সরিৎশেখরের চিঠি এল। ট্রেনে কোন অসুবিধে হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে কিছু লেখেননি। তবে এখনও শরীর সুস্থ হয়নি। বাড়িতে তিনি এবং হেমলতা ছাড়া তৃতীয় কোন প্রাণী না থাকায় সাংসারিক কাজকর্ম তাকেই ওই শরীর নিয়ে করতে হচ্ছে। এখন যাওয়ার জন্য তিনি তৈরি, নিজের শ্রাদ্ধ করে এসে এক অদ্ভুত আনন্দের মধ্যে ডুবে আছেন। তবে তার একটাই আশংকা এবং সেটা হেমলতাকে নিয়ে। তার যাওয়ার আগে যদি হেমলতা যেতেন তাহলে নিশ্চিত হতে পারতেন সরিৎশেখর। এসব লেখার পর তিনি জানতে চেয়েছেন অনিমেষ পূজোর ছুটিতে জলপাইগুড়িতে আসছে কিনা। এবং সরিৎশেখর কলকাতায় তার কাছে থাকার দরুণ যে টাকা খরচ হয়েছে তার অংকটা জানালে তিনি সেটা ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।
চিঠিটা পড়ে অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। হাতে লেখা এক না হলে এটাকে দাদুর চিঠি হিসেবে মেনে নেওয়া শক্ত হত। দাদুর চিঠি মানেই কিছুটা উপদেশ এবং সেই সঙ্গে কড়া সমালোচনা। অথচ এই চিঠির ভাষার মধ্যে কেমন যেন শীতলতা ছড়ানো। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে বাবার চিঠি আজকাল নিয়মিত আসে না। মাসের প্রথমে যে মানি অর্ডার পাঠান তার তলায় যেটুকু জায়গা তাই এখন বরাদ্দ। সরিৎশেখর চলে যাওয়ার পর তমালের মুখে জানতে পেরেছিল অনিমেষ, তিনি অনেক কিছু জেনে গেছেন। সেদিন সে যখন সন্ধ্যেবেলায় ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিল তখনই তিনি তমালদের খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে অনিমেষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন কিন্তু চিঠিতে সেসবের কোন উল্লেখ নেই। শুধু এই প্রথমবার তিনি জানতে চেয়েছেন অনিমেষ ছুটিতে জলপাইগুড়িতে যাবে কিনা?
অনিমেষ অনুভব করছিল বাড়ির সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে সেটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। না এই ছুটিতে সে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না। বিমানের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। পার্টি অফিতে গিয়ে দিন টিন ফাইনাল করে এসেছে। আগামী উপনির্বাচনে দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারের জন্য দল কলকাতা থেকে যাচ্ছে তাকেও সেই সঙ্গে যেতে হবে। ছুটিটা পড়ছে বলে তার ক্লাস কামাই হবে না। অনিমেষ ঠিক করল, এসব কথা সরিৎশেখরকে খোলাখুলিই লিখে দেবে। ওদের উপনির্বাচনের জায়গাটা জলপাইগুড়ি থেকে খুব দূরে যদিও নয় তবু সে সময় পাবে কিনা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। কথাগুলো মাধবীলতাকে জানালো অনিমেষ। আজকাল কোন কিছু ওকে না বললে স্বস্তি পায় না সে। এখন প্রতিটিদিন শুরু হয় বুক জোড়া এক ধরনের চাপ নিয়ে। সে চাপ বুক থেকে সরে না যতক্ষণ মাধবীলতাকে সে না দেখছে। একটু একটু করে মাধবীলতা তার রক্তে মিশে যাচ্ছে। এখন ওদের দেখা কিংবা কথা হয় লাইব্রেরী, বসন্ত কেবিন, কিংবা কফি হাউসের তেতলায়। শেষের জায়গাটাই ওদের প্রিয়, কারণ দীর্ঘসময় এককাপ কফি নিয়ে বসে থাকা যায় এবং চার পাশে এত কথার বিড় যে স্বচ্ছন্দে নিজেদের কথা বলা যায়।
মাধবীলতাকে সে তার সব কথা বলেছে। মা যে রাতে মারা গেলেন সেই বর্ণনা শোনার সময় মাধবীলতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। ছোটমার কথা শুনে অবাক হয়েছিল খুব। অনিমেষ তাঁর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না জেনে অনুযোগ করেছিল। বলেছিল, তোমার ছোট মাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
কেন? অনিমেষের আজকাল একটা ব্যাপারে খুব মজা লাগে। মাধবীলতা যখন তার পরিবারের কারোর সম্বন্ধে কথা বলে তখন মনে হয় ও তাকে ভীষণ চেনে। আসলে অনিমেষের মুখে শুনে শুনে দাদু পিসীমাদের ছবিটা ওর মনে স্পষ্ট আঁকা হয়ে গেছে। এক এক সময় ও এমন কথা বলে যে অনিমেষের নিজেরই দ্বন্দ্ব লাগে, ওদের কে বেশি চেনে, সে না মাধবলীতা।
মাধবীলতা বলল, কত বড় হৃদয় থাকলে তবেই এভাবে তোমাকে আপন করে নেওয়া যায় সেটা তুমি বুঝবে না। তোমার ছোট মার নিজস্ব দুঃখ কিংবা কষ্টের কথা তোমরা কোনদিন জানতে পারোনি, পেরেছ?
কি দুঃখ নিজের সন্তান নেই বলে বলছ?
সে তো আছেই । কিন্তু সে কষ্ট ভুলে থাকা যায় যদি স্বামীর ভালবাসা কেউ বুক ভরে পায়। তোমার ছোট মা সেটা পাননি। তোমার বাবা কখনোই তাকে ভালবাসেননি। মাধবীলতার গলায় আত্মপ্রত্যয়।
কি বলছ। ওঁরা এতদিন একসঙ্গে আছেন।
অনিমেষকে থামিয়ে দিল মাধবীলতা, একসঙেগ অনেকদিন থাকলেই বুঝি ভালবাসা যায়। এই শহরে তো একসঙ্গে এতগুলো মানুষ চিরকাল আছে তবু মানুষে মানুষে ভালবাসাবাসি হল না কেন?
কি আশ্চর্য, এ দুটো ব্যাপার এক হল? দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকলে পরস্পরকে গভীর ভাবে জানতে পারে, নিজেদের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নিতে পারে, পরস্পরের জন্যে তখন টান জন্মায় আর হাজার হাজার মানুষ যতই একসঙ্গে থাকুক এই নৈকট্য কখনোই গড়ে ওঠে না, দুটোকে এক করছ কেন?
বেশ, ওই ভাবে থাকতে থাকতে তুমি যেটাকে টান বললে সেটা এলেই তাহলে ভালবাসা পাওয়া গেল কি বল? মাধবীলতার মুখে দুষ্টুমি।
আমি কি ভুল বলছি। অনিমেষ একটু বিব্ৰত হল ।
নিশ্চয়ই। দুটো মানুষ সারা জীবন শুধু প্রয়োজনের জন্যে পরস্পরের ওপর নির্ভর করে কাটিয়ে দিতে পারে। দুজনে কেউ কাউকে একটুও ভালবাসল না হয়তো। শুধু প্রয়োজনই কাছাকাছি ওদের ধরে রাখল। আবার দুজন দুই বিপরীত মেরুতে বাস করেও পরস্পরকে ভালবাসতে পারে সারাজীবন। বুঝলে মশাই। কথাটা শেষ করে টেবিলে রাখা অনিমেষের হাতে আলতো করে চিমটি কাটলো মাধবীলতা।
বুঝলাম। অনিমেষ গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, এবার বল ভালবাসা কি জিনিস? মানুষ মানুষকে কেন ভালবাসে?
কথাটা শোনামাত্র চোখ বড় হয়ে গেল মাধবীলতার। তারপরেই প্রচণ্ড শব্দে সে হেসে উঠল। সমস্ত শরীর কাঁপছে তার হাসির দমকে, দুহাতের চেটোয় নিজের মুখ ঢেকেও সামলাতে পারছে না। এ রকম দৃশ্য এবং শব্দ আশেপাশের অনেক টেবিলকে সচকিত করেছিল, তারা বেশ মজা দেখার মুখ করে এদিকে তাকিয়ে আছে এখন। অনিমেষ চাপা গলায় বলল, এই কি হচ্ছে। এভাবে হাসিতে ফেটে পড়ার কি কারণ সে বুঝতে পারছিল না।
কোন রকম নিজেকে সামলে মাধবীলতা বলল, অনেকদিন এত প্রাণ খুলে হাসিনি, তোমার জন্য সেটা পারলাম। বলেই আবার হাসতে লাগল, অবশ্য নিঃশব্দে।
তোমাকে কোন কথা সরল মনে জিজ্ঞাসা করা যায় না। অনিমেষ গম্ভীর হল ।
আমি তোমাকে এখন ভালবাসা শেখাবো?
শেখাতে কে বলেছে, আমি জাস্ট আলোচনা করছিলাম।
বেশ, তাহলে সরাসরি কথা হোক। তুমি রোজ আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত ব্যস্ত হও কেন? দুটো বড় চোখ অনিমেষের মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি ফেলল। সেই চাহনির দিকে তাকিয়ে অনিমেষ ভেতর ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করল। সে কোন রকমে বলল, তুমি জানো?
কথা এড়িয়ে যাচ্ছ।
বেশ, তোমাকে না দেখতে পেলে আমার ভাল লাগে না, খুব কষ্ট হয়। ঘুম ভাঙ্গার পরই তোমার মুখটাকে দেখতে পাই আর ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ও মুখ চোখের সামনে থেকে সরে না।
মারাত্মক ব্যাপার।
কেন?
যে কোন মুহূর্তে এ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু হচ্ছে না।
মানে?
চোখের সামনে যদি আমি ছাড়া কিছু না থাকে তাহলে তুমি হাঁটাচলা পড়াশুনা করছ কি করে? সে সবই করছ অথচ
কি আশ্চর্য । এতো মোটা কথা বলছ কেন? চোখ কি শুধু রক্ত মাংষেরই? মনের যে চোখ আছে কান আছে সেটা অস্বীকার করতে পারো?
এবার পথে এসো। প্রত্যেক মানুষের এ রকম দ্বৈত সত্তা আছে। মুশকিল হল অনেকেই ওই দ্বিতীয়টির ব্যবহার জানে না। তারা প্রথমটি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এবার আমার ভয় হচ্ছে তোমার এই মন কদ্দিন থাকবে?
আমরণ!
মরণ কি শুধু শরীরের? মনেরও নয় কি?
আমি এত বুঝি না। আমি জেনেছি তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ নই।
কিন্তু এ জানায় যদি ভুল হয়
না। এটা আমি আমার সমস্ত রক্ত দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু আমি তো একজন সাধারণ বাঙালী মেয়ে। তোমার সামনে বিরাট জগৎ। রাজনীতিতে তুমি গা ভাসাচ্ছ, নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখো তুমি, একবার যদি ঝড় উঠে তুমি উত্তাল হবে। তখন আমি কি করব?
তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।
আমার যদি সে ক্ষমতা না থাকে।
অনিমেষ মাধবীলতাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, লতা, তুমি কি আমার রাজনীতিতে জড়ানো পছন্দ কর না?
মাধবীলতা হাসল, পাগল!
তবে?
আমার ভয় করে, খুব ভয় হয়।
এই হল মাধবীলতা। অনিমেষ যখন ছায়া চায় তখন ছায়া দেয়; কিন্তু যেই কুড়েমি করে তখনই রোদে পুড়িয়ে মারে। শুধু এই জন্য অনিমেষ মাঝে মাঝে ওকে বুঝতে পারে না। যুনিয়নের কাজে অনেক সময় ক্লাস করা হয় না। মাঝে মাঝে মনে হত এম এ ক্লাসের বিপুল কোর্স সবাই না জানা থেকে যাচ্ছে কিভাবে পরীক্ষা দেবে–হিম হয়ে যেত শরীর। এম এ না পাস করতে পারলে চিরকাল বাবার কাছে চোরের মত থাকতে হবে। মাধবীলতা তাকে প্রতিদিনের ক্লাসনোটস দিয়ে যেতে লাগল। অধ্যাপক যখন নোটস দিতেন তখন সে কার্বন ব্যবহার করে টুকে রাখত। কোন কোন রাতে হোস্টেলে শুয়ে সেই নোটসে চোখ রেখে অনিমেষ যেন মাধবীলতাকে দেখতে পেত, কল্পনায় মাধবীলতার হাতের গন্ধ নাকে আসতো। কিন্তু নিজের বুকের এ ছটফটানি সে কখনো মাধবীলতার মধ্যে দেখেনি। আর এই না দেখতে পাওয়ার জন্য কষ্ট হয়। কেন মাধবীলতা তাকে তার মত আঁকড়ে ধরে না, কেন পরের দিন কখন দেখা হবে এই প্রশ্ন কখনো করে না, তা বুঝতে পারে না অনিমেষ। মাধবীলতার এই নির্লিপ্ত আচরণে মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হতো সে সত্যি তাকে ভালবাসে কিনা কিন্তু পরক্ষণেই এমন এক একটা কান্ড করতো মাধবীলতা যে অনিমেষ এসব চিন্তার জন্য নিজেকে অপরাধী ঠাওরাতো।
হ্যাঁ, সে মাধবীলতাকে সব বলেছে। এমন কি উর্বশী যে জ্বরো মুখে সেই জলপাইগুড়ির কৈশোরে তাকে চুমু খেয়েছিল তাও। কিন্তু অনিমেষ মাধবীলতার কিছু জানে না। কোন উগ্রতা না থাকলেও অনিমেষের বুঝতে অসুবিধে হয় না মাধবীলতারা অত্যন্ত স্বচ্ছল । কিন্তু কোনদিন তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়নি। এই ব্যাপারটা খুব অস্বস্তি আছে অনিমেষের। অনেকদিন ভেবেছে মুখ ফুঠে বলেই ফেলবে কিন্তু সংকোচে সেটা সম্ভব হয়নি।
এর মধ্যে দুএক রবিবার সে চুপচাপ বেলঘরিয়ায় গিয়েছিল। স্টেশন ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা নিমতার দিকে গিয়েছে সেদিকেই মাধবীলতার বাড়ি। এলোমেলো ঘুরে এসেছে সে, কোনদিন দেখা পায়নি।
কথাটা ওকে জানাতে খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, একটা দিন দেখা না করে থাকতে পারো না কেন? এর পরে হয়তো মাসের পর মাস না দেখা করে থাকতে হবে। অনি, আমার জন্য তোমার সব কাজকর্ম নষ্ট হোক এটা আমি চাই না। নিজেকে সংযত করো, এ রকম তরল হওয়া তোমাকে মানায় না।
অনিমেষ বুঝতে পারে না তার এমন কেন হল। চিরকাল সে যেভাবে কাটিয়ে এল এখন সে রকম থাকতে পারছে না কেন? সেই ছোটবেলায় জলপাইগুড়িতে মা-বাবাকে ছেড়ে আসবার পর সে এক রকম একাই। নিজের ভাল লাগা মন্দ লাগার কথা বলার মত কেউ ছিল না কাছাকাছি। দাদু কিংবা পিসীমার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান তাকে ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে অনেক কিছু থেকেই নিবৃত্ত করে। আনন্দ কিংবা দুঃখের উচ্ছাস তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অন্যে তা জানতেও পারত না। বোধ হয় এইভাবেই সংযম জন্ম নেয় এবং নিয়েছিলও। অথচ মাধবীলতাকে দেখার পর সেই দীর্ঘ সময়ে গড়া দুর্গ এক মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হল, অনিমেষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না এবং মাধবীলতার এই রকম সতর্কীকরণ কানে বড় খারাপ শোনায়।
কিন্তু সংযম অবশ্যই প্রয়োজন। ওকে না দেখতে পেলেই এই যে শূন্যবোধ এটাকে চাপা দেওয়া দরকার। আর কদিন বাদেই পূজোর ছুটি। তখন মাসখানেকের জন্য কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে। কথাটা মাধবীলতাও জানে। মাধবীলতার কি তাকে এক মাস না দেখতে পেলে কোন কষ্ট হবে না। না অনিমেষ ঠিক করল নিজেকে পরিবর্তিতত করবে এইভাবে সহজে ধরা দিয়ে বসবে না।
আজ বিকেলে মাধবীলতা বলল, রোজ রোজ ট্রেনে যাই আজ বাসে যাব। এখন ছুটির সময়। ট্রাম বাসগুলো বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
মাধবীলতা রাস্তা পার না হয়ে ধর্মতলাগামী একটা প্রাইভেট বাসে উঠে পড়ল। উলটোমুখ বলে বাসটা খালি। ধর্মতলায় বোঝাই হয়ে বেলঘরিয়ায় ফিরবে। জানলার পাশে একটা জায়গায় বসে মাধবীলতা বলল, সব সমস্যার সমাধান আছে শুধু রাস্তাটা খুঁজে নিতে হয়।
অনিমেষ বলল, ডবল ভাড়া দিতে হবে।
মাধবীলতা বলল, প্রয়োজনে তাই দিতে হয় বই কি।
অনিমেষ একটু উষ্ণ গলায় বলল, তুমি সব কথাই দুরকম মানে সাজিয়ে বল। কেন, সহজ কথাটা সহজ গলায় বললে মান যায় নাকি!
মাধবীলতা আস্তে আস্তে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
অনিমেষ খেয়াল করেনি, অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দেখছিল। ওয়েলিংটনের মোড় পার হতেই বাসটা দ্রুত ভরে গেল। লেডিস সিট উপচে মেয়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেরা যারা রড ধরে রয়েছে তারা মাধবীলতার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছে। কোন মেয়ে সাধারণ সিটে বসলেই পুরুষরা সেটাকে মানতে পারে না। অথচ সেগুলো তো শুধু পুরুষদের জন্যই নির্দিষ্ট নয়, তবু।
অনিমেষ কিছু বলার জন্য ডাকল এই! ডাকটা না শোনার মত নয়, মাধবীলতা মুখ ফেরালো না। অনিমেষ অবাক হয়ে আবার ডাকতেই সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো ওদের দিকে তাকালো। এবারও মাধবীলতার কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। অনিমেষের খুব অস্বস্তি এবং এক ধরনের ভয় হল। পাশ থেকে সে যেটুকু দেখছে তাতে বুঝতে পারছে মাধবীরতার মুখের প্রতিটি ভাজ এবং টান টান। দাঁত দিয়ে হয়তো নিচের ঠোঁট চেপে রেখেছে। সে ডাকছে অথচ মেয়েটা সাড়া দিচ্ছে না, এই তথ্যটা যদি আশপাশের লোকজন টের পেয়ে যায় তাহলে ওদের ঔৎসুক্য আরো বেড়ে যাবে। এই মুখ অনিমেষের অচেনা। যদি হঠাৎ কোন রুঢ় কথা বলে বসে তাহলে এদের কাছে নির্ঘাৎ অপমানিত হবে বলে আবার ডাকতে তার ভয় করছিল। সে চেষ্টা করল নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকতে। কিন্তু কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছেল না। মাধবীলতা কেন এ রকম আচরণ করছে। তাদের মধ্যে কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি, আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু সে করেনি, তবে? ওই মুখ দেখতে অনিমেষের খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আর কথা বলার মত সাহস সে পাচ্ছিল না।
বাসটা এখন স্ট্যান্ডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ইডেন গার্ডেনের পাশে বাবুরঘাটে স্টিমারের ডাক শোনা যাচ্ছে। চার পাশে নানান রকম হকার আর বেড়াতে আসা মানুষের ভিড় জায়গাটাকে মেলার চেহারা দিচ্ছিল। অনিমেষ দেখল জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে ইডেন থেকে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। অনিকের ভঙ্গিতে একটা চোর চোর ভাব আছে। ইডেন কিংবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যেসব জায়গায় সবাই প্রেম করতে যায়, সেখানে মাধবীলতাকে নিয়ে সে কখনো যায়নি। য়নিভার্সিটির চার পাশে যেসব। খোলামেলা রেস্টুরেন্ট আছে সেখানেই কথা বলেছে ওরা। প্রেম করলেই সকলে বোধ হয় নির্জনতা খোঁজে চায়ের দোকানের কেবিনে গিয়ে ঢোকে। আশ্চর্য ওদের মাথায় সে রকম চিন্তা আসেনি কেন? অনিমেষের খেয়াল হল সে এখনও মাধবীলতার হাত পর্যন্ত ধরেনি। এই যে এখন সে পাশে বসে আছে স্বাভাবিকভাবেই ওর শরীরে স্পর্শ লাগছে কিন্তু এই মুহূর্তেই সে সম্পর্ক সচেতন হল অনিমেষ। এবং হওয়ার পর আরো সংকুচিত হয়ে পড়ল।
মাধবীলতা হঠাৎ কথা বলল। বাইরে থেকে মুখ সম্পূর্ণ না ফিরিয়ে চাপা গলায় উচ্চারণ করল, ওই রকম হলে খুশি হন জানি, তা আমার কাছে কেন ওই একটা জুটিয়ে নিলেই পারেন।
কথাটা বুঝতে কয়েক পলক গেল, অনিমেষ চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একটি জোড়া ইডেনের দিকে ঢুকছে। মেয়েটি খিল খিল করে হাসছে তার একটা হাত ছেলেটির কোমরে আর ছেলেটির হাত মেয়েটির কাঁধে। কি কারণে ওরা অমন হাসছে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আশপাশের লোকজনের কৌতুকের চোখ ওদের গ্রাহ্যবস্তু নয় এটা বোঝা যাচ্ছিল। যে কোন মানুষের চোখে ওদের ভঙ্গিতে একটা বেলেল্লাপনা ধরা পড়বে, অনিমেষের খারাপ লাগল । কিন্তু মাধবীলতার ইঙ্গিত বোঝামাত্রই তার মুখে রক্ত জমে গেল। তার সম্পর্কে এতটা নীচ ইঙ্গিত করতে পারল ও? শুধু শারীরিক প্রয়োজনেই সে মাধবীলতাকে কামনা করে? এই তাহলে তার সম্পর্কে ধারণা? অনিমেষের মনে হল এখনই এই সিট থেকে উঠে যায়। এই অপমানের পর আর পাশাপাশি বসে থাকা যায় না। কিন্তু সেই মুহূর্তেই আর একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। মাধবীলতাকে হারিয়ে সে থাকবে কী করে। ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে। হয়তো কোন কারণে মাধবীলতা নিজেকে বেসামাল করে ফেলায় এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলছে। কিন্তু মন যখন শান্ত হবে তখন নিশ্চয়ই এই কথাটার জন্যে সে লজ্জা পাবে।
পালটা যুক্তি খুঁজে পেতে অনিমেষ সিট ছেড়ে উঠল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা হীনমন্যতাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। বুকের ভেতর একটা ভারী কিছু অনড় হয়ে আছে। বাসটা চলতে শুরু করলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। ভিড়ের চাপাচাপিতে আশেপাশের মানুষরা আর তাদের ভাল করে নজর করছে না দেখে অনিমেষ চাপা গলায় বলল, তুমি এ রকম করে বলতে পারলে?
মাধবীলতা উত্তর দিল না। যেন অপরিচিত সহযাত্ৰীনীর মত চুপ করে বসে থাকল অনিমেষ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, শুনছো।
মাধবীলতা নির্বিকার কিন্তু ওপরের একটা মুখ বলে উঠল, কিছু বলছেন?
অনিমেষ হতভম্ব হয়ে মুখ তুলে দেখল একটি টিয়াপাখির নাক বসানো মুখ ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে চটপট বলে উঠল, না না কিছু বলিনি।
কিছু বলছেন না তো তখন থেকে বিড়বিড় করছেন কেন?
রাগ হয়ে গেল এই গায়ে পড়া ভাব দেখে। অনিমেষ বলল, কি যা তা বলছেন!
যা-তা বলছি! আই বাপ!, লোকটা মুখ ঘুরিয়ে আশেপাশের ঝুলে থাকা মুখগুলোকে বলল, তখন থেকে দেখছি মেয়েটিকে জ্বালাতন করছে, বিড়বিড় করে কথা বলে যাচ্ছে, আবার চোখ রাঙ্গানো দেখেছেন!
বাসে ট্রামে এই হয়েছে আজকাল। মেয়েরা যে নিশ্চিন্তে একা একা যাবে তার উপায় নেই। কান ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া উচিত। আর একটি কিলবিলিয়ে উঠল। অনিমেষ মহা ফাপড়ে পড়ল। আশেপাশের সবাই তো বটেই ওপাশের মহিলারা পর্যন্ত ঝুঁকে তাকে লক্ষ্য করছে। সে দ্রুত মাধবীলতাকে দেখল। তেমনি নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকানো। যেন ছুটন্ত ফুটপাতগুলোর পৃথিবীর যাবতীয় দেখার জিনিস ছড়িয়ে আছে। বাসের ভেতর এখন যে কথাবার্তা চলছে তা ওর কানে মোটেই যায়নি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চট করে সামলে নিল অনিমেষ। এখন চলে যাওয়া মানে এই লোকগুলোর ইঙ্গিতকে সত্যি প্রমাণিত করা। একটি হেঁড়ে গলা বলে উঠল, ভদ্রভাবে যদি বসে থাকতে না পারেন তাহলে ঘাড় ধরে বের করে দেব বাস থেকে।
মাথায় আগুন জ্বলে গেল অনিমেষের, চিৎকার করে বলল, মুখ সামলে কথা বলুন।
একটা হুড়োহুড়ি শুরু হওয়া মাত্র কন্ডাক্টরের গলা শোনা গেল, বাসের ভেতরে নয়, বাইরে গিয়ে করুণ। ও দাদারা।
কলকাতার মানুষ নিজে দর্শক হয়ে দূরত্বে থাকতে ভালবাসে। অন্য কেউ শুরু করে দিলে ছুঁক ছুঁক করতে পারে এইমাত্র। সমস্বরে গলাগুলো কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, নামিয়ে দিন তো মশাই, মেয়েদের বিরক্ত করবে আর বললে চোখ রাঙ্গাবে। এদের জন্যেই ছেলেদের বদনাম হয়।
ভিড় ঠেলে কন্ডাক্টর অনিমেষের সামনে এসে দাঁড়াতেই অনিমেষ বসে পড়ল। উত্তেজনায় ওর শরীর এখন থর থর করে কাঁপছে। এবং উত্তেজিত হলেই পেটে যে চিন চিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে সেটাও বাদ গেল না। কন্ডাক্টর কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, ও মশাই, কোথায় যাবেন আপনি?
হাতিবাগান বলতে যাচ্ছিল অনিমেষ কিন্তু তার আগেই একটা হাত কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্য এগিয়ে গেল। গম-রঙ্গা সেই হাতের কবজিতে একটা মকরমুখী বালা। হাতের শেষে আঙ্গুলের চাপে একটা এক টাকার নোট ধরা মাধবীলতার গলা শুনল অনিমেষ, দুটো বেলঘরিয়া দিন।
দুজন কে? কন্ডাক্টর টাকাটা ভাঁজ করে আঙ্গুলের ফাঁকে খুঁজে পয়সা বের করছিল। হাত দিয়ে অনিমেষকে দেখালো মাধবীলতা।
কন্ডাক্টর এ গাল হেসে বলল, আপনারা এক সঙ্গে, ও হ্যা কলেজ স্ট্রীট থেকেই তো উঠেছিলেন।
কথাটা শেষ করে আশেপাশের জনতার দিকে বাঁকা গলায় জানালো, আপনারা মাইরি সব জায়গায় সিনেমা করেন।
এক পলকেই অনিমেষ দেখল আশেপাশের মুখগুলো হাওয়া বেরুনো মুখের মত ঝুলছে। কিন্তু কারোর দিকে তাকাতে ওর ইচ্ছে করছিল না। এই সময় লোকগুলোকে একহাত নেওয়া যেতে পারত কিন্তু তার প্রবৃত্তি হল না। হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না অনিমেষ। কারণ মাধবীলতা টিকিট কাটার পর আবার একই ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসের ভেতরে যে নাটকটা হয়ে গেল সে সম্পর্কে যেন মোটেই ওয়াকিবহাল নয়।
অনিমেষের খেয়াল হল দুটো বেলঘরিয়ার টিকেট কাটা হয়েছে। কেন? ও রহস্যটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল। এবার স্বাভাবিক গলায় কিন্তু অন্য কেউ স্পষ্ট শুনতে পেল না। মাধবীলতা ঘাড় না ঘুরিয়েই জবাব দিল, ইচ্ছে করলে হাতিবাগানে নেমে যেতে পারেন।
এবার জেদ চেপে গেল নিমেষের। হাতি বাগান শ্যামবাজার পেরিয়ে বাসটা যখন বি টি রোড ধরল তখনও ওরা তেমনি চুপচাপ বসে। লাস্ট স্টপে নামার পর মাধবীলতার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবে সে। তখন নিশ্চিয়ই এই ঝুলন্ত মুখগুলো আশেপাশে থাকবে না। এটা না করলে হোস্টেলে ফিরে কিছুতেই স্বস্তি পাবে না অনিমেষ।
বিকেলটা দুদ্দাড় করে ছুটে গেল অন্ধকারে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো জ্বলে উঠছে চার ধারে। এত দেরী করে মাধবীলতা কখনো বাড়ি ফেরে না। আজ এই বাসে চড়ে যাওয়ার আবদারের জন্যই এটা হল । বাড়ি ফিরে বকুনিটা অবশ্যই জোট উচিত আজ। অনিমেষ নড়েচড়ে বসল।
বেলঘরিয়ার স্টেশনের সামনে যখন বাসটা থেমে গেল তখন অল্পই যাত্রী তাতে। মাধবীলতার পেছন পেছন নীচে নামতেই অনিমেষ বলল, দাঁড়াও।
মাধবীলতা দাঁড়াল তারপর নীচু গলায় বলল, এখানে নাটক করতে হবে না।
কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। এভাবে অপমান করলে কেন?
এখানে দাঁড়িয়ে আমি কথা বলতে পারব না। হাঁটতে হাঁটতে কথা বল।
তোমার বাড়ির দিকে যাব?
আমাদের পাড়ার অনেকেই এখন তোমাকে দেখছে। এখান থেকে চলে গেলে আমার বদনামের গল্পটা ছড়াবে। তার চেয়ে বাড়িতে যাওয়াটা শোভন হবে। এসো। মাধবীলতা পা বাড়াল।
এর আগে কখনই অনিমেষকে বাড়িতে যেতে বলেনি মাধবীলতা। আজকের এই রকম আচরণের পর এই নিয়ন্ত্রণটা কেমন বেমানান ঠেকছে। তাছাড়া একটা পরিস্থিতির চাপে পড়েই তাকে যেতে বলছে ও। কিন্তু এখান দাঁড়িয়ে থাকা আরো খারাপ দেখায়। আশেপাশের চায়ের দোকান থেকে অনেক চোখ এখন এদিকে সেঁটে আছে। অনিমেষ মাধবীলতাকে অনুসরণ করল।
লেবেল ক্রসিং পেরিয়ে মাধবীলতা খানিক ইতস্তত করল। অনিমেষ পাশাপাশি হাঁটছিল, জিজ্ঞাসা করল, কী হল?
আমাদের বাড়ি তোমার ভাল লাগবে না।
কেন? অনিমেষ প্রশ্নটা করতেই একটা সাইকেল রিকশা এগিলে এল, আসেন দিদিমণি। মাধবীলতা রিকশাওয়ালার দিকে চেয়ে একটু হাসল। অনিমেষ বুঝল ওরা সবাই মাধবীলতাকে চেনে। মাধবীলতা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, যা থাকে কপালে, উঠে পড়ুন, নিজের চোখে দেখে যদি মতিগতি পালটায়।
পাশাপাশি বসতে কোন অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালা যে রকম দ্রুত চালাচ্ছে তাতে অনিমেষের ভয় হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অবিরাম হর্ণের শব্দে ওরা ঘিঞ্জি এলাকাটা পেরিয়ে এলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে তোমার এত কুণ্ঠা কেন?
মাধবীলতা কথা বলল না, কিন্তু সেই টিপিক্যাল হাসিটা হাসল যার কোন স্পষ্ট মানে ধরা যায় না। অনিমেষের এ রকম হাসি শুনলে খুব রাগ হয় কিন্তু বাসে যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে এখন কথা বাড়ালো না। শুধু বলল, তোমার যদি আমাকে বিরক্তিকর মনে হয় সোজাসুজি বলে দিও। আমি কি করব সেটা আমার ব্যাপার, ওটা আমাকে বুঝতে দাও।
অন্ধকারে মাধবীলতার ঠোঁটের কোণে সামান্য ভাঁজ পড়ল। অনিমেষের মনে হল এটা হাসির চেয়েও মারাত্মক।
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে রিকশাওয়ালা জোর প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। তার মানে মাধবীলতাকে অনেকখানি এসে রোজ ট্রেন ধরতে হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটাও কি বেলঘরিয়া?
না, মিতা। একদম মফস্বল লাগছে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু ভাল লাগছে।
এক আধ দিনই লাগে। পুরোন হলে আর কিছুই আকর্ষণীয় থাকে না। ওর বলার ধরনটা এমন যে দ্বিতীয় অর্থটি বুঝতে অসুবিধে হল না।
প্রায় মাইল দেড়েক যাওয়ার পর একটা গলিতে ঢুকে মাধবীলতা ভাড়া মিটিয়ে রিকশাটাকে ছেড়ে দিল। ডান দিকে অন্ধকারেও একটা বড় পানা পুকুর দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকের বাড়িগুলো বাগানসুদ্ধ কিন্তু বয়সের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত । মাধবীলতা বলল, আপনি আমার কাছ থেকে একটা বই নিতে এসেছেন।
অনিমেষ কথাটা অনুধাবন করার আগেই গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ডাকল, আসুন।
গেটের ওপরই মাধবীলতার ঝাড় বাগান থেকে ফুলের গন্ধ আসছে। সামনেই একটা ভাঙ্গাচোরা পুরোন আমলের দোতলা বাড়ি। দু-একটা ঘরে আলো জ্বলছিল মাত্র। পেছনে পুকুরের আভাস। মাধবীলতা রোয়াকে উঠে অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল । একজন নুয়ে পড়া বৃদ্ধা খ্যানখেনিয়ে উঠলেন, এতক্ষণে আসা হল মেয়ের। ইদিকে তোর বাপ মা এতক্ষণ বসে থেকে থেকে চলে গেল খিদিরপুর।
খিদিরপুর কেন?
অঞ্জলির মামাতো ভাই এয়েছে না? তোকে নিয়ে যেতে বলেছিল।
অ। মাধবীলতা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আসুন।
কে ওখানে? বৃদ্ধার গলা শুনে অনিমেষ ইতস্তত করল এগোতে।
আমার সঙ্গে পড়ে। তুমি চায়ের জল বসাও যাও। আসুন দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
অনিমেষ অত্যন্ত সন্তর্পণে উঠে এল। বৃদ্ধা তাকে জরিপ করছেন। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ওকে প্রণাম করবে কিনা। মাধবীলতার কে হন উনি বোঝা যাচ্ছে না। মাধবীলতার পেছন পেছন একটা ঘরে গিয়ে ঢুকতেই মাধবীলতা বলল, বসুন। আমি আসছি।
অনিমেষ সেকেলে ঘরটাকে দেখল। দু-তিনটে চেয়ার, একটা তক্তাপোষ। জানালাগুলো বন্ধ । বাইরে বুড়ির গলা শোনা গেল, একটা উটকো ছেলেকে হট করে বাড়িতে ঢুকালি বাপ-মা শুনলে কি বলবে?
সে আমি বুঝবো তুমি চা বসাও।
আজ বাদে কাল যার বিয়ে
কে বলেছে?
অঞ্জলির মামাতো ভাই কি জন্যে এসেছে?
বেশি বাজে কথা না বলে এখন যাও।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই মাধবীলতা ঘরে এল। এসে বলল, এই আমাদের বাড়ি। মা বাবা এখন নেই তাই আলাপ করাতে পারলাম না।
উনি কে?
কদুমাসী। ভাল নাম কাদম্বিনী। আমাকে মানুষ করেছেন।
আমি আসায় বোধ হয়
একেই আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। এ বাড়িতে এভাবে কথা বলবেন না। আর কদ্দিন থাকা যাবে কে জানে।
কেন?
শুনতে পাননি? বিয়ের জন্য ছোটাছুটি শুরু করেছেন সবাই।
অনিমেষ কথা বলল না। একবার ভাবল বলে, ভালই তো কিন্তু পারল না।
হঠাৎ মাধবীলতা কেমন শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করল, আমার কিছু হলে তুমি ভার নিতে পারবে?
সমস্ত রক্ত এখন বুকের মধ্যে। আর এ রকম সময়ে পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় মনে হল অনিমেষের। সে পরিষ্কার গলায় বলল, হ্যাঁ।
ওরা অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। এর মধ্যে বৃদ্ধা এসে চা দিয়ে গেছে। এক চুমুকে সেটা শেষ করে অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আজ যাই।
মাধবীলতা মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করল। তারপরই হঠাৎ উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত মায়াময় চাহনিতে অনিমেষকে ভরিয়ে দিল। একটা হাত আলতো করে অনিমেষের বুকের ওপর রাখল মাধবীলতা, আমাকে ক্ষমা কর।
কেন? নিজের হৃৎপিণ্ড যেন মাধবীলতার হাতের তলায় এমন অনুভব অনিমেষের। মাধবীলতা তো কোন অন্যায় করেনি, তাহলে ক্ষমা কিসের।
হাত না সরিয়ে মাধবীলতা বলল, লোকে যে যাই বলুক, আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি কড়া গলায় কিছু বললে আমি সইতে পারব না।
অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল, আমি কি কিছু বলেছি? এবার থেকে আমি সহজ কথাটা সহজ গলায় বলব।
অনিমেষের মনে পড়ল বাসে উঠে সে ওই কথাটা বলার সময় খুব বিচ্ছিরিভাবে ধমকেছিল। কিন্তু সেটা তার মনে ছিল না, নেহাৎ অভ্যেসেই কথা বলা। তাই যে এই মেয়ের এমন করে লেগেছে তা কে জানত।
সে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ওকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কিছুতেই হাত উঠল না ওপরে। মুখ নামিয়ে সে ওর চুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলল, আমি আর তোমাকে আঘাত দেব না। উজ্জ্বল হাসিতে মাধবীলতার মুখ এখন মাখামাখি। হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, দেখো, আমি ঠিক তোমার মত হব। কোন রকমে পরীক্ষাটা অবধি যদি এড়াতে পারি তাহলে আর কোন চিন্তা করি না। চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না মোটেই। তবু অনিমেষ বলল, যাই।
মাধবীলতা বলল, না। বল আসি।
হাসল অনিমেষ। আচ্ছা। আসি তাহলে।
গেট অবধি পৌঁছে দিল মাধবীলতা। ভীষণ হালকা লাগছে এখন, অনিমেষ গলিটা পেরিয়ে এসে পেছনে তাকাল আবছা অন্ধকারে মাধবীলতার শরীরের আদল দেখা যাচ্ছে। নিজেকে এখন সম্রাটের মত মনে হচ্ছে তার। ওর মাথায় কোন চিন্তাই জায়গা পাচ্ছিল না। এখনও যে বাবার টাকায় তাকে মাস চালাতে হয়, অনিশ্চিত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে সে নিজেকে জড়াতে যাচ্ছে, ব্যক্তিগত কোন আয়ের সংস্থান নেই, মাধবীলতার ভার নিতে হলে এই কলকাতায় একটা বাড়ি নিদেনপক্ষে একটা ঘর দরকার এবং সেটা পেতে হলে টাকা চাই এসব অত্যন্ত নগণ্য মনে হল। এসব সমস্যা নিয়ে আকাশ পাতাল ভেবে কোন লাভ নেই। মাধবীলতা যদি তার পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে সব সমস্যাই সমাধানের পথ খুঁজে পাবে । অনিমেষ দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগল।
Leave a Reply