৫. প্রথমে ছিল দ্বিধা

প্রথমে ছিল দ্বিধা। পরে এলো নিস্পৃহতা। সেদিন সন্ধ্যে সাতটায় নিশাতের সঙ্গে দেখা হবে, ও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু আমি যাইনি। এই প্রথম ওকে কোনো কথা দিয়ে সে কথা রাখতে পারিনি। পরদিন টেলিফোনে যোগাযোগ করতে গিয়েও পারলাম না, দ্বিধা আমাকে থামিয়ে দিল। কাজি সাহেবের চেম্বার থেকে তারপর যখন শরীর খারাপ বলে বেবিয়ে এলাম তখন আমাকে জড়িয়ে ধরলো এক অবসাদ আর নিস্পৃহতা। মনে হলো, আমার ভাগ্যই হচ্ছে নিশাত থেকে দূরে থাক, আমার সমস্ত সুখের কবর হয়ে যাওয়া। তখন বড় অর্থহীন মনে হলো আমার বাড়ির স্বপ্ন, গাড়ি, শখ, ফুটফুটে একটি ছেলের কল্পনা। মনে হলো, এসব থেকে নিজেকে আমি যতক্ষণ না বঞ্চিত করছি ততক্ষণ পিতৃহত্যার দায় থেকে আমার মুক্তি নেই।

আমি নিজেকে সবকিছু থেকে একেবারে দূরে সরিয়ে দিলাম। এই অভিশপ্ত জীবন আমাকে যে একটা ধারণ করতে হবে। এখানে কেউ বন্ধু হতে পারবে না, অংশ নিতে পারবে না।

নিশাত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিল কিনা বলতে পারব না। করে থাকলেও আমার তা জানবার উপায় ছিল না। কারণ সে আমার ঐ ঠিকানাটাই জানতো–জালালের বাসার ঠিকানা; কিন্তু মার কাছ থেকে ফিরে আসবার পাঁচদিনের মধ্যেই আমি জালালের বাসা ছেড়ে চলে যাই। যাই মানে, যেতে হয়েছিল। আমার দেয়া সেন্ট, চপ্পল, শাড়ির বিশ্রী ব্যাখ্যা করেছিল জালাল। এবং একদিন আমার সামনেই সে তার স্ত্রীর হাত থেকে সেন্টের শিশিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ড্রেনে। সেদিনই আমি আমার বাক্স বিছানা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসি। সেদিন আমার আরো দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায় যে আমার স্পর্শমাত্রই অমঙ্গল। এই পরিস্থিতিতে জালালের কাছে নতুন ঠিকানা রেখে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই নিশাত যদি এখানে খোঁজ করেও থাকে আমি আর জানতে পারিনি।

আরেকটা হতে পারত, নিশাত যদি আমাকে টেলিফোন করত কাজি সাহেবের চেম্বারে। কিন্তু পরদিনই, ঐ টেলিফোন তুলে রেখে দেয়ার পর, পনেরো দিনের ছুটি নিই আমি। সেই পনেরো দিনে আমি এতটা বদলে গেলাম যে, মনে হলো ওকালতি আর করবো না। সেই কথা লিখে একটা পোস্টকার্ড কাজি সাহেবকে পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিলাম। তাকে লিখেছিলাম, আমি ঢাকাতেই থাকছি না। কাজেই নিশাত যদি এখানেও খোঁজ নিয়ে থাকে তো ব্যর্থ হয়েছে।

এখন মনে হয়, সত্যি নিশাত সেদিন কী ভেবেছিল তার জীবন থেকে আমার এই আকস্মিক অন্তর্ধানে। একথা তো সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সে আমাকে ভালোবাসত এবং আমার ওপরে নির্ভর করে ছিল। আমি যে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে ভুলে যেতে পারব একথা সে বিশ্বাস করবে কী করে? সে নিশ্চয়ই মনে করেছে–আমি মরে গেছি, কী আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, কী কেউ আমাকে বন্দি করে রেখেছে। হ্যাঁ, এইসব অসম্ভব অবাস্তব কারণ ছাড়া আর কী ইবা সে ভাবতে পারত?

কিন্তু আসলে যা সত্যি তা নিশাত তার দুঃস্বপ্নেও দেখতে পারবে না। সে কি কেঁদেছিল? তার রাত কি বিদ্রি হয়েছিল? তার শরীরে কি জীবন-রসের ধারা ক্ষীণ, ম্লান হয়ে গিয়েছিল?

আজ আমার মনে হয়, নিশাত যদি আমার খোঁজ পেত, তাহলে আমার জীবন আবার অন্যখাতে বইতো। তার সঙ্গে যদি একবার দেখা হয়ে যেত আমার, তাহলে আমি স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। মনে হয়, আমাকে যেভাবেই হোক তার খুঁজে বার করা উচিত ছিল। কিন্তু, এ পৃথিবীতে কার দায় পড়েছে আমার চেতন বা অচেতন মনের ইচ্ছেগুলোর তোয়াক্কা করবার? মানুষ নিজেই তার নিজেকে তৈরি করে এবং সেখানে অন্য কারো দায় নেই।

নিশাতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক এভাবে চুকিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত যে কী করে নিতে পারলাম সেদিন। সাতদিন আগেও তো কত অসম্ভব মনে হতো বিচ্ছেদ। আজ আমার সাকুল্যে এই ধারণা হয়েছে, মানুষ আবিষ্কার করতে পারে মহাদেশ, পর্বত, নক্ষত্র; জয় করতে পারে যুদ্ধ; সৃষ্টি করতে পারে সঙ্গীত; কিন্তু চির অচেনা চির অজেয় এবং স্বয়ম্ভ তার নিজেরই মন।

জালালের ওখানে থাকতেই, কী ওখান থেকে চলে আসবার কদিন পর, আমি বহুদিন পর আবার গিয়েছিলাম ফরাসগঞ্জে গোবিন্দর চা-দোকানে। কতকাল পরে সেখানে পা দিয়েই আগের মতো নাকটা ধরে উঠল রান্না করা ঝাল মুরগির ঝাঁঝালো গন্ধে, বাতাসে ধোঁয়ার গুমোট, হলুদ দেয়ালে কালির পরত–এক মুহূর্তে যেন ফিরে গেলাম আমার সেই দিনগুলোয় যখন আমি পরীক্ষায় ফেল করে তিতাস ধরেছিলাম।

গোবিন্দ আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো।

আসুন, আসুন স্যার। ওরে, চেয়ারটা মুছে দে। বলতে বলতে সে নিজেই একটা চেয়ার বেশ ঘষে মুছে দিল। হেসে জিগ্যেস করল, কেমন আছেন? অনেকদিন এদিকে আসেন না। অ্যাডভোকেট হয়েছেন শুনলাম?

বললাম, ভুলে যাইনি বলেই তো এলাম। তোমার দোকানটা যে কে সেই রয়ে গেল গোবিন্দ। চলে যায় স্যার। কী খাবেন? মুরগি পাউরুটি? না ওমলেট?

দাও, তোমার বেস্ট যা আছে। মনে আছে, আমি ঠাট্টা করে বলতাম এটা আমাদের লিটল শাহবাগ।

হেঁ হেঁ করে হাসল গোবিন্দ। তার কোকড়ানো বাবড়ি চুলে হাতের পিঠ ঘষলো অনাবশ্যক ভাবে একবার। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দরোজার মুখে কয়লার চুলোয় চাপানো ডেকচির ঢাকনাটা তুলল। আমি ভেতরে গেলাম।

যাদের আশা করেছিলাম, সবাই আছে। আমার তাসের পুরনো বন্ধুরা এবং নতুন আরো দুটি মুখ। পুরনোরা আমাকে দেখে প্রথমে বোকা হয়ে গেল। আর তাদের অবাক হওয়া দেখে নতুনেরা তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল আমাকে।

আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে, আমিও অবাক হয়েছিলাম ওদের সেই একই টেবিলে এই দীর্ঘদিন পরেও একই ভাবে গোল হয়ে বসে থাকতে দেখে। তাসের প্যাকেটটা তেমনি পড়ে আছে পাশে, হাতগুলো উদ্যত এবং স্থির। যেন আমার উঠে যাওয়া আর আজ ফিরে আসার মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট কাল অতিবাহিত হয়েছে; আমি বেরিয়ে গিয়ে ঐ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তিন বৎসর পরিক্রমা করে এসেছি–তিন বৎসর।–নিশাত, ভালোবাসা, বিয়ের কথা, মা, আমার বাবার মৃত্যুর ইতিহাস। তফাৎটা কেবল এখানে, আগে আমি ছিলাম গোবিন্দর ভিনিগারের শিশির মতো ফালতু, আর আজ ওরা আমাকে দেখছে মুগ্ধ চোখে, ঈর্ষার কাঁচের ভেতরে দিয়ে; যেন রাজার সঙ্গে দেখা করে গাঁয়ের মানুষ আবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে।

লোকমান টেবিলে চাপড় দিয়ে বলে উঠল, বাই জোভ, কে এসেছে ভাঙা ঘরে?

আসাদ বলল, বেশ যাহোক আপনি। একেবারে লাপাত্তা। একবার তো আসতে হয়, নাকি? তাইতো এলাম।

আরো দুহাত খেলল ওরা! আমি বসে বসে দেখলাম। একবার একটা তর্ক হলো তাস নিয়ে। আমাকে তার সালিশী করতে হলো। গোবিন্দ মুবগি পাউরুটি এনে দিল। পর পর দুকাপ চা খেলাম আমি।

ওরা উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, এত সকালে কোথায়?

তখন এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ওরা। বিধাটা কোথায় বুঝতে পারলাম না। অবশেষে লোকমান বলল, যাবেন আপনি?

কোথায়?

যেখানে যাচ্ছি।

সবাই যাচ্ছে?

হ্যাঁ, আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল। চলুন মন্দ হবে না।

আমি ভেবেছিলাম, সিনেমা। বললাম, বেশ তো।

বেরুনো গেল ওদের সঙ্গে।

সে রাতে আমি প্রথম মদ্যপান করি। খারাপ লাগছিল বেশ, কিন্তু ওয়াক-থু করিনি। বরং আমার বেশ স্ফুর্তি করছিল ভেবে যে এতকাল শুনেই এসেছি, জিনিসটার স্বাদ নেওয়া গেল। নেহাৎ মন্দও নয়। গলা পুড়তে পুড়তে ভেতরে নেমে যায়, পাকস্থলীতে গিয়ে ফণা তুলে বসে থাকে। তারপর মনে হয় মাথার পেছনে কে যেন মৃদু হাতে অবিরাম চাপড় দিচ্ছে–তার আরামে ভারী হালকা আর রঙিন হয়ে আসে মেজাজটা।

পরদিন আমি ওদের খাওয়ালাম। এবং তারপর থেকে নিয়মিত। ব্যাঙ্কে যে টাকাগুলো ছিল তার সঠিক অঙ্ক মনে থাকত না; মনে হতো আমি যদি কিছু নাও করি সারাজীবন আর এভাবে সারারাত ফ্লাস খেলে, মদ খেয়ে, হৈ হৈ করে কাটিয়ে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোই তো কোন অভাব হবে না কোনদিন।

নিশাতের কথা এখন আর মনে পড়ে না। আমার মনে হয় না এই এক বৎসরে নিশাতকে আমি ভাববার চেষ্টা আদৌ করেছি। একদা তাকে ভালোবাসঞ্জাম। সে ভালোবাসা সুদূর আর অবাস্তব মনে হতো এই দিনগুলোয়। যেন অন্য কারো জীবনে ওসব ঘটে গেছে, কিংবা আমার আরেক জীবনে। নিশাতের কোনো ছবি আমার কাছে ছিল না। আমার মনে হয়, যদি চোখ বুঝে দেখবার চেষ্টা করতাম তো দেখতে পেতাম না নিশাতকে। নিশাতের চেহারাই ভুলে গিয়েছিলাম আমি।

এই সময়ে একটা নতুন ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমি ভাবতে চেষ্টা করতাম আমার বাবাকে। যে কোনো মুহূর্তে পেয়ে বসত এই ভাবনার রোখ। টের পেতাম, কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে আমার চোখ–কোনো বস্তু বা শূন্যের মধ্যে চোখ রেখে আমি কোন এক অদৃশ্য বলীয়ানের সঙ্গে লড়াই করতাম, যে শক্তিমানের কাছে গচ্ছিত রয়েছে আমার বাবার মুখ। যেন তাকে হারিয়ে দিতে পারলে, দৃষ্টির তীরে বিদ্ধ করতে পারলেই সব পেয়ে যাবো স্পষ্ট দেখতে পাবো বাবাকে।

একেকদিন তাস হাতে স্তব্ধ হয়ে যেতাম। তাসের টেক্কা হঠাৎ বিস্তৃততর হতে থাকতো আমার সমুখে। টেক্কার শরীরে দুর্বোধ্য কারুকাজের ভেতরে ছড়ানো ছিটানো দেখতে পেতাম–যুগলের অংশ, চিবুক, নাকের রেখা, ঠোঁট–ধাঁধার মতো, খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন; আমার সাধনা সেগুলো একত্রিত করে মিলিয়ে বাবার মুখ সৃষ্টি করা।

বন্ধু কেউ ধাক্কা দিলে ঘোরটা কেটে যেত। খুব অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম। খেলা আর জমতো না।

এবারে আমার একটা উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। সে আমার কপাল খুলে গিয়েছে। আগে, নিশাতের আগে, যখন এই গোবিন্দর দোকানের পেছনে বসে খেলতাম, তখন হারতাম। যদিও বা জিততাম তো সেটা এমন কিছু বিস্ময়কর জিৎ হতো না। আর আজ ওরা আমাকে তাস বেঁটে দিতে বলে, কপাল তো তোমার। লাও দেখি কী হয়।

কী আবার হবে? গোবিন্দ যখন দোকান বন্ধ করছে বলে শেষবারের মতো তাগাদা করত, আর আমরা আরো এক হাত বলে আরো তিন চার হাত খেলে উঠতাম, তখন দেখা যেত আমার পকেটে লাভের কড়ি আসল উপচে উঠেছে। অবশ্যি, আমার মনটা ছিল খুব উদার এবং টাকাগুলোর সদ্ব্যবহার হতো মদের বোতলে, মাংসে, সিনেমায়, সিগারেটে। আজ মনে হয়, ওরা আমাকে ভালোবাসত। আমার সম্পর্কে একটা উচ্চ ধারণা ছিল ওদের। কিন্তু কী কারণে এই ভালোবাসা, আর কেনই বা এ উচ্চ ধারণা তা বলতে পারব না।

ওরা ছিল কয়েকজন চমৎকার বন্ধু। কোনো প্রশ্ন করত না, আমার কোনো কিছুই জানতে চাইতো না, দিনমানে কী করি, আমার সংসার আছে কী নেই–এসব ওদের কাছে তুচ্ছ। আমার তো মনে হয়, আমার পুরো নামটাও ওরা কেউ বলতে পারবে না। অথচ কত গভীরভাবে আমরা একে অপরকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। মানুষ যখন স্কুল বানায়, দেশ চালায়, সংসার করে, হাসপাতাল কী মসজিদের পরিকল্পনা করে তখন তারা একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছু না জেনে একসঙ্গে মিলিত হতে পারে অথচ সেই মানুষই যখন একসঙ্গে জুয়ো খেলে, মদ্যপান করে, ধর্ষণে সঙ্গী হয়, রাহাজানির জন্যে জোট পাকায় তখন কত সহজে এবং পরস্পরের কত কম তথ্য জেনে হাতে হাত মেলাতে পারে। আসলে, আমাদের রক্তের ভেতরে রয়েছে পাপ আর বুদ্ধির মধ্যে পুণ্যের ধারণা। এই পাপের বেসাতিতে বন্ধু জোটে সহজে। রক্তের ডাক বলেই হয়ত পাপের বন্ধু যত নিকট হতে পারে পুণ্যের বন্ধু ততখানি হতে পারে না।

আমরা একসঙ্গে মদের টেবিলে প্রাণ খুলে সব কথা বলতাম, বিশ্বাস করুন, কোনো রাখা ঢাকা ছিল না; পারতাম একজন আরেকজনের সমুখেই ট্রাউজারের বোম খুলে প্রস্রাব করতে; আরো পারতাম মেয়েমানুষের ঘরে একজন ঢুকলে বাকি সবাই বাইরে অপেক্ষা করতে, আর পারতাম সরকারকে নির্ভয়ে গালি দিতে, বেপরোয়ার মতো দেশনায়কদের সম্পর্কে যা খুশি তা বলতে–যার একাংশ বাইরে গেলে নির্ঘাত রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে পড়তে হতো। আমার সময়গুলো কাটছিল চমৎকার। জীবন মৃত্যুর দায়মুক্ত পরমপুরুষের মতো মনে হতো আমার নিজেকে–যার পাপে পাপ নেই, পুণ্যে প্রয়োজন নেই, বন্ধন যার কাছে এক অশ্রুত শব্দ।

আমি জানি, আপনারা চমকে উঠেছেন মেয়েমানুষের উল্লেখে। আমি নিজেও এখন কম আশ্চর্য বোধ করি না, যখন পেছনের দিকে তাকিয়ে আমার এ ছবিটা দেখতে পাই। আমিওতো কোনদিন ভাবিনি, এরকম হয়ে যাবো। আমার বরাবর ধারণা ছিল, পুণ্য বরং সহজে করা যায়, কিন্তু পাপ করতে রীতিমত প্রস্তুত হতে হয়ে নিজেকে। যখন আমি এম.এ পড়তাম তখন কী জানি কীভাবে আমার মাথায় ঢুকেছিল কোনো মেয়েমানুষের সঙ্গে রাত কাটাবার খেয়াল। কার কাছে যেন শুনেছিলাম জিন্নাহ এভেন্যুর মোড়ে দাঁড়ালেই সন্ধ্যের সময় দালাল এসে কাছে দাঁড়ায়, শ তিরিশ টাকা লাগে। কয়েক মাস ভাবতে ভাবতে অবশেষে একবার সদ্য পাওয়া চাচাদের মনি অর্ডার থেকে তিরিশ টাকা পকেটে ফেলে রাত আটটায় জিন্নাহ এভেন্যুতে এসে দাঁড়ালাম। মা তো ভোঁ ভোঁ করছিলই, যখন এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি আমার হৃদপিণ্ড যেন হাজারখানেক সৈন্যের মতো দুমদুম করে মার্চ করে চলেছে, আর কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ডিসেম্বরের শীতে পেয়েছে যেন ট্রাউজারের ভেতরটা। একটা করে তোক নির্লিপ্ত মুখে ছায়ার মতো এগিয়ে আসে, আমার মনে হয়, এখুনি বিস্ফোরণ হবে কোথাও, মরে যাবো, লোকটা চলে যায়।

সে রাতে একাই ফিরে আসতে হয়েছে। কিছু হয়নি। কোনো দালালের দেখা পাইনি। দেখা পেলেও যে যেতাম তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কেমন একটা মোহের মতো পেয়ে বসেছিল, কোনো বোধই ছিল না। যখন ফিরে এলাম আবার এত স্বচ্ছন্দ মনে হলো নিজেকে যেন ফাঁসির আসামি খালাস পেয়ে বাড়ি যাচ্ছি।

সেই আমি মাত্র কয়েক বৎসর পরে কত সহজে পয়সা দিয়ে পাওয়া একটা মেয়েকে অভিজ্ঞ শিকারীর মতো কোলে টেনে সিক্ত চুমো দিতে পেরেছিলাম। আর যখন মেয়েটা আমাকে লোক দেখানো খিদে বাড়ানো লজ্জা দিয়ে দূরে রাখবার চেষ্টা করছিল, আমি তাকে হ্যাঁচকা টানে বিছানায় ফেলে তার ওপরে শরীরের সমস্ত ভার ছুঁড়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম, খুব হয়েছে। বাইরে আরো তিনজন বসে আছে তোমার জন্যে।

অবশ্যি এটা খুব নিয়মিত কিছু ছিল না, যেমন তাস বা মদ। ঝোঁক উঠলে, কিংবা ভালো কিছুর খবর পাওয়া গেলে বেরুতাম। একবার একজনের সঙ্গে শুতে গিয়ে মাথার মধ্যে ঘুরে। উঠল নিশাতের ছবি। আমার মনে হলো, বিয়েটা যদি হতো তাহলে আজ এই মেয়েটার বদলে নিশাতের শরীর আমার নিচে নৌকোর মতো দুলে দুলে উঠতো। পরপর কয়েকদিন রোজ রাতে রোখ উঠতো আমার, আর আমি বেরুতাম। নিত্য নতুন চাই। আরো নতুন। আমি ও-রকম সময়গুলোতে চোখ বুজে শরীর আর মনকে কেন্দ্রীভূত, ভয়াবহ ও বিক্ষুব্ধ করতে করতে কল্পনা করতাম নিশাতকে। কানে যেন শুনজে পেতাম নিশাতের কণ্ঠস্বর, তার অনুনয়।

নিশাতের সঙ্গে বিয়ে হবার কোনো বাধাই ছিল না। তবু হলো না। আজকাল আমি ভাগ্যদেবী হয়ে উঠেছি এবং আগেই বলেছি, এখন আমার মনে হয় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমাদের নিছক কল্পনা। সবকিছুই ঘটেছে এবং ঘটবে। জীবন এক অসম্ভব প্রস্তাব এবং তার সমাধা করতে হলে আমাদের কর্মগুলোকে অসম্ভবের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। নিশাতের সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে না তার ইঙ্গিত অনেক আগেই আমার পড়ে নেয়া উচিত ছিল, যা তখন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বিয়ের কথা যেদিন বলব সেদিন নিউমার্কেটের কাছে স্কুটার অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে আমরা বেঁচে গেলাম। নিশাত বিয়েতে রাজি হয়ে যখন বাসে উঠে চলে গেল, তখন পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার পকেট কাটা গিয়েছে। তবু আমি লিখন পড়তে পারিনি। আর শেষ অবধি এই নিশাতের কারণেই আমি জানতে পেলাম, আমার হাতে মৃত্যু হয়েছে বাবার; এই যে দুটো হাত, এই হাতে ধাক্কা দিয়েছি তাকে, পড়ে গেছেন বর্ষায় উন্মত্ত নদীতে সাঁতার জানতেন না, মৃত্যু থেকে জীবনের পাড়ে আর উঠে আসতে পারেননি তিনি।

আজ আমি ভাবি, ওটা কি সত্যি সত্যির পর্যায়ে পড়ে? আজ যখন মার মুখে কথাটা শোনবার পর একটি বছর চলে গেছে, নিশাতের সঙ্গে আবার অপ্রত্যাশিত আমার দেখা হয়েছে, আমি খানিকটা পারছি নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকে পুরো ঘটনাকে দেখতে।

তিন সাড়ে তিন বছরের শিশু যা করছে তা কি সজ্ঞান মানুষের জন্যে প্রযোজ্য আইন দিয়ে দেখা সম্ভব? না, উচিত?

কিন্তু যা ঘটে গেছে তা সত্য। আমার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সজ্ঞানে কী অবোধ-চেতনায় যে মৃত্যু আমি এ দুহাতে একদা ধারণ করেছিলাম তাকে অস্বীকার করবো কী করে?

.

নির্জন ঘরে এখন রাত্রির নিস্তব্ধতা তাকিয়ে আছে আমার দিকে তার গভীর চোখ মেলে। বাতি জ্বালিয়ে লিখছি, লিখতে লিখতে ঘামছি, আবার লিখছি। খেই হারিয়ে যাচ্ছে কথার, স্মৃতির পল্লবিত শাখার সহস্র পাতায় লাগছে ঝড়ের মাতন, মনে হচ্ছে আমি বিশ্বের সবচে একা অথচ বিশ্বের সঙ্গে আমার বন্ধন এত যে নিবিড় তা এর আগে এমন করে আর উপলব্ধি করিনি। আমার জীবন–কাহিনীর কোনো সুস্পষ্ট শুরু নেই, ধারাবাহিকতা নেই স্মৃতির কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ছবির অ্যালবাম নিয়ে আজ আমি আমার হারানো ভালোবাসার সন্ধান করছি। আবার আমি সৃষ্টি করতে চলেছি পিতাকে আমার আদর্শ, কর্ম আর লক্ষ্যের মধ্যে। আমার যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে এই রচনার মাধ্যমে। যা ঘটে গেছে তা আর ফেরাতে পারব না; কিন্তু লেখক হয়ে লিখতে পারব যা ঘটতে পারত–আমার লেখায় সাজাতে পারব অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ, আর জীবনকে, যেন আমি চেয়েছিলাম সৃষ্টি করতে পারব মানুষ, যেমনটি আমি নিজে হতে পারিনি।

.

কিন্তু লেখক হবার এই সিদ্ধান্তটাও আকস্মিক। একেবারে একটা ঝড়ের মতো। সেদিন ছিল এরকম—

গোবিন্দর দোকানে রোজকার মতো বসেছিল তাসের আড্ডা। এই আমি প্রথম ক্রমাগত হারছিলাম। বন্ধুরা খুব অবাক হচ্ছিল এবং একজনকে বেশ লজ্জিত মন হচ্ছিল তার জিতবার পরমুহূর্তে। আমি বললাম, তাতে কী আছে? চলুক না? কিন্তু খেলা চলল ধুকে ধুকে– কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। আমি ওদের মেজাজ ফিরিয়ে আনবার জন্যে প্রস্তাব করলাম, চলো কোথাও যাই। খানিকটা গেলা যাক। আর যদি পাওয়া যায় বলে বা চোখ ছোট করলাম।

ওরা হৈ হৈ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, চমৎকার। চমৎকার। আজ থাক তাস পড়ে।

বেরিয়ে কোথাও পাওয়া গেল না কিছু। সব বারই বন্ধ হয়ে গেছে। একটা মেয়েমানুষের বাড়ি আমাদের জানা ছিল যেখানে খানিকটা মদ রাখা থাকত। আমার বন্ধুরা বলল, চলো সেখানে।

 আমার স্পষ্ট মনে আছে, বন্ধুরা আমাকে স্ফুর্তিতে রাখবার জন্যে কী আকুলি বিকুলিই না করছিল সে রাতে। আমি যে বারবার তাসে হেরে যাচ্ছিলাম, ওরা ধরে নিয়েছে, আমার মনটা খুব দমে গেছে। একটা পয়সা খরচ করতে দিল না আমাকে ওরা। নিজেরা খানিকটা খেল। আর সবাই চলে গেল আমাকে রেখে। যেন আমি একা একটা রাত মেয়েটার কাছে থাকলে মনটা ভালো হয়ে যাবে। ওরা সত্যিই ভালো বন্ধু ছিল আমার। ওদের ধারণা যতটুকু করলে একজন বন্ধুকে খুব চাঙ্গা করে তোলা যায় তাই করেছে। ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে ঘুমোতে পারত সবাই মেয়েটাকে নিয়ে সে ইচ্ছে বলি দিয়েছে ওরা একজন বন্ধুর জন্যে।

ওরা যখন চলে গেল রাত একটা। আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মেয়েটা হাসল, আর বুঝতে পারলাম আমি একা। কিন্তু সে বোঝাটাও স্পষ্ট করে নয়– মাথার মধ্যে নয়–রক্তের ভেতরে যেন ছলাৎ করে উঠল। আমি উঠে বাইরে গেলাম, নাম ধরে ডাকলাম ওদের, কিন্তু সাড়া পেলাম না।

রাস্তাটা জনশূন্য। আজ আমার ভাবতে অবাক লাগে নিয়তিই বোধহয় আরেকবার, বোধহয় শেষবারের মতো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন; নইলে পা টলছে নেশায়, মাথা ঘুরছে মিলের চাকার মতো, তবু অতটা পথ হাঁটলাম কী করে?

বেরুতেই মেয়েটা আমাকে ধরে ফেলল। বলল, যাচ্ছেন কোথায়?

বললাম, কী চাও? টাকা?

জানতাম, অন্তত একটু আমার জ্ঞান ছিল, বন্ধুরা সমস্ত টাকা দিয়ে গেছে, এমনকি মেয়েটার জন্যেও। তাই সে যখন বলল–হ্যাঁ টাকা–তখন আমি কুৎসিত একটা গাল দিয়ে তার হাত ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমার জামা থেকে। সে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আমার বন্ধুদের নাম ধরে উচ্চকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

কেউ নেই ওরা। কোথায় গেল? আমার রক্তের ভেতর থেকে ডাক উঠছে ওদের জন্যে। একা লাগছে। আমি আরো জোরে ডাকতে লাগলাম, আসাদ, লোকমান, সমশের। কান পেতে রইলাম যদি ওদের কণ্ঠে শুনতে পাই আমার নাম, মুশতা–ক।

রাতের অন্ধকার থেকে একটানা শব্দ শুনছি ঝিঁঝির, আর কিছু না। আকাশে কোটি কোটি নক্ষত্র জ্বলছে, যেন তাদেরও পুড়ে যাবার চিড় চিড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার নাম ধরে ডাকছে না কেউ। আবার আমি ডাকলাম, লোকমা–ন।

ফকিরাপুল পেরিয়ে, নটরডেম কলেজ ছাড়িয়ে এসে পড়লাম মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার চৌরাস্তায়। চারটা পথ চলে গেছে চারদিকে। কোন দিকে যাবো? পেছনের পথটা আমাকে নিয়ে যাবে যেখান থেকে আমি উঠে এসেছি। বন্ধুরা গেছে সমুখে। তিনটে পথের কোটা ধরে? আমি জানতাম কে কোথায় থাকে, কিন্তু সেই নেশাগ্রস্ত মুহূর্তে তা মনে পড়ল না। আমার মনে হলো, পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ওরা। তাই ভয় করতে লাগল আরো। উন্মাদের মতো আবার আমি ডাকলাম ওদের নাম ধরে।

তাকিয়ে দেখি নবাবপুর রেলওয়ে ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছি আমি। রেল গেটটা বন্ধ। একটা ট্যাক্সি থমকে দাঁড়িয়ে আছে তার সমুখে। কয়েকটা মুখ ভেতরে। যেন এই প্রথম আমি এক মহাপ্লাবনের পর মানুষের মুখ দেখলাম। ক্ষুধার্তের মতো তাকালাম তাদের দিকে। ট্যাক্সির গায়ে ফুলের ম্লান মালা জড়িয়ে আছে, কয়েকটা ফালি ফালি আলো ভেতরটা খণ্ডিত ছবির মতো করে তুলেছে।

নিশাত। সে আমাকে চোখ তুলে দেখল।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভিখিরি এই এত রাতেও কোথা থেকে এসে হাত বাড়ালো আমার সমুখে। আমি এ–পকেট ও–পকেট হাতড়ে একটা আনি বার করলাম। একটা ইঞ্জিন মাথার ওপরে আগুনের ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে চলে গেল। ভিখিরিটা গিয়ে দাঁড়াল ট্যাক্সির কাছে। আবার সে হাত বাড়াল।

চলতে লাগল ট্যাক্সিটা। ক্রসিং বারের লালবাতিটা দুলতে দুলতে স্থির হয়ে গেল আকাশে। কুক্কমে সাজানো বিয়ের শাড়ি পরা নিশাত। পাশে তার বর। বিয়ের শেষে ফিরে যাচ্ছে ওরা ওদের বাসরে। বরের মুখ আমি দেখতে পেলাম না।

বন্ধুদের নামগুলো ঘুরতে লাগল আমার ভেতরে, কিন্তু আর ডাকতে পারলাম না আমি। নিশাত। ঝাঁপিয়ে পড়া দুরন্ত মমতায় আর সমস্ত কিছু স্থির হয়ে আসা অতল ভালোবাসায় আমি বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

না কি স্বপ্ন দেখছি?

তখন আমার মাথার মধ্যে একটা জলপ্রপাত যেন হঠাৎ বিশ্ব ডোবানো গর্জন করতে করতে নেমে এলো, যার পুঞ্জিভূত, উৎক্ষিপ্ত, ফুলের মতো কোটি কোটি শাদা ফেনায় আমি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম অবিশ্বাস্য, নতুন, চিরন্তন, মর্মরিত এক সুন্দর।

একটা স্কুটার এসে বিকট শব্দ করে থামল আমার পাশে। এক মুহূর্তে আমার সবকিছু ফিরে এলো আমার কাছে। ড্রাইভার গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, সাব কহি যানা হ্যয়?

বললাম, হ্যাঁ কহি তো যানা হয়। মুঝে ঘর পহচা দো।

আমাকে নিয়ে স্কুটার ছুটে চলল সেই পরিচিত প্রচণ্ড শব্দ, গিয়ার ফেঁসে যাওয়ার করুণ আর্তনাদ, চাকার নিচে অসমতল রাস্তার ধাক্কা। ড্রাইভার জানে না যাকে সে উঠিয়েছে আর যাকে সে নামিয়ে দেবে তারা দুজন এক নয়। রাত্রির ভেতর দিয়ে ঘুমন্ত শহরের রাজপথে একটা মৃত্যু থেকে জন্মের দিকে চলেছে তার স্কুটার।

নয়াপল্টন, ঢাকা
১৯৬৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *