন! পরে দেখি চাবিটা ব্যাগেই পড়েছিল। হাউ সিলি! থাক, অন্য কথা বলি। গতকাল আপনাকে দেখলাম খুব একা একা। স্ত্রী বাচ্চা নেই বললেন, কিন্তু বান্ধবী! রুমনো পলাশকে সুধোয়।

–বন্ধু আছে। কিন্তু বান্ধবী নেই। আপনার!

–সবই আছে। আবার কেউ-ই নেই। একা। খুব একা। কাউকে ভালোলাগে না। স্বামী ছিল। মনের মতো কোনদিনই মেলেনি, মিশ খায়নি। তাই ডিভোর্স হয়ে গেছে।

পলাশের হার্ট ডাব লাব ডাব ডাব করতে শুরু করলো। একদিন আসুন আমার গরিবালয়ে। খুব খারাপ অবস্থা। এলে বসতে দিতে পারবো।

–বেশ ভালো। ঠিকানা দিন। টেলিফোন নম্বর?

–সত্যিই আসবেন!

–‘বাহ! না আসার কি আছে। বললে কাজশেষে আজ বিকেলেই আসতে পারি। কাজের পর কি করছেন? আমি ফ্রি।’ পলাশ চমকে উঠলো। প্রস্তুতির অভাব ছিল মনে। চট করে বলতে পারলো না। বললো ‘কাল আসুন। আসবেন?’ মনে মনে ভাবলো একদিন সময় হাতে থাকা ভালো। একটু ভাবা যাবে। একটা অপরিচিত সুন্দরী মেয়েকে চট করে এভাবে আসতে বলাটা যে রিস্কি, অন্তত সে ভাবনার সময়টুকু পাওয়া যাবে। মন না চাইলে মানাও করে দেয়া যাবে। মুহূর্তের জন্যে ভাবলো সে। ওকে, কাল আসবো। ঠিকানাটা লিখে নিচ্ছি বলুন।

–রুমনো ফরিদপুরের মেয়ে। এখানে একটা এপার্টমেন্টে একজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে। সিটির চাকরি করে। স্বামী কলকাতায় গিয়ে ডিভোর্সের পর সে আবার বিয়ে করেছে। রুমনো আমেরিকায় চলে আসে সমীর বাবুর সাথে ডিভোর্সের পর। রুমনো আলট্রা মডার্ন। কিন্তু সমীর চ্যাটার্জি ঠিক তার উল্টোটা। ভারিক্কি আর আধ্যাত্মিক ধরনের পুরুষ। মন মেজাজে রক্ষণশীল। তাই বিয়ে ভেঙে গেল মাত্র তিন বছরের মাথায়। এ দেশে রুমনোকে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেও সে প্রত্যেকটি প্রস্তাবই নাকচ করে দিয়ে বলেছে ভালো আছি। স্বাধীন জীবন। নাক গলাবার কেউ নেই। তাই বিয়ের কথা বললেই হো-হো করে হাসে এই দারুণ অহঙ্কারী মেয়েটি। কিন্তু পলাশের এক ডাকেই সে চলে গেল পরদিন সোজা ওর এপার্টমেন্টে। কেন! ভেবে নিজেও সে অবাক হয়।

–আসুন। গরিবের ছোট ঘর। মনে কিছু নেবেন না কিন্তু।

–এতো আদিখ্যেতার কোনও দরকার নেই। আমারটা দেখলে নিজেরটাকে গরিব বলবেন না। বলতে বলতে রুমনো পলাশের ঘরে ঢুকলো। পলাশের মনে হলো সে যেন নির্ঘাত স্বর্গ থেকে আসা এক অপ্সরী। দু’জনে ড্রয়িং রুমে বসে গল্প বলতে শুরু করলো।

–চা খাবেন?

–আপনি! খাবেন! চা খাবেন!

–খাবো, বসুন। বানিয়ে আনছি।

–আপনি বসুন। আমি বানিয়ে আনছি। বলুন টি ব্যাগ কোথায়! চিনি! দুধ!

–দেখিয়েই যদি দিতে হয় তার চেয়ে বরং নিজে তৈরি করাই কি ভালো নয়। হাসতে হাসতে পলাশ বললো, আবহাওয়াটা একটু হালকা করতে।

একসময় দুজন দুজনের জীবনের গল্পে মেতে উঠলো। সেই দিনের পর থেকে নিঃসঙ্গ দু’জনের মধ্যে দ্রুত গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব একদিন ভালোবাসায় রূপ না নিয়ে পারলো না। তিন মাস পর রুমনো পলাশের সঙ্গে একই এপার্টমেন্টে মুভ করলো। তারপর থেকে ওরা একসাথে এক এপার্টমেন্টে স্বামী-স্ত্রী জীবন যাপন শুরু করে। এমনি করে পলাশ, রিনার কথা ভুলেই যায়।

–আবার বিয়ের কথা কখনো ভাবিনি। যদি চাও তাহলে নতুন করে ভাববো পলাশ!

–কি দরকার রুমনো! এমনিই ভালো আছি। তুমিই বলেছ। নাক গলাবার কেউ নেই! ফ্রি! বিয়ে হলেই বলবো এটা করো। ওটা করো। এখন তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো। তখন পারবে না।

–পলাশ তুমি তো অবিবাহিত। কোনওদিন হয়তো পালিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই তোমার বিয়ের ইচ্ছেটা মরে যায়নি। বললো রুমনো।

–‘বলেছি তো পালিয়ে যাবো না। হলো তো!’ রুমনোর মাঝে মাঝেই ভয় হয়। ভয় হয় পলাশ একদিন সত্যি সত্যি চলে যাবে। তাই এরকম প্রায়ই সে পলাশকে হুট করে কথায় কথায় বিয়ের কথা বলে ফেলে, প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়ে লজ্জা পায়। কিন্তু ওর গোপন ইচ্ছেটা কিছুতেই মন থেকে যায় না। পলাশকে ও প্রাণ থেকে ভালোবাসে। শিশুর মতো।

পলাশ বিবাহিত, রুমনো সেকথা জানে না। কিছুদিন পর পলাশ এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছে রিনার কথা। বাচ্চাদের কথা। রুমনোর কারণে তাকে লুকিয়ে ফোন করতে হয়। রুমনো, শুনলে কষ্ট পাবে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে! রিনা ওর স্ত্রী। রুমনো তাহলে, কে! বান্ধবী! এই বন্ধুত্ব কি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চেয়েও গভীর নয়! দু’জন একসাথে থাকছে। স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। শরীর খারাপ লাগলে স্ত্রীর কোমলতা দিয়ে শিয়রে বসে রুমনো রাত জাগে। এই সম্পর্ক কি মেকি? ভাবতে ভাবতে পলাশ এসে ধড়াস্ করে শুয়ে পড়লো চারপেগ নির্জলা হুইস্কি খেয়ে।

এমনি করেই আরো দু’বছর পার হয়ে যায়। রুমনো যদি চলে যায়! তার চেয়ে বরং ওকে বলাটাই ভালো নয় কি! রুমনোকে সে ছেড়ে থাকতে পারবে না। রিনাকে সে কি দোষে ডিভোর্স দেবে! বরং রুমনোকে সব কথা খুলে বলবে। বলবে, রুমনো–কে সে রিনার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। নিশ্চয়ই সে তা বুঝবে।

–কি ভাবছো! চোখে জল কেন! এ কি, পলাশ!

–তোমাকে একটা কথা বলা প্রয়োজন।

–বলো। হাতে চায়ের কাপটা কেঁপে উঠলো। ‘বলো, কি বলবে?’

–বলছি। চলো ভেতরের ঘরে গিয়ে বসি।

–রুমনো, আমার অপরাধ নিও না। আর পারছি না, না বলে থাকতে। তোমার মতো সুন্দর মনের মানুষ আমি জীবনে কাউকেই দেখিনি। তোমার মতো ভালোও কাউকে দেখিনি। লোকে তোমাকে ভুল বুঝে, বুঝুক। আমি কিন্তু জানি, তুমি ভালো। খুব ভালো।

–রুমনো আমি বিবাহিত। দেশে আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে আছে। রুমনো পলাশের কথার কোনও উত্তর দিলো না।

–কি কিছু বলছে না যে! রুমনো! কিছু বলো! বলো আমি নষ্ট! খারাপ।

–‘কি বলবো বল। সবই ঠিক আছে।’ বলেই রুমনো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

সেই রাতেই মিডটাউনের ক্রসিংয়ে বিরাট এক গাড়ি এক্সিডেন্টে রুমনো মাতাল অবস্থায় মারা গেল। ওর মৃত্যু নিয়ে পত্রপত্রিকায় হৈ-চৈ। পুলিশ এসে পলাশকে মর্গে নিয়ে গেল। দেহ সনাক্ত দাহন ইত্যাদি সব পলাশই করেছিল। দাহনের আগে বিয়ের কাজটুকু ফিউনারেল হোমেই পলাশ মন্দির থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে এনে সম্পন্ন করলো। ওকে শাখা সিঁদুর পরিয়ে দিলো। রুমনো হিন্দু, পলাশ নয়। কিন্তু ওর কাছে বিয়েটা ভীষণ জরুরি মনে হলো। রুমনোর ইচ্ছা ছিল পলাশের স্ত্রী হওয়ার। এই ইচ্ছে সে অপূর্ণ রাখবে না। কিছুতেই না। হলই-বা বিয়েটা এক মৃতের সঙ্গে। তবুও সে, তার। রুমনোর মৃত্যু ওকে শূন্য করে দিয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণ করতেই বারে যাতায়াত। তারপর থেকে যথেষ্ট সুযোগ পেলেও আর কোনও মেয়ের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করতে রাজি নয়। এই আগুনের তাপে একবার সে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ঐ যে মেয়েটি মুচকি হাসছে! দেখতে স্বর্গের অপ্সরীর মতো। দেখেই ইচ্ছে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে ওর কামরাঙা ঠোঁটে চুমু খেতে।

–‘হাই’! মেয়েটা ওর টেবিলে এলো। ইংরেজিতে বললে, সেই থেকে কি এতো ভাবছো কি! তুমি কি ভারতীয়? ভারতীয় পুরুষদের আমার খুব ভালো লাগে। ওরা খুব ভালো। ওহ নামই বলা হয়নি। আমার নাম ডেলোরেস! তোমার নাম?

–পলাশ। আমি ভারতীয় নই। বাংলাদেশি, কেমন।

–খুব সুন্দর নাম। তোমার পাশে কি বসতে পারি?

–হ্যাঁ, কিন্তু! কিন্তু তোমার সঙ্গে ঐ যেলোকটা এসেছে সে কিছু মনে করবে না? আমি কিন্তু কোনও ঝামেলা চাই না।

না না। ওর সাথে পরিচয় বারে আসার পর। সে আমার কেউ নয়। জাস্ট কম্পোনি। ভেবেছিলাম চতুর, কিন্তু এক্কেবারে গাধা। এবার বলো তুমি কেন এত গম্ভীর। কি হয়েছে! জানো, তোমার চোখ দুটো ভীষণ বিষণ্ণ। সেই থেকে তোমার দু’চোখ আমাকে তাড়া করছে। তোমার চোখে কি যেন একটা রহস্য আছে। তুমি কি জান?

–জানি। আরেকটি মেয়েও আমাকে বলেছিল। তার নাম রুমনো। যেচে এসে তোমার মতোই পাশে বসেছিল। একদিন ফুরুত করে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। তা বলো তুমি কি জন্যে এসেছো?

–এমনিই। না চাইলে চলে যাবো।

–না-না বসো। মানে, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে ক্লাবে এতো সুন্দর ছেলেদের রেখে আমার পাশে…!

–‘সিগ্রেট খাবে?’ বলে জাদুকরী হাসিতে দাঁড়ালো ডেলোরেস।

–খাবো। আছে?

–‘আছে। মার্লবরো। রেগুলার। এই নাও।’ বলে ঠাস করে লাইটার জেলে সিগ্রেটটা ধরিয়ে দিল। নিজেও একটা সিগ্রেট খেতে খেতে বললো, রুমনো কি তোমার স্ত্রী না বান্ধবী! পলাশ আঁতকে উঠলো। কি কঠিন প্রশ্ন। সর্বনাশ! একথা তো সে ভাবেনি কখনো! কি উত্তর দেবে? স্ত্রী? আমার স্ত্রীর নাম তো রিনা। কিন্তু যাকে সিঁদুর পরালাম! ছি! এসব কি ভাবছি? আমি কি পাগল হয়ে গেছি! একটা মানুষ ক’জনকে ভালোবাসে!

–কি, বলবে সে!

–স্ত্রী, রুমনো আমার স্ত্রী। হলো! কেন জানতে চাইছো? তোমার সাথে আমার সামান্য পরিচয়ে এতো কথা কেন জিজ্ঞেস করছো? তুমি খুব নাকগলাও।

স্যরি, আমি এতো কিছু ভেবে বলিনি। ইটস ওকে। আমিই বরং স্যরি। আসলে কি জান। রুমনো মরে গেছে। আমার খুব কষ্ট হয় ওর জন্যে, তাই চেঁচিয়ে উঠেছি।

–আমি খু-উ-ব দুঃখিত। যাচ্ছি।

–না, তুমি বসো। তুমি বসে থাকবে। কিছুক্ষণ অন্তত। তোমাকেও আমার ভালো লেগেছে। অনেকটা রুমনোর মতোই তুমিও। রুমনো একদিন আমার জীবন জুড়ে এমনি করেই এসে বসেছিল…। তোমার মতোই সুন্দরী সে। কমনীয়। স্মার্ট। শুধু ওর চুলগুলো ছিল কালো এবং কোকড়ানো। বলে রুমনোর ছবিটা ওয়ালেট থেকে বের করে দেখালো।

–অদ্ভুত সুন্দরী। আমি দুঃখিত যে সে বেঁচে নেই। তোমার দুর্ভাগ্য।

–ডেলোরেস এবার তোমার কথা বল।

এবার একটু পজ দিয়ে হাতের সিগ্রেটটা নিবিয়ে ফেলে বললো–আমি সুন্দরী এবং ধনী, কিন্তু নিঃস্ব। তাই বারে আসি। বন্ধুর খোঁজে। এক বছর ধরে প্রকৃত বন্ধু খুঁজছি। অনেকের সঙ্গে বসেই মদ খাই কিন্তু মনের মতো কাউকেই পাচ্ছি না, যাকে সত্যিকারের বন্ধু বলা যায়। ঐ যে লোকটার সঙ্গে মদ খেলাম, সে একটা স্টুপিড। পরিচয়ের পরেই বলে চু-উ-মু খাবে। আই হেইট হিম।

–আমার বাবা-মা ডিভোর্সড। পোর্টোরিকো থেকে এখানে এসে ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করেছি। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং শিখেছি। এখন আমি ওয়াল স্ট্রিটে চাকরি করছি খুব উঁচু পদে। নাসডাক স্টকের সিম্বল নিয়ে টিভি-তে যে ফিতে নড়ে, আমি সেসবের দায়িত্বে। তুমি স্টক করো?

–করি না। কিন্তু বুঝতে পারি তুমি কি বলছো। এই কাজ তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। দাও আরেকটা সিগ্রেট দাও। তোমার কথা আরো বলো। ভালো লাগছে।

বারে তখন জমজমাট আড্ডা পিং-পং টেবিলের জন্যে লাইন ধরে লোক। ড্যান্স ফ্লোরটা দারুণ মেতেছে। জোড়ায় জোড়ায়-যৌবনের তরঙ্গ পুরো বারটা জুড়েই। মধ্য বয়সের সব যুবক-যুবতী। যৌবন তরঙ্গে–উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারের মতো শ্বেতশুভ্র ঢেউয়ের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে জোড়ায়-জোড়ায়।

–নাচবে! ডেলোরেস জিজ্ঞেস করলো।

–নাচতে জানি না।

–দেখিয়ে দেবো।

–আরেক দিন, আজ না।

–চলো প্লিজ! আমি তোমার সাথে নাচতে চাই। তোমার চোখ সুন্দর। আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাসতে চাই।

–পরে যাবো, আরো বলো তোমার কথা। তোমার স্বামী-ছেলেমেয়ে।

–আমি ডিভোর্সড। ছেলেমেয়ে নেই। মাতালটা শরীরের লোভে বিয়ে করে দু’বছর পরে অন্য মেয়ের সঙ্গে চলে গেল। আমি তখন গরিব। এতো সুন্দরীও ছিলাম না। আমি এই অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন আমার অনেক টাকা। ম্যানহাটানে এপার্টমেন্ট। লোকটা ফিরে আসতে চায়। ইউ কিডিং! আমি খুউব ভালো আছি একা। কিন্তু নিঃসঙ্গতা মাঝে মাঝে কুরে কুরে খায়। আমি একজন ভালো সঙ্গীর অপেক্ষায় আছি পলাশ। যাই হোক এবার চলো নাচবো।

–চলো। তবে আগেই বলেছি, আমি নাচতে জানি না।

–বলেছি তো শিখিয়ে দেবো।

ডেলোরেস হেসে পলাশের হাত ধরে টান দিল।

ডি-জের নিয়ন্ত্রণে ড্যান্স ফ্লোরে তখন মাকারিনা বাজছে। ফ্লোরে সবাই ভীষণ মুডে। ডেলোরেস ওর পেন্সিল হিলের ওপর পাক দিয়ে পলাশের কোমরে হাত দিল। পলাশের ডান হাতটা নিজের বাম হাতে ধরে নিজের ডান হাত পলাশের কোমরের পেছনে দিয়ে ওকে ঘুরপাক খাওয়াতে থাকলো। পলাশ ওকে ফলো করলো। ডেলোরেস প্রতিটি স্টেপ ওকে ধরিয়ে দিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে পলাশ ওর ডান পা বাম পা-তে ঠিকমতো বিট মিলিয়ে সবার সঙ্গে মাকারিনা নাচতে থাকলো। এবার ডি-জে স্লো ড্যান্সের মিউজিক দিলো। লাভ সং। ভীষণ স্লো। শুধু বুকে মাথা আর হাতে হাত রেখে ঢেউয়ের মতন দুলে দুলে নাচা ছাড়া করার কিছু নেই। পলাশের বুকে আচমকা ডেলোরেস ওর মাথা রাখতেই পলাশ, আঁতকে উঠে মনে মনে বললো, সর্বনাশ।

–পলাশ, আমার নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর জন্যে তোমার মতো সুন্দর আকর্ষণীয় সুপুরুষ আমি দু’বছর ধরে খুঁজছি। আমি কামার্ত! আমি রিক্ত! আমি … আমি …। জানো! আমার অনেক অর্থ। দেখো আমার কানের দুটো হীরের দাম পঞ্চাশ হাজার ডলার। আর শরীরে এখন দুশো হাজার ডলারের হীরে আছে। ব্যাংকে আমার লক্ষ লক্ষ টাকা। কিন্তু শান্তি নেই। আমি রাতের বেলায় কারো বুকে মাথা রেখে দু’বছর ঘুমোইনি। মাঝরাতে বুকের ভেতর নিঃসঙ্গ সমুদ্র গর্জে ওঠে। এই অর্থবিত্তের কি মূল্য, বলো! তুমি যদি চাও আমরা ডেইট করে দেখতে পারি যে, আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারি কি, পারি না।

পলাশ, এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। এতো দ্রুত সব ঘটছে। অথচ ডেলোরেসের মতো মেয়েকে ‘না’ বলাটাও বোকামো। সেতো একটা সোনার হরিণ!

–ডেলোরেস বাড়ি যেতে চাই। মদ আর খাবো না। বমি আসছে।

–আমার বাড়িতে চলো। যত্ন করবো।

 –না ডেলোরেস। নিজের বাসায় না ফিরলে রুমমেট দুশ্চিন্তা করবে।

–ম্যানহাটানে-আমি তোমাকে যে একা ছাড়তেই চাই না। তুমি মাতাল। রাস্তায় পড়ে যেতে পারো।

–ডেলোরেস আমি ভালো থাকবো। ভেবো না। আজ যাই।

–ঘরে গিয়ে ফোন করবো।

–হ্যাঁ।

–এই নাও কার্ড। সব নম্বর দেয়া আছে। ফিরেই কল করবে, প্রমিজ! তোমার নম্বরটা!

–‘নেই ডেলোরেস। রুমনো সেটা ওর চিতায় নিয়ে গেছে। আসি।’ বলে পা দুটো কোনরকম টেনে পলাশ হাঁটতে শুরু করে।

ডেলোরেস তাকিয়ে দেখলো পলাশ সামান্য দুলছে। রাস্তায় বাতির নিচে এক কোণায় দাঁড়িয়ে হাতের কার্ডটা কয়েক সেকেন্ড পড়লো। ডেলোরেস রড্রিগ্যাজ। সিনিয়র কন্ট্রোলার। এস ই সি। সর্বনাশ! এই কার্ড যদি সত্যি ওর হয়ে থাকে তবে ও কত বড়মাপের মানুষ। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে কত তুচ্ছ, অসহায়! এই মেয়ে তো সোনার হরিণ!

না–না এ আগুনে আর ঝাঁপ দেয়া নয়। এবার পালাতে হবে। জীবন নিয়ে। রুমনো আমার সব নিয়ে গেছে।

কার্ডটা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে পলাশ দ্রুত বাড়ি ফিরে গেল। পরদিন রাতে সে রিনাকে ফোন করলো। বাবাকেও। সবাইকেই জানালো ওর দুর্বিষহ প্রবাস জীবনের কথা। ‘বাবা এবার দেশে ফিরতে চাই। আর পারছি না। কত বছর রিনা আর মেয়েদের দেখিনি। এবার ফিরে একসঙ্গে বাঁচতে চাই।’

কি বলিস পলাশ! লোকেরা একটা আমেরিকার ভিসার জন্যে মরে যাচ্ছে। খবরদার! এই চিন্তাও করিস না। জানিস দেশের কি অবস্থা! বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায়, তুই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাসনি। দেশ, দেশ নেই। চুলোয় গেছে। সরকার একটা আস্ত জানোয়ার! একটা এঁটো শুয়োর! আমি গাজীপুরে দশ লক্ষ টাকার জমিতে সামান্য বায়না দিয়ে দিয়েছি। বাকি টাকা এক বছরের মধ্যেই লাগবে। ওসব চিন্তা মাথায় কিছুতেই জায়গা দিবি না। তুই দেখ কি ভাবে টাকাটা দ্রুত পাঠাতে পারিস। পাগল না হলে কি কেউ আমেরিকা থেকে ফিরে আসতে চায়। রিনাও নির্লিপ্ত রইলো।

‘না বাবা পাগল হয়ে যাইনি। তবে হবো। শিগগিরই হবো।’ বলে, পলাশ ফোন নামিয়ে আনমনা হাঁটতে হাঁটতে সেই বারে গেল।

ভাবছে, বাবা-চাচা, স্ত্রী কেউই রাজি হলো না ওর দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তে।

ইস! কার্ডটা থাকলে ডেলোরেসকে আজ একটা ফোন করা যেতো। বারে তিন আঙুলে মদের গ্লাস ধরে রাজ্যের ভাবনা মাথায় নিয়ে সে একা বসে আছে। ডেলোরসের কথা ঘুরেফিরে মনে পড়ছে। কিন্তু নম্বর নেই। ভাবলো, সেই বরং ভালো। কী প্রয়োজন এই মায়ার খেলার! ডেলোরেস ক্ষমা করো। তুমি সুখী হও। তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হোক। তুমি কাউকে খুঁজে নাও। ভাবতেই ডি-জে লাইটটা কমিয়ে দিয়ে স্লো ড্যান্সের মিউজিক ছাড়লো। ফ্লোরে সে একা নাচতে থাকলো। আবছা আলো আঁধারে ওর চোখ গিয়ে পড়লো অন্য কোথাও। রিনা আর তার দুই মেয়ে। দৌড়ে আসছে ওকে দুয়ারে দেখে। কল্পনায় সে দেশে ফেরে। আবছা আলোয় নাটকীয়ভাবে খেলে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে রিনা, মলি আর মেঘনার আলো-অন্ধকার মুখ।

সেই ছায়ায়–ওরা সবাই ঘুরতে থাকলো দুয়ারের একটা গাছের নিচে। মাথার উপর পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ। গাছে দুটো ফুল, ডালপালাগুলো সবুজ পাতায় ছাওয়া। ওরা ঘুরে ঘুরে নাচছে। এর মধ্যে ফুলকির মতো হঠাই কোত্থেকে ডেলোরেস এলো। পলাশ শুধু দুই বাহুতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলো। মুখে কেউ কোনও কথা বললো না। ফ্লোরে তখন, স্লো মিউজিক। দু’জনেরই চোখে অল্প জল–ক্লাবে নিভু নিভু সোনালি আলো। ডেলোরেস কখন থেকে যে ওর বুকে মাথা রেখে নাচছে, কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না। একবার ভাবলো একি সত্যি! নাকি কল্পনা। হঠাৎ দু’চোখে কিছু একটা অনুভব হলো। ডে-লো-রে-স …।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *