উপন্যাস
গল্প
1 of 2

অথ নিমন্ত্রণ ভোজন

অথ নিমন্ত্রণ ভোজন

পিসতুতো ভাই ফুচুদার সবই ভালো, কেবল নেমন্তন্নের নাম শুনলেই তাঁর আর মাথাটা ঠিক থাকে না।

দিব্যি আছেন ভদ্রলোক, খাচ্ছেন দাচ্ছেন, বাঁশি বাজাচ্ছেন। কোনও ঝামেলা নেই। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন রাঘব মুখুজ্যের বাপের শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন করে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফুচুদার ভাবান্তর। দু’দিন আগে থেকে খাওয়া কমিয়ে দিলেন, তারপর শুরু করে দিলেন ডন আর বৈঠকী। শরীর ভালো করা চাই, খিদেটাকে চাগিয়ে তোলা চাই। পরস্মৈপদী লুচি-পান্তুয়া যত বেশি পেটস্থ করে আনা যায় ততই লাভ!

বর্ণনাটা শুনে মনে হতে পারে লোকটি ইয়া তাগড়া জোয়ান–বুকের ছাতি বুঝি বাহান্ন ইঞ্চি! কিন্তু ভুল–একদম ভুল। আমি শ্রীমান প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে–পালাজ্বরে ভুগি, বাসকপাতার রস আর চিরতা খেয়ে প্রাণটাকে ধরে রেখেছি। সুতরাং যারা আমাকে দেখনি তারাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ আমার চেহারাটা কী রকম। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবে না–সেই আমি স্বয়ং শ্রীমান প্যালারাম–ল্যাং মেরে ফুচুদাকে চিৎপটাং করে দিতে পারি। অর্থাৎ ফুচুদা রোগা একেবারে প্যাঁকাটির মতো–ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথাটি দেখতে একটা খেজুরগাছের আগার মতো–আর পিলেতে ঠাসা পেটটা দেখলে মনে হয় কোনদিন সেটা বেলুন হয়ে ভদ্রলোককে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

এই তো চেহারা–কিন্তু আহারের ক্ষমতাটি অসাধারণ। অত বড় পিলের সাম্রাজ্য পেটে নিয়ে লোকটা লুচি-মণ্ডাগুলো যে কোথায় রাখে এ একটা গুরুতর ভাবনার বিষয়। ক্লাসে অঙ্কের পরীক্ষায় আমি প্রায়ই গোল্লা খাই। তবু অনেক চিন্তা করে আমার মনে হয়েছে ফুচুদার পেটের পরিধি নির্ধারণ করার চাইতে স্কোয়াররুটের অঙ্ক কষাও সোজা।

এই ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়ে একবার একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম।

জীবনে অনেক দুঃখই ভুলেছি। এমন কি গত বছর খেলার মাঠে কাটা-ঘুড়ির পিছনে ছুটবার সময় একটা নেড়ী কুকুর যে আমার বড় সাধের নতুন আলবার্ট জুতোজোড়া আমসত্ত্ব ভেবে চিবিয়ে খেয়েছিল, তা পর্যন্ত ভুলে যেতে রাজি আছি। কিন্তু ফুচুদার সঙ্গে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গিয়ে যে সাংঘাতিক দাগা পেয়েছিলাম মরে গেলেও সে আমি ভুলব না।

থাকি মফস্বল শহর দিনাজপুরে–পড়ি জেলা ইস্কুলে। এমন সময় আমাদের দু’ভাইয়ের পৈতে হল। আমি প্যালা, আর মেজদা ন্যালা কানে বেলকাঁটার ফুটো নিয়ে নাক টিপে প্রাণায়াম করি আর পঞ্জিকা খুলে খুলে খুঁজি কবে সায়ংসন্ধ্যা নাস্তি!

তোমাদের ভেতরে যাদের পৈতে হয়েছে তারা নিশ্চয় জানো যে, এই সময় ব্রাহ্মণবটুদের দামটা কী রকম বেড়ে যায়। পাড়ার বুড়িদের যত ফলদানের ব্রত–সে তো আমাদের বাঁধা! দ্বাদশজন ব্রাহ্মণ-ভোজনেও আমাদের ডাক পড়বেই। বেশ সুখেই ছিলাম সন্দেহ কী।

আমাদের এক আত্মীয় আছেন–নাম শ্যামানন্দ চৌধুরী। থাকেন দিনাজপুরের পরের স্টেশন বিরোলে সেখানে যেন তাঁর কী একটা ব্যবসা আছে।

হঠাৎ শ্যামানন্দবাবুর শখ হল, তিনি তাঁর বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধে জন কয়েক ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন।

বিরোল জায়গাটি ছোট। একটি বাজার, খান কয়েক দোকান–একটি থানা। অনেক কুড়িয়ে বাড়িয়েও ন’জনের বেশি ব্রাহ্মণের সন্ধান সেখানে পাওয়া গেল না। সুতরাং শ্যামানন্দবাবু দিনাজপুরে এলেন বাকি তিনজন ব্রাহ্মণের খোঁজে। আর যোগাড় করলেন কাকে কাকে বলো তো? আমি প্যালা, মেজদা ন্যালা, আর পিসতুতো ভাই ফুচুদাকে।

সেদিন বিকেলেই দেখলাম, উঠনে দাঁড়িয়ে ফুচুদা প্রাণপণে মুগুর ভাঁজছেন। সে একখানা দেখবার মতো জিনিস। পাড়ার যত কাক সেদিন সেব্যাপার দেখে কা কা করে মাইল তিনেক দূরে পালিয়ে গেল। বেগুনখেতে বাঁশের মাথায় কেলে হাঁড়ি দেখলেও তাদের এত ভয় করে না।

পরদিন সকাল থেকেই নামল মুষলধারে বৃষ্টি।

সারা বছরেও বোধ হয় কোনওদিন এমন বেখাপ্পা বৃষ্টি নামেনি। আকাশের চৌবাচ্চাটা কী করে সেদিন ফুটো হয়ে গিয়েছিল কে জানে–হড়-হড় করে জল যে পড়তে লাগল তার আর বিরাম নেই।

আর অবস্থা দেখে ফুচুদার চোখ দিয়েও অমনি করে বর্ষা নামবার উপক্রম। আহা হা–বিরোলের কই মাছ বিখ্যাত–তার তিনটেতে সের হয়। তা ছাড়া আগের দিন বিকেলে শ্যামানন্দবাবু দিনাজপুর থেকে যে-পরিমাণ বাজার করে নিয়ে গেছেন তাতে ওখানে যে দস্তুরমতো একটা রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু যা বৃষ্টি–স্টেশনে যাওয়া তো দূরের কথা, বাড়ি থেকে বেরুনোও অসম্ভব।

শুধু ফুচুদা কেন–আমাদের মনটাও খারাপ হয়ে গেল।

দশটার ট্রেনে আমাদের যাওয়ার কথা। নটা বাজতে না বাজতেই ফুচুদা ছটফট করতে লাগলেন। ইচ্ছেটা–ওই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়বেন।

আর থাকতে না পেরে ফুচুদা দরবার করতে গেলেন বাবার কাছে।

-মামা, ট্রেনের সময় তো হল।

বাবা ভয়ানক রাশভারী লোক–ছুটির দিন বসে বসে পড়েন মোটাসোটা ফিলজফির বই, আর সে সময় কেউ বিরক্ত করলে ভয়ঙ্কর চটে যান। ফুচুদার কথা শুনে তিনি বই থেকে মুখ তুললেন, চশমাটা নামিয়ে আনলেন নাকের একেবারে ডগাটাতে, শান্তভাবে প্রশ্ন করলেন, তাতে কী হয়েছে?

বিরোল তো যেতেই হয়—

বাবা বললেন, হুঁ।

ব্রাহ্মণ-ভোজনের ব্যাপার, গেলে ভদ্রলোকের

মুখের কথাটা লুফে নিয়ে বাবা বললেন, ভদ্রলোকের স্বৰ্গত বাপের গলায় পিণ্ডি সেঁধোবে না–এই তো? তা নাই সেঁধোল–এই বাদলার দিনে একবেলা উপোস করে থাকলেও তাঁর ক্ষতি হবে না। ভেবেছ, এই বৃষ্টির ভেতরে আমি তোমাদের বেরুতে দেব? তারপর ভিজে তিনজনের নিমোনিয়া হলে ডাক্তারের কড়ি গুনবে কে? যাও–এখন ঘরে বসে লজিক পড়ো গে। বিকেলে আমি পরীক্ষা নেব।

হাঁড়ির মতো মুখ করে ফুচুদা পালিয়ে এলেন।

ছোট বোন আনি অত্যন্ত ফাজিল। বললে, ফুচুদা–একটা কোলাব্যাং মেরে উঠোনে চিৎ করে রাখো–এখুনি বৃষ্টি ধরে যাবে।

ফুচুদা দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, যা-যা—

কিন্তু কপাল ভালো, হঠাৎ ঝাঁ করে বৃষ্টিটা থেমে গেল।

আর কথাবার্তা নেই-ফুচুদা আমাদের দু ভাইকে বগলদাবা করে সোজা ছুট দিলেন ইস্টেশনের দিকে। দশটার ট্রেনটা আধঘণ্টা আগেই বেরিয়ে গেছে আরও আধঘণ্টা পরে এগারোটার গাড়ি পাওয়া গেল। আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে ফুচুদা বললেন, দেখলি তো ট্রেনটা কী রকম পেয়ে গেলাম। আরে, শাস্ত্রে কী বলেছে জানিস? ব্রাহ্মণ-ভোজনের নিমন্ত্রণ যে অবহেলা করে, তাকে চৌষট্টি হাজার রৌরব আর কুম্ভীপাক নরকে বাস করতে হয়।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কোন শাস্ত্রে আছে ফুচুদা?

ফুচুদা গম্ভীর হয়ে বললেন, পেটার্থ-সংহিতায়। লিখেছেন অগস্ত্য মুনি। দুনিয়ার সেরা পেটুক–এক চুমুকে সমুদ্রটাকেই জলপান করে ফেলেছিলেন।

ট্রেনটা সবে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়েছে এমন সময় আবার বৃষ্টি।

ফুচুদা বললেন, তা হোক। খায়েঙ্গা ইয়া মরেঙ্গা। সাইক্লোন হলেও কেউ আজ আর ঠেকাতে পারবে না। আহা হা-বিরোলের কই আর রাধিকাপুরের চমচম–একখানা মণিকাঞ্চন যোগ যা হবে।

উস্-উস্ করে জিভে জল টেনে নিয়ে বাজখাঁই গলায় ফুচুদা বিকট রাগিণী ধরলেন :

“যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত
পান্তুয়া শত শত,
আর ধানের মতন হ’ত মিহিদানা
বুঁদিয়া বুটের মত,
আমি গোলা ভরে তুলে রাখতাম গো—

দশ-বারো মিনিটের পথ। বিরোল স্টেশনে এসে যখন আমরা নামলাম তখন প্রবল বৃষ্টিতে চারিদিকের কোনও কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। মোটা মোটা ধারায় অশ্রান্তভাবে জল পড়ছে আর বৃষ্টির রেণু যেন ঘন কুয়াশার মতো আকাশ বাতাস মাঠ-ঘাটকে ঢেকে ফেলেছে। কোনওখানে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

সঙ্গে ছাতা ছিল। কিন্তু সে বৃষ্টি কি আর ছাতায় বাগ মানবার পাত্র! রাস্তাও কম নয়–স্টেশন থেকে প্রায় একটি মাইলের ধাক্কা!

আমরা বললাম, ফুচুদা–যা বৃষ্টি, একটু স্টেশনে দাঁড়িয়ে গেলে হয় না?

ফুচুদা বললেন, বৃষ্টি! বৃষ্টি তো হয়েছে কী? বর্ষাকালে আকাশ থেকে জল পড়বে না তো পাকা তাল পড়বে নাকি? চল চল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, আরও দেরি করে গেলে বাকি ন’টা বামুনে সব কটা কই মাছ আর সবগুলো চমচম বেমালুম মেরে দেবে। খানিকটা ঝোল আর খানিক রস ছাড়া আর কিছু জুটবে না তা হলে। নে–বেরিয়ে পড়। গায়ে একটু জলের ছিটে না লাগতেই ছাগলের মতো ঘরের দাওয়া খুঁজে বেড়াস, জীবনে কী করে উন্নতি করবি–অ্যাাঁ?

তা বটে। জীবনে উন্নতি করাটা খুবই দরকার বলে শুনেছি। কিন্তু এমন প্রাণান্তিক নেমন্তন্ন না খেলে সে-উন্নতি যে হতে পারে না, এ কথা কখনও শুনিনি। তবু বেরুতেই হল।

ফুচুদা বললেন, দুর্গা-দুগা–দুর্গে দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু বৃষ্টির শব্দে দেবী বোধহয় ফুচুদার কথা ভাল করে শুনতে পাননি। দুর্গতিনাশিনী না শুনে শুনেছিলেন বোধ করি ‘দুর্গতি-দায়িনী’। তাই পরমানন্দে দুর্গা আমাদের দুর্গতি শুরু করে দিলেন।

রেললাইনের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় তার যা শ্রী হয়েছে ভাষায় তার বর্ণনা সম্ভব নয়। হাঁটু-প্রমাণ কাদার তলায় জুতো চালান হয়ে যেতে লাগল। পা উঠে এল জুতো এল না। কাদা হাতড়ে হাতড়ে–যেমন করে লোকে জিওল মাছ ধরে, তেমনি করে আমরা জুতো উদ্ধার করতে লেগে গেলাম।

বৃষ্টি পড়ছে সমানে। ছাতার ভেতর দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া আসছে– কই মাছের সঙ্গে চমচমের মতো মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে। জামাকাপড়ের আধ ইঞ্চিও শুকনো নেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর বৃষ্টির জলে আমরা হিহি করে কাঁপছি।

ফুচুদা বুক ঠুকে বললেন, ইসমে ক্যায়া হ্যায়? ধৈর্য চাই বুঝলি ধৈর্য চাই। দ্যাখ–বিদ্যেসাগর মশাই

নীতিমুলক গল্পটা শেষ হওয়ার আগেই ফুচুদার আর্তনাদ উঠল : আরে–আহা-হা

দমকা হাওয়ায় ফুচুদার ছাতাটা বেমালুম উলটে গেছে। আরে মোলো

প্রাণপণে ছাতায় চাপ দিয়ে ঠিক করতে গিয়েই–মট মট। দু দুটো শিকের গয়াপ্রাপ্তি।

ধ্যাত্তোর–যাত্রাটাই খারাপ–এতক্ষণে ফুচুদার স্বীকারোক্তি, কিন্তু দমবার লোক নন তিনি। বললেন, তা হোক। খাওয়াটা ভালোই হবে কী বলিস? বিরোলের কই আর রাধিকাপুরের চম–

কিন্তু বাকি ‘চম’টা বলবার আগেই দম–একেবারে আলুর দম। ফুচুদা কাদায় ভূত হয়ে গাত্রোত্থান করতে না করতেই আবার অধঃপতন! এঁটেল মাটিতে পা আর দাঁড়ায় না।

দৃশ্যটা উপভোগ করব কী–ততক্ষণে দু’ভাই–আমি প্যালা, আর মেজদা ন্যালা, দুজনেই আছাড় খেয়ে পড়েছি। পাঁচ মিনিট ধস্তাধস্তির পরে তিনজনে যখন উঠে দাঁড়াতে পারলাম, তখন কেউ কাউকে চেনা তো দূরের কথা নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারছি না। একটু আগেই প্যালারাম ছিলাম তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু এখন আমি কে? কাদায় যা অবস্থা হয়েছে, তাতে তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এখন আমিও হতে পারি, মেজদা ন্যালাও হতে পারি–এমন কি ফুচুদা হওয়াও আশ্চর্য নয় বোধহয়!

নিজের নিজত্ব সম্বন্ধে সজাগ হবার আগেই আবার পতন, আবার উত্থান, পুনরায় পতন। কখনও পর পর তিনজন, কখনও একসঙ্গে দুজন, কখনও বা তিনজনই একসঙ্গে। পতন-অভ্যুদয়ের সে কী বিচিত্র লীলা! আঘাত খেতে খেতে এখন আর ব্যথা পাচ্ছি না–আছাড় খাওয়াটা যেন নেশার মতো ধরেছে আমাদের। কারও মুখে আর কোনও কথা নেই, পড়ছি, উঠছি আবার পড়ছি। যেন জীবনে আছাড় খাওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

খানিক পরে পায়ের নীচে আবার শক্ত জমি পাওয়া গেল। আর মুখ খুলল ফুচুদার : উঃ–কার মুখ দেখে আজ বেরিয়েছিলাম রে! একেবারে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিলে। আচ্ছা–এর শোধ তুলব, কই

কথাটা শেষ হল না–সঙ্গে সঙ্গে যেন ভোজবাজি। ধপাস ঝুপ করে একটা শব্দ আর ফুচুদা ভ্যানিশ।

আমি প্যালা আর মেজদা নালা–আমরা দু’ভাই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না! সত্যিই ফুচুদা নেই, কোথাও নেই! রাস্তার পাশে একটা ছোট নালা দিয়ে বর্ষার জল যাচ্ছে–শুধু তার ওপরে একটা ছাতার বাঁট দেখা যাচ্ছে। আর স্থলে জলে অন্তরীক্ষে-উঁহু–কোথাও নেই। ফুচুদা একেবারে হাওয়া! ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?

আমরা দুভাই প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলাম : ও ফুচুদা—

নালার জলে বিরাট আলোড়ন। ওরে বাবা, কুমির উঠছে নাকি?

না, ভয় নেই কুমির নয়, ফুচুদা উঠে এলেন। বৃষ্টির জলে যেটুকু বাকি ছিল–নালার জল তা শেষ করে দিয়েছে। গা বোঝাই পাঁক–ঘাড়ে মাথায় একরাশ পচা পাতা–নাকে মুখে ব্যাঙাচির নৃত্য–ফুচুদার সে কী রূপ খুলেছে–মরি মরি!

ফুচুদা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, একপাটি জুতো গেল। অনেক ডুবে ডুবে খুঁজলাম–ব্যাটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। নাঃ–কপালটাই খারাপ!

তবু সব পথের শেষ আছে, আমাদেরও শেষ হল।

নেমন্তন্ন বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন আমাদের দেখে শ্যামানন্দবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, সর্বনাশ এ কী হয়েছে! এসো, কাপড়-জামা ছেড়ে ফেলো এখুনি

তোমরা ভাবছ এত দুঃখের পরে খাওয়াটা বোধহয় ভালোই জমল। কিন্তু হায় রে! তা হলে কি আর এ-গল্প লেখবার দরকার ছিল! দুগা দুর্গতি-দায়িনী কী কুক্ষণেই যে ফুচুদার প্রার্থনায় কর্ণপাত করেছিলেন। এ-যাত্রাও তিনি আমাদের ভুলবেন না।

 কই মাছের গামলাটা সবে আমাদের বারান্দার দিকে আসছে আর সেদিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠেছে ফুচুদার চোখ, এমন সময়- আরে দূর-দূর-মার-মার-মার

শ্যামানন্দবাবু চেঁচিয়ে উঠেছেন। কিন্তু তার আগেই যা হবার তা হয়ে গেছে। কোত্থেকে একটা ঘিয়ে ভাজা কুত্তা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে বারান্দায়।

নতুন ব্রাহ্মণ, সবে পৈতে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাতা ছেড়ে আমরা উঠে পড়লাম। খাওয়ার পর্ব ওইখানেই ইতি।

কই মাছের গামলা আবার অন্যদিকে ফিরে গেল।

শ্যামানন্দবাবু হায় হায় করতে লাগলেন। কিন্তু ফুচুদার বুকে যে আগুন জ্বলছে তাকে নেবাবে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *