উপন্যাস
গল্প
1 of 2

তিন আনার আমের জন্যে

তিন আনার আমের জন্যে

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর হারুবাবু ঝোলা-লাগানো আঁকশি দিয়ে একটার পর একটা পাকা আম পাড়ছেন। খাসা আমগুলো! এত দূরে দাঁড়িয়েও আমের গন্ধে আমার প্রাণমন উদাস হয়ে যাচ্ছে।

আর-একটা সোনালি রঙের আমকে ঝুড়িতে সাজিয়ে রেখে হারুবাবু বললেন, কী হে প্যালারাম, অমন জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছ কী–অ্যাঁ?

আমি বললুম, কিছু না।

–কিছু না?–হারুবাবু এমন হেঁ হেঁ করে হাসলেন যে, আমার পিত্তি পর্যন্ত জ্বলে গেল; মিথ্যে নজর দিয়ে কষ্ট পাচ্ছ কেন শুনি? এ-আমগুলো বাজারে পাঠাব–টাকায় ছটা করে। বিক্রি হবে।

–হোক না বিক্রি–আমার কী? আমি ব্যাজার হয়ে জবাব দিলাম।

–তোমার কী? তা বটে। বেল পাকলে কাকের কিছু আসে যায় না বটে। হারুবাবুর মুখে আবার সেই গা-জ্বালানো হাসি।

আমার অপমানবোধ হল। হাঁড়ির মতো মুখ করে বললুম, ও-আম আমি খাই না।

–পেলে তো খাবে? যাও–যাও–মিথ্যে এখেনে দাঁড়িয়ে থেকে আর কষ্ট পেয়ো না–বলে আবার আঁকশি দিয়ে আর-একটা পাকা আম নামাতে লাগলেন।

আমি গেলুম না। বাগান হারুবাবুর বটে, কিন্তু রাস্তাটা তো মিউনিসিপ্যালিটির। সুতরাং আমি যতক্ষণ ইচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকব, যত খুশি নজর দেব। হারুবাবু বললেই যাচ্ছি আর কি। যেতে বয়ে গেছে আমার।

বিচ্ছিরি কিপটে এই লোকটা! টাকার আণ্ডিল–অথচ প্রাণে ধরে একটা পয়সা খরচ করবে না। আমাদের এই শহরে ভিখিরিরা পর্যন্ত ওঁর দোরগোড়ায় যায় না–পাছে ঝুলি ফেঁসে যায়। সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে বেরিয়ে আসে স্রেফ দুটো নয়া পয়সা। তা হলেই বোঝো।

হারুবাবু আমাকে আম খেতে দেবেন এ-আশা আমার কোনও দিনই ছিল না। কিন্তু অমন খাসা টুকটুকে আম–গন্ধে চারদিক ম-ম করছে, প্রাণভরে দেখতে দোষটা কী! আমিও তাই দেখছিলুম আর মনে মনে ভাবছিলুম, একটা নিরেট কাঁচা আম যদি অনেক উঁচু থেকে টপাক করে ওঁর টাকের ওপর পড়ে–বেশ হয় তা হলে!

এক-একটা করে পাকা আম হারুবাবুর আঁকশির ঝোলায় নামছে, আমি হাঁ করে দেখছি ঠিক তখন

রামছাগলটা কখন গুটিগুটি পায়ে ঝোপের আড়াল থেকে এগোচ্ছিল আমরা কেউই দেখতে পাইনি। কিংবা ছাগলের গতিবিধি কে-ই বা দেখতে পায়! ছোট ছোট চারটে পা, একগাল দাড়ি আর দু ইঞ্চি একটা ল্যাজ নিয়ে চিরকাল ওরা আমার কাছে এক দারুণ রহস্য। ওরা পৃথিবীর সব জিনিস খেয়ে থাকে, কিন্তু বাঘ ধরে খেতে পারে না কেন এবং বাঘেই বা পালটা ওদের ধরে খায় কেন–এ-সমস্যার সমাধান আমি কখনও করতে পারিনি।

হঠাৎ হারুবাবুর হায় হায় চিৎকারে আমার চমক ভাঙল।

ধরো ধরো প্যালারাম নিলে–আম নিয়ে গেল–তিন আনার আম নিয়ে গেল একটা–

তাকিয়ে দেখি সেই চিররহস্যময় ছাগল। একটা আম গালে পুরে সে ছুটছে, তার মিহি দাড়ি ফুরফুর করে উড়ছে হাওয়ায়, দু ইঞ্চি ল্যাজটা রেলের টিকিটের মতো উঁচু করে মেল ট্রেনের মতোই সে ধাবমান।

ধরো প্যালারাম–তারস্বরে ডাকলেন হারুবাবু। ছুটতে ছুটতে আমায় বললেন, ধরতে পারলে কেটে খাব ব্যাটাকে-তোমাকেও ভাগ দেব।

এটা ভালো প্রস্তাব। আমারও উৎসাহ এসে গেল।

কিন্তু ছুটন্ত ছাগলকে বিশেষ করে রামছাগলকে কে ধরতে পারে উড়ন্ত পাগল ছাড়া? আর পাগল কখনও উড়তে পারে কিনা তাতেও আমার সন্দেহ আছে। কারণ কোনও উড়ন্ত পাগল আমি কোনওদিন দেখিনি।

অতএব আধ মাইলখানেক ছোটবার পরে ছাগল যখন দিগন্তে বিলীন হল, তখন পেছন ফিরে হারুবাবু আবার হাহাকার করে উঠলেন।

গেল গেল প্যালারাম–সর্বস্ব গেল আমার।

কেন গেল, কোথায় গেল, কবে গেল?-ছাগল ধরবার আশায়, মাংসের লোভে আমি তখনও ছুটছি হাঁপাতে হাঁপাতেই জানতে চাইলুম : কোন্ ট্রেনেই বা গেল?

ধুত্তোরি!-হারুবাবু আমার ঘাড় চেপে ধরলেন : চুলোয় যাক তোমার ট্রেন। ফেরো–ফেরো! গোরু–গোরু এসে পড়েছে।

–কোত্থেকে পড়ল?

–তোমার মুণ্ডু থেকে। হারুবাবু আমাকে টানতে টানতে আবার বাগানের দিকে ছুটলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন : পালা–পালা–হেট হেট। গেল প্যালারাম-আমার সব গেল।

তখন আমি দেখতে পেলুম। আমরা যখন ছাগলের পেছনে ছুটেছি, সেই সময় গোরু এসে পড়েছে আমের গন্ধে। আর নিশ্চিন্তে ল্যাজ দিয়ে মাছি তাড়াতে-তাড়াতে সোজা এগোচ্ছে হারুবাবুর আমের ঝুড়ির দিকে।

হারুবাবু আবার গগনভেদী চিৎকার করলেন : হেট হেট-পালা–পালা

অতদূরের হাঁকে গোরুর কিছুমাত্র বিকার দেখা গেল না। পরিষ্কার দেখতে পেলুম, আমের ঝুড়ির ওপর তার মুখখানা গভীর মনোযোগের সঙ্গে নেমে গেল।

হারুবাবু একটা খাবি খেলেন।

–এক গ্রাসেই তো তিনটে খেয়ে নেবে–অ্যাঁ। হেট–হেট-ভাগ–ভাগ

বলেই মাটি থেকে কী কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিতে চাইলেন গোরুর দিকে। কিন্তু সেটা গোরুরই খানিকটা কাঁচা গোবর–ঘাস হারামি করতে রাজি হল না। উলটে হারুবাবুরই হাতে-টাতে লেগে গেল।

উঃ কী গন্ধ! ধরো প্যালারাম–ধরো। ওই ওই আবার খাচ্ছে। ওফ আরও তিনটে! পুরো এক টাকার আম খেয়ে নিলে যে!–হারুবাবু ডুকরে উঠলেন।

আমরা এসে পড়েছি দেখে গোরুও ছুট লাগাল।

ধরো, গোরু ধরো-প্যালারাম—কুইক!

গোরু ধরে কী হবে?–আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলুম : ওরও মাংস খাবেন নাকি?

–ওয়াক থু রাম রাম। হিঁদুর ছেলে না আমি?–গোরুকে তাড়া করতে করতে হারুবাবু বলললেন, খোঁয়াড়ে দেব ওটাকে–খোঁয়াড়ে। অন্তত আটগণ্ডা পয়সা উশুল হবে। তা থেকে দু আনা তোমাকেও দেব। ছোটো ছোটো–

দু আনা! তাই বা মন্দ কী। খামকা দু আনা পয়সাই বা আমায় দিতে যাচ্ছে কে? আবার গোরুর পেছনে ছুট লাগালুম দুজনে।

কিন্তু ছুটন্ত ছাগলকে যদি উড়ন্ত পাগল ছাড়া কেউ ধরতে না পারে, তবে দৌড়বাজ গোরুকে কে ধরতে পারে ধড়িবাজ গোঁয়ার-গোবিন্দ ছাড়া? ছাগল ছুটেছিল মেল ট্রেনের মতো, গোরু ছুটল জেট প্লেনের মতো। পেছনের ল্যাজটা তার জয়ধ্বজার মতো উড়তে লাগল।

ধর—ধর—ধর–

ধরা গেল না। গোরুকে ধরে খোঁয়াড়ে দেবে–গোঁয়ার ছাড়া এমন গোঁ আর কার আছে?

অগত্যা গোঁ গোঁ করতে করতে ফিরে এলেন হারুবাবু। দু আনার আশা ছেড়ে আমাকেও ফিরতে হল। গোরুতে কটা আম খেয়েছে কে জানে। ঝুড়ির অনেকখানিই সাফ।

হারুবাবু সোজা চোখ বুজে আমগাছতলায় শুয়ে পড়লেন।

গেল প্যালারাম, কমসে কম দু টাকার আম আমার গেল।

কী আর করি। একটা ডাল কুড়িয়ে হারুবাবুর মাথায় হাওয়া দিতে লাগলুম।

আরও একটা জিনিস আমি দেখেছি। একটা কুকুর হারুবাবুর একপাটি নতুন চটি নিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু কুকুর ধরে লাভ কী? তার মাংস খাওয়া যায় না তাকে খোঁয়াড়েও দেওয়া যায় না বোধহয়। আর পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত জুতো নিয়ে পলাতক কুকুরকে কে-ই বা ধরতে পেরেছে? কোনও উড়ন্ত পাগলও নয়–কোনও ধড়িবাজ গোঁয়ারগোবিন্দও নয়।

তা ছাড়া শকটা একটু সামলে নিন হারুবাবু। এই মুহূর্তে দুঃসংবাদটা দিয়ে ওঁর অপঘাত ঘটিয়ে কী হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *