১৮. কত অজানারে!

১৮. কত অজানারে!

দুঃখ-সুখ

সংসারী মানুষের সুখ-দুঃখ থাকবেই। আর তা নির্ভর করে চাহিদার ওপর। সন্ন্যাসীদের ওসব বানানো বালাই নেই কারণ ওদের দাম্পত্য নেই। গৃহীর আছে। গৃহীর জীবনে, হয় দুঃখ, না হয় সুখের। এই করে করে শেষে পরমায়ু ভেসে যায় স্রোতের মতন। আর এই পরমায়ু কিছু আঁচলের তলে না কিছুর প্রভাবে, গৃহীর দুঃখ সুখ আমৃতুও প্রভাবিত হয়। এবং প্রভাবিত করেও। এবং তার মানে খুঁজে কোনদিনও পাওয়া যায় না। মানুষ তার আগেই মরে যায়। তবে বেঁচে থাকা অবস্থায়। মানুষের জীবনে সঙ্কটের কোনও শেষ নেই। তবে সমাধান, সুখ, ভালোলাগা সমস্ত কিছুর শেষ আছে এবং এরা উল্কার মতন। এই আছে এই নেই। সুখ! মনে করতে হয়। কতক্ষণ! স্মৃতিতে জেগে থাকে। অতিথির মতো, ওহ! এসেছিলেন। তিনি এসেছেন! বেশ তবে।

আমি সর্বাণী রায়। ব্যর্থ দাম্পত্য শেষে আজ বিধবা। অলস দুপুরে হা-হুঁতোশ বসে আজ অতীত সুখের মুহূর্তগুলো আমিও স্মরণ করছি। হ্যাঁ, তিনি এসেছিলেন। নিশ্চয়ই এসেছিলেন তিনি! তবে এসে বিশেষ বসেননি। এতই দেমাকি তিনি যে এসেই চলে যেতেন। অহঙ্কারী অধ্যাপিকা শাশুড়িসমেত। ভীষণ দেমাকি আর অস্থির প্রকৃতির। জোয়ারের চেয়েও, ঘূর্ণির চেয়েও, বিদ্যুৎচমকের চেয়েও দ্রুত। তিনি কমেট। একশ’ বছরে একবার উদয় হন। অস্ত যাওয়ার আগে দান করে যান প্রচণ্ড স্বর্গীয় আলো। দুধে ধোয়া চৈত্রের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের আলো। …তখন আমার সমস্ত পৃথিবীটা পাল্টে যেতো। তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম আমার মস্তিষ্কের ভেতরে স্নায়ুস্থল যা আমার সহসা চঞ্চল অন্ধকার মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং সেই আলোর স্মৃতি মনে করে আমি আজও স্পষ্ট দেখতে পাই সেই স্বর্গ, আমার স্বর্গীয় অনুভূতি। তখন আমার কাউকে ভালো লাগে না আর। সুখ এমনই। জ্যোৎস্নার আলপনায় বোয়া আলো। নীরবে চলে যায়। এবং আমি এই তাৎক্ষণিক সুখে আরও অধিক বিভ্রান্ত হই। ভাবি এইতো সে। এই তো। আমি ভুল বুঝি। ভাবি তিনি চলে যাবেন না। কিছুতেই না। কারণ তিনি আমার জন্যেই এসেছেন। তিনি থাকবেন। এই সঘন সুন্দর শ্যামলিমায় মহিমান্বিত তিনি কখনোই আর যাবেন না। কিন্তু…চলে যান। তিনি চলে যান। চাঁদের আলোর মতোই তিনিও, ধরা দিয়েও না দিয়ে সব নিয়ে নিভে যান। তবুও, আবার উদয় হবেন এই আশায় মানুষ অপেক্ষায় রয়। আমি এস রায়। আমিও, সেই আশাতেই, হাঁ-মুখো বসে রই।

তিনি যান অসুখী মানুষদের ঘরে ঘরে তার যেখানে কর্মব্যস্ততা। বিশেষ করে পৃথিবীতে ধর্ম আসার লগ্ন থেকে। নেই বলেই তো তাকে পাওয়ার এমন তীব্রতা। থাকলে হতো না। এই কান্না! আহা! বটে! তিনি এলেন তবে? এলেন যদি, তবে কেন। তিনি এমন ক্ষণজীবী!

যা যাচিত, যাহা কাম্য, পৃথিবীতে সেই-ই হয় ক্ষণজীবী। যা চাই না, তা লেগে থাকে যার প্রয়োজন নেই, সেই-ই চোখের সামনে। যাহা চাই তাহা পাই না। সুখ তাদেরই একজন। সুখ! আছে বলে কোনও কথা নেই। ছিল, সেই-ই স্মৃতি। সেই সুখের স্মৃতি আগলে থাকা। অনুভবে তাকে পাওয়া। এইটুকুর নামই সুখ।

স্বামী স্ত্রী সন্তান নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। জীবিত অবস্থায় একজনের বিরুদ্ধে অন্যের সর্বক্ষণ অভিযোগ। কিন্তু হঠাৎ একজন ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলে সেখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সকল কষ্ট উপেক্ষা করে বড় হয়ে দেখা দেয় তখন তার অতীতের যা কিছু সুখ। তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মধুর স্মৃতি বড় হয়ে দাঁড়ায়। সব মন্দ তুলে রেখে ভালো। সুখ অতীতের। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন। মনে হবে মাতালটা যখন বেঁচে ছিল তখন তার উপস্থিতি সহসাই এনে দিতো অভিযোগ আর কলহ। আর তার মৃত্যুর পর সব ছাপিয়ে শুধু তার বেঁচে থাকার মধুর স্মৃতিই সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয়, না হয়, পেটাতো! না হয় মদ খেয়ে গভীর রাতে এসে ছিন্নভিন্ন করতে শরীর। ক্রোধে আক্রোশে ঘৃণায় না হয় ফালাফালা করতো এই না খাওয়া দুর্বল দেহটুকু। তবুও তো মাতালটা বেঁচে ছিল! দিন শেষে বাড়ি ফিরে এই যে পেটাতো, তবুও তো চিৎকার করে জানাতাম বেঁচে আছি। আর আজ এই নিঃসঙ্গতার উপকূলে এত নির্জনতা মনে হয়, মৃত্যু। কাঁদি মনে করে। তখন বাবা বেঁচে। ভাইবোন সব এক ঘরে, এক সঙ্গে বড় হচ্ছি। মার মাথা ভর্তি কালো চুল। ভরা যৌবন তার। ক’টি শিশু আমরা হাঁসের মতো কৌতূহলে চষে বেড়াই পুকুর পাড় থেকে সি এন্ড বি রাস্তার ওপাশে কাঁচা ট্যানারির দুর্গন্ধ ঘরে। কাঁদি কৈশোরবেলার সুখে। মনে হয় বিয়ের রাত্রির কথা। চিত্ত উথলে ওঠে সুখে। বাসর রাতের স্মৃতি যখন তিনি বলেছিলেন আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে! তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এক ভীত মেষশাবকের মতো, স্তব্ধ। মনে আছে তিনি হেসে, আমাকে তার বুকে অনেক্ষেণ চেপে ধরে বসে বসে কি যেন সব বলছিলেন। আর আমি ক্রমশ শীতল থেকে তাপিত আগুন হচ্ছিলাম। তারপরই সব উধাও। কি যেন হলো। তিনি চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে। আমি নিরন্তর একা! সুখের মুহূর্তগুলো এমনই ক্ষণিক হলো। এমনই অপার্থিব। নশ্বর।

সুখ শুধু সময়ের গায়ে তীব্র আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করে চলে যায়। আর সেই ক্ষত আগলে বসে আমরা বাকি জীবন সুখের আক্ষেপ করে করে শুধুই দুঃখ পোহাই। জীবটা শুধু দুঃখসার।

সুখের সীমানা যদি হয় পুকুরের তল, দুঃখ তবে অতল সমুদ্র। সুখ যদি হয় জলাশয় হঠাৎ বৃষ্টি, দুঃখ তবে বৃষ্টির অভাবে তাপিত স্থবির জলাশয়।

কৈশোর ও যৌবনের কঅজানা

কিছু কিছু বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া, কৈশোর বা যৌবনের প্রারম্ভে মনে যে বসন্তের আঁচড় লাগে তাকে বড়ই স্থায়ী বলে ভাব হয়। জীবন মুহুর্মুহু রঙ বদলায়। নীল-হলুদ-খয়েরি। কৈশোর ও তারুণ্যের শরীরে বসন্ত খুঁজে পায় তার নিকেতন। এই বসন্তের রঙ সবুজ, লাল, নীল, কমলা।…মন হয় রঙধনু। প্রিয়ার কণ্ঠের সাতনরী। বা কমলার কোয়ার মতো তার ঠাসা পুরু এক জোড়া অর্ধচন্দ্র ঠোঁট। এই তো কৈশোর। এর মানেই কণ্ঠস্বর ভাঙা। মানেই বয়োসন্ধির আয়োজন। স্বপ্নে জাগরণে রতি সুখ। কিশোরের ঠোঁটে গোফের রেখা। কিশোরীর বক্ষে এক জোড়া পর্বত চূড়ার আগাম আবছা আভা। কিংবা নাইকুন্ডুলীর নিচের অমসৃণ উপত্যকায় মাতৃত্বের ফাটলে মাসিক শিশুর লাল রঙের চিৎকার। শরীরে ইলেকট্রিক শকের মতো সুখ যন্ত্রণা যা মাথা থেকে পা অবধি কালো পশমাবৃত উপকূল বেয়ে নেমে যায় কত রিক্টার স্কেলে কে জানে! ভেজে নিম্নভূমি। ভেজে পুরুষ। ভেজে নারী। সব ভালো। সব ভালো লাগে। তখন সবকিছুই ভালো লাগে যখন স্বপ্নসুখে আমূল উত্তাল হয় পুরুষ, হয় নারী। এই মধুক্ষণে মনে হবে পৃথিবীর সব অন্যায় ক্ষমার যোগ্য। মানুষই দেবতা। সব মানুষ, দেবতা। মনে হবে পৃথিবীর সব সুখ শুধু শরীরভিত্তিক।

অবৈধ কাম

নিষিদ্ধ বলে যা অশ্লীল। অবৈধ বলে যা লোভনীয়। অবৈধ কাম! যদিও সামাজিক নয় কিন্তু সুখের তাড়না রতির তাড়নাকেও ছাড়িয়ে যায়। ফলে রতির সুখ সম্পূরক হয়ে দাঁড়ায় অন্য অন্য সার্বিক সুখভোগের। কিসের বৈধতা! রতির তাড়না মানে কী, কোনও বৈধ-অবৈধতা? এই সুখের পেছনে শুধু সুখানুভূতি ছাড়া চাওয়া-পাওয়া নেই বলে সুখের স্থায়িত্ব প্রগাঢ়। কিন্তু যখনই রতি সুখকে বৈধতা দিতে বিবাহ বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করা হয়, চাওয়া-পাওয়া তখন রতি সুখের চেয়েও অন্যদিকে প্রাণ পায়। দাম্পত্যের সুখ, ক্ষণজীবী। এখানে থাকে সংসার সন্তান সমাজ ও সংস্কার। এই চার স’ মিলে ক্রমাগত। উৎপাটন করতে থাকে সুখের সকল চাষাবাদ।

আমি সর্বাণী রায়

প্রেমের বিষয়ে পৃথিবীতে অবৈধতার প্রশ্ন, প্রশ্নই থেকে যাক। কেননা প্রেমের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক আমার সাধ্যে সাহসে কুলোবে না। আমি সর্বাণী রায়। প্রেম আমি খুব ভালো করে চিনি। কারণ আমি প্রেম করেছি। একাধিকবার। একাধিক জন। তার মানে একাধিক ব্যক্তিত্ব আমায় প্রেমের অনুভূতি দিয়েছেন। সে অর্থে আমার অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। প্রেমের অনুভূতি দিয়েছেন। সে অর্থে আমার অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। প্রেমের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যক্তিত্ব আসে যার যার নিজস্বতা নিয়ে। প্রেমে, একেকজনের চাওয়া, প্রকাশ, রুচি, অভ্যেস, সংস্কার ভিন্ন যেমন কোনও কোনও মানুষের কাছে প্রেমের অনুভূতিই সব। কেউ, শরীর। কারো শরীরই সব, কারো অনুভব। কারো দুটোই আবার কেউ প্রেমই বোঝে না। কেউ বোঝে স্বর্গীয় আলোকে। কেউ কেউ হতাশায় শুধু রিক্ত ও ক্লান্ত হতে হতে। এবং এও সত্য যে-যে-কোনও প্রেম, ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। বৈধ-অবৈধতার বিতর্কের ঊর্ধ্বে। পরকীয়া, সেও প্রেম। প্রকৃত প্রেম। হৃদয়ে নব-যৌবন। স্বামী-স্ত্রী, সেও। লেসবিয়ান হোমো বাইসেক্যুয়াল ওরাও প্রেম করে।

প্রেম অনন্য। প্রেম ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যে বেঁচে আছে, সে সত্যিই বেঁচে নেই। সে অন্ধকার। নিয়তই মানসিক ও শারীরিক নিষ্ঠুরতার চাবুকে বিধ্বস্ত। সে নিয়ত মরে যেতে চায়।

মানুষের বিচিত্র জীবনে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে। আমি সর্বাণী। আকাল বিধবা। তবে এখন অবৈধ প্রণয়। পরকীয়া কি আমি তা বুঝি না। এই মুহূর্তে বুঝতে চাইও না। বুঝি, প্রেম। বুঝি প্রেম বদলে যায়। এক মানুষ থেকে, অন্য মানুষে। এক দেহ থেকে অন্য দেহে। যেতেই পারে। কারণ বিষয়টা বহুমাত্রিক। আমরা ক’জন জানি যে প্রেমের রয়েছে নিজস্বতা, যা মানুষের নিজস্বতার উর্ধ্বে। সুতরাং সমাজ, পরকীয়া বলে যাকে সহজেই ভুল বোঝে, বুঝে তাকে কঠোর সব প্রাচীন অবাস্তব শাস্তির কাছে আজও হেনস্তা করে, বাস্তবে তা প্রমাণ করে কতিপয় ব্যক্তি –তাদের বীর্য ও সমাজে, বুদ্ধির নিরক্ষরতা।

প্রেম পাল্টায়। তার মানেই পরকীয়া নয়। স্রেফ প্রণয়। সে অর্থে পরকীয়া আসলেই পরকীয়া নয়। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী পরবর্তীকালে অধিকাংশ সময়েই তারা শরীর, যা মিটে গেছে। তা সত্ত্বেও দাম্পত্যের সীমানা। এর বাইরে গেলেই অবৈধ। এবং যে প্রেম শুকিয়ে যায়, সঙ্কটে, বিচ্যুত বিধ্বস্ত দাম্পত্য সে, বিকল্প খুঁজে নেয় অন্য মানুষে, অন্য শরীরে, যেখানে প্রেম আছে। শরীরের প্রকৃত সুখ আছে। আছে দুস্থ রতি ও কামনার স্থলে, স্বর্গময় সুখভোগ। যা থেকে শরীরসর্বস্ব প্রেমবিহীন স্বামী-স্ত্রী বিচ্যুত বহুদিন। সংস্কার চৌকাঠ পেরোলে তা, অবৈধ কেন হবে?.খুব সঙ্গতভাবেই প্রেম শুকিয়ে গেলে, পরকীয়ার প্রশ্ন আসে। সমাজের অন্যদের মতেই এটাও জীবনের অঙ্গ। না চাইলেও বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান। অনেকের জন্যে পরকীয়াই একমাত্র উপাদান। কারণ, ঘরে ঘুণধরা দুটি সম্পর্ক যা শুধু দুটি, থাম।

প্রেম শুকিয়ে যায় কেন তার কি কোনও হিসেব আছে? সমমনা না হলে শরীর কদিন ধরে রাখবে দুটো উল্টো মনের মানুষ! পা যায় তখন ঘরের বাইরে। হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় নিষিদ্ধ ফুল। সেই দুর্গন্ধ ব্লাউজ সেই বিবর্ণ পেটিকোট যার গন্ধে, পেট উগরে বমি আসে। সেই অমসৃণ উপত্যকা যার চামড়ায় নাক ঘষলে নাকে উঠে আসে তীব্র গন্ধ, যা মোটেও পরিচ্ছন্ন নয়। অথচ ঘরে পরিচ্ছন্নতা রেখে অপরিচ্ছন্ন নিষিদ্ধ পরিবেশে পতিতার আড্ডা তার শরীর সমাজের সব কঠিন প্রশ্ন, প্রশ্ন এড়িয়ে সত্য হয়ে দাঁড়ায়। কিসের এত প্রশ্ন যখন নারী তার পুরুষের পুরুষ বৃন্তের শৈথিল্যে মানসিক যুদ্ধে পরাস্ত। যখন সে মাসের পর মাস অনুপস্থিত। স্বামী যখন প্রবাসে। স্ত্রী যখন প্রবাসে। যখন ঘরের চেয়ে সুখ টানে পতিতালয়! স্ত্রী নয়। যখন পতিতাই উজ্জীবিত করে তার প্রয়োজনীয় সৃষ্টিশীল মনমানসিকতা! যখন পরকীয়ার তীব্রতা বৈবাহিক বন্ধনকে ছাড়িয়ে যায়। যখন তার নিষ্ঠুরতা, অমনোযোগ, আকর্ষণ করে অন্য প্রেম। যখন তার হাতের তলে সে ফোটে না বসন্ত মহিমায়! অসম মনমানসিকতা যখন দু’জনের মধ্যে ফুটে বের হয়, দূরত্বে। যখন দূরত্ব এত দীর্ঘ হয়, যা অতিক্রম করে দু’জনে আর পৌঁছতে পারে না দু’জনের কাছাকাছি তখন, যখন একটি ছোট বিছানায় পিঠ ফিরিয়ে শোয় দু’জন মানুষের মধ্যেকার দু’হাত ফাঁকে, অনন্ত ফাঁক! হাহাকার। হাজার হাজার মাইল ফাঁক। যখন তার তারুণ্য তুঙ্গে। আর অপরপক্ষ শীতল। যখন সে কণিকায়, মল্লিকা দেখে। সে দেখে অরূপে, শিশির। যখন দোহের মিলনে সৃষ্ট সন্তান সংসার দশ বছরশেষে তাকেই হঠাৎ মনে হবে আগন্তুক, এবং পরম তিতিক্ষার আবেগ প্রেম মাধুর্য বসন্ত, নতুন করে মেলে দেবে তার কুঁড়ি, খুঁজে নেবে প্রেমের প্রকৃত সম্ভার, অন্যজনে! যা নতুন! যা যাচিত! যা স্বর্গীয়! যা জীবনে কখনো এর আগে ঘটেনি বা এমন সৌরভে, মহিমায় ফেটেনি!

মধ্য বয়সের নিঃসঙ্গতা

যখন অপরপক্ষ মারা যায় বা চলে যায়, বিচ্ছেদ রচনা করে! যখন সমাজ ও ব্যক্তি দুটি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় নৈতিক ও মানসিক প্রশ্নে! যখন সত্মা বা সৎপিতা কিংবা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ইত্যাদি জাতীয় সম্পর্ক কোনওরকমেই সন্তানের হৃদয়ে গ্রহণযোগ্য নয়, তখন! কিংবা কন্যার বিবাহ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় অমন দ্বিতীয়বার বিবাহিত নষ্ট বিধবা মায়ের চরিত্রের কারণে!

মধ্য বয়সে, বা যে-কোনও বয়সে, যে-কোনও কারণে মানুষ একা হয়ে গেলে, সমাজ সন্তান সংসার ও সংস্কার যখন তাকে সেই অবস্থাতেই বিশুদ্ধ বিধবা নারী বা বিপত্নীক পুরুষ দেখতেই অধিক উদ্গ্রীব থাকে তখন ব্যক্তির জীবনে নিঃসঙ্গতায় যে মৃত্যুর চেয়েও অধিক নিষ্ঠুর অন্ধকার নেমে আসে, এবং সেই অন্ধকার থেকে সৃষ্ট হতাশায় আসল মৃত্যুর প্রত্যাশা, সেই কি ভালো?

তার পাঁজরের তলে রুদ্ধ হয়ে আসা শ্বাস, রাতের অন্ধকারে তার স্নায়ুযুদ্ধ, নিঃসঙ্গতায় ভেঙে আসা বুকে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর স্পর্শ প্রেম আদর ভালোবাসাহীনতায় সৃষ্ট মানসিক শুষ্কতা, প্রত্যহ হারিয়ে যেতে থাকা মানসিক উজ্জীবন! তার প্রতিদিন! তার নিষ্ঠুর রাত্রি! সৃষ্টিশীলতা!

একটি হাতের ছোঁয়া! একটু ছোঁয়া। পাশে এসে বসা। শরীরে স্নেহের আঙুল। তৃষিত, এক জোড়া ঠোঁটের কি করুণ সুধাপান পিঠে হাত রেখে, পায়ে পা ঘষে। মনন্তরের ক্ষুধায় কাঙাল শরীরের, কি নিবিড় বিনিময়!

কোনটি ভালো? নিঃসঙ্গতা ক্যান্সারের চেয়েও কঠিন ব্যামো। দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন বিধবা বা বিপত্নীকদের দ্রুত মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিসংখ্যান সে কথাই কি প্রমাণ করে ছাড়েনি? কেন জানবো না যে পঁয়ত্রিশের পর যে-কোনও নারী, বা পঁয়তাল্লিশের পর যে-কোনও পুরুষ মানসিক ভারসাম্যহীনতার মুখোমুখি দাঁড়ায়! জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ইতোমধ্যেই চলে গেছে। নতুন করে দেখার পাওয়ার চাওয়ার কিছু নেই। জীবনের রঙ সব জলে গেছে। জীবনের সুখ সব ঝরে গেছে। ফিকে আকাশ। সমুখে তাকিয়ে শুধুই পড়ন্তবেলার সূর্য ছাড়া কিছু নেই। আর নতুন কোনও ভোর হবে না এই বয়সের পর। যা হবে তা অস্ত। এবং এর সঙ্গে যখন জমা হয়, মধ্য বয়সের নিঃসঙ্গতা সেখানোই সমূহ সর্বনাশ। মধ্য বয়সের মন এবং শরীর যখন নদীর টলটলে জল, যখন জলের উৎস সরোবর থেকে সৃষ্ট ঝরনাধারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন সে নদীর কি দশা?

বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতা

মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। অন্ধকার আকাশের চেয়েও, কালো। বার্ধক্যে যারা বিধবা বা বিপত্নীক তাদের নিঃসঙ্গতার কষ্ট যৌবনের নিঃসঙ্গতার চেয়ে আরো গভীর কালো। এবং শুধু সেই বোঝে, যার এ দশা হয়। বার্ধক্যে একটা সঙ্গীর প্রত্যাশা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। একজন কথা বলার সঙ্গীর বিকল্প নেই তাকে ডাক্তার, ওষুধ কাউন্সিলিং থেকে দূরে রাখতে। একজন রক্তমাংস, যৌবনে তাকে যত নয় প্রয়োজন তার উপস্থিতি, বার্ধক্যে যা লক্ষগুণ অধিক যাচিত।

কর্মবিহীন জীবন যখন সঙ্গীবিহীনতার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সে ঘোলা নরকের মুখোমুখি। জীবন তখন বোঝ। তার বেঁচে না থাকা, সমান। বেঁচে থাকাটাই অপচয়। ঈশ্বরকে সে মাথা কুটতে কুটতে দোষ দিয়ে বলবে কেন সে বেঁচে আছে! কেন? কি পাপ করেছে সে! মনে হবে। বোঝ। সার্বক্ষণিক পাথরের পাহাড়, পাহাড়, পাঁজরের তলায় চেপে বসে শুধু কষ্টই দেয়। যার তলায় চাপা পড়ে থাকে, রুদ্ধশ্বাস। কখনো যা পুরোপুরি বের হয় না, মনে হয় কে যেন তার গলা টিপে তাকে চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু কষ্ট দিচ্ছে। তার কষ্ট হয় হাঁটতে, বসতে, শুতে, খেতে, বলতে, নিশ্বাসে, প্রশ্বাসে…।

যদি কেউ ভুল করেও ভাবে বার্ধক্যে, পুনর্বিবাহ বা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা অসামাজিক এবং নিন্দনীয়, তবে সে জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। বরং বার্ধক্যে বিধবা ও বিপত্নীক হয়ে দ্রুত তাদের পুনর্বিবাহ বা স্থায়ী বন্ধুত্ব, যৌবনের কারণের চেয়ে এতটুকুও কম নয়, যখন মানুষ পরনির্ভরশীল। প্রায় বৃদ্ধ। এবং অপরের বিরক্তি। সেই বোঝা বিরক্তির জন্যে তাকে চাই যে নিজেও অন্যের বোঝা বিরক্তি। সঙ্গীবিহীন বার্ধক্য=ওষুধ+মানসিক অসুখ+অভিযোগ। অতএব বার্ধক্যের সঙ্কট, এই পুরুষ বোঝ বিরক্তি+নারী বোঝা বিরক্তি=সমাধান। অর্থাৎ মাইনাসে মাইনাসে প্লাস (- – = +) বিছানায়, শূন্যতার বদলে উষ্ণ ওম। ঘরে নিস্তব্ধতার বদলে, কোলাহল। টেবিলে একাকিত্বের বদলে মুখোমুখি নিশ্বাস। এতে সমাজেরই-বা কি সমস্যা, সংস্কারেরই-বা বলার কী? সমাজ কি মানুষের প্রকৃত সঙ্কট, জানে? জানলে, ছিছিক্কারে কেন ভরে ওঠে বাতাস, যখন কোনও বৃদ্ধ বিধবা বা বিপত্নীকের বিয়ে হয়! কেন সন্তানেরা তাদেরকে এত দ্রুত ত্যাগ করে? কেন আত্মীয়েরা ঘৃণায় মুখে দেখে না? কেন পড়শিরা ঘরে ঘরে রটিয়ে দেয় কোন দুশ্চরিত্র বা দুশ্চরিত্রার গল্প! কেন শ্বশুড়বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়, কারো ছেলের বৌ ছেনাল বাপের জন্যে? অলস দুপুর কেন অলস থাকে না, কেন বৃদ্ধ ছেনালের গল্পে। নিঃসঙ্গতার নরক সংবাদ কি কেউ রাখে?

বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতার সঙ্কট, যতটুকু জানি, যা ভাবি, তার চেয়েও গভীর। অন্ধকারে কত পথ হাঁটা যায়? চেনা পথটুকুও, অন্ধকারে ভুল হবে।

কেই-বা বুঝতে চায় বয়স্কদের সমস্যা! সে সময়, কার আছে? তবুও বুঝতে হয় যে বার্ধক্যে মানুষ আরো বেশি অসহায় আর পরনির্ভরশীল। অনেক বেশি বাঁচাল। হরমোনের শুষ্কতায় শরীরে ও মনে তারা অনেক বেশি জটিল। তাদের মৃত্যু দুয়ারে। বিরক্তি লাগে, দেখলে এড়িয়ে যেতে হয়, মুরুব্বির চেয়েও তারা অধিক বোঝ। কোন পুত্রবধূর সংসারে ওরা ওষ্ঠাগত প্রাণ। হায় খোদা কেন বেঁচে আছে, মরে না কেন? মনে হয়! মেকি আদর। মেকি ভদ্রতা। মেকি সম্মান। মেকি সব মেকি। যাচিতের চেয়ে তারা বরং অযাচিত। কার সময় আছে! ওষুধ পথ্য খেলো কি খেলো না, এত কে দেখে? গু-মুতের কাপড় কে ধোবে? কেন এসব অতিরিক্ত বালাই! খেয়ে কাজ নেই? সংসার নেই। স্ত্রী নেই? স্বামী নেই! ছেলেমেয়ে নেই? এই প্রশ্নগুলো, প্রশ্ন যা যথেষ্ট সামাজিক। কিন্তু কেউ এর সমাধান খুঁজে নিলে তা ‘অসামাজিক।’ হয়, ‘অযাচিত’ বা ‘ছেনাল’।

এবং দেখা গেছে সবশেষে এই অসামাজিক ও অযাচিত দু’জনই শেষ পর্যন্ত দু’জনকে বাঁচিয়ে রাখে। সন্তান নয়, আত্মীয় নয় এই দু’জনই শুধু দু’জনের, যারা অযাচিত, যারা অসামাজিক। যে সঙ্কট সমাজ বোঝে না তার উত্তর এই অযাচিত দু’জন।

ওরা শিথিল ওরা শীতল। ওরা ফানি, ওদের চাওয়া, যৌবনের লিঙ্গ যোনির চাওয়া-পাওয়া থেকে ভিন্ন। ওরা সঙ্গী।

তা সত্ত্বেও বার্ধক্যে, শুষ্ক নারী আর শিথিল পুরুষ, দুই পাটি দাঁত খুলে রেখে বিছানায় ওরাল সেক্স আর সুগন্ধ ভেসেলিন বিকল্প নিয়ে ওরাও যে মাতে না অবিনশ্বর। আনন্দে, কে বলে? যে বলে সে ঘুণ কাঠ। ঘুণে খাওয়াই নয়, অন্ধও বটে। প্রেম বার্ধক্য ঠেকায়। মৃত্যু দূরান্বিত করে। প্রেম ভালোবাসা, পরকীয়া অউর, নো। পরকীয়া=পেয়ার জিন্দেগি হ্যাঁয়। যে-কোনও বয়সে। যে-কোনও সমাজে। এখানে সবাই, মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *