২. কাজ

কাজ

জীবনে মানুষকে কাজ করতে হবে, কারণ কাজের মাধ্যমেই মানব জীবনের সুখ ও কল্যাণ নিহিত। মানব সমাজের সুখ ও কল্যাণ বর্ধন ছাড়া জীবনে আর কিসে আনন্দ পাওয়া যায়? মানব সমাজের কথা বাদ দিয়ে যদি নিজের সুখের কথাও চিন্তা করা যায়, তা হলেও আমাদেরকে কাজ করতেই হবে। মাথার ঘাম পায়ে না ফেলে জগতে কোনো সম্পদ লাভ করা যায় না।

সাধনা ও পরিশ্রমের সঙ্গে যদি জ্ঞানের যোগ থাকে, তবে লাভ হয় খুব বেশি। মূর্খ শত পরিশ্রম করে যা না করতে পারে, জ্ঞানী অল্প পরিশ্রম করেই তা করতে পারেন। বড় বড় কল কারখানা রেলওয়ে, স্টীমার, তড়িতের অপূর্ব শক্তিরহস্য জ্ঞানীর মাথা হতেই বের হয়েছে।

আলস্য করেই জাতি ধ্বংসের পথ তৈরি করে। মানুষকে দোষ দিয়ে কী লাভ? কেউ আমাদেরকে ছোট করে না, নিজের পতনের পথ আমরা নিজেই তৈরি করে নেই।

এ জগতে শুধু মুটে-মজুরেরাই পরিশ্রম করবে–এ হতে পারে না। দৈনিক আহার সংস্থানের জন্য তাদেরকে পরিশ্রম করা দরকার হয় বটে; কিন্তু বড় যারা তাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে। পয়সা-কড়ির অভাব নাই, নিজের অর্জিত ধন-সম্পত্তিতে দিন বেশ চলে যাচ্ছে, সুতরাং কোনো কাজ করবার দরকার নাই,–এমন কথা বলবার তোমার কোনো অধিকার নাই। এই যে ধন-সম্পত্তি, যা তুমি ভোগ করছ; এগুলি সগ্রহ করতে তোমার পিতাকে কতখানি পরিশ্রম করতে হয়েছিল, তা কী তুমি একটুও ভাব না? রাজা হও, নবাব হও, নিজের জন্য না হোক তোমার পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। কাজ না করে, এই দীর্ঘ জীবনটা কী করে কাটিয়ে দেওয়া যায়? আলাপ, রহস্য, হাসিঠাট্টা, খেলাধূলায় অনুরক্ত ব্যক্তিরা অফুরন্ত আনন্দ লাভ করতে পারে, কিন্তু কেমন করে এই সব লক্ষ্যহীন তরুলতার মধ্যে তোমার মহিমান্বিত জীবনকে ডুবিয়ে রাখতে পার? তোমার কাজ আছে, বড় লোকদের সঙ্গে দেখা করে, হেসে, গান করে তুমি তোমার জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পার না!

এ জগতে যারা বড় হয়েছেন, নাম করে মানুষ ধন্য হয়–যারা জগৎ সংসারকে বহু কল্যাণ সম্পদ দিয়ে গিয়েছেন, তারা জীবনে অনবরত কাজ করেছেন। অলসের উপাসনার কোনো মূল্য নাই। কাজের মধ্যে কী এবাদত নাই? শুধু আল্লা আল্লা’ করে খোদাকে তৃপ্ত করা যায় না–এ তুমি বিশ্বাস কর।

দুঃখী নর-নারীর জন্য পরিশ্রম করা কী এবাদত নয়? বিপন্ন মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করা কী এবাদত নয়? আল্লাহর জন্য পয়সা উপায় কী এবাদত নয়?

জগতে যে সমস্ত সুবিধা আমরা ভোগ করছি, এর মূলে কত মানুষের সাধনা বর্তমান–হয়তো কেউ তাদের নামও জানে না। যুদ্ধক্ষেত্রে যে সমস্ত মানুষ প্রাণ দিয়ে জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করে, তাদের কয় জনের নাম মানুষের মনে আছে?

আলস্যে মানুষের এবং জাতির সর্বনাশ হয়, মানুষের সুখ ও জাতির কল্যাণের মূলে কুঠারাঘাত হয়। কতকগুলি মানুষ আয়াস-আরামে জীবন কাটাতে পারে; কিন্তু এই আয়াস-আরামের উপকরণ যোগাবার জন্যে বহু মানুষ প্রাণপণ পরিশ্রম করছে। জাতির স্বাধীনতা ও শক্তি বাচিয়ে রাখবার জন্যে সভ্য জাতির মধ্যে কী বিপুল বিরাট সাধনা চলতে থাকে! ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যারা মোটেও চিন্তা করে না, তাদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। যারা অভাগা, মূর্খ, তারা এ সমস্ত কথার কিছুই বোঝে না। তাই তারা হাসি-উল্লাসে জীবন কাটিয়ে দেয়। নিজেদের উদ্যত সাধনা ব্যতীত খোদা কখনও মানুষকে বড় করে না। মানুষের অভাব বেদনা মানুষকেই মীমাংসা করতে হবে!

যাদের মধ্যে চরিত্রবলের খুব অভাব, যারা পরের ধন অপহরণ করে বাঁচতে চেষ্টা করে, তাদের পরিশ্রম করবার কোনো দরকার নাই। মানুষকে সত্যপথে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করতে হলে, তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর কঠিন সংযম চাই। মান-অপমানের জ্ঞান ভুলে যেতে হবে; ভেবে নিতে হবে চুরি করলে, পরমুখাপেক্ষী হয়ে অলস জীবনযাপন করলে জীবনের অপমান হয়। সত্যপথে থেকে যে কোনো কাজ কর তোমার দুঃখের মীমাংসা হবে। মানুষ তোমাকে ছোট কাজ করতে দেখে নাক সিটকাতে পারে, কিন্তু যে নাক সিটকায়, দুর্দিনে তার কাছে একটা পয়সা চেয়ো, দেখবে সে কেমন করে তোমার কাছ থেকে সড়ে পড়ে। উপরে খোদা আর নিচে তুমি, মানুষের চেয়ে খোদার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ বেশি, কত মানুষ এ জগতে এসেছিল–কোথায় তারা? খোদা চিরকাল আছেন–তোমার। জীবনের হিসাব তারই সঙ্গে হবে। যে দাম্ভিক ও অহঙ্কারী, সে তোমায় ঘৃণা করে মানুষের চোখ মুখে উল্লাসের হিল্লোল তুলেছে–সে কয়দিন বাচবে? মানুষের উপহাসকে ভয় করে অন্যায় করে জীবনকে বড় করে তুলবার কোনো দরকার নাই, মানুষ তোমাকে সম্মান করে বড় আসন দিক আর না দিক, কোনো ক্ষতি নাই–দাম্ভিক ধনবান মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ তোমার খুব অল্প। এরূপ মানুষের কাছ থেকে তুমি ফিরে এস। যা উচিত সেই পথ অনুসরণ করলে শত রকমে জীবনকে বড় করে তোলা যায়। ফর্সা কাপড় পরে ভদ্রলোকের কাছে সম্মান বজায় রাখবার জন্য নিজের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে ফেলো না। সে তোমাকে অপমান করে তৃপ্তি লাভ করেছে, বিশ্বাস কর তার চেয়ে সুখের জীবন তোমার–তুমি অন্যায় করো না, তোমার জীবনে কোনো পাপ নাই, তোমার ছেলেগুলি অন্যায়ের পয়সায় বেঁচে নাই–সতী সাধ্বী পত্নী তোমার ঘরে–তুমি তো রাজা।

জীবনের অপমান হয় দুটি জিনিসে–প্রথমত অজ্ঞতায়, দ্বিতীয়ত পর নির্ভরশীলতায়।

অজ্ঞতার ন্যায় মহাশত্রু মানব জীবনে আর নাই। জীবনে যে অবস্থাতে থাক না, তোমাকে জ্ঞানের সঙ্গে যোগ রাখতে হবে। জ্ঞানের চরম সার্থকতা মানুষকে ভালো মন্দ বলে দেওয়া,–তার আত্মার দৃষ্টি খুলে দেওয়া, তার জীবনের কলঙ্ক-কালিমাগুলি ধুয়ে ফেলা। অর্থ আছে বলে বা কাজের অজুহাতে যাদের জ্ঞানের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকে না, অজ্ঞাতসারে নিজদেরকে পতিত করে। দাম্ভিকতা ও অর্থে প্রভাব তাদের মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়।

দরিদ্রতম-দরিদ্র অপেক্ষা যে হতভাগ্যের অলস কর্মহীন জীবন অন্যের উপর নির্ভর করে, তার অবস্থা অধিকতর শোচনীয়। এতে মনুষ্যত্বকে একেবারেই চূর্ণ করে ফেলা হয়। জীবনে সকলের চেয়ে উচ্চ লক্ষ্য হবে, তোমাকে জীবনে যেন পরের দয়ার উপর নির্ভর না করতে হয়, কোনো সময়ে যেন মানুষের সামনে তোমার মন সঙ্কুচিত না হয়ে ওঠে। তোমার মাঝে যে বিবেক-বুদ্ধি আছে, তাকেই যেন তোমাকে ভয় করতে হয়।

কোনো ছোট কাজ করেও যদি জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায় তাও ভালো। কর্মহীন দীন জীবন কত দুঃখের, তার মুখোনি কত করুণ। বৃথা তার জীবন, বৃথা তার মানব সমাজে বাস। মানব জীবনের এই দারুণ অপমান হতে নিজেদের উদ্ধার করতে হবে। নারী-পুরুষ উভয়েরই যেন জীবনের চরম লক্ষ্য হয় এই। যে ন্যায় ও সত্যের অপমান করে, মানুষকে ভয় করে, তার উপাসনার কোনো মূল্য হয় না। যে মানুষের কাছে নিজের আত্মাকে বিক্রয় করেছে, তার আত্মায় খোদার আসন হবে না। আত্মার উপর আল্লাহ ও ন্যায়-সত্য ছাড়া আর কারো প্রভাব যেন না পড়তে পারে।

যে কোনো হীন ব্যবসা করা ভালো তবু বাইরে চাকচিক্য বজায় রাখবার জন্য অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করা ঠিক নয়। তোমার পত্নীর পরনে ভাল শাড়ি, তার গায়ে সোনার গহনা দেখে নর-নারী প্রশংসাপূর্ণ বিনীত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকবে তোমার ভালো ঘোড়াটি, তোমার দাস-দাসী ও খানসামা-পেয়াদা দেখে হয়তো তোমার মন অহঙ্কারে ভরে উঠবে–তোমার অসত্য জীবনের, তোমার দীন হৃদয়ের খবর তোমার পত্নীর কাছে হয়তো ঢাকা আছে; মানুষও তা জানে না। কিন্তু তুমি তো জান? তোমার মনুষ্যত্বের কাছে তো এ কেলেঙ্কারী অবিদিত নাই। মানুষের এই প্রশংসার দৃষ্টি ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান কর, তোমার এই অনুভূতি একেবারে চূর্ণ করে দাও।

আত্মাকে অবনমিত করে কে কুকুরের মতো দেহটিকে বাঁচাতে চায়, আত্মাকে পতিত করে ধর্ম জীবনকে ঠিক রাখা যায় না–এ যদি মানুষ না বোঝে, তবে সে কী প্রকার মানুষ? কোন ধর্মের লোক সে? কোন্ মহাপুরুষের দীক্ষা সে লাভ করেছে, অর্থ ও রুটির জন্য দীন-ভিক্ষুক হয়ে মানুষকে সালাম করতে হবে, এর চেয়ে বড় লজ্জা, বড় অপমান জীবনে আর কী আছে?

আমি মানুষ, এ জগতে আমার বাঁচার অধিকার আছে। তোমার ইচ্ছা হয়, আমাকে সম্মান করনা হয় করো না, ও আমি ভিক্ষা করে নিতে ইচ্ছুক নই। আমি কারো মনে অন্যায় করে আঘাত দিতে চাই নে। আমি দীনাতিদীন, তাই বলে মানুষের পদলেহন করা আমার কাজ নয়–যা সত্য বলে বুঝি, তাই আমি করবো–মানুষের সত্য গ্রহণের জন্য আমার আত্মা উন্মুখ। আমি যা বুঝি তাই অভ্রান্ত সত্য–এ কথা আমি বলি না। আত্মা আমার স্নেহ-করুণায় ভরা, আমি প্রতিবেশীর ক্ষতি করি না। আমার নয়নে জল আসে, আমার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য নাই। আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে কথা বলি, পাছে আমার কথায় কোনো অশুভ হয় এই ভয়ে; দেশকে ভালবাসি বলে সময়াভাবে নিরন্ন প্রতিবেশী ও দীন-দরিদ্রের কথা আমি ভুলি না, জাতির স্বাধীনতা চাই বলে দুর্বলকে আমি রূঢ় কথা বলি না; আমার বেশি বুদ্ধি আছে বলে আমি আমার বোকা প্রতিবেশীর সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করি নাই, আমি কখনও মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করি না, ঋণ পরিশোধ করতে আমি ইতস্তত করি না–আমি স্বাধীনচিত্ত কৃষক, আমি নিজের হাতে লাঙ্গল চষি, জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর সঙ্গে আমার যোগ আছে; জিজ্ঞাসা করি কে আমাকে ছোট বলে?

ডেপুটি সাহেব, দারোগা বাবু, উকিল বাবু আমাকে সম্মান করে না। তাতে আমার . কিছু আসে যায় না; পল্লীর অজ্ঞাত–দুঃখিনী বিধবা আমার নাম করে চোখের জল ফেলে, সর্বহারা নিঃসহায় দরিদ্র বুড়ো ডেকে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করে, তরুণ যুবকটি আমার স্নেহ নেবার জন্যে আমার কাছে আসে–ঐ আমার ঢের। আমি কারো কাছে কোনো সম্মান চাই না, কোনো বড় আত্মীয় আমার নাই, চেয়ারে আমি বসি না, যাদের পেট ভরা ভাত আছে, তাদেরকে খাইয়ে আমি নাম ক্রয় করি না–আমার পত্নীর গায়ে বহু গহনা নাই, আমার ছেলেরা চাকরের সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলে না।

কাজ করলে অসম্মান হয়?–অসম্মান হয় মূর্খ হয়ে থাকায়, পাপ জীবনে, আত্মার সঙ্কীর্ণতায়। জীবনকে কলঙ্কিত করে লোকের সঙ্গে উঁচু মুখ করে কথা বলতে কি লজ্জা হয় না–তঙ্করকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে তোমার মনে ঘৃণাবোধ হয় না?

কাজ করতে কোনো লজ্জা নাই। পবিত্র সন্তুষ্ট মন নিয়ে পরিশ্রম কর, তোমার জীবনে সোনা ফলবে। হৃদয়ে আশা পোষণ করে কাজ করাতে কত আনন্দ পাওয়া যায়। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ কেমন করে কাজ করে। যুবক বয়সে নিষ্কর্ম জীবন যাপন করা খুবই বিপজ্জনক। মেয়েদের পক্ষে আরও বিপজ্জনক। কাজ নাই কর্ম নাই–অনবরত শুয়ে। বসে থাকলে মাথায় হাজার তরল চিন্তা আসে। জীবনে তরল চিন্তার ধাক্কা সামলান বড় কঠিন। যার মাথায় একবার তরল চিন্তা ঢুকেছে, তার আর রক্ষা নাই–অধঃপতন হবেই।

টাকা-পয়সার অপব্যবহার করলে লোকে অমিতব্যয়ী লক্ষ্মীছাড়া বলে, সময়ের অপব্যবহার যে করে সে অমিতব্যয়ী। সময়ের সদ্ব্যবহার কর–সময়ের আর এক নাম সম্পদ, লেখাপড়া শিখে চাকুরি করা ছাড়া কি জীবনের আর কোনো ব্যবহার নাই। কামারের লোহার কাজ, টুপি তৈরি, পুস্তক বাঁধাই, কল-কারখানার কাজ, কাপড় তৈরি ও কাঠের কাজ, খেলনা তৈরি, লণ্ঠন ও ছড়ি তৈরি প্রভৃতি বহু শিল্প তুমি শিখতে পার।

শিল্প জাতির গৌরব–শিল্প দেশকে সৌন্দর্য ও সম্পদে পূর্ণ করে ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলি তার প্রমাণ। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ; এখানে মাটি হতে সোনা ফলান যায়। মাটির ফসল হতেই জীবনের অভাব পূরণ হল, তা হলে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সমস্যার ভার হতে তুমি মুক্ত হলে। বিদেশী বিলাদ্রব্য কিনে, নিত্য নূতন অভাব সৃষ্টি করে, জীবনের দৈন্য না বাড়িয়ে নির্বিবাদে পল্লীর নির্জন প্রান্তে বসে জীবনের শত রহস্যের সন্ধানে জীবনকে ব্যাপৃত রাখ, বিশ্বের চিন্তাশীল পণ্ডিতমণ্ডলীর লেখা পাঠ করে নূতন নূতন কলকারখানা উদ্ভাবনে মনোনিবেশ কর,–বিজ্ঞান আলোচনা কর, তোমার চিন্তা তোমার জ্ঞান জাতিকে দান কর।

তোমার চারিদিকে যে সমস্ত জাতি বড় আসনে উপবিষ্ট রয়েছে, এদের বড় হবার মূলে কত পণ্ডিতের চিন্তা বিদ্যমান। কয়েকটি টাকার জন্যে ভিক্ষুক জীবনের অভিশাপ নিয়ে তোমার আত্মাকে বিনষ্ট করে ফেলো না। তোমার ভিতরে কত বড় শক্তি সম্ভাবনা ঘুমিয়ে রয়েছে তা হয়তো তুমি জান না! মানুষের আত্মা ফেলে দেবার জিনিস নয়। জ্ঞান-চর্চার দ্বারা তোমার আত্মার ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোল। মানুষ যে কত বড়, সে কেমন বড় ও সম্মানী হতে পারে, তা হয়তো সে জানে না, তাই সে সম্মানের জন্য মানুষের দুয়ারে যায়, পথে আবর্জনার দামে তার অমূল্য রত্ন বিক্রয় করে।–পরিতাপ!

মানুষের বুকের ভিতরে কী শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে জাগ্রত কর, সে অসাধ্য সাধন করবে। তাকে বলে দাও, সে অফুরন্ত শক্তির মালিক। কেন সে ছোট হয়ে আছে?–নিজের সিংহাসন সামনে রেখে কেন সে ভয়ে ভয়ে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তুমি ছোট, তুমি হীন? পতিত, অবজ্ঞাত, হীন, ছোট মানুষের কানের কাছে আজ আমাদিগকে শক্তির গান গাইতে হবে। মানুষ পাপ ও মূর্খতাকে ঘৃণা করতে শিখুক, সে জ্ঞান সাধনার দ্বারা আত্মচেষ্টায় মানুষের সম্মান পূজা লাভ করুক। জলে বৃষ্টিতে কি গা ভেজে না? পিচ্ছিল পথে কি মানুষ হাঁটে না? পড়ে যেয়ে কি পথের মাঝে বসে থাকতে হবে? আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্য বুঝতে পারি নি, দুঃখ-সুখ সবাই তার স্নেহের দান; কিন্তু দুঃখে পড়েছি বলে কি আমি দুঃখকে জয় করতে চেষ্টা করব না? পাপ অন্যায় করেছি, অজ্ঞান অন্ধকারে আত্মা অচেতন হয়ে আছে, সে অজ্ঞান–সে আঁধার কি ঘুচাতে হবে না?

ভদ্রলোক রাজা, জমিদার বড় মানুষের ছেলে জ্ঞানে অর্থে পুণ্যে ধর্মে বড় হবে, আর যারা ছোট, তারা চিরকালই ছোট হয়ে থাকবে, এ তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না। যে তাঁতী, যে জেলে, যে কামার, যে রাজমিস্ত্রি সেও ভদ্রলোক হতে পারে। চাই তার জ্ঞান, চরিত্র-শক্তি বিনয় ও সত্যপ্রিয়তা। বিনয়ের অর্থ অত্যাচারী অহঙ্কারী ব্যক্তির পদধূলি মাথায় নেওয়া নয়। অত্যাধিক বিনয় ও ভক্তি নম্রতার মানব জীবন অনেকখানি ব্যর্থ হয়ে যায়! অসন্তোষ ও বিদ্রোহ এ দু’টিও চাই।

তুমি দরিদ্র নও, তোমার ভিতরের শক্তিকে তুমি জাগিয়ে তোল। জীবনে যে কোনো অবস্থায় যে কোনো সময় তুমি নিজেকে বড় করে তুলতে পার। তোমাকে কোথায়ও যেতে হবে না, তোমার ছোটও হতে হবে না, এই বয়সেই তুমি জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর চিন্তার সঙ্গে যোগ স্থাপন কর, জীবন ব্যর্থ হবে না।

সামান্য কৃষক হয়ে জীবনকে অবনমিত করে ফেলেছ, এ মনে করো না। আলোক রহস্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, শরীরতত্ত্ব, ইতিহাস, বিবিধ ধর্মশাস্ত্র আলোচনা করে কি তুমি তোমার জীবনকে ধন্য করতে পার না? স্কুল কলেজে না গেলেই কি জীবন মাটি হয়ে গেল? জান না কোনো বাধাই জীবনের গতিকে রুদ্ধ করে রাখতে পারে না। চিন্তা ও সাধনা দ্বারা সকল বিঘ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে। যে বিষয় ভালো লাগে, জীবন ভরে তারই আলোচনা করো, তোমার সমাজকে তুমি মৃত্যুর পূর্বে তোমার কাজে ঋণী করে রেখে যেতে পারবে। উপাধি না পাও কোনো ক্ষতি নাই! তোমার গুণের আদর না হয়, তাতেও বিশেষ কিছু মনে করবার দরকার নাই। জ্ঞান আলোচনার যন্ত্রপাতি, বড় বড় অধ্যাপক ও অট্টালিকা দরকার নাই। অধ্যাপকের আড়ম্বর আর যন্ত্রপাতিতে মানুষ জ্ঞানের পথকে বরং অসরল, অসহজ করে তুলেছে। জ্ঞানের পথ সব সময়েই আনন্দ ভরা ও সহজ। অর্থলাভ শিক্ষকদের শাসন, গুরুজনের অসহিষ্ণুতা আর সাধারণ মানুষের ধিক্কার-ভয় জ্ঞানের আনন্দকে নষ্ট করে ফেলেছে। এক একটা বিষয় বুঝতে দার্শনিক পণ্ডিতদের কতদিন কতমাস কেটে গিয়েছে তা আমাকে একদিনেই ঠিক করে নিতে হবে! বিদ্রোহী অবুঝ মনকে পিটিয়ে বুঝতে ও জানতে হবে, এতে কি প্রকৃত জ্ঞান লাভ হয়? এই ভাবের জ্ঞান সাধনায় কি আনন্দ আছে?

যে বিষয়ে আলোচনা করতে মনে খুব আনন্দ জন্মে, তুমি, সেই বিষয়েরই আলোচনা কর; জীবনে তুমি কীর্তি অর্জন করতে পারবে।

আলস্য করে, শুধু খেয়ে-পরে, শুধু পৃথিবীর কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে তুমি তোমার জীবনকে নিরর্থক করে দিও না–এ আমার অনুরোধ।

যে কুঁড়ে এবং আলসে, তার স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, তার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে।

শরীরের পরিশ্রম অপেক্ষা মাথার পরিশ্রমের মূল্য বেশি। হাত-পাগুলি মাথার আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। বুদ্ধিহীন মাথার আদেশ পালন করতে যেয়ে হাত-পাগুলির পদে পদে দুঃখ আর বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়।

জগতের শ্রেষ্ঠ ও সভ্য জাতিগুলি মস্তিষ্কের সদ্ব্যবহার করেই বড় হয়েছে। সভ্য জাতির সামনে টিকে থাকতে হলে নিজেদের সম্মান ও জীবনের জন্যে বেশি করে মাথার সদ্ব্যবহার করতে হবে। চারদিকে যে এত বেদনা, এত দুঃখ দেখতে পাচ্ছ, এর একমাত্র কারণ জাতির বুদ্ধির দৈন্যতা।

ব্যাধি, অনাহার এইসব দরিদ্র জাতির মধ্যেই বেশি দেখা যায়। শত শত বছর আমরা আমাদের জীবনের মূল্য বুঝি না, কেন আমরা পথে পড়ে মরবো না? যে পরিশ্রম করে না তার দুঃখ তো হবেই। বিশ্বের পথে যে চারদিকে চেয়ে না চলে, তাকে তো রথের চাকার তলে পড়ে চূর্ণ হতেই হবে।

চুরি-বাটপাড়ি করে, দেশের মানুষকে কৌশলে ফেলে পয়সা অর্জন করা বিশেষ কঠিন নয়; কিন্তু এ ভাবে পয়সা উপায় করে বেঁচে থাকা যদি অন্যায় না হয়, তা হলে অভাবগ্রস্থ লোকদের বিরুদ্ধে কথা বলবার অধিকার তোমার নাই।

জীবনে অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে সুখী ও ভদ্রলোক হতে যেয়ো না; তার চেয়ে মুটে মজুরের মতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করা বেশি মনুষ্যত্ব।

জীবনকে বড় করে তোলার ক্ষমতা, মানুষকে সুখ দেবার ও সাহায্য করবার ক্ষমতা তোমার মধ্যে আছে। মানুষের সকল সুখের মূল অর্থ। নিজের পরিবার ও দীন-দুঃখীর সেবা করাও অর্থ ছাড়া হয় না। যার বুদ্ধি আছে, যে পরিশ্রম করতে পারে, তার দুঃখ নাই। জীবনে সে নিজে সুখ সংগ্রহ করে নিতে পারবে, পরকেও সে সুখ দেবে। যে অপদার্থ সেই দরিদ্র হয়। দরিদ্র হয়ে থাকা জীবনের পক্ষে এক অপমান। যে সমাজে সামাজিক মর্যাদা ঠিক রাখবার জন্য দরিদ্র হয়ে থাকতে হয়, সে সমাজ তুমি ত্যাগ কর। দেশের মায়ায় গ্রামের মায়ায় জীবনের দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কী? যেখানকার মানুষ তোমার সাদা কাপড়, তোমার চটক দেখে তোমায় সম্মান করে; তোমার অভাব ও ঋণের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে, সেস্থান ছেড়ে যেখানে পয়সা আছে সেখানে চলে যাও-নারী-পুরুষ ছেলে-মেয়ে কঠিন পরিশ্রম কর–দুঃখ থাকবে না। অলস পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে যারা প্রতিজ্ঞা করেছে, তারাই এ জগতে দুঃখী হয়ে থাকে।

মানুষের নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস নাই, তাই সে এত ভীরু। ভিখারির মতো সে মানুষের দয়ার পানে চেয়ে থাকে। কে তোমাকে এ জগতে পাঠিয়েছে, মানুষ তোমার খোদা নয়। যে তোমাকে এ জগতে পাঠিয়েছে, সেই তোমার আহার ঠিক করে রেখেছে। তোমাকেও পরিশ্রম করতে হবে, খুঁজে নিতে হবে, ঘরের মধ্যে বসে কাঁদলে চলবে না। খোদাতালা সব সময়ে তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কথা ভেবে তারই উপর নির্ভর করে তুমি সাগরে ঝাঁপ দাও। সাবধান, অন্যায়কে আশ্রয় করে কখনো খোদার নাম নিও না। অন্যায়ের সঙ্গে যার জীবন জড়িত হয়ে আছে, তার খোদাকে ডাকবার অধিকার নাই। মানুষ যেদিন অন্যায়কে অবলম্বন করেছে, সেদিন সে মিথ্যাকে আশ্রয় করেছে, সেদিন সে আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা আরম্ভ করেছে। আল্লাহ্ দয়ালু এ কথা ভেবে তোমার পাপ করার কোনো অধিকার নাই। অবিবাহিত চরিত্রহীন ব্যক্তিকে বরং ক্ষমা করা যায়, কিন্তু বিবাহিত মিথ্যাবাদী, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী, নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানুষকে আমরা কখনও ক্ষমা করতে প্রস্তুত নই। যে অনাথিনী বিধবার সম্পত্তি অপহরণ করে, যে মানুষের সঙ্গে দাম্ভিক ব্যবহার করে, যে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করে না, যে নিন্দুক, যে দুর্বল নারী জাতির উপর অত্যাচার করে,–সে খোদার শত্রু।

মানুষ যে পথে গিয়েছে, সে পথেই যে তোমাকে চলতে হবে তা নয়। যে পথে চলে হাজার মানুষের দুঃখের মীমাংসা হয় নি, দেখাদেখি তুমিও কেন সে পথে চলো? তোমাকে নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে–যে পথে কেউ যায় না, সেই পথেই তুমি চল। তোমার সত্য জীবনের সঙ্গে তুমি সন্ধি স্থাপন কর–তুমিই আদর্শ ভদ্রলোক, আমি তোমাকে সম্মান করবো। এ জগতে কে তোমাকে ছোট বলে ঘৃণা করে? করুক না–তুমি যেন নিজেকে ঘৃণা না কর। তোমার মনুষ্যত্ব, তোমার বিবেক যেন তোমাকে ঘৃণা করার অবসর না পায়। পরাধীন জাতির ভদ্রলোক কে তা ঠিক করে বলতে পারি নি। তোমাকে ছোট বলে কোনো অভাগা ঘৃণা করবে, তা আমি বুঝি না। ছোট বলে কেউ যদি তোমাকে হীন চোখে দেখে, দেখুক আপত্তি নাই–যেন মিথ্যাবাদী দুবৃত্ত না বলে।

মিথ্যা সম্মানের জন্য কি পল্লীর দরিদ্র ঘরের সতী কুলবধূ চরিত্রহীনা বড়লোকদের বিলাসিনী পতিতা বন্ধুদের স্বর্ণালঙ্কার ও বহুমূল্য পোশাক-পরিচ্ছেদ পরতে চায়? এ জগতে গায়ের জোরে অনেকেই ভদ্রলোক হতে পারে, গায়ের জোরে তোমার ভদ্রলোক হয়ে দরকার নাই।

জীবনের কাজ করতে হলে বড় সহিষ্ণুতা চাই, খোদার উপর বিশ্বাস করে সহিষ্ণু হয়ে পরিশ্রম করো, দুঃখের মেঘ তোমার মাথার উপর হতে সরে যাবে। আমি এ কথা পুনঃ পুনঃ বলছি, যে পাপী, মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, সে যেন খোদার উপর নির্ভর করে খোদার মহিমা ও দয়ার অপমান না করে। যে মিথ্যাবাদী মানুষকে ব্যথা দেয়, যে ভণ্ডমানব সমাজের দুঃখ বর্ধন করে কী বলে খোদা তাকে ভালবাসেন? কুকুরের মতো পরিত্যক্ত হাড় খেয়ে সে এ জগতে বেঁচে আছে।

দুদিন পরিশ্রম করেই তুমি রাজা হবে, এ মনে করো না। দুই একদিন বা দুই একমাস কঠিন পরিশ্রম করে ফল লাভ করার আশা করো না। বহুদিন ধরে অল্প অল্প পরিশ্রম করলে বরং ফল লাভ হয় কিন্তু অল্প কিছুদিন কঠিন পরিশ্রম করলেও কোনো লাভ হয় না। কোরান (শঃ) বহুস্থানে সহিষ্ণুতার গুণ লেখা আছে। বড় বড় লোক যেমন পরিশ্রমী তেমনি সহিষ্ণু। মন অবুঝ হয়ে বলছে, কতদিনে এ কাজ হবে? কতকাল আর অপেক্ষা করবো? না, এমন কথা ভেবো না। বছরের পর বছর চলে গিয়েছে, আর সময় নাই, এরূপ মনে না করে। সম্মুখের দিনগুলিকেই যথেষ্ট মনে কর। আজকার এই নূতন দিন, বার বছর পর কত পুরাতন হয়ে যাবে তা কি ভেবে দেখেছ?–আজকাল এই নবীন ঊষা কিছুকাল পরে অতীতের স্বপ্ন বলে মনে হবে। এই সময়েই তোমার যাত্রা শুরু হোক। নিজেকে বিশ্বাস করো, এই তুচ্ছ দিনগুলি তোমাকে কত সম্পদ দান করে তা তুমি পরে দেখে নিও। জীবনের দিনগুলি কি অপব্যবহার করা যায়? এই সাধের মানব জন্ম কি আর পাওয়া যাবে? তুমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক দিন হতে মণি রহ কুড়িয়ে নিতে পার। অর্থ সঞ্চয় করা আর সময়ের সুব্যবহার করা একই কথা।

জীবন সাধনার পথে অনেক দুঃখ-ব্যথা আসতে পারে। কিন্তু সে সব দুঃখ-ব্যথাকে উপহাস করে তুমি সময়ের ব্যবহার করো। কেঁদে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জীবন কাটালে কোনোই লাভ নাই, কেউ ফিরে তাকাবে না। পরীক্ষায় পাস করে চাকরির উমেদারিতে বছরের পর বছর পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ? এতে প্রতিপন্ন হচ্ছে, তুমি নিতান্তই নির্বোধ। চাকরির উমেদারিতে থাক, আর চাকরি-জীবন অবলম্বন করে–সময়কে অনর্থক উড়িয়ে দেবার অধিকার তোমার কৈ? নিজের জন্য না হোক, পরের জন্য তোমার উদ্যম ও শক্তি ব্যয় কর। জীবনের মূলধনটিকে যত খাটাবে, ততই তোমার নিজের কল্যাণের মুদ্রা লাভ হবে; সে মুদ্রা তুমি নিজেই ব্যবহার কর অথবা পরকে দাও। লোহার বাক্সে টাকা আটকিয়ে রেখে লাভ কী? সেগুলি নিজে খাটাও, না হয় পরকে খাটাতে দাও। পরীক্ষায় পাস করেছ বলেই কি তোমার জীবনের সকল কাজ শেষ হয়েছে? শারীরিক পরিশ্রম করবার ক্ষমতা যদি তোমার বাহুতে না থাকে, জ্ঞানার্জন দ্বারা জীবনের দিনগুলি সার্থক কর। নিরক্ষর দেশবাসীকে তোমার চিন্তায় দীক্ষিত কর, এর চেয়ে বড় কাজ কী আর জীবনে আছে? বুদ্ধির দ্বারা মানুষের মঙ্গল করা মহাজনের কাজ। অর্থ অপেক্ষা জ্ঞানের দানই সমধিক মূল্যবান।

জীবনে কোনো পথ হচ্ছে না–পথ একটা তৈরি করে নাও ফিলিপ সিডনী বলেছেন–জীবনের সকল পথ যদি রুদ্ধ হয়, তবু আমি একটা তৈরি করে নিতে পারি–পুরুষের জন্য মুক্তির পথ আছেই। অবিশ্বাসী, পরমুখাপেক্ষী, বিশ্বাসহীন মানুষের জন্য মুক্তির পথ নাই। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট হয়ে থাকবে না, না খেয়ে মরবে না–আল্লাহর নামে সহিষ্ণু হয়ে পরিশ্রম কর, তোমার সম্মুখে মুক্তির পথ খুলে যাবে। সন্দেহ ও। আত্মবিশ্বাসের অভাবে মানুষ মৃত্যু লাভ করে। বিশ্বাসের বলে বাবর শাহ রাজ্য লাভ করেছিলেন, ভিখারী শিবাজী রাজা হয়েছিলেন। মানুষ ইচ্ছা করে ছোট ও দরিদ্র হয়। তার ছোট ও দরিদ্র হবার কোনো কথাই নাই। তার শুধু সহিষ্ণু পরিশ্রম চাই। জয়ের জন্য শুধু আল্লাহর দিকে চেয়ে থেকো না। তোমার বাহুতে শক্তি আছে, তোমার মাথায় যে বুদ্ধি আছে, তার ব্যবহার তুমি কর।

নিজের শক্তিকে অবিশ্বাস করে মানুষের কাছে যে দয়া ভিক্ষা করে, সে অপদার্থ। মানুষের কাছে কেন ভিক্ষা করবে? আল্লাহ তোমার দুখানি শক্তিশালী হাত, দুখানি পা, আর মুখে ভাষা দিয়েছেন,–এই তো যথেষ্ট।

যে কাজে প্রাণ ঢেলে দেওয়া যায় না, তাতে বিশেষ লাভ হয় না। কাজ করতে যদি মনে আনন্দ অনুভব না হয়, তাতেও বিশেষ ফল হয় না। তুর্কী জাতির সম্মুখে ইউরোপের সমস্ত শক্তি বিধ্বস্ত হতো কেমন করে? তুর্কীরা প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করতো! দেশের মমতায় যারা যুদ্ধ করে, আর যারা টাকার জন্য যুদ্ধ করে–এদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি! পারস্যের সৈন্যকে কী করে মুষ্টিমেয় রোম সৈন্য হারিয়ে দিয়েছিল? রোম প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তাই সে জয়লাভ করেছিল। প্রাণ-মন ঢেলে না দিয়ে অনিচ্ছায় সারারাত্রি পড়, কোনো লাভ হবে না। শরীর কোনো কাজ করে না, কাজ করে মন। পরিশ্রমের সঙ্গে কোনো আশা পোষণ করা মন্দ নয়–আশায় মানুষ পর্বত লঙঘন করে। মানুষ অনেক সময় বলে থাকে, সময় নাই–প্রকৃত কথা তাদের প্রাণ নাই। প্রাণের ইচ্ছা না থাকলে কোনো কাজ সুসিদ্ধ হয় না। যে কাজে প্রাণের যোগ আছে, তা অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সম্পন্ন করা যায়।

জীবনে অর্থ লাভ করবার জন্য নিজেকে বড় করে তোলার জন্য পরিশ্রম কর। কখনও বলো না আমি যা বুঝি তা সম্পূর্ণ। সারা জীবন ভরে জ্ঞানালোচনা করলেও তো বুঝার শেষ হবে না।

জ্ঞানের জন্য যে পরিশ্রম করা যায়, তার মূল্য খুব বেশি। জ্ঞানই জগতের কাজকে সরল, সুখময় ও সহজ করে তোলে। কাষ্ঠের বাক্সগুলি হাতে তৈরি করতে গেলে, একদিনে তো একটাও করা যাবে না এবং তার প্রত্যেক বাক্সের দাম পড়বে এক টাকার কম নয়। জ্ঞানবলে মানুষ ঐরূপ হাজার হাজার বাক্স প্রতি ঘণ্টায় তৈরি করছে।

মাটিতে ধান ফেললে যে ফসল উৎপন্ন হয়, একথা পণ্ডিতেরাই মানুষকে শিখিয়েছে, এ জগতের সকল কাজ জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। দিনে রাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম কর–তার মূল্য পাবে ছাই। শারীরিক হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের সঙ্গে যদি তোমার বুদ্ধিবল থাকতো, তা হলে তুমি রাজা হতে পারতে। সংসারের সকল কাজ চলছে, শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবু বৃষ্টি-বাদলার মাঝে, গভীর রাতে, দুপুর রৌদ্রে সংসারে কাজে হেঁটে বেড়াতে পার, আর তোমার আত্মার মঙ্গলের কোনো চেষ্টা করতে পার না?

অপক্ব অনুন্নত ও অবোধ মন নিয়ে বহু উপাসনা করলেও বিশেষ লাভ হয় না। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, জ্ঞানী ব্যক্তির এক মুহূর্তের উপাসনা মূখের চল্লিশ বৎসরের উপাসনার সমান! তুমি যে অবস্থায় থাক না যে কাজই কর না, তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এই-ই তোমার বিধান। পয়সার লোভে যুবক বয়সেই পড়া শেষ করে এখন আরাম। ভোগ করছ? এটা মানুষের জীবন নয়, কাজের চাপে বই-পুস্তক ধরবার মোটে অবসর হয়, এও মানুষের কথা নয়। জ্ঞানকে বাদ দিয়ে উপাসনাকে যে বেশি আঁকড়ে ধরে, সে অপদার্থ। তার ধর্ম-বিশ্বাসের কোনো মূল্য নাই।

কারো কারো ধারণা, কোরান (শঃ) ছাড়া কোনোও পুস্তকে জ্ঞান নাই। এ অতি বড় মূর্খ মানুষের কথা। শিশু কোরানের (শঃ) অর্থ গ্রহণ করতে পারে? কোরান (শঃ) বুঝতে হলে, গীতার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আমাদের মনটিকে বহু জ্ঞানভাণ্ডারে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে। জ্ঞান চিন্তার দ্বারা আত্মার দৃষ্টি খুলে দাও, সে সমস্ত প্রকৃতির ভিতর দিয়ে আল্লাহকে উপাসনা তুল্য হবে! মুখের সম্মুখে কোরান (শঃ) খুলে রাখ, সে সহস্রবার পাঠ করুক,–ধর্ম পথের কিছুমাত্র সন্ধান সে পাবে না। তার আত্মতৃপ্তির কোনো মূল্য নাই, জাতির যখন অধঃপতন হয়, তখনই সে এমন সঙ্কীর্ণ পন্থায় নিজের জীবনকে সার্থক করতে চায়; সে বাদুড়ের মতো দীপালোক হতে চোখ বুজে বসে থাকে। মানুষকে সব দিক চাইতে হবে, তাকে অনন্ত বড় হতে হবে, তাকে অনন্ত পথে চলতে হবে, তাকে খুব কথা ভাবতে হবে, সে তো সহজ জীব নয়। জাতির পতন হলে, যে গর্বে আপনাতে আপনি ডুবে থাকে, তার সম্বল হয় শুধু ঘৃণা ও অহঙ্কার। যাবৎ কোনো মহাপুরুষ তাকে নতুন করে পথ না দেখিয়ে দেন, তাবৎ সে আঁধারেই পড়ে থাকে। জ্ঞানসাধনা ব্যতীত জাতির দেহে শক্তির সৃষ্টি হয় না, সে তার ধর্ম ও মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে।

ইংরেজ কোথায় না গিয়েছে? বরফের দেশে, দুর্গম গিরিশিরে, আকাশে, মরুভূমে, সমুদ্রর তলে–কোথাও তার যেতে বাকি নাই? সে ভীল, কোল সাওতালী ভাষা হতে পৃথিবীর সমস্ত ভাষার চর্চা করেছে। সে কত পরিশ্রম করে। মুহূর্তকালও তো তার আলস্যে কাটে নাই। তার এই সাধনা ব্যর্থ হয় নাই।

নিজেকে এবং জাতিকে বড় করতে হলে তোমার সমস্ত শক্তির পূর্ণ ব্যবহার চাই। তোমার নিজের বড় হবার উপরেই জাতির বড় হওয়া নির্ভর করে। তুমি ছাড়া জাতি স্বতন্ত্র নয়। জাগরণের অর্থ তোমাদের সকলের জাগরণ। জাতিকে আহবান করা।

অনবরত কাজ করতে করতে মানুষ নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে পড়ে। তা যেন স্মরণ থাকে। নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে বড় হওয়ার কোনো লাভ নাই।

নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। নিজের সুখটুকু আদায় করে নিতে পারছ বলে, তোমার তৃপ্ত হবার কোনো কারণ নাই। এই দুঃখ-শাভরা দেশের অনন্ত দুঃখী মানুষের কথা না ভেবে, যে আপনার পূর্ণতায় প্রাণহীন হয়ে বসে থাকে, তাকে আর কী বলবো! সে যদি উপাসনা করে, তা দেখে আমার মন যেন সুখী হয় না।

এ জগতে কতকগুলি লোক আছেন, যাদের কাছে বসে থাকা নিতান্তই অসম্ভব বলে। মনে হয়। তারা ভাবেন, জীবন আমাদের ক্ষুদ্র–কাজ অসীম। সারা জীবন ভরে কাজ করলে যা আমাদের করবার ছিল, শেষ হবে না। আলস্য করবার সময় নাই। মুহূর্তগুলি তাঁদের কাছে অমূল্য জিনিস, জীবনের সুখই হল তাদের সাধনা ও পরিশ্রমে।

লিউনার্ড ডি ভিনসী (Leonardo De Vince) এক সঙ্গে হাজার গণ্ডা কাজ করতেন, তাতে তার কোনো ক্লান্তি হতো না। সারা জসুয়া রেনল্ডকে এক সময় বন্ধুরা গ্রামে ধরে নিয়ে যান। সেখান হতে ফিরে এসে পুনরায় কাজে হাত দিয়ে তিনি যেন পূর্ণ জীবন লাভ করেন।

পেসিন (Poussin) যতই বুড়ো হচ্ছিলেন; ততই তিনি সাধারণ পূর্ণতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এত যে কাজ করা, তবু তার তৃপ্তি ছিল না। প্রতিভাবান পরিশ্রম করে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। অনবরত কাজ, অনবরত পরিশ্রম–তবুও তাদের মনে হয় কিছু হচ্ছে না। ভার্জিল এগার বছর ধরে তাঁর ইনিদ কাব্যখানি লেখেন। লেখা শেষে তিনি কিছু হয় নাই ভেবে আগুনে পোড়াতে যাচ্ছিলেন। ভলটেয়ার (Voltaire) কোনো বই লিখেই তৃপ্তি লাভ করেন নি! প্রকৃত কর্মী যারা তারা সব সময়েই নিজেকে খুব দীন মনে করেন নিজেদের দরিদ্র অপরাধী ভেবে কর্মের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। তাদের লক্ষ্য হয়, জয়-সাফল্যের গৌরব পতাকা।

যে জাতি সময়ের মর্যাদা জানে, কাজের মূল্য বুঝে, যারা পরিশ্রম করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তাদের ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল! লক্ষ লক্ষ মানুষের আলস্য কত কোটি কোটি টাকা মাটি করে ফেলে দিচ্ছে। সময়ের অপব্যবহার করা, আলস্য করে জীবনকে মাটি করে দেওয়ার অর্থ, জাতির কোটি কোটি টাকা অবহেলা করে নষ্ট করে ফেলা।

যে পরিশ্রম করতে তোমার মনে আনন্দ হয়, তাই করো। তোমাকে প্রত্যহ কিছু কিছু করতে হবে। কিছু কিছু করে কয়েক বছর ধরে বিশেষ কোনো কাজ করলে শেষে কাজের ফল দেখে তুমি অবাক হয়ে যাবে।

কাজ করলেই যখন বিনিময়ে অর্থ, সম্মান, সুখ ও কল্যাণ লাভ হয়, তবে কেন তা করবে না? আলস্যে জীবনকে নিরর্থক করে না দিয়ে, সময় ও সুযোগ থাকতে কিছুকাল পরিশ্রম করে নাও। কে এমন হতভাগ্য আছে, যে জীবনের উন্নতি চায় না? পরমুখাপেক্ষী, অলস ও অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোক হয়ে থাকায় কত লজ্জা। তুমি সমাজের এক স্তর নিচে নেমে যাও, বন্ধুরা তোমার সঙ্গে কথা না বলুক, তোমার কোনো আত্মীয়ের নাম করবারও তোমার দরকার নাই, তুমি পরিশ্রম করে যেমন করে হোক অর্থ উপার্জন কর। তোমার ঘরে যেন ভাত থাকে, দান করার জন্য তোমার হাতে যেন পয়সা থাকে, তোমার পত্নীর কাপড়ের যেন অভাব না হয়, অসাধুতা করে অভাব মোচনের প্রবৃত্তিও যেন তোমাতে না জাগে।

হযরত দাউদ (আঃ) নিজ হস্তে উদরান্নের সংস্থান করতেন। হযরত ঈছার (Jesus Chirst) (আঃ) কোনো চাকর ছিল না। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) পানি তুলতে গিয়ে ইহুদির হাতে চড় খেয়েছিলেন। ক্ষুধার তাড়নায় হযরতের পরিবার যখন ব্যাকুল, তখন তিনি পয়সা উপায় করতে গেলেন ইহুদির পানি তুলে। তিনি বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার করতে যান নি। কাউকে নিজের অভাবের কথা বলতেও যান নি। বড় বংশের ছেলে বলে পানি তুলে পয়সা উপায় করতে লজ্জা বোধ করেন নি। মূর্খেরা বাহ্য অনুকরণ করেই মনে করে যে সুন্নত। হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর কাজের অনুকরণ পালন করা হল, কিন্তু মহানবীর দীনতা, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর সৎসাহস, তাঁর মহামানবতা, তার নৈতিক বল অনুকরণ করার জন্য তাদের কোনো আগ্রহই নাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যে মহানবীর জীবনের বিশেষত্ব, সে বিশেষত্ব তোমার মধ্যে কই? সময়ের পরিবর্তনে মানুষের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন হয়, জগতের রুচি ও সভ্যতা পালন না করে চললে, লোকের কাছে তোমার শিক্ষা-দীক্ষা ও মনুষ্যত্বের আদর হবে না। পাপকে ধ্বংস করা, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, জ্ঞান আলোচনা করা, মানুষের প্রতি প্রেম পোষণ করা–এসব মহাসত্যের কোনো কালে পরিবর্তন হবে না। মানুষেরা চান–তোমাদের পবিত্র জীবন, তোমাদের মনুষ্যত্ব, তোমাদের চরিত্র।

ঘুষ খেয়ে, মানুষের উপর অত্যাচার করে যে বাড়িতে দালান দিয়েছে, ধিক তার জীবন। ধিক সেই অপদার্থ মানুষগুলিকে, যারা তাদের সম্মান করে। বাইরের চাকচিক্যের মধ্যে কী সম্মান বিদ্যমান? শুভ্র, সুরুচি সঙ্গত পোশাক এবং দেশের অবস্থা ও শিল্প বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে মূল্যবান সাজসজ্জা বেশি করে পরলে দোষ হয় না কিন্তু তাই বলে কী সেগুলি চুরি করে পরতে হবে?

পোশাক পরে মনে যদি বিন্দুমাত্র অহঙ্কার আসে, তবে সেগুলি ফেলে দাও। আল্লাহ্র কাজ করবার জন্য সুবিধার নিমিত্ত অনেক সময় পদ-মর্যাদার নিদর্শনস্বরূপ ভাল পোশাক আবশ্যক হয়; কিন্তু সত্য জীবন অবলম্বন করতে যেয়ে যদি সেগুলি না জোটে, তাতে বিশেষ কী আসে যায়? মহর্ষি টলস্টয় এত বড় লোক হয়েও খালি পায়ে বেড়াতেন, মহর্ষি জনসন নোংরা পোশাকে থাকতেন। তোমাদের শুভ্র পোশাকের পূর্বে চাই তোমাদের শুভ্র আত্মাটি–তোমার চিত্তের স্বাধীনতা–তোমার মনুষ্যত্ব।

পরিবারের মান-মর্যাদা বজায় রাখবার জন্য পোশাক পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, ডিস বর্তন, দাস-দাসী আবশ্যক, কিন্তু অবোধ জিজ্ঞাসা করি–মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে এই পদমর্যাদার মূল্য কী? যে তস্কর, যে পরস্বার্থহারী দস্যু, তার পত্নীর গায়ে সোনার গহনা, তার ছেলেদের গায়ে জরির পোশাক দেখলে মনে কি ঘৃণা হয় না?

লোকে কী বলবে? ওরে পাগল! জীবনকে পাপ, অন্যায় ও অজ্ঞানের আঁধার দিয়ে কলঙ্কিত করে ফেলছো তা তো ভাব না! ভাব লোকে কী বলবে? অন্যায় করে, চুরি করে নিজেকে সাজাতে পাচ্ছ না বলে ভাবছ লোকে কী বলবে?

মানুষের সমালোচনাকে একেবারেই উপেক্ষা কর, সৎ উপায়ে পয়সা অর্জনের জন্য যে কোনো কাজ কর। লজ্জায় যখন মুখ কাল হয়ে আসবে তখন মহাপুরুষের জীবনের কথা ভেব। কাজে কখনও মানুষের অপমান হয় না। অপমান হয়–অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকায়, অসত্য জীবনযাপনে, দরিদ্রকে সাহায্য করতে না পাড়ায়, দাম্ভিক ও অহঙ্কারী হওয়ায়।

যদি সম্মান চাও, তা হলে মানুষের দুয়ারে কুল-মর্যাদা ভিক্ষা না করে জ্ঞানের সেবা কর। জ্ঞানের বজ্রবাণ দিয়ে তুমি আভিজাত্যের মাথা ভেঙ্গে ফেল। কাজ কর, পরিশ্রম কর, কারো কাছে ঋণী হয়ো না! আমি কারো ধার ধারি না, কাউকে ধার দেই না, এসব কথা। বলে মানুষের কাছে গর্ব করা কিন্তু নিষেধ। অপদার্থেরা তোমাকে সম্মান করুক না করুক, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে সম্মান করবো। তোমার ছোট সরল। জীবনকে দেখে তোমার কাছে কেউ না আসুক কোনো ক্ষতি নাই। অসত্যের উপাসক, দুষ্ট, বদমাইশ লোককে বেশি সম্মান প্রদর্শন করো না।

হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “কেউ যদি কাপড় কেনে আর তার দেওয়া দামে যদি অন্যায়ের পয়সা থাকে, তা হলে সে কাপড় পরে সে যেন নামাজ না পড়ে।”

দরিদ্র সরল কৃষক, কামার, দর্জি, মিস্ত্রী, স্বর্ণকার, ক্ষৌরিক ও মুচি হও, সেও ভালো, তবু অসত্য জীবনযাপন করে ভদ্রলোক হতে চেও না। চিত্তের স্বাধীনতা হারিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে মানুষের কৃপা ভিক্ষা করে জীবনকে ব্যর্থ করে দিও না।

এ কথাও বলে দিচ্ছি, যে সত্য পথ অবলম্বন করে, যে বিনয়ী ও সত্যবাদী জ্ঞান পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগ রাখে, যে পরিশ্রমী, সে দরিদ্র হয়ে থাকবে না। সে বড় হবেই; তার দৃঢ়তা, তার সৎসাহস তার নৈতিক বলের পুরস্কার সে অবশ্যই পাবে।

অনবরত কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন, তোমার এই পরিশ্রমের কোনো মূল্য নাই। কলিকাতার আদিম অধিবাসী কোনো এক ব্যবসায়ী শ্রেণী যেমন পরিশ্রমী, তেমনি অর্থশালী কিন্তু এদের চরিত্রবলের খুব অভাব। এইরূপ নীতিহীন স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন মূর্খ নিকৃষ্ট জাতির পক্ষে সাজে। সভ্য ভদ্র মানুষ এরূপভাবে অর্থশালী হতে ঘৃণা বোধ করেন।

হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন–”আমার রাত কাটে এবাদতে আর দিন কাটে পরিশ্রমে”। তুর্কী সম্রাট সেলিম সারাদিন কাজ করতেন। রাত্রিতে অল্পই নিদ্রা যেতেন। সারারাত্রি বসে বসে তিনি পড়তেন। জীবনে কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে তার আনন্দ ছিল না। নারীসঙ্গ তিনি পছন্দ করতেন না।

শিবনাথ শাস্ত্রী প্রত্যহ বিশ ঘণ্টা করে পড়তেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ঘুমে পড়া নষ্ট হবে এই ভয়ে বালিশ মাথায় দিতেন না।

মাইকেল এঞ্জেলো কাজ না করতে পারলে অস্থির হয়ে যেতেন। কোনো কোনো সময়ে দুপুর রাত্রে জেগে উঠে তিনি কাজ শুরু করে দিতেন।

অর্থ পাবার লোভেই সকলে কাজ করে না। কাজ সবাইকে করতে হবে। সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দেশের মানুষের উন্নতির জন্যে কাজ করা দরকার। সম্রাট ষোড়শ লুই একখানি বই উৎসর্গ পাবার সম্মানের লোভে স্পিনোজাকে পেন্সন দিতে চেয়েছিলেন। স্পিনোজা চশমার পাথর সাফ করে জীবিকা অর্জন করতেন। সম্রাটের এই দান তিনি গ্রহণ করেন নি,–বইও উৎসর্গ করেন নি। তিনি এত পড়তেন যে কোনো সময় তাঁকে অনবরত দুই-তিন দিন ধরে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে দেখা যেত। হাঙ্গেরীর জনৈক গণিতজ্ঞ গ্রীষ্মকালে দুই ঘণ্টা এবং শীতকালে চারঘণ্টা মাত্র শুতেন। বেলী প্রত্যহ চৌদ্দ ঘণ্টা করে চল্লিশ বৎসর ধরে পরিশ্রম করেন।

যে জাতির মানুষ শ্রমশীল, যারা জ্ঞান-সাধনায় আনন্দ অনুভব করে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে। কর্তব্যজ্ঞানহীন নীতিজ্ঞানশূন্য আলসে মানুষের স্থান জগতে সকলের নিচেই হয়ে থাকে। তারা জগতে অবজ্ঞার ভার, অসম্মানের অগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতে ধন-সম্পদ জয় করতে হলে, জীবনের কল্যাণ লাভ করতে হলে, পরিশ্রম ও সাধনা চাই।

কিছুদিন আগে চিৎপুর রোডের একটা দোকানে এক টুপি বিক্রেতাকে একটা ছোট ঘরে বসে একখানা ইংরেজি নভেল পড়তে দেখেছিলাম। আমার একটু আশ্চর্য বোধ হয়েছিল। যারা লেখাপড়া না শিখে আরামে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে তারা তো বই পড়বার ধার ধারে না। তারা মনে করে এগুলি বাজে কাজ। কবে সেই দিন আসবে, যেদিন দেখতে পাব গাড়োয়ান ও কোচোয়ান বই খুলে পড়ছে, নাপিতের দোকানে রাজনীতি আলোচনা হচ্ছে।

জাতির হাজার হাজার মানুষের জীবনকে মৃত্যু হতে বাঁচাবার উপায় কী? দেশের লক্ষ মানুষ শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা মরে আছে। যে জাতির এত মানুষ মরে আছে, সে জাতি অতি শীঘ্রই শেষ সমাধি লাভ করবে, এতো কবির কল্পনা নয়। জেলখানায়, রাজদরবারে, রান্না ঘরে বা রাস্তার বিপরীতে, পাহাড়ের মাথায় অথবা সমুদ্রের উপর যেখানেই থাক না জ্ঞানরাজ্য হতে রত্ন মাণিক আহরণ করে তুমি তোমার জীবনকে সার্থক কর! তোমার কল্যাণের পথ তোমার হাতেই রয়েছে। কেন ভিক্ষুকের সঙ্কোচ নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছ? স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট না পেলে তোমার জীবনের মূল্য হবে না, কে তোমাকে একথা বলেছে? মানুষ তোমার সার্টিফিকেট দেখবে না, দেখবে তোমার জ্ঞান, তোমার মনুষ্যত্ব, তোমার নৈতিক বল, তোমার চরিত্র। মানুষ তোমার দুর্জয় শক্তির সামনে লুণ্ঠিত হবে–এ তুমি বিশ্বাস কর। তোমার উকিল মোক্তার বা স্কুলের মাস্টার হবার দরকার নাই, সুতরাং সার্টিফিকেট না হলেও তোমার চলবে। চাই তোমার মনুষ্যত্ব ও প্রাণশক্তি জাগরণ–পরিশ্রম করার ক্ষমতা। হযরত মোহাম্মদ (সঃ), ঈচ্ছা (আঃ), বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ এরা কি প্রবেশিকা অথবা বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সত্য প্রচারের শক্তি অর্জন করেছিলেন?

কলেজে যেতে পার নি, তুমি ইংরেজি জান না। তাই বলে তোমাকে মানুষ হতে কে নিষেধ করেছে? কাপড় বেচতে বেচতে কি তুমি বিজ্ঞানের আলোচনা করতে পার না? চাউলের বস্তার কাছে কি তুমি একখানা ভালো বই রেখে দিতে পার না? কেন গর্ধভের মতো সিঁথি তুলে জীবনকে ব্যর্থ করে দিচ্ছ? কাপড় বেচতে অসম্মান হয় না, তুমি যে জ্ঞান-দরিদ্র, তুমি যে অবোধ, তোমার মনুষ্যত্ব নাই, তোমার চরিত্রবলের অভাব, তুমি নিষ্ঠুর ও কটুভাষী; এতেই তোমার অপমান, অন্য কারণে নয়। জ্ঞান আহরণ ব্যতীত মানুষের কী করে কল্যাণ হবে? মানুষ না হয়ে পশু হয়ে বাঁচতে আনন্দ কোথায়? শুধু রাজনৈতিক শিক্ষায় মনকে আবেগ আকুল করে তুললে চলবে না। তোমার চরিত্রবান হওয়া চাই, তোমার মানুষ হওয়া চাই, কারণ তোমার মনুষ্যত্ব, চরিত্রবলের উপরই তোমার এবং তোমার জাতির বড় হওয়া নির্ভর করে। সমাজসেবক হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ, কিন্তু তুমি সামান্য একটু স্বার্থ ত্যাগ করতে পার না–তুমি অনাথিনী বালিকার অশ্রুকে উপহাস কর, মূঢ় তুমি। ধর্মের অর্থ বিশেষ কোনো মতে বিশ্বাস নয়–ধর্মের অর্থ মনুষ্যত্ব, জীবনের পবিত্রতা, ন্যায়নিষ্ঠা, আত্মার বিনয় ও দৃষ্টি।

এক এক কাজে এক এক জনের বিশেষ মন থাকে। যে কাজ মন চায়, তাই করা উচিত–সেই কাজে শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে জীবনকে সার্থক করতে হবে। জগতের প্রত্যেক কাজে, জীবনের প্রত্যেক সাধনার মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়া যায়। উকিল, ডেপুটির কাজ অপেক্ষা কাপড় বিক্রেতার মর্যাদা খুব কম, তা আমি মনে করতে পারি না। এক মহা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমরা অনন্ত মানুষ অনন্ত পথে অগ্রসর হচ্ছি, কাকে তুমি ঘৃণা করবে? মিস্ত্রীর নীরস বাটালির আঘাতে, রজকের কাপড়ের পাটের শব্দ, পণ্ডিতের সুললিত শ্লোকে–আমি শুনেছি একই গান। কাকে বলব, তুমি ছোট। কাপড় বিক্রেতা তার মোটা কাপড় দিয়ে দীন-দুঃখীর সেবা করতে পারে না? তার দীন উপহারে সতী বালিকার লজ্জা নিবারণ হয় না? এগুলি ছাড়া এবাদত কাকে বলে, তা আমি বুঝি না। তুমি বড় সাহিত্যিক, তুমি বড় বৈজ্ঞানিক, দিকে দিকে তোমার যশ ও গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে, তুমি শ্রেষ্ঠ কবি, প্রকৃতি মুখর হয়ে তোমাকে কেবল গান জোগাচ্ছে, মানুষ তোমাকে দেখে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ওসব দেখে আমার মনে তৃপ্তি আসে না। দীন নয়নে একটা কটাক্ষ তোমার প্রাণকে চমকিত করে তোলে কিনা? শিশুর হাসি তোমার প্রাণে আনন্দ আনে কিনা? দুঃখীর নয়নজল তোমার কর্মনিরত হাতখানি একটু কাপিয়ে তোলে কি না? তোমার গ্রামে সেই একটা দুঃখী নারীর সিক্ত চোখের স্মৃতি তোমার বুকে লেগে রয়েছে কি না? অভাগার করুণ চিৎকার তোমার কানে আশে কিনা? যদি বল আমার সময় নাই, আমি কত বড় ব্যস্ত, আমি দেশসেবা করতে যাচ্ছি, আমার চিন্তার মধ্যে কেউ বাধা দিও না, আমি বলব তোমার বিজ্ঞানের হাড়গোড়গুলি সমুদ্রজলে ফেলে দাও–তোমার কবিতার বইগুলি পুড়িয়ে ফেলো–তোমার দেশসেবার দরকার নাই, আমার জন্যে তুমি লড়াই করতে যেয়ো না। দেশসেবার নামে যেদিন সুলতান প্রথম বায়েজীদ তার নিরপরাধ ভাইকে নিষ্ঠুরের মতো হত্যা করলেন, সেদিন আল্লাহ্ নীরব ভাষায় বলেছিলেন, এর নাম দেশসেবা নয়। অবিচার করে রাজকর্ম পালন করার দরকার নাই। নিষ্ঠুর প্রাণ হয়ে কবিতা লেখবারও কোনো প্রয়োজন নাই।

ছোট লোকের ছেলে ছোট হয়, লোকে এ কথা বলে থাকে। মানুষ যাদের মধ্যে বাস করে, তাদের চিন্তা, প্রবৃত্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা মনের উপর বড়ই ক্রিয়া করে সত্য! পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমাদের আত্মাকে চেপে মেরে ফেলে। কিন্তু মানুষ কখনো এ জগতে ছোট হয়ে আসে না। যদি সুবিধা ও সুযোগ থাকে, তা হলে হীন মানুষের ছেলেও কালে বরেণ্য হতে পারে। মানুষই মানুষকে ছোট ও নিচু করে ফেলে। যে শিশু পিতা-মাতা, বন্ধু বান্ধব, দেশ ও সমাজের মানুষের কাছে জীবনে বড় কথা শোনে না, সে কেন বড় হতে চাইবে? কু-কাজ করে হীনতার পরিচয় নিয়ে আমরা চারদিককার সবাইকে যদি গৌরব করতে শুনি, তা হলে আমার দুর্বল মন ধীরে ধীরে নিচ হতে থাকবে না কেন?

সাহিত্যের কাজ মানুষকে তার চারদিককার মন্দ-শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলা, তার মধ্যে সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাহ্য করে ন্যায়, সত্য ও আল্লাহূকে মেনে নেবার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে দেওয়া।

নিজের সুবিধার জন্যে সন্তানকে নিচ ও পাপ করতে প্ররোচনা দিও না। সেতো তোমার সন্তান নয়, সে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে, আল্লাহ্র কাজ করবার জন্যে। তুমি তার সাধনা পথের সহায় হও, তার বিবেক ও সুবুদ্ধির উপর হাত দেবার কোনো অধিকার তোমার নাই।

ক্রমওয়েল প্রথম জীবনে একটা মেঠো চাষা ছিলেন অথচ শেষ জীবনে তার শক্তিতে বিলেতের শাসনতন্ত্র একেবারে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। ক্রমওয়েলের জীবন-সাধনা ইংরেজ জাতির ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।

নেপোলিয়নের প্রিয় ঐতিহাসিক জেনারেল জেমিনী প্রথম জীবনে কোম্পানির কাগজের দালাল ছিলেন। কাপ্তান কুক সুচ সুতা বেচতেন।

দার্শনিক ব্রাউন ছিলেন তাঁতী! প্রাণিতত্ত্ববিদ আলদ্রভিনদা প্রথম জীবনে জনৈক ভদ্রলোকের বালক ভৃত্য ছিলেন। জ্যোতির্বিদ পিকার্ড যখন বাগানের মালী ছিলেন, তখনই তিনি সাধনার পথ ঠিক করে নিয়েছিলেন। এঁরা প্রথম জীবনে খুব ছোট কাজ করতেন। এই ধরনের ছোট কাজ আমাদের দেশে যদি কেউ করে, লোকে তাকে ছোটলোক বলবে। ছোট লোকদিগকেই মানুষ হতে হবে। জাতির প্রাণ এরা। জাতিকে এরাই ধ্বংস করে, এরাই বাঁচিয়ে তোলে।

যে ছোট হয়ে আছ, সে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখ করো না। তোমার মস্তিষ্ক ও শরীর নিয়ে তুমি তোমার বড় হবার পথ মুক্ত করে নিতে পার।

তুমি সামান্য কাজ করছ? তোমার জীবনকে জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের গৌরব দিয়ে বড় করে তুলতে চাও? তা হলে বন্ধু-বান্ধব ও মানুষের উপহাসকে উপহাস করে জ্ঞানের আলোচনা করো। বিদেশী ভাষা পড়বার দরকার নাই–বিদেশী ভাষা জানলে মানুষের সম্মান বাড়ে এ কথা ভাববার দরকার নাই। তুমি তোমার নিজের ভাষার ভিতর দিয়েই চরিত্রবলে, সৎসাহসে ও বুদ্ধিতে বড় হতে পার! দেশের মানুষের কাছে তোমার সম্মান হবে। মানুষ তোমার স্পর্শে এসে সুখী হবে।

তুমি খেলা করে, শুধু মানুষকে সেলাম জানিয়ে, বড় মানুষকে মিথ্যা তোষামোদ করে কেন তোমার জীবনকে বিফল করে দিচ্ছ?

বিলেতে এবং অন্যান্য দেশে বহু মানুষ জীবনের প্রথম অবস্থায় খুব ছোট ছিলেন। উত্তরকালে পরিশ্রম ও জ্ঞান সাধনা দ্বারা তারা দেশের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন।

শুধু নভেল পাঠ করলে তোমার শিক্ষা পূর্ণ হবে না, নভেল, উপন্যাস, কাব্য-কবিতা তোমার মনে শক্তি, সাহস, সুবুদ্ধি ও উদ্যম আনতে পারে, কিন্তু মানবজীবন শুধু শক্তি, সাহস, উদ্যম আর সহানুভূতিতে বেঁচে থাকবে না। শক্তি আছে, কিন্তু সে শক্তি প্রয়োগ করবার পন্থা তুমি জান না; তোমার সাহস আছে, তোমার উদ্যম আছে, তোমার প্রাণে প্রেমও আছে–কিন্তু অস্ত্রহীন হয়ে সাহসী হয়ে লাভ কী? অন্ধ হয়ে উদ্যমশালী হয়ে কী ফল? হীন হয়ে প্রাণে প্রেম পোষণ করলে মানব-দুঃখের অবসান হবে না।

মনুষ্যত্ব, সৎসাহস ও চরিত্রবল অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেশের আইন, বর্তমান জগতের অবস্থা জমাজমি সংক্রান্ত মোটামুটি জ্ঞান, হিসাবপত্রের জ্ঞান–এসব শিখতে হবে, নইলে তোমার মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমার চেয়ে ছোট যারা, তাদের কাছে তোমাকে বোকা ও অপ্রস্তুত হতে হবে।

জীবনে ধনী লোক হতে পার আর না পার, জগতে বড় হতে চেষ্টা কর।

তোমার যদি বড় অভাব হয়ে থাকে–মানুষের দুয়ারে হাত পেত না। শারীরিক পরিশ্রম কর, ছোট ব্যবসা করে যদি সে অভাবের মীমাংসা হয়–লজ্জা করো না, সেই ছোট কাজ করেই তোমার অভাবের মীমাংস কর। তোমার পত্নী, তোমার মা, তোমার ছেলে মেয়েগুলিকে তুমি সুখ দাও। তোমার এ দীন জীবন দেখে আমি তোমায় ঘৃণা করব না।

এই ছোট কাজ করার সময় সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখতে হবে। তাদের বই তোমার পড়তে হবে। তোমাকে তোমার পত্নীকে, তোমার মা, তোমার বোন, তোমার কন্যা, তোমার প্রতিবেশী সকলকে ভালো কথা শুনাতে হবে। যে উপন্যাস চিত্তকে মার্জিত ও রুচিসম্পন্ন করে, সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে সমর্থ, চিত্তকে বিনয়ী, কোমল ও মধুর করে তোলে, যা আত্মার পশু-ভাব চূর্ণ করে প্রেমের মর্যাদা শিক্ষা দেয়–যা নারীর সুষমা সৌন্দর্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়–সে উপন্যাস পড়তে পারো। নানা দেশের ইতিহাস বিজ্ঞানের বই, জগতের মহামানুষ ও পণ্ডিতদের জীবনী এসব তোমাকে পড়তে হবে।

মানুষের শ্রদ্ধার জন্যে লালায়িত হয়ো না, তুমি শুধু তোমার কাজ করে যাবে। সাধনা পথে শ্রদ্ধার সম্মানের জন্য লালায়িত হলে তোমার সাধনা পণ্ড হয়ে যাবে।

মনের চাঞ্চল্য ও ধৈর্যশূন্যতা মানুষের সমূহ অনিষ্টের মূল। বছরের পর বছর চলে যাক–পল্লীর শান্ত-শীতল গৃহের বারান্দায় বসে তুমি তোমার পবিত্র নিরীহ জীবন, তোমার কর্ম, তোমার জ্ঞানানুশীলনের সাধনা দিয়ে কাটিয়ে দাও। কি ব্যবসাক্ষেত্রে, কি শারীরিক পরিশ্রমে, কি পাঠকার্যে–কখনও ধৈর্য হারিও না। যেতে দাও বছরের পর বছর–তোমার জন্যে গৌরব অপেক্ষা করছে।

তোমার ছোট সুন্দর পরিবারকে নিয়ে দরিদ্র স্বচ্ছল অবস্থায় জ্ঞানরাজ্যের সঙ্গে যোগ রেখে যদি তুমি মরে যেতে পার–তোমার জীবন সার্থক হবে।

যেখানে আছ, সেখান হতেই তোমার যাত্রা শুরু হোক–এখান হতেই তুমি তোমার জীবনকে বড় করে তুলতে পার।–কোথাও যাবার দরকার নাই।

যে সমস্ত মানুষ বিদেশী মানুষের কাছে পণ্ডিত বলে উপাধি পেয়েছে তাদের যদি চরিত্রবল না থাকে, তাদের মন যদি সঙ্কীর্ণ ও নিষ্ঠুর হয়, তাদের কাছে যেয়ো না তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করো না।

যার চরিত্রবল নাই, মানুষকে যে ভালবাসতে জানে না, অভাব যার মোটে ঘোচে না, মানুষের কাছে হীন হয়ে সম্মান ভিক্ষা করে, সে অপদার্থ শিক্ষিত হলেও সে শিক্ষিত নয়। তোমাকে জাগতে হবে। পুনঃপুনঃ বলছিইচ্ছা হলে তুমি বড় হতে পার। তুমি জাতির সেবা করতে পার। তোমার হাতে মানবসমাজের বহু কল্যাণ হতে পারে, তোমার বিরাট আত্মা, তোমার পূত, শুভ্র, চরিত্র নিয়ে তুমি আজ ঊষার আলোর পথের দিকে তাকাও। সমস্ত গগন পবন আজ তোমায় ডেকেছে। এই জড় দেহের হীন ক্ষুধাগুলি আজ চূর্ণ করে ফেল। তোমার আত্মার কিরণ দুঃখ-দগ্ধ আর্ত-পাপ নর-নারীর কাছে শুভ ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে যাক। আজ সকল পাপ-তাপ তোমা হতে খসে পড়ুক।

বাপ-মায়ের অন্ধ স্নেহ, আত্মীয়-বান্ধবদের চিন্তাশূন্য মন্তব্য তোমার আত্মাকে যেন দুর্বল না করে ফেলে। মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেবার জন্যে এই দুটির মতো পরম শত্রু আর নাই।

তুমি নিজেকে কখনও নিঃসহায় ও দরিদ্র মনে করো না। যেদিন তুমি জন্মেছিলে সেদিন আল্লাহ্ তোমাকে দু’খানি হাত, দুখানি পা আর একখানা মাথা দিয়েছিলেন–মানব জীবনের পক্ষে এই-ই যথেষ্ট সম্বল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *