০৪. বাস্তবিক ও মানবিক

০৪. বাস্তবিক ও মানবিক

ধারালো, অর্থভারি শব্দের ফুলঝুরি ছড়িয়ে আর বুদ্ধির কড়চা নয়, বরং সহজ সরল গদ্যে মানুষের হৃদয়ে মাঝচল্লিশে যে ক্রাইসিসগুলো সহসা এসে হুমড়ি খেয়ে নড়িয়ে দেয় জীবনের খুঁটি। সেসব নিয়েই লিখতে বেশি ভালো লাগে। কারণ বিষয়টা দারুণ বাস্তব ও মানবিক। মানুষের হৃদয়ে যদি সাড়াই না জাগলো তাহলে সে লেখা লিখে লাভ কী? এবং এই কথাগুলো মানুষের কথা। সবার কথা। সব মানুষের। আমি চাই মানুষের কথা বলতে। তাদের দুঃখ-সুখ, তাদের হৃদয়। মাঝচল্লিশ, নারী আর পুরুষের জীবনে, মন ও হৃদয়ের ক্রান্তিলগ্ন। প্রশ্নবোধক বর্তমানকে ঘিরে, অতীতের সাথে ভবিষ্যতের ক্রান্তিকাল। যেখানে ভোর এবং সকালের আলোর সন্ধিক্ষণের মতো জীবনের দুটো সময় একটার মাঝে আরেকটা এসে মিলিয়ে আবার, দিনের আলোয় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মাঝচল্লিশ, অতীত এবং ভবিষ্যতের সম্মিলিত মঞ্চে নাটকের উৎসবের মাঝপথে, দৃশ্য বদলের অঙ্ক, সমাপ্তির প্রস্তুতির পথে।

জীবন মধ্যাহ্নের নাটকে, সময়ের সাথে সাথে যখন দৃশ্য বদল হয় তখন, শেষ অঙ্কে পৌঁছে বেশি সময়েই দেখা গেছে হাসির বদলে কান্না। শুকিয়ে যাওয়ার বদলে, রক্ত। মূল কারণ পরকীয়া। পরকীয়ার চেহারাই তাই। নীল-নীল মেঘ নদী। সুখ নেই। যাকে না গেলা যায়, না যায় উগরানো। শাখের করাত।

ব্যক্তিগত জীবনে সৃষ্ট সঙ্কটের জবাব দিতে গিয়ে পরকীয়ার মতো, বিকল্প জীবনের শান্তি খোঁজেনি সংসারে এমন সাধু বা সতী ক’জন আছে! সংসারের বাইরে দু’দণ্ড শান্তির পথ। এই সমস্যাগুলো তাদেরও, আমার এবং আপনার মতো, নিতান্তই আপন! তফাত শুধু, কেউ সাড়া দেয়। কেউ দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে সন্ধান করে করে এই বিষয় নিয়ে প্রচুর সাড়া পেয়েছি প্রকাশ্যে এবং নীরবে দুইভাবেই। কেউ কেউ বলে, অবশেষে জানতে পারছে এত খোলাখুলি। বলে এ যে আমারই কথা! আমাদের সমস্যা। আসলে সঙ্কটে আমরা সকলেই এক। একটি সঙ্কট লাগে, এক হতে গেলে। আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ, আর তাই আমাদের দুঃখকষ্টভারগুলোও একই তরঙ্গে বয়। কিন্তু উল্টো কেউ কেউ যে থুতুও ছিটোচ্ছে না তাও বলবো না। কিন্তু তাতে আমার কি কিছু এসে যায়? যায় না। কারণ ইটস অ্যা ফ্যাক্ট।

দিনের শেষে দিনের শুরুতে, মাস্টার আর স্লেইভ, যে যেখানেই থাকুক, তাদের। সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা হৃদয় এবং আবেগতাড়িত মানুষ। অনেক মানুষই তার হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির কাছে কারাবন্দি, বুদ্ধিহীন শিশু। মাস্টার বা স্লেইভ বিছানায় সবাই এক। সেখানে আমি আপনি সবাই ভালোবাসি, মানুষকে। যন্ত্রকে নয় প্রকৃত অর্থে, ভালোবাসি। যার উদাহরণ, একটি শিশুর জন্ম। মাস্টার বা স্লেইভ। এখানে কোনও কৃত্রিম বলে কিছু নেই। একেবারেই আদিম। স্পষ্টত খোলামেলা, অকৃত্রিম।

প্রেমবিহীন জীবন কোনও জীবনই নয়। বয়স্ক গাছেও আমের মুকুল ফোটে। চৌষট্টি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধার গর্ভে সন্তান আসে। প্রেম সর্বদাই রোমাঞ্চসঞ্চারী। চির যৌবনা, যে-কোনও বয়সেই। প্রেম, বয়সবিহীন এবং অমীমাংসিত। ”প্রেম–দূরান্বিত করে বার্ধক্য। আর প্রেমহীনতা বার্ধক্যকে করে ত্বরান্বিত।”

বিয়ের পরে প্রেম! সমাজ বলতেই পারে–সেই প্রেম, পরকীয়া যত্তসব নষ্টামো তার নষ্টামো। নোংরা। ছিঃ! কিন্তু হৃদয়ের অনুভূতির অপূর্ণ কোষগুলো যখন মস্তিষ্কের স্নায়ুতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে বলে, দাও প্রেমের সুধা। দাও জল। দাও ফল ও ফুল। তখন সে কি করবে! হৃদয়ের কাছে আমি কি ক্ষুদ্র নই! আপনি কি দরিদ্র নন? সেও কি ভিক্ষুক নয়! আমি, আপনি ও সে, অতঃপর হৃদয় নদীর তীরে আমরা সকলেই, শ্রীশ্রী বোকাঁচন্দর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যেমন। বৃষ্টির ভূতলের বদলে আকাশে পতনের আশা যেমন। পাহাড়ের চূড়া আকাশের বদলে উল্টো মাটিতে দেখার প্রত্যাশা যেমন! অবাস্তব, অসম্ভব। ঠিক তেমনি, মাঝ বয়সে হৃদয়ের হঠাৎ পরিবর্তন, চিনতে পারার ভুলে তার বিরুদ্ধচারণ, তা ক্ষতিকরই শুধু নয়, অন্যায়ও। নিজের প্রতি নিজের দারুণ ক্ষতি। সুতরাং পরকীয়াকে অস্বীকার করা বা অশ্লীল বলা কোনওটাই ঠিক নয়। স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনের মতোই, পরকীয়াও জীবনের উল্টো পিঠ, যেখানে প্রেম আছে। ভালোবাসা আছে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, কান্না, বিরহ, হাসি, সুখ, ঘর ও সন্তান আছে। পরকীয়া যদি হয়, তখন তা কোনও না কোনও কারণে বা যুক্তিতে হয়।

বিত্ত বা ক্ষমতা কিংবা যুগপৎ এ দুই থাকলে কি না সম্ভব! পৃথিবীর সর্বত্রই বিত্তবানদের দ্বৈত সংসার। অগণিত রম্যবালা তারা কিনে রাখে, কিংবা পারলে খাঁচায় পুষে রাখে দেশে-বিদেশে তাদের প্রাসাদগুলো বা প্রমোদ তরীতে চলে ঘরের রমণী ফেলে বাইরে বাইরে সুরা আর সাকির, দ্বৈত জীবনযাত্রা। তখন মনে হয় কেন বিত্ত হয় না! কেন ক্ষমতা হয় না! এমন মিডলাইফ ক্রাইসিস কেন হয় না, যখন ধর্ম এসে তাকে আরো সম্প্রসারিত করে সমৃদ্ধির হাত এভাবে বাড়িয়ে দেয়। বাহ! কি মজা। কি মজাদার এই রাজকীয় ক্রাইসিস। মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকা এসব দেশের শরিয়া আইনের সুযোগে বিত্তবান মুসলমান পুরুষদের সংসারে একাধিক স্ত্রী কোথায় নেই? আমরা তাকে পরকীয়া না বলে বলি, বহুবিবাহ। বহুবিবাহ কি বিয়ের অজুহাতে বিকল্প পরকীয়া নয়! যা শুধু পুরুষেরাই একাই ভোগ করে! বহুবিবাহ, পরকীয়ার একটা বিকল্প ব্যবস্থা। সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এবং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এসব দেশের বিত্ত বা ক্ষমতাবানদের জীবনে বহুবিবাহ এবং পরকীয়া, খোলাখুলি ব্যাপার! বহুবিবাহ, পরকীয়া, আরব বা আফ্রিকার মুসলিমদের জন্যে যে বিলাসিতার সম্ভার বিশ্বের কোথাও, নারীদেহ নিয়ে তার সমান্তরাল কিছু নেই। দুঃসংবাদ! নারীদের জন্যে নেই বহুবিবাহ। পরকীয়া করলে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দুঃসংবাদ দারুণ–দুঃসংবাদ।

দুর্বল হৃদয় এবং লোভী যৌনাঙ্গের কাছে, মানুষ বুদ্ধিহীন। সোজা কথা প্রেম ও কামের কাছে আমরা সবাই কোনও না কোনওভাবে পরাজিত। যার হৃদয়ে হঠাৎ সে আক্রমণ করবে, তার রক্ষে নেই। জবাব দিতেই হবে, হয় নিজের, না হয় অন্যের হৃদয় নিঃশেষ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *