১৫. মেয়েদের ক্রাইসিস পুরুষ

১৫. মেয়েদের ক্রাইসিস পুরুষ

ক. মানুষের ক্রাইসিস নিয়ে লেখার বিষয়গুলোর মধ্যে হৃদয়ের ক্রাইসিস আমার সবচেয়ে পছন্দের। হৃদয়ের ক্রাইসিস, যা অন্য সব ক্রাইসিসকে ছাড়িয়ে যায়। ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়েও তীব্র। অকাল বিধবার রাতজাগা কামার্ত শরীরের অনুভূতির চেয়েও যন্ত্রণার। আমি ক্ষুধার্ত থেকে দেখেছি। হৃদয়ের ক্রাইসিস জাগিয়ে তোলে শরীর। জাগায় স্নায়ুকোষ। জাগায় অপ্রাপ্তির, মৃত্যুযন্ত্রণা। মাসের পর মাস, স্বামীর কাছে থেকে, দূরে থেকেও দেখেছি। কিন্তু হৃদয়, সেখানে ক্রাইসিসের মুচড়ে ওঠা ব্যথা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল ব্যথার চেয়েও একমাত্র মৃত্যুযন্ত্রণা বাদে ছাড়িয়ে যায়। দুঃসহ এই ব্যথার কোনও ওষুধ নেই। কোনও ডাক্তার-বদ্যি নেই। সুতরাং কোনও নিরাময়ও নেই।

মেয়েদের হৃদয়ের ক্রাইসিস জাগে, পুরুষের প্রতারণা থেকে। প্রতারণা, পুরুষের স্বভাব। ওরা খেলুয়া পুরুষ, খেলে যতদিন খুশি। ওদের সুবিধে, ওদের পেট ফোলে না। ফোলে নারীর। পুরুষ পালিয়ে যায়। আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে নারী পড়ে এক মহা-সঙ্কটে। ভীষণ ভারি! ভীষণ বোঝা! কি যেন একটা পাথরের মতো ভারি সর্বক্ষণ চাপা দিয়ে রাখে হৃদয় নামের অদৃশ্য যন্ত্রটিকে। এই যন্ত্রণা যার হয় শুধু সেই বোঝে এর ভার! তার অন্য সকল সুখ এমনকি কোটি কোটি টাকাও তখন ভীষণ নগণ্য হয়ে যায়। তৃপ্ত হৃদয়, প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। তার দু’চোখ দেখলেই বোঝা যায় হৃদয়ের আবহাওয়া। আর্ত না আনন্দ। চোখই সে কথা বলে। দু’চোখের তারা। ব্যর্থ প্রেম, প্রতারণা, স্বপ্নভঙ্গ, হৃদয় নিয়ে খেলা, ক্রাইসিসের শত কারণ, চোখেই প্রথম প্রকাশ পায়। যে চোখ অন্ধকারে ভরা। চোখ, যা মৃত।

একথা জানা যে পুরুষের হৃদয় মেয়েদের তুলনায় কঠিন। পুরুষ, অপেক্ষাকৃত পাষাণ প্রকৃতির এবং আবহাওয়া বুঝে প্রতারক। প্রয়োজনে নির্মম ও নিষ্ঠুর। মেয়েদের নম্রতা, কমনীয়তা, আবেগ, অনুভূতি, সমর্পণ এবং বিশ্বস্ততা। পাশাপাশি, পুরুষের কিন্তু সেসবের কোনও বালাই নেই। হয়তো-বা এগুলো নারীর জন্যে তার স্বভাবজাত সম্পদ। তবে পুরুষ যে অপেক্ষাকৃত কঠিন হৃদয়ের সেকথা আর ঘটা করে না বললেও চলে।

মেয়েদের মিডলাইফ ক্রাইসিসের অন্যতম একটি কারণ, তার হৃদয়! যেখানে বোধ খুব কমই কাজ করে বা কখনই কাজ করতে পারে না। তার মহাসমস্যা তাকে নিয়ে পুরুষের ছিনিমিনি খেলা। মেয়েরা ওদের চরিত্র বুঝে উঠতে পারে না। ফলে মুহুর্মুহু ওদের নিষ্ঠুরতার জালে ফেঁসে যায়। পাষাণ হৃদয়, কঠিন চরিত্রের পুরুষ। পুরুষের প্রতারণার শিকার হয়ে কত মেয়েদের যে সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে তার কি কোনও পরিসংখ্যান আছে? নেই। কোনও পুরুষ হয়তো কদিন বেমালুম লজ্জা লুটে পালিয়ে গ্যাছে, কাউকে গর্ভবতী করে, কাউকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কথা না রেখে, কেউবা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। সন্দেহ নেই যে, পুরুষ নিষ্ঠুর! তবে সবাই নয়। কিন্তু যারাই এধরনের অপকর্মের আওতায় পড়ে, তাদের সংখ্যা নেহাৎ কমও নয়। পুরুষের টিপিক্যাল চরিত্র। হাত ঝেড়ে-ঝুড়ে ভুলে যেতে পারে সবকিছু, যেন কিছুই হয়নি।

আমাকে বলবে, ভালোবাসে। ওকেও। তাকেও। সততা, স্থিরতা, নিমগ্নতা, সমর্পণ, ওরা দায়ভার অস্বীকার করতে পারে নিমেষে। না হলে ওরা হয়তো মনে করে এগুলো না থাকলে পুরুষের সংজ্ঞায় পড়বে না। ওদের এই মুখোশ সম্পর্কে যে নারী অবহিত তিনি নিরাপদ। আর যে চেনে না সে অবহেলিত। ছেলেদের থেকে তাকে কতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়! এই না-জানা ভুলের মাসুলও গুণতে হয় প্রচুর। কিন্তু চাইলেও কি আর দূরে থাকা যায়? মেয়েরা স্বভাবজাত কারণেই পুরুষের ভালোবাসার প্রত্যাশী। তারা পুরুষ চায়; পুরুষদের বুক চায়। তার ওম ওম বুক চায়। দিতে চায় আবার পেতেও চায়। পুরুষ ছাড়া তাদের চলে না। বিয়ের পর স্বামী ছাড়া সে যেন কিছুই বোঝে না। কত সহজে তারা ত্যাগ করে পিতৃগৃহ। সব আপনজন ছেড়ে চিরতরে অচেনার এই ত্যাগ, শুধু মেয়েদের জন্যে প্রযোজ্য। পিতৃগৃহ ত্যাগ তারই। কি নিষ্ঠুরতা! কত ব্যথা! তারই। কি যদিও তা ঠিক নয়, কিন্তু এটাই নিয়ম। বিয়ের পর পুরুষ কখনো যাবে না আপন ঘর ছেড়ে, নারীর ঘরে। প্রশ্ন হয়, কেন যাবে না? কেন নারীকে দিতে হয় এই নিষ্ঠুর মূল্য। নিমগ্নতা, সততা, শুদ্ধিও মেয়েদেরই। ওদের অধিকাংশেরই কুৎসিত চরিত্র আমি দেখেছি তৃতীয় চোখ দিয়ে। হ্যাঁ, তবে ব্যতিক্রমী ভালো পুরুষ যে সেই তাও নয়। আছে। তবে খারাপ পুরুষ নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনারও শেষ নেই। আমাদের সুরঞ্জনাদের ঘরে ঘরে, পুরুষ এখন একটা চরম নিষ্ঠুরতার নাম।

আমি প্রচুর মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে দেখেছি মধ্য বয়সের সঙ্কট নিয়ে। শুনে বুঝি যে মেয়েরা তাদের চিরাচরিত সমস্যার কথা, না কাউকে বলতে জানে, না সইতে জানে। নপুংসক স্বামী, নিজের যৌন অভ্যেস, সমকামিতা, বিকার, অতৃপ্ততা, পছন্দ, অপছন্দ। পারলে জীবন অনেক সহজ হতো। কিন্তু বলতে পারার সেই ভাষা সেই সাহস মেয়েরা আদৌ রপ্ত করতে পারেনি আজও। অন্তত আমাদের মেয়েরা। মেয়েদের ক্রাইসিস, পুরুষ। ক্রাইসিসের কারণ তার শিশুসুলভ নির্মল হৃদয়। ক্রাইসিসের ফল, মানসিক ও মানবিক যন্ত্রণা। ক্রাইসিসের শেষ পরিণতি, মাথার গোলমাল দেখলে যখন রাস্তার লোকেরা ঢিল ছুঁড়ে মারে। তবে এ কথা প্রযোজ্য শুধু খেলুড়ে প্রেমিক এবং নির্যাতক স্বামীদের বেলায়।

খ. কিছু পুরুষ আছে যারা খুব সহজে মেয়েদের কাছে রীতিমতো ভীতিকর দুঃস্বপ্ন। খেলুড়ে প্রেমিক ওরা। হৃদয় নিয়ে খেলার প্রেমিক ওরা। মেয়েদের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে নরম জায়গা নিয়ে ওরা মজা করে। মুখে ভালোবাসা বললেও, আসলে ওরা ভালোবাসে না। শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে এবং মেয়েরা ওদেরকে বিশ্বাস করে করে অনেকদূর এগিয়ে যায়। মেয়েরা যেহেতু সঙ্গত কারণেই পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে চায় সেহেতু ভালোলাগার পুরুষ মানুষটিকে সে তার মনপ্রাণ এমনকি শরীরও দিয়ে দেয় খুব সহজেই। তাকে খুশি রাখতে। তার ভালোবাসা পেতে। পুরুষ বলে দাও না হলে চলে যাবো। মেয়েরা দেয়। তা সত্ত্বেও অধিকাংশই পালিয়ে চলে যায় নেয়া শেষ হলে।

আশ্চর্য যে, এমনকি খেলুড়ে পুরুষদেরকেও মেয়েরা জেনেশুনে বিশ্বাস করতে চায়। ইচ্ছে করে সত্যকে অস্বীকার করবে। নিজেকে ইচ্ছে করে ভুল বুঝতে চায়। নিজেকে ভুল বুঝে ভাবতে চায়, না! না! সে খেলুড়ে নয়। সে সত্য। সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। আমি তাকে ভুল বুঝেছি। এই যে বিভ্রান্তি, নিজেকে অস্বীকারের এই যে বিড়ম্বনা এরই নাম সর্বনাশ। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশ। কথাটি মেয়েটির বেলায় ধ্রুব সত্য। তখন মন হয় এলোমেলো, দিশেগুলো হয় দিশেহারা, উদ্দেশ্য হয় উদ্দেশ্যহীন। পুরুষকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস করতে করতেই সুরঞ্জনারা শেষ হয়ে যায়। চোখে দেখছে, কানে শুনছে কাজে কর্মে বুঝছে, সে প্রতারক। তা সত্ত্বেও হৃদয়ের ব্যাপারে সে অবুঝ। সে শিশু। এতদ্সত্ত্বেও সে তাকেই ভালোবাসে।

প্রকৃত ভালোবাসা আর ভালোবাসার খেলা, দুটো দুই জিনিস। বিভ্রান্তিতে ভুগতে ভুগতে মেয়েরা এই দুটোকে এক সময় আর আলাদা করে চিনতে পারে না। তবে সন্দেহ তাদের যে নেই তাও ঠিক নয়। কোথায় যেন একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার মনে হতে থাকে। মনটা মাঝে মাঝেই উদাসীন থাকবে। বুকে, হাহাহার। খারাপ লাগবে, কান্না পাবে, সর্বক্ষণ একটা সন্দেহ। একটা বিচ্যুতি, কি যেন! কোথায় যেন! এই যে সন্দেহ, এখানেই সমস্যা। এটাই প্রথম চিহ্ন, তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার। কিন্তু দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়ে মেয়েরা এ কাজটা সহজে পারে না। প্রতারক পুরুষটির প্রতারণাও তার ভালো লাগে। তাকে কিছুই নিরুৎসাহ করে না। ভালোবাসা তাকে তাৎক্ষণিক অন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে যখন তা একতরফা। একতরফা ভালোবাসায় দুইয়ের মানসিক সংযোগ না থাকায়, শুধু শরীরের কারণে হলে তা, ধসে পড়তে বাধ্য।

হঠাৎ একদিন সব নিয়ে বা ছেড়ে উধাও হয়ে যায় খেলুড়ে পুরুষ। খেলুড়ে পুরুষ, যাকে ঘিরে মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্ন নামের গাছ বুনেছে। বুনে তাতে আগাম ফল ও ফুল দেখেছে ছোট্ট সংসারের। জল সিঞ্চিত করে যত্ন করেছে পুরুষটিও তার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে তার সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটি যে কিছুই টের পায়নি তা ঠিক নয়। সে জেনেশুনেই ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই সে সন্দেহকে সন্দেহাতীত করে ভেবেছে। খেলুড়ে পুরুষ পালিয়ে গেলে স্বপ্নভঙ্গ মেয়েটির অবস্থা তখন কেমন হতে পারে? মানসিক রোগ! আত্মহত্যা! হয়তোবা। না হয় ফের সে স্বেচ্ছায় পা বাড়াবে, অন্য আরেক খেলুড়ে পুরুষের কাছে। কেননা দুর্বল হৃদয়ের মেয়েরা, একবার পা পিছলে পড়লে, বারবার সেই ভুলের দিকেই পা বাড়ায়। ভাবে, না এবার সে ঠিক মানুষ খুঁজে পেয়েছে। একবার পা পিছলে পড়া মেয়েগুলো বারবার যায়, পিছল খেতে। এটা মেয়েদের অভ্যেস বদভ্যেস! এরই নাম দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ভ্রান্তি-পা-শ! হৃদয়ের ক্রাইসিস কুলিয়ে ওঠার মতো মানসিক শক্তি সব মেয়েরই একই তরঙ্গের হবে এমন কোনও কথা নেই। সব মেয়ের মানসিক আবহাওয়াও এক মৌসুমের নয়। আমাদের সমাজ বুঝতেই চায় না মেয়েদের সমস্যাগুলোকে। এ ব্যাপারে সমাজ এখনো জাহেলিয়াতের যুগে। সেক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত নারীর পারিবারিক সমর্থন বা সহানুভূতির আশাও বৃথা। যে মেয়ের মানসিক শক্তি আছে, তাকে নিয়ে আমার ভাবনা নেই। কিন্তু যার নেই, তাকে নিয়ে আমার যত দুশ্চিন্তা। পশ্চিমে যে কোনও হৃদয়ের ক্রাইসিসকে জরুরি বলে বিবেচ্য ধরা হয়। ফলে মানসিক কাউন্সেলিং পারিবারিক সমর্থন সবই সম্ভব। ফলে ব্যর্থ প্রেমের কষ্ট, ওরা পরিবার বন্ধু এবং ডাক্তারদের সহায়তায় কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ ঠিক সেরকম নয়। কৈশোর বা যৌবনের কোনও প্রতারণা, খেলুড়ে প্রেম একটা। মেয়ের বাকি জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাকে বাকি জীবনের জন্য মানসিক রোগী বানিয়ে রাখতে পারে। সে আত্মহত্যাও করে।

গ. প্রত্যেক সমাজেই রয়েছে, নারী নির্যাতক পুরুষ। পুরুষের শাশ্বত চেহারা, ঘরের বৌদেরকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। ধরুন একজন বিবাহিত পুরুষ। সেও খেলে ঘরের নারীর হৃদয় নিয়ে। তাকে ভালোবাসার কথা বলে যায়, অন্য নারীর কাছে। তাকে মিথ্যে বলে, গোপনে আশ্রয় নেয় অন্য নারীর শয্যায়। গেস্ট হাউজ, পতিতালয়, পরকীয়া। বাড়ির কাজের মেয়ে। ঘরে কাজের মেয়েরা সবচেয়ে বড় নাগালের। ওদেরকে মায়া বড়ি খাইয়ে, কিছু হাত খরচা দিলেই ঢুকে যাওয়া সম্ভব ওদের মশারির তলায়। পেট হয়ে গেলে অস্বীকার তো হাতের পাঁচ আছেই! নইলে কিছু টাকা হাতে দিয়ে মিটিয়ে দেয়া এমন কিছু অসম্ভব নয়। এমন ভগ্ন হৃদয়ের নারীর সংখ্যা কি খুবই কম, যাদের প্রতারক স্বামী বারবার তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি। কাজের মেয়ে, গেস্ট হাউজ, পতিতালয় করেনি! আছে! অনেক আছে। সন্দেহের, সবটাই মিথ্যে নয়। যা রটে তার কিছু তো বটে। বিবাহিত পুরুষগুলোকে নিয়ে মেয়েদের সন্দেহ, অবিশ্বাস, সবটাই মিথ্যে হয় না। স্ত্রীকে ভালোবাসে না, এমন পুরুষ যদিও বিরল নয়, কিন্তু স্বামীকে ভালোবাসে না এমন নারী বিরল। স্ত্রীর মৃত্যু হলে, ক’জন পুরুষ মেয়েদের মতো আমৃত্যু বিধবা থাকে! স্ত্রীর মৃত্যুর মাসখানেক পরেই শুরু হয় নারীর সন্ধান। বলে, ধৎ, একা থাকা যায় না-কী? আমি বলি, যায়। অধিকাংশ মেয়েই বৈধব্য জীবনে, মৃত স্বামীর কথা ভেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিংবা নিষ্ঠুর সমাজের তুচ্ছ সংস্কারের কাছে ওরা বাধ্য হয় বৈধব্য জীবন কাটিয়ে দিতে। তবে মধ্য এমনকি বৃদ্ধ পুরুষদের মতো নারী কখনোই বিয়ের জন্য এমন খোলামেলা হয় না। হতে পারেও না। মধ্য বয়স্ক একজন বিপত্নীক পুরুষ নিঃসন্দেহে বিয়ে করবে। এমনকি বৃদ্ধ পুরুষও। কিন্তু নারী সেকথা ভাবে না। ভাবতে জানেও না। সে স্বপ্নও তার নেই।

অবিশ্বাসী স্বামীর আচরণে মানসিক কষ্ট একটা মেয়েকে মানসিক নরকে পৌঁছে দিতে পারে। রাতের ঘুম হারাম করে দেয়ার জন্যে যা যথেষ্ট। বিশ্বাসের বুকে ছুরি চালিয়ে তার জীবনটাকে রূপান্তর করতে পারে, নরকে।

ঘ. হৃদয়ের ক্রাইসিস নিয়ে খোলামেলা কথা বলা আমার স্বভাবজাত অভ্যেস। বারবার মেয়েরা যে ভুলটা করে, তা হলো, পুরুষকে বিশ্বাস করার যত আত্মঘাতী প্রবণতা। এই প্রবণতা তার স্বভাবজাত। কারণ মেয়েরা নির্ভর করতে চায়। খেলুড়ে পুরুষেরা খেলতে খেলতে হঠাৎ যখন সেই জগৎটাকে ভেঙে নিয়ে চলে যায়, কিংবা বিবাহিত স্বামী যখন দিনের পর দিন গেস্ট হাউজে নিয়মিত খদ্দের হিসেবে স্থায়ী সদস্য হয়, তখন ঘরের বৌয়ের হৃদয়ের ক্রাইসিস কোথায় দাঁড়াতে পারে? সবসময় সন্দেহ, সর্বদা শঙ্কাগ্রস্ত। অন্য নারীর গন্ধ, স্বামীর শরীরে পেয়ে সে শিউরে ওঠে। আস্ত একটি মানসিক নরকে বাস করতে শুরু করে। মানত, তাবিজ, কবজ, দোয়া, ফুঁ, পীর ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে ভাবে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আশা-ভরসা শেষাবধি তার অপূর্ণই থেকে যায়। এমনই নির্বোধ সে।

স্বপ্ন ভেঙে সারাক্ষণ শূন্যতা। কিছুতেই কিছু ভালো লাগে না। অর্থ, আনন্দ, সুসংবাদ ভালো লাগে না। বুকে নিরন্তর কষ্ট, অন্য সব সুখ নষ্ট করে দেয়। কষ্টগুলো খুঁজে বেড়ায় সেই পাথর, সেই খেলুড়ে, সেই অবিশ্বাসীকেই। হয়তো সে তখন আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় অন্য নারীর বিছানায় মজা করছে। তখন তাকে কে পায়? সব ধরাছোঁয়ার বাইরে সে তখন। হায় নারী! সেসবে তার খেয়ালই নেই! সে তবুও তাকেই দেখে তার অন্ধ চোখে।

হৃদয়ের কান্নাগুলোকে কোনও না কোনওভাবে গুছিয়ে তবুও, জীবন-যাপন করতে হয়। মাতৃহারা শিশু যেমন। যেভাবেই হোক সে বেঁচে থাকে। একদিকে হৃদয়কে শান্ত করা, অন্যদিকে পৃথিবীর মোকাবিলা। সকাল হলেই রাত অবধারিত। ভোর হবে রাতটাকে টেনে নিয়ে যেতে। এই দিন আর রাত টেনে নেয়াই তো নারীর কাজ।

খেলুড়ে পুরুষ বা অবিশ্বাসী স্বামীর নিষ্ঠুরতাগুলো যৌবনে যেরকম অনুভব হয়, মাঝ বয়সে তার অনুভূতি অন্যরকম। অনুভূতি, অনুভবের। অনুভব, তার কৈশোরের যৌবনের লাভক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট। অনুভব তার সুখ। অতীতের ভালোমন্দ, মধ্য বয়সে সে অন্য চোখে দেখতে পায়। দেখতে পায় দূর থেকে। দূর-যা অতীত। অতীত, যার সঙ্গে তার বিচ্যুতি ঘটেছে। অতীত, যা নেই তার বর্তমানে, নেই তার ভবিষ্যতে।

মধ্য বয়সে ক্রাইসিসের এই অনুভূতি সত্য। নিষ্ঠুর কখনো কখনো সুন্দরের সাক্ষী। এই ক্রাইসিসও সুন্দর। নিষ্ঠুর কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে বাস্তব। যেহেতু সে বাস্তব। বাস্তব সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে, কুৎসিত থেকে জীবনটাকে আলাদা করে। আমি এই অনুভূতির, একজন ধারক ও সেবক। মধ্য বয়স আমাকে দিয়েছে অনন্ত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির অফুরন্ত সম্ভার। নারীকে তার যৌবন আর বার্ধক্যের এই সন্ধিক্ষণে, তার সকল সাফল্য আর ব্যর্থতা উপলব্ধির আমন্ত্রণ জানাই, বার্ধক্যের পথে হাতেগোনা বাকি ক’বছর ভুলভ্রান্তি ছাড়া, সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে। বাঁচতে।

ঙ. দেবদাস ছবি দেখে বই পড়ে অনেক আগেই আমার এই অনুভূতি হয়েছিল যে, শরৎ বাবুর দেবদাস কল্পনার পৃথিবীতে শুধু একবারই জন্ম লয়। যে দেবদাসরা পার্বতীর বিরহে মরে যায়। এই কি আসল সত্য? সত্যিই কি নিরীহ প্রেমিক পুরুষ। এতই নিরীহ এতই প্রেমিক যে নিষ্ঠুর পাষাণ পার্বতীর জন্য সে মদ খেতে খেতে মরে যায়! এই পাষাণ পার্বতী যদি সত্য হয় যে পুরুষকে অমন কষ্ট দেয়, তবে আমি তার মৃত্যু কামনা করি। যে অমন সোনার মতন, নরম হৃদয়ের প্রেমে টইটম্বুর দেবদাকে কষ্ট দিয়েছে। আহা! এই পুরুষের জন্যে আমার কান্না পায়। দেবদা বললো–”পারু! পারবি তুই আজ রাতে আমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে?” পার্বতী বললো,”তা হয় না দেবদা!” আহা! কি ভালো এই দেবদাস! কি। মানবিক! কি বঞ্চিত! হায়!

না-না উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ এই দেবদাস বাস্তবের পুরুষ নয়। এই দেবদাস কখনো বাস্তবে জন্ম নেয় না। নিতে পারে না। কারণ ওরা পুরুষ। এরা শরৎ বাবুর গল্পের গুজব। মিথস বা ইউএফও। নাগরিক বিশ্বাসে এই দেবদাস সত্য নয়। রুচিতেও নয়।

তবে প্রকৃত অর্থে দেবদাস যদি কেউ হয়, সে নারী।

বাস্তবে, আমার দেবদাসী = শরৎ বাবুর দেবদাস।

বাস্তবে, আমার পুরুষ = শরৎ বাবুর পার্বতী।

বাস্তব কঠিন। আমার ইচ্ছে হয় শরৎ জেঠুর দেবদাস যদি কালেভদ্রে কখনও সত্যি হয়! অহো! বড়ো দুরাশা আমার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *