জার্নি বাই কার

জার্নি বাই কার

আমি, নেড়া, গজা, ভজা আর ন্যাদা– এই পাঁচজনে মিলে আমরা বাবা ষণ্ডেশ্বরের মন্দিরে পিকনিক করতে গিয়েছিলুম। স্টেশন থেকে নেমে আরও দুমাইল রাস্তা, কিন্তু জায়গাটি ভারি খাসা। বাবা যণ্ডেশ্বরের একটা পুরনো মন্দির, সামনে বাঁধানো ঘাটওয়ালা দিঘি, দিঘির চারিধারে অনেক গাছ-টাছ, নানারকমের পাখি-টাখি। সেখানে আধপোড়া খিচুড়ি আর আধসেদ্ধ তরকারি রান্না করে খেয়ে, হাঁড়ি-ফাড়ি ভেঙে যখন আমরা আবার স্টেশনের দিকে যাব-যাব ভাবছি, তখন হঠাৎ ভঁপ—ভঁপ–ভঁপ।

দেখি, সামনের খোয়া-ওঠা বিচ্ছিরি রাস্তাটায় একটা কালো কালো গাবদা চেহারার ঝরঝরে পুরনো মোটরগাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। যে-ভদ্রলোক গাড়িটা চালাচ্ছিলেন, তিনি গলা বের করে আমাদের জিজ্ঞেস করছেন, খোকা তোমরা কী করছ এখানে?

ভদ্রলোকের চোখে কালো চশমা, চেহারা বকের মতো। রোগা, মাথার চুলগুলো যেমন খাড়া-খাড়া, নাকটা আবার পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা। দেখে একদম ভালো লাগে না। ন্যাদা গম্ভীর হয়ে বললে, আমরা এখানে পিকনিক করতে এসেছিলুম।

ভদ্রলোক বললেন, ভেরি গুড।

গজা আরও ভারিক্কি চালে বললে, আমরা এখানে ছুটির দিনটা এঞ্জয় করতে এসেছিলুম।

ভদ্রলোক এবারে বললেন, ভেরি ভেরি গুড। তা, তোমরা কোথায় থাকো?

আমরা বললুম, চাঁইবাসা।

ভদ্রলোক ভারি খুশি হয়ে বললেন, আরে আমিও তো চাঁইবাসায় থাকি।

নেড়া বললে, তা যান। মোটরে চেপে গড়গড়িয়েই চলে যান। চাঁইবাসা যেতে কারও কোনও বারণ নেই।

–আহা, আমি তো যাবই।–তিনটে পোকা-ধরা দাঁত বের করে ভদ্রলোক হাসলেন : কিন্তু তোমরা যাবে না?

–যাব বই কি। সন্ধ্যে ছটার ট্রেন ধরব আমরা।

তার মানে এখন দু মাইল রাস্তা ঠ্যাঙাবে, তারপর আরও এক ঘণ্টা বসে থেকে রেলে চাপবে? আর রেলে যা ভিড়। হয়তো তিনজন উঠবে, দুজন উঠতেই পারবে না। তা ছাড়া গাড়ির কামরাও কি কম বিপজ্জনক? চোর, জুয়াচোর ও পকেটমার নিকটেই আছে জানো তো?

ভজা বললে, আজ্ঞে জানব না কেন–সবই জানি। কিন্তু যেতে তো হবেই।

–নিশ্চয় যেতে হবে। তা আমার এই গাড়িটায় চেপে বসলে কেমন হয়?

–আপনার গাড়িতে?

ভদ্রলোকের টিকটিকির মতো শুকনো মুখের ভেতর থেকে আবার তিনটে পোকা-খাওয়া দাঁত বেরিয়ে এল : একসঙ্গে মিলে বেশ গল্প করতে করতে যেতে পারি। তোমাদের এক পা-ও হাঁটতে হবে না আর সন্ধের আগেই পৌঁছে যাবে চাঁইবাসায়। চোর, জুয়াচোর, পকেটমার কেউ তোমাদের কিছুই করতে পারবে না।

অবশ্য করবারও কিছু নেই, কারণ পাঁচজনের ফিরে যাওয়ার রেলভাড়া ছাড়া ট্যাঁক আমাদের গড়ের মাঠ। তবু মোটরে যাওয়ার সুযোগ পেলে আর কে ছাড়ে? যদিও গাড়িটা দেখতে তেমন ভালো নয়, কীরকম কালো আর ঝরঝরে, তবু মোটরে চড়ে রাজার হালে যেতে কী আরাম! লোকের মুখের সামনে দিয়ে ভোঁক-ভোঁক করে ধোঁয়া আর ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছি সবাই তাকিয়ে থাকবে, সামনে থেকে গোরু-ছাগল পালিয়ে যাচ্ছে, গেঁয়ো মানুষগুলো বলছে- সর সর, মোটর-গাড়ি আসছে। খুব কায়দা করে যাওয়া– যাকে বলে!

ভদ্রলোক আরও মিঠে গলায় বললেন, উঠে এসো– উঠে এসো। বেশ গল্প করতে করতে আরামসে চলে যাওয়া যাবে।

-বেশ, চলুন তবে।

ভদ্রলোক অমনি হাত বাড়িয়ে ক্যাঁচাত করে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন, আর আমরা টপাস-টপাস করে তক্ষুনি উঠে পড়লুম। দুজন সামনে, তিনজন পেছনে। আমি আর ন্যাদা ভদ্রলোকের পাশেই বসে পড়লাম। আর অমনি ঘ্যারর-ঘ্যারর ঘড়াং-ঘড়াং আওয়াজ তুলে গাড়িটা চলতে শুরু করে দিলে।

অবিশ্যি– সিট-টিটগুলো তেমন ভালো নয়, গদিগুলোতে তাপ্পি মারা, বসে যে খুব আরাম হচ্ছিল তা-ও নয়। তবু মোটর-গাড়ি ইজ অলওয়েজ মোটরগাড়ি। ভেতরে নানারকম আওয়াজ হচ্ছে, থেকে-থেকে শীতের কাঁপুনি-লাগা বুড়ো মানুষের মতো আচমকা ঝেঁকে উঠছে- তবু বিকট হর্ন বাজিয়ে, চারিদিকের লোক, গোরু-ভেড়া কুকুর-ছাগল তাড়িয়ে বেশ যাচ্ছিল। ন্যাদা কাব্য করে বললে, জার্নি বাই এ কার। কী চমৎকার!

আমি বললুম, হুঁ, অতি মনোহর।

ভজা বললে, চারিদিকে অপরূপ তরুরাজি।

গজা বললে, কী মনোরম বিহঙ্গসমূহ!

মনোরম বিহঙ্গ তেমন দেখা যাচ্ছিল না, এদিক-ওদিক দুটো-একটা চড়ুই শালিক ফুড়ৎ-ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু মোটরগাড়িতে চাপলে এসব ভালোভালো কথা বলতে হয়, নইলে প্রেস্টিজ থাকে না। নেড়া তো দস্তুরমতো ভাবে মাতোয়ারা হয়ে বিচ্ছিরি বেসুরো গলায় গানই ধরে দিলে :

অরুণ প্রাতের তরুণদল
চল রে চল রে চল

সেই টিকটিকির মতো মুখওলা কালো চশমা-পরা ভদ্রলোক সেই-যে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে কথা বন্ধ করলেন, আর তাঁর সাড়াশব্দ নেই। খালি ঝকরঝকর করে গাড়ি চালাচ্ছেন আর ভ্যাঁপাক-ভ্যাঁপাক করে হর্ন দিচ্ছেন। মাইলপাঁচেক বোধ হয় এই রকম কাটল। তারপর

তারপর সামনে একটা শুকনো নদী। রাস্তাটা তার মধ্যে গিয়ে নেমে তারপর আবার একটা উঁচু ডাঙায় গিয়ে ঠেলে উঠেছে। গাড়িটা ঝাঁকুনি খেতে-খেতে গড়গড়িয়ে নদীতে বেশ নেমে গেল, এক আঁজলা জল আর একরাশ নুড়ি পেরিয়ে নদীর এপারেও চলে এল, তারপর উঁচু ডাঙাটার সামনে এসেই ক্যাচাং। মানে ডেড-স্টপ!

আমরা বললুম, কী হল মশাই, থেমে গেল যে!

আবার পোকা-খাওয়া তিনটে দাঁত বের করে ভদ্রলোক হাসলেন, এই ইয়ে– ক্র্যাচটা ঠিক ধরছে না মনে হচ্ছে। তোমরা যদি নেমে একটু

-মানে, ঠেলতে হবে? আমি ব্যাজার হয়ে জিজ্ঞেস করলুম।

নইলে, ইয়ে মানে, গাড়িটা অতখানি উঠতে পারবে মনে হচ্ছে না। মানে, আমি স্টিয়ারিং ধরছি, তোমরা পাঁচজন রয়েছ, ঠেলে একটু তুলে দাও

নিশ্চয়-নিশ্চয় বলে গজা লাফিয়ে পড়ল। আমাদের দলে ওই সব চাইতে জোয়ান, জিমনাস্টিক করে, এ-সব ঠেলাঠেলির ব্যাপারে ওর বেশ উৎসাহ আছে।

কী করা, আমরাও নামলুম। ভদ্রলোক বিনি পয়সায় মোটর-গাড়িতে চাপাচ্ছেন, তাঁর জন্য অন্তত এটুকু না করলে কি আর ভদ্রতা থাকে।

অতএব মারো জোয়ান হেঁইয়ো! আউড় ঘোড়া হেঁইয়ো। শাবাশ জোয়ান হেঁইয়ো।

খাড়া পাড়ি, ঠেলতে গিয়ে পাঁচজনের স্রেফ কালঘাম ছুটে গেল। মনে হল, পেটের আধপোড়া খিচুড়ি আর আধসেদ্ধ তরকারি একেবারে গলায় উঠে আসছে। তবু জয় বাবা যণ্ডেশ্বর বলে চিৎকার ছেড়ে আমরা গাড়িটাকে একেবারে পাড়ির ওপর তুলে দিলুম।

ঘাম-টাম মুছে, হাঁপিয়ে-টাপিয়ে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি– ভদ্রলোক হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। বললেন, আরে আরে, উঠছ কেন? আমি তো চাঁইবাসা যাব না– যাচ্ছি ট্যাঁকখালি স্রেফ অন্যদিকে।

তার মানে? ন্যাদা চেঁচিয়ে উঠল : তবে আমাদের গাড়িতে ওঠালেন কেন?

নইলে পাড়ির ওপর ঠেলে তুলত কে? বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে তিনটে পোকারা দাঁতে হেসে ভদ্রলোক বললেন : গাড়ি ঠেলবার জন্যে কি আর তোমরা সঙ্গে আসতে? এখন বাঁ দিকে মাইল তিনেক হাঁটলে একটা স্টেশন পাবে, আর যদি অরুণ প্রাতের তরুণদল গাইতে-গাইতে জোর পায়ে হেঁটে যাও, তা হলে ঘণ্টা তিনেকের ভেতরে চাঁইবাসাই পৌঁছে যাবে। টা—টা–

গজা গর্জন করে বললে, জোচ্চোর। আমাদের চাঁইবাসায় পৌঁছে না দিয়ে– বলেই, লাফিয়ে উঠতে গেল গাড়িতে। কিন্তু তার আগেই গজার মুখে একরাশ দুর্গন্ধ ধোঁয়া আর এক খাবলা ধুলো ছড়িয়ে ঝকর-ঝকর ঝকাং ঝকাং করতে করতে সেই ঝরঝরে গাবদা গাড়িটা ত্রিশ মাইল স্পিডে জঙ্গলের রাস্তায় হাওয়া হয়ে গেল।

আর অনেক দূর থেকে যেন একবার ভেসে এল থ্যাঙ্কিউ–টাটা—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *