১১-১৫. প্রভুর সংবাদ বহন

১১. প্রভুর সংবাদ বহন

চল যারা পথহারা, পতিত, অশিক্ষিত, ঈশ্বরবর্জিত, পাপের অন্ধকারে ডুবে আছে; যেখানে আল্লাহর নাম কেউ লয় না–যেখানে আল্লাহর কথা কেউ ভাবে না–সেখানে যাই এবং আল্লাহর মহাবাণী শুনাই। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, এই-ই ধর্ম। এছাড়া কোনো উচ্চতর ধর্ম নাই। শুধু রোজা, নামাজ, কোরবানি কোনো ধর্ম নয়। ওরে পাগল, ভ্রান্ত, কীভাবে জীবন নষ্ট করলে?

নব যুগের, নব জাতির এই নূতন ধর্ম গ্রহণ কর। যদি গ্রহণ না কর তোমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মিথ্যা ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আপন ধর্ম জীবনের সর্বনাশ সাধন করো না। পশুর ধর্ম পালন করো না, বর্বর, মূর্খের ধর্ম পালন করো না–মানুষের ধর্ম পালন কর।

সত্য ও সুন্দরের পূজারী হও।–সত্যের বাক্যের অন্ত নেই–প্রভুর বাক্য সত্যের বাক্যরূপে অনন্তকাল ধরে মানব জাতির কাছে থাকবে, সময় ও কালের উপযোগী হয়ে তাকে অশ্রদ্ধা করো না–প্রভুর বাণী গ্রহণ কর।

প্রভু বলেছেন, পতিত, মূর্খ, অবোধ, পৌত্তলিক, জ্ঞানহীন, পথহারা, ধর্মহীন, পাপ ব্যবসায়িনী নারীকুল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত নর-নারীর কাছে যাও। তাদের ভিতরে যেয়ে নামাজ পড় এবং প্রভুর শুভ ইচ্ছা জ্ঞাপন কর–মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পূজারী হতে বল–তাদের মধ্যে বিদ্যালয় স্থাপন কর, তাদের মধ্যে ঈশ্বরের বাক্য প্রচার কর। পতিত মানুষের জন্য তুমি দায়ী।

বাংলার সহস্র সহস্র নারী বেশ্যাবৃত্তি করছে–এ মহাপাপ যে দেশে হচ্ছে সেখানে কি আল্লাহর এবাদত সিদ্ধ হয়? হায়! নারীর অনুষ্ঠিত এই পাপ ব্যবসা কি চোখে দেখা যায় বা কানে শোনা যায়? এ যে একে বারে অসহ্য ব্যাপার। এদের সাবধান করবার জন্যে কি মুসলিম সন্তানদের কিছু করবার নেই? নিশ্চয়ই আছে।

পতিত ভ্রান্ত মানুষ চন্দ্র, সূর্য, প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি, বৃক্ষ, পাহাড়, সর্প, বরাহকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করছে। এদের উদ্ধারের জন্যে কী তোমার কিছু করবার নেই? দেশের শত শত মানুষ ধর্মহীন জীবন যাপন করছে, ঈশ্বর-হীন জীবন কাটাচ্ছে–এদের কাছে কিছু বলবার নেই আমাদের?

নিজের উন্নতির চেষ্টায় সারা জীবন ব্যয় করলে। নিজের পুত্রের জন্য টাকা রেখে যাচ্ছ। হয়তো ভবিষ্যতে তোমার টাকা তারা মদ খেয়ে উড়াবে। প্রভুর প্রচারের পথে তোমার অর্থ ব্যয় কর–এইভাবে তোমার সঞ্চিত ধন পবিত্র কর। হায়, জীবন শেষ হয়ে গেল, তবু ধর্ম কী তা বুঝতে পারলে না।

যাও, সর্বত্র–অন্ধকারে, অলিতে গলিতে প্রভুর আলো জ্বালো।–দিকে দিকে প্রভুর বাণী বহন কর।

হে সাহিত্যিক, হে কবি, হে লেখক, তোমাদের অমর লেখনীতে প্রভুর মহিমা ও আলো জ্বলে উঠুক। হে বক্তা প্রভুর বাণী তোমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক। পৃথিবীতে যতগুলি মসজিদ আছে, প্রত্যেক মসজিদ ঘরের ইমাম যিনি–তিনি হবেন শিক্ষিত, সাধু, মসজিদের অন্তর্গত পল্লীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তি। সেই পল্লীর সকল মানুষের ভার তার উপর দাও। তোমরা তার সাংসারিক অভাব পূর্ণ কর। প্রভুর প্রচার কার্যে তোমরা প্রত্যেকে কিছু কিছু দান কর–প্রভুর পথে দান ব্যতীত তোমাদের নামাজ কখনও সিদ্ধ হবে না। প্রভুর বাণী প্রচারে, দরিদ্রদের সাহায্যে, শিক্ষা বিস্তারে, হাসপাতাল প্রভৃতি মহৎ প্রতিষ্ঠানে যে দান করা হয়, তা প্রভুর পথে দান। দানবর্জিত শুষ্ক রোজা-নামাজের কোনো মূল্য নাই। তা লবণহীন ব্যঞ্জনের ন্যায় অপ্রিয়।

.

১২. আল্লাহর আদেশ, নরহত্যা করো না

শুধু কি না বুঝে নামাজ পড়লেই ধর্ম জীবনের কর্তব্য পালিত হল?–কী মিথ্যা বিশ্বাস! না বুঝে নামাজের আবৃত্তি করেই আজ মুসলমানের ছুটি। এই অন্ধ নামাজ-রোজার সার্থকতা কোথায়? ভুল বিশ্বাসই মুসলমান সমাজের পতন এবং সর্বনাশের একমাত্র কারণ। আল্লাহর আর কোনো আদেশই তার পাষাণ, সংগ্রামহীন কর্মবিমুখ মনে সে অনুভব করে না। সে নামাজই পড়ে, কিন্তু সর্বপ্রকার কুকার্য করে–তার জীবন পশুর মতো বিচারহীন, অতিশয় কুৎসিত–অতিশয় মন্দ।

খুন কারা করে? প্রতিশোধ কারা নেয়? ব্যভিচার কে করে? মিথ্যা কথা কারা বলে? অল্প ওজনে জিনিস কারা দেয়? দোকানে রূঢ় কথা বলে ক্রেতাকে কারা অপমান করে? নারীর সম্পত্তি কারা হরণ করে? এতিমের সম্পত্তি কারা ভোগ করে? যেখানে যেখানে ধর্ম জীবনের পরীক্ষা সেখানেই মুসলমান অপারগ, অসমর্থ এবং গোনাহগার। কোরান, সূরা বকর ১৭৬ নম্বর আয়াত (বাক্য)—“পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ করলে পূণ্য হয় না। যে কেউ ঈশ্বরের ও শেষ বিচারে দিনে, স্বর্গের দূতগণে, সমস্ত অবতীর্ণ ঐশ্বরিক গ্রন্থে এবং নবীগণে বিশ্বাসী (এই সবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আন্তরিক বিশ্বাস পোষণ করে) এবং তাঁর প্রেমে আত্মীয় ও অনাথদের (নিঃসহায়) ধন প্রদান করে, জাকাত দান করে প্রতিজ্ঞা পালন করে, দারিদ্র্যে, পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যশীল হয়–তারা সত্য কথা বলিয়াছে–ঈশ্বরের ভক্ত বান্দা। আল্লাহ্তে যার বিশ্বাস নাই, তার আবার ধর্ম কী? তাঁর আবার জাতি কী? জিজ্ঞাসা করি, বুকে হাত রেখে বল, আল্লাহতে বিশ্বাস আছে কি?–তার বিদ্যামানতায়, তার প্রেমে, তার ন্যায় বিচারে, তার প্রতাপ ও শক্তিতে, তার নৈকট্যে, তার সর্ব ব্যাপকতায়, বিশ্বাস আছে কী?–একদিন তোমার কৃতকর্মের বিচার হবে, তার ফল তোমার ভোগ করতে হবে–এ বিশ্বাস আছে কি?

তোমাকে ‘কাফের’ ছাড়া আর কী বলি? তুমি ধর্মহীন গুরু। তুমি ঈশ্বরের দূতগণের অস্তিত্ব বিশ্বাস কর? তুমি কি অনাথ, দরিদ্র নিঃসহায় পথিক ও ভিক্ষুককে প্রেম করে থাক?

আজকাল একদল লোক ধর্মপথের পথিক নয়, ভিক্ষার জন্যে পথিক বা মুসাফির। আল্লাহ্ এদেরকে পথিক বলেন নাই। আল্লাহর পথে যারা পর্যটক, তারাই মানুষের সাহায্য দাবি করতে পারে। অশিক্ষিত, অকর্মণ্য, আলস্যপরায়ণ ব্যক্তিরা কখনও আল্লাহর পথের পথিক নয়।

অনাথ যারা, নিঃসহায় যারা তাদের কথা সমাজের একজনও ভাবে না। শুধু দালান দেওয়ার কথা, জমিদারি রক্ষার কথা, আপন পরিবারের সুখ-দুঃখের কথাই মানুষ বলে বলে শেষ করতে পারে না। আল্লাহর আদেশ মানুষের পালন করতে দেখি কৈ? সময়কালে একটু নামাজ পড়তে দেখি মাত্র! সাহেব বাকি সময় যেন রেগেই বসে থাকেন। কে কবে জাকাত দিয়ে থাকে?–আমি তো একজনকেও জাকাত দিতে দেখি না। মুসলমানকে আল্লাহর কোনো আদেশই পালন করতে দেখি না। শুধু নামাজের আবৃত্তিতেই কোনো কাজ হবে কি? তাও কেউ কেউ বৎসর শেষে একবারও মাত্র পড়ে। আল্লাহর সমস্ত প্রেরিত ধর্মগ্রন্থে কার বিশ্বাস আছে? কৈ এক কোরান ছাড়া কাউকে তো ইঞ্জিল (বাইবেল), জবুর, তওরাত পড়তে দেখি না। হযরত ঈসাকে তো অনেক মুসলমান গালি দেয়। কোরানে লেখা আছে–ইঞ্জিলে হেদায়েত ও জ্যোতি আছে। তার সন্ধান তো একজনকে করতে দেখি না! পাছে খ্রিষ্টান হতেই হবে। নইলে মুসলমান হবে কী করে? সে নিজের কোরানই বুঝে না, পড়ে না–তাতে অন্য ধর্মগ্রন্থ, আল্লাহর কোন আদেশটি সে মানে? মুসলমান প্রতিজ্ঞা পালন করে কৈ? তার মতো মিথ্যাবাদী আমি দেখি না।

দারিদ্রে তার ধৈর্য কৈ? একটু উপায়ের পথ পেলে সে দুই হাত দিয়ে লুট করতে থাকে। ক্ষমতা পেলে সে দারিদ্রের উপর জুলুম করে। বিশ্বাসঘাতকতা তার ধর্ম। দারিদ্র্যে সে ছলনা, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সততাতার কাছে নাই।

আল্লাহর শত আদেশ সে অগ্রাহ্য করে। জীবন ভর সে আল্লাহকে অগ্রাহ্য করে বুড়াকালে কিছুদিন নামাজ নামে অন্ধভাবে আবৃত্তি করে।

ইহকাল, পরকালে কোনো মঙ্গল তার ভাগ্যে হওয়া সম্ভব? তোমরাই বিচার কর।

নামাজের সঙ্গে জীবনকে সত্যময়, নিষ্পাপ, মধুর, ঐশ্বরিক গুণভূষিত, নবী-পন্থী এবং সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে হত্যা করা দূরের কথা, মানব হৃদয়ে বেদনা দেওয়াও মহাপাপ। ঈশ্বরের হাতে প্রতিশোধ নেবার ভার দাও। তোমরা নিজেরা গোপনে মানুষকে হত্যা করো না। ধৈর্যশীল হও এবং প্রার্থনা কর।

আল্লাহর আদেশ, মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না। ভয়ে মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করা মহাপাপ। খোদাকেই ভয় কর ন্যায় পক্ষে কথা বল। বড় লোক বলে ভয়ে তার দিক হয়ে কথা বলো না–তা হলে তোমার ঈমানের কোনো মূল্য থাকবে না।

প্রায়ই দেখা যায় মানুষ ক্ষতির ভয়ে, প্রাণের ভয়ে সাংসারিক স্বার্থ নষ্ট হবার ভয়ে, ধনবানের পক্ষে কথা বলে। যথার্থ ধার্মিকের কাজ তা নয়। যা বিবেক, জ্ঞান ও ধর্মসঙ্গত, যা সত্য তা নির্ভীকভাবে প্রকাশ কর। অধার্মিকেরা আত্মীয় ও বলবানের দিকে টেনে কথা বলে। যেখানে সত্য লাঞ্ছিত হয়, বিচার অপমানিত হয়, সেখানে আল্লাহর অভিশাপ আসে। অন্ধের মতো মৌখিক নামাজ পড়লে, কাজ হবে না। কার্যে, কথায়, ব্যবহারে আল্লাহর মর্যাদা রক্ষা কর। যা আল্লাহ্, তাই সত্য, তাই ন্যায়, তাই বিচার।

God is truth–M.S. Letter Gandi যার গায়ে বল আছে, তার প্রতাপ বেশি যে অর্থশালী, তার পক্ষই মানুষ অবলম্বন করে। ঈশ্বরের পক্ষ মানুষ অবলম্বন করে না। ন্যায় ও সত্যের পক্ষই ঈশ্বরের পক্ষ।

মানুষ মুখে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে, কার্যত সে শয়তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তার প্রচারিত ধর্মের সঙ্গে জীবনের ধর্মের সঙ্গতি নাই। এ চালাকি আল্লাহর কাছে ঢাকা থাকে না। আল্লাহ মৌখিক তোষামদ চান না। তিনি দেখতে চান তার বান্দা কাজে তাঁকে। শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করছে কিনা! স্বীকার করাই হচ্ছে প্রকৃত ঈশ্বরের সম্মান।

যে অন্যায় পক্ষ অবলম্বন করে, মিথ্যাকে সম্মান করে, সে কাফের। সে শয়তানের অনুচর। যায় যাবে যাক প্রাণ, তবুও সত্যকে সমর্থন করব, এই হচ্ছে প্রকৃত বিশ্বাসী বা ঈমানদারের জীবন নীতি।

.

১৩. আল্লাহর আদেশ মিথ্যা কহিও না

ধিক সেই কুকুরকে যে মিথ্যা কথা বলে। জান তো মিথ্যার দ্বারা কত দুঃখ সৃষ্টি হয়। যে কুকুরের কথায় ঠিক নেই, যার প্রতিজ্ঞার ঠিক নেই, তার কোনো ধর্ম নেই।

এক প্রবীণ সম্পাদকের কাছে দুই মাস হেঁটেছিলাম। তিনি প্রত্যেক বারেই বলতেন–আগামী সপ্তাহে আপনার পুস্তকের সমালোচনা বের হবে। তিনি মিথ্যা কথা বলতেন।

পণ্ডিত, বৃদ্ধ, দেশনায়ক,শাসনকর্তা যে কেউ মিথ্যা বলুক, তাকে ভ্রান্ত বলা যায়। সে ব্যক্তি মনুষ্য সমাজের সম্মানের যোগ্য নয়। বাঙালির কথায় ঠিক নাই মিথ্যা বলা তার স্বভাব–অথচ বলে আমরা সুসভ্য জাতি, স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত দাবি, আমরা ধার্মিক। আমাদের ধর্মের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নাই। বাঙালি যদি রাত্রি ৮টার কথা বলেন। তাতে পরদিন বেলা ৮টায় বুঝায়। আমি মিথ্যাবাদীকে নীচ কুকুর বলি। জীবনে যারা সত্যবান এবং সুন্দর নয়–তাদের কোনো ধর্ম নাই। আলী নামক এক কৃষক আবদুল নামক এক ভদ্রলোককে একদা লোকচক্ষুর অগোচরে গভীর রাত্রিতে পঞ্চাশটি টাকা কর্জ দেন। না দিলে ভদ্রলোকের বহু সহস্র টাকা ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল। আলী কাউকে স্বাক্ষী না করেই সেই নিশীথ রাত্রে ভদ্রলোককে পঞ্চাশ টাকা দিলেন। আলীর এই মহৎ কার্যের বিষয় আর একটি লোক জানতেন, তিনি এক সাধু। এই ঘটনার পর ২/৩ বছর গেল। আলী আবদুলের কাছে সবিনয়ে আরজ করে বললো–টাকাগুলি ২/৩ মাসের মধ্যে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, তিন বছর হয়ে গেল, আমি এতদিন লজ্জায় চাই নি। আমার কষ্টার্জিত টাকা, আপনাকে কয়েক দিনের জন্যে মাত্র দিয়েছিলাম। একেবারে দেই নাই। আবদুল বললেন–অপেক্ষা কর। এইভাবে আরও এক বছর গেল। সাধু এই ব্যবহারের কথা শুনে বললেন, আপনার এই মহত্ত্বের প্রতিদান! ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

অবশেষে আলীকে রাজদ্বারে অভিযোগ জানাতে হল। একজন সাক্ষী না হলে আইনত কীভাবে ডিক্রি হবে? তাই সেই সাধু বিচারপতির সামনে যেয়ে বললেন–আমি আমার সম্মুখে টাকা দিতে দেখেছি। ফলে মোকাদ্দমার ডিক্রি হল। এই মিথ্যা কথায় দোষ হয়, নাই। অক্ষর পালন ধর্ম নয়।

অনুতপ্ত–সাধু, মহৎ প্রকৃতির ফরাশি দস্যু জিন্ ভালজিনকে ইন্সপেক্টর জাভার্টি ধরতে গেলেন, তখন পথে জনৈক সন্নাসিনী উপবিষ্ট ছিলেন। রাক্ষস ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, মাতা, কোনো লোক এই পথ দিয়া গিয়াছেন? সন্নাসিনী জানতেন, সেই পথ দিয়া জিন ভালজিন ঘরে প্রবেশ করে লুকিয়ে আছেন। তথাপি ইন্সপেক্টরের অপমান হতে তাকে রক্ষা করবার জন্য অম্লানভাবে কঠিন রূঢ় কণ্ঠে ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললেন–না, এ পথ দিয়ে কেউ যায় নাই। জিন্ ভালজিন আল্লাহর কাছে বহু পূর্বে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে মহাপুরুষ হয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ধর্ষ প্রতিহিংসাপরায়ণ ফরাশি পুলিশ তাকে চিরজীবন দাগী করে রেখেছিল। যাই হোক সন্ন্যাসিনী মাতার এই মিথ্যা কথা সত্য অপেক্ষা মধুর, পুণ্যজনক এবং সুন্দর। তথাপি জীবনের কাজে মিথ্যা কথা পাপ। যে মিথ্যা বলে সে সমুদ্রে ভাসমান তৃণখণ্ডের মতো–যে ভর সয় না, যার জীবনের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব নাই। মিথ্যাকে আন্তরিক ঘৃণা করবে, এবং যে মিথ্যা বলে তাকেও আন্তরিক ঘৃণা করবে। জনৈক মৌলবী সাহেব সারারাত্রি নামাজ পড়তেন, অথচ বিচারালয়ে পরিষ্কার মিথ্যা বলতেন। জীবনে পরীক্ষায় যে জয়ী হয় না–তার নামাজের আবৃত্তি করে কী লাভ! অন্ধেরা বুঝে না মানুষ এবং খাঁটি মুসলমান হবার জন্য আল্লাহ্ নামাজ পড়ার আদেশ দিয়ে তাঁর বাণীগুলি দিনের মধ্যে পাঁচবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যাতে মানুষ সাবধান হয়–সতর্ক হয়। আল্লাহর আদেশগুলি সর্বদা চোখের সামনে দেখে মানুষ মনে করে-সত্যে লাভও নাই, বলও নাই। তা হলে আর কেন বল–”আল্লাহু আকবর। আর সেই মহাবাণী বলে মাটিতে মাথা রাখ। এ ভণ্ডামি কেন কর। আল্লাহ্ অর্থ সত্য হক, ন্যায়, বিচার, উত্তমতা। মুখে যা বল, কার্যে তার বিপরীত সাক্ষ্য দাও। তা হলে কী করে বলি তোমরা ঈমানদার, তোমরা মুসলমান?

শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরেই তার কর্ণে ‘আল্লাহু আকবর’ এই মহাবাণীর ধ্বনি তোলা হয়। হায়, জীবন ভরই সে কিন্তু এই মহাবাণীর অপমান করে। তার মুখের আর জীবনের কাজে সঙ্গতি কৈ?

.

১৪. প্রতিবেশীকে প্রেম করিও

আল্লাহর আদেশ–প্রতিবেশীকে প্রেম করিও। কৈ আপন প্রতিবেশীর সঙ্গেই তো মুসলমানের বেশি বিরোধ। “আপন ভ্রাতার সঙ্গে প্রথমে সন্ধি কর, অতঃপর মসজিদ ঘরে এস।” মানুষ নিজ প্রতিবেশীকে ঘৃণা করে, ছোট মনে করে–এই তো মুসলমান সমাজের আজ দৈনন্দিন কাজ।

যে ধার্মিক হতে চাও, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে চাও–সে প্রতিবেশীর সঙ্গে আত্মীয়তা কর। প্রতিবেশী আত্মীয়ের চাইতেও আপন। যে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব রাখে না–তার ঘরের পার্শ্বে চলাচল বন্ধ করবার জন্যে বেড়া তোলে–তার পক্ষে উচিত নয়, নামাজ ও কোরান পাঠ করা। প্রতিবেশীর জন্য অন্তরে যার সত্যের আলো জ্বলে না–কলবে (হৃদয়ে) যে ঈশ্বরের বাণীর ধ্বনি শুনতে পায় না–তার আবার রোজা-নামাজ কী? তার আবার ধর্ম কী?

প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখ মিলিত কর। তার সহস্র অপরাধ ক্ষমা। কর। তাকে আপনজন বলে গ্রহণ কর। তোমরা কি শহরবাসী সে প্রতিবেশীকে চেন না–যে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে না? সে দস্যু, বিধর্মী এবং ব্যাভিচারী, সে তোমার প্রতিবেশী হলেও তাকে বেগানা অর্থাৎ তাকে বিদেশী মনে করবে।

আল্লাহর আদেশ–কারো অনিষ্ট করো না। মানব জীবনের কাছে আল্লাহর এই-ই অন্যতম শ্রেষ্ঠ আদেশ। যে ব্যাক্তি দ্বারা মানুষ দুঃখ পায় না, সেই তো ধার্মিক। ফকিররা পথে কাউকে বেদনা দেন না, আর তুমি নরাধম, গায়ের জোরে নিত্য মানুষকে কত দুঃখ দিচ্ছ! অপেক্ষা কর আল্লাহর শাস্তি তোমার চক্ষুকে অন্ধ করবে, তোমার বাহু শক্তিহীন হবে, তোমার পা অবশ হয়ে যাবে–তোমার নিকট আত্মীয় বিনষ্ট হবে। হে অবোধ, সাবধান হও। আল্লাহর শাস্তি নিকটবর্তী।

আল্লাহর আদেশ-ব্যভিচার করো না।

হায় কী সর্বনাশের কথা! বাংলার পথ-ঘাট ব্যভিচারের পাশে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে–ব্যভিচারের উৎসব চলছে। আল্লাহর গজব এসে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীকে নিশ্চয় ধ্বংস করবে। কেন ব্যভিচার কর? আল্লাহ্ কি তোমাদের বিবাহিত হতে নিষেধ করেছেন? বাংলার ব্যভিচারের জন্য হিন্দু সমাজই দায়ী বেশি–হায় এ মহা পাপের ভার ধরণী সহ্য করতে। পারে না। ওগো মা, ওগো জননী! তোমাদের পায়ে ধরি, ব্যভিচার করো না যদি অন্নের কাঙাল হয়ে বস্ত্রহীন হয়ে তোমরা ব্যভিচার করতে বাধ্য হয়ে থাক, তবে হে মুসলমান সমাজ, নামাজ বন্ধ করে ব্যভিচারিণী পাপ ব্যবসায়িনী নারী সমাজকে অন্ন, বস্ত্র এবং আশ্রয় দাও। এ পাপ যত দিন বন্ধ না হবে ততদিন তোমাদের নামাজ হবে না। কিছুতেই না। মুসলমান তুমি কি মরে গিয়েছ? তোমরা বেঁচে থাকতে আল্লাহর এত অপমান? এ পাপ কি চোখে দেখা যায়! হায়! হায়! কী হল। নারীদেহের কী দুর্গতি!

হায়, বাংলার যুবক সমাজ, হে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ধনী, তোমরা ব্যভিচারের পাপকে প্রশ্রয় দিও না। এর মতো মহাপাপ আর নাই। এর ফল ইহকালেও অতি সাংঘাতিক।

ওগো! বাংলার পিতা-মাতা, তোমরা আপন আপন কন্যাকে শিক্ষিতা কর, তা হলে এ। মহাপাপ নারী কর্তৃক অনুষ্ঠিত হবে না। তোমরা বিধবাকে ঘরে রেখ না–তাদের বিবাহিত করাও।

বেশ্যাকে বল, সে যেন তার মহাপাপের জীবন ছেড়ে দেয়!–সে জীবিকার জন্যে অন্য কোনো ব্যবসা করুক। দোকান দিক। এমন কুকার্য কি মানুষে করে? এমন ঘৃণিত কাজ কি নারীর দ্বারা অনুষ্ঠিত হবে? অভাবে, দুর্গতিতে, সমাজ তাড়িত হয়ে নারীকে যেন বেশ্যাবৃত্তি না করতে হয় তা হলে দেশের সকল লোককেই এ মহাপাপের অংশগ্রহণ করতে হবে। হে দেশের সাহিত্যিকগণ, হে সমাজ-সংস্কারক, হে দেশ-সেবক, হে সম্পাদক তোমরা দেশে ব্যভিচারের বিরুদ্ধে তোমাদের আপন আপন শক্তি প্রয়োগ কর। এই কাজের জন্য একদল নারী মুক্তিসেনা প্রয়োজন। পতিত নারী বিষ এবং আগুনস্বরূপ–ওদের কাছে পুরুষ মানুষের যেতে নেই। গেলেই কলঙ্কিত হবে, পা ফসকে যাবে। কাজ করবার ওদের বাঁচবার শক্তি থাকবে না। নিজেরাই পতিত হবে।

পাপের চিত্ত দেখতে হলে, বেশ্যাদের কাছে যেও–এ মহাপাপ ক্ষেত্র, এমন মহাশ্মশান আর নাই।

আল্লাহর আদেশ–পরের কুৎসা রটনা করো না।

পরের নিন্দা করবার কী উৎকট ইচ্ছা সকলের! নিজের মধ্যে কত কদ, কত পাপ, সেদিকে একটি লোকও তাকায় না, শুধু পরের কথাই বলে।

যে যত ছোট সে তত পরের দোষ দেখে। নিজের দোষ-ত্রুটির কথা ভাবলে, সারা জীবন কেটে যায়। তুমি আবার অপরের ত্রুটি আলোচনা করছো? আল্লাহ্ যা নিষেধ করেছেন, কোন্ সাহসে তা কর? আবার নামাজ পড় শুধু নামাজই কি আল্লাহর আদেশ? আর যে আল্লাহর শত আদেশ উপেক্ষা করছ–সে দিকে লক্ষ্য নাই। নামাজ পড়লে চোখে দেখা যায়, তাই আনুষ সুখী হয়। আবার যে সব পাপ গোপনে করা হয় তা তো দেখা যায় না, তাই মানুষ বিরক্ত হয় না। মানুষ যে দিনের মধ্যে উঠতে বসতে কত পাপ করে, আল্লাহকে কত রকমে অপমান করে, তার কত আদেশ অগ্রাহ্য করে–তা ধরে দেখতে গেলে, মনে হয়, মানুষ শয়তানের অনুচর, আল্লাহর দাস নয়। দাসের কী এই কাজ? দাস কি কখনও প্রভুর আদেশ অমান্য করে আল্লাহকে এইভাবে তোমরা অপমান কর, তবু তিনি তোমাদের কত দয়া করেন। সারা জীবন ভরে তিনি তোমাদের অনুতাপের জন্য অপেক্ষা করেন। জীবন শেষ হয়ে যায়, তবু তোমরা সজাগ হও না।

আল্লাহর আদেশ পিতা-মাতাকে অমান্য করো না। অনেক মানুষকে দেখা যায়, জুম্মার নামাজ পড়তে চলেছে, অথচ ঘরে মা কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে কোন্ ফাঁকে মরে আছেন সে খবর রাখে না–মাকে যত্ন করা তো দূরের কথা। এই তো মানুষের নামাজ।

ছেলে সেয়ানা হয়েছে। বাপ-মা কী অবস্থায় থাকেন, কী খান সে সংবাদ কে রাখে? সেই বুড়াবুড়ি শেষকালে সংসারে দয়ার পাত্র-পাত্রী।

আল্লাহর আদেশ–পরের দ্রব্যে লোভ করো না। পরের দ্রব্যে তো লোভ লেগেই আছে–পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার দুর্নিবার ইচ্ছা সব হাজি, সব নামাজির আছে। কে কবে আপন বোনের সম্পত্তি তাকে দিয়ে থাকে? এসব আগুন খেয়ে নামাজ পড়লে, নামাজ হবে না। মৃত ভ্রাতার নাবালক সন্তানগণকে বঞ্চিত করে, বিধবা পত্নীকে বঞ্চিত করে তাদের সম্পত্তি নিজে ভোগ কররার কী লোভ তোমার!

কেউ যদি কিছু গচ্ছিত রাখে, তাও ভোগ না করতে পারলে, মোটেই ভালো লাগে না।

পরের দ্রব্যকে হারাম ভাব। তোমার উপর কেউ সম্পত্তি পরিচালনার ভার দিলেন। তুমি ধীরে ধীরে তার অজ্ঞাতসারে একে একে সব গ্রাস করতে থাকলে। তোমার নামাজ রোজার কামাই নাই। ধর্ম খুবই ঠিক রাখছ বটে। ভাবছো আল্লাহ কিছুই বুঝতে পারছেন না। তোমার লম্বা কুর্তা দিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছ–আল্লাহকে ঠকাতে পারবে না।

আল্লাহর আদেশ-চুরি করো না।

জনৈক পদস্থ রাজপুরুষ গোপনে রাত্রে ঘুষ আদায় করতেন–শুক্রবারে বাচ্চাহারা গাভীর মতো মসজিদ ঘরে দৌড়ে যেতেন। এ তো চমৎকার নামাজ! নামাজের ত্রুটি হয়।

কিন্তু ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, এসব লেগেই আছে। বোধ হয় বণিকের খাতার মতো জমা-ওয়াসীল হয়ে পুণ্যের ভারই বেশি হবে। আর সেই পুণ্যবলে বেহেস্তে লেজ দোলাতে দোলাতে উপস্থিত হবে।

এই যে নামাজ–আমার মনে হয় এও অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা। ধার্মিক বলে। সমাজে নাম থাকলে, অর্থ উপার্জনের কেননা বিঘ্ন হবে না। এই হচ্ছে ধারণা।

.

১৫. অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা

মানুষকে অন্ন দেবার মতো মহাধর্ম আর নাই। ভরা পেটে খাবার দান করা এমন কিছু নয়, কিন্তু জগতে তাই হয়। বাইরে রাস্তায় পড়ে মানুষ এক মুঠো অন্নের জন্য কাতর চিৎকার জানাচ্ছে। ভিতরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি জোড়হস্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেও তাকে আরো খেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, বড়লোক, এদের প্রীতিভোজ দিতে নিষেধ করি না–কারণ এরও একটা আবশ্যকতা আছে। যার আছে তারও তো ক্ষুধা লাগে। আনন্দ তার। জন্যেও দরকার। অন্নহীন দরিদ্রের কথা একেবারে ভুলে যেও না। তোমরা বড়লোকের সন্তান, ঘরে অন্নের অভাব নেই। কিন্তু রোজার মাসে আল্লাহ তোমাদের অন্নহীন উপবাসীর বেদনা বুঝবার সুবিধা করে দিয়েছেন সেই ব্যথা ভেবে দরিদ্রের কথা চিন্তা কর। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পেট ভরে খেয়ে শুয়ে থেকো না–তার মতো পাপ আর নাই।

দেশের অন্নহীনদের অর্থ উপার্জনের সুবিধা করে দেওয়া মহৎ লোকের কাজ–দেশ সেবকের কাজ, পুণ্যবানের কাজ। শুধু শুক্রবারে সমবেত উপাসনা করলে উপাসনা সিদ্ধ হবে না–ওরে অবোধ!

শুধু অক্ষর পালন করলে আল্লাহর আদেশ পালন হবে না। সমবেত হও সবাই, দেশের জনহিতে কাজ কর, মানুষের ক্ষুধার স্থায়ী মীমাংসা কর–ভিক্ষা দিয়ে কটা লোককে কদিন বাঁচান যায়। তথাপি ভিক্ষা দাও–দান কর, দান ব্যতীত নামাজ সিদ্ধ হয় না। দেশের লোকের বেদনার চিৎকার শোন না? ওরে অবোধ! এই কি তোমার প্রাণের দরদের পরিচয়! দরদ ছাড়া কি স্বর্গের যোগ্য হওয়া যায়? দরদ চাই, প্রেম চাই।

যদি জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, ফকিরিতে আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে পার, তবু তোমার কোনো মূল্য হবে না, যদি না তোমার প্রাণে প্রেম, দরদ, আদর-মহব্বত থাকে। প্রেম করতে শেখ, অহঙ্কার ত্যাগ কর–মানুষকে, আপন ভ্রাতাকে দরদের দাবি হতে বঞ্চিত করো না। ওরে পশু! ভ্রাতাকে বঞ্চিত করে মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছ? পশুতেও তো গোয়াল ঘরে তার বন্ধুর অঙ্গ চাটে। তুমি মানুষের বেদনা-চিৎকার শুনে কি ঘরের দরজা দিয়ে শুলে? হায়, মানুষের কী হল? মানুষ ঈশ্বরের সন্তান হয়ে কি এত নিষ্ঠুর হল! পিতার মৃত্যুতে ফাতেহা উপলক্ষে বৃথাই ৫০০ টাকা ব্যয় করলে? যে মানুষ জীবনে ধর্ম করে নাই, পয়সা দান করে নাই, মরণের পর তার দান আর একজন করলে কী হবে? জীবিতের জন্য ধর্ম। মৃতের জন্য নয়। জীবনে বেঁচে থাকতেই ধর্ম করে যাও। দেশের আর্ত পীড়িতের জন্য ফাতেহার পরিবর্তে বরং হাসপাতাল স্থাপন কর। এতে মানুষের কত মঙ্গল হয় তা কি একটু বুঝতে পার না! এমন পাগল কোথায় আছে?–যে আপন মঙ্গল, জাতির মঙ্গল ভাল বুঝে না? দেশের সর্বত্র শিশুদের জন্যে, পীড়িত প্রসূতির জন্যে, বৃদ্ধের জন্যে হাসপাতাল স্থাপন কর এবং মানুষকে বাঁচাও। এর মতো ধর্ম আর কী আছে? এই দুঃখের দেশে এই দরিদ্রের দেশে কি মান করা সাজে? অর্থশালী হও, অর্থ উপার্জন কর–সেই অর্থ দিয়ে পীড়িত দুঃখীর সেবা কর। মাঠে পরিশ্রম কর, ঘর ধানে অনে ভরে উঠুক। মানুষকে অনুদান কর। অন্নদানের মতো পুণ্য কী আর আছে! বাড়িতে অতিথি এলে যে অন্য বাড়ি দেখিয়ে দেয়, ধিক তাকে! মানুষকে, অতিথিকে, প্রতিবেশীকে অন্ন দাও–তারা পেট ভরে খাক এবং দোয়া করুক! কৃষি কর–এবং প্রচুর ধান গোল ভর্তি করে তোল। দান কখনো সুদি করে লাগাতে নাই। দানের জন্যেই অন্ন। মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অন্ন গ্রহণ করতে বল–এরই নাম প্রেম ও ভালবাসা। যাবৎ না মানুষকে আপনার ভাই বলে ভালবাসতে পার, তাবৎ স্বর্গের যোগ্য তোমরা হবে না। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে টাকার হিসাব করো না। অফুরন্ত উপার্জন কর এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দান কর। তোমার গ্রামের নিঃসহায় বিধবা পীড়িতেরা যেন অভুক্ত এবং বেদনায় ব্যথিত না থাকে।

মানুষকে গোপনে দান কর যেন তোমার দানশীলতার পরিচয় কেউ না পায়।

দানে যার হস্ত পবিত্র হয় না, সে যেন অজু করে নামাজ না পড়ে।

যে বাহুল্য ব্যয় করে, যার নিজেরই বিলাস আকাঙ্ক্ষার তৃপ্ত হয় না, সে ক্ষুধিত, মরণ মূৰ্ছিতকে কী দেবে? সেই নিষ্ঠুর আপন সুখ-চিন্তায় ব্যস্ত-ব্যথিতের বেদনা-চিৎকার তার কানে কী পৌঁছাবে?

Lay by something in youth, so that you may not sharve in old age.

মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক ধর্ম যা তাই বড় ধর্ম। মানব-সমাজে থেকে নিত্য মানুষ যা করবে, মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে নিত্য ব্যবহার করবে, তারই আদর্শ এ ধর্ম জীবনে দেওয়া হয়েছে। কোনো গুপ্ত মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব এখানে প্রচার করা হচ্ছে না। আম গাছে কাঁঠাল তৈরি করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, মরা মানুষ বাঁচান–এসব জগতে হয় না! ওসব কথা সত্য হলেও বা শুনতে ভালো শোনা গেলেও ধার্মিকের কাজ নয়। ঈমানের বলে মরা মানুষকে জীবিত করা যায়–এসব বিশ্বাস বর্তমানে না করাই উচিত।

“কাল কী খাবে, তার চিন্তা আর করো না–
কালকের জন্য কালকের চিন্তাই যথেষ্ট।”

যে জাতির পুরোহিত এই বাণী প্রচার করেছেন, তার শিষ্যেরা কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করে বসে আছেন। রিক্তহস্ত হওয়া তাঁরা পাপ ও মূর্খতা মনে করেন। এই বাণী যতই মহৎ কার্যত মানুষের অভাব সঞ্চয় ব্যতীত, নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত অতি কঠিনভাবে পূরণ হয়-এক রকম হয় না। অভাবে, দুঃখে-দারিদ্রে মানুষ মরে যায় অথবা চির অবহেলিত হয়ে শৃগাল-কুকুরের মতো জগতে বাঁচে। এ অভাব পূরণ করা পূর্ব হতে সতর্ক হওয়া, বুদ্ধি করে পূর্ব হতে বিপদের দিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখাই ধর্ম করা–অভাবের দিনে আল্লাহই পূরণ করবেন, এ বিশ্বাস পোষণ করা ধার্মিকের কাজ নয়–এই বিশ্বাস মূখেরাই পোষণ করে। সন্তান হবার আগে মায়ের স্তন দুগ্ধ ভর্তি হয় এ কি দেখ না।–পূর্ব হতে সঞ্চয় করে রাখ এবং সতর্ক হও। এ জগতে কেউ কারো কথা ভাবে না। নিজের অভাব পূরণ না করে মানুষ তোমার অভাব পূরণ করবে, এ আশা করা উচিত নয়।

এক দরবেশ দেখলেন মাঠে এক মরা পড়ে আছে। সিংহ বৃষ হত্যা করে রেখে গেছে, শৃগাল আনন্দে বিনা পরিশ্রমে তাই খাচ্ছে। দরবেশ ভাবলেন, শৃগাল যখন বিনা পরিশ্রমে বসে বসে খাচ্ছে, তখন খোদাতায়ালা ইচ্ছা করে এইভাবেই বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, তবে আমি কেন অন্নের জন্য উদ্বিগ্ন হই। এক স্থানে বসে থাকি, আপনা-আপনি আহার আসবে। সেই কথা ভেবে দরবেশ এক অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। ১৫ দিন অতিবাহিত হল, কোনো সাহায্য এলো না। তখন তিনি জ্ঞান–বাণী পেলেন। কেন শৃগালের মতো হতে চাও? সিংহের মতো নিজে চেষ্টা করে বৃষ হত্যা কর–শৃগালেরা খাবে।

কথাও তাই, শৃগাল হতে ইচ্ছা করা বীর ধার্মিকের কাজ নয়।

তার পক্ষে সিংহ হওয়াই উচিত।

যার অর্থ নাই, সে মানুষকে কি করে বাঁচাবে?–মানুষকে কি খাওয়াবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *