উপন্যাস
গল্প
1 of 2

চুল কাটার ভয়ে

চুল কাটার ভয়ে

সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছিলুম। অল্পবয়সী পরামাণিক ছেলেটি একবার আমার দিকে তাকিয়ে, মুচকে হেসে আর-একজন খরিদ্দারকে বললে, আপনি একটু বসুন, দাদা! আমি এঁরটা পাঁচ মিনিটেই সেরে দিচ্ছি।

তার মানেটা বুঝতে পারছ? আমার তো মাথাভর্তি মস্ত টাক; অল্প দু-চারগাছা চুল যা আছে তা ছাঁটাই করতে কী-ই বা আর সময় লাগবে? কাজেই অন্য খরিদ্দার এসময়টুকু নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারে।

সেলুনওলা আজকে আমার টাকের দিকে তাকিয়ে যাই বলুক, ছেলেবেলা আমার মাথার চেহারাই ছিল অন্য রকম। রাশি রাশি ঝাঁকড়াঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, ছাঁটবার পনেরো দিন যেতে না যেতে ধামার মতো ফুলে উঠত। সে-চুল এত ঘন যে আমাদের ভগবান-দা বলত : ছোট দাদাবাবুর চুল কাটতে আমার কাঁচি ভেঙে যায়।

ছেলেবেলায় এই ভগবানদা ছিল আমাদের বিভীষিকা।

সে যে কতদিন থেকে আমাদের বাড়িতে কামাচ্ছে আমরা কেউ জানি না। বয়সে বাবার চাইতেও ঢের বড়, রোগা লম্বা মানুষটা, মাথার চুল সব প্রায় শাদা হয়ে এসেছে, চোখে নিকেলের ফ্রেমের চশমা। বাবা তাকে দাদা বলতেন, আমরাও বলতুম। আর ভগবানদার নাতি ভোলা ছিল আমাদের বন্ধু, স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত আমাদের সঙ্গে।

ভোলা আমাদের বন্ধু হলে কী হয়, তার ঠাকুর্দাকে আমি আদৌ পছন্দ করতুম না। সবাই বলত, ভগবানদা খুব ভালো লোক, কিন্তু আমার কখনও সেকথা মনে হত না। ছেলেবেলায় চুল ছাঁটবার কথা মনে হলেই আমার গায়ে জ্বর আসত। আর বাড়িতে নিয়ম ছিল, প্রত্যেক মাসে অন্তত দুবার অর্থাৎ একটা করে রবিবার বাদ দিয়ে চুল আমাদের ছাঁটতেই হবে–বাবা কিংবা বড়দা দাঁড়িয়ে থেকে তার তত্ত্বাবধান করবেন।

রবিবারের ছুটির সকালে সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা, তা বলে বোঝাবার নয়। বাড়ির সামনেই মাঠ ছিল, দেখতুম সেখানে ছেলেদের দঙ্গল জমেছে, খেলা চলছে, হইহই চিৎকার উঠছে। তার ভেতরে ভগবানদার কাঁচির সামনে সেই-যে ঘাড় পেতে দিয়ে বসে আছি, আছিই। খুচখাচ-কুচ-কাটাস চলছেই, মাথা এদিক-ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে প্রাণ বেরিয়ে গেল, ভগবানদার আর কিছুতেই পছন্দ হয় না।

আঃ–এত নড়া-চড়া করো কেন? চুপ করে বোসো–নইলে চুল খারাপ হয়ে যাবে। এই একটু–আর একটু–এই হয়ে গেল।

এই হয়ে গেল মানে আরও ঝাড়া পনেরো মিনিট।

চুল কাটা শেষ হল তো ঠাকুরমার পাল্লায়। তখন ইঁদারার সামনে বসে স্নান করা, সাবান ঘষা–আরও প্রায় একটি ঘণ্টা। তার মানে, রবিবারের সকালটা একেবারেই বরবাদ।

ভগবানদার জ্বালায় এইভাবে জেরবার হতে হতে শেষ পর্যন্ত আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এক রবিবার না হয় চুল কাটা বাদই রইল, না হয় চুল আধ ইঞ্চি বেশি বেড়েই গেল–এমন কোন্ মহাভারতটা অশুদ্ধ হয় তাতে? আমার যদি অসুবিধে না হয়, ঘাড় কুটকুট না করে, তোমাদের কী? কিন্তু কথাটা না বলা যায় বাবাকে, না বোঝানো যায় দাদাকে। আর ভগবানদা তো কাঁচি হাতে তৈরি হয়ে বসেই রয়েছে, চুলের ঝুঁটি একবার পাকড়ে ধরতে পারলেই হল।

ছিঃ দাদাবাবু, চুল কাটব না বলতে হয়? মাথার চুল বড় থাকলে লোকে যে পাগল বলবে।

বলুক।

দুষ্টুমি করতে নেই দাদাবাবু, ঠাণ্ডা হয়ে বোসো। দশ মিনিট। আজ ঠিক দশ মিনিট বাদেই তোমায় ছেড়ে দেব।

তারপরেই মাথা একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে। একবার এখানে খ্যাঁচ, আর একবার সেখানে খুচ। মানে ঠিক সেই একটি ঘণ্টা। একদিন প্রতিজ্ঞা করলুম, সামনের রবিবারে ভগবানদাকে আমি ফাঁকি দেবই, যেমন করে হোক।

বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা বৃথা, কারণ খিড়কির দিকে মা-ঠাকুরমার নজর। সদর দরজার সামনে পাহারাওলার মতো বড়দা হাজির। বৈঠকখানা দিয়েও বেরুনো যায়, কিন্তু সেখানে বাবা কাগজ পড়ছেন। অতএব তিনটে রাস্তাই বন্ধ।

কিন্তু ভগবান স্বয়ং পথ দেখিয়ে দিলেন।

আমাদের পশ্চিমের ঢাকা বারান্দায় কতগুলো পুরনো ফার্নিচার আর প্যাকিং বাক্সের স্তূপ পাহাড়ের মতো জড়ো হয়ে ছিল কতকাল ধরে। কেউ সেখানে যেত না–ওর ভেতরে কী আছে আর কী যে নেই, তাও বোধহয় কারও জানা ছিল না। কিন্তু যে রবিবারে ভগবানদা আসবে, তার আগের দিন আমি আবিষ্কার করলুম ওর ভেতরে পালিয়ে থাকবার চমৎকার জায়গা আছে একটা।

আমার একটা মার্বেল গড়িয়ে গিয়েছিল ওদিকে। তার সন্ধানে দু-তিনটে কাঠের বাক্স টেনে সরাতেই দেখি একটা মস্ত তক্তপোশ রয়েছে ওখানে। ভাঙাচুরো জিনিসপত্রগুলো তারই ওপরে ডাঁই করা। তক্তপোশটার তলায় যে-কেউ দিব্যি লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারে, বাইরে কাঠের বাক্সগুলোর আড়াল থাকলে দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, কেউ সন্দেহও করতে পারবে না ওখানে মানুষ আছে। হাত দিয়ে দেখলুম, ধুলো-ময়লাও বিশেষ নেই।

ভগবানদা সাধারণত আসত বেলা আটটা নাগাদ। আমাদের জলখাবারের পাট মিটে যেত সাড়ে সাতটার মধ্যেই। সেদিনও সকালের বরাদ্দ রুটি আর সুজি গিলে নিয়ে আমি ফাঁক খুঁজতে লাগলুম। তারপর যেই দেখলুম পশ্চিমের বারান্দার দিকে কেউ নেই, তৎক্ষণাৎ বাক্স সরিয়ে  

আঃ কী আরাম। মনে হচ্ছে যেন কোন পাতালপুরীতে চিতপাত হয়ে শুয়ে আছি। আবছা অন্ধকারে নানা রকম পুরনো জিনিসের গন্ধ-যেন আমার চারদিকে যখের ধন লুকনো রয়েছে, হাত বাড়ালেই আমি খুঁজে পাব। অল্প-অল্প গরম লাগছিল–তা সত্ত্বেও ওইভাবে লুকিয়ে থাকতে বেশ একটা রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর কেউ কোনওদিন আর আমাকে খুঁজে পাবে না।

তারপর ভগবানদার গলা শোনা গেল বাড়ির বাইরে। আমি কান খাড়া করলুম। তারও খানিক পরে যা শুরু হল সেইটেই আসল মজার।

আমার নাম ধরে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি। গেল কোথায়?

এই তো এখানেই ছিল।

না-বাইরে তো বেরোয়নি।

তা হলে ছেলে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?

খোঁজ–খোঁজ। আমার নাম ধরে ডাকাডাকি। মেজদা বললে, নিশ্চয় কোন্ ফাঁকে বাচ্চুদের বাড়ি পালিয়েছে। আমি ধরে আনছি।

কান ছিঁড়ে ফেলে দেব।–বড়দা লাফাতে লাগল।

আর এই সব হইচই হট্টগোলে আমার দারুণ হাসি পেতে লাগল। লুকিয়ে লুকিয়ে খিকখিক করে হাসতে-হাসতে পেটে ব্যথা ধরে গেল, তারপর কখন এক ফাঁকে

অনেকগুলো খরখরে পা যেন ছুরির ফলার মতো আমার নাক-মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কী বিশ্রী গন্ধ সেই সঙ্গে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম।

আরশোলা দলে দলে আরশোলা। আমার নাক-মুখ কানের ওপর দিয়ে তারা মার্চ করে বেড়াচ্ছে।

আমি তক্তপোশের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। এদিকে আমার সর্বাঙ্গে আরশোলা, ওদিকে ঠাকুরমা চিৎকার করে কাঁদছেন : নিশ্চয় ছেলেধরায় নিয়ে গেছে, নইলে নদীতে গিয়ে পড়েছে। তা না হলে

তখন আর ভগবানদার ভয় নয়, আরশোলার হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই এক লাফে আমি ছিটকে পড়লুম বাইরে। কাঠের বাক্সের স্তূপে যেন সাইক্লোন ঘটে গেল।

এই যে আমি–এই যে—

দুহাতে গায়ের আরশোলা ঝাড়তে ঝাড়তে আমি লাফাতে লাগলুম : এই যে–এই যে ওরে সর্বনেশে ছেলে! কোথায় ছিলি?–কাঁদতেকাঁদতে ঠাকুরমা ছুটে এলেন আমার দিকে। বাবা এলেন, মা এলেন, বড়দা-মেজদা-বোনেরা সবাই দৌড়ে এল।

কোথায় ছিল, কোথায় ছিল?

কিন্তু সেটা গল্প নয়। আসল ব্যাপার হল, ভগবানদাকে আসতে হল পরের দিন, মানে সোমবারেই।

আর এবার তার কাঁচির সামনে ইচ্ছে করেই আমি ঘাড় পেতে ছিলুম– মানে, না দিয়ে উপায় ছিল না। আরশোলারা বাগে পেয়ে এমন ভাবে আমার চুল কেটে নিয়েছিল যে সে-যাত্রা সোজা কদম ছাঁট দিয়েই স্কুলে যেতে হল আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *