১১-১৫. যুবকের ভ্ৰম-প্রমাদপূর্ণ আত্মবিশ্বাস, দাম্ভিকতা এবং অহঙ্কার

১১. যুবকের ভ্ৰম-প্রমাদপূর্ণ আত্মবিশ্বাস, দাম্ভিকতা এবং অহঙ্কার

প্রথম জীবনে যুবকেরা খুবই লম্বা কথা ছাড়ে। তার ধারণা সংসারে তার মতো বুদ্ধিমান আর কেউ নাই। জ্ঞানবৃদ্ধ পিতাকেও সে মনে মনে এবং প্রকাশ্যে মূর্খ এবং ভ্রান্ত মনে করে। যেন এ জগতে তার মতো জ্ঞানী বুদ্ধিমান আর দ্বিতীয়টি নাই। ভবিষ্যতে সে যে কি একটা মহাজন হবে, সে কথা ভেবেও সে ঠিক করতে পারে না। সংসারের সমস্ত জনই তার কাছে বোকা। সে যে কাজে হাত দেবে তাতেই সে জয়ী হবে নিশ্চয়! দুর্ভাগ্যক্রমে হতভাগ্য পিতা যে কয়দিন বেঁচে আছে, সে কয়দিন সে তার বুদ্ধি, চাতুরী কাজে লাগাতে পাচ্ছে না! পিতা বেটা কতদিনে সংসার ত্যাগ করে যাবে! রাত-দিন ফ্যাচ ফ্যাচ করতে আছে। মায়ের কাছে পিতৃনিন্দা এবং বিবাহিত হলে পত্নীর কাছে নিজের বাহাদুরি এবং রাজ্যের লোকের নিন্দা করা তার কাজ। প্রথম জীবনে ভাবে, সে কম হলেও একজন হাকিম হবে, তার পর যখন লেখাপড়া আর ভালো লাগে না তখন ভাবে লেখাপড়া শিখে কে কী করেছে! সে একজন বড় ব্যবসায়ী হয়ে লক্ষপতি হবে। সংসারে সে যে অবাধে একজন বিশিষ্ট লোক হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

তার মুখে সদাই তাচ্ছিল্য লেগে থাকে। সামান্য কারণে, সামান্য কথায় ম্যাচের কাঠির স্পর্শে দপ করে জ্বলে ওঠে। সর্বদাই রেগে আগুন হয়ে থাকে–যেন সকল মানুষই তার কাছে অপরাধী। সে ভাবে তার চিন্তা ধারা নির্ভুল, তার কাছে কোনো গলদ নাই।

কিন্তু এই ধরনের আত্মবিশ্বাস যে কত ভ্ৰম-প্রমাদপূর্ণ, তা যুবকেরা নিজেরাই কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারে। তখন বুঝে আর কোনো ফল হয় না।

ক্ষুদ্র অবস্থা থেকেই বড় হতে হয়। রাতারাতি বড় মানুষ হবো, প্রথমেই চেয়ার-বেঞ্চ খাঁটিয়ে সাহেব হয়ে জীবনে নামজাদা লক্ষপতি হবার আকাঙক্ষা যদি করে থাকে, তবে শেষকালে মজুরের সৌভাগ্যও লাভ হবে না। প্রথম জীবনে, জীবন যাত্রার আরম্ভে মান অপমান জ্ঞান ত্যাগ করে মজুর সাজ। বড় ঘরের বন্ধু-বান্ধব বা স্বশ্রেণীর বন্ধু-বান্ধবদের সমালোচনাকে ভয় করো না-লোকে যদি তুই করে কথা বলে, তা হলেও দুঃখিত হয়ো না। ঐগুলি হচ্ছে তোমার উন্নতির পথে শিক্ষা। কেউ তোমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুক বা না করুক-গ্রাহ্য করো না। নীরবে, নত মাথায়, মুখ বুজে ছোট হয়ে নিজের কর্তব্য করে যাও। দিন-রাত্রি উন্নতির চিন্তা করো না, কর্তব্য করে যাও।

যদি উন্নতি করতে চাও, তবে বিবাহিত হও, অবিবাহিত হও (বিবাহিত না হওয়াই ভালো) নারীর চিন্তা বিষবৎ বর্জন করবে। নারীর চিন্তা যদি মনে ঢোকে তা হলে কোনো উন্নতির আশা করো না। নারীর কথা যতই ভাববে ততই অধঃপতনের পথে যেতে থাকবে। প্রথমে যোগ্য হও, তারপর সুখ আপনাআপনি চারদিক থেকে হেঁটে আসবে। বিশেষ করে আমাদের দেশে নারী কখনও জীবনের সহায় নয়। তারা সকল ক্ষেত্রেই জীবনের মস্তবড় বাধা। নারীর সংস্রব থেকে যত দূরে থাকবে, ততই তোমার মঙ্গল হবে। বড় বড় শহরের কোনো কোনো লোক পশুবৃত্তি শান্ত করবার জন্যে রক্ষিতা রাখে, মুসলমান হলে বাড়িতে ভদ্রঘরের পত্নী রেখে বিদেশে আর একটি নিম্নশ্রেণীর মেয়েমানুষকে বিবাহ বা নেকাহ্ করে। এর মতো ঘৃণিত কাজ আর নাই। এতে নিজের মর্যাদা নষ্ট হয়, মনুষ্যত্বের ঘোর অপলাপ হয়। কামকে যথাসম্ভব চেপে রাখ। প্রথমে যোগ্য হও, তারপর ভদ্রভাবে নারীসঙ্গ আকাঙক্ষা করবেনইলে জীবনে চিরদারিদ্র্য, অফুরন্ত দুঃখ ভোগ করতে হবেই।

যৌবনকালে একটু লেখা-পড়া শিখলেই যেমন প্রথমেই কবি হতে সাধ হয়, তেমনি প্রায় যুবকেরাই ইচ্ছা হয় একেবারে কলিকাতায় যেয়ে মস্তবড় দোকানদার হই। যদি দোকানদার হবার ইচ্ছা হয় তবে যেখানেই কর, খুব ছোট হয়েই তা আরম্ভ করতে হবে। অজানা-অচেনা স্থানে মুটে মুজুর, বিড়িওয়ালা হওয়া এবং ভালো তত্রাচ ব্যবসা আরম্ভ করতে না করতে কোট-প্যান্ট পরতে যাওয়া ঠিক নয়। ও হচ্ছে পতনের লক্ষণ বরং Show-ওসবের কোনো মূল্য নেই।

যাতে হাত দেব তাতেই সোনা ফলবে। অপরেরা উন্নতি করেছে অতএব আমিও নিশ্চয় করতে পারব। এ বিশ্বাস পোষণ করাও উচিত নয়। সুদে টাকা কর্জ করে কোনো ব্যবসা করতে যাওয়াও ঘোর বোকামি। অন করের মতো অনেক খেয়ালই আমাদের মাটি হয়ে যায়। খেয়াল, হিসাবে, অনেক সময় হঠাৎ বড় মানুষ হওয়া যায়। কিন্তু কার্যত বড়লোক হওয়া দূরের কথা, দুটি পেটের অন্ন সংগ্রহ করাই অনেক সময় কঠিন।

সুদ জিনিসটা এখন সমস্ত সভ্য জগত ছেয়ে ফেলেছে। সুতরাং অযথা গোড়ামি করে সুদ খাব না বলে বসে থাকলে চলবে না। টাকা ধার দেবার ব্যবসাও সমাজে একটা মস্তবড় শক্তি। সমাজে মহাজনের আবির্ভাব হওয়া বিশেষ দরকার। মুসলমানের সমস্ত আর্থিকশক্তি, সমস্ত অর্থ-সম্পদ হিন্দু মহাজনদের হাতে দিনে দিনে কবলিত হচ্ছে। ভিক্ষুক মোল্লাদের বক্তৃতা শুনে চুপ করে বসে থাকলে আজ আর কাজ চলাবার উপায় নেই।

বড়লোক হবো, ধনী হবো, জমিদার হবো–এই আকাঙক্ষা নিয়ে যাত্রা শুরু করা ভালো নয়। এসব হচ্ছে দুরাশা, দুরাকাঙ্ক্ষা। কোনো রকমে ভদ্রতা রক্ষা করে জীবনে বেঁচে থাকবো, তার জন্যে যা হয় একটা কিছু করছি–এরূপ চিন্তা যারা মনে পোষণ করে, তারাই জগতে টিকে থাকে। এমন কি ঘটনাক্রমে তারা বড়লোকও হয়ে পড়ে।

যারা দুরাশা পোষণ করে, তারা বড়লোক তো হয়ই না, বরং জীবনে দুবেলা স্ত্রী-লোক নিয়ে তাদের দুমুঠো অন্ন সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে ওঠে। তাদের জীবনে কোনো শান্তি থাকে না, দৌড়াদৌড়ি করে হয়রান হওয়াই তাদের কাজ হয়ে পড়ে।

একথা ঠিক মনে রেখ–নারীই যুবকের উন্নতির পথে একমাত্র বাধা। নারীর চিন্তা মাথায় ঢুকলে তার কোনো উন্নতি কখনও হবে না।

যে কাজে দিন দিন কোনো উন্নতির আশা নেই–যা জুয়াচুরি, প্রতারণা, দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের কাজ, এসব যুবক বয়সে করবে না, শিক্ষকতা যুবকদের সাজে না, জামিদারি সেরেস্তার কাজ ঐসবও ভালো নয়। বুড়া নিষ্কর্মা লোকের পক্ষে শিক্ষকতা মানায়। সরকারি স্কুলে যেখানে উন্নতির আশা আছে, সেখানে অবশ্য চাকরি গ্রহণ করলে অনুদিত উন্নতি হতে থাকে।

শিল্প শিক্ষা করে এবং তা ব্যবসারূপে অবলম্বন করে হিন্দু ভদ্রসন্তানেরা বেশ পরিবার প্রতিপালন করেছেন। সততা ও বিনয় জিনিস দুইটি উন্নতির মস্তবড় সহায়।

.

১২. বাক্যের মূল্য–চটক দেখান পোশাকের বাহার

যদি কেউ পাণ্ডিত্যে দেশকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করে, সাহিত্য প্রতিভায় নোবেল পুরস্কার পায়, ধার্মিকতায় শত সহস্র মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি লাভ করে, বিজ্ঞান আলোচনায় অশেষ কৃতিত্ব লাভ করে, প্রবীণতায় আগা জারোর মতো ভক্তি ভাজন হয়, তথাপি যদি তার কথার ঠিক না থাকে, তবে সে ব্যক্তি তুচ্ছ, মূল্যহীন, অপদার্থ, তুণের মতো নগণ্য। সে কোনোমতে শ্রদ্ধার পাত্র হবার যোগ্য নয়।

বড়ই দুঃখের বিষয়–সমাজের ছেলেরা এবং প্রৌঢ়েরা ভয়ানক মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করে, অকারণে মিথ্যা বলে। যেন মিথ্যা কথায় কোনো দোষ নাই। যার কথার ঠিক নাই তাকে ভদ্রলোক-তো বলা চলেই না। তাকে ইতরের ইতর বলা যায়, তিনি যতই কোনো পদস্থ ব্যক্তি হউন না। ভদ্র ইউরোপীয়ানদের মধ্যে মিথ্যা কথার চলন খুব কম। কিন্তু আমাদের দেশের বিশিষ্ট লোকেরাও মিথ্যা কথা বলে এবং পত্র লেখে। কি নারী, কি পুরুষ, কি যুবক, কি যুবতী, কি বালিকা–সকলেই মিথ্যাবাদী। দায়ে পড়ে মিথ্যা বলাও সব সময় যায় না। কিন্তু বিনা কারণে, বিনা স্বার্থে যারা মিথ্যা বলে তাদের কান মলে দেওয়া উচিত। হয়তো বলবে কাল সন্ধ্যায় আসবো, কিন্তু যথাসময়ে তাকে তুমি পাবে না। লোকটা এসে তোমাকে বাড়িতেই পেলো না। একজন অধ্যাপককেও Stupid বলা যায় কারণ ঠিক সময়ে হয়তো তিনি ওজু করে নামাজ পড়বেন–কিন্তু তার কথার ঠিক নাই। বাক্যকেই মানুষ বলা যায়। কারণ বাক্যের যদি মূল্য না থাকে তবে কী করে তার উপর নির্ভর করে কাজ করা যায়।

একজন লক্ষপতি দিন-রাত্রি জপমালা হাতে করে লক্ষবার আল্লাহর বিশেষ নাম উচ্চারণ করেন, অতিশয় পীরভক্ত সেই ব্যক্তি একবার আমাকে একখানি পুস্তক লিখতে বললেন। আমি অনেক কষ্ট করে, বইখানি লিখলাম। এই লেখা শেষ হলে, একদিন বললেন–বই নেবো না। ইনি যদি সত্যবাদী হতেন তা হলে নিশ্চয়ই নিজের বাক্যের মূল্য রাখতেন।

এক Stupid রোজ প্রভাতে তার স্ত্রীকে বলতো, আজ town-এ যাব। ৮টায় ট্রেন। ৭টায়ই ভাত চাই। তার পত্নী তাড়াতাড়ি করে রোজ ৭টায় ভাত প্রস্তুত করতেন। রোজই প্রতিজ্ঞা করতেন–আজ আর যাওয়া হল না, কাল ঠিক যাবো। হয়তো জীবনভরই পত্নী এবং কত মানুষের সঙ্গে কত কাজে ইনি মিথ্যাচার করে চলেছেন, তার ইয়ত্তা কী? এই শ্রেণীর লোক জগতের কলঙ্ক এবং দাস জাতির নমুনা।

বহির্জগতের কাছে সাধু বলে পরিচিত, রোজা-নামাজের একনিষ্ঠ ভক্ত (খোদাতালা অপেক্ষা এরা রোজা-নামাজের অধিক ভক্ত) এমন লোকও মিথ্যা কথা বলতে, মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করতে লজ্জাবোধ করে না। যদি কোনো সময় কেউ তাদের ব্যবহারের সমালোচনা করে, অমনি বলবে–সংসারে অত পারা যায় না। গ্রন্থকার প্রথম জীবনে যখন সর্বপ্রথম মানুষকে সাধুতা, সততা ও সত্যনিষ্ঠার কথা বললেন–তখন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, অতি শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ আপনার জনেরা পর্যন্ত বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। সংসারের আবার সাধুতা কী? মানুষ কি অত পারে। ওসব পীর, দরবেশ, সাধু, ফকিরদের জন্যে এ তোমার ওপথ নয় বাবা! ও-পথে হাঁটলে মারা পড়বে। সত্যি করেই এই বর্বর সমাজে, এই অনুন্নত সমাজে সত্যের পথে যাত্রা করে জীবনে মরে আছি। প্রতিকূল অসংখ্য বাধাকে জয় করে সংসারে মাথা খাড়া করে রাখতে পারি নি। জীবন অসংখ্য দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়েছে–তবুও অন্তরের সুখ এইটুকু, আপন জীবন দিয়ে সত্যের পতাকা ধরে আছি।

যুবকদের লোককে চটক দেখানোর একটা মস্ত বড় আগ্রহ জন্মে। সাইকেল, চশমা, ঘড়ি–এসব দরকারই। ভালো একটি করে কোট মাঝে মাঝে ৮/১০ টাকা খরচ করে তৈরি করা চাই। নইলে বন্ধু মহলে নাম জাগে না।

আসল কাজে মন নেই, কীভাবে দশজনের মধ্যে বড়লোক বলে বাহবা নেওয়া যায়, সেই হয় যুবকদের আগ্রহ। অসভ্যের মতো সাজ-সজ্জা করা উচিত নয়। সর্বদা চটকদার নতুন নতুন পোশাক পরে বন্ধুদের কাছে বাহবা নেওয়ার কোনো মূল্য নেই। কোনো গতিকে কাজ চললেই হল। পোশাকে মানুষের কালো রূপ সাদা হয় না, বোচা নাক সরু হয় না, কুতকুতে চক্ষুও পটলচেরা হয় না।

জীবনের প্রকৃত মূল্যের দ্বারা জগতে বড় হওয়া যায়। চটকে, দামি পোশাকে মানুষের প্রভুত্ব ও মূল্য বাড়ে না। যা দরকার, অবস্থানুসারে তা ব্যবহার করা উচিত। অবস্থায় কুলায় না, তত্রাচ চটকদার জামার কিংবা ভালো ফারনিচারের স্বপ্ন দেখা, দিন-রাত্রি মন খারাপ করা, বড়ই হীনতা–ও-তো লোক দেখান প্রবৃত্তি মনে গোপন ভাবে বিরাজ করে। অলঙ্কার ছাড়া জগতের কোনো জিনিস দেখানোর জন্যে নয়–যারা তাই ভেবে জিনিসপত্র করে, তারা যেমন জীবনে একদিকে দুঃখ পায় অন্যদিকে তেমনি হীনতার পরিচয় দেয়। জীবনের রূঢ় আবশ্যকতার জন্যে জিনিসপত্র করতে হবে।

সাইকেল, ঘড়ি–এসব কিনবার বাতিক যুবকদের এক সময়ে চেতিয়ে তোলে–অথচ এগুলোতে প্রকৃত আবশ্যকতা ছেলেদের খুবই কম। যেখানে আবশ্যকতা, সেখানে ব্যবহার করা অবশ্যই উচিত! আসল কথা লোক দেখান প্রবৃত্তিটা বড়ই খারাপ।

.

১৩. সাহিত্যের সঙ্গে যোগ

যে-সকল যুবকের বাঙলা সাহিত্য অর্থাৎ দেশীয় সাহিত্যের উপর প্রভাব নেই–তাদের পরিপূর্ণ শক্তির স্ফুরণ হয় না। তাদের আত্মিক মূল্য জীবনে অনেক কমে যায়। সু-সংস্কৃতি ভাষা, সূক্ষ্ণ চিন্তা আপন মাতৃভাষায় প্রকাশ করবার ক্ষমতা মুসলমান যুবকদের একটা সহজ পারিপার্শ্বিকতা, ঘটে ওঠে না, তারা ভালো করে কথা বলতে পারে না, যেন সবসময় একটা বন্ধন, একটা জড়তার ভাব প্রকাশ্য (public) জীবনে লেগেই থাকে। দেশের মাতৃভাষা, বাঙলা ভাষায়। লিখিত খবরের কাগজ, বিভিন্ন মাসিকের সঙ্গে যোগ রাখা চাই–নইলে দেশের অন্তর্নিহিত আত্মার সঙ্গে একটা গভীর যোগ, আত্মীয়তা এবং পরিচয় হয় না। যুবকদের স্বভাবে যেন সর্বদা একটা বিদেশী অনাত্মীয়ের ভাব জড়িয়ে থাকে, আপন দেশের সঙ্গে যেন তারা অপরিচিত, যেন ভুল করে ঘটনাক্রমে মুসলমান যুবকেরা, এদেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই যে অস্বীকারের ভাব, এটা মুসলমান যুবকদের জন্য কত বড় ক্ষতির কথা তা বলবার নয়।

জীবন যত জটিল হয়, দেশের সাহিত্যও তত জটিল হয়। আমাদের দেশের যুবকদের জীবনে কোনো সাধনা নাই, নূতনত্ব নাই, বৈচিত্র্য নাই–শুধু, একঘেয়ে পরাধীন জীবন। বাল্যকালে লেখাপড়া শেখ, প্রৌঢ় অবস্থার চাকরি বা ব্যবসা বা কৃষি কর, বুড়াকালে বিশ্রাম কর। ধর্ম জীবনেও তাদের কোনো আন্তরিকতা নাই–একটা সাধারণ অভ্যাস পালন করে গেলেই কাজ শেষ হল। এ জীবনে আর কী বৈচিত্র্য থাকবে? নারী-পুরুষের সঙ্গে জীবনের যে একটা আত্মীয়তা, সেখানেও কোনো সাধনা বা কষ্ট করতে হয় না। যেখানে বন্ধন সেখানেই মুক্তির চেষ্টা। আমরা পরাধীন জাতি–সুখের নন্দদুলাল। সুবোধ শিষ্ট হয়ে কাজকর্ম করে যাচ্ছি। আমাদের জীবনে বন্ধন নেই–মুক্তির চেষ্টাও নেই।

লোক-সমাজে মিশতে গিয়ে বহু চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। লোক-চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে, যেসব সাহিত্যিক গল্প-উপন্যাসের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্মভাবে লোক-চরিত্র অঙ্কন করতে পারেন তাদের বই পড়া উচিত। সমাজের মধ্যে মানুষের দৈনিক জীবনে যে-সব ঘটনা ঘটে, তার সুখ-দুঃখের কাহিনী, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার, প্রতারণা, উন্নত ধর্মজীবন–এসব উপন্যাসে অঙ্কিত করা হয়। সে-সব পুস্তক পাঠ করলে মনুষ্য সমাজ সম্বন্ধে সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতা জন্মে। পূর্বেই বলেছি,–আমাদের সমাজে জীবনের বৈচিত্র্য নেই। বিশেষ করে মুসলমানদের জীবন যেন একেবারেই একঘেয়ে–যেন সবাই মৃত। সজীব আত্মায় চিন্তা, বিচার, পাপের সঙ্গে সগ্রাম যা মনুষ্য জীবনকে বিচিত্র করে, তা যেন মুসলমান সমাজে নেই। সুতরাং এই সমাজে ভালো কথাসাহিত্য সৃষ্টি হওয়া খুব কঠিন। তবু এ সমাজে দুঃখ ব্যথার অন্ত নাই। সমাজকে সুখময়, শান্তিপূর্ণ, সম্পদশালী, সম্মানী করার সাধনা যেদিন সমাজে জাগবে, সেদিন থেকে সমাজে ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া শুরু হবে। এই দিক দিয়ে মুসলমানদের এক অভিনব সৃষ্টির পথ পড়ে আছে। যোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়লে অভিনব সাহিত্য প্রভাবে সমাজে নব জীবনের সঞ্চার হবে, বিপুল কর্মসাধনা জাগবে, সমাজের জয়যাত্রা শুরু হবে। সে শুভ সময় কতদিনে আসবে, তা বলা যায় না। শিক্ষিত মাত্রেই আপন আপন সুখ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ সমাজের জন্য দুকলম লেখেন না। সাহিত্যিক হওয়া তো দূরের কথা, যারা লেখেন, তাদের প্রতি কোনো উৎসাহও নাই। বাল্যকালে কিছুদিন কোরান পড়লে, ছাত্র জীবনে পাঠ্য-পুস্তকগুলি পড়ে শেষ করতে পারলেই জীবনের শিক্ষা পূর্ণ হল। নতুন নতুন বই পড়বার আকাঙ্ক্ষা সমাজের নেই। হিন্দু সমাজের মেয়েরা যে-সব বই পড়ে, মুসলমান সম্রান্ত ও পদস্থ ব্যক্তিরাও ততখানি বই পড়ে না। কী উন্নতি আমাদের পক্ষে সম্ভব? আপন দেশ, মাতৃভাষা, জীবিত মনুষ্য সমাজে এবং পৃথিবীকে অস্বীকার করে চলাই আমাদের স্বভাব। আমরা যেন সবাই পরকালের মানুষ, যেন এ জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব নেই। এতেই আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে। আমাদের বোঝা উচিত–ইহজগতের কাজের উপর পরকাল নির্ভর করে। ইহকালের। জীবনের উন্নতির উপর পরকালের উন্নতি নির্ভর করে। কবি বলেছেন–

সংসারে সংসারী সাজ;
কর নিত্য নিজ কাজ।
ভবের উন্নতি যাতে হয়।

এই বিশ্ব সংসারকে স্বীকার করতে হবে–এ বিরাট বিপুল সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশতে হবে। জীবিত মনুষ্য সমাজের সঙ্গে যোগ রাখতে হবে। জীবিত মনুষ্যের নতুন নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে আমরা যদি যোগ না রাখি, তা হলে আমরা দুর্বল, শক্তিহীন হবোপদে পদে লাঞ্ছিত হবো। আল্লাহর এবাদত শুধু ঘরের মধ্যে নয়–পৃথিবীর কাজের ভিতর দিয়ে তা করতে হবে। জীবিত জগৎ এবং মনুষ্য সমাজকে নিয়ে তা করতে হবে। জীবিত জাতির প্রাণের চিন্তা ও ভাবধারা সাহিত্যে ব্যক্ত হয়। সেই সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগ রাখতে হবে–যদি আমরা জীবিত জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই। মৃতের কোনো সাধনা নাই।

কবিতা পাঠ করলে এবং সঙ্গীত শ্রবণে মন পবিত্র ভাবাপন্ন হয়, এ কারণে লোকে কবিকে সম্মান করে। অশ্লীল কবিতা–যাতে নারীর রূপ অশ্লীল ও তরলভাবে আলোচিত হয়, তা পাঠ করলে মন অপবিত্র হয়। খারাপ বই পড়লে কোনো লাভ হয় না। বিজ্ঞানের বই, উন্নত কবিতা, কাব্য, ভালো উপন্যাস, জীবনী, ইতিহাস, উন্নত চিন্তা, এসব নিত্য পাঠ করলে মানুষের প্রভূত কল্যাণ হয়–দিন দিন মানুষ উন্নত হয়। যে সমস্ত যুবকের সৎ সাহিত্যের সঙ্গে সংস্রব নেই, যারা অনুন্নত নিম্ন সমাজে সদা মেশে, কথা বলে, আলাপ করে, ভদ্রসমাজে ওঠা-বসা করে না–তাদের রুচি, চরিত্র, ব্যবহার দিন দিন জঘন্য ও কদর্য হতে থাকে। অহঙ্কার, অশিক্ষা, মন্দভাব, সংকীর্ণতা তাদের জীবন ও মনকে অজ্ঞাতসারে দুর্গন্ধময় করে, যা তারা নিজেরা বুঝতে পারে না।

.

১৪. যুবকদের বাহুল্য খরচ

অভিভাবকহীন যুবকেরা যে কত রকমে বাহুল্য খরচ করে তার ইয়ত্তা নেই। কলেজে পড়ার সময় যুবকদের মনে বুড়া বাপ-মা’র জন্যে কিছুমাত্র মমতাবোধ থাকে না। কেবল টাকার জন্য চিঠি বাড়ি আসে। কত অজুহাত–যেমন নতুন বই কোনো, কলেজের মাইনে, ঔষুধ খরচ ইত্যাদি দিয়ে নানা ভাবে বুড়া বাপের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। পড়ার বেলা হয়তো গল্পসল্প করেই সময় কাটে। পোশাক এবং ইয়াকী করতে ষোল আনা, যুবকদের পিতৃনিন্দাও মুখে লেগে থাকে। এত যে টাকা দেওয়া হয়, তবু ছেলের মন পাবার জো নেই। এইসব হতভাগা কাণ্ডজ্ঞান হীন ছেলের লেখাপড়া হবার আশা খুব কম। তবু বুড়া বাপ-মা আশা ও আনন্দে এদের পেছনে অজস্র টাকা ব্যয় করতে থাকেন।

শাসন করেও কোনো ভালো নেই–সেয়ানা যুবক ছেলেকে শাসন করে পড়তে বাধ্য করা যায় না। এত দৌড়াত্ম করেও যদি পরীক্ষায় পাস করতে পারে, তা হলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।

যুবকদের মনে করা উচিত, সংসারে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করা বড় কঠিন। বাবা বিশেষ হিসাবী বলে টাকা দিতে পারছেন। নিজের শত অভাব ঠেলে ফেলে ছেলের অভাবের কথাই আগে ভাবেন–যদি যুবক ছেলে বাপের হৃদয় বেদনা একটুখানি বুঝতো, তা হলে নিশ্চয় সে সুবোধ হতো। পড়া-লেখাও মন দিয়ে করতো। যথা সময়ে পাস করে দেশের ও দশের প্রশংসাসহ বাড়ি ফিরে আসতো, সংসারে সুখে থাকতে পারত।

বাপ-মাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে, নানা প্রকার বাহুল্য খরচ করে, থিয়েটার-বায়োস্কাপ দেখে, পোশাক-পরিচ্ছদ করে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে ছেলে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসে, শেষকালে দেখা যায়, ছেলে ফেল ডিভিসনে পাস করেছে। বাড়ির কাছে যদি কোনো মাইনর স্কুল থাকে, তবে ছেলে সেখানে যেয়ে অবৈতনিক শিক্ষক হয়। টাকার দংশন বেদনা সহ্য করা বড়ই কঠিন কার্য। হাতে টাকা থাকলে যত বেলা তা খরচ করে নিঃসম্বল এবং রিক্ত হস্ত না হওয়া যায়, তাবৎ যেন আর শান্তি থাকে না। বুদ্ধিহীন যুবকদের হাতে টাকা পড়লে তা যে অতি অল্প সময়ে নিঃশেষিত হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংসারে যদি কোনো নগদ টাকা থাকে তবে তা খুব গোপনে কোনো প্রবীণের হেফাজতে রাখা উচিত, নইলে সে টাকা কিছুতেই থাকবে না। পিতার মৃত্যুর সঙ্গে যুবকেরা হাতে টাকা পেয়ে দুই হাত দিয়ে বাহুল্যভাবে খরচ করতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বোঝে না। যতদিন টাকা থাকে, ততদিন যুবকেরা তার মূল্য বুঝে না।

যে টাকার উষ্ণতা সহ্য করতে পারে, কৃপণের মতো খরচ না করে টাকা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে–সে জীবনে সুখে থাকে। জীবনে তার দুঃখ হয় না। সঞ্চয়ের বুদ্ধি সকলের থাকে না অধিকাংশ যুবকই বাহুল্য খরচে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।

নগদ টাকা বহু সম্পত্তি ছেলেদের না দিয়ে কোনো সৎ প্রতিষ্ঠানে দান করে যাওয়া ভালো। ছেলেরা যাতে ভদ্রলোকের মতো চলে, তার শি দিলে তাদের অধঃপতনের পথ প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। প্রথম জীবনে মনুষ্য নিতান্তই অপরিপক্ক বুদ্ধি ও ছেলেমানুষ থাকে! আঘাত, অভাব, বেদনা ছাড়া মানুষ কখনও শিক্ষাপ্রাপ্ত হয় না।

মানুষ কেউ কাউকে সুখী ভালো ও বড় করতে পারে না। আপন যোগ্যতায় মানুষ যোগ্যস্থান ঠিক করে নেয় উচ্চাসন দিলেও, সে আসনের মর্যাদা ঠিক রাখতে পারে না। এ কারণে ছেলেদের যতটুকু দরকার তার এক ক্রান্তি বেশি দিয়ে তাদের সর্বনাশ করা উচিত নয়। মানব কল্যাণের জন্য উন্নতপ্রতিষ্ঠানে জীবনের সঞ্চিত ধন ব্যয় করা, যথার্থ জ্ঞানীর কার্য–ছেলে-পেলেকে দেওয়া মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের কী এমন দাবি আছে। পিতার উপর, যাতে করে তারা পিতার সমস্ত ধনরত্ন নিজেরাই অধিকার করবে? সন্তানেরা বছরেও হয়তো পিতার কথা একবার মনে করবে না–পোতা ছেলেরা তো জীবনেও। একবার করবে না। ছেলেদের শিক্ষাকালে তাদের ন্যায্য খরচ দিতে কৃপণতা করা উচিত নয়। অবশ্য সে কথা পুত্রদের বলা উচিত নয়।

বড়ই দুঃখের বিষয়, অনেক লোক যুবকদেরকে তাদের পিতার নিন্দা করে তাদেরকে পিতৃদ্রোহী করতে চেষ্টা করেন। পিতার কার্যে কোনোরূপ ভুল ধরা পুত্রের পক্ষে অনুচিত। পিতা যে সাহায্য করতে পারেন, তাতেই সন্তুষ্ট থেকে জীবন পথে অগ্রসর হবে। পিতার কোনো কার্যের সমালোচনা করা মহাপাপ। পিতার অমতে কোনো ধর্মকাৰ্য, কোনো সন্ধার্য সিদ্ধ হয় না–তার ইচ্ছা পালন করাই সুবোধ পুত্রের কাজ। যা মহাপাপ তা করবে না, করলেও সে পাপ পুত্রের হবে না, পিতারই হবে। বিদেশে যুবকদের চরিত্র খারাপ হতে পারে। এর ঔষধ পুত্রকে সদুপদেশ দেওয়া, সস্নেহ ব্যবহার করা। যুবক বয়সে ছেলেদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করলে, তাদের চরিত্র খারাপ হবার খুবই সম্ভাবনা।

যুবকেরা যদি বেশ্যালয়ে গমন আরম্ভ করে, সমাজে মিশে সুরাপান অভ্যাস করে তা হলে তো সে বাহুল্য খরচ করতে শিখবেই। যুবকদের এ অভ্যাস হলে তো সর্বনাশের পথ রচিত হবেই। যদি তাই হয়, তবে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়ি এনে সাংসারিক কাজের ভার দেওয়াই ভালো।

যার ভিতর একবার এ পাপ প্রবেশ করেছে তাকে মরণ গহ্বরে টেনে না নিয়ে আর এ পাপ তাকে ত্যাগ করে না। এই সময় কোনো উচ্চস্তরের বন্ধুর চরিত্র প্রভাব এবং সহবাসই তার পক্ষে উত্তম ঔষধ। এ সম্বন্ধে প্রকাশ্যে বকাবকি করাও উচিত নয়–তাতে লজ্জা ভেঙ্গে যায়, ফল খারাপ হয়।

থিয়েটারে যাওয়া, ছায়াচিত্র দেখা, Style বজায় রাখা, এইসব ব্যাপারেই যুবকেরা বাহুল্য খরচ করে।

.

১৫. যুবকের মুখে অশ্লীল ভাষা

কোনো কোনো যুবক এত ইতর (Vulgar) যে তারা কথায় কথায় অতি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে। অতি মাত্রায় মূঢ় ও হীন না হলে যুবক কখনও ইতর হতে পারে না। বলতে কী এই শ্রেণীর যুবককে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া উচিত, তবে সবাই যদি নীচ ও ইতর হয় তবে আর কে কাকে বের করে?

যুবকদের মনে করা উচিত, মনুষ্য এমন কি লম্পট, বেশ্যা পর্যন্ত যা দেখাতে লজ্জা বোধ করে,–তা প্রকাশ্যভাবে এক প্রকার মুক্ত করেই দেখানো কতখানি ভালো কাজ! নিতান্ত পশু না হলে কে কাকে উলঙ্গ করতে চায় এবং উলঙ্গ হতে চায়? নীচ শ্রেণীর যুবকেরা কথায়, ভাষায়, ব্যবহারে যেন সর্বদাই মানব সমাজে উলঙ্গ হয়ে তাদের কুৎসিত, উলঙ্গ বীভৎস মূর্তি দেখাতে চায়! ধিক! এইসব নরপিশাচ যুবকদেরকে, যারা অশ্লীল কথা বলতে লজ্জাবোধ করে না, যারা বৃথাই বস্ত্র পরিধান করে। ধিক! এদের পিতামাতাকে–এদের আত্মীয়-স্বজন ভ্রাতা-ভগ্নিকে!

এরূপ ছেলেকে সংসারের এবং সমাজের সকলেরই ঘৃণা করা উচিত। খোদা যা গোপন করতে বলেছেন, তা কথায় প্রকাশ করা ঘোর অধর্ম। যুবকেরা ধর্মের কোনো ধার ধারে না–তাদের মনে খোদার ভয় এক প্রকার নাই বল্লেই চলে।

সমাজের যে-সব লোক ইতর শ্রেণীর অন্তর্গত, তাদেরকেই অশ্লীল কথা বলতে শোনা যায়। তারা সাধারণত অশিক্ষিত অমার্জিত রুচির। তাই বলে শিক্ষিত ঘরে বা ভদ্রঘরের ছেলে বলে যদি কেউ দাবি করে, তারা যদি ইতরের মতো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে, কথায় কথায় যেখানে সেখানে পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ির ভিতরে, গুরুজনের সম্মুখে কুভাষা ব্যবহার করে, তবে সে বড়ই ঘৃণার কথা। সমাজের কেউ যদি জোর করে অন্যায় করতে থাকে, অন্যায় পথে চলে তবে প্রথমে তাকে সাবধান করে, তার সংশ্রব ত্যাগ করাই ভালো।

কোনো কোনো জননী বলে থাকেন–শিশুদের কুস্বভাব বড় হলে সেরে যাবে। কিন্তু সব সময় তা হয় না। বাল্যকালে অত্যধিক প্রশ্রয় পাওয়াতেই ছেলেদের স্বভাব মন্দ হতে থাকে, ততই তারা বেশি করে মন্দতায় দৃঢ় হতে থাকে–জীবনে আর সংশোধন হয় না।

খালি গোয়াল ভালো, তবু দুষ্ট এড়ে ভালো নয়। সংসারে যদি একটি ছেলে দুষ্ট, ইতর, অশ্লীল ভাষাসক্ত হয়ে ওঠে তবে তার দেখাদেখি বাড়ির সব ছেলে খারাপ হয়। পাড়া গাঁয়ের লোকদের মাঝে, সৎ কথার আলোচনা এক প্রকার নেই বললেই হয়। কোনো লোকের কোনো মন্দ ব্যবহার বা মন্দ স্বভাব দেখলে তাতে ঘৃণা প্রকাশ না করে, লোকে বরং উৎসাহই প্রদান করে–কারণ সকল মানুষই মন্দ! মন্দতায় কে কাকে কতখানি ছাড়িয়ে যেতে পারে, তাই যেন হয় সবার প্রতিযোগিতার বিষয়।

একটা ছেলে, একটা যুবক, একটা মানুষ, একটি বালিকা যখন ধ্বংসের পথে যেতে থাকে, তখন তার জন্য প্রত্যেক জ্ঞানবান মানুষের মনে কঠিন দুঃখ উপস্থিত হয়। শরীরের ধ্বংস অপেক্ষা আত্মিক ধ্বংসই অধিকতর আক্ষেপের বিষয়। হায়, মনুষ্য যেন বিনাশের জন্যই প্রস্তুত! জীবন যে চারু না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *