উপন্যাস
গল্প
1 of 2

একটি খুনের ঘটনা

একটি খুনের ঘটনা

গোয়েন্দা বা অপরাধ কাহিনীর সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ঘটনার আশপাশে যারা তয়েছে, তাদের প্রত্যেককেই সন্দেহের আওতার মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু চারদিকের সাক্ষ্য প্রমাণে নিশ্চিতভাবে যাকে অপরাধী বলে মনে হয়, তাকে যদি নিরপরাধ ধরে নিয়ে, তার অনুকূলে তদন্ত শুরু করা হয়, তা হলে কী রকমটা দাঁড়ায়?

সোভিয়েত দেশে তদন্তের প্রণালী আজকাল এই। ওখানকার একজন ইন্সপেক্টরের জবানবন্দিতে একটা ঘটনা শোনাই। গল্পটা–না এটা গল্প নয়, সম্পূর্ণ সত্য কাহিনী–একটু সংক্ষেপ করে তোমাদের বলছি।

মেরু অঞ্চলে গবেষণার জন্যে গিয়েছিলেন দুজন অধ্যাপক। এদের একজন অল্পবয়সী, আর একজন বুড়োমানুষ। দুজনেই নামজাদা বিজ্ঞানী, দুরন্ত পণ্ডিত, কিন্তু সম্পর্কটা একেবারে সাপে-নেউলে।

পণ্ডিতে পণ্ডিতে যা হয়। এর মত উনি মানেন না। এঁর থিয়োরির উনি প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মতভেদ এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যে ইনি ওঁর নাম শুনলে একেবারে জ্বলে যেতেন। অথচ, অবস্থাচক্রে দুজনকে একই সঙ্গে পাঠানো হল গবেষণা করতে।

সেই ধু-ধু তুষারের দেশে দুই বৈজ্ঞানিক একসঙ্গে তাঁবু ফেলে থাকেন, গবেষণা করেন। আর একজন সহকারী আছেন এঁদের সাহায্য করেন। তিনি দেখেন, রাতদিন দুই পণ্ডিতে সমানে তর্কাতর্কি খেয়োখেয়ি চলছে।

বুড়ো বৈজ্ঞানিক-ধরা যাক প্রোফেসর একস, একটা চিঠিতে লিখছেন : আমার সঙ্গে এই বানরটাকে কেন যে পাঠানো হল। ওকে আমি এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারি না–দেখলেই আমার পিত্তিসুদ্ধ জ্বালা করে।

আর ছোকরা বৈজ্ঞানিক–প্রোফেসর ওয়াই–তাঁর ডায়েরিতে লেখেন : বুড়ো ক্রমশই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সব সময়ে ওর একগুয়েমি। মধ্যে-মধ্যে আগুন ধরে যায় আমার মাথায়। একদিন নিশ্চয় আমি ওকে খুন করব।

অবস্থা যখন এই রকম, তখন একদিন খবর এল, প্রোফেসর একস্ খুন হয়েছেন।

ব্যাপারটা কীরকম?

দুই বৈজ্ঞানিক এবং তাঁদের সহকারী একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন হাঁস শিকারে। একটা জলার একধারে দাঁড়িয়েছিলেন একস– কিছু দূরে ওয়াই হাঁস খুঁজছিলেন। কী একটা জিনিস আনতে সহকারী চলে গিয়েছিলেন তাঁবুতে।

সহকারী যখন ফিরে আসেন, তখন একটা বন্দুকের আওয়াজ তাঁর কানে যায়। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, শিকারে বন্দুকের আওয়াজ হবেই।

কিন্তু ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি।

প্রোফেসর একস্ পড়ে আছেন মাটিতে। হাতের বন্দুকটাও পড়ে রয়েছে তাঁর পাশে। তাঁর বাঁ চোখে শিকারের ছুরি-অর্থাৎ হান্টিং নাইফটা একেবারে বাঁট পর্যন্ত ঢোকানো। চোখের ভেতর দিয়ে সে-ছুরির ফলা একেবারে মস্তিষ্ক পর্যন্ত চলে গেছে। মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ।

আর তাঁর পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে প্রফেসর ওয়াই।

কী করে হল?

শুকনো মুখে প্রোফেসর ওয়াই বললেন, কিছুই জানি না। আমি ওদিকে হাঁস তাক করছিলুম। হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজে এদিকে ফিরে দেখি, প্রোফেসর একস্ মাটিতে পড়ে আছেন। এসে দেখি, এই কাণ্ড।

সেই নির্জন তুষারের দেশে এই দুটি প্রাণী ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর এ তো হত্যাকাণ্ড! দুজনের ভেতরে যে বিশ্রী সম্পর্ক ছিল, তাতে এমন কাজ আর কে করতে পারে প্রোফেসর ওয়াই ছাড়া?

অতএব একদিন প্রোফেসর ওয়াই এসে আমাদের অফিসে উপস্থিত হলেন।

বললুম, প্রোফেসর, আপনি যা জানেন তা বলুন।

নতুন কথা তিনি কিছুই বললেন না। আমি বন্দুকের আওয়াজ শুনে ফিরে দেখি, উনি পড়ে আছেন। চোখের ভেতরে ছোরা বেঁধানো। আর আমি কিছুই জানি না।

প্রোফেসর ওয়াই শীর্ণ মুখে হাসলেন। বললেন, জানি, কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি তৈরি হয়েই এসেছি সেজন্যে। পড়ুন আমার ডায়েরি।

ডায়েরিটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। পাতায় পাতায় সেই এক কথা। “অসহ্য–বুড়োটা অসহ্য। কী করে এই পাগলের হাত থেকে নিস্তার পাই? আজ খাবার টেবিলে–আঃ, লোকটাকে খুন করতে পারলে আমার শান্তি হয়”। পড়েই মনে হবে, কোনও সন্দেহ নেই, বিশুদ্ধ, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

আচ্ছা মানুষ এই প্রোফেসর। নিজের মৃত্যুবাণ যেন তুলে দিচ্ছেন আমার হাতে।

আমি চুপ করে রইলুম। প্রোফেসর বললেন, আমি বুঝতে পারছি আমার কী হবে। আমার আর কোনও ভাবনা নেই। আপনি অনুগ্রহ করে কেবল এই চিঠিটা আমার স্ত্রীকে দিয়ে দেবেন।

আমি বললুম, চিঠির দরকার নেই। আপনি বাড়ি যান।

তার মানে? ছেড়ে দিচ্ছেন আমাকে?–প্রোফেসর যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

বললুম, বিনা প্রমাণে আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি না। আপাতত আপনার নামে আমাদের কোনও ওয়ারেন্ট নেই। আপনি যান।

আসলে আমার খটকা ধরিয়েছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্টের একটি কথা।

অস্বাভাবিক–অমানুষিক শক্তিতে ছুরিটা চোখের মধ্যে বিঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

অস্বাভাবিক–আনুষিক শক্তি। প্রোফেসর ওয়াই অবশ্যই খুব সবল স্বাস্থ্যবান পুরুষ, কিন্তু অমানুষিক শক্তি। কথাটা ক্রমাগত পাক খেতে লাগল ঘরের ভেতরে।

আমি ব্যালিস্টিক একসপার্ট–অর্থাৎ গোলাগুলি-বিশারদদের ডাকলুম।

আচ্ছা, মেরু অঞ্চলের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বন্দুকের টোটা ফেঁপে যায় তো?

তাঁরা বললেন, স্বাভাবিক।

সেই টোটা বন্দুকে ভরতে তখন তো অসুবিধে হয়?

তা হতেই পারে।

আচ্ছা বলুন–এ-অবস্থায় শিকারি কী করবেন?

একটা কিছু দিয়ে টোটাটাকে ঠেলে ভেতরে দেবার চেষ্টা করবেন।

হান্টিং নাইফের হাতল ব্যবহার করতে পারে লোকে?

কেন পারবে না?–একজন বললেন, সেটা কোমরেই থাকে, আর তার কথাই মনে পড়বে সকলের আগে।

তা হলে–আমি জিজ্ঞেস করলুম, ধরুন যদি হাষ্টিং নাইফটা এমন হয় তার হাতলটা যেমন-তেমন করে তৈরি, তার পেছনে এক টুকরো লোহার ডগা বেরিয়ে রয়েছে? আর টোটাটাকে যদি জোরে ঠেলে দেওয়া যায়, তা হলে সেটা ট্রিগারের পিনের মতো কাজ করতে পারে?

তাঁরা বললেন, নিশ্চয়।

মনে করুন–আমি আবার জিজ্ঞেস করলুম, সে-ক্ষেত্রে একজন ছুরির বাঁট দিয়ে টোটাটাকে জোরে ঠেলে দিলে। লোহার ডগাটা ট্রিগার পিন হয়ে যেই কাট্রিজে ঘা মারল, অমনি গুলি বেরিয়ে গেল। তখন বন্দুকটা তো গুলি ছোটবার বেগে পেছনে এসে ধাক্কা মারবে?

হ্যাঁ, তাই নিয়ম। আগ্নেয়াস্ত্র মাত্রেই ব্যাকপুশ দেবে।

খুব জোরে?

স্বাভাবিক।

তা হলে ছুরির ফলাটা তো তখন উলটো দিকে রয়েছে। বন্দুকটা যেই হাতে ধাক্কা দিলে, অমনি ছুরিটা ফলাটা তীরবেগে গিয়ে চোখে বিঁধতে পারে?

নিশ্চয় পারে। যদি অবশ্য সেটা চোখ বরাবর থাকে।

অস্বাভাবিক–অমানুষিক জোরে বিঁধে যেতে পারে?

বন্দুকটা চোখের কাছে থাকলে তাই সম্ভব।

ধন্যবাদ, আর আমার কিছু জানবার নেই।

তা হলে এই আমার কেস। হত্যা নয়, বিশুদ্ধ অ্যাকসিডেন্ট। ওয়াই বলেছেন, গুলির আওয়াজ শোনবার আগে একবার যখন তিনি এদিকে তাকিয়েছিলেন, তিনি দেখেছিলেন, অধ্যাপক একস্ যেন তাঁর বন্দুকটা লোড করবার চেষ্টা করছেন। অতএব দুই আর দুয়ে চার।

পরম উল্লাসে খবরটা জানালুম আমার ওপরওলাকে। তিনি একটু হাসলেন। বললেন, তোমার থিয়োরি বেশ ভালো। কিন্তু একটা মস্ত ফাঁক রয়ে গেল যে ওর ভেতরে।

আমি তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম।

তোমার থিয়োরি যদি সত্যি হয়, তা হলে প্রোফেসর একস্ ডান হাতে ছুরি আর বাঁ হাতে বন্দুক ধরবেন। আর সেক্ষেত্রে বন্দুকের ব্যাক পুশে ছোরাটা ডান চোখেই বিঁধে যাবে। কিন্তু ওটা বিধেছে বাঁ চোখে, সেটা খেয়াল রেখো।

সব মাটি। গেল আমার সাধের থিয়োরি।

আমি বিভ্রান্তের মতো বেরোলুম। কোনও থই পেলুম না। তারপর হঠাৎ মনে হল, প্রোফেসর একস তো ন্যাটাও হতে পারেন! অর্থাৎ ডান হাতের বদলে বাঁ হাত ব্যবহারের অভ্যাস তো থাকতে পারে তাঁর?

আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে ছুটলুম তাঁর বাড়িতে। গেলুম তাঁর সহকর্মীদের কাছে।

অনুমান নির্ভুল। প্রোফেসর একস্ ন্যাটাই ছিলেন। বাঁ হাতই তিনি ব্যবহার করতেন।

কিন্তু জট কেটেও কাটে না।

অভিযানে প্রোফেসর একস-এর যে জিনিসপত্রের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে-অর্থাৎ যা-যা তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন, তার প্রত্যেকটার বিবরণ পাচ্ছি, কিন্তু ছুরিটার তো কোনও সন্ধান নেই। কটি পেনসিল নিয়েছেন তারও খবর আছে–ছুরিটার উল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না!

তা হলে কোথা থেকে এটা এল

এমন হতে পারে যে, যাত্রার শেষ মুহূর্তে ওটা কিনে থাকবেন। কিন্তু কোথায়? শহরের কোনও দোকানে আমি ওধরনের হান্টিং নাইফের কোনও সন্ধান পেলুম না।

শেষে কি আমার ঘাটে এসে নৌকো ডুববে? আমি কি তখন জোর করে বলতে পারব, ওঁকে খুন করার জন্যে ওটাকে মাডার উইপন হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাননি প্রোফেসর ওয়াই?

সুতরাং আমি বেরিয়ে পড়লুম শেষ চেষ্টায়।

যে-পথ দিয়ে ওঁরা এগিয়ে গেছেন, তার প্রতিটি শহরে আমি ওই রকম একটি ছুরির দোকান খুঁজতে লাগলুম। হাজার হাজার হান্টিং নাইফ আমি দেখলুম, দেখিয়ে দেখিয়ে হয়রান হয়ে গেল দোকানদারেরা–কিন্তু ঠিক ওই জাতের ছুরি কোথাও পেলুম না।

এবার এসেছি সর্বশেষ শহরে। এখান থেকেই ওঁরা মেরু অঞ্চলে রওনা হয়ে গেছেন। কিন্তু না–এখানেও ও-ছুরির সন্ধান মিলল না।

হতাশ হয়ে যেদিন ফিরে আসব, সেদিন চলছিলুম, শহরের একটা পুরনো অঞ্চল দিয়ে। শ্রীহীন ছোট ছোট দোকান দুধারে, কেনা-বেচাও খুব কম। তার মধ্যে হঠাৎ ওই তো! ওই ছোট্ট দোকানটিতে ঠিক ওই ধরনের ছুরি ঝুলছে দু-তিনটে ওই জিনিস।

এক বুড়ো তার মালিক। সেই ওগুলো তৈরি করে।

হাতে নিয়ে দেখলুম, যেমন-তেমন কাঠের বাঁটে তৈরি সব সাদামাটা ছুরি। আর প্রায় প্রত্যেকটার পেছনেই একটু করে লোহার মুখ বেরিয়ে রয়েছে।

বুড়ো বললে, শিকারের সিজনে ওগুলো অনেক বিক্রি করি আমি।

আচ্ছা–অমুক মাসে, বুড়ো এক প্রফেসর কি এসেছিলেন দোকানে? তিনি কি কিনেছিলেন একটা? এই রকম চেহারা, এই রকম গোঁফ

দাঁড়ান–দাঁড়ান। প্রোফেসর একটু খিটখিটে, ভুরু কুঁচকে রয়েছেন, এই তো? দাঁড়ান-খাতাটা খুলি।

খাতায় পাওয়া গেল নাম। প্রোফেসর একস।

এই হল কেস। আদালতের রায় বললে, এটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা।

প্রোফেসর ওয়াইয়ের মৃত্যুর আয়োজন তৈরিই ছিল। কেউ তাঁর সাক্ষী ছিল না, তাঁর কথা বিশ্বাস করবার মতো কেউ ছিলেন না, বরং বাড়তির মধ্যে ছিল একস-এর চিঠিগুলি আর ওয়াইয়ের নিজের সেই মারাত্মক ডায়েরি।

কিন্তু নিরপরাধের মুক্তির সূত্রও থাকে। সে-সূত্রও ছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্টের মধ্যে : অস্বাভাবিক, অমানুষিক শক্তিতে ছোরাটা চোখের মধ্যে বিঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *