যুদ্ধ হয় একটার পর একটা এবং শত্রু শক্তি ধ্বংস করা যায় একের পর এক। কল–কারখানা তৈরি হয় একটার পর একটা। চাষীরা চাষ করে একের পর এক প্লট। আমরা যে খাবার শেষ করতে পারব তাই নিই কিন্তু আমরা মুঠো মুঠো করেই তা খাই । সমস্ত খাবার একসঙ্গে খাওয়া অসম্ভব। একেই পিসমিল সলিউসন বলে। মাও সে তুং–এর বিখ্যাত এই উক্তিটিকে ব্যবহার করেছিল সুদীপ। একসঙ্গে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। পিসমিল সলিউসন হচ্ছে একমাত্র উপায়। এই যে পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষ হল সেটা হয়তো একটা ছোট্ট বিক্ষিপ্ত ঘটনা, কিন্তু এই ঘটনা থেকে আর একটা ঘটনা জন্ম নেবে। আজ যদি সারা দেশের মানুষ এই রকম ঘটনা অবিরত ঘটতে থাকে তাহলে কোন সরকারের পক্ষে তার মোকাবিলা করা অসম্ভব। ভারতবর্ষ ভিয়েত্রম হয়ে যাবে সেই সময় ।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সাহসী ছেলেরা বেরিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পুলিশের ভ্যান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এবং কলেজ স্ট্রীটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। চারধারে একটা থিতিয়ে আসা ভাব কিন্তু কোন দোকানপাট খোলেনি, সামান্য যে কজন পথচারী হাঁটছে তারা যে সন্ত্রস্ত তা বোঝা যায়। পোড়া ট্রামটাকে এখনও সরিয়ে নেওয়া হয়নি। অবশ্য সেটার কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এখন কোন রকম গোলমালের আশঙ্কা নেই। সমস্ত কলকাতা জেনে গেছে কলেজ স্ট্রীটে এই সংঘর্ষের কথা । খবর এসেছে বিমানের মিছিল এয়ার লাইনসের কাছেই পুলিশ আটকে দেয়। খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল শোভাযাত্রা তাই ওখানে কিছু ঘটেনি। বিমান অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও ফিরে আসতে পারেনি কিন্তু একটি ছাত্র খবরটা পৌঁছে দিয়েছে।
সুদীপ চার পাঁচজনের একটা দলকে নিয়ে কথা বলছিল।
অনিমেষ বলল, আপনি যা বলছেন তা এসব ইস্যু নিয়ে সম্ভব নয়। তাছাড়া—
চুরুট ধরিয়ে এক হাতে ওকে থামতে বলে সুদীপ খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, সেটা আমরা জানি। কিন্তু এভাবেই মানুষকে সচেতন করতে হবে। যে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে সরাসরি যাওয়া সম্ভব নয়, কিছু ছলনার আশ্রয়ও নিতে হয়। আজকে এই ঘটনা না ঘটালে বিমান মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছাতে পারত না।
কিন্তু মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে কি লাভ হল? ওরা শুনবে আমাদের কথা? এটাও তো একধরনের চাটুকারিতা। একটি ছেলে ফোঁস করে উঠল।
অনিমেষ চমকে ছেলেটাকে দেখল। ফরসা সুন্দর চেহারা কিন্তু এর আগে কখনো কথা বলতে দ্যাখেনি ওকে।
সুদীপ বলল, তোমাদের মনে রাখতে হবে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। চীনের দালাল বলে গুলজারিলাল নন্দা যখন আমাদের চিহ্নিত করেছিল তখন আমাদের পার্টি সেক্টেটারী যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন সেটা পড়ে দেখো।
অনিমেষ বলল, কি সেটা?
তিনি বলেছিলেন, আমরা কোন রকমের সশস্ত্র যুদ্ধের কথা চিন্তা করছি না। আমরা আইনসম্মত দল এবং খোলাখুলি কাজ করতে চাই। আমি আর একবার স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে তেলেঙ্গানা–মার্কা সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্য আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই।
ছেলেটি বলল, আমাদের সঙ্গে সি পি আই–এর তাহলে তফাৎ কি?
সুদীপ বলল, ওরা সুবিধাবাদী, রাশিয়ার তাবেদার।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, পার্টির যদি এই সিদ্ধান্ত তাহলে আজ আমরা সংঘর্ষে গেলাম কেন?
বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল সুদীপের মুখে, কে বলেছে আমরা সংঘর্ষে গেছে। পুলিশ সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় আমাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে, গুলী চালিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনকে হেয় করার জন্য নিজেরাই গুন্ডা দিয়ে ট্রাম জ্বালিয়েছে। তুমি কি যারা ট্রাম জ্বালিয়েছে তাদের দেখেছ? ওদের কি ছাত্র মনে হয়েছে? তবে! দু-একটা ইট যা এখান থেকে ছোঁড়া হয়েছে তা প্ররোচিত হওয়ার পরই ছোঁড়া হয়েছে। ব্যাপারটা যে সমস্তটাই সাজানো তা বুঝতে এত অসুবিধে হয় কেন?
একটি ছেলে দৌড়ে এসে বলল, সুদীপ, রিপোর্টাররা এসেছে কথা বলতে চায়। কি করবে?
কি করবে মানে?
বিমান তো নেই।
আমরা আছি। ওদের ক্যান্টিনে বসাও আর রাখালদাকে চা করতে বল। আমি আসছি। ছেলেটি সুদীপের নির্দেশ নিয়ে চলে গেলে সে বলল, বোধ হয় কিছু মেয়ে এখনও আটকে আছে এখানে। তাদের বুঝিয়ে বল ভয়ের কিছু নেই, ওরা বাড়ি যেতে পারে। আমি রিপোর্টারদের সামলাচ্ছি।
সুদীপ খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে য়ুনিয়ন অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। অনিমেষ শুনল, ফরসা ছেলেটি নিজের মনে কিছু বিড়বিড় করছে। বোঝা যাচ্ছিল সে আজকের ব্যাপারটায় মোটেই সন্তুষ্ট নয়। অনিমেষ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছিল না।
সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনিমেষ নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে হাঁটছিল। এর আগে যখন সে মেয়েদের দেখেছিল তখন কোন কথা বলেনি। চুপ চাপ দরজা থেকে সরে সুদীপের খোঁজে নেমে এসেছিল। এখন সিঁড়ির মাঝামাঝি মুখোমুখি হয়ে গলে ওদের। ওরা নেমে আসছে।
আপনাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে?
অনিমেষ সেই চোখ দুটো নজর করল। এখন টকটকে জবাফুলের মত লাল। অনিমেষের নিজের অবস্থাও তাই কিন্তু অনেকটা সামলে নিয়েছে সে। আর একটি মেয়ে প্রায় ভেঙে পড়া গলায় বলে উঠল, ট্রাম-বাস চলছে না, না? আমি কি করে বাড়ি যাই বলুন তো?
কোথায় থাকেন আপনি? রোগা এবং আতঙ্কিত মেয়েটিকে দেখল অনিমেষ।
ঢাকুরিয়া।
ট্রেনে যাবেন?
না, না, ট্রেনে গেলে অনেক হাঁটতে হয়।
তাহলে সেন্ট্রাল এভিতে চলে যান। ওদিকে সব বাস পাবেন।
সে কি! এই যে একজন বলল, সব বাস-ট্রাম বন্ধ
সেটা শুধু কলেজ স্ট্রীটে। আপনারা ইডেন হোস্টেলের পাশ দিয়ে চলে যান। উত্তর বা দক্ষিণ দু দিকের গাড়ি পেয়ে যাবেন।
অনিমেষের কথায় উজ্জ্বল হল মুখগুলো। কুয়ো থেকে যেন টেনে তোলা হল ওদের।
নীচে নেমে এসে রোগা মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ গুলী করবে না তো?
অনিমেষ হাসল, কি আশ্চর্য! খামোখা পুলিশ গুলী করতে যাবে কেন?
আর একটি মেয়ে বলল, কেন? করেনি গুলী? কিছু বিশ্বাস নেই।
না, এখন সব থেমে গেছে। অনিমেষ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। সে লক্ষ্য করছিল, সবাই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু সে প্রথম প্রশ্ন করার পর থেকে একজন একেবারে চুপ। যেন তার উত্তরটা না পাওয়া অবধি সে কথা বলবে না। অনিমেষ প্রশ্নের শ্লেষটা গায়ে না মাখার চেষ্টা করছিল অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে।
ততক্ষণে অন্যান্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ইডেন হোস্টেলের পথে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রায় নিঃশব্দে ওরা হাঁটা শুরু করতে অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
একটু অস্বস্তির গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যাবেন না?
সব অসুখেই কি এক ওষুধ খান আপনি?
মানে?
পরোপকার করতে গিয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? সেন্ট্রাল এভিন যে আমার পথ তা আপনাকে কে বলল?
অনিমেষ বলল, আপনি এত বেঁকিয়ে কথা বলেন কেন? সব সময় মানুষকে বিদ্ধ করে কি আনন্দ পান কে জানে? কোথায় থাকেন আপনি?
কেন? এখন কি আপনার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাদের দেখাশোনা করার?
যদি বলি তাই। অবশ্য আপনার আপত্তি থাকলে আলাদা কথা।
এটাও কি সংগ্রামী পদক্ষেপ?
আর কিছু বলবেন? তাহলে একবারে বলে ফেলুন।
আপনাদের কান্ডকারখানা দেখে মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল।
একটু ঠান্ডা করে বলুন কোন দিকে যাবেন?
মেয়েটি একটুক্ষণ অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেদিন বলছিলেন না যে মফস্বলের ছেলে আপনি। ওটা তো সহানুভূতি আদায়ের ছল, কিন্তু এর মধ্যেই–। কথাটা শেষ না করে হেসে ফেলল সে।
অনিমেষ দেখল ঠাস দাঁতের সারির একটা দিকে গজাতের আদল, যেটা হাসিটাকে আরো সুন্দর করেছে। সেটা চোখে পড়ায় অনিমেষ একটুও রাগতে পারল না কথাটা শুনেও। বলল, আপনি একনাগাড়ে ঝগড়া করে যাচ্ছেন।
মেয়েটি আবার গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। কলেজ স্ট্রীটের দিকে মুখ করে সে জিজ্ঞাসা করল, এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না?
আপনি কোথায় যাবেন এখনও বলেননি। যদি আপত্তি থাকে তবে
আপত্তির কি আছে! আমাদের বাড়ি বেলঘরিয়া। শিয়ালদা দিয়ে গেলে সুবিধে হয়। আপনি ওদিকে গেছেন?
না। আমি যদি শিয়ালদা অবধি যাই তাহলে–।
চলুন।
কলেজ স্ট্রীট দিয়ে যেতে অনিমেষের একটু, অস্বস্তি ছিল। কারণ এখনও প্রচুর পুলিশভ্যান ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউ নিশ্চিয়ই গোলমালের সময় তাকে মাঝরাস্তায় টিয়ারগ্যাসের শেল কুড়োতো দেখে থাকতে পারে। সুতরাং এখন মুখোমুখি হলে ওকে ধরে ফেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু মেয়েটির কাছে এসব কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছেল তার। সত্যিই তো শিয়ালদা যাওয়ার জন্যে সেন্ট্রাল এভিন্যু ঘোরার কোন মানে হয় না।
দু-একজন মানুষ সন্তর্পণে ফুটপাত ধরে হাটছে। পোড়া ট্রামটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা হচ্ছে ততক্ষণে।
অনিমেষ বলল, আসুন, ওই কলেজ স্কোয়ার দিয়ে বেরিয়ে যাই।
ওরা যখন রাস্তা পার হয়ে এ ফুটপতে এল তখন একজন অত্যন্ত অবহেলায় হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলল। মেয়েটি চাপা গলায় বলল, ওরা আমাদের কেয়ারই করছে না।
কলেজ স্কোয়ারের ভেতর ঢুকে একটু সহজ হল অনিমেষ। সামনেই বিদ্যাসাগরের স্ট্যাচু এবং সেটা জড়ভরতের মত তাকিয়ে। এইসব মূর্তিগুলো দেখলে ইদানিং অস্বস্তি হয় ওর। সে-সময়ের মানুষগুলোকে আমরা আস্তে আস্তে লিলিপুট বানিয়ে ফেলছি।
মীর্জাপুরের কিছু দোকান খোলা। মোড়ে মোড়ে জটলাগুলো বোধ হয় আজ দুপুরের ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত। অর্থাৎ বিমানের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। অবশ্যই এটাকে এক রকম জয়লাভই বলতে হবে। টুকরো টুকরো করে যদি সফলতা আসে একসময় সেগুলো জোড়া দিয়ে দিলেই পূর্ণতা পাবে।
মেয়েটি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আজকে যা করলেন তাতে আর কি ভাল হলো বলতে পারেন?
অনিমেষ বলল, একদম মেরুদণ্ডহীন আমরা নই সেটা প্রমাণ হল।
তাই নাকি? বাঁকা চোখে তাকাল মেয়েটি, পাড়ার গুন্ডারা যখন পুলিশের সঙ্গে বোমা নিয়ে লড়াই করে তখন তাদেরও মেরুদণ্ডহীন বলে মনে হয় না।
আশ্চর্য! দুটো ব্যাপার এক হল? ওরা লড়ছে কোন কারণ ছাড়াই–জাস্ট গুণ্ডামি করতে। অনিমেষ বিরক্ত হল।
মেয়েটি বলল, আপনাদের কারণটা কি? না, ভিয়েত্নাম আমেরিকা অত্যাচার করছে তাই কোলকাতার ট্রাম পোড়াও, পুলিশ মারো, সাধারণ মানুষকে অসুবিধেতে ফেলো–কি মহৎ ব্যাপার!
কুঁচকে গেল অনিমেষের, আপনি কি বলতে চাইছেন।
দেখুন, আমি সাধারণ মানুষের দলে। মাথায় যদি অন্য চিন্তা না থাকে তাহলে যে কেউ বুঝতে পারবে এগুলো হল স্টান্ট দেওয়ার চেষ্টা। নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার সহজ রাস্তা। আচ্ছা, সত্যি কি আপনি নিজেকে কম্যুনিস্ট ভাবতে পারেন?
কম্যুনিস্ট। আমি ঠিক জানি না। তবে আমি এমন সমাজব্যবস্থা চাই যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। সেটা তো আর আকাশ থেকে নেমে আসবে না, তাই তার জন্যে কতগুলো আদর্শ সামনে রেখে এগোতে হবে। সেক্ষেত্রে কম্যুনিজমের কোন বিকল্প নেই।
বেশ, আপনার দল যা করছে তা কি সাম্যবাদের লক্ষণ! কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে আপনারা ভুল করেছেন।
আপনি কি কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করেন?
মোটেই না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনাদের দল সরকারে এলে আর একটা কংগ্রেসী সরকার হবে। টাকার এ পিঠ আর ওপিঠ।
চট করে নিশীথবাবুর মুখ মনে পড়ে গেল অনিমেষের। জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলের যে মাস্টারমশাই তাকে প্রথম দেশ সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। তারও তো একই বক্তব্য ছিল । কথাটা এখন স্পষ্ট মনে আছে, এ দেশে কম্যুনিস্ট সরকার হওয়া মুশকিল। যদি কখনো হয় দেখবে আমরা যা যা করেছি ওরা তারই নকল করছে আর যা করিনি ওরা সেটা করছে না। উপরন্তু ওদের বাড়তি সমস্যা হল যে ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের এখন ওরা জন্ম দিচ্ছে তাদের সামলানো তখন মুশকিল হয়ে পড়বে। একজনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তুমি দশ রকমের ভাওতা দিতে পার, কিন্তু নিজে ক্ষমতায় এলে দেখবে সেই ভাঁওতাগুলো একশ রকমের হয়ে গেছে।
কমুনিস্ট পার্টির মাথা বা মাঝারি নেতাদের চেনে না অনিমেষ। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বিমানের কথাবার্তা ওর তেমন পছন্দ হয় না। সব সময় একটা চাপা মনোভাব, কেউ প্রতিবাদের ভঙ্গী করলে সেটা যেন বিমানের সহ্য হয় না। কিন্তু একজন লোককে দিয়ে সেটা যখন সত্য তখন অন্য কোন বিকল্প দলের কথা ভাবা যায় না। ছাত্র পরিষদের শচীন সেদিন ওদের যে মতবাদের কথা বলছিল কিংবা মুকুলেশ যা করতে চায় সেটা তো শুধুই ভাব-প্রবণতা। অবলম্বন ছাড়া কোন সার্থকতা আসে না। আসলে মানুষের সহজাত ধর্ম হল চট করে হতাশ হয়ে পড়া। কাজ শুরু করার আগেই যারা ব্যর্থ পরিণতির কথা চিন্তা করে তারা তো কিছুই করতে পারবে না।
মেয়েটি বলল, কি ভাবছেন তখন থেকে
অনিমেষের খেয়াল হল ওরা শিয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকের অবস্থা প্রতি দিনের মত স্বাভাবিক। এই যে মাত্র মাইলটাকে দূরে অমন কান্ড হয়ে গেল তা এই এলাকা দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। অনিমেষ বলল, কিছু না। পরে একদিন আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব। আপনার ট্রেন কটায়?
এখনতো ঘন ঘন ট্রেন। আপনাকে এতদূর এনে কষ্ট দিলাম।
কষ্ট কি! শিয়ালদায় এলে আমার মন ভাল হয়ে যায়।
সেকি? কেন?
স্টেশনে ঢুকলেই রেলগাড়ি দেখতে পাই। আর রেলগাড়ি দেখলেই জলপাইগুড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলা এমন একটা জিনিস যা সব ক্ষত সারিয়ে দিতে পারে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও।
আপনার ক্ষত আছে? ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল মেয়েটি।
কথাটা শুনে চমকে তাকাল অনিমেষ। তারপর হেসে ফেলল, আপনি এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর দেওয়া যায় না।
তাহলে আপনার এমন কথা বলা উচিত নয় যার অর্থ আপনি জানেন না।
নর্থ স্টেশনের দরজায় এসে দাঁড়াতে মেয়েটি বলল, এবার আমি যেতে পারব, আপনাকে শুধু এটুকু করার জন্য ধন্যবাদ।
কিছুই করিনি।
তা ঠিক। আসলে আমরা মেয়েরা অনেক কিছু অলীক ভয় আগাম কল্পনা করে নিয়ে বিব্রত হই। একটা পুরুষ যা পারে আমিও তাই করতে পারি। কিন্তু যদি কিছু হয়, যদি যদি করে নার্ভাস হয়ে সব গুলিয়ে ফেলাটা আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে, কি করব বলুন? নইলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে রোজকার মত আজও চলে আসতে পারতাম, এই যেমন এলাম। গজদাঁত বের করে হাসল মেয়েটি।
আমি সঙ্গে এলাম বলে এখন আফসোস হচ্ছে?
এটাও কিন্তু মেয়েদের অভ্যেস, গায়ে পড়ে কাদা মাখা।
ও কথা আমি একবারও বলিনি।
এই যাঃ, কি অভদ্র দেখুন তো আমি। আপনি কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসাই করিনি। ঠোঁট টিপে হাসলে মেয়েটির চোখ কথা বলে।
হাতিবাগানের একটা হোস্টেলে
আপনি হোস্টেলে থাকেন? ও তাই!
মানে? আবার কি থিওরি আছে এ ব্যাপারে!
হোস্টেলের ছেলেরা একটু ডেসপারেট এবং স্বার্থপর হয়।
তাই নাকি? বাঃ, এটা তো জব্বর জানা হল।
একা একা থেকে ভাবতে শুরু করে আমি যা করছি তাই ঠিক।
বাঃ, গুড। জ্ঞান গ্রহণ করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল অনিমেষ। হঠাৎ যাত্রীদের ভিড় বেড়ে গেল। অফিস–ফেরত মানুষেরা পড়ি কি মরি করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন ধরতে। গেটে যে টিকিট কালেক্টর দাঁড়িয়ে আছেন তার ভঙ্গি জগন্নাথের মত। হাত দুটো আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি এবার চলে যাওয়ার ভঙ্গি করতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, টিকিট কাটবেন না?
আমার মাসের টিকিট আছে।
হঠাৎ অনিমেষের ইচ্ছে হল ট্রেনে ওঠার । অনেকদিন ট্রেনে ওঠা হয়নি। জলপাইগুড়ি যাওয়া-আসা ছাড়া তো ট্রেনে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না।
সে বলল, একটু দাঁড়াবেন, আমি টিকিটটা কেটে আনি।
কেন? আপনি কোথায় যাবেন? বিস্ময় মেয়েটির চোখে
ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে খুব। বলে অনিমেষ দ্রুত গিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। বোধ হয় এখন অফিসটাইম বলেই কাউন্টারের ভিড় কম। এখনকার যাত্রীদের মান্থলি আছে। যারা হঠাৎ–যাত্রী তারা এই সময়টাকে এড়িয়ে আসে। বেলঘরিয়া পর্যন্ত টিকিট কাটল অনিমেষ । হাতিরবাগান দিয়ে একটা বাস যাওয়া-আসা করে বেলঘরিয়া পর্যন্ত। ফেরার সময় সেটায় আসা যাবে।
অনিমেষকে আসতে দেখে মেয়েটি প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ঢুকে গেল। পাশাপাশি কতগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে কিন্তু সেগুলোয় বাদুড়-ঝোলা ভিড়।
অনিমেষ বলল, আরে ব্বাস, এগুলোয় উঠবেন কি করে?
মেয়েটি বলল, আপনাদের কাছে যেটা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ আমাদের সেটা প্রাণ বাঁচানোর দায়। নিজে সুখে থাকলে অবশ্য এ রকম করা যায়।
মানুষকে আঘাত দিয়ে আপনার এক ধরনের আনন্দ হয়, না?
মেয়েটি সেকথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে হাঁটছেন এ দৃশ্য পরিচিত কেউ দেখলে কি কৈফিয়ত দেবে?
কৈফিয়ত কেন? আপনি আমার সঙ্গে হেঁটে অন্যায় করছেন নাকি?
এই সন্ধ্যেবেলায় একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরঘুর করছি–সমাজটাকে তো আপনারই নিয়ন্ত্রণ করেন।
এখন সমাজ বলে কিছু নেই।
তাই নাকি? তাহলে সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা চান কেন?
থতমত হয়ে গেলে অনিমেষ। কি কথা থেকে কোন কথায় চলে এল এ মেয়ে। এতক্ষণে ওর মনে এক ধরনের হীনতাভাব ছাড়াতে শুরু করল। মেয়েটির সঙ্গে কথায় সে প্রতি মুহূর্তে হেরে যাচ্ছে।
কি, মুখ শুকিয়ে গেল কেন? ভয় নেই, কেউ জিজ্ঞাসা করলে আলাপ করিয়ে দেব ইনি একজন মহান কর্মী, আজ য়ুনিভার্সিটিতে বিপ্লব করে এসেছেন। একথা শুনলে কেউ আর অন্য কিছু ভাববে না।
মেয়েটি ওকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে চলে এল। এদিকের লাইনে কোন গাড়ি নেই। যাত্রী হকার কুলিতে স্টশন গমগম করছে। সেই প্রথম রাতটার কথা মনে পড়ে যায় যেদিন সে একা জলপাইগুড়ি থেকে এসে শিয়ালদায় নেমেছিল। এখানে এসে প্রথমে বোঝা যায়নি কলকাতার এ্যালার্জি হয়েছে। একথাটা ত্রিদিবের মুখে শোনা। এই যে মাঝে মাঝে বিক্ষোভ, ট্রাম–বাস পোড়ানো নাকি অ্যালার্জির মত। চিংড়ি খেয়ে অনেকের শরীরে কয়েক দিনের জন্যে বেরিয়ে আবার যেমন মিলিয়ে যায় তেমনি। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, কোথাকার টিকিট কাটলেন?
বেলঘরিয়া।
আপনার মতলবটা কি বলুন তো?
বুঝলাম না।
ন্যাকামি করবেন না। আপনি আমার বাড়িতে যেতে চাইছে নাকি?
আপনার আপত্তি থাকলে যাব না, অনিমেষের মজা লাগছিল।
নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। আমি একটা উটকো লোককে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি না। বাড়িতে যখন জিজ্ঞাসা করবে কেন এল তখন আমি কি বলব? এ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছে?
না। বলবেন বেড়াতে এসেছে।
আপনি আমাকে কি ভাবেন?
একজন শিক্ষিত মহিলা।
কোন শিক্ষিতা একদিনের আলাপে কোন ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে যায় আদর করে কোন প্রয়োজন ছাড়া! আর আপনিই বা কেমন লোক অযাচিত হয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে চাইছেন?
বললাম তো আপত্তি থাকলে যাব না।
শুনেছেন তো, আমার আপত্তি আছে।
বেশ যাব না।
তাহলে আমার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
টিকিটটা যখন কেটে ফেলেছি তখন ট্রেনে উঠব। সেটায় নিশ্চয়ই আপনার আপত্তির অধিকার নেই।
তা নেই কিন্তু অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠবেন। আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন আমি ধন্যবাদ দিয়েছি। এর বেশি কিছু চাইবেন না।
আচ্ছা।
কিন্তু অনিমেষ সরে গেল না। মেয়েটির মত উদ্বিগ্ন করে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। এখন প্ল্যাটফর্মটা ভরে উঠেছে। হঠাৎ খেয়ালে টিকিটটা কেটে একটু অস্বস্তি হচ্ছে এখন। মেয়েটি নিশ্চয়ই সহজ ব্যবহার করছে। যেকোন ভাল মেয়েই এরকম কথা বলবে। যদিও ওর বাড়িতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা ওর ছিল না কিন্তু খেপিয়ে দিতে ভাল লাগছে। মেয়েরা একবার রাগলে বোধ হয় থামতে জানে না, এর মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। অনিমেষ চটপট আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ ওদের কথা শুনছে কিনা। দু-একজন দূর থেকে আচার খাওয়ার মত মেয়েটিকে দেখছে বটে কিন্তু কথা শোনার মত কাছাকাছি নেই। যদি ওর সঙ্গে বেলঘরিয়া স্টেশনে নেমে বাড়ি অবধি যায় তাহলে মেয়েটি কি করবে? ব্যাপারটা কল্পনা করতেই হাসি পাচ্ছিল ওর।
পাশে দাঁড়িয়ে অমন ক্যাবলার মত হাসবেন না। ফোঁস করে উঠল মেয়েটি।
অনিমেষ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল, আরে, আমি হাসতেও পারব না?
দূরে গিয়ে হাসুন।
আপনি বড্ড রেগে গেছেন। এরকম যদি অভ্যেস হয় তাহলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত। কারণ এটা একটা অসুখ।
এই সময় ট্রেনটা এসে গেল প্ল্যাটফর্মে। যাত্রীরা নামতে না নামতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল সেটায় ওঠার। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দৃশ্যটা আতঙ্ক নিয়ে দেখছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনটা ভরে গেল মানুষে। এখনও প্রচুর লোক ছুটোছুটি করছে প্ল্যাটফর্মে একটু জায়গা পাওয়ার আশায়। চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছু শোনা যাচ্ছে না। এই মানুষগুলো প্রতিদিন এভাবে গাদাগাদি করে যায়। মুখ দেখে বোঝা যায় না ওরা এতে অসন্তুষ্ট কিনা। অভ্যেস বোধ হয় সব কিছু সহজ করে দেয়। এ নিয়ে বিক্ষোভ নেই, তবে এটুকুও না পেলে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড হয়। কতটুকু ন্যূনতম চাহিদা মানুষের তবু তাই মেটাতে সরকার অক্ষম। আচ্ছা কম্যুনিস্ট পার্টি তো এসব নিয়েও আলোচনা শুরু করতে পারে।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার কথা মনে হতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। হঠাৎ কি করে যে ও উধাও হয়ে গেল বুঝতে না পেরে অনিমেষ চারপাশে তাকাতে লাগল। তবে কি ওই ভিড় ঠেলে মেয়েটি উঠে পড়েছে ট্রেনে? এরকম একটা অসম্ভব কাজ একটা মেয়ের পক্ষে এখন আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না অনিমেষের। চোখের সামনে ও মেয়েদের ঠেলাঠেলি করতে দেখেছে।
হঠাৎ কেমন নিঃসঙ্গ মনে হল ওর। এতক্ষণ কথা কাটাকাটি করেও যা মনে হয়নি হঠাৎ ওকে না দেখে তাই হল। অনিমেষ ট্রেনের কামরাগুলোয় সাগ্রহে চোখ বোলানো শুরু করল। ভেতরে কেউ থাকলে এই ভিড়ে বাইরে থেকে কিছুতেই বোঝা যাবে না। এইভাবে কাউকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। কিন্তু অনিমেষের মনে হল এ অবস্থাতেই যদি ওকে দেখতে পেয়ে যায় সে তাহলে অনেক কিছু ব্যাপার সত্যি হতে পারে । যেন নিজের ভাগ্য যাচাই করার জন্যে ও কামরাগুলো দেখা শুরু করল। এবং ভাগ্য এত কাছে অপেক্ষা করছে তা দেখে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এই কম্পার্টমেন্টে লোক আছে কিন্তু অন্যগুলোর চেয়ে কম কারণ সামনে বড় বড় করে মহিলা এবং ফার্স্ট ক্লাশের চিহ্ন লেখা আছে। আর তারই জানলায় বসে মেয়েটি যে অনেকক্ষণ তাকে লক্ষ্য করছে এটা বলে দিতে হবে না । কিছুই হয়নি। এমন ভাবে করে অনিমেষ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার?
বাধ্য হয়ে। আপনিও উঠতে পারেন কারণ এখানে অন্য শ্রেণীর লোকও উঠে থাকেন। আপনার অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল?
সে কি, যাবেন না?
আর ইচ্ছে নেই।
এত তাড়াতাড়ি ইচ্ছে চলে গেল?
যার সঙ্গে যাব সেই যখন এরকম ভদ্রতা করতে পারল
ওকথা আপনার মুখে মানায় না।
কি কথা?
ভদ্রতা।
কেন? আমি কি কিছু অদ্ৰতা করেছি?
এতক্ষণ যার সঙ্গে এলেন, কথা বললেন, বাড়ি যেতে চাইলেন, একবারও তার নাম জানতে ইচ্ছে করল না? আমি মেয়ে এটাই কি আপনার কাছে সব?
অনিমেষ সোজা মুখের দিকে তাকাল। ট্রেনটা এবার ছাড়ছিল। মেয়েটে হাসল, নিজে কখনও ছোট হই নি, আজ হচ্ছি। আমার নাম মাধবীলতা মুখার্জী।
মাধবী?
উঁহু, ফুল নয়, আমি শুধুই লতা, মাধবীলতা।
অনিমেষ ট্রেনটার চলে যাওয়া যেন দেখতে পেল না।
Leave a Reply