২.২ তিলি মুড়ি নিয়ে এসে দেখল

তিলি মুড়ি নিয়ে এসে দেখল চালিস ঘুমিয়ে পড়েছে পিপুলতলায়। প্যান্টের তলাটা ছেড়া। সেখানে হাত চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

তিলি ডাকল, এই, কইরে চালিস না কি। ওঠ, মুড়ি নে।

চালিস এক ডাকেই উঠল। উঠেই একগাল হাসি। পরমুহূর্তেই চোখ ঘষে বলল, ও আপনি আর এক ঠাকরুন বুঝি? আমি ভাবলাম, সেই কর্তাবাবুরই বউ। মুড়ি এনেছেন? দিন। বলে, কোমরে বাঁধা ন্যাকড়াটা খুলে পাতল। মুড়ি ঢেলে দিতে তিলি অবাক হয়ে দেখল, ছেলেটা হাসছে আর তাকে দেখছে।

তিলি বলল, হাসছিস যে?

চালিস বলল, আপনি বুঝি ওই ঠাকরুনের বুইন?

তিলি হেসে বলল, কী করে বুঝলি?

চালিস একগাল হাসি হেসে বলল, এই আপনাদের ঠাটবাট দেখে। এক জাতের কি না।

তিলি লীলার মতো সব সময় খিলখিল করে হাসে না। বলল, কী ঠাটবাট দেখলি রে? 

চালিস এক মুহূর্ত চোখ পিটপিট করল। বলল, এই কথার রকমসকম, গলার স্বর। বেশ লাগে কি না আমার। বলে একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে দিল। সারা রাত ঘামে, কয়লার গুঁড়োয় আর ধুলোয় সারা গায়ে কালির দাগ।

তিলি বলল ভ্রূ তুলে, হুঁ। আর কী ভাল লাগে?

আর? বলেই মুড়ির পুঁটলি গুছিয়ে ধরল এক হাতে। অন্য হাতে পেটে চাপড় মেরে একটা বিচিত্র শব্দ তুলল, বুক, বুকং বুকুং। ভঙ্গি ও শব্দ, দুই-ই হাসিতে নাড়ি ফুলিয়ে তোলে। উসকালে বাড়বে সন্দেহ নেই।

তিলি বলল, থাম থাম। তুই জুটলি কোত্থেকে? একেবারে সিরাজদিঘা থেকেই নাকি?

চালিস বলল, না। রেলগাড়ি থেকে। ওনারা কি সিরাজদিঘা থেকে আসছেন?

তাও জানিসনে? তিলি বলল, মেঘনাদ দাসের নাম শুনেছিস, সিরাজদিঘার বিস্কুটের কারবারি?

চালিস তখনও বলল, শুনিনি আবার? অনেকবার দেখেছি।

তিলি চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠল, মিছে বলছিস যে মুখপোড়া? ও-ই তো মেঘু সা যাকে পটিয়েপাটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এলি।

চালিসের গলায় আটাকাল মুড়ির ডেলা। পিলে সুদ্ধ পেটটা কেঁপে কেঁপে উঠল বারকয়েক। তারপর কোঁত করে ডেলাটা গিলে হাসল। হলদে চোখ দুটো বড় করে বলল, ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম গো ঠাকরুন। তারপর ফিসফিস করে বলল, ঠাকরুন, মা খুড়ির মতো আপনি। একটা বিড়ি দিতে পারেন?

তিলি ভ্রুকুটি করল–বিড়ি খাওয়াও ধরেছ? গাঁট কাটতে, হাততালি আর শিস দিতে শিখিসনি? বলে জবাবের প্রতীক্ষা না করে ফিরতে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, গলিতে ছুটির ভিড় দেখা দিয়েছে। কখন বাঁশি বেজেছে টেরও পায়নি। সাড়ে দশটা বেজে গেছে এর মধ্যেই। বিজয় এসেই চান করে খেতে চাইবে। গলির ভিড়ে নজর করতে গিয়ে চোখে পড়ল বিজয়কে। হাতে ঝুলছে বড় একটা ইলিশমাছ। ফের সেই মিস্তিরিপনা। ধার করেছে নিশ্চয়ই। সে রান্নাঘরে ছুটল তাড়াতাড়ি।

চালিসের মুড়ি খাওয়া বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। সে আস্তে আস্তে উঠে উঁকি দিল ঘরের মধ্যে। দিয়েই চমকে দাঁড়াল। সিংহের মতো সেই মানুষ। বসে বসে কথা বলছে আর মুড়ি চিবুচ্ছে। সিরাজদিঘার মেঘনাদ দাস। মেঘু সা! গুনোহাটি বন্দরের বদরুদ্দিনের কারখানায় কিছু কাজ শিখেছে বটে। তা বলে মেঘু সা’র সামনে মিছে কথা। পেছিয়ে এসেই লম্বা। আর কোনওদিকে তাকাল না চালিস।

পথে বিজয় বলল, কী রে কালা গেঁড়াবাজ চললি কোথায়? গিলবে চলল, তোমার জন্যে ইলিশমাছ এনেছি।

চালিস টের পেতে দিল না যে, সে পালাচ্ছে। বলল, সত্যি? বলেই সুর করে বলে উঠল, চাখুম চুখুম চাখুম চাখুম চুখুম রে

বিজয়রা অনেকে আসছিল। হেসে উঠল সবাই। একজন বলল, এ কোত্থেকে জুটল হে

বিজয় বলল, অনেক দূর থেকে।

সবাই এগিয়ে এল। চালিস আবার পিছন ফিরে একেবারে বড় রাস্তা। মুড়িটাই যা লাভ ছিল কপালে।

তিলি চা নিয়ে এসে দেখল, পিপুলতলা শূন্য। রাস্তায় ছুটির ভিড়। মনে মনে বলল, কী ছেলে রে বাবা !

ইতিমধ্যে পাড়াটা একটু কোলাহলমুখর হয়ে উঠেছে। সকলেই প্রায় কলে কারখানায় কাজ করে। খাবার তাড়ায় এসেছে সবাই। পাড়াটা যেন নিদ্রিত ছিল এতক্ষণ। জেগে উঠল এখন। সমস্ত গলিটার মধ্যে মাত্র দুটি জলকল। সেখানে পিঁপড়ের মতো হেঁকে ধরেছে সবাই। আশেপাশে আছে গোটা দুই তিনেক পুকুর। চিংড়ি লাফানো জলের পরিমাণ তাতে। দই-পাঁক হয়ে উঠল পুকুরগুলি।

এ বাড়িটাও হঠাৎ চেঁচামেচিতে মুখর হয়ে উঠেছে। বাড়ি নয় এ গলির মধ্যে সবই প্রায় বস্তি। একলা বিজয় নয়। অন্যান্য ভাড়াটেরাও এই কলে কাজ করে। ছেলের কাঁদা, রান্নার তাড়া, জল। তোলা আর চাল ডালের হিসাবের এই যেন সময়।

লীলা তো ইলিশমাছের দাম শুনে হাঁ। আড়াই টাকা সের। হলই বা গঙ্গার মাছ। মাথায় থাক অমন গঙ্গা।

তা বললে কী হয়? কারবারি বোনাই এসেছে। ইলিশমাছের মরশুমে তো বাজারে কাটা ইলিশের এক টুকরো ল্যাজা ছাড়া কিছু আসত না। ওইটুকু গন্ধ যদি বা হয়। আজ এনে ফেলেছে একটা। এ বছরের মরশুম তো শেষ । আর কী, শ্রাবণ মাস পড়ে গেছে। বড় জোর দু টাকায় নামবে, আর একদিন আনা যাবে তা হলে।

বুক কাঁপছে সুকুমারীর। গলায় খুসখুস করে চুলকোচ্ছে। কিন্তু চিৎকার করে ঝগড়া আরম্ভ করতে পারছে না। শত হলেও মেয়ে-জামাই এসেছে এত দিন বাদে। কিন্তু হপ্তার টাকায় নিশ্চয় কম পড়বে।

বিজয়ের সে সব খেয়ালই নেই। ষোড়শীর কোল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিল ছেলেটাকে। খানিকক্ষণ হাসাল, তারপর কাঁদাল, কাঁদিয়ে আবার দিয়ে গেল সোড়শীর কোলে।

ষোড়শী একবার বিজয়কে দেখে ছেলেটিকে আবার বসিয়ে দিল মাটিতে। ছেলেটা আরও চিৎকার জুড়ল। বিজয় গলা ফাটিয়ে হেসে লীলাকে ডেকে বলল, দেখছিস তো কী রকম বউ? সে তোরা টের পাবিনে। গোবর ন্যাতা হলে কি হয়? ছেলেটাকে কাঁদিয়েছি, তাই মাটিতে বসিয়ে দেওয়া হল রাগ করে। কাঁদ কাঁদ বেটা, গলা ফাটিয়ে কাঁদ।

চারদিকে চিৎকার। অন্যান্য ভাড়াটেদের ঘরেও একই ব্যাপার। যেন কারখানা জয় করে এসেছে সবাই।

লীলা ঘুরছে এদিকে সেদিকে। বাড়িটা যেন মাঝখানে উঠোন রেখে, চারদিকে পায়রার খোপ তৈরি হয়েছে। দেখছে, ঠোঁট বাঁকাচ্ছে। পা ফেলছে টিপে টিপে। পান খুঁজেছে মুখে এর মধ্যেই। ঠোঁটটি লাল করে পানের পিক ফেলছে প্যাঁচ প্যাঁচ করে। তিলি মাছটা কুটতে যাচ্ছিল। বিজয় তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, দে নিজেই কাটি।

মাদি মাছটা, বেশ গড়ন না?

তিলি বলল, তা বেশ, কত সুদে টাকা ধার করলি?

তা কত আর বলতে গিয়েই খ্যাঁক করে উঠল বিজয়, তোর তাতে কী লো মুখপুড়ি? ভাগ, যা জল এনে দে। দ্যাখ, জামাইবাবুর কিছু লাগবে কি না। বলে সে ঝিনুক দিয়ে খস খস করে আঁশ ছাড়াতে লাগল।

তিলি মুখ টিপে হেসে বলল, ইস। বোনাই পেয়ে যে একেবারে মেতে গেলি রে দাদা।

থমকে গেল বিজয়। হঠাৎ গম্ভীর আর করুণ হয়ে উঠল তার মুখ । বলল, দ্যাখ তুমি, শত হলেও একটা মিস্তিরি মানুষ। কারবারি বোনাই। না খাওয়ালে লোক কী বলবে, বল? এক দিন দু। দিন তো। তারপর তো হাঁড়ি ভেঙে যাবে, বোনাই শালা সবই বুঝবে, তার বিজা-শালার ট্যাঁকের দৌড় কত? দু দিন যাক না। বলেই গলা ছেড়ে নিজের বউ ছেলেকে দেখিয়ে বলল, ইমি, মা ষোড়শীকে ওর গণেশের কান্না থামাতে বল। নইলে শালার দুটোর গলাতেই পা দেব, মাইরি। বলছি।

ঠুমি তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে কোলে নিল। বলল, বউ, তুই দাদাকে জল দে।

তারপর লীলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রান্না চেপেছে সকলের। সকলের ঘরের পাশে এক ফালি করে বারান্দা। কাঁচা বারান্দা। সারি সারি উনুনের পাশে ভিড় করেছে সকলে। লীলা সকলের রান্না দেখে দেখে বেড়াচ্ছে।

.

ঘরের মধ্যে জামাই শ্বশুরের তখন ঘোরতর আলোচনা চলছে। মেঘনাদের ব্যবসায়ের কথাই উঠেছে। সে ঢাকার ব্যবসায়ের কথা বলছে। বিস্কুট রুটি তো দূরের কথা। বাকরখানিওয়ালাদের। তন্দুর (উনুন)-গুলি কুকুরের আস্তানা হয়েছে। মনে হয় না যে, এ দেশে বাকরখানি তৈরি হত। কোনওকালে। সপ্তাহে একদিন কোনও কোনও দোকানে বাকরখানি তৈরি হত। তাও চোরাবাজারের ময়দা দিয়ে। দাম ডবল। এ সব ছোটখাটো কারবারিদের সরকার এক চিমটি আটা ময়দারও পারমিট দেয়নি। শত হলেও বাকরখানি তো। কোথাও তৈরি হচ্ছে শুনলে সেখানে লোকে লাইন দিয়েছে। একেবারে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

অধিকাংশ কারখানা তো বন্ধ-ই। হাতে গোনা যেত ঢাকার কারবারিদের। বাদবাকি সব দোকান গুটিয়ে অন্য কাজে ভিড়ে পড়েছে। অগুনতি পাইকের বেকার হয়েছে। মাল বেচে খাওয়া, তাও সইল না। ভিক্ষের ঝুলিও উঠেছে অনেকের কাঁধে। বাপরে বাপ! কী যুদ্ধ! গোলা ফাটল তো এদেশে দুটো। তার গ্যাস এত? রায়সাহেবের বাজারের কারবারিরা তো সরকারের ময়দার গুদাম লুট করারই মতলব করল একবার। টের পেয়ে গেল। সব্বাইকে ধরে একেবারে জেলে। ওরা বলল, সে-ই ভাল। কাজ কারবার বন্ধ, জেলে থাকা তবু ভাল। মেঘনাদের তখন অবশ্য ভালই অবস্থা। সপ্তাহে পনেরো থেকে কুড়ি মন ময়দার কাজ হয়েছে।

নকুড়ের বুকের মধ্যে ধুক ধুক করে। কুড়ি মন ময়দার কাজ? তা হলে মন পিছু কত লাভ? হিসাবে দড় নকুড়। কিন্তু মেঘুর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। সে তখন নতুন প্রসঙ্গ পেড়েছে। এই যখন ঢাকার ব্যবসায়ের অবস্থা, সেই সময়, এক সাহেব টিকাটুলির ওদিকে নতুন কারখানা খুলে বসল। কলকাতায় যে মস্তবড় সাহেবি বিস্কুটের ফ্যাক্টরি আছে, তার সঙ্গে ঝগড়া করে সাহেব ঢাকায় গেছে। পাঁচ বিঘা জমির উপরে পেল্লায় কারখানা খাড়া হল। কুড়ি বিঘা জুড়ে তার ঘেরাও পাঁচিল। লাখ টাকার মেশিন এসে পড়ল বিলাত থেকে। সকলের টনক নড়ে গেল। ঢাকা, ময়মনসিং, চাটগাঁ, সকলের কী হুতাশ ! যেন বৃষ্টি না নামতেই সবাই মাথায় ছাতা খোলার উপক্রম করল। মেঘনাদও চিন্তিত হয়েছিল বইকী! মনে হল যেন, এতদিনের সাজানো বাগানে মত্ত হাতি আসছে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে। চারদিকে রটে গেল, এবার হাতুড়ে ব্যবসা উঠল।

কলকাতার সাহেব কোম্পানিকে ময়দা সাপ্লাই করছিল স ওয়ালেস। স ওয়ালেস নামটা অবশ্য মেঘনাদের মুখ থেকে বেরুল সালেস। ঢাকার সাহেবকে সাপ্লাই দিতে আরম্ভ করল স্বয়ং ইস্পাহানি। সাহেবের কারখানা। তার সবই অন্যরকম। নতুন রকম, নতুন নতুন সব কায়দা। টিনের কৌটা আর ঝালাইয়ের কাজের জন্যই প্রথম তোক নেওয়া হল পঞ্চাশজন। যাকে বলে ছিট মাল, অর্থাৎ মচমচে বিস্কুট, তাতে দুধের দরকার। দরকার, কিন্তু অত খরচ করবে কে? পড়তা পড়বে না যে ! কিন্তু সাহেব কোম্পানি। আশেপাশের বহু গয়লার তো মাসকাবারি বন্দোবস্ত হয়ে গেল।

তারপরে প্রথম মাল বেরুল। সেই সঙ্গে কাগজ ছাপিয়ে বিলি হল। ঘোড়ার গাড়িতে ড্রাম পাইপ বাজিয়ে, সারা শহরে ছড়িয়ে দিল কাগজ। ইংরেজি আর বাংলায় লেখা ছিল সেই কাগজে, বিস্কুটের নানান কথা। দেওয়ালে দেওয়ালে ছবির কাগজ। মেমসাহেব আর সাহেব সেই বিস্কুট খাচ্ছে, এই রকম সব ছবি। দোকানে দোকানে নমুনা মাল বিলি হল। সবাই দেখতে লাগল, চাখতে লাগল।

ঢাকার কারখানাগুলির অনেকে গেল, সাহেবের মশলার কারসাজিটা যদি জানা যায়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ও ব্যাপার দেশি কারখানার মতোই গোপন। কেউ-ই জানতে পারবে না। কলকাতা থেকে এক বাঙালি এসেছেন, তাঁর মাইনেই নাকি, পাঁচশো টাকা। একটা ঘরে বসে তিনি শুধু মশলা তৈরি করেন। আর কারুর প্রবেশাধিকার নেই সে ঘরে। একমাত্র স্বয়ং মালিক সাহেব ছাড়া। কারখানার অন্যান্য লোক তো দূরের কথা !

তারপর বাজারে বেরুল মাল। পাইকেররা ঘিরে ধরল কারখানা। লেখাপড়া-জানা কোট প্যান্ট-পরা ভদ্রলোক নমুনা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামান্তরে, হাটে ঘাটে বন্দরে। বলতে বলতে মেঘনাদের বোধ হয় বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল। ঘরের অন্যদিকে জটলা, হাসাহাসি, অনেক কথা। বিজয়ের হেঁড়ে গলার চিৎকার। শিশুর কান্না। একটি-ই তো ঘর। ঘরের কোলেই রান্না। মাথায় টিনের শেড, গোলমাল রীতিমতো প্রতিধ্বনিত হয়।

কিন্তু মেঘনাদের সে সবে কাজই নেই। নকুড় শুনছে, কিন্তু শোনার মতো নয়। অনেক কথা তার কান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবু সে মাঝে মাঝে হাঁ হুঁ আচ্ছা দিয়ে চালাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, এ শুনে কী লাভ! মেঘনাদের তাতে কিছু হয়েছে কী? মেঘনাদ বলল, কিন্তু দেশের মানুষকে তো সাহেব চেনে না। আলটপকা কারখানা খুললেই তো হল না। কারা রটিয়ে দিল, বিস্কুটে নাকি গরু শুয়োরের চর্বি মেশানো হচ্ছে। চর্বি কে না মেশায়? ঢাকার মুসলমান কারখানাগুলি গরুর চর্বি কি আর না মেশায়? শুয়োরের চর্বি বরং ব্যবহার-ই হয় না। ব্যবহার যদি করতেই হয়, ঘিয়ের ব্যবহারই নিয়ম। কিন্তু এ আকালের দেশে সে কথা কেউ কল্পনা করতেও পারে না। ভাতের পাতে ঘি জোটে না, আবার রুটি বিস্কুটে। সে হত নবাবি আমলে। কারখানাগুলিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দালদা কোম্পানি শস্তায় ঘি বের করে। সাহেব ফ্যাক্টরিতে দালদা-ই ব্যবহার হচ্ছিল। কিন্তু গুজব বড় বিচিত্র জিনিস। মানুষ সব ফেলে আগে ওইটে শোনে। শহরের লোকেরা ছাড়া, গ্রামের লোকেরা প্রায় বাতিল করল সে বিস্কুট। তারপর দাম? কদর না বুঝলে লোকে দাম দিতে চায় না। মেঘু শুধু কারবারি নয়, হাতেনাতে কাজ জানা কারিগর। সে তো জানে সাহেবের বিস্কুট কী জিনিস ! বিস্কুটের গায়ে বাইরের হাওয়া লাগে না। বাইরের আলো দেখতে পায় না। তৈরি হয় আর সঙ্গে সঙ্গে টিনজাত। একেবারে রাং ঝালাই সঙ্গে সঙ্গে।

পড়তা অনুযায়ী দাম দিতে হবে তো ! বাজারে মাল ছাড়লে কী হবে? বাজার ছাড়ে না। বাজারের পা ভারী। ঠেলেঠুলেও চলে না। কায়েমি হয়ে সে দোকানে বসে রইল। এদিকে পাইকেররাও গণ্ডগোল আরম্ভ করল। তাদেরও পড়তা পড়ে না। তারপর সব সময় নগদ টাকায় মাল নেওয়া সম্ভব নয়। কারবারীর সময় অসময় আছে। বিশ্বাস করে ধারে দিতে হবে। কিন্তু ধারের ধার ধারে না সাহেব কোম্পানি। আগে কারবার জমুক। পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপিত হোক, তারপর ভাবা যাবে ধারের কথা।

পাইকেররা সরে পড়ল। সাহেবের এজেন্ট ঘুরতে লাগল। সর্বত্র। বাঁশের বেড়ার এমনি গুণ। সেই বংশ্যবনিকা ঠেলে, এগুয়, সাধ্য কি। শুধু নামে কি আর মাল কাটে। নাম, ভার, ধার, সবই চাই। দুই ধার, একটা কাটবে আর একটা দেবে। তা ছাড়া দাম মস্ত বড় কথা।

সাহেবের মাল ছুটল কলকাতার দিকে। তারপর শোনা গেল, কারখানাসুদ্ধ উঠে যাবে কলকাতায়। কিন্তু গেল না। কিছুদিন পরে শোনা গেল, সাহেব কারখানা বিক্রি করে দেবে। শাঁখ বাজার আগেই হরিধ্বনি উঠল। অর্থাৎ আঁতুড় ঘরেই সন্তান মারা গেল।

বিক্রির কথা শুনে চনমন করে উঠল মেঘনাদের মন। একবার দেখে আসতে দোষ কী?

হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল নকুড়। এতক্ষণ শুনছিল আনমনে। তার কানে গেছে, বিজয় ইলিশমাছ এনেছে। মাছ কাটা আর ভাগাভাগির কথা শুনছিল সে থেকে থেকে। নকুড়ের বাপ মাছ খেত না : বংশ তাদের পরম বৈষ্ণবের। নকুড়ের সময় থেকে নিরামিষ খাওয়াটা বিলাসিতা হয়ে উঠেছিল। শুধু তো কচু, হিঞ্চে, কলমি। আলু কপি পটল জাতীয় তরকারি সোনাদুলির চরের মানুষ চোখে দেখে কম ! খায় আরও কম, তার জন্য নগদ পয়সার দরকার। সিরাজদিঘার হাট না হলে পাওয়াও মুশকিল ছিল। কচু হিঞ্চের সঙ্গে খালবিলের পুঁটি মৌরলা চিংড়ি কিংবা শোল বোয়াল সিং কই পরম উপাদেয় মাছ হয়েছিল। অভাব আর জিভের আস্বাদের কাছে দুই হার মানে বইকী। নকুড়ের বাপ থাকতে ওসব বাড়িতে ঢুকত না বড় একটা। ছেলেমেয়েরা ধরেছে কোঁচড় ভরে। পরের বাড়িতে দিয়ে এসেছে, কলাপাতায় করে রান্না মাছ নিয়ে এসেছে, লুকিয়ে খেয়েছে। নকুড়ও খেয়েছে, বাপ মরার পর অবাধ স্বাধীনতা। গলায় তুলসীর মালাটা ছিল, তাতে পুঁটি মৌরলার স্বাদ তেতত লাগেনি ! আঁশের গন্ধে যে এত খিদে পায়, তা কে জানত।

আজকেও আঁশের গন্ধটা ছড়িয়ে গেছে একটু বেশি। নকুড়ের মোক্ষম ইন্দ্রিয়গুলি ওদিকেই ধাবিত হচ্ছিল। পুরো একটা ইলিশমাছ এসেছে। কিন্তু হঠাৎ সে চমকে উঠল। কান খাড়া করল। কথার দিকে। হঠাৎ একটা ছিদ্র পেয়েছে যেন কালনাগিনী লখীন্দরের বাসর ঘরে। এই ছিদ্র হচ্ছে, মেঘনাদের অন্ধকার রন্ধ্রে প্রবেশের মুখ। মেঘনাদের আসল পাল্লা, সেখানে তার ওজন ঠিক কাঁটায় । কাঁটায় মাগা আছে। অর্থাৎ মেঘনাদের টাকার অঙ্ক। সাহেবের কারখানা কেনার জন্য যার মন কেমন করে, তার কত টাকা থাকতে পারে, নকুড় সে অধ্যবসায়ে মেতে উঠল। লাখ টাকার উপরে তো মেশিনেরই দাম ! নকুড় তুলসীমালা খুটতে লাগল ঘন ঘন। মেঘনাদ বলল, দেখে আসার আগেই শোনা গেল নিলাম হবে কারখানা। সব এক সঙ্গে নিলে বেশ শস্তাতেই হয়ে যাবে মনে হল। আর মেঘনাদের মনে এইটিই বড় সাধ । যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ হবে, সাহেব যা পারে, দেশের লোক তা পারবে না কেন? সাধনা থাকলে সিদ্ধি লাভ হয়, লালমিঞা বলত। নজর চড়িয়ে কাজ করতে পারলে দেশের কারখানাগুলিও সাহেবি কারখানার মতো হয়ে উঠতে পারে। দেশি কারখানায় হাতের কাজে মাল নাই বেশি। সাহেবি কারখানায় এক চিমটি ময়দা নষ্ট হওয়ার উপায় নেই। একদিকে মেশিনে, আর একদিকে সাফাই। কী রকম সাফাই? উঠতে বসতে যোয়া মোছা। মাথায় হাত মোছা চলবে না। আর শয়তানি করলে চলবে না। লালমিঞা বলত, তুই এক শয়তান, তোর মাথার উপরে আর এক শয়তান। তারপরে ঈশ্বর। খবরদার! ভেজাল দিয়ো না।

মায়ের কোল ধামসে ধামসে ছেলে বিস্কুট খেতে চাইবে। মা কিনে দেবে, সে বিস্কুট তৈরি হচ্ছে তোমার ঘরে। ছেলেকে বিষ খাওয়াবে? রোগে পড়ে আছে মানুষ। মেঘনাদের বিস্কুট খেতে চাইবে সে, তুমি শয়তানি করলে সে মরবে। খুন করে পয়সা রোজগার করবে? পাল্লা ঠিক রাখো, কাঁটা যেন এদিক ওদিক না হয়। লাভের দিকে যেন ঝোঁকটা বেশি না পড়ে। আবার বিস্কুট রুটি খাওয়াতে গিয়ে রসগোল্লা হাজির কোরো না। তা হলে ন্যায়ের কাঁটা এমন ঝুঁকবে, তোমাকে নিয়ে ঝুঁকবে একেবারে।

সাহেবি কারখানাগুলি এ নীতির অর্ধেক মানে। তাইতেই দেশের টাকা গলগল করে চলে যাচ্ছে। দেশের মানুষ পুরো নামলে, গলগল করে টাকা খাওয়া বন্ধ হবে। দুটো টাকা ঘরে থাকবে, কিন্তু দোকান ব্যবসায়ীরা সিকি মানতে রাজি আছে কি না সন্দেহ। ভেজাল বিক্রি করে তরে গেলে মা কালীর পূজা দিয়ে আসে।

সাহেবরা কি জাদু জানে ! মন্ত্র পড়ে দেয় নাকি মালে। যেন খেলেই মানুষ ভুলে যাবে ! মেঘনাদের সাহস ছিল, ইচ্ছা ছিল সে মেশিন নিয়ে কাজ আরম্ভ করবে। সিরাজদিঘার কারখানা এমনিতেই সে ঢাকায় সরিয়ে নেবে ভাবছিল। সাহেব কারখানা নিলাম হবে শুনে বিপিনকে নিয়ে। ঢাকা শহরে যাওয়ার উদ্যোগ করল। টাকার দৌড়ে পারবে কি না, সে তো পরের কথা। ডাকটা শুনে আসতে আপত্তি কী। একলা মেঘনাদের পক্ষে তো সম্ভবও নয়। অত বড় কারখানা, বিশ বিঘা জমি, বাড়ি, সাহেবের বাংলো, মেশিন। কিন্তু যাওয়া হল না।

এদিকে এই ব্যাপার। অন্যদিকে তখন দাঙ্গার ছুরি শাণাচ্ছে গুণ্ডারা। যাওয়ার দিনেই লেগে গেল, ব্যাপার তো এই পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। ভাগ্যে এখনও কী আছে!

মেঘনাদ নীরব হল, নকুড় মশগুল নিজের ভাবনায়। একলা নয়, মেঘনাদ দোকলা কিনতে চেয়েছিল সাহেবের কারখানা। অবশ্য নিলামে, তাই যদি হয়, নিলামে দশ টাকার মাল আড়াই টাকায় দাঁড়ায়। খদ্দের বেশি হলে কপাল ফিরতে পারে নিলামওয়ালার। বিস্কুট কারখানার খদ্দের আর কত হতে পারে। তাও অত বড় কারখানা, সাহস আছে ক-জনার।

তা হলে কত? কত হতে পারে মেঘনাদের পুঁজি। পঞ্চাশ হাজার থেকে করতে হয়। আশি হাজার থেকে লাখখানেক ! কিংবা তারও বেশি দেড় লাখ ! মেঘনাদ সিরাজদিঘার অতবড় কারবারি, মরতে মরতেও লালমিঞা তাকে কিছু দিয়ে গেছে। হাত সামলাল নকুড়, খুটতে খুঁটতে তুলসী মালা ছিঁড়ে যাচ্ছিল প্রায়। আবেগ চাপতে পারল না নকুড়, হঠাৎ বলে উঠল, বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো। মা লক্ষ্মী মুখ তুলে চান তোমার দিকে। সাহেব কারখানার মতো কারখানা তুমি যেন খুলতে পারো। দেশে তোমার মান হোক। তুমি জন্ম জন্ম মাকে ইট পেতে বসাও। সা বংশের শিরোমণি হবে তুমি। তোমার বাপ অনেক চেষ্টা করেছে। করে করে প্রাণটাই দিয়েছে। বলতে বলতে নকুড়ের গলা ধরে এল। বলল, আমি বড় শক্ত, পাথরের চেয়ে শক্ত। আমার প্রাণটা গেল না। এ বয়সেও বেঁচে অনেক কিছু দেখতে হচ্ছে আমাকে। নিজে কিছু করতে পারলাম না। ছেলেগুলি সাবংশের কুলাঙ্গার হয়েছে। বিজাকে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছ। কুলি মজুর হয়ে গেছে। এই বস্তিতে বাস, অনন্তটার বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল। থাকলে কী হবে। এই কলকারখানার বাজার ওটাকে একেবারে খেয়ে ফেলেছে। বসন্তর কথাও শুনেছ বোধ হয়। কী যে পাপ করেছিলাম। হে ভগবান, হে ভগবান!

মেঘনাদ কী রকম বোকা হয়ে উঠল। দুঃখে সান্ত্বনা দেওয়াই তো উচিত। সে অনুভব করতে পারে। বলতে পারে না। কী যে বলতে হয়, সেটাই আয়ত্ত করতে পারেনি আজও। তার তামাটে। মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল আরও। যেন, নিষ্ঠুর হয়ে উঠল তার মুখভঙ্গি।

নকুড়ের হাতটা নিশপিশ করতে লাগল। মেঘুর হাত ধরতে চায় সে। পারছে না। লজ্জা করছে। তা ছাড়া, মনটি তার পরিষ্কার নয়। এটুকু সে পরিষ্কার বুঝেছে। তবু, মেঘনাদের হাতে হাত ঠেকে গেল তার। বিদ্যুতের মতো সে স্পর্শ। মেঘনাদের বলিষ্ঠ মূর্তিটাকে ভয়ও হয় নকুড়ের। বলল, এই অলক্ষ্মীর ঘরে তুমি এসেছ বাবা। তোমার ছোঁয়ায় যেন এ ঘরে লক্ষ্মী ফেরে। দেখে শুনে আমার সাপুরদের যেন মন ফেরে। জানি না, এ অভাবের সংসারে তুমি কেমন করে থাকবে।

কে যেন চাপা গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল। চমকে উঠল নকুড়। চমকে ক্রুদ্ধ চোখে সে ফিরে তাকাল। উঃ, ধ্বকধ্বক করছে বুকের মধ্যে। যেন সে কী এক বিরাট কার্যোদ্ধার করতে যাচ্ছিল। এক ভয়াবহ অমঙ্গলের মতো খিলখিল করে হঠাৎ বেজে উঠল হাসি। দেখল তুমি ঝুমির বুকে লুটিয়ে পড়ে হাসছে।

নকুড়ের কুঞ্চিত-চামড়া মুখ ভয়ংকর হয়ে উঠল। সে কী একটা বলে উঠতে গেল চেঁচিয়ে। সামলে নিল পরমুহূর্তে। সামলাতে গিয়ে কেশে উঠল ঠরঠরে গলায়। ঝুমি রয়েছে। ঝুমিও হাসছে। যদি সে রাগ করে। দাঁতহীন মাড়ি ঘষে খালি মনে মনে বলল, হারামজাদি ছেনাল।

মেঘনাদের গোঁফের দু পাশে গভীর দাগ পড়ে গেছে হঠাৎ। নকুড়ের জন্য সে ব্যথিত হয়ে উঠেছে। সে বলতে চাইছিল কিছু। বলতে চাইছিল, যদি সে এ সংসারেই থাকে, তাতে ভাববার কী আছে। খুব ভাল ভোগে, সুখে কিংবা সোহগে তো কোনওদিনই থাকেনি। অভ্যস্তও নয়। ও সবের বাড়াবাড়ি হলে তার অস্বস্তিই হবে। বিয়ের পর তাকে কেউ কোনওদিন সামনে বসে খাওয়ায়নি। তার জন্য যে বিরাগ কিংবা অভিমান, সেটুকুও কোনওদিন রপ্ত হয়নি জীবনে। লীলা গোড়া থেকেই সেটুকু না করে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। সে চিৎকার করে ডেকে বলেছে, আর দুটি ভাত চাই যে ! ভাত দিয়েও লীলার বসবার সময় হয়নি। কিংবা ইচ্ছে হয়নি। এখানে আসার চারদিন আগেও নিজের হাতে নিয়ে খেয়ে এসেছে মেঘু। এঁটো পরিষ্কার করে ফেলে রেখেছে থালা। একটি নমঃশূদ্র মেয়ে কাজ করত। সে ধুয়ে দিয়েছে। কেউ কোনওদিন কোঁচানো কাপড়টি বাড়িয়ে দেয়নি হাতের কাছে। কাপড় ময়লা হলে হয়তো বিপিন বলেছে। অথবা আর কেউ। লীলাও বলেছে। হঠাৎ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে নাকে কাপড় চাপা দিয়েছে। উঃ! কী গন্ধ ! বলে ঘরের থেকে ফরসা কাপড় এনে ছুড়ে দিয়েছে। বলেছে, ঘরে মেয়েমানুষ আছে সেটা মনে রেখো।

মনে ছিল না নাকি? গদিতে বসতে গিয়ে তো বার বার মনে হয়েছে, আর এক জন আছে সে বাড়িতে। সে ঝুমি! ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে যে ঘর সে তুলেছে, সেই ঘরে কে আছে সে ভুলবে কেমন করে। তবে সে যে ভোলে না, এটুকু জানতে দিতে চায় না সে নিজেকেও। তাকে বাড়িতে ডেকে যে কেউ আদর আপ্যায়ন করেনি কোনওদিন, তার জন্য সে অভিযোগ করেনি কখনও। কখনও কখনও বাড়িতে ঝুমির অভাববোধ হলে সে হেসেছে হ্যাঁ হ্যা করে। অভাব না হোক, অভাবহীনতার মধ্যে থেকেও তার জীবনে পরিবর্তন হয়েছে কতটুকু। তার কোনও কষ্টই হবে না এখানে থাকতে।

মেঘনাদও ফিরে তাকাল তিলি লীলার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেই ফেলল, হাসছ যে তোমরা? কী হল?

তাতে হাসিটা বাড়ল আরও। তিলি বলেই ফেলল, তোমাকে দেখে।

সত্যি তাই। তাকে দেখেই হাসাহাসি করছিল তারা দুই বোন। লীলা বলছিল, ওই দ্যাখ, দেখছিস তো। নিজের কারবারের কথায় জামাই-শ্বশুর কেমন মেতে গেছে। এখন তুই হাজারবার এখান দিয়ে যাতায়াত কর, তোকে চোখেও দেখতে পাবে না। এ বাড়িতে আগুন লাগলেও টের পাবে না।

তিলি আবার সেটুকু পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে। বারকয়েক সামনে দিয়ে যাতায়াত করেছে। মেঘুর খেয়াল হয়নি। মুড়ি খেতে খেতে কখন মেঘুর থালা খালি হয়ে গেছে, সে টের পায়নি। খালি থালাটাই হাতড়েছে বারকয়েক। তিলি বলেছে, আহা, বেচারির আরও দুটি মুড়ির দরকার ছিল গো দিদি।

লীলা বলেছে, তোর মুণ্ডু। ও কি খিদেয় খাচ্ছে নাকি? কী খাচ্ছে সেই খেয়ালই নেই। দশ থালা দিলে তাই খেয়ে নেবে।

তিলি গিয়ে খালি থালাটি তুলে নিয়ে এসেছে। মেঘু টেরও পায়নি। তখন থেকে দুই বোন হাসাহাসি করছে।

মেঘনাদও হেসে উঠল। নিঃশব্দ হাসি। সে হাসিতে তার মুখটা বোকা বোকা দেখাতে লাগল ।

তিলি হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, তোর লোকটাকে কিন্তু দিদি ভালমানুষই মনে হচ্ছে।

লীলা বলল, হ্যাঁ কী রকম ভাল, সে ঘর করলেই বুঝতে পারবি।

ওদিকে বিজয়ের চিৎকারে কান পাতা দায়। সে একাই একশো। মাছ কুটে এখন আবার বাটনা বাটতে বসেছে। এতক্ষণ কারখানায় খেটে এসেও তার ক্লান্তি নেই। মা বউ দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। উনুনে তেল ফুটছে। অন্যান্য ঘরণী পাশাপাশি যারা রান্না করছে, তারা সবাই হাসছে। বিজয়ের কাণ্ড দেখে।

এটা রসাধিক্যের ব্যাপার নয়। বিজয় মানুষটি একটু ওই রকমই। হেঁকে ডেকে চেঁচিয়ে, প্রাণ খুলে দশটা কথা বলে, দু ঘা মেরে, পাঁচটা গালাগাল দিয়ে চলে সে। বাটনা বাটতে বাটতেই মনে। মনে হাসছে আর আপন মনে বলে চলেছে, কী করব । কপাল ! শালা এমন মেয়ের সঙ্গেই বাপ মা বে দিয়েছে, উনি আবার মিস্তিরির বউ হতে পারবেন না। গলায় কণ্ঠী বোষ্টম আর মুদি হলেই উনি ভাল বাটনা বাটতে পারতেন।

বলে আড়ে আড়ে দেখছে বউয়ের মুখের দিকে। সে বেচারি ঘোমটার আড়ালে এতক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ছিল। এবার নিঃশব্দে জুড়েছে কান্না।

সুকুমারী ভাবছিল অন্যরকম। এক তত তিলির গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো ভাল লাগছে না। কে জানে, দুটিতে গলাগলি করে, ছেনালের মতো হেসে গলে কী ফুস ফুস গুজ গুজ করছে। তার উপর বিজয়ের এই কাজ। সুকুমারী জানে। এ সব হচ্ছে বউকে কাজের চাপ থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। খেতে জোটে না, শুতে রাঙ্গা মাটি। হারামজাদা বোনাইয়ের জন্য সোহাগ করে ইলিশমাছ নিয়ে এসেছে। এখন বউয়ের সোহাগে বাটনা বাটতে বসেছে। লজ্জা করে না।

কিন্তু প্রাণ খুলে চেঁচাতে পারছে না আজ সুকুমারী, শত হলেও জামাই রয়েছে। অনেক দিনের হলেও জামাই তাদের কাছে নতুনই।

ঘরের মধ্যে তিলি বলল মেঘুকে, তুমি যে ওখানেই খুঁটি পুঁতে বসলে। এসো, দেখে যাও তোমার শালার কীর্তি।

মেঘনাদ উঠে এল। দুই বোনের সঙ্গে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বিজয় হো হো করে হেসে উঠল। এতক্ষণ সে আপনি আপনি বলেছে মেঘনাদকে। এবার তুমি করে বলল। বলল, দেখছ তো, কী রকম সংসার করি? ওই যে দেখছ ঘোমটা ঢাকা তোমার শালাজটি, ও সব ঘোমটার মধ্যে খ্যামটা। শালা ভাজার মাছ এপিট ওপিট করে খায় ঠিক।

বলেই খ্যাল খ্যাল করে হাসি। তার পরেই গাঁক করে উঠল, এই ঠুমি পেতনি বনুইকে তেল গামছা দে। রাত জেগে এসেছে, লোকটা খাবে শোবে না?

তিলি বলল, তোকে আর বলতে হবে না সে কথা। কোথায় নিয়ে যাবি নাইতে? জংলা পুকুরে?

বিজয় বলল, তা ছাড়া আর কোথায় যাব? গতর খাঁটিয়ে যদি জল তুলে রাখতিস কলের, তা হলে না হয় বাড়িতেই হত।

মেঘুকে বলল, পুকুরে নাইতে পারবে তো?

মেঘনাদ বলল, নদী পুকুরেই তো চিরকাল নেয়ে আসছি। কলের জল কি সইবে?

তাই বলো! বলে, বাটনা বাটা শেষ করে উঠল বিজয়। লীলাকে বলল, তুই চল, নেয়ে আসবি।

তিলি বলল, তবে কি তোরা একলা যাবি? আমরা দু জনেই যাব।

চারজন চান করতে চলে গেল। সুকুমারী জ্বলন্ত চোখে ফিরে তাকাল বউয়ের দিকে। একটা খালি বালতি এগিয়ে দিয়ে বলল, কলে গিয়ে ভাজা লাগাও, সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না।

কাঁখে ছেলে, হাতে বালতি নিয়ে বউ চলে গেল রাস্তার দিকে। তখনও চোখে তার জলের দাগ। কাপড় খসে গেছে অর্ধেক বুক থেকে। ফাটা ফাটা নীল শিরাবহুল দুধোলো স্তন বেরিয়ে পড়েছে একটি। ছেলেটি মুখ ঘষছে সেখানে। ঘোমটা উঠে গেছে অনেকখানি। কলে এসে রোদ মাথায় করে দাঁড়াল। জলকলের চারপাশে বালতি কলসি ছড়ানো। জল পেতে অনেক দেরি।

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে, অদূরে গাছতলায় গিয়ে বসল সে। মাথায় কাপড় রেখে, বুক দুটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ফেলল। তারপর ছেলেকে মাই খাওয়াতে খাওয়াতে গাছের ফাঁকে ফাঁকে তাকাল উত্তর। দিকে। ওদিকেই জংলা পুকুর। যেখানে বিজয় গেছে চান করতে।

সুকুমারী এসে দাঁড়াল নকুড়ের কাছে। এবার চোখাচোখি হল পরস্পরের। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নকুড় বলল, ব্যবসা করার মতলবেই এসেছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না, অবস্থা কী রকম।

লীলার কথা বলছে নকুড়

সুকুমারীর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। সে ঠিক কালো নয়। খানিকটা মাজা মাজা রং। ছেলেমেয়েরা কেউই প্রায় তার রং পায়নি বোঝা যাচ্ছে। অনেকটা পেয়েছে বোধ হয় তিলি। সিঁথি বরাবর চুল উঠে টাক পড়েছে তার। কপালটা চওড়া। সিঁথিতে কপালে সিঁদুর মাখা। নকুড়ের মতো তারও সারা মুখে কুঞ্চনরেখা ভরতি। বয়স হলেও শরীরের বাঁধুনি বেশ বলিষ্ঠ সুকুমারীর। চোখ বড় করে ফিসফিসিয়ে বলল, মেয়ে আমার, তোমারও। জানিনে জামাইয়ের সঙ্গে কী রকম সম্পর্ক। নিজের মেয়ে হলেই বা কী। ভাবভঙ্গি বাজারের ছেনালের মতো। ওর চরিত্র ভাল নেই, আমার মন গাইছে । দেখে নিয়ে তুমি । ওর কথায় যে জামাই চলে, তা আমার মনে হয় না। মনে নেই, এ মেয়ের কথা?

চকিতে একবার চোখাচোখি হল নকুড় সুকুমারীর। দু জোড়া চোখ আবার ঘুরে গেল চারদিকে। নকুড়ের মনে পড়ল সোনাদুলি চরের সেই সব কথা। লীলার কথা। বলল, মনে আছে। ওর কী দোষ বলো। কিন্তু জামাইয়ের সঙ্গে… কী জানি, কী রকম ওদের ব্যাপার।

সুকুমারী হঠাৎ বলল, কোনও পাপ করছি কি আমরা? মাথার উপরে ভগবান আছেন।

নকুড়ের গলার শিরাগুলি কেঁপে উঠল। তুলসী মালাটাও উঠল নড়েচড়ে। বলল, কোনও দিন পাপ করিনি, অভাব, তাই জামাইয়ের পিত্যেশি। এতে পাপ কী করলাম বলো?

সুকুমারী যেন খপিসের মতো তাকাল নকুড়ের দিকে। বলল, তুমি যে বলেছিলে, মেঘুর সঙ্গে ব্যবসায় নামবে । তোমার তো টাকা নেই কোনও কালেই। মাছের তেলেই মাছ ভাজবে, এই তো তোমার মতলব। সেই কথা বলছি।

নকুড় বলল, ওর নামই হল পিত্যেশ করা। আমি কি আর ছিনিয়ে নেব, না, চুরি করব? চুরি তো করব না। আর চেয়েচিন্তে যদি কিছু পাওয়া যায়। মেয়েটার একটু মায়া মমতা থাকলে, ওর হাত দিয়েও কিছু আসতে পারে।

সুকুমারী বলল, সে গুড়ে বুঝি বালি। কথাবার্তার ধরনধারণই আলাদা। তবে হ্যাঁ, একটা লক্ষ্মীমন্ত মানুষ যখন ঘরে এসেছে, কিছু হতে পারে।

এ শুধু আজকের কথা নয়। যে দিন প্রথম মেঘনাদের চিঠি এসেছে, সে দিন থেকে এ কথাই ফিস ফিস গুজ গুজ করে আসছে তারা। সিরাজদিঘার একজন গদির মালিক আসছে। প্রতি মুহূর্তে নিজেদের যে জীবনকে তারা ক্লেদাক্ত মনে করেছিল, ঘৃণা করছিল নিজেদের, সে সময় হঠাৎ যেন একটু আশার আলো দেখা দিল। যেন সোনার ড্যালা পেয়েছে। এক চিমটি ভেঙে নিতে পারলেই লাভ। ফাঁক পেলেই ধারালো যন্ত্র দিয়ে চাঁছতে হবে সোনার পাতটাকে ।

হঠাৎ নকুড় বলল, বড় হতভাগ্য আমি।

তার গাঢ় ভাঙা ভাঙা গলার স্বরে চাপা ব্যথা ফুটে উঠল। এরকম কতই বলে। কত সময় বলে। সুকুমারীর মনে দাগ কাটে না। আজ হঠাৎ সুকুমারীর মনে লাগল কথাটা। বলল, কেন?

নকুড় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, কোনও দিনই কিছু করতে পারলাম না। আমার বাপ তবু তার বয়সকালে মুন্সিগঞ্জের হাটের গদিতে দু দিন বসতে পেরেছিল। আমি চিরকাল সোনাদুলি চরের অপয়া দোকানটায় বসে ছারপোকার কামড় খেয়ে মলাম।

এ সব সুকুমারীর শোনা কথা। বিয়ে হওয়ার পর এসে আর চোখে দেখেনি কোনওদিন । শুনেছে, মুন্সীগঞ্জে দাদা শ্বশুরের জমজমাট ব্যবসা ছিল গুড় আর তামাকের। তার শ্বশুর, নকুড়ের বাবাও যৌবনে মুন্সীগঞ্জ যাতায়াত করেছে। সে ব্যবসা রসাতলে গেছে অনেকদিন। নানান কারণে গেছে। তার মধ্যে এক কারণ তার শ্বশুরের চরিত্রহীনতা।

সুকুমারী একটু ঘন হয়ে বসল নকুড়ের কাছে। কেউ দেখলে হয়তো অবাকই হবে। কোনওদিন এভাবে তাদের বসতে দেখেনি কেউ। সুকুমারী বলল, দেখলাম তো চিরকাল, একপাড় ভাঙে, আর একপাড় গড়ে। দেখো, হয়তো আবার গদিতে বসতে পাবে।

অ্যাঁ, কী বলছ? চমকে উঠল নকুড়। আবার গদিতে বসতে পাবে সে। আবার কেন, বলতে গেলে সে-ই তো প্রথম বসা হবে তার জীবনে।

সুকুমারী আবার বলল, সব সময় তো আর চেয়েচিন্তে খেটে লক্ষ্মী হয় না। বুদ্ধিও খাটাতে হয়। ভাবো, দেখো, কী হয়।

এক মুহূর্ত নীরব। হঠাৎ আবার বলে উঠল সুকুমারী, টাকা পয়সা সব কীভাবে রেখেছে মেঘু, কে জানে? খোলা রেখে যায়নি তো?

নকুড় আবার চমকে উঠল, অ্যাাঁ?

মনে মনে ভাবল, ফেলে রেখে যাবে। মানে পঞ্চাশ হাজার, কিংবা এক লাখ অথবা দেড় লাখ। এ বস্তিতে!

আচমকা ঢং করে একটা শব্দ হল। দু জনেই চমকে উঠল। দেখল, দরজার কাছে বিজয়ের বউ। জলভরা বালতিটা নামিয়েছে সিঁড়ির উপর, কোলের ছেলেটা এলিয়ে পড়েছে ঘুমে। ঘুমন্ত আঁকড়ে ধরে আছে মায়ের বুক। বউ হাঁপাচ্ছে বালতিটা এনে। কী রকম ধড়ফড় করছে বুকের মধ্যে ! সুকুমারী হঠাৎ উঠে বেরিয়ে গেল। এ ঘরের পাশেই, কোণের ঘরটা আপাতত ভাড়া নেওয়া হয়েছে মেঘুর জন্য। দেখল, মস্তবড় তালা আঁটা রয়েছে কড়ায়। মনে পড়ল, বুমি তুমি হাতে হাতে জিনিসপত্র তুলেছে ওই ঘরে। তারপর কখন তালা বন্ধ করে রেখেছে।

সে আবার এল এ ঘরে। বউ তখনও দাঁড়িয়ে। বলল, ছেলেটাকে ধরো তো মা, বালতিটা নিয়ে যাই।

সুকুমারী ছেলেটাকে নিয়ে শুইয়ে দিল মেঝেয়। বউ বালতি নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

সুকুমারী সহজ গলায় বলল, তালা দিয়ে গেছে ঘরে।

যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাসই পড়ল নকুড়ের। বলল, ওঃ, বেশ, ভাল।

সুকুমারী বারান্দার দিকে একবার দেখে বলল, তুমিও নাইতে যাও।

বউকে ডেকে বলল, বালতিটা ভাজা রেখে এসো আবার জালায় জল ঢেলে। নইলে আবার জলের কম পড়ে যাবে।

বউ খালি বালতি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *