০৩. মিডলাইফ ক্রাইসিসের রহস্য

০৩. মিডলাইফ ক্রাইসিসের রহস্য

ক. মিডলাইফ ক্রাইসিস নিয়ে আমার কেন এই কৌতূহল, সে নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন। আবার কিছু কিছু ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাহ! বেশতো, সাবজেক্টটা তো বেশ ভালো! যৌবন আর বার্ধক্যের সন্ধিক্ষণের এই যে একটা সময়, এখানে পৌঁছে মৃত্যুর। প্রথম অনুভব। একে কি অস্বীকার করা যায়! সুতরাং এটাই তো লেখার শ্রেষ্ঠ বিষয়। এবং খুব ভালো বিষয়। আমিও বলি! সেই তো! ওরাও বলে! অনেকেই বলে। এবং অবশেষে দেখি, সবাই বলে।

বয়ঃসন্ধি-কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ। এক অনন্য পরিবর্তন এবং অনুভূতি। বালক ও বালিকাদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন, যা শাশ্বত। যা দৃশ্যমান। এই সময়ে তাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন লক্ষণীয়। প্রথমে ভাঙে তাদের কণ্ঠস্বর। নারী ও পুরুষের শারীরিক চিহ্নগুলোর পরিমিত বর্ধন হতে শুরু করে। মেয়েদের ঋতু, ছেলেদের বীর্যপাত ধরনের জটিল বিষয়গুলো যা হরমোনের সঙ্গে জড়িত, বয়ঃসন্ধিতেই হয় তার প্রথম প্রকাশ। শরীরে প্রথম এক অন্যরকম পুলকের অনুভব। রোমাঞ্চ আর অনুভূতি। আর এই রোমাঞ্চ থেকে শরীর অনুসন্ধানের কৌতূহল সবই সম্ভব হয় বয়ঃসন্ধিকালে। বয়ঃসন্ধি আনন্দের। বয়ঃসন্ধি বসন্তের। এই সন্ধি যৌবনের আগাম উৎসব। আমি তাকে বসন্ত বলি যেখানে যৌবনের কুঁড়ি ধরে, কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে। রঙ লাগে। পাতা গজায়। যৌবনের প্রারম্ভে এই বয়ঃসন্ধি আমাদের যাচিত। নিজেকে ঘিরে এই মধুমাখা দুপ্রাপ্য সময় আমাদের বড় প্রাপ্তি। বয়ঃসন্ধির এমত কৌতূহল এবং ভালোলাগা খুবই কাম্য। কিন্তু তখন তা হয় গিয়ে যৌবন আর বার্ধক্যের বয়ঃসন্ধি! যেখানে পৌঁছে, যৌবনের সব জোয়ারে পড়ে ভাটা। সেটাও কি আমাদের কাম্য?

মিডলাইফ, সে-কি চিহ্ন, দুঃখের! সে-কি সুখের! সে-কী? কীসে? বার্ধক্যের প্রথম চিহ্ন দেখে আমরা কি ভয়ে চমকে উঠি না? মেয়েদের বেলায়, ঋতুতে অনিয়ম। যৌনাঙ্গে শুষ্কতা। হাঁটুতে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা। ব্যথা সর্বত্রই। ডাক্তার-ওষুধ, পথ্য। মাথায় পাকা চুল। দাঁতের মাঢ়িতে নেকলেসের মতো কালো কালো পাথর। পুঁজ, রক্ত, দুর্গন্ধ। দুই দাঁতের মধ্যে কালো অর্ধচন্দ্র গর্ত। ছেলেদের বেলায়, লিঙ্গ শিথিল হয়ে আসতে শুরু করে। রতিক্রিয়ার সময়ে পুরুষেরা ঠিক আগের মতো শক্তি পায় না। স্ত্রী, স্বামীকে দায়ী করে, কেন তুপ্তি হলো না। সুতরাং এত কিছু নিয়ে যে বয়স ও সময়টা জীবনে আসে, যৌবনের বিপরীত যা, তাকে নিয়ে লিখবো না তো কি নিয়ে লিখবো! তবে এখানেও ভাগাভাগির প্রশ্ন আছে। সমস্যা এই বয়সে কারটা বেশি! পুরুষ না নারীর। এর সোজাসাপটা উত্তর, নারীর। মেয়েদের মিডলাইফের সমস্যা অনেক অনেক গুণে বেশি। তার কারণ মেয়েদের রয়েছে সামাজিক সীমাবদ্ধতা। নারীর এত সীমাবদ্ধতা না থাকলে তার সমস্যাগুলো পুরুষের সমস্যার মতোই আবছা এবং অস্পষ্ট হতে পারতো।

প্রাপ্তি আর হারানোর এই বয়সে মেয়েদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শরীরে তার হরমোনের পরিবর্তন। তার মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়া। যাকে বলে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। ঋতুর পরিবর্তন, তার মনের ও চেহারার পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। মেনোপজের শুরুতে বা মধ্যখানে অনেক মেয়ে, এমনকি আত্মহত্যা করার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। ঋতুবন্ধের আগে যেমন লাগতো, মন বা শরীর কোনওটাই ঋতু বন্ধের পরে তেমন লাগে না। ইংরেজিতে তাকে বলে ব্লু ফিলিং। বাংলায় নীল অনুভূতি। অনেক কিছুই তখন ভীষণ অন্য রকম মনে হয়। কেমন যেন ভালো না লাগার একটা সার্বক্ষণিক অনুভূতি। ভয়, না চাইলেও বার্ধক্য দুয়ারে এসে গ্যাছে। ওপরের ঠোঁটের দু’পাশে নাকের বাঁশি বরাবর মাংসের লম্বা দুটো ভাজ। আর নিচের ঠোঁটের দুই পাশের কোণার মাংসে দুটো ভাঁজের আগাম আলামত। মুখশ্রীতে কি বিশ্রী একটা পরিবর্তন! থুতনি, নাক সবকিছুই একটু নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। ভাঙে। নাক সংলগ্ন চোখের দু’কোণে জমে ওঠে ক্লান্তিজনিত কালো ছাপ। প্রস্তুতি নিতে থাকে। চোখ দুটো ভিতরের দিকে যাওয়ার। চেহারায় ম্লান হতে শুরু করে যৌবনের সৌন্দর্য। গাল দুটো ভারি হয়। একটু অতিরিক্ত মেদ, এখানে সেখানে সবখানে বিশেষ করে পেটে যাকে বলে নেয়াপাতি ভুড়ি। আয়নায় দাঁড়িয়ে মনে হবে–সত্যিই! এই ভঁজ কি সত্যি! এবং তা শত চেষ্টা সত্ত্বেও, মিথ্যে হয় না। সব মিলিয়ে বার্ধক্যের একটা ছাপ, চোখে পড়ার মতো। শিথিল হয়ে আসে শরীরের চামড়া। ত্বক হারায় তার লাবণ্য। মিডলাইফ, শরীরের ও মনের আরেক ধাপ আগাম পরিবর্তনের পুঞ্জীভূত মেঘবর্ষণের সময়সীমা।

মেয়েদের আরেকটি অন্যতম জটিল সমস্যা তার জরায়ু। তার মাতৃত্বের পাসপোর্ট যা বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে এই বয়সে। যেমন টিউমার বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। ফলে অনেক সময়েই এই জরায়ুটা তাদেরকে ফেলে দিতে হয়। জরায়ু, একখণ্ড মাংসপিণ্ড, যা হরমোনের ভারসাম্যতা রক্ষার জন্যে জরুরি। ফলে, জরায়ু হারিয়ে নারীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যার আগমন হয়, যা সৃষ্টি করতে পারে ছোটখাট ছাড়াও,ভারসাম্যহীনতার সমস্যা।

খ. আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারী নির্যাতন অনেকটাই প্রথার সামিল। হবেই, অল্প বা বেশি। বিয়ের পর থেকেই নারীর ওপর পুরুষের যে নির্যাতন তার প্রভাব, সেখান থেকে সৃষ্ট তার মানসিক প্রতিক্রিয়া, এর সবই যৌবনের তারুণ্যে ও শক্তিতে কাটিয়ে ওঠা যায়। মধ্য বয়সে না পৌঁছুনো অবধি ক্রাইসিসগুলো ঠিক বোধগম্য হয় না। বোধ, যা তাকে এই বয়সে এসে জাগায়, তাড়না দেয়। ভাবায়, চেনায়। মধ্য বয়সে আমরা, কি-না ভাবি? যৌবনে যা ভাবতে পারি না, মধ্য বয়স আসে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে। সংসার-সন্তান, দায়িত্ব এবং তার প্রভাব। যা, মধ্য বয়সে পৌঁছে জন্ম দেয় একটি বোধের, যা নারীকে করতে পারে অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত! জীবনে সে কি করলো আর কি করলো না। সংসার করার লাভ ও ক্ষতি। এবং ক্ষতি যার বেশি সে ভাববে, সংসারের বিড়ম্বনা তার জীবন থেকে এই যে যৌবনের বছরগুলোকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল, পড়ে থাকা বাকি বার্ধক্য দিয়ে সে করবেটা কী? বার্ধক্য, তার কি কোনও কাজে লাগবে! একমাত্র অসুস্থ হওয়া, পরের গলগ্রহ, বা বৃদ্ধ হওয়া ছাড়া! অথচ তার বিদ্যা তার বুদ্ধি সবই ছিল। সে শিক্ষক হতে পারতো। ব্যাংকে চাকরি করতে পারতো। শিল্পী-সাহিত্যিক অনেক কিছুই হতে পারতো। পৃথিবীতে সংসার ছাড়াও করার বিষয় কি কিছু কম ছিল। তার মনে হতে পারে। কিন্তু সংসার ও সন্তান তাকে সে সময়, বা সুযোগ, কোনওটাই দেয়নি। এখন সময় আছে তবে মন নেই। স্বামীও তাকে যথেষ্ট সময় দেয়নি। কথায় কথায় সে করেছে অপার সন্দেহ, মৌখিক আর শারীরিক নির্যাতন। সুতরাং ”মিডলাইফের অনুভূতি, যদি হয় অতীতের অনুতাপ, তবে তার তাপ রূপান্তর হতে পারে ভবিষ্যতের ক্রাইসিসে।”

এখন সে আর যুবতী নয়। তবে বৃদ্ধও নয়। যদি এখান থেকে সে অন্য কোথাও যায় যাবে, শুধু বার্ধক্যের দিকেই। পরমায়ু শেষের দিকে। ভাটার দিকে। জোয়ারের উল্টো ভাটা। আর যৌবনের উল্টো, বার্ধক্য। তখন কৈশোর আর তার যৌবনের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি। তার মাসিক ঋতু যার শুরু হয় বয়ঃসন্ধিতে, যার আগমনে শরীরে যৌবনের জোয়ার নামে, যার উপস্থিতি মানে সে যুবতী, সেই অনন্য সম্পত্তিটুকুও তার এখানে এসেই হারিয়ে যায়। অর্থাৎ সে আর যুবতী নয়। এই অনন্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার খেসারত প্রচুর। প্রথমত, তার মানসিক ও শারীরিক জটিলতা। আর দ্বিতীয়ত, তার শরীরে মেনোপজের কারণে যে শুষ্কতার সৃষ্টি হয়, রসক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট অসুবিধায়। অনেক পুরুষই তার নারীর শরীর ত্যাগ করে বা অবহেলা করে। অনেকেই পরকীয়া, কেউ কেউ অন্য বিয়ে। মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সে এবার বার্ধক্যের দুয়ারে। নারীর মেনোপজ, যার প্রতিক্রিয়া কেড়ে নিতে পারে রাতের ঘুম। জীবনের মায়া।

কালজয়ী শেক্সপিয়রের ভাষায় জীবন একটা রঙ্গমঞ্চ। আর সকলেই এখানে অভিনেতা। আমরা সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা এখানে পৌঁছেই ঠিক করে ফেলি নাটকের শেষের অঙ্ক কেমন হবে। জীবনটা কী ক্রাইসিস! নাকি ক্রাইসিস নয়। মিডলাইফে এসে, মানুষ প্রথম অনুধাবন করে নিজের সঙ্গে শরীর, মন ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। মিডলাইফ, একটি চরম সত্য। এই নিষ্ঠুর চরম সত্য উপলব্ধির জন্যে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত একটি সময় ও বয়সের একটি কেন্দ্রবিন্দুই হলো মিডলাইফ। সে আসে অনেক অনেক ক্রাইসিস সঙ্গে নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *