০৬-১০. ধর্মের জীবিত উৎস

০৬. ধর্মের জীবিত উৎস

মানব হৃদয়ে স্বাভাবিক ধর্মের উৎস আছে। কোনো বাঁধাধরা পথ তার জন্য নির্দেশ করা। চলে না।–কালধর্মে নিত্য নব নব সমস্যা তার জীবন সম্মুখে উপস্থিত হয়। তখন সে কোনো গ্রন্থের বাণীর অপেক্ষা করে না। আপনার জীবিত আত্মার আসনে জীবিত ঈশ্বরের বাক্য সে শুনে এবং কাজ করে। হৃদয় আসনে জীবিত ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা, সত্যের আত্মা, প্রজ্ঞার বাণী মেনে চলাই তার ধর্ম। যে আত্মায় ঈশ্বর বাক্য অনুভব করে না–কোনো ধর্মগ্রন্থ তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ জন্য প্রত্যেক ধার্মিক মানুষকে পবিত্র আত্মায় বিশ্বাসী হতে হবে।

পবিত্র সত্যের আত্মা মানুষের প্রতি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আল্লাহ্ স্বয়ং মুমীনের আত্মায় আসন গ্রহণ করেন। আত্মায় আল্লাহর সত্তা অনুভব এবং তার বাণী শ্রবণ করা। ভাববাদী পয়গম্বরের কার্য। যে মানুষ অপবিত্র চিত্ত, মিথ্যাবাদী, সে কখনও প্রাণে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করে না। নিষ্কলঙ্ক, সত্যবান, বিনয়ী, প্রেমিক, দরদী, ক্ষমাশীল, আত্মশ্লাঘাবর্জিত, বৈধ অন্নভোজী মহব্যক্তি যাঁরা, তাঁরাই হৃদয়ে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করেন এবং সেই বাক্যমত কাজ করেন।

প্রার্থনা ব্যতীত কখনও মনুষ্যচিত্তে ঈশ্বরের আসন অধিষ্ঠিত হয় না–দুরাত্মা লোকদের সঙ্গে ঈশ্বর কথা বলেন না।

হৃদয়ে ঈশ্বরের সত্তা অনুভব করা এবং জীবনে তার উপদেশ মতো কাজ করাই তোমার ধর্ম। প্রচলিত ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে তোমার কাজের কথা তত ভাববে না। নিজের কাজে নিজে মিথ্যা হবে না, তা হলেই যথেষ্ট হল।

লোকে বলে কে ধার্মিক, কে অধার্মিক, কে মনোনীত, কে অমনোনীত তা কেউ জানে না। কথাটি অনেকাংশে ঠিক। জীবনের কাজ দেখে সব সময় বুঝতে পারা যায় না। লোকটি নিরপরাধ কিংবা ঈশ্বরের কাছে অপরাধী–প্রভুই জানেন, কে সাধু এবং কে অসাধু।

মানব জাতির একটি সাধারণ ধর্ম আছে। ধর্মের উদার ক্ষেত্রে সকল মানুষই সমান। তান্ত্রিক সন্ন্যাসী গোপনে যদি ব্যভিচার করে, মরণের পূর্বে একটিবারও কি সে আত্মপাপ অনুভব করে না? যদিও সে জীবনে মানুষের অফুরন্ত ভক্তি লাভ করেছে। সবাই অন্তরে জানে সে নিজে ভালো কী মন্দ–যদিও মানুষ মুখে বড়াই করতে ত্রুটি করে না। মুসলমান, হিন্দু, জৈন, খ্রিষ্টান, পারসীক, বৌদ্ধ সকল জাতির মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে আপন আপন চিত্তে একটা পরিষ্কার ধারণা আছে। জীবনকে বেদনা দেওয়া, নারীকে দুঃখ দেওয়া, পরের ধন অপহরণ করা, মিথ্যা বলা, ছলনা করা, ব্যভিচারের পাপে লিপ্ত হওয়াকে কোন্ ধর্মে ভাল কাজ বলে জানে? অথচ সকল ধর্মের অধিকাংশ লোক এই সমস্ত পাপ কাজ করে। জীবনে ভালবাসা, পরোপকার, মানব-দুঃখ, সহানুভূতি, সতীত্ব, ক্ষমাশীল, দরদ, বিনয়-কে না শ্রদ্ধার চোখে দেখে! মানব ধর্মের কোনো ধার ধারে না–মারামারি করে ধর্মের নাম নিয়ে। পাষণ্ড যারা তার ধর্মের নামেই বড়াই করে বেশি। যদিও তাদের জীবনে ঈশ্বরের কোনো আসন নাই।

‘জীব মাত্রেই শিব’ এ কথা হিন্দুরা মানে? মুসলমান শাস্ত্রে নামাজের প্রতি জনসাধারণকে এত কঠিনভাবে ভক্তিমান হতে আদেশ করা হয়েছে, নামাজ পালন করতে এতবার অনুজ্ঞা করা হয়েছে নামাজ ত্যাগ করলে এত ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখান হয়েছে মুসলমান জাতি সব ভুলে নামাজই সর্বাগ্রে পালন করতে অগ্রসর হয়,–নামাজ ছাড়া আর কোনো কর্তব্যের কথা তাদের মনে আগে আসে না। নামাজ পড়া তাদের জীবনের বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোনো দায়িত্ব তারা ভালো করে অনুভব করে না। বুঝে হোক, না বুঝে হোক নামাজ পড়তে হবে। যে সব ঈশ্বর বাক্য তারা পাঠ করে সেই বাক্যের মর্ম গ্রহণ–তদানুসারে জীবন গঠন করা বিশেষ আবশ্যক বোধ করে না। কোনো রকমে আবৃত্তি করে নামাজ পড়তে পারলেই তারা মনে করে ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ আজ্ঞা পালন করা হল, তারা ইসলাম ধর্ম পালন করলো। নামাজের জন্যে এই অতিরিক্ত ভীতি প্রদর্শন মুসলমান সমাজের ধর্ম জীবনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। তার আধ্যাত্মিক জীবন চূর্ণ হয়ে গেছে। নামাজকে ছেড়ে ধর্ম সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে তারা মোটেই সাহস পায় না। নামাজ-রোজা হয়ে পড়েছে তার কাছে দুই সশরীরী দেবতা। সে এইভাবে প্রাণে মূর্তিহীন প্রতিমা পূজা শুরু করেছে। সে ঈশ্বরকে চেনে না শুধু নামাজ পড়ে। তার বিশ্বাস, নামাজ ত্যাগই সকল পাপের। বড় পাপ। কিন্তু তা তো নয়। অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্রুরতা, মিথ্যা, কথন, দয়াশূন্যতা, ছলনা, প্রতারণাই বড় পাপ কিন্তু সে তা বিশ্বাস করে না, এই অবিশ্বাসই তার পতনের কারণ। এই জন্যেই তার জীবন মানুষের কাছে এত দুঃসহ। নামাজ অর্থাৎ প্রার্থনা দুই-এক বার ত্যাগ করলে তেমন ক্ষতি হয় না। আসল ধর্ম ঠিক রাখা চাই।

.

০৭. ধর্ম কী চোখে দেখলাম

একদিন আষাঢ়ে বৃষ্টি এবং শীতল বাতাসের মাঝে একটি দরিদ্র শিশুকে খালি গায়ে খালি পায়ে একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় আমার পার্শ্ব দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। সেই দিন ধর্ম কী তা চোখে দেখলাম।

মনুষ্য শিশুকে মানুষ করে ভোলা ইহাই ধর্ম। তাকে বস্ত্র দাও, তার জন্যে স্কুল তৈরি করে দাও–এ জন্য তোমরা অর্থ দান কর। মনুষ্য শিশুর সেবা কর। নামাজ পড়লে কি স্বর্গে যাওয়া যায়? নামাজ পড়ার মধ্যে ধর্ম নাই। যুদ্ধের পূর্বে কি বাদ্য এবং যুদ্ধসঙ্গীত গায় না? তাতে সৈন্যদের বুকে উৎসাহ আসে। গান আর বাদ্যই যুদ্ধ নয়। গানে যুদ্ধ জয় হয়। ধর্ম জীবনের সঙ্গীত, নামাজে ধর্ম পালন হয় না। ওর দ্বারা আত্মার মহত্ত্ব ধর্ম সাধনের জন্য তৈরি হয় মাত্র। ধর্ম পড়ে আছে জীবনের ক্ষেত্রে, জগতের মাঝে-ধর্ম সেখানে, যেখানে শত কাজে মিথ্যাকে দমন করে, পরোপকারে মানব কল্যাণে, বিশ্বের সেবায়, লোভকে জয় করে। নিজেকে জয় করে পালন করতে হবে–কাজ করে ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। শুধু মুখে ঈশ্বর বাক্যের আবৃত্তি করলে কোনো লাভ হবে না। ঈশ্বর মনুষ্যজাতিকে কী কথা বলেছেন :

প্রাচীন কালে ঈশ্বর তাঁহার বন্ধু ইব্রাহীম নবীকে মনুষ্য জাতির জন্য দশটি আজ্ঞা দিয়েছিলেন :

১. মনুষ্য হত্যা করো না।

২. মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না–অর্থাৎ মিথ্যা ঘটনা সত্য বলিয়া সমর্থন করিও না। অন্যায়ের পক্ষে কথা বলিও না।

৩. প্রতিবেশীকে প্রেম করিও। প্রতিবেশীর সহিত অসদ্ভাব করিয়া অপরের সহিত মিত্রতা করিও না।

৪. মিথ্যা কহিও না।

৫. কাহারও অনিষ্ট করিও না।

৬. ব্যাভিচার করিও না।

৭. পরের কুৎসা রটনা করিও না।

৮. পিতামাতাকে মান্য করিও।

৯. পরের দ্রব্যে লোভ করিও না।

১০. চুরি করিও না।

তোমরা কি মনে কর ঈশ্বরের এই আদেশগুলি বসে বসে শুধু পাঠ করলেই হবে, না আদেশ অনুসারে কাজ করতে হবে? কোরানে ঈশ্বর বাক্যগুলি শুধু পাঠ করবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, না ঈশ্বরের আদেশের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে হবে? তবে কেমন করে বল নামাজেই সব–নামাজের দ্বারাই ধর্ম পালন হল। এমন পাগল ভ্রান্ত জাতি তো কোনো কালে দেখি নি। মুসলমান জাতি এত ভ্রান্ত কীভাবে হলেন? এমন কী শিক্ষিত লোককেও জীবনে সত্য সুন্দর হবার সাধনা করতে তাদের লজ্জা হয় না। কোনো মহৎ হিতানুষ্ঠানে তারা সেরূপ। উৎসাহ দেখান না। সত্যকে মিথ্যা করেন, মিথ্যাকে সত্য করেন–কী ব্যাপার?

সমস্ত মুসলমান জাতির ভিতর এই ভ্রান্তি এসেছে। জীবনের কার্যে তারা ধর্ম পালন করতে চান না–জীবনকে তারা মিথ্যা অন্যায়, সর্ববিধ পাপ থেকে রক্ষা করবার কোনো চেষ্টা করেন না। কোনো অন্যায় করবার আগে তারা ভীত হন না–ভাবেন না, আমরা পাপ করছি, ঈশ্বরের আজ্ঞার অপমান করছি। দিনে দিনে মহৎ হতে মহত্তর, সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে ঈশ্বরের যোগ্য হবার কোনো চেষ্টা মুসলিম জীবনে নাই। আউজুবিল্লাহ তাঁরা মুখে পাঠ করেন মাত্র। এই বাক্য অনুসারে শয়তানের প্রভাব হতে মুক্তি পাবার চেষ্টা তাঁরা বিশেষ দরকার মনে করেন না। সুর করে প্রাতঃকালে বাক্যটি পড়লেই তাদের বিশ্বাস বহু পুণ্য সঞ্চিত হল। হায় কী ভ্রান্তি।

এই হাজি সাহেব। তিনি হজ করে ফিরে এলেন। সম্পত্তির যে-সব শরীক ছিল, তারা তাকে বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞানে সম্পত্তি পরিচালনার ভার তার হস্তে সমর্পণ করলেন। তিনি গোপনে তহশীলদারের সঙ্গে যোগ করে, সম্পত্তির খাজনা আত্মসাৎ করতে লাগলেন, ফলে সম্পত্তির খাজনা বাকি পড়ায় সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। হাজি সাহেবের কত সম্মান ছিল, তিনি অন্ধকারে থাকতে উঠে সুর করে প্রাতঃকালীন নামাজ পড়তেন এবং অনেক বেলা পর্যন্ত কোরান পাঠ করতেন। রোজার মাসে রোজা করতেন। তার এই রোজা, নামাজ ও কোরান পাঠ দ্বারা কি ধর্মের পুণ্য তিনি সঞ্চয় করেছিলেন? তাঁর মনে হয়তো একটা গোপন বিশ্বাস ছিল, আমি যতই অন্যায় করি, এই রোজা, নামাজ এবং কোরআন পাঠে সব কেটে যাবে। তা কি কাটে! মানুষ অনবরত দিনের মধ্যে পাঁচবার ঈশ্বরবাক্য পাঠ করলে–পাপ করতে, অধর্ম করতে তারা ভীত হবে, তারা মানুষ হবে, জীবনে ধার্মিক হবে, এই জন্যেই রোজা নামাজের এত কঠোর ব্যবস্থা। কার্যের দ্বারা ধার্মিক হবে। নামাজ পড়ে মানুষ ধার্মিক হবে না। তসবীহ্ পাঠ, রোজা-নামাজ করা দেখে মানুষকে ধার্মিক বলা যায় না।

জীবনের কার্যে সাধু হতে হবে। প্রতি দিনকার পাপ কার্যে যদি মানুষ ধর্মে পতিত না হয় তবে বেশ্যাখোরের রোজা-নামাজ সিদ্ধ হবে না কেন? পাপ ও মিথ্যা জীবনের সঙ্গে রোজা-নামাজ সিদ্ধ হয় না। জীবনকে সুন্দর ও সংস্কৃত করতে আপ্রাণ চেষ্টা কর এবং সেই। সঙ্গে বুঝে প্রার্থনা কর। সত্য জীবনের প্রার্থনা গ্রাহ্য হয় এবং প্রভু তার উত্তর দেন। চোর, বাটপাড়, কুর, কুক্ৰিয়াসক্ত ও ঘুষখোর এবং লজ্জা ও অনুশোচনাশূন্য সৃষ্টির আবার নামাজ রোজা কী? একবার নামাজ ত্যাগ করলে পাপ হয় না,–একটা মিথ্যা বললেই, অন্যায় কাজ করলেই পাপ। এর বিপরীত বিশ্বাস মুসলমানেরা পোষণ করেন।

.

০৮. পাপ, মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

পাপ, মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচার–এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চাই, এই-ই ধর্ম।

পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর। ঈশ্বরের সৈনিক হও।–ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার কর।

হে ঈশ্বরের সন্তানেরা! তোমরা থাকতে ঈশ্বরের এই অপমান? দেখতে পাচ্ছ না, কেমনভাবে চারদিকে পাপের আগুন জ্বলে উঠেছে। মানবাত্মা কীভাবে অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে? অত্যাচারে ব্যথিত নর-নারী কীভাবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে?

কাতর ব্যথিতের ধ্বনি উঠেছে, সৈনিকেরা কি বসেই থাকবে?–প্রকাশ্যে এবং গোপনে আপন আত্মার বিচার সৎ, সুন্দর এবং নিষ্পাপ থাক–মানুষের মনে কোনো দুঃখ দিও না। তোমাদের জীবনের দ্বারা পৃথিবীর দুঃখ সৃষ্টি না হোক। এসব কথা কি আজ পর্যন্ত তোমরা শোন নি? তা হলে এখন শোন এবং গ্রাহ্য কর। এতদিন শুনেছ শুধু রোজা নামাজের কথা। এত দিন শুনেছ রোজা-নামাজই ধর্ম জীবনের কর্তব্যে শেষ হবে। না, তা হবে না–কখনও হবে না।

ঈশ্বরকে প্রচার কর, অথবা যারা করেন, অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য কর। ঈশ্বরের বাক্য সর্বত্র বহাল রাখ। যারা পাপী ও পাপিনী,যারা পতিত ও পতিতা, তাদের রক্ষা কর–ইহাই তোমার ধর্ম। শুধু ভেড়ার মত পেট ভরে খেয়ে এশার (রাত্রির) নামাজ পড়ে শুয়ে থেকো না।

ঘুষ খেয়ো না-প্রবঞ্চনা করো না, মানুষকে গালি দিও না–মনুষ্য সম্বন্ধে মিথ্যা কথা বলো না। তাতে তোমার ধর্ম থাকবে না। তোমরা কি ঈশ্বরকে ভয় করতে চাও না? এই ক্ষুদ্র জীবনে অনন্তকালের সুখ ভোগ করে নিতে চাও? তোমরা তো আমার চাইতে ঈশ্বরকে অধিক বিশ্বাস কর–তবে কেন তাকে ভয় কর না।

জীবনে অন্যায় করো না। মনুষ্য নামের অপমান করো না। এই সামান্য কয়দিনের জন্য এত অত্যাচার করতে, এত অধর্ম করতে কীভাবে সাহস কর? পোশাক পরলে, টুপি মাথায় দিলে কি ধর্ম রক্ষা হয়? আত্মায় ধার্মিক হও।

মানুষের ক্ষুধা ও দৈন্যের মীমাংসা কর। তাকে আলো দাও, জ্ঞান দাও, বুদ্ধি দাও। তাকে পশুর স্তর থেকে দেবতার স্তরে টেনে আন। ধর্মহীনদের সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। কারণ তারা ঈশ্বরের শত্রু–তথা মানুষের শত্রু। দিকে দিকে বেদনার ধ্বনিকে দুপুর রাতে রোজ কাঁদে? হে যুবকদের দল, তোমরা তার কাছে যাও এবং জিজ্ঞাসা কর কী তার বেদনা। তার পুত্র নাকি পীড়িত! চিকিৎসার খরচ নেই, পথ্যের পয়সা নেই, প্রদীপে তেল নেই। তোমরা সবাই দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার ঝুলি ভরে দাও, এইভাবে তার আশীর্বাদ গ্রহণ কর এবং ধর্ম অর্জন কর। . সে কি স্বামীহীন দুঃখী, অন্নহীনা? তোমরা সবাই মিলে তার দুঃখ দূর কর কর। এইভাবে তোমরা জীবন সার্থক কর। কোনো অত্যাচারী কি তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিচ্ছে? তোমরা সবাই অত্যাচারীর বিষদন্ত ভেঙ্গে দাও এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ কর। গান শোন কিন্তু আর সুর কেমন করে তোমাদের আত্মার কাছে বেদনার ফরিয়াদ তোলে, তা কি শোন না? জেনে শুনে যে অন্যায় করে, অপরকে অন্যায় করে বঞ্চিত করে, নিজের কোলের দিকে বড় মাছখানা টেনে আনে–সেই নরপিশাচকে শূকর বলা যায়। তার মুখ দেখতে কত কুৎসিত? কুকুরের মতোই তার মুখ। ঠিক সে-ই নরপিশাচ যার ন্যায় বিচার নেই, যে কুকুরের ন্যায় নিজেই সব গ্রাস করতে চায়।

.

০৯. পবিত্র আত্মা

পবিত্র আত্মা মানুষকে উন্নতির পথে পরিচালিত করে। ন্যায়-অন্যায় কী তা বুঝিয়ে দেন। গুরুর মতো অন্যায় কার্যে মানুষকে অন্তর হতে ভর্ৎসনা করেন। যে পবিত্র আত্মাতে বিশ্বাসী নয়, সে মনুষ্য নামের যোগ্য নয়। পবিত্র আত্মার অবিশ্বাসী নর-নারীকে ধর্মহীন বলা যায়। পবিত্র আত্মাকে কোরানে রুহে কুদ্স’ বলা হয়েছে। মুসলমান সাধুরা অন্যত্র উহাকে ‘মানবাত্মায় ঈশ্বরের আসন’ এই নামে অভিহিত করেন।

পবিত্র আত্মা মানুষের বুকের ভিতর সদা বিরাজ করেন। মানুষ যে যে কথা বলে এবং যে কাজ করে, তার আগে সেই কাজ করা উচিত কিনা, এবং সেই কথা বলা ঠিক কিনা তা বলে দেন। যে পবিত্র আত্মার আদেশ পালন করে, তার অশেষ মঙ্গল হয়। সে ঈশ্বরের পথের সন্ধান পায়। পবিত্র আত্মা মানুষের পরম বন্ধু। পবিত্র আত্মার সহায় যে অনুভব করে, তার কাছ থেকে কোনো মঙ্গলের আশা করা যায় না। তার সংশ্রব ও সহবাস অশেষ দুঃখের কারণ। ঈশ্বর মনুষ্য ভাষায় তাঁর ভক্তের সঙ্গে কথা বলেন না। তার কাব্য পরম সত্যনিষ্ঠ ভক্ত আপন পবিত্র আত্মায় অনুভব করেন এবং তিনি সেই প্রভুর বাক্য মানবীয় জনসমাজে প্রচার করেন। যে মানুষের মধ্যে মিথ্যা আছে, ঈশ্বরের মহামহিমা ও মাহাত্ম্যকে যে ভক্তি ও পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে না; সে ঈশ্বরের বাক্য বহন করবার যোগ্য নয়। সাধারণভাবে ধর্মপরায়ণ নরনারী মাত্রই আত্মার সর্বদা ঈশ্বরের আদেশ লাভ করেন এবং তদানুসারে কার্য করেন। মোটামুটিভাবে সাধারণ শ্রেণীর মানুষ আপন আপন বিবেকের আদেশকে ঈশ্বরের আদেশ বলে গ্রহণ করতে পারেন। বিবেকের বাণী পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে নির্ভুল পরম সত্য ঈশ্বরবাণী আত্মায় প্রতিভাত হবে। ইহাই মানবাত্মার সম্পূর্ণ অবস্থা। ঈশ্বরবাণীরূপে কখনো কখনো শয়তান মনুষ্যকে ছলনা করে। একটু অসতর্ক হলে শয়তানের হাতে মানবাত্মার চরম দুর্গতি হবে। হয়ত ঈশ্বরবাক্য পালনের ভ্রান্ত ধারণায় সে নরকের পথে যাত্রা করবে। ঈশ্বরবাক্য সর্বদা সাহসী, বিদ্যুতের মতো, দিনের আলোর মতো সত্য–সে ধ্বনিতে বিন্দুমাত্র সংশয় বা সন্দেই থাকে না। যথার্থ ভক্ত ঈশ্বরবাক্য গম্ভীর বজ্রনিনাদে আপন কর্ণে শ্রবণ করেন। অনন্ত সৃষ্টি জুড়ে সে বাণী ধ্বনিত হয়, যার কান আছে সেই শোনে।

তোমাদের কাছে অনুরোধ নিজের সত্তা অনুভব করতে শেখ, নিজেকে বোধ করতে শেখ, নিজেকে বিচার করতে শেখ। মৃত হয়ো না। মৃতের আবার ধর্ম কী? নারী হও, পুরুষ হও–স্বামী, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, বন্ধু, পিতা-মাতা, সংসার, ধনসম্পত্তি হতে হাত তুলে, জায়নামাজে বসে নিজেকে চেন।

যদি প্রভুকে জীবনে না পাইয়া থাক, তবে জীবনে তোমার কিছুই পাওয়া হয় নাই। যার আত্মায় ঈশ্বর ধরা দিয়েছেন তার কোনো জাতিভেদ নাই, ভক্তমাত্রেই এক জাতি। আনন্দকে বর্জন করে প্রভুর পরিচয় হয়তো সহ্য করতে পারবে না।

ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম সকল মানুষই বুঝতে পারে। তার মানে তার ভিতরে ঈশ্বর আছেন। মানুষের কাছে কোনো ধর্মগ্রন্থ না এলেও সে আপন আত্মায় তার প্রকৃত ধর্ম অনুভব করতে পারে। গায়ের জোরে অনেক সময় মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। বুঝেও বুঝে না। হিন্দু মুসলমান বলে দায় দিলে কী হবে? যে পতিত, সে পতিত, যে দুষ্ট,, সে দুষ্টু, যে অধার্মিক সে অধার্মিক মুসলমান হলেও। হে মনুষ্য, তোমার গায়ের জোরে মন্দ কাজ করো না। তোমার ভিতরের প্রভুকে জিজ্ঞেস কর তিনি তোমার সম্বন্ধে কী বলেন। তোমরা যদি নীচ, মন্দ, অধার্মিক, হারামখোর ও অত্যাচারী হও, তবে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিলে কী হবে?’

.

১০. ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার

ভক্তের জন্যে ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারই ধর্মকার্য। প্রত্যেক মুসলমান ঈশ্বরের সৈনিক। সে প্রভুর পতাকা বহন করবে এবং তার রাজ্য বিস্তার করবে।

ঈশ্বর রাজ্যের ভাব কী? ঈশ্বর রাজ্যে অশান্তি, দুঃখ এবং কোনো শয়তানী ভাব কর্তৃত্ব করবে না। ঈশ্বর রাজ্য অর্থ স্বর্গ। এই জগৎকে স্বর্গে পরিণত করতে হবে। ইহাই ধার্মিকের কাজ। এই জগৎ হবে পরম শান্তি ও আনন্দের স্থান। এখানে পাপ থাকবে না–দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস, নিরানন্দ, বেদনা, অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন, অন্ধকার থাকবে না, এরই নাম ঈশ্বরের রাজ্য স্থাপন। জগৎ যতই পাপ মুক্ত হবে, ঈশ্বরের রাজ্য ততই বিস্তার লাভ করবে, প্রভুর এই কার্যে জীবন দান কর–এরই নাম ঈশ্বরের নামে কোরবানি। হে প্রভুর সৈনিকেরা, এই জন্যেই প্রভুর কাছে জীবন্ত প্রার্থনা করতে হবে। মৃতের ন্যায় মৃত প্রার্থনা করো না।

নারী ক্রন্দন যেন আকাশকে ব্যথিত না করে। সাবধান! তাকে স্বামী, চক্ষু এবং স্বাধীনতা দাও। তার বংশ তুলে গালি দিও না। এতে ব্যভিচার হয়–মহাপাপ হয়।

ঈশ্বরের রাজ্য মধ্যে যার অন্তরে বেদনা জাগে না, পৃথিবীতে শয়তানের কর্তৃত্ব সম্মানে যার মন দুঃখিত হয় না–সে ঈশ্বরের কেউ নয়। সংগ্রাম অর্থ শরীরের বল, তরবারি জ্ঞান, বক্তৃতা, সাহিত্য, উপন্যাস, কাব্য ও অভিনয় দ্বারা পাপের বিরুদ্ধে, শয়তানের বিরুদ্ধে, নর নারীর প্রাণে ঘৃণা সৃষ্টি করা–কুৎসিতের বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলা। মানুষ সুন্দর, কল্যাণ, সত্য এবং মঙ্গলের উপাসক হোক, এই-ই ধর্ম।

প্রভুর অপমানে, সত্যের পরাজয়ে, শয়তানের প্রতাপে যদি প্রাণে বেদনার সঞ্চার না হয়–তোমার তীর্থ ভ্রমণ, নামাজ, কোরান পাঠ, কোরবানি কোনো ধর্মক্রিয়ায় ফল হবে না।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তার কর্ণকুহরে এই মহামন্ত্র দাও ‘আল্লাহু আকবর’। আল্লাহ্ই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ যা সত্য ও ন্যায়, যা সুন্দর এবং মঙ্গল, তাই মুসলমানের একমাত্র আরাধনার বস্তু। জীবনে তার একমাত্র উপাস্য ন্যায় ও সত্য। যা উত্তম, সত্য, মঙ্গল, শৃঙ্খলা প্রেমময় শক্তি ভাব, সীমার অতীত মহাজীবন, পরম শান্ত, পরম আনন্দ তাই পূজিত। ঈশ্বর জগতের জীবন। শয়তান পরম দুঃখের সর্ববিধ অনুষ্ঠাতা। সে ঈশ্বরের রাজ্য ধ্বংস করে, ঈশ্বরের প্রিয়তম সৃষ্টি মনুষ্য হৃদয়ে পাপের বিষ ঢালে, তাকে প্রলোভনে মুগ্ধ করে সমস্ত দুঃখ ও নরকের পথে আহ্বান করে–প্রভুর রাজ্যে সর্বনাশ সাধন, তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করাই তার কাজ। সে মানুষকে, মনুষ্য সমাজকে প্রতি মুহূর্তে কুমন্ত্রণা দিয়ে উদভ্রান্ত করে। মনুষ্য মধ্যে যারা তার অনুগামী, কার্যে যারা তার ভক্ত, যারা কদাচারী, হীনচিত্ত, মূঢ়, মানুষকে যারা দুঃখ দেয়, মুখে আনুগত্য স্বীকার করলেও কার্যে যারা শয়তানকে সেজদা করে, সেই বিধর্মী দুরাচার মানুষের দল শয়তানেরই অনুচর। ধীবর যেমন মৎস্য ধরে, ঈশ্বরের সৈনিকেরা, যাবতীয় বিশ্বাসীরা যারা ঈশ্বরের গৌরব করেন–তারা শয়তান ও তার অনুচরদের বিরুদ্ধে চিরজীবন যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে জয়ী হয়ে সৈনিকেরা প্রভুর শান্তির রাজ্য বিস্তার করেন। শয়তানের মাথা নত হোক। পরাজয়ের গ্লানিতে তার মুখ মলিন হোক। এস, আমরা প্রভুকে এবং তার রাজত্বে উল্লাসিত হই এবং আনন্দ করি। প্রভুর জন্যে যুদ্ধে যদি আমরা মরি, সে আমাদের শহীদের মৃত্যু হবে। আমাদের যে সব ভ্রাতা ও ভগ্নি শয়তান এবং তার সেনাপতি ও সেনাদলের কাছে বন্দি হয়েছেন, তাদের উদ্ধার করি। এই তো আমাদের কাজ শয়তানের সঙ্গে ঈশ্বরের এবং তার সৈনিকদের সন্ধি অসম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *