সরিৎশেখরকে জানলার কাছে বসিয়ে দিল অনিমেষ! রিজার্ভেসন পাওয়ার কোন উপায় নেই, কুলিকে একটা টাকা দিয়ে জায়গা কিনতে হল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সরিৎশেখরের দিকে তাকাতেই অনিমেষের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সেই বিকেলটার কথা মনে হচ্ছিল। তার প্রথম কলকাতায় আসার বিকেল। সেদিন সে ছিল কামরায় আর সরিৎশেখর প্ল্যাটফর্মে । এবার সরিৎশেখরকে দেখার পর থেকেই কে যেন বুকের মধ্যে বসে বারংবার জানিয়ে যাচ্ছে, এই শেষবার। এরপর আর বৃদ্ধের দেখা পাবে না অনিমেষ। একটা বিরাট গাছ একটু করে শুকিয়ে একটা ছোট শেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে । হাওয়ার তেজ বাড়লেই ঢলে পড়বে যেন। কিছু করার নেই, শুধু চোখে দেখা। এই যে সে স্টেশনে এসেছে এটাও পছন্দ ছিল না সরিৎশেখরের। তার জন্যে অনেক সময় নষ্ট করেছে অনিমেষ, আর নয় । কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি। রাস্তায় কিছু খাবেন না জেনেও মিষ্টি দিয়েছে সঙ্গে। পিসীমাকে দাদুর প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে একটা চিঠি দিতে হবে।
নির্বিকার মুখে বসেছিলেন সরিৎশেখর। হঠাৎ কাছে ডাকলেন ইশারায়। চারদিকে যাত্রীদের ব্যস্ততা, কুলির হাঁকাহাঁটি, ইঞ্জিনের আওয়াজ–অনিমেষ জানলার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। দাদুর মুখটাকে একদম অচেনা দেখাচ্ছে এখন। অনিমেষ বলল, কিছু বলবেন?
ঘাড় নাড়লেন বৃদ্ধ। তারপর বললেন, তোমার মায়ের কোন চিহ্ন তোমার কাছে আছে?
চমকে উঠল অনিমেষ, মা?
হুঁ। তোমার স্বৰ্গত মায়ের কথা বলছি।
সেই ছবিটার কথা মনে পড়ল। ছবিটা কোথায়? মায়ের সেই জ্বলজ্বলে চোখের ছবি যেটা বাবার ঘরে টাঙানো থাকতো।
সরিৎশেখর অনিমেষের মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, খুব ছেলেমানুষ ছিলে তুমি তিনি যখন চলে গেলেন। তবু, তোমার কি তাকে মনে পড়ে?
চোখ বন্ধ করলেই টকটকে লাল জ্বলন্ত চিতা। আগুন তখনও গ্রাস করেনি শরীর। দুটো পা আর হাঁটু-ছোঁয়া চুল তখনও চিতার বাইরে। রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া কালো দুটা হাত সে চোখের সামেন ধরে আছে–পরিষ্কার দেখতে পেল। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তের আগে মাকে তো তেমন করে মনে পড়েনি তার। এমন কি মাধবীলতাকে দেখার সময় মনে হয়েছিল মা এরকমই দেখতে ছিল। এই ছবিটা তো চোখের সামনে আসেনি। সে ছবিটাও তো এখন মনে পড়ছে। মৃত্যুর রাতে মা তাকে বলেছিল, আমি যদি না থাকি তুই একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস, আমি ঠিক শুনতে পাব। অনি, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে।
দুচোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অনিমেষ চেষ্টা করে নিজেকে ঠিক করল। কলকাতায় আসার পর ওসব কথা মনেই পড়ে না। মা ক্রমশ ধূসর হয়ে এক সময় হারিয়ে গেছে কখন। আজ দাদু এভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা না করলে হয়তো… সে মুখে বলল, হ্যাঁ, পড়ে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
হঠাৎ তাকে মনে পড়ল, তোমার মুখ দেখে–। অনিমেষ, জীবন বড় জটিল। নিজেকে ঠিকঠাক রাখা খুব মুশকিল। তাই একটা অবলম্বন দরকার হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্যে, তোমার মা তোমাকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখতেন। আজ তিনি নেই। তাঁর কথা ভেবে চোখের জল ফেলা কোন কাজের কথা নয়। কিন্তু দুদিন তোমায় আমি দেখলাম। যাই করো, শুধু মনে রেখো কেউ একজন তোমায় লক্ষ্য করে যাচ্ছে। তাই কখনো অসৎ হয়ো না।
অনিমেষ জানলায় হাত রেখেছিল। পলকেই সে টের পেল হাতের তলায় জানলা নড়ছে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগল সেটা। একটার পর একটা কামরা অনিমেষকে অতিক্রম করে গেল। সরিৎশেখরের মুখটা কখন অনেক মুখের আড়ালে হারিয়ে গেল। স্টেশন ছাড়ার সময় কেন যে সবাই সতৃষ্ণ চোখে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থকে। ট্রেনটা সম্পূর্ণ বেরিয়ে না যাওয়া অবধি অনিমেষ নড়ল না।
এখন অফিসের সময় । শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। পিলপিল কর মানুষজন ছুটে যাচ্ছে সার্কুলার রোডের দিকে। ঘন ঘন লোকাল ট্রেনগুলো শহরতলী থেকে মানুষ বয়ে এনে ছেড়ে দিচ্ছে কলকাতায়। প্রত্যেকে এত ব্যস্ত যে কারো পেছনে তাকানোর সময় নেই। অনিমেষ দেখল মানুষের চেহারা মোটামুটি একই। যেহেতু এদের প্রয়োজন অভিন্ন তাই ভঙ্গিতেও ফারাক নেই। হঠাৎ তাকালে সেই ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। ঝড়ের আভাস পেয়ে যেভাবে নানান চারপেয়ে জন্তুরা পাগলের মত ছুটে যায় আশ্রয়ের জন্য ধুলোর বন্যা বইয়ে, ঠিক তেমনি। তাড়াহুড়া এমন যে, কেউ কাউকে সামান্য সৌজন্য দেখাচ্ছে না। আবার এই মানুষই পৃথকভাবে, একা থাকলে অত্যন্ত ভদ্ৰ শিষ্টাচারসম্পন্ন হবে। কি করে মানুষের এতগুলো মুখ হয়! এদের দিকে তাকিয়ে থাকতে সরিৎশেখরের কথাটা মনে পড়ল। এই যে লোকগুলো ঘুম থেকে উঠেই ভাত খেয়ে ট্রেনে চাপে, শিয়ালদার নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে অফিস যায় বাদুড় ঝুলে, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ে, পরচর্চা করে এবং কিছু কাজ করে কাটিয়ে দেয়, আবার বিকেলে শেয়ালদা থেকে বাজার নিয়ে ট্রেনবন্দী হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে–তারা কী ধরনের মানুষ? বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি সংসারের আয়-যন্ত্র; রাত্রে সন্তান উৎপাদন এবং দিনে পরচর্চা এখন রক্তে মিশে গেছে। কেউ নিজেকে কি ভারতবাসী বলে মনে করে? এই দেশ আমার এরকম বোধ কখনো কি তাদের চিন্তিত করে একমাত্র সমালোচনা ছাড়া এরা রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষে না। যারা তাদের পাইয়ে দেয় সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এরা সমর্থন করে । আদর্শের বালাই নেই। তাহলে, এই যে মানুষের ভারতবর্ষ সে কতটা উন্নতি করবে? হাত-পা মাথা বিহীন একটা জন্তুর মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেশটা। এবং তার জন্যে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কম্যুনিস্ট পার্টি এদের কথা কিভাবে চিন্তা করে অনিমেষ জানে না। পার্টির প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার আলাপ নেই। কম্যুনিষ্ট পার্টি সর্বহারার পার্টি। কিন্তু এই সব মানুষ কিছুই হারাতে রাজী নয়। ওর মনে হল এই রকম দরকচা মারা মানুষগুলোকে কখনই কম্যুনিজমে বিশ্বাসী করানো যাবে না। একটা বড় আঘাত সে যুদ্ধই হোক কিংবা শাসনযন্ত্রের দুর্বার পীড়নই হোক–যা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপগুলোকে ছত্রাকার করবে, তা না এলে মানুষে মানুষে জানাশোনা হবে না।
স্টেশনের বাইরে এসে অনিমেষের খেয়াল হল গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি। সরিৎশেখরকে নিয়ে সে এমন ব্যস্ত ছিল যে কোনদিকে তাকাবার সময় পায়নি। হ্যারিসন রোডের দেওয়ালে টাঙানো একটা বামপন্থী কাগজের সামনে সে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পুলিশী হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন নেতারা। ভিয়েতনামে আমেরিকা বিষাক্ত বোমা ব্যবহার করছে। রাশিয়ায় পৌঁছে ভারতীয় ডেলিগেটরা লেনিনের সমাধিতে মালা দিয়েছেন। কেমন যেন সব সাজানো সাজানো ব্যাপার, অনিমেষ তৃপ্তি পেল না। আজ অবধি কোন কম্যুনিস্ট নেতা বললেন না, ভারতবর্ষ আমাদের দেশ। এই দেশের জন্যেই এখানে কম্যুনিজম প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষকে দেশকে ভালবেসে সংগ্রামী হতে হবে। সব সময় বিদেশের কথা বলে একটা অস্পষ্ট ধোয়াটে বৈপ্লবিক আবহাওয়া তৈরি করা হয়। কি লাভ কে জানে। তাছাড়া এতগুলো বছর নেতারা কাজ করলেন কিন্তু কপা এগিয়েছেন তা তারাই জানেন। এখনও শহরের মানুষকে কম্যুনিজম সম্পর্কে আগ্রহী করা সম্ভব হয়নি। গ্রামে তো আরো দূর অস্তৃ। ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশ তো কম্যুনিজম বলতে বিদেশী কিছু বোঝে। তাহলে? এদিকে কংগ্রেসীরা তিল তিল করে অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছে কিন্তু সে সুযোগ নেবার কোন বাসনা বাম নেতাদের নেই । কংগ্রেসীদের অবস্থা যদুবংশের মুষলপর্বের মতন। এটাই তো প্রকৃত সময়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় অনিমেষের। কিন্তু সেই যে দামী কথা, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই তোমাকে কাজ করতে হবে; মন চায় তবু মেনে নিতে হয়।
অনিমেষ ভেবেছিল হোস্টেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে কলেজে যাবে। কিন্তু মীর্জাপুরের কাছাকাছি এসে ভাবল একবার য়ুনিভার্সিটিটা ঘুরেই যাই। এখন সাড়ে দশটা বাজে। বারোটার আগে ক্লাস আরম্ভ হবে না। স্বচ্ছন্দে হোস্টেল থেকে তৈরি হয়ে আসা যেত। কিন্তু এক কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হল। রাখালদার ক্যানটিনে এখনও আট পয়সায় চা পাওয়া যায়। লনে ঢুকতেই দেখল চারধারে পোস্টার। ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশী অত্যাচারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। যদিও সে গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি তবু কেউ তো একথা বলেনি! তমালদের মুখেও তো শোনা যেত তাহলে। এখনও ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি। অনিমেষ ক্যান্টিনে ঢুকে দেখল কয়েকজন ভাত খাচ্ছে, কোণার দিকে ছোট্ট একটা জটলা। ওরা যে ছাত্র পরিষদের ছেলে বুঝতে অসুবিধে হল না। অনিমেষকে দেখতে পেয়েই ওদের গলার আওয়াজ নীচে নেমে এল। একজনকে চিনতে পারল সে। শচীন। নীলার বন্ধু । একদিন কফি-হাউসে এই ছেলেটির সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিল। বেশ ভদ্র ছেলে। অনিমেষ রাখালদাকে একটা চায়ের কথা বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল। ওর এই চিনতে পারার ভঙ্গিটায় শচীন অবাক হল। অনিমেষ গলা তুলে বলল, ভালো আছেন?
গায়ে পড়ে কথা বলা ওর অভ্যেস নয় কিন্তু মনে হচ্ছিল ছেলেটি কোন কারণে আড়ষ্ট হয়ে আছে। ব্যাপারটা জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছিল।
শচীন এবার উঠে এল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছেন?
অনিমেষ দেখল শচীনের বলার ভঙ্গিতে একটা শীতলতা আছে। তবু সে আবার জিজ্ঞাসা করল, অনেকদিন দেখিনি, খবর কি সব?
কি খবর চান?
অনেকদিন নীলাকে দেখিনি। কেমন আছে ও? অনিমেষের মনে হল নীলার কথা বললে শচীন সহজ হবে।
শচীনের কপালে ভাঁজ পড়ল। অনিমেষকে খুঁটিয়ে দেখে বলল, আপনি কিছু জানেন না?
কি ব্যাপার, কি হয়েছে? অনিমেষ অবাক হল।
ওদের বাড়িতে যাননি এর মধ্যে?
না, বেশ কিছুদিন আমার যোগাযোগ হয়নি?
তাহলে নিজে গিয়েই জেনে আসুন। আজ তো আপনারা ধর্মঘট ডেকেছেন, চলে যান আজকেই। কাছেই তো। শচীন এমন ভঙ্গী করল যেন তারা কথা শেষ হয়ে গেছে, এবার ফিরে যাওয়া যেতে পারে।
অনিমেষ বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার কি সব কথা খুলে বলতে অসুবিধে আছে?
এই সময় ছেলেটা চা দিয়ে যেতে সে ইশারায় শচীনকে এক কাপ দিতে বলল। শচীন আপত্তি জানিয়ে বলল, আপনি গতকাল বিকেলে জানতেন যে আজ ধর্মঘট করা হবে! আপনিও তো একজন ছাত্র-প্রতিনিধি!
অনিমেষ এ রকম প্রশ্ন আশা করেনি। ও বুঝতে পারল শচীন এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করেই তার সম্পর্কে এক বিরূপ ধারণা নিয়ে কথা বলছে। অনিমেষ উত্তর দিল, আমি গতকাল অনুপস্থিত ছিলাম। থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারতাম। সিন্ধান্ত নিশ্চয়ই সর্বসম্মত।
মিথ্যে কথা। আমাদের খবর, কালকেও আপনাদের পরিকল্পনা ছিল না ধর্মঘট করার। পুলিশ যাদের অ্যারেস্ট করেছে তারা কেউ ছাত্র নয়। কিন্তু গত রাত্রে পার্টির নির্দেশে বিমান নিজে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
কথাটা শুনে চমকে গেল না অনিমেষ। এটা হতেই পারে। সাধারণ সম্পাদককে যদি পার্টি নির্দেশ দেয় তবে নিশ্চয়ই সে মান্য করবে। এতে অন্যায়টা কিসের। সে বলল, এটা তো আমাদের ভেতরের ব্যাপার, আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?
মাথা ঘামাচ্ছি কারণ আপনারা নিজের ইচ্ছে মতন সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন না। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার আপনারাই করেছিলেন। ওদের খুঁচিয়ে দিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে এসে লুকিয়েছেন যাতে আমরাও জড়িয়ে পড়ি। বাইরের গুন্ডা দিয়ে ট্রাম পুড়িয়েছেন নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে। কি ইস্যু নিয়ে এত কান্ড হল? সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে কী সম্পর্ক? গতকাল কেবলে তিনজন কমুনিস্ট পুলিশের গুলীতে মারা গেছে এতএব আজ এখানে ধর্মঘট করো। অথচ সেকথা আপনারা বলছেন না ধর্মঘটের কারণ দেখাতে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বহুদূর থেকে কষ্টের পয়সা খরচ করে এখানে এসে দেখবে ক্লাস হচ্ছে না–এই হয়রানি এবং অপচয় কেন করালেন? আর সবশেষে একটা কথা, নিজের নাক কেটে কি অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যায়? একদিনের ধর্মঘট করা মানে একটা দিনের পড়াশুনো নষ্ট করা। এতে আপনাদের কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?
আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে আপনি ধর্মঘটে যোগ দেবেন না। ব্যাস। অনিমেষ চায়ের দাম দিল।
সে তো একশবার। আপনারা যা ইচ্ছে করবেন আর আমরা তা মুখ বুজে সহ্য করব এটা ভাববেন । আমরা ধর্মঘটের প্রতিবাদ করব। আমরা ছাত্রদের বলব ক্লাস করতে। শচীন কথা শেষ করা মাত্রই অনিমেষ ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল । কি পরিস্থিতিতে বিমানদা আজকের ধর্মঘট ডেকেছে সে জানে না কিন্তু সেদিন যে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছিল সেটা তো সত্যি।
য়ুনিয়ন রুম জমজমাট। কার্যনির্বাহক কমিটির সবাই এসগেছে। অনিমেষকে দরজায় দেখে সুদীপ চুরুট নামালো, এই যে অনিমেষবাবু আসুন।
কথাটায় ব্যঙ্গ মেশানো, অনিমেষ অবাক হল। এভাবে কথা বলার কী কারণ আছে তা বুঝতে পারল না সে।
একটা চেয়ার টেনে বসতেই বিমান বলল, কাল কি হয়েছিল তোমার?
অনিমেষ বলল, একটু পারিবারিক কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলাম।
বিমান বলল, যাই হোক না কেন, একবার তোমার ঘুরে যাওয়া উচিত ছিল। পার্টির কাজ করতে গেলে ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া চলবে না অনিমেষ। তাছাড়া তোমার কাছ থেকে আমরা তেমন কোন কাজও পাই না।
সুদীপ বেঁকানো গলায় বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে স্নান-খাওয়া করো নি। তা এখানে আসতে পরামর্শ দিল কে?
এবার বিরক্তি চাপতে পারল না অনিমেষ, আমি কি এসে অন্যায় করেছি?
বিমান বলল, তুমি হোস্টেলে ছিলে না সকালে, খবর পেলে কি করে?
অনিমেষ বলল, আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল?
হ্যাঁ কিন্তু তোমাকে পাওয়া যায় নি।
আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম । ফেরার পথে কোন কিছু না ভেবেই এখানে এসেছি।
আর এসেই সোজা ছাত্র পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসে গেলে! সুদীপ বলল।
এবার অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনারা কি বলতে চাইছেন খুলে বলুন!
বিমান একটা হাত উপরে তুলে বলল, উত্তেজিত হবার মত কিছু হয় নি। বসো।
তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কমরেডস, আমাদের অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনাদের কাছে আমার আবেদন যে, এ সময়ে কোন রকম আচরণ করবেন না যাতে পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য এক সক্রিয় ষঢ়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমরা যেন কেউ সেই ফাঁদে পা না দিই। আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলো পার্টির এক একটা হাতের মত। অতএব, এই সংগঠনের গুরুত্ব অনেক। পুলিশ, কংগ্রেস সরকারে পুলিশ প্রকাশ্যে জঘন্য অত্যাচার করে ছাত্রসমাজকে কলুষিত করেছে। আমার এত তীব্র প্রতিবাদ করেছি। এই প্রতিবাদের প্রকাশ আজকের ছাত্র ধর্মঘট। আমরা জানি সাধারণ ছাত্ররা আমাদের পাশে আছেন। যদি কেউ বিরোধিতা করতে চান সেই দালালদের আমরা বাধা দেব। গতকাল কেবলে পুলিশ তিন জন কমরেডকে হত্যা করেছে। এই সুযোগে আমরা তারও প্রতিবাদ করব। আপনাদের কারো কিছু বলার আছে? বিমানের দৃষ্টি সবার মুখের ওপর বুলিয়ে এসে অনিমেষের ওপর স্থির হল। উত্তেজিত হলে মানুষের নার্ভ বিক্ষত হয়।
বিমানের বক্তৃতা অনিমেষের কানে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। তার সম্পর্কে অবিশ্বাস এদের মধ্যে এসেছে, এই বোধ তাকে নিঃসঙ্গ করছিল। বিমান জিজ্ঞাসা করল, অনিমেষ কিছু বলবে? সচেতন হল অনিমেষ। ঘাড় নেড়ে না বলে বসে পড়ল। বিমান বলল, কোন কোন ব্যাপারে সবাই একমত নাও হতে পারে কিন্তু প্রতি ব্যাপার নিয়ে যদি আমরা সমালোচনা করি তাহলে কোন কাজই শেষ হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের কর্তব্য হল হুকুম পালন করা। তাতে যদি মৃত্যুও হয় তবু তাই সই। কারণ আজকের মৃত্যু আগামীকালের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবেই। আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমাদের আন্দোলন সফল করতে প্রত্যেকে সক্রিয় ভূমিকা নিন।
বিমান বসে পড়তেই সুদীপ উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর অত্যন্ত গুরুগম্ভর গলায় বলল, কমরেডস, আমি খবর পেয়েছি আজকের ধর্মঘট বানচাল করতে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা বদ্ধপরিকর। তাদের লালিত ছাত্রসংস্থা এর মদত দেবে। দুঃখের কথা, কিছু প্রতিবিপ্লবী বিপথগামী বন্ধু এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমরা এর মোকাবেলা করব। আপনারা অন্যান্য কমরেডদের নিয়ে য়ুনিভার্সিটির প্রতিটি গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করুণ। কেউ যদি জোর করে ঢুকতে যায় তাহলে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না।
কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সবাই এক একটা গেটে চলে গেল। য়ুনিভার্সিটির অফিস খোলা, অধ্যাপকদের আসতে বাধা দেওয়া হবে না।
অনিমেষকে ডাকল বিমান, তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো।
একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে বিমান জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি হয়েছে?
কিছুই হয়নি।
তুমি কি পার্টির প্রতি ভরসা হারাচ্ছো?
একথা কে বলল?
আমাদের কানে এসেছে তুমি এরকম কথাবার্তা বল।
না, আমি কখনও বলিনি। অনিমেষ ভাবতেই পারছিল না তার মনের কথা এরা টের পাচ্ছে কি করে! সে তো কারোর সঙ্গে আলোচনা করেনি।
কাল রাত্রে তুমি কি করছিলে?
মানে?
অনিমেষ বি ইজি। কাল রাত্রে তুমি হাতিবাগানে কি করছিলে?
এবার অনিমেষ শক্ত হল। ওরা কি সুবাসদার সঙ্গে তার দেখা হওয়া নিয়ে এসব বলছে? কিন্তু সুবাসদা তার পরিচিত, দেখা তো হতেই পারে।
সে বলল, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে সুবাসদার সঙ্গে দেখা, আমরা চা খেলাম, গল্প করলাম।
কী গল্প?
এটা একদম ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়?
গুড। তুমি সহজ হতে পারছ না অনিমেষ। মনের মধ্যে ময়লা থাকলেই মানুষ গুটিয়ে যায়। তবু জিজ্ঞাসা করছি, কী কথা হয়েছিল?
অনেক দিনের আলাপ। দেখা হল দীর্ঘ ব্যবধানে। এ রকম ক্ষেত্রে যে রকম কথা হতে পারে আর কি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি সুবাসদার?
না। সে দেখা করবে না। সুবাসকে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এ খবরটা তো তুমি শুনেছ ওরই কাছ থেকে। কেউ শাস্তি পেলে তার ব্রেন অনেক কিছু বানিয়ে নেয়। সুবাস তোমাকে প্রকাশ্যে রেস্টুরেন্টে যেসব কথা বলেছে তা অনেকেই শুনেছে। এসব কথা ওকে বলতে দিয়ে তুমি ভাল করনি। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধ করার চেষ্টার জন্যে দল ওকে তাড়িয়েছে। এ রকম মানুষের সঙ্গে কোন রকম সংশ্রব না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার কথা বুঝতে পেরেছ।
বিমানের শেষ কথাগুলো যে সতর্কীকরণ তা বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের। এ নিয়ে অনেক তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু অনিমেষ নিস্পৃহ থাকল। সুবাসকে ওর ভাল লাগে। সুবাস যে কথাগুলো বলেছে তা অযৌক্তিক বলে মোটেই মনে হয়নি। ও বুঝতে পারছিল এ ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত তা নিজেই নিতে হবে। এবং সেটা যতক্ষণ না নিতে পারছে ততক্ষণ বেফাঁস কথা বলা বোকামি হবে। মেইন গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল। গতকাল ওই রেস্টুরেন্টে এমন কোন পরিচিত মুখ ছিল না যে সুবাসের সঙ্গে তার আলোচনা এদের জানাতে পারে। তাহলে জানল কি করে? সুবাস যদি দল থেকে বিতাড়িত হয় তাহলে নিশ্চয়ই এদের বলবে না। ব্যাপারটা রহস্যময় অথচ কোন সূত্র খুঁজে পেল না সে। অনিমেষ বুঝল, রাজনীতি করতে গেলে তাকে সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে।
অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল। এখন দু–একজন করে ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করেছে। য়ুনিয়নের যারা যারা সমর্থক তারা ওদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় দলটাকে ভারী দেখাচ্ছিল। যারা কোন দলে নেই তারা দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছিল। য়ুনিভার্সিটির সব কটা গেটেই এই ধরনের বিক্ষোভ চলছে। ফলে ওদের ডিঙ্গিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। পাশের দেওয়ালে পোস্টার সঁটা হয়েছে, পুলিশের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদের আজ ছাত্র ধর্মঘট। এ কথাটাই বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে অনিমেষরা বলছিল। কলেজ স্ট্রীটে এখন অফিস টাইমের ভিড়। ট্রাম–বাস থেকে লোকজন মুখ বের করে দেখছে ওদের। শ্লোগান থামিয়ে একটু এগ বিমান বক্তৃতা দিয়ে গেল একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। জ্বালাময়ী ভাষণ এবং সমগ্র ছাত্র সমাজের অপমান হিসেবে সে ঘটনাকে ধিক্কার জানাল।
ক্রমশ কলেজ স্ট্রীটে ভিড় জমছে। ছেলেমেয়েরা ফুটপাত উপচে রাস্তায় নেমে ওদের দেখছে। ট্রাম বাসগুলো এক সময় দাঁড়িয়ে গেল ভিড়ের জন্যে। এতক্ষণ কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে নি। এমন কি কোন অধ্যাপক বা অফিসকর্মীকেও আসতে দ্যাখেনি অনিমেষ। ওর মনে হল, এই রকম ধর্মঘট ডাকা ছাত্রছাত্রীরা বেশ আনন্দিতই হয়েছে। মুফতে একটি ছুটি পাওয়া গেল, বেশ চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে–ছুটির মেজাজ এখন ওদের। কি জন্যে ধর্মঘট, কেন সেটা করা হচ্ছে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার কেউ বোধ করছে না। শ্লোগান উঠছে ঢেউ–এর মত, হঠাৎ শুনলে প্রতিটি শব্দ আলাদা করে কেউ বুঝতে পারবে না। অনিমেষের মনে হচ্ছিল, পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন সাজানো অথবা চাপানো, কারো মনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। যেন একটা ফর্মুলাকে অনুসরণ করে যাওয়া, সেটা যে কখন বাসি অকেজো হয়ে গেছে তার খোঁজ কেউ রাখে না।
অনিমেষের খিদে পাচ্ছিল। হোস্টেলে ভাত ঢাকা আছে কিন্তু এখন যদি সে হাতিবাগানে গিয়ে খেয়ে আসতে চায় তাহলে সেটা দৃষ্টিকটু হবে। স্নান না করে সে একটা দিনও থাকতে পারে না, সে না হয় আজ না করল। পকেটে এমন পয়সা নেই যে চট করে রাখালদার ক্যান্টিন থেকে খেয়ে আসবে। দাদুর জন্যে আচমকা যে খরচ হয়ে গেল তা সামলে এই মাসের বাকী কটা দিন কেমন ভাবে চালাবে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ । খিদের কথা মনে হতেই এই চিন্তাটা এল।
ঠিক এই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে শ্লোগান উঠল । চীনা দালাল নিপাত যাক। বেআইনি ধর্মঘট মানছি না, মানব না। গুন্ডাদের আন্দোলনে ছাত্ররা থাকছে না থাকবে না। একজন একটু এগিয়ে দেখে এসে বলল, বড় জোর কুড়িজন ওদের দলে। চিন্তার কিছু নেই।
ও পক্ষে শ্লোগান কানে আসা মাত্রই এ পক্ষের গলা উত্তাল হল। ওদিকের আওয়াজ যত এগিয়ে আসতে লাগল তত টেনসন বাড়ছে। ক্রমশ অনিমেষ ওদের দেখতে পেল। মুকুলেশ সামনে, শচীনও আছে। প্রত্যেকের হাতে বই খাতা, যেন ক্লাস করতে আসছে। দুপক্ষের চিৎকারে কান পাতা দায়, য়ুনিভার্সিটির কার্নিশে বসা একটা চিল ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল আচমকা ।
গেটের কাছাকাছি ওরা আসতে পারল না। অনিমেষরা অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে। মুকুলেশ নিজের দলকে চুপ করিয়ে ওদের দিকে মুখ করে গলা তুলে বলল, আমরা এই ধর্মঘট মানছি না। আমাদের ভেতরে যেতে দিন।
বোধ হয় এইরকম অনুরোধের জন্য এরা প্রস্তুত ছিল না। শ্লোগান থেমে গেল হঠাৎই, সবাই চুপচাপ, কেউ উত্তর দিল না।
মুকুলেশ আবার বলল, যারা ধর্মঘট করবেন তারা যাবেন না, কিন্তু সেটা সবার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনাদের নেই।
বিমান বা সুদীপ এই গেটে নেই এখন। অনিমেষ চট কর টুলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, এটা যুনিয়নের সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের তা মানতে হবে।
মুকুলেশ বলল, য়ুনিয়নের নয়, আপনাদের পার্টির সিদ্ধান্ত, সেটা মানতে আমরা বাধ্য নই । আপনারা সরে যান, আমরা ভেতর ঢুকব।
ঠিক তখনই হইচই বেধে গেল। মুকুলেশের দলের দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে এদের সরিয়ে জোর করে ভেতরে ঢুকতে গেল। এরা তাদের থামাতে হাতাতাতি বেঁধে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলেজ স্ট্রীট যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা, যারা এতক্ষণ নাটক দেখছিল তারা উধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল। দেখা গেল সেই দুটো ছেলে রীতিমত প্রহৃত হয়ে মির্জাপুরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মুকুলেশরা উধাও। একটি ছেলেও ঢুকতে পারেনি। সবকটা গেটই অনিমেষদের দখলে। ফুটপাতের দোকানদাররা মালপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল জোর গলায়। খবর পেয়ে বিমান সুদীপ ছুটে এসেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় সবাই কাঁপছে। ঠিক সেইসময় গেটের মুখে বোমা পড়ল। মাটিতে পড়েই যে শব্দ হল তাতে হকচকিয়ে গেল এরা। ধোয়ায় চারধার ঢেকে যাচ্ছে। পর পর কয়েকটা। কলেজ স্কোয়ারের দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। আত্মরক্ষার জন্যে সবাই গেট ছেড়ে ভেতরে ঢুকে এল।
বোমা ছোড়ামাত্রই অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য করতে লাগল কোন দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। এখন কলেজ স্ট্রীট খাঁ-খাঁ করছে। ট্রামগুলো পিছু হটছে। পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ পেল সে। অনিমেষদের মনে হল কেউ একজন কলেজ স্কোয়ারের গেটের আড়ালে লুকিয়ে আছে। ছেলেটাকে ধরার উদ্দেশ্যে অনিমেষ রাস্তা পার হতেই আরো কয়েকটা বোমা তার মাথা টপকে ওপাশের ফুটপাতে গিয়ে সশব্দে ফাটল। ছেলেটি তাকে কাছে আসতে দেখে গেটের আশ্রয় ছেড়ে প্রাণপণে ভেতরে দৌড়ে গেল। অনিমেষ পিছু ধাওয়া করতে চেয়ে বুঝতে পারল তার পক্ষে সম্ভব নয় ওকে ধরা, জেরে পা ফেললেই থাই টন টন করছে।
গেটের ও পাশে আবার শ্লোগান উঠছে। বিমান চিৎকার করে ওকে ফিরে আসতে বলল। ফুটপাত ছেড়ে সে যখন সবে রাস্তায় পা দিয়েছে ঠিক তখনই আচম্বিতে একটা কালো ভ্যান তার পাশে এসে ব্রেক করল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই দু-তিনটে পুলিশ ওর দুহাত ধরে টানতে টানতে ভ্যানের পেছনে তুলে দিল। ঘটনাটার আকস্মিকতায় অনিমেষ এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কোন কথা বলতে পারছিল না। সে শুনল সার্জেন্ট বলছে, আর কেউ আছে?
নেহি স্যার, সব অন্দর মে।
অয়্যারলেসে বলে দাও, একটা হুলিগান অ্যারেস্টেড।
তারপর যান্ত্রিক কিছু কথাবার্তার মধ্যে অনিমেষ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করছেন কেন? কী করেছি আমি? কেউ উত্তর দিল না। পুলিশভ্যানটা তেমনি স্থির হয়ে আছে অথচ অনিমেষের বেরুবার পথ বন্ধ।
এই সময় অনিমেষের কানে এল গেট থেকে নতুন শ্লোগান উঠছে, পুলিশ তুমি নিপাত যাও। কমরেড অনিমেষ লাল সেলাম লাল সেলাম।
সার্জেন্টটা নখ দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, সেলাম আবার লাল হয় কি করে মাশাই?
দাঁতে দাঁত চেপে অনিমেষ বলল, শালা!
পুলিশভ্যানটা সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করল।
Leave a Reply