১. আমাকে আবার ফিরে আসতে হলো

জনক ও কালোকফি – সৈয়দ শামসুল হক

আমাকে আবার ফিরে আসতে হলো। নিশাতের সঙ্গে আমার কখনো যদি দেখা না হতো তাহলে আসতাম না। নিশাত না হয়ে অন্য কেউ হলে কী হতো জানিনে। নিশাত এতদিন আমার কাছে কাছে, ওকে ছাড়া এই যে আমি আর কিছু ভাবতে পারিনে, এই যে আমার সব কাজ, সব ভবিষ্যতের মধ্যে কেবল নিশাতের মুখ দেখতে পাই– তবু এতদিন এখানে ফিরে আসার কথা মনে আসেনি। আজ আসতে হলো।

মা’র কাছে আমি ছাব্বিশ বছর পরে ফিরে আসছি। নিশাত বলেছে, আমার বউ হতে ওর কোনো আপত্তি নেই।

বউ? আমার বউ? চব্বিশ ঘণ্টা আমার শয়নে জাগরণে তন্দ্রায় কি স্বপ্নে একটা মেয়ে থাকবে। যেখানেই যাই না কেন, ফিরে এলে ঘরে দেখব একটি মুখ, হাসিতে খুশিতে ভরা; খামের মধ্যে উঁকি দেয়া চিঠির মতো উৎসুক একটি মেয়ে। তাকে সকালে দেখব সবুজ পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে দাতে ঘষে ঘষে ফেনা তুলে দাঁত মাজছে; দেখব ভিজে চুলে একাকার হয়ে এক পায়ে স্যাণ্ডেলে গলাতে গলাতে বেরিয়ে আসছে বাথরুম থেকে; দেখব অবেলা দুপুরে ঘুমে লালায় ভিজিয়ে তুলেছে বালিশের কোণ –চকচক করছে ঠোঁট– গালে ভাঁজ পড়েছে লাল ফিতের মতো–মুখ দেখাচ্ছে নতুন তুলোয় তৈরি যেন; দেখব খাটের কোণে পা ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে সে খুন হয়ে যাচ্ছে; দেখব রাতের অন্ধকারকে খুব ভয় করে আমার মুখের পরে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বলছে–এই ওঠো না, আমি একটু বাইরে বেরুবো। বউ? আমার বউ? নিশাত আমার বউ হয়ে আসবে, আসতে পারে যদি আমি তুলে নিই, বলেছে। যেন একটা সরোদ হঠাৎ সোনার কমলের মতো বিরাট এক ফুল তৈরি করতে লাগল আমার বুকের মধ্যে, চোখের পরে, যখন কথাটা শুনলাম। আমরা, আমি আর নিশাত, তখন স্কুটারে মোহাম্মদপুর থেকে শহরের দিকে আসছি। সন্ধ্যেটা কেবল হয়েছে, বাতিগুলো তখনো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না, ছেলেমেয়েরা তখনো রাস্তায়। আর একটা লাল মেঘ নতুন শালের মতো ঝকঝক করছে পশ্চিম আকাশে।

নিশাত থাকে মোহাম্মদপুরে। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখা হতো বড় মজা করে। বড় রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা সরু একটা গলি চলে গেছে কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে ডানদিকে, মাঠের সঙ্গে মিশেছে। মাঠ পেরিয়ে বর্ষার পানি ভরা ডোবা। সে ডোবার পাড় দিয়ে ভিজে এঁটেল মাটি পেরিয়ে বাঁদিকে বেড়ায় ঢাকা টিনের ছোট্ট একটা বাড়ি। নিশাতদের। ওর ভাইজান ৫০ সালের রায়টের পর কলকাতা থেকে এসে কিনেছিল। ওর ভাবীর ছোট্ট ছেলে থোকনটাকে সারাদিন চোখে চোখে রাখতে হয়, কখন পানিতে পড়ে; পানির দিকে ওর এত লোভ, ছাড়া পেলেই টলমল করতে করতে ডোবার পানিতে গিয়ে মুখ দেখাবার চেষ্টা করবে। সেবার ওপাশের রায়হানরা দেখেছিল, নইলে ঠিক মরতো। আরেকবার নিশাতের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুপুরে। নিশাতও। কখন যে উঠে গেছে জানে না। ভাবী খুব বকেছিলেন নিশাতকে। কাঁধের ব্যাগটা ঘোরাতে ঘোরাতে নিশাত আমাকে বলেছিল, বাবারে বাবা এত দুষ্টু। আমার নিজের ছেলে হলে মার খেয়ে মানুষ হতো। নিশাতের মুখে নিজের ছেলে শুনে অবধি ধুক করে উঠেছিল আমার ভেতরটা। তখনো নিশাতকে বলিনি, ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। মেয়েদের সম্পর্কে গল্প–উপন্যাস–সিনেমা থেকে আর বন্ধুবান্ধবের কাছে মেলারকম শুনে শুনে একত্রিশ বছর বয়স করেছি। শুনেছি, ওরা নাকি বড় চাপা, মুখে কিছু বলবে না, যদি বলে তো আকারে বলবে, ইঙ্গিতে বলবে, নীরব চোখে নাচন তুলে জানাবে, কথায় কখনো না।

খুব স্পষ্ট মনে আছে আমার, সেদিন নিশাতের মুখে নিজের ছেলে কথাটা আমাকে বেশ চঞ্চল করে তুলেছিল। তারপর নিশাত যে সারক্ষণ বকবক করে কী বলেছিল কিসসু আমার মাথায় যাচ্ছিল না। আমার চোখের ভেতরে আমি যে সমস্ত জিনিস ভালোবাসি, যেমন নতুন চাদর, লাল ফুল, সিনেমার বড় বড় পোস্টার, স্টেডিয়ামের মোড়, নিশাত– এই জিনিসগুলো অর্থহীন কারণহীন একটা নাচ করছিল। ঘুরে ঘুরে, একটার গায়ে আরেকটা গড়িয়ে পড়ে আমাকে তন্ময় করে রাখছিল। আর কার যেন সুন্দর গানের মতো একটা তান শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই তানের ভেতর থেকে পাড়ের বুনোনের মতো একটা ছলোছলো আবছা হাসি শুধু। আর কিছু না। হঠাৎ চোখ তুলে দেখি বড় রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা গলির মুখে কাঁঠাল গাছের নিচে আমি একা দাঁড়িয়ে। আর নিশাত চলে যাচ্ছে। তার পেছনটা শাড়ির ফুলে ফুলে আচ্ছন্ন, একটা অতিকায় ফুলদানির মতো দেখাচ্ছে। তখন মনে পড়ল, একটু আগেই তো নিশাত বলল, আমি যাচ্ছি আর আমি বললাম, আচ্ছা।

যে কথা বলছিলাম। নিশাতের সঙ্গে আমার দেখা হতো বড় মজার। গলিটার মুখে একটা নতুন ওঠা দোতলা বাড়ি, তার সামনের জমিতে টিনের একটা শেভ তুলে দিয়েছে বাড়িওলা। শেডের মধ্যে তিনটে দোকান। একটা লন্ড্রী। একটা মুদিখানা। আর এপাশে চায়ের দোকান। চায়ের ওখানে আমি এসে বসি বাস থেকে নেমে। একা যখন আসি তখন বাসে। নিশাতের সঙ্গে বেরুতে হলে স্কুটার। স্কুটারে চাপতে আমার খুব ভালো লাগে। হেলান দিয়ে বসে, একটা হাত সিটের মাথায় বিছিয়ে, ঝরঝর ভটভট করতে করতে পীচঢালা রাস্তা দিয়ে দালান ইস্কুল পেট্রলপাম্প সায়েন্স ল্যাবরেটরী পেছনে ফেলে নিউ মার্কেটের মোড়ে শোঁ-ও করে বাঁক নিয়ে চলতে আমার ভারী আনন্দ। নিশাতের আগে মাথা ধরে যেতো স্কুটারের ঐ কটকটানিতে। আজকাল কিছু বলে না। মেয়েরা নাকি যাকে ভালোবাসে তার অপছন্দটাকেও পছন্দ করে নেয়। আমার এটা ভালোই লাগে যে নিশাত আমার স্কুটার চাপার আনন্দটাকে নিজের কষ্ট তুচ্ছ করে বড় করে দেখছে। এতে হাতেনাতে একটা প্রমাণ পেয়ে যাওয়ার তৃপ্তি হয় আমার যে নিশাত আমাকে ভালোবাসে।

সেই চা-দোকানে বসে থাকব। বসে বসে এক কাপ চা আর অনেকগুলো সিগারেট খাবো। এইসব সাংঘাতিক মিষ্টি আর কাঁচা দুধের সন্ধ ধরা চা খেতে একটুও ভালো না, তবু। দেয়ালে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার। কোনটাতে সিনেমা স্টারদের ছবি, কোণে সাবানের নক্সা, আবার কোনটাতে ঝিল পাহাড় কী নদীতে পাল তোলা নৌকার রঙ্গিন সিনারি। দোকানে টেবিলের ঢাকনা থেকে দুপুরে খেয়ে যাওয়া মাছ তরকারির আঁশটে ভিজে ভিজে গন্ধ দেবে। পেছন থেকে অবিরাম গ্লাশ বাসন কাপ ধোয়ার টুংটাং ছলছলাৎ শব্দ আসবে। বিকেলটা নামতে থাকবে থিয়েটারের স্ক্রীনের মতো দুলতে দুলতে। ইট বোঝাই একটা দুটো ট্রাক এসে দাঁড়াবে। মাল খালাশের হুল্লোড় শোনা যাবে সারাক্ষণ। তারপর দোকানের রেডিওটা খুলবে ওরা। পাঁচটা বাজেনি। এক মিনিট কী দুমিনিট বাকি। রেডিও থেকে একটানা সিগনেচার টিউন আকাশ বাতাস জুড়ে বড় বড় আঁচড় টানছে যেন। হঠাৎ সেটা থেমে যাবে। ঢং ঢং করে বাজবে ঘণ্টা। শোনা যাবে অনুষ্ঠান আরম্ভের ঘোষণা। আর তক্ষুণি দেখতে পাবো নিশাত গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা দিয়ে খুব আনমনা হাঁটছে। তার কাঁধের ওপর বড় খোঁপা থেকে কী একটা শাদার ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে; হেয়ার পিনের রূপোলি তীরটা, নয়ত জরির শাদা রিবন। তখন আমি উঠে দাঁড়াবো। হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখব নিশাত ইস্কুলের কাছে চলে গেছে, তখন কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। দেখেই নিশাত হাসবে। বলবে, কতক্ষণ? বলবো, এইতো, এইমাত্র।

নিশাত কলেজে পড়ায়। বলে, আমি একটা লেকচারার। রাস্তার মোড়ে দোকানগুলোতে কী সব আড্ডা। দুজনকে দেখলে খামোকা হি-হি করবে। তাই বেশ খানিকটা দূরে না গেলে দেখা হয় না। আমার অবশ্যি এসব বালাই নেই। এক এ্যাডভোকেটের জুনিয়র আমি; মককেলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবার সময় আসেনি। তাছাড়া, রাস্তায় কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখবে আমার মকেল, দেখুক–পুরুষদের ব্যাপারে সুবিধে অনেক, বদনাম কম। ও নিয়ে মাথা ঘামাইনে। নিশাতের দিকটা ভাবতে হয়। বাড়িতে যেতে পারি, যেতে দেবে না ও। বলবে, ভাইজান আমাকে খুব ভালোবাসে। কিছু বলবে না তোমাকে। তবু যাবে কেন? এটাও আমি বুঝতে পারি। লজ্জার অবকাশ রাখতে চায় নিশাত, ভয় নেই তবু ভয়কে কল্পনা করতে চায় মেয়েটা। ভাবতে চায়, তার ভালোবাসায় বাধা অনেক, বিপদ বহু। লেখাপড়া শিখেছে, চাকরি করছে, সংসারের একমাত্র মাথা বড় ভাই প্রশ্রয়ে আদরে বোনকে গড়ে তুলেছেন–তবু, তবু নিশাত তার হৃদয়ের ব্যাপারে যেন কল্পনা করে নিজেকে সেই মেয়েটির মতো যাকে থাকতে হয় চার দেয়ালের মধ্যে, বেরুতে হয় লুকিয়ে, কথা বলতে হয় ফিসফিসিয়ে। বেড়ালের পায়ের শব্দে শাদা হয়ে যেতে হয় ভয়ে। আমি এটা প্রথমে বুঝিনি, বুঝেছি অনেক পরে। কিন্তু নিশাতকে বলিনি। আমার ভাবতে ভালো লাগে, নিশাতের একটা কথা জানি যা নিশাত জানে না আমি জানি। ভারী একটা বোকা ছেলেমানুষের মতো লাগে তখন নিশাতকে। যেন খেলনা–টেলনা কিনে দেয়া যাবে টানতে টানতে মেলায় নিয়ে গিয়ে।

কদিন আগে আমার সিনিয়র কাজি সাহেব একটা খুনের কেসের আসামিকে বেকসুর খালাস করিয়ে দিলেন। জুনিয়র ছিলাম আমি আর শরিফ। দুজনে কিছু মোটা টাকা পাওয়া গেল। সিনিয়র আমার কাজের খুব প্রশংসা করলেন বাসায় একা ডেকে। তাঁর ছোট শালী রুমি থাকত এ বাড়িতে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে এবার। রুমি চিড়ে ভাজা আর চা এনে রাখলো। আড়চোখে তাকাল একবার আমার দিকে। চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠলো হাসি! ছুট দিল ভেতরে।

মেয়েটা কালো, নাকটা কেমন ছড়ানো, পাতলা ঠোঁট, শরীরটা ছিপছিপে, ভালো করে কাপড় পড়তে জানে না, রংও চেনেনা। সবুজ শাড়ি পরেছে। ভারী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। কিন্তু খুব চঞ্চল। ঐ চঞ্চলতাটুকুর জন্যে একেক সময় আমার ভালো লাগে। কোন কোন দিন একটু দেখতেও ইচ্ছে করে এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আর মনে থাকে না। আবার একেকদিন আমার সিনিয়রের পুরনো ফোর্ডে চেপে কোর্টে যাবার পথে রুমি এসে সামনে বসে। সে কলেজে যাবে। সারাক্ষণ তার ভিজে ভিজে বেণি দুটো বড়ড ভারী আর নির্জীব দেখাবে, তেলে মলিন লাল ফিতেটা থেকে কী কোথা থেকে একটা জ্বালা ধরানো গন্ধ বেরুবে। মেয়েটা আমার সিনিয়রের লায়াবিলিটি। শ্বশুর মারা যাবার সময় জামাইর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে শরিফ বলছিল। শরিফকে বলেছিলাম, তুমি বিয়ে করো। উন্নতি চড় চড় করে হবে। ভদ্রলোকও বাঁচবেন। তোমার নতুন করে এস্টাবলিশমেন্টের খরচ আর লাগবে। শুনে শরিফ নাক সিটকে ওয়াক করে নাটকীয় ভঙ্গিতে থুতু ফেলে বলেছে, তোবা তোবা। তুমি থাকতে আমি? ময়ূর থাকতে দাঁড়কাক?

ব্যঙ্গচ্ছলে শরিফ নিজেকে দাঁড়কাক আর আমাকে ময়ূর বলেছে। উপমাটা বেজেছে কিন্তু আমার অন্যখানে গিয়ে। রুমি আর নিশাত। নিশাত আমার ময়ূর।

এটা একটা মুশকিল হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে টের পাই, কোনো কারণ নয় এমনিতেই যেন বুঝতে পারি, আমাকে নিয়ে কথা হয়। মনে হয়, কাজি সাহেব আমার চারদিক থেকে জাল এমনভাবে গুটিয়ে আনছেন যেন একদিন সঙ্কুচিত হতে হতে হঠাৎ দেখতে পাবো আমি রুমির বাহুবন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছি। একেকদিন খুব অস্বস্তি করে যখন ভাবনাটা হয়ে ওঠে। প্রবল। চেম্বারে বসে ঘামতে থাকি। বেরুতে পারলে যেন বাঁচি।

আবার নিঃশ্বাস ফেলি মুক্তির। কারণ, তখন হঠাৎ সব তুচ্ছ হয়ে যায়। হাসি পায়। ভাবি, আমি ব্যাচেলের বলেই আমার ম্যানিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে–কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত লোককে সন্দেহ করা। আর এ–ও বোঝাই নিজেকে তুমি তো বেশ লোক হে? কাজি সাহেব বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তুমি যদি না করো তো সাধ্য কী তোমাকে রাজি করায়। এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করবার, ভয় পাবার কী আছে?

কিন্তু ভয় হতো। ভয় হতো, যখন কোনো কোনো রাতে, ফাঁকা চেম্বারে আমি আর কাজি সাহেব বসে থাকতাম আর উনি অহেতুক প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন পরিবারে; বড় ছেলেটার যে ফেল করে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছোট মেয়েটা যে এবার নাচের স্কুলে ভর্তি হবে বলে বায়না ধরেছে, স্ত্রীর অসুখ লেগেই আছে, তিনি আর কত দিন বাঁচবেন, দীর্ঘনিঃশ্বাস, শ্যালকেরা কেউ মানুষ হলো না, প্রতিবেশীর সঙ্গে পেছনের জমির মালিকানা নিয়ে মামলা এবং রুমিটা বড় হচ্ছে–এইসব শুনতে শুনতে আমার ভয় করত। আমি হাঁ–নার বেশি কিছু বলতে পারতাম না। আমার তখন উঠে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু ওঠবার আগেই, দৈবেরই কী ইচ্ছা আমাকে হেনস্তা করবার, দেখতাম রুমি এসে দাঁড়িয়েছে; বলছে–আপা রাতে আপনাকে খেয়ে যেতে বলেছে, আমার তখন হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার যোগাড়। যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পাই চারদিকে, সব কিছুতে। রুমির এই হঠাৎ আসাটাকে কাজি সাহেবের সুচিন্তিত একটা চাল মনে করে শিউরে উঠি।

গোড়ার দিকে বুঝতেই পারতাম না, এত ভয় কিসের? রুমি কালো বলে? কুৎসিৎ? না, সে রুচিতে শ্রীমতি নয় বলে? আচ্ছা যদি রুমি দেখতে খুব ভালো হতো? ফর্সা হতো? নিশাতের মতো। তাহলে?

নিশাতকে বলতে পারতাম না। মেয়েরা এ ধরনের কথা শুনতে আদৌ পছন্দ করে না, তারা খেপে যায়–এ রকম একটা ধারণা আমার আছে। হোক রুমি কালো, দেখতে ভালো না, চাই কি নিশাত একটা ফালতু ঝামেলা করে বতে পারে। তাছাড়া বলব কী, নিশাতের কাছে যতক্ষণ থাকি বিশ্বসংসারের আর কারো কথা মনে পড়ে না আমার। রুমিকে নিয়ে দুর্ভাবনার সীমা ঐ চেম্বার পর্যন্তই। আর কখনো কখনো যখন গাড়িতে ওর সহযাত্রী আমাকে হতে হয়। পরে একদিন আবিষ্কার করেছি ভয়ের কারণটা। চিন্তা করে নয় ভাবনা করে নয়, কিছু না। একটা রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাচ্ছি–কালো, দুধ ছাড়া কোন একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম কে যেন কালো কফি খেতে ভালবাসত সেই থেকে অভ্যেসটা। নাকে এসে লাগছিল রকফির ঝাঁঝালো মিষ্টি ঘ্রাণ আর ধোঁয়ায় বারবার মেঘলা হয়ে যাচ্ছিল আমার চশমার কাঁচ, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললাম কারণটা।

ভয় আমার জীবিকার উপার্জনের, প্রতিষ্ঠার। কাজি সাহেব যদি বলেন আর আমি রুমিকে বিয়ে না করি, তাহলে আমাকে তার চেম্বার ছেড়ে দিতে হবে– এইটেই আমার অজ্ঞাতে জন্ম দিয়েছে ঐ ভয়টার। কাজি সাহেবের মতো খ্যাতনামা, প্রতিপত্তিসম্পন্ন এ্যাডভোকেটের জুনিয়র হতে পারাটা ভাগ্যের কথা; পশার তার অমিত সম্ভাবনায় ভরা। সেই কাজি সাহেব যদি আমাকে খারিজ করে দেন তো আমাকে পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। আবার সেই সংগ্রাম। মাসে যে আজ আমার শচার পাঁচেক আসছে– এর ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ আমার সব স্বপ্নের মৃত্যু।

আমি তো জানি কী ভীষণ এই একাকীত্ব, এই টাকা না থাকাটা, এই লড়াই।

ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর, আমার তখন চার বছর বয়স শুনেছি, মার আবার বিয়ে হলো। আমাকে রেখে গেলেন চাচাদের হাতে। তার নতুন স্বামীকে দেখিনি কখনো। মা কেও তারপর থেকে আর কোনদিন না। চাচাদের কাছে ভয়ঙ্কর বর্ণনা শুনতাম। লোকটা খুব চাষা, চোয়াড়ে আর বিস্তর টাকা তার। মামারা কেউ ছিলেন না, মামা–বাড়ির অবস্থা ছিল খুব খারাপ। মা–কে তাই আবার নতুন ঘর করতে যেতে হয়েছিল। আমার এসব কিস্‌সু মনে নেই। কেবল একটা ছবি মনে আছে, আমাকে কোলে করে দলা করে ভাত পাকিয়ে ছড়া বলতে বলতে মা খাইয়ে দিচ্ছেন। চেহারাটা মনে নেই। ঘরে একটা ডিবে জ্বলছে। খুব ধোঁয়া হয়েছে। আর একটা ছবি, গোরস্তানে বাবাকে ওরা কবর দিতে নিয়ে গেছে। আমিও গেছি। আমি আমার সমান কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দূরে একটা ভাঙা কবর থেকে ছাতার গোড়া দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলছি একটা মড়ার খুলি আর খুব মজা পাচ্ছি। খুব রোদ বলে আমাকে ছাতাটা দিয়েছিল। খুলিটাকে গড়াতে গড়াতে নিয়ে যাচ্ছি বালু–বালু মাটির ওপর দিয়ে, থানকুনি পাতার ভেতর দিয়ে, কারা যেন গাদা ফুলের গাছ লাগিয়েছে তার দিকে। মেলা ফুল ফুটেছে হলুদ হলুদ। ছাতাটাকে আমি কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। এমন সময় কে একজন এসে বলল, গ্যাদা, শীগগীর আসো। তোমার বাপেরে না মাটি দিতাছে, দেখবা না? ব্যাস এইটুকু। আর কিছু মনে নেই। আমি গিয়েছিলাম কী গিয়েছিলাম না, দেখেছিলাম কী দেখেছিলাম না কতদিন ভাবতে চেষ্টা করেছি একেবারে শাদা, কুয়াশার মতো। কিছু মনে পড়ে না।

 চাচারা খুব কালো মুখ করে দেখতেন আমাকে। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই জানতাম, যাদের বাবা নেই তাদের কেউ নেই। ইস্কুলে আমাদের হেডমাস্টার ক্লাশের ছেলেদের বলতেন, ওর সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করো না যেন। ওর বাবা নেই! ওর কত দুঃখ। দুঃখের কথা শুনে খুব আবছা একটা গর্ব হতো তখন। আমি সবার থেকে আলাদা। ক্লাশে একদিন ইংরেজির স্যার অরফান শব্দের বাংলা বলতে গিয়ে উদাহরণ দিলেন আমাকে। ভারী ফুর্তি হলো আমার। এখন মনে পড়লে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আবার ভাবি, বেশ ছিলাম তখন। দুঃখকে দুঃখ মনে হতো না, আনন্দকে বুঝতে পারতাম না তখন। মানুষ বড় হলেও যদি এ রকম হতো তাহলে তাকে বুঝি সুখী বলতো সবাই। কিন্তু ওটাতো অবোধের কাল। এখন এই যে আমি বড় হয়েছি, দুঃখ হলে দুঃখটাকে একেবারে ভেতর থেকে নিংড়ে নিংড়ে বেরোতে দেখছি, এক ঝলক আলোর মতো আবার আনন্দে ভরে উঠছি আর সেই আনন্দটুকু স্মৃতির মধ্যে প্রদীপের মতো জ্বলছে, এই শক্তিটার নাম বোধ হয় জীবন।

চাচারা অনেক করেছেন। এম.এ. পরীক্ষায় যখন থার্ড ক্লাস পেলাম, বকলেন তারা। কী যে দুর্বুদ্ধি হয়েছিল, সিএসপি–র জন্য পরীক্ষা দিলাম। চাচারা খুব খুশি হলেন। বললেন, গ্যাদা হাকিম হলি পর বংশের একটা নাম থাকে। আল্লার উপর ঈমান রাখলি সব হয়। চাচারা আমাকে গ্যাদা গ্যাদা বলেই ডাকেন। আমার নাম যে মুশতাক সেটা মনে হয় ওঁরা জানেনও না। সিএসপি পরীক্ষাতে কিছু হলো না। রিটেনেই ফেল করলাম। চাচারা বললেন, আর পড়াতে পারবেন না। না বললেও আমি নিজেই আর ভার হয়ে থাকতাম না। তখন কিছু দিন বিরাট এক শূন্যতার ভেতর দিয়ে আমার জীবন কাটলো। চার বছর।

এই চারটে বছরের কোন স্মৃতিই আমার নেই। যেন এই চার বছররের এক হাজার চারশো ষাট দিন একরকম। সেই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, জুবিলি স্কুলে ইতিহাস পড়ানো সেভেন আর এইট ক্লাশে, তারপর বিকেল থেকে নিয়ে রাত এগারটা অবধি ফরাসগঞ্জে গোবিন্দর সরু তেল কালিতে আচ্ছন্ন, কয়লার ধোঁয়ায় হাঁসফাস রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দেয়া। শেষদিকে তো রেস্তোরাঁর পেছনে কয়লা আর কাঠ রাখবার শেডে বসে ফ্লাস খেলতে শুরু করেছিলাম। একট; পায়া–ভাঙা নড়বড়ে টেবিল ছিল, দুদিকে দুটো বেঞ্চ আর আধখানা, মানে পিঠ–ভাঙা, টিনের চেয়ার। রোজ সন্ধ্যেয় সেখানে ফ্লাস বসতো। কোনদিন হারতাম, কোনদিন জিততাম। আমার ভাগ্যে চূড়ান্ত কিছু লেখা ছিল না। অনেকে ছিল রোজ হারতো, আবার অনেকে জিতে যেত দিনের পর দিন। দেখতাম, কেবল আমিই আলাদা। গোবিন্দ যখন চপ দেয় তখন সঙ্গে একটা ছোট্ট ভিনিগারের শিশি আসে। সে শিশিটা কেউ খোলে না। বিস্বাদ নাকি। কিন্তু টেবিলে নিত্য আসা চাই। আমার অস্তিত্ত্ব ছিল ঐ ভিনিগারের শিশিটার মতো!

তখন নিশাতের সঙ্গে আমার দেখা।

তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগেও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, আমার সমস্ত শক্তি গতরাতে কে যেন নিঃশেষে বার করে নিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা সুন্দর একটা বাতাস বারে বারে সে আমার মুখ ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একবার খুব দাপাদাপি করে বাতাসটা এলো। আর আমার তখন কান্না পেল। আমার এক বন্ধু বিয়ে করেছে, তার সঙ্গে থাকি। বাইরের ঘরটার আব্রু নেই। চাটা আসবে ঘর ঝাট দিতে। কাঁদতে লজ্জা করল আমার। যদি নিজের বাসা থাকতো–বাসা করবার মতো যদি কিছু করতাম আমি।

ছেলেবেলায় পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলে রাতে শুয়ে শুয়ে ঘুম আসত না একেকবার। প্রতিজ্ঞা করতাম, সামনের বছর ফার্স্ট হবই হব, যেমন ওরা সবাই হয়। ঠিক সেই রকম করে উঠল বুকের ভেতরটা। নিশাতকে গিয়ে বললাম, আমি ল পড়ব।

নিশাত একেবারে আকাশ থেকে পড়ার মতো চেহারা বানিয়ে মুখ গোল করে প্রতিধ্বনি করল, ল?

সেই থেকে শুরু হলো আমার নতুন করে চলা। একেবারে সব ভুলতে শুরু করলাম। অতীতের সবকিছু। কী করে, কিছু বলতে পারব না। দেশের কথা আর মনে পড়ে না, চাচাদেরও না। সেই মেজো চাচির কথা, যার সঙ্গে রাতে ঘুমোতাম, তাকেও না। যেন ওসব অন্য কারো জীবনের গল্প। যেন আমি জন্ম থেকে এখানে এমন করে রাতে রাতে ল পড়ছি, কখনো দেখা হচ্ছে নিশাতের সঙ্গে, হাঁটছি স্টেডিয়ামের মোড়ে, আমার বন্ধু-স্ত্রী বাচ্চা হবে বলে হাসপাতালে গেছে– দুবন্ধুতে হাত পুড়িয়ে রান্না করছি, সিনেমার পোস্টারে অতিকায় মুখগুলো থমকে দাঁড়িয়ে দেখছি।

আশ্চর্য, চাচারাও ভুলে গেলেন আমাকে। হাকিম হয়ে বংশের নাম পেটাতে পারলাম না। বোধহয় সেই দুঃখে। কখন যে আমার জীবনের সব কটা নোঙর আস্তে আস্তে খসে পড়ল তার এতটুকু বুঝতে পারিনি। নিঃশব্দে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেল, কেউ জানতে পারল না। তাকিয়ে দেখি, নতুন নোঙর কখন আমি ফেলে বসে আছি; কখন সেই বাঁধনে স্থির হয়ে বড় বড় ঢেউগুলোকে অনায়াসে কাটাতে পারছি; আমার জীবন বড় সুমিত হয়ে গেছে; অনেক কাদা ভোবা খানা খন্দ পেরিয়ে সাজানো গোছানো ছবির মতো বড়

বাড়ির নিরিবিলি বাগানে গিয়ে দাঁড়ালে যেমন হয় তেমনি। নিশাত। ভারী সুন্দর নামটা। ওর চেহারার সঙ্গে, চলনের সঙ্গে, চিবুক তুলে কথা বলবার ধরনটার সঙ্গে নামটার কোথায় যেন মিল আছে। মিলটা যে কী, আর কোথায়, জিগ্যেস করলে তা বলা যাবে না– কেবল অনুভব করা যায়। একেকটা নাম, কী জানি কেন, উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার মতো কল্পনার ভেতর থেকে একটা মুখ ভেসে উঠতে থাকে। সেই মনে করা মুখটার সঙ্গে কখনো আসল মানুষটার আশ্চর্য মিল থাকে, কখনো থাকে না। নিশাতকে বলেছিলাম। শুনে অবধি ও এমন উচ্চকণ্ঠে হাসতে লাগল।

.

বলছিলাম না, নিশাতের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। মনটা ছিল অসম্ভব রকমে ভালো। খুনের মামলায় জিতে যাওয়ার দরুণ করকরে টাকাগুলো ছিল পকেটে। অক্টোবরের শীত–শীত দেখে আমার ফিকে সবুজ জাম্পারটা বার করে পরেছিলাম। রুমালটা পকেটে ঢোকাতে গিয়ে দেখি মলিন হয়ে আছে। জিন্নাহ এভেন্যুতে এসে একটা শাদা ফিনফিনে রুমাল ভারী পছন্দ হলো। দাম তিন টাকা বারো আনা। মসৃণ, ইস্ত্রী করা, হাতে রাখলে যেন পিছলে পড়ে যাবে। পকেটে সারাক্ষণ হাত ঢুকিয়ে অনুভব করতে লাগলাম রুমালটার স্পর্শ। নিশাত বোধহয় এতক্ষণ কলেজ থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে।

আজ আর চা-দোকানে বসতে ভালো লাগল না। সেই অল্প অল্প বাতাসে পাতা–পত্তর দুলতে থাকা কাঁঠাল গাছের গোল ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নিশাতের সঙ্গে দেখা হতো রোববার আর বুধবার। আজ বুধবার, নিশাতের কলেজ ছিল চারটে অবধি। সুরকির পরে আমার ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। জাম্পারটা থেকে ট্রাঙ্কের ঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে আমার। আর বুকের ভেতরটা উদ্বেগে অস্থির– যেন কী হয়, কী হয়।

বাঁক পেরিয়ে নিশাত বেরিয়ে এলো! থমকে দাঁড়াল আমাকে দেখে। যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তারপর মুখটা নিচু করে হাসি ফুটিয়ে কাছে এসে বলল, আজ এখানে যে। চা-দোকানটা বড় বাজে আর নোংরা।

এতদিনে বুঝলে?

বড় রাস্তায় আমরা পা রেখে বললাম, শোনো, আজ অনেক কটা কথা বলব।

আজ ভাবী তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছেন।

আজ আমাদের অনেক দেরি হবে।

বাড়িতে মেহমান আসবে। বলল নিশাত।

বাড়ির তো গিন্নি আছে।

মেলা কথাটা কী?

কিসসু না। এমনি। এই– এই বেবি। পাশ দিয়ে স্কুটার যাচ্ছিল, সেটাকে থামাবার জন্যে চিৎকার করলাম। কিন্তু থামল না। টুক করে বাতি জ্বলে উঠল রাস্তার। আমাদের চোখের সামনে যতদূর পথ বেঁকে গিয়েছে, একটা আলোর রেখা পোস্টের মাথায় মাথায় নাচতে লাগল। স্থির হলো।

বললাম, নিশাত, দ্যাখো, আজ আমার অনেক কথা আছে।

আহা, তাই তো জিগ্যেস করছি, কী কথা?

যেন আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না, নিশাত তাই আমাকে তিরস্কার করছে। বললাম, সেটা এভাবে বলা যায় না।

নাহ, একটা স্কুটারও পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুটারে চাপবার জন্যে উসখুস করছে মনটা, ভালো লাগছে না হাঁটতে কিন্তু হাঁটতে হচ্ছে। একবার দাঁড়ালাম আমি। দাঁড়াল না নিশাত। তখন আবার আমাকে হাঁটতে হলো। তখন আর নিশাতের দিকে দেখতে পারছি না, সামনে দেখছি আর বারবার পেছনে। বারবার উচ্চকিত হচ্ছি দূরের কোনো যানবাহনের শব্দে। একটা স্কুটারও কি আজ আসতে নেই এদিকে? পথে নিশাতের সঙ্গে এক মহিলার দেখা হলো। তিন বাচ্চা তার সঙ্গে। এক মুখ হাসি। চওড়া পাড় শাড়িটা সমস্ত শরীরে পল্লবিত অতএব আমাকে দূরে দাঁড়াতে হলো।

স্কুটারে উঠতে উঠতে নিশাত বলল, খামোকা দেরি হয়ে গেল। তারপর অন্যমনস্কভাবে জানাল, আজ কলেজে নতুন প্রিন্সিপাল এলেন।

আমি বললাম, আগে নিউমার্কেট, নিউমার্কেট থেকে–আচ্ছা, চলো দেখি, বলছি।

নিশাত কী যেন বলল, সেটা শুনতে পেলাম না। প্রচণ্ড আওয়াজ করছে স্কুটার। বোধহয় গিয়ার আটকে গেছে। হাতলটা ঘোরাচ্ছে খুব। আমি চেঁচিয়ে বললাম নিশাতকে, কিছু বলবে?

তখন নিশাতও গলা তুলে বলল, বলছিলাম–উহ্, কী শব্দ–নিউমার্কেট কেন?

এমনি। কোথাও তো যেতে হবে।

তবু ভালো। ভাবলাম, ওখানে বুঝি তোমার কথা কিনে আমাকে বলতে হবে।

আওয়াজটা সয়ে এসেছে। নিশাতের গলা তাই ঝন্‌ঝন্ করতে লাগল আমার কানে। বেসুরা ঠেকল। বললাম, ঠাণ্ডা পড়েছে।

তুমি তো জাম্পার চড়িয়েছে।

তুমি একটা কিছু গায়ে দিয়ে এলে পারতে।

হাসল নিশাত। বলল, মাফলারটা বাদ পড়ল কেন?

আমাদের কথাবার্তাই ঐ কম। একেকজন একেকটা বলতে থাকি–আরেকজনের উত্তর দেয়া হয় না। যেন চিন্তার দুটি বেণি পাকিয়ে পাকিয়ে কেবলি নামতে থাকে–এক হয়ে যায় না। বেশ লাগে। অনেক অহেতুক কথা মনের ভেতরে জমতে জমতে ভার হয়ে ওঠে, সেগুলোর একটা পথ হয়। আর শুনতে ভালো লাগে–অনেক অর্থহীন কথা এত ছন্দময় হয়ে ওঠে একেক সময়, মনে হয় সারাদিন শুনতে থাকি, ধরে রাখি, লিখি।

একবার আমার খুব শখ ছিল নিশাতকে চিঠি লেখার। কদিন লিখলাম খুব। তারপর হাঁফ ধরলো। কী লিখব, কিসসু মাথায় আসে না। কথা বলার সময়ে কেমন সহজ হয় সব, কিছু লিখতে বসলে আধখানা লিখে সেন্টেন্স আর শেষ করা যায় না। আর ওদিকে নিশাত লিখত আমার চেয়েও বড় বড় চিঠি। কেমন সাজানো গোছানো। তেলের শিশি হাত থেকে পড়ে ভেঙেছে সেটা একটা চিঠিতে লেখার বিষয় হতে পারে এই প্রথম জানলাম; কলেজে ছাত্রীদের মুখের বর্ণনা এত জীবন্ত হতে পারে তা নিশাত না হলে জানতাম না; আর কী আশ্চর্য, সেই মুখণ্ডলের বর্ণনা, যাদের আমি হয়ত কোনদিন দেখব না, দেখলেও চিনতে পারবো না আমার এত ভালো লাগবে তাইবা কে ভেবেছিল?

চিঠি লেখার অসুবিধে অনেক। সঙ্গে সঙ্গে জবাব আসে না। পোস্টাফিস হয়ে আসতে যেতে কম করেও তিনদিন। তিনটে দিন চুপ করে বসে থাকা আর ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে যাওয়া প্রথমদিকে বেশ লাগত। পরে কেমন অসহ্য হয়ে উঠল। নিশাতকে বললাম, চিঠি কে লেখে? আমি আর না।

গ্রীন রোডের কাছে ছুটে আসা একটা দৈত্য স্টেট বাস এড়াতে গিয়ে আমাদের স্কুটার আচমকা পাশ কাটালো। নিশাতকে ধরে না ফেললে হয়ত ছিটকে পড়ত রাস্তায়। রাস্তার লোক ইস্ ইস্ করে উঠল। আমি ড্রাইভারের জামা টেনে চিৎকার করে বললাম, পাশে করো।

পাতার মতো কাঁপছে নিশাত।

সমস্ত ব্যাপারটা এত আকস্মিক, আর আমরা এত তন্ময় হয়ে ছিলাম যে, ভালো করে বুঝতেই পারছিলাম না কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল। নিশাতের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপড় দিয়ে বললাম, কী হতো বলোত? কিসসু হয়নি। আর স্কুটারওলাকে একটা টাকা দিয়ে বললাম, আর একটু হলেই–।

সে খুব বিষদৃষ্টিতে দেখল আমাদের। যেন, সে তো এ ধরনের অ্যাসিডেন্টকে হর–হামেশাই এড়াচ্ছে, আমরাই কেবল তার ওস্তাদির কদর করছি না, নেমে যাচ্ছি। নিশাতকে বললাম, একটা রিকশা নিই।

রিকশায় বসে বললাম, এই রাস্তাটায় সেদিন একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল। স্কুটারের সঙ্গে ট্রাক। স্কুটারে ছিল গান গাইত, খেয়াল, মস্তান গামা। পড়োনি কাগজে? মারা গিছল। আমার খুব একটা খারাপ লাগছিল না। কিন্তু নিশাত চুপ করে রইলো সারাক্ষণ। বললাম, একসঙ্গে মরে গেলে একটা হৈচৈ পড়ে যেত কিন্তু! যেত না? লোকে, আমরা, মানে মনে করত আমরা স্বামী–স্ত্রী।

লজ্জা করল আমার। তাকাতে পারলাম না নিশাতের দিকে। চেনটা পড়ে গেল রিকশার। রিকশাওয়ালা যতদূর গতির মুখে যাওয়া গেল, তারপর নেমে উপুড় হয়ে পরাতে লাগলো হুইলের সঙ্গে চেন। পাবলিক লাইব্রেরীর জানালা থেকে চৌকো চৌকো আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আবার চলতে শুরু করল।

নিশাত বলল, আজ বেরুনোর মুখে ভাবীর ছেলেটা ভারী দুষ্টুমি করছিল। একটা চড় দিয়েছি।

মন খারাপ করছে?

নাহ। আবছা হেসে ফেলল নিশাত। আবার বলল, এমনি মনে পড়ল। খুব বেঁচে গেছ কিন্তু আজ।

আমার অনেকগুলো কথা ছিল। বলে নিশাতের দিকে চোখ ফিরিয়ে রাস্তার পাশে বুড়ো গাছগুলোর মাথায় মাথায় তাকালাম। শাদা মেঘ হয়েছে। চাঁদটা গেল কোথায়?

বলো, শুনছি।

বলব, এভাবে বলা যায় না।

হাসল নিশাত। ঐ রকম করে নিঃশব্দে, মেলা রকম মনে হয় হাসতে পারে নিশাত।

তুমিই বলো এভাবে বলা যায়?

না যায় না। কিছুতেই বলা যায় না। আমার কণ্ঠ অনুকরণ করে নিশাত বলে উঠল।

নিশাত না হয়ে অন্য কেউ হলে ঠিক চটে যেতাম। বদলে যেন খুব উপভোগ করেছি এমনিভাবে হেসে ফেললাম সশব্দে। আর আমিও বললাম, না বলা যায় না। কিছুতেই বলা যায় না। তারপর প্রস্তাব কলাম, চলো, খাই।

খাই মানে?

বাইরে। কোনো রেস্তোরাঁয়!

নিশাত দুহাতে মানা করে উঠল। বলল, আমি কবে বাইরে খাই? তুমি জানো না?

আজকে।

উঁহু। না।

কী হবে?

বাসায় মেহমান আসবে।

তো আমি খাবো। তুমি বসে বসে দেখো।

আমি এ রকম যখন রাগ করে বসি, নিশাত কিছু বলে না–এটা অনেকদিন দেখেছি। একদিন ওকে একটা কলম কিনে দিলাম। নেবে না কিছুতেই। বললাম, না নেবে তো না। বলে কলমটা খুলে নিবটা ভেঙে ফেলব বলে হাত তুলেছি, খপ করে হাত ধরে ফেলল নিশাত। কেড়ে নিয়ে কলমটা ব্যাগে রেখে দিল বলল, নিলাম। আবার আরেকদিন আমার মেজাজটা কিসে বিগড়ে ছিল বলতে পারব না। নিশাতের সঙ্গে আলাপটা জমছিল না। ও একাই কথা বলছিল সারাক্ষণ। বলতে বলতে একবার শুনলাম, কই, কী হয়েছে তোমার? কিছু বলো। হঠাৎ কী হলো ঠাস্ করে বলে ফেলাম, কী বলব? তুমিই তো সব বলছ। বলেই বুঝতে পারলাম অন্যায় করেছি। ভয় হলো, নিশাত হয়ত এক্ষুণি উলটো হনহন করে হাঁটতে শুরু করবে। কিন্তু, তার বদলে হাসল নিশাত। যেন অন্ধকারে ফিক করে চাঁদ উঠল। নিজেকে খুব ছোট আর নষ্ট মনে হলো তখন।

চীনে দোকানে খেতে বসে দুজনের জন্যেই আনতে বললাম। নিশাত আমাকে বাধা দিল না। বেয়ারা পানির গ্লাস বেখে চলে যাবার পর ও আস্তে আস্তে বলল, আমি, কী যে আমি, মানে আমি না করব না।

অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার?

জানোই তো।

তখন ঝুঁকে পড়ে বললাম, জানিই তো, আমি খাবো আর তুমি বসে বসে দেখবে, সে হতেই পারে না।

তখন নিশাত চোখ নামিয়ে বলল, সেটা নয়। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা।

ওহো।

যেন হোঁচট খেলাম। খুব বিব্রত মনে হলো নিজেকে। আমি কিনা ভাবছি, ছিঃ। নিজের বুদ্ধিকে ক্ষমা করতে পারলাম না। একটুও না। আর খুব অবাক হলাম, নিশাত কী করে বুঝল, এই কথাটা ওকে বলার জন্যেই আজ সন্ধ্যে থেকে আমি তৈরি হয়ে আছি। শুনেছিলাম মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখ দেখে সব বুঝতে পারে।

বললাম, আমিও তাই ভাবছিলাম।

বেশ তো। বলল নিশাত। তখন ধোঁয়া ওড়ানো সুপ এলো সমস্ত ঘ্রাণ আচ্ছন্ন করে। পেটের ভেতরে চচন করে উঠলো খিদে। ন্যাপকিন দিয়ে খামোকা ঠোঁট মুছে ওর পেয়ালা নিয়ে চামচে চামচে তুলে দিতে লাগলাম সুপ। নিশাত বলল, থাক, আর না। তুমি নাও।

ব্যস?

অনেক।

বললাম, তুমি সব দেখে শুনে নাও। একটু নুন লাগবে। ঐটা নিয়ে না বড়ড ঝাল। আমি আজ সন্ধ্যে থেকেই ভাবছিলাম, বুঝলে।

আর আমি কদিন থেকেই বুঝতে পারছিলাম, যেন কিছু একটা হবে আমার। এক চামচ মুখে দিয়ে ঠোঁটটাকে সঙ্কুচিত করে চুষতে চুষতে নিশাত আবার বলল, দূর, কী যে সব বলছি! দ্যাখো, দ্যাখো, ওরা কী সুন্দর গোল হয়ে বসেছে।

তাকিয়ে দেখি এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক, কাঁচা-পাকা চুলে ভর্তি মাথাটা, চোখে চশমা, গায়ে। শাদা হাওয়াই শার্ট। আর তাকে ঘিরে বসেছে এক–দুই –ছয় সাত –আটটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোক একবার এর আর একবার ওর মুখে তুলে দিচ্ছেন খাবার। গরম লাগছে, ছেলেটা মুখ বিকৃত করে ফিরিয়ে নিচ্ছে আর হেসে উঠছে তার ভাইবোনেরা। ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন, তখন টুক টুক করে মাথা গুঁজে খেতে লাগল যারা হাসছিল।

নিশাত বলল, আহা, ওদের মা নেই বোধ হয়।

বললাম, কিংবা মা আবার বাচ্চা হতে হাসপাতালে গেছে।

যেমন তোমার বন্ধুর বউটি বছর বছর যায়। নিশাত যোগ করল বিদ্রূপ করে।

যেন তুমি কত দেখেছ?

বাহ তুমিই তো গল্প করো।

আমার বন্ধুটি ঐ রকম। কাণ্ডজ্ঞান নেই। বাচ্চা হবে বছর বছর। যদি আমি বিয়ে করি, তো অনেকদিন ছেলেপুলে হবে না। নিশাত যদি ইউনিভার্সিটিতে আসতে পারে, আসার কথা হচ্ছে, তো ভালো। নয় স্কলারশিপটা নিয়ে যাক ও বিলেতে। আর আমি দুদিন পরেই জুনিয়র থেকে প্রমোশন পাবো। নিজের পশার জমে উঠতেও বছর দুবছর। তখন একটা ছোট্ট বাড়ি করব। একতলা। আজকাল কত লোকে বাড়ি করছে। আমারও হবে। তারপর ছেলে।

নিশাত জিগ্যেস করল হাসছ যে?

কই না।

বেয়ারা এসে পেয়ালাগুলো নিয়ে গেল আমাদের। কাঁটা চামচ সরিয়ে জায়গা করল। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললাম, তাহলে সামনের মাসে?

ভাইজানকে বলো।

আমি?

কেন? ভয় কিসের।

না, এমনি। আমার যেমন কপাল। তিনকুলে কেউ নেই তো। নিজের বিয়েতেও নিজেই ঘটক।

নিশাতকে খুব স্নান দেখাল তখন। হঠাৎ একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি কী বলব? তোমার যেদিন ভালো মনে হয়।

ঠিক তখন আমার বুকের মধ্যে রিমঝিম করে উঠল সরোদের ঝঙ্কারের মতো। মনে হলো, আজকেই আমাদের বিয়ে। এখান থেকে উঠে গেলেই দেখতে পাবো, বাইরে আলো ঝলমল করছে, মেলা লোকজন এসেছে, গাড়ি এসেছে, কাজি সাহেব এসেছেন, শরীফ এসেছে, ফটাস ফটাস করে পাড়ার ছেলেরা বাজি পোড়াচ্ছে আর আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতর বাড়িতে। চোখের সামনে নিশাত বসে আছে, নিশাতকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ঘরের মধ্যে সমস্ত মানুষ যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে এসে সব বসে আছে, আর আমি বুঝতে পারছি না– কেন?

উঠে দাঁড়াল নিশাত। বলল, মেলা দেরি হয়ে গেল না?

নিশাত কিছুতেই স্কুটারে উঠবে না, বাস স্টপেজে কিউ দিয়ে দাঁড়াল। বাসটা যখন ছেড়ে দিল, আমি দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ভাবীকে বোলো যে সামনের মাসে। কেমন?

বাসটা জোরে চলতে শুরু করেছে। সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শো করে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ যেন প্রচণ্ড একটা শূন্যতা লাফিয়ে পড়ল পথের পরে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো বুকটা অকারণে হু হু করে উঠল আমার। চৌরাস্তার ল ল বাতিটা দপ্ করে সবুজ হলো। স্রোতের মতো চলছে স্কুটার, কার, বাস, রিকশা। আমি দাঁড়িয়ে আছি তখনো। আমার যেন কোথাও যাবার নেই।

এত হালকা লাগছে নিজেকে, এত খুশি, কিন্তু কোথায় যেন কিসের একটা মোচড়–সব অথচ কিছু নেই! দুটো লোক আমার দুদিকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল সামনে, গিয়ে আবার হাত ধরাধরি করে তারা হাঁটতে লাগল।

একটা রিকশা এসে থামলো। যাইবেন সাব? উঠে বসলাম। যেন এই কথাটাই এতক্ষণ কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না যে আমার একটা রিকশা দরকার। তাকে নবাবপুর দিয়ে সোজা যেতে বলে পকেটে হাত দিয়ে দেখি–বুকটা ধ্বক করে উঠলো–আমি টাকা হারিয়েছি। না এ-পকেটে, না ও-পকেটে, আমার মানিব্যাগটা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *