২. বন্ধু-স্ত্রী রাঁধেন ভালো

বন্ধু-স্ত্রী রাঁধেন ভালো। ঘরে পা দিতেই রান্নাঘর থেকে তাঁর কণ্ঠ শোনা গেল, আজ এত দেরি যে?

দেরি কোথায়? রোজ তো এই সময়েই ফিরি।

আসলে দেরিই হয়েছিল। সন্ধ্যের পর ঘরে ফিরে আসা আমার বেশ পুরনো অভ্যেস–যখন থেকে কাজি সাহেবের জুনিয়র হয়েছি। প্রথম দিনেই তিনি বলেছিলেন, ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি দিয়ে বিদায় করে। আসল লেখাপড়ার শুরু তারপর থেকে। মাথাটা খুব সাফ রাখতে হবে। পড়তে হবে প্রচুর। ভালো ল-ইয়ারের সিক্রেট হচ্ছে স্টাডি অ্যান্ড শার্প মেমরি।

আমার একটা স্বপ্ন, বড় ল-ইয়ার হবো। পয়সা হরে। বাড়ি হবে। জাল–ঘেরা প্রশস্ত বারান্দায় থাকবে আরাম চেয়ার। বাড়ির সামনে রাস্তাটা হবে চওড়া আর রাস্তাটার নাম চিনবে সবাই একডাকে। কাজি সাহেবের যে পশার প্রতিপত্তি, তাতে এ সবকিছুই তিনি করতে পারতেন। তিনি পুরনো কালের মানুষ বলেই হয়ত করবার মন নেই তার। সেই পুরনো দোতলা, আগে ভাড়া থাকতেন, এখন কিনে নিয়েছেন। গাড়িটার বয়স কুড়ির কাছাকাছি, মাসের মধ্যে পনের দিন গ্যারেজে পাঠাতে হয়। বসবার ঘরে খাড়া নকশাপিঠ চেয়ারের আর বদল হলো না। দরজার পর্দা কেমন ভিজে ভিজে মলিন আর তার আসল রংটা কোনদিন দেখেছি বলে মনেও পড়ে না। তবু তার পশারের কথা জানতাম। তাই তাঁর মতো হবার আশা করছি।

সন্ধ্যের পর পড়তে বসতাম। পুরনো সমস্ত কেসের রিপোর্ট। মনে রাখবার চেষ্টা করতাম, চাঞ্চল্যকর সমস্যাগুলোর সন তারিখ ঘটনা আর কোন কোর্ট, কোন হাকিম, কী রায়। আমার স্মৃতিশক্তি তেমন সক্ষম বলে মনে হয় না। কোনদিন কোনো কিছু স্পষ্ট মনে রাখতে পারিনি। কেবল ভাসা ভাসা এখান থেকে ওখান থেকে মনে থেকেছে। গেল বছরের হয়ত ঘটনা, কিন্তু সব সময় আমার ধারণা হবে, দুতিন বছর আগে হয়েছে। কতবার যে মাস ভুল করেছি, নাম ভুলে গেছি, একজনের বদলে আরেকজনকে ভেবেছি তার লেখাজোখা নেই। কাজেই আমাকে পড়তে হতো বারবার, কষ্ট করতে হতো মনে রাখবার জন্যে। রাত বারোটা একটা হতো রোজ।

ভেজানো দরোজাটা একটু হাত দিতেই দড়াম করে খুলে গেল। সুইচ টিপতেই পাণ্ডুর আলোয় স্নান হাসতে লাগল বালিশ, বিছানা, টেবিল, আলনা।

দরোজার কাছে শব্দ করে এসে দাঁড়ালেন বন্ধু-স্ত্রী। বললেন, খাবেন এখন? না, পরে।

জালাল?

জালাল আমার বন্ধুর নাম।

তার একটু জ্বর দেখলাম।

জালালের একটা না একটা ছোট অসুখ এ রকম লেগেই আছে। আজ সর্দি, কাল মাথাব্যথা, পরশু জ্বর। শীত পড়তেই শুরু করেছে। শুরু হবে সারা সিজন ধরে খুক খুক কাশি। জ্বরটা বোধ হয় তারই পূর্বাভাস। জামপারটা খুলে আলনায় রাখলাম।

বন্ধু-স্ত্রী জানালেন জালাল শুয়ে আছে। রাতে রুটি খাবে। তারপর দরোজার কাঠ ধরে মাথাটা ভেতরে ঝুঁকিয়ে আচমকা ঝরঝরে গলায় জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার? আজ বড় খুশি খুশি যে।

কে, আমি?

তাকিয়ে দেখি, তিনি হাসছেন মাথায় কাপড় দিতে দিতে। বললাম, না, খুশি লাগছে আপনাকে। সন্দেহ হলো, জালালের বোধ হয় জ্বরটা মিছে কথা। আমার সঙ্গে ঠাট্টা হচ্ছে। এ রকম ঠাট্টা ইনি মন্দ করেন না। বিশেষ করে আমার সঙ্গে। দেখলে কে বলবে, অভাবের সংসার আর পাঁচ ছেলে–মেয়ের মা। যেন গল্পে পড়া সুয়োরাণীর সেবাদাসী–সারাক্ষণ হাসি মুখে, আর রসিকতার তুবড়ি। মন্দ লাগে না। একেকদিন আমিও খুব উৎসাহের সঙ্গে লেগে যাই ঠাট্টার কম্পিটিশনে।

বললাম, আমাকে তো খুশি লাগবেই। চোখ দেখান শীগগীর।

কেন?

টাকা তুলে নিয়েছে। শতিনেক। এই তো আধঘণ্টাও হয়নি।

পকেট মেরেছে?

হুঁ।

ইস। তিনশ? কী করে?

জানলে কি আর নিতে পারতো? কপাল খারাপ। আমি এত কশাসলি চলি।

লুঙ্গিটা আলনা থেকে নিয়ে চেয়ারের ওপর রাখলাম। দরোজা থেকে চলে গেলেন বন্ধু-স্ত্রী। তার মুখটা আমার চেয়েও অনুতাপে কালো দেখাল।

মুখ ধুয়ে বলে এলাম, আজ আর খাবো না। দাওয়াত ছিল। বলতে ভুলে গেছি।

এতগুলো টাকা হারিয়েও মনটা খারাপ নেই। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে অবাক হলাম। যেন অনেক বড় কিছু একটা পেয়েছি। আনন্দে ভেতরটা আলো হয়ে আছে। নিশাত রাজি হয়েছে, তাই? আমি যেন জানতামই নিশাত রাজি হবে। না, সে আনন্দও নয়। কিছুতেই মনে পড়ছে না এ রকম একটা কিছু; কিন্তু। কী সেটা? অনেকক্ষণ ভাবলাম। অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ চমক ভাঙ্গল। দেখি, এতক্ষণ কিছুই ভাবছিলাম না। একেবারে শাদা, শূন্য নিরবলম্ব লাগছে নিজের অস্তিত্বকে।

আজ পানি আনতে ভুলে গেছি। উঠে দাঁড়িয়ে রান্না ঘরের কুঁজো থেকে জগ ভরে নিয়ে এলাম। ঘরের ভেতর থেকে জালাল ডেকে উঠল, কে?

আমি।

আবার নিস্তব্ধ হয় গেল রাত্রিটা।

আমি এখন মাসে চারশ থেকে পাঁচশ করে পাই। আর নিশাত কি তিন সাড়ে তিনশ পায় না? কলেজে লেকচারারদের মাইনে কত, আমার ধারণা নেই। নিশাতকেও কখনো বলতে শুনিনি। তাহলে দুজনে সাত থকে আটশই হ.ব। মন্দ কী? কজন আছে মাস গেলে ঘরে এতগুলো টাকা তুলতে পারে? বেশ চলে যাবে আমাদের সংসার। সংসার আর কী? আমরা দুজন শুধু। দুজনের আর কতই বা লাগবে? জমানো আছে পৌনে চার হাজার আমার। বিয়ের পর একটা বছর গেলে দুজনে অন্তত আরো হাজার চারেক জমাতে পারবো। ভাইজানের বাড়ির পাশের জায়গাটা তো খালিই পড়ে আছে নিশাতের নামে। সেখানে বাড়ি করতে পারব। বছর খানেক কষ্ট করতে হবে। তারপর এককামরা দুকামরা করে আস্তে আস্তে দালান তোলা যাবে। একটা কামরা হলেই থাকতে শুরু করা যাবে। এক তলা। ইংরেজি এল-এর মতো করে তুলবো। এ–এর ছোট মাথাটায় থাকবে আমার চেম্বার। আজকাল সুন্দর প্রিন্ট বেরিয়েছে, দোর–পর্দা করা যায়। সোফার রংটা হবে ধূসর– বর্ষার আকাশের মতো। বেশ লাগে রংটা। একটা শার্ট কিনেছিলাম ঐ রকম– রংটা টিকল না। জাপানি ইম্পোর্ট বলেছিল।

কিন্তু নিশাত যে বলছিল ওর স্কলারশিপটা বোধ হয় হয়ে যাবে। বিলেতে দুবছর থাকতে হবে। আমার মনেই ছিল না। সেটা বরং আরো ভালো যাক ও বিলেত। ফিরে এলে নাম হবে। ইউনিভার্সিটির কাজটা হয়ে যাবে হয়ত তখন। দুবছরে আমিও অনেকটা গুছিয়ে বসতে পারবো। আজকাল উঁকিল বেড়েছে–কম্পিটিশন বড্ড টাফ।

বাতিটা খামোকা জ্বলছে। নিভিয়ে দিলাম। কাল আলোয়ানটা বার করতে হবে। শুধু চাদরে বেশ ঠাণ্ডা করে। ঠাণ্ডা পড়ছে। রাত বোধ হয় একটা। দূরে হঠাৎ মানুষ চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে, একটা গানের কলি, হাসি। সেকেণ্ড শো থেকে ফিরছে বোধ হয়।

বুকের কাছে পা টেনে নিতেই নিশাতের মুখটা মনে পড়ল। ছবির মতো। অনেক বড়। সিনেমার পোস্টারে যেমন! অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম। আমি একটু হাসলাম। নিশাত হাসল। আমার চোখে পলক পড়ছে না। নিশাতেরও না। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, নিশাত আর নেই।

আবার মনে করলাম নিশাতকে। ঐতো ওর চোখ দুটো, নাকের তরতরে রেখা, চাপা ঠোঁট, একটা গালে চুলের ছড়িয়ে থাকা। আবার নিশাতকে দেখতে লাগলাম তেমনি নিঃসাড় পড়ে থেকে, বালিশে মাথা কাৎ করে রেখে, বুকের কাছে দুপা দ–এর মতো টেনে।

আমাদের যখন বিয়ে হবে, তখন বালিশ থেকে মুখ তুলেই দেখতে পাবো ওর মুখ। পাশের বালিশে ঘুমে ডুবে আছে নিশাত। অন্ধকারে আচ্ছন্নের মতো, কী হলো আমার, মুখ তুললাম। হাত রাখলাম। জানি নেই, জানি বিয়ের পরে, তবু যদি থাকে।

হাসি পেল আমার। একেবারে উঠে বসলাম। ছেলেমানুষের মতো করছি আমি। সিগারেটের জন্যে হাত বাড়াতে যাবো হঠাৎ হাতটা জগের গায়ে লাগল। চট করে সামলে নিতে পেরেছি, নইলে ভেঙেই ফেলেছিলাম। হৃদপিণ্ডটা এখনো লাফাচ্ছে। আস্তে আস্তে সন্তর্পণে উঠে বাতি জ্বালতে যাবো, তখন—

তখন হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির মতো মা–র কথা মনে পড়ল। আমার আর ওঠা হলো না। সমস্ত শরীরের ওপর দিয়ে অদৃশ্য ঠাণ্ডা পানির রেখা নামতে লাগল যেন। আমি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এক নিমেষে খুইয়ে বিহ্বল নির্বাক এক ভিখিরির মতো বসে রইলাম। যেন শরীর থেকে এক ধাক্কায় ছিটকে আলাদা হয়ে গেছে আমার আত্মা; কয়েক হাত দূর থেকে আমাকে সে দেখছে অসীম করুণার সঙ্গে।

নিশাত জানে না। নিশাতকে আমি মিথ্যে বলেছি। বাবা মারা যাবার পর মা–র বিয়ে হয়েছিল আবার। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে মা-র দ্বিতীয় বিয়ের কথা মনে পড়লেই মনটা গ্লানিতে, লজ্জায়, ছোট হয়ে যেত। যেন দোষটা আমারই। যেন এ লজ্জার কুলান হয় না পৃথিবীতে। যেন আমার মা যদি মরে যেতেন তাহলে খুব ভালো থাকতাম আমি। ছাব্বিশ বছর দেখা হয় না, মরে যাওয়াই তো। নিশাতকে বলেছিলাম, আমার মা-ও মারা গেছেন ছোটবেলায়। আমি তখন অনেক ছোট। কিসসু মনে নেই।

অনেকদিন ভেবেছি, এ রকম তো কত হচ্ছে। কাঁচা বয়সে বিধবা হয়েছিলেন, মামারা ছিলেন না কেউ; থাকলেও কিছু হতো না, কারণ শুনেছি নানা ছিলেন বড় গরিব; আবার বিয়ে ছাড়া উপায়ই বা কী? চাচারা কেন মাকে রাখেননি, কোনদিন জানতে পারিনি। হয়ত তারা পছন্দ করেননি মাকে, বোঝা বইতে চাননি। অনেকবার মনে মনে রাগ করতে চেয়েছি চাচাদের ওপর, পারিনি; কেমন নির্জীব একটা মায়া হয়েছে বরং।

মা-র দ্বিতীয় স্বামী আমাকে একেবারে কাছে ঘেঁষতে দেননি। বিয়ের পর সেই যে গেছেন, আর কোনদিন আসেনওনি মা আমাকে দেখতে। এখন বুঝতে পারি, ছোটবেলায় সে অভিমানটা কত ছেলেমানুষের মতো করেছি; দ্বিতীয় স্বামীর ঘর থেকে প্রথম স্বামীর পুরনো সংসারে কেউ আসে না–থাক না যতই মায়ার টান–এই সাধারণ কথাটা তখন বুঝিনি। আর মা–র কথা মনেই নেই যে মনে করে কোনো কিনারা হবে। কেবল একটা অবোধ আকুতির মতো, কিছুতেই মনে না পড়া স্বপ্নের মতো, অস্পষ্ট কম্পিত বহু দূরের অনুভূতির মতো মা–র অস্তিত্ব টের পেতাম। এই পৃথিবীর কোনখানে তিনি আছেন। একেক সময় স্পষ্ট দেখতে পেতাম যেন, গ্রামের মধ্যে টিনের বাড়ি একটা, সামনে আঙ্গিনা, আঙ্গিনায় হলুদ খড় শুকোতে দেয়া হয়েছে, কামলা বসে হুঁকো খাচ্ছে, গরু–ছাগল মাটিতে মুখ রেখে ঘুরছে আর চড়া রোদ উঠেছে আকাশ পুড়িয়ে–চারদিক খা খা করছে। তার মধ্যে মা কাজ করছেন। আমার কল্পনায় তাকে দেখতে পেতাম, ট্রেন থেকে গ্রামের একেকটা আঙ্গিনায় হঠাৎ হঠাৎ যেমন নীল তাঁতের ময়লা শাড়ি পরে, মাথায় কাপড় তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে, কী উপুড় হয়ে কাজ করতে, বা গাড়ির শব্দে মুখ ফেরাতে বৌ-ঝিদের দেখা যায়। তাদের আলাদা করে মনে থাকে না, সব মুখ এক হয়ে যায়–সেই কালো শ্যামল রং, দুঃখী, নির্বাক। দেখতে পেতাম, যেন তার চারদিকে কালো কালো ন্যাংটো কী ছেঁড়া প্যান্ট পরা, ধুলো মাখা, নাকের সর্দি গালে চট চট করতে থাকা অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে। তাদের পেট ফুলে উঠেছে, হাতে একটা আম, ভন ভন করছে মাছি– চকচকে চঞ্চল চোখে তারা আমাকে দেখছে।

বাতিটা আর জ্বালানো হলো না। সিগারেট খেতে চেয়েছিলাম। থাকগে। সিগারেটের দাম আবার বাড়িয়ে দিয়েছে। ট্যাক্স, ট্যাক্স আর ট্যাক্স। এক বছরে কটা ক্যাবিনেট ভাঙলো আর হলো? একটা স্টেবল গভর্ণমেন্ট চাই। আমার কিসসু হবে না। একটা লাইন করতে পারতাম, একটা যোগাযোগ থাকতো কোথাও এক মাসে আমারও বাড়ি হতো ধানমণ্ডিতে, গাড়ি হতো, টাকা আসতো বন্যার মতো। ঐ বাড়িগুলোতে কারা থাকে? অমন সুন্দর বাড়ি। আমার বাবা যদি মিনিস্টার হতেন, বেশ হতো। উঠে বসে আবার খুঁজতে হলো সিগারেট। ধরাবার পর মনে পড়ল, একটু আগেই খাবো না ভাবছিলাম। আজ আমার কোনো কিছুই মনে থাকছে না।

জানালার পাট খুলে দিতেই ঝলক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে এসে পড়ল। বেশ লাগছে শীতটা। নিশাতের কথা ভাবছিলাম। নিশাতকে সুন্দর দেখতে পাচ্ছি, যেন বাতি জ্বালিয়ে ফটোগ্রাফ দেখা হচ্ছে। আর মা–কে।

একেকদিন হুহু করত মনটা–খুব যখন আনন্দ হতো, তখন। তখন সব আনন্দকে ব্যথায় মুচড়ে দিত মায়ের স্মৃতিটা। চমকে উঠতাম তখন। মনে হতো, আমার কথা শুনে মা খুব খুশি হতেন। ম্যাট্রিক যেবার পাশ করলাম, এত খারাপ লাগল। একটা গরম কোট ভালো ফিট করেছিল আর মানিয়েছিল চমৎকার হলে থাকতাম তখন–তীরের মতো মা–র কথা মনে পড়ল। আরেকদিন স্টেশনে একটা পরিবারকে আপার ক্লাশ ওয়েটিং রুমে ঢুকতে দেখলাম বাচ্চাগুলো এত সুন্দর আর চঞ্চল আর লাফাচ্ছিল—-আমার মুখটা হাসিতে ভরে গেল, তখন মনটা খুব খারাপ করল হঠাৎ।

আশ্চর্য! কতবার আমার জ্বর হয়েছে, কই মাকে একটুও মনে পড়েনি। আমার রুমমেট একটু অসুখ হলেই খালি বাড়ি যেতে চাইতো মাকে দেখতে। এম.এ. পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলো, তখনো না। আশ্চর্য নয়? দুঃখের সঙ্গে কোনো যোগ নেই আমার মা–র। অথচ মাকে যখনি মনে হয়েছে, যেন চোখে দেখতে পেয়েছি দুঃখী, মলিন এক মহিলা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

ঘুম থেকে উঠে দেখি বেলা আটটা বেজেছে। খচ খচ করছে দুচোখ এখনো। মনে হচ্ছে, আরো খানিকটা ঘুমোলে ভালো লাগত। কিন্তু নটার মধ্যে না পৌঁছুলে কাজি সাহেব রাগ করবেন। বলবেন, আমি কটায় উঠি জানো? পাঁচটা। পাঁচটায় তোমাদের মাঝরাত হয়।

রুমির কথা মনে পড়ল অহেতুক। আর তক্ষুণি মনে হলো, কাজি সাহেবকে দিয়ে নিশাতের ভাইজানের কাছে প্রস্তাব পাঠাবার কথা ভাবছিলাম। সেটা খুব সহজ হবে না। খুব অস্বস্তি লাগল। জালালকে পাঠাব? মন্দ হয় না। কিন্তু কাজি সাহেব তো আজ হোক কাল হোক জানতে পারবেনই। রুমির জন্যে কাল্পনিক ভয়টাকে প্রশ্রয় দেবার কোনো মানেই হয় না। আমি একেক সময় এমনসব কাণ্ড করতে পারি। কাজি সাহেবকেই বলব। বরং তাকে পাঠানোই সবদিক দিয়ে সুন্দর হবে। আমার সিনিয়র, নাম আছে, গাড়ি আছে। বিয়ের প্রস্তাব, একটু আভিজাত্য হলে চমকার মানায়।

 আজ নিশাতকে কলেজে টেলিফোন করে বলতে হবে। ভাবতে ভাবতে খুব হালকা লাগল ভেতরটা। নিশাতের সারারাত কেমন করে কেটেছে সেইটে কল্পনা করতে ডুবে গেল আমার মন। টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগালাম, ঠাণ্ডা পানিতে আমার চোখ থেকে ঘুম ধুয়ে গেল, জালালের ছেলেমেয়েরা পড়তে না বসার দরুণ বকা খাচ্ছে, জালাল আমার হাতে খবর কাগজের ভেতর শীটটা দিল, চায়ে একটা পাত ভাসছে, সেটাকে চামচে কিছুতেই তুলতে পারছি না– সারাক্ষণ নিশাতের কথা মনে পড়তে লাগল। কাল এলোমেলো কী সব স্বপ্ন দেখেছি যেন একটা জায়গায় অনেকগুলো বেলুন উড়ছিল, তারপর আর মনে নেই। আবার দেখলাম সিনেমা শুরু হয়ে গেছে, আমি তবু বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, কেন যেন ঢুকতে পারছি না, অথচ খারাপ লাগছে না একটুও, আমার যেন কোনো উদ্বেগই নেই। তারপর কী হলো জানি না। দেখলাম একটা গাড়ি মাঠের ভেতর দিয়ে খেলনা ট্রেনের মতো যাচ্ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই, হুইসেল নেই, একজন প্যাসেঞ্জারও নেই–সবগুলো কামরা খালি।

জালাল জিগ্যেস করল, কাল তোমার পকেট কাটা গেছে শুনলাম।

আমি বললাম, সে এককাণ্ড শোনো, দাঁড়িয়েছি জিন্নাহ এভেনুতে… উৎসাহের সঙ্গে তাকে সবটা কাহিনী শোনালাম।

সে শুনে খেদোক্তি করল, তোমার মতো গাধা তো একটা দেখিনি। এত টাকা নিয়ে ভিড়ের মধ্যে যেতে আছে?

তখন বললাম, আরে শোন। তোমাদের বলাই হয়নি, আমি বিয়ে করছি।

কাকে? একসঙ্গে জালাল আর তার স্ত্রী জিগ্যেস করল, হঠাৎ খুশিতে লাফিয়ে ওঠা গলায়।

আবার কাকে? নিশাত।

আরে–আরে… ওরা কী বলবে বুঝতেই পারল না। এ ওর মুখ চাওয়া–চাওয়ি করতে লাগল। তারপর একসঙ্গে হেসে উঠল খামোকা।

বললাম, আর আমি কাল পরশু একটু দেশে যাচ্ছি। চাচাদের বলতে হবে না? অনেকদিন তো যাইনি, দেখিনি।

জালালের স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, যাওয়া উচিত। বিয়ের ব্যাপার, তারাই তো আগে জানবেন, আসবেন। কী বল? যেন এটা একটা মতামতের অপেক্ষা রাখে এমনি চোখে তিনি তাকালেন স্বামীর দিকে।

আমি হেসে বললাম, এতদিনে মনটা বেঁধেই ফেললাম। অনেক হলো! আর কত?

নাশতা শেষে ঘরে এসে একা দাঁড়াতেই বুকটা ভার হয়ে গেল আমার। মুখ ফিরিয়ে চোর চোখে দেখলাম বাইরে বারান্দায়। না, দেখা যাচ্ছে না কাউকে। ওদের কাছে তো আমি বলতে পারি না। আসলে আমি যাচ্ছি আমার মাকে দেখতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *