২.১ ঘুংগুরের আর রোগা জোড়া ঘোড়ার ঠুকঠুক শব্দ

নয়া পাড়ি

ঘুংগুরের আর রোগা জোড়া ঘোড়ার ঠুকঠুক শব্দ ভোর জাগিয়ে চলেছে। শহরতলির পিচবাঁধানো সরু রাস্তা। এখনও লাইট জ্বলছে রাস্তায়। আনাগোনা শুরু হয়েছে লোকজনের। শিল্পাঞ্চল। অধিকাংশই কলকারখানার লোক।

গাড়ির ভেতরে দুই ভাই বোন আর ভগ্নীপতি। পেছনে, সহিসের জায়গায় দাঁড়িয়েছে চউথি। পাশে পা ঝুলিয়ে বসেছে চালিস। যেন এই যাওয়াটা তার পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার। নির্বিকার মুখে বসে আছে। গাড়ির গাড়োয়ান পেছনে ঝুঁকে পড়ে চউথির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। চউথিও ব্যস্ত বলতে। ঘোড় চলেছে আপন মনে।

গাড়োয়ান বলল, চাপা গলায়, বিজয় মিস্তিরির বোন?

চউথি ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, খুব বড়লোক। অঢেল সোনা, টাকাও অনেক। বহুত ভারী কারবারি বিজয়ের বোনাই।.

মেঘ যত গর্জে তত বর্ষে না। গাড়োয়ান মাথার উপর চাবুক ঘুরিয়ে শব্দ করল, মারল না। বলল, বোনাই খুব লেখাপড়াজানা লোক?

লেখাপড়া? চউথি মনগড়া কথা যখন বলে, তখন আগে পাছে জ্ঞান থাকে না। বলল, ওরে বাপরে, খুব খুব। নইলে আর এত টাকা করেছে?

তবে ওর বোনটা ও রকম কেন?

কী রকম?

খিলখিল করে হাসছিল আর বোনাইয়ের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছিল রাস্তায়। খুব খারাপ দেখাচ্ছিল।

চউথি এক মুহূর্ত নীরব রইল। হ্যাঁ, একটু বেশি বেশি লাগছিল চউথিরও। কিন্তু সেটা স্বীকার করা যায় না রতন গাড়োয়ানের কাছে। হলই বা চেনা লোক। বিজয় তার বন্ধু। বন্ধুর বড় বোন। খারাপই যদি হয়, সেটা বলা ঠিক নয়। বলল, মানে খোড়া ব্যায়রাম আছে। মাথার ব্যায়রাম।

এই মন্তব্যটিই জুতসই মনে হল চউথির ।

হায় হায় ! বলে জিভ দিয়ে তু তু শব্দ করল গাড়োয়ান। সপাং করে এক ঘা কষাল ঘোড়ার পিঠে। খেকিয়ে উঠল, শালে তুমকো ভি শির মে বেমারি পাড় গয়া?

গাড়ির ভেতরে কলকল করছে বিজয় আর লীলা। গাড়ির দরজা খোলা। লীলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিজয় আঙুল দিয়ে দেখাল, এই যে জামাইবাবু, আমি এই চটকলে কাজ করি।

মেঘনাদ উঁকি দিয়ে দেখল। ঝুঁকে পড়ে দেখল লীলা। সুদীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কারখানা। পাঁচিলের গায়ে গায়ে লাইট পোস্ট। এখনও আলো জ্বলছে। লাল আলো জ্বলছে চিমনিটার মাথায়।

লীলা বলে উঠল, মস্তবড় কারখানা তো। নারায়ণগঞ্জের সূতাকলের মতোই।

বিজয় হেসে বলল, নারায়ণগঞ্জের সূতাকাল আর কী! তার চেয়ে বড় বড় কারখানা আছে।

লীলা বলল, তুই কী কাজ করিস ওখানে? পাটের দড়ি বানাস?

বিজয় আবার হাসল। বলল, বিজয় মিস্তিরি দড়ি বানাবে?

লীলা খিলখিল করে হেসে উঠল। হেসে উঠে বিজয়ের হাঁটুতে চাপড় মেরে বলল, ওমা, তুই আবার মিস্তিরি নাকি? বিজয় মিস্তিরি? কী করিস?

বিজয় প্রথমে একটু চটে উঠল। এতে হাসবার কী আছে! যেন কোথাও একটা বিদ্রুপের হুল রয়েছে লীলার হাসিতে, কথাতে ও ভাবে ভঙ্গিতে। হতে পারে ছোট ভাই। কিন্তু সে কি সেই আগের বিজয়ই আছে। যার হাঁটুতে চাপড় মেরে স্নেহচ্ছলে বিদ্রূপ করা যায়। কিন্তু অনেকদিন বাদে দেখা। তা ছাড়া, জীবনে দেখেছে কতটুকু লীলা। জানে কতটুকু। রাগটা সামলে নিল বিজয়। হয়তো দিদি আগের মতোই আছে। বুঝতেই পারছে না, দশ বছর ধরে চটকলে কাজ করছে। সে বড় হয়েছে, চেহারা বদলে গেছে। সে আজ উইভিং-এর মিস্তিরি। সে বিয়ে করেছে, তার একটা ছেলে হয়েছে।

সে বলল, কী আবার করব? মিস্তিরিরা যা করে। তাঁত মেশিন খারাপ হলে সারাই রিপেয়ার করি, এটা সেটা ফিট করি।

ঠিক কী বললে যে বোঝানো যায় লীলাকে, আন্দাজ করতে পারে না বিজয়। বলল, এই আর কী, মিস্তিরির যা কাজ।

লীলা চেয়ে চেয়ে দেখে বিজয়কে। হঠাৎ বলে উঠল, মাইরি তোর চেহারাটা কী রকম বদমাইসের মতো হয়ে গেছে। এক নম্বর একেবারে। তোর মুখে এত ছাপকা ছাপকা দাগ কীসের?

বিজয় রাগ করবে কী? হেসেই খুন। –মাইরি, বদমাইসের মতো না? আর বলিসনে ভাই, শালা এমন ব্রণ গোটা হয়েছিল মুখে। আর কলমিলের কাজ, বুঝতেই পারছিস। মুখের চামড়া আর চকচকে থাকবে কী করে। কী বলেন জামাইবাবু?

মেঘনাদ হাসল কিনা বোঝা গেল না। গোঁফ জোড়া সামান্য কাঁপল। বোধ হয় ঘাড়টাও একবার নাড়ল। কিন্তু সে বাইরের দিকেই তাকিয়ে রইল। যেন সে এখন থেকেই জায়গাটার হালচাল বুঝে নিতে চাইছে।

লীলা আবার বলল, কত মাইনে পাস?

এই হপ্তা গেলে, গোটা আঠারো টাকা।

হপ্তায় হপ্তায় বুঝিন?

হ্যাঁ।

হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে, চোখ কুঁচকে একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল লীলা, মেয়েমানুষেরাও কাজ করে পাটকলে?

তা করে।

লীলা বলল, জোটেনি কেউ?

বিজয় অবাক হয়ে হেসে বলল, ভাগ, তোর যত ইয়ে কথা। শালা এমনিতেই হয় না, আবার কলের মেয়েমানুষের পেছনে। তাদের কি ঘর সংসার নেই, না আমারও নেই? বলেই হঠাৎ হেসে উঠল বিজয়। বলল, এদ্দিন বাদে এলি, তুই কি আর কথা খুঁজে পেলিনে? তুই যেন কী মাইরি

লীলা আড়চোখে একবার দেখল মেঘনাদকে। বলল, দেখছি তোকে চানকে, বউতে মন বসেছে। কি না। পুরুষমানুষ তো ! পেরেক ঠুকলেও নৌকার কাঠ। দিব্যি ভেসে থাকিস। তোর বউয়ের সুরৎ কেমন?

বিজয় বলল, ওই এক রকম! রংটা কটা, দেখতে শুনতে তত খারাপ নয়। তবে একেবারে গোবর ন্যাতা। রাখলে আছে, ফেলে দিলে যেন আপদ গেল। শালা ভয়ংকর ভালমানুষ। অত ভাল আবার ভাল নয়। 

চাপা তীব্র গলায় হেসে বলল লীলা, সেই তো ভাল, ঠকানো সুবিধে আছে।

আবার হাসি। ভাই বোনের একত্র হাসিতে চমকে চমকে উঠছে শহরতলির ভোরের রাস্তা। বাতিগুলি নিবে গিয়েছে। পথচারীরা সবাই ফিরে ফিরে দেখছে গাড়িটা। যেন বিলাসমত্ত মেয়ে পুরুষেরা হুল্লোড় করতে করতে চলেছে।

গাড়ির গাড়োয়ান ভ্রূ তুলে ইশারা করল চউথিকে। অর্থাৎ এ সবই পাগলামির লক্ষণ নাকি? চউথি বড় বড় চোখে ঘাড় নাড়ল। মানে হ্যাঁ। বুঝেছ? আর চালিস, গাড়ির পেছনে হেলান দিয়ে বসে আছে। অবাক চোখে চেয়ে থাকা পথচারীদের এক চোখ বুজে অকারণ ইশারা করছে। তুড়ি দিচ্ছে কখনও বা। নয়তো তাল ঠুকছে পেটে। কিন্তু পথচারীরা কেউই অবাক কিংবা বিরক্ত হচ্ছে না তার অঙ্গভঙ্গিতে। তারপর যখন গাড়ির ভিতর ভাইবোনের হাসিটা উচ্চরোলে উঠল বেজে, তখন হঠাৎ গান ধরে দিল।

তোর হাসি দেখে পান জ্বলে সই
কেঁদে যে আর বাঁচবি না।

বিজয় বলে উঠল গাড়ির ভিতর থেকেই, চুপ যারে চালিস।

চালিস চুপ। গাড়ি একটা গলির মধ্যে ঢুকল। সরু গলি, খোয়া উঠে উঁচু নিচু হয়ে গেছে। গাড়িটা হোঁচট খেতে খেতে দুলে দুলে চলল। এখনও ভোরের আলো ভাল করে ঢোকেনি গলিটাতে। পশ্চিমা ভাষায় বেসুরো গলায় কে রামভজন গাইছে। গাড়োয়ান হেঁকে উঠল, হট যাও সামেনে সে।

একটা জলকলের সামনে ভিড় হয়েছে মেয়ে পুরুষদের। গাড়িটাকে গাল দিল তারা। আধ অন্ধকারে যাত্রীদের দিকে তাকাল ক্রুদ্ধ বিরক্ত চোখে। এ গলিতে আবার গাড়ি?

বিজয় আর লীলা ঝুঁকে আছে বাইরের দিকে। আশ্চর্য ! মেঘনাদ অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখছে বিজয়কে। বিজয়ের হাবভাব, কথা। বিজয়কে তার দরকার। একজনকে দরকার, যার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজে হাত দেবে এখানে। বিজয় ছাড়া আর কে আছে? কিন্তু পরামর্শ করার আগে। মানুষটাকে জানতে চায় সে। যাচাই করতে চায়। মেঘনাদ তো দেরি করতে পারবে না। অবশ্য এখনও এ ভাবনা তার মুখ্য হয়ে ওঠেনি। এ তার হৃদয় স্রোতের চোরা ধারা। এখনও মন জুড়ে আছে যোবলা আনা গ্রাম, ঘর, গদি, কারখানা। মনজোড়া সেই ভাবনাতে অবশ হৃদয়। তাতে এই ক্ষীণ অন্তস্রোতের অনুভূতি এসেছে অন্যমনে। অন্যমনে সে দেখছে বিজয়কে। মনটা ভাল গাইছে। বিজয়কে তার ভালই লাগছে।

চউথি গাড়ি দাঁড় করাল বাড়ির কাছে। একটু পরিষ্কার হয়েছে গলিটার আকাশ। বিজয়দের বাড়িটার সামনে মস্তবড় একটা পিপুল গাছ। পিপুল গাছের তলায় খানিকটা খোলা জায়গা। ইটের দেওয়াল আর টিনের দোচালা ঘর। আলকাতরা লেপা টিন। গলিটার দু পাশেই বাড়ি। এলোমেলো বাড়ি, অসংলগ্ন। অধিকাংশ টালি, টিন আর খোলা। মাঝে মাঝে পুরনো কোঠাবাড়ি। এ গলিটাতে সেগুলি বেমানান হয়নি। এক আধখানা নতুন বাড়িও আছে। এমনকী দোতলা তেতলাও আছে। কিন্তু তেমন কোনও কৌলীন্য আয়ত্ত করতে পারেনি যেন। ফুল লতাপাতা কাটা বারান্দার রেলিং। গণেশ আর নারায়ণের সিমেন্টের মূর্তি আছে দুটো বাড়ির ছাতের মাথায়। সবই মানিয়ে গেছে গলিটাতে। 

বিজয় গাড়ি থেকে নেমেই হাঁক দিল, মা দিদি এসেছে। ইমি, ঝট করে চায়ের জল চাপা।

টিনের দোতলা বাড়ি থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল একরাশ লোক। চউথি আর চালিস জিনিসপত্র জড়ো করতে লাগল পিপুলতলায়।

প্রথমে ছুটে এল তুলি অর্থাৎ ঠুমি। তারপর মা সুকুমারী। সুকুমারীর পেছনে বিজয়ের বউ ষোড়শী। লীলা আর মেঘনাদকে ঘিরে ধরল সবাই। সুকুমারী এসেই হাত ধরল লীলার।

এমন সময় কারখানার বাঁশি বেজে উঠল। বিজয় বলল, যাঃ শালা, চা আর খাওয়া হল না। চউথি, চল তাড়াতাড়ি। বলে সে আর চউথি ছুটে বেরিয়ে গেল।

লীলা আর মেঘনাদকে নিয়ে বাড়ি ঢুকল সকলে। বিজয়ের বাবা নকুড় দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। সোনাদুলি চরের মুদি নকুড় সা । খোঁচা খোঁচা সাদা চুল। মুখটা আরও ছোট হয়ে গেছে। যেন চামড়া কুঁচকে একটুখানি হয়ে গেছে মুখটা। খাটো হয়ে গেছে অনেকখানি। মাড়িতে দাঁত নেই। বোধ হয় আর। গর্তে ঢোকা চোখ দুটো করুণ ক্লান্ত।

সে দুহাতে মেঘনাদের চওড়া একটা হাত জড়িয়ে ধরল, এসো বাবা জীবন, এসো।

নকুড় সা’র হাত ধরার মধ্যে কিছু ছিল। যেন ব্যর্থ জীবনে অনেক আশা পেয়েছে সে। যেন। অনেকদিনের দাবদাহ জুড়াল। যেন এই হাতটি জড়িয়ে ধরার জন্য অনেকদিন থেকে এমনি দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে। সোনাদুলির চর যেদিন ছেড়ে এসেছিল সে, সেইদিনও এমনি করে এসে দাঁড়িয়েছিল মেঘনাদের গদিতে। দেশ গাঁ ছেড়ে চললাম বাবা, বলে এমনি করে হাত ধরেছিল। মেঘনাদের কষ্ট হয়েছিল। অনুভূতিটা তেমন প্রবল ছিল না। লোকটার জীবনের কষ্ট জেনেও প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থা তার মাথায় আসেনি।

আজ মেঘনাদ মার খেয়ে ছুটে এসেছে। আজ সামনে সবটাই অন্ধকার, অস্পষ্ট। অনেক সংশয়, সন্দেহ। তবু সে অনুভব করল নকুড় সা’র ব্যথা। এক ব্যর্থ সওদাগর তার সামনে। লক্ষ্মী যাকে নিয়ে কোনও খেলাও কোনওদিন খেলেনি। চোখেই পড়েনি। লালমিঞা চেষ্টা করেছিল। আজ মেঘনাদ নিজেও অন্ধরাত্রের মাঝি । কোন দিকে পাড়ি দেবে, কোন পাড়ে ভিড়বে সে জানে না। তবু বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল তার। শুধু তাই নয়। নকুড় সাকে দেখে অকূলপাড়ি মনে এক বিন্দু সান্ত্বনা পেল।

কিন্তু প্রণাম করার কথা মনে হল না মেঘুর। সাহা ঘরে লৌকিকতা আচার বিচারের তো অভাব নেই। তবে প্রণাম করতে তেমন শেখেনি মেঘনাদ। বোধ হয়, এই জীবনে নকুড় সাও সে সব ভুলে গেছে। মেঘু অবাক হয়ে দেখল, লীলা বাবা মাকে প্রণাম করছে। মেঘু পারল না।

 তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্নায় সবাই চমকে উঠল। দেখা গেল, সুকুমারী লীলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। লীলাও কাঁদছে। মায়ে ঝিয়ের এই কান্নায় এক বিষণ্ণ স্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। দুজনে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে লাগল তারা। তিলিও চোখে আঁচল দিয়ে কাছে বসল। ষোড়শী কোলে ছেলে নিয়ে ছলছল চোখে বসল কাছে। তার ছলছল চোখ দুটি খালি লীলার সারা গাটি দেখছে।

নকুড় সা কাঁদতে পারল না। কান্নার চেয়েও করুণ মুখে নীরবে বসে রইল। মেঘনাদ লীলাকে দেখছে। এমন করে ঝুমিকে কখনও কাঁদতে দেখেনি সে। এমন করে, মায়ের বুকে পড়ে। মায়ের ছোট মেয়েটির মতো। ঝুমির কান্না। সে অশ্রু যেন অ্যাসিডের মতো ক্ষার পদার্থ ছিল। তার কান্না মেঘনাদের জীবনে দুর্ঘটনা আর দুর্বিষহ যন্ত্রণাই বয়ে নিয়ে এসেছে। কান্নাটা তার চরম ক্রোধের ও বিদ্বেষের লক্ষণ ছিল।

আজ ঝুমি কাঁদছে। কী বিচিত্র কান্না ! কত বেদনাদায়ক ! ঝুমিকে এমন করে কাঁদতে দেখে বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল মেঘুর। তার ঝুমি, তারই। সে এমন করে কাঁদলে যে তার সহ্য হয় না। তার আদর করতে ইচ্ছে করে। বুকে নিয়ে থামাতে ইচ্ছে করে কান্না। হঠাৎ এই মুহূর্তে মনে হয়, সত্যি, লক্ষ্মীমতী ঝুমি। তার ঝুমির ঝুরি তাকে অনেক দিয়েছে। আবার সে কিছু করবে। এবার আদর করে নাম দেবে, ঝুম কুড়কুড়। একেবারে নতুন জিনিস। এমন কেউ কখনও খায়নি।

নীরব নয়, সরব কান্না। শুধু কান্না নয়। কথা কান্না। সুকুমারী কেঁদে কেঁদে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে বলে চলেছে অনেকগুলি বছরের কথা। কেমন করে মারা গেল হেমন্ত। সুকুমারীর বড় ছেলে হেমা। এই জীবন, শহরতলির এ ভাঙা ঘরে অষ্টপ্রহরের দরিদ্র জীবন। বসন্ত, অর্থাৎ বসনা, তিলির ছোট। সে বেরিয়ে গেছে। কেন, কে জানে? ঘরে ভাল লাগে না। প্যান্ট পরে, শার্ট গায়ে দেয়, ছিরগেট খায়, শিস দেয়। একেবারে খারাপ হয়ে গেছে সে। আর তিলি, গলার কাঁটা। সোনাদুলির সা’ঘরের মেয়ে। দশ বিউনী মাগির সমান হল। বিয়ে হচ্ছে না, টাকা নেই। বিজার বউ, যশোরের মেয়ে। তবু বিজা-ই যা একটু এ পোড়া সংসারের সান্ত্বনা। তারপর ঝুমি! আহা, মায়ের ভাগ্যবতী মেয়ে? কতদিন বাদে দেখা। আর যে কোনওদিন দেখা হবে, এমনি করে পাওয়া যাবে বুকে, সে আশা ছিল না। 

যত কথা, তত কান্না। জীবনের যত শোক, সব বাধামুক্ত হয়ে হা হা করে বেরিয়ে পড়েছে। লীলারও মনে পড়েছে দাদার কথা। হেমন্ত। চোখে দেখা হল না আর। সে যে পোড়ামুখী, পাপিষ্ঠা। ভগবান দেখতে দেয়নি। আর কতদিন পর দেখা। তারও বুকের মধ্যে কম উথালিপাথালি করেছে!

ঘর ভরে গেছে লোকে। এ বাড়ির আরও দুই ভাড়াটেরা এসেছে, পাড়ার লোক এসেছে কিছু কিছু। বিজয় মিস্তিরির পরিচয়েই সবাই পরিচিত। মিস্তিরির বোনবোনাই এসেছে। দু তিনজন হিন্দুস্থানি মেয়েও এসেছে। প্রতিবেশিনী তারা। কান্না দেখে সবাই গম্ভীর, কিন্তু কৌতূহলীও। সবাই দেখছে লীলার গায়ের গহনা, আর প্রকাণ্ড মানুষ মেঘনাদকে। একটু চাষাড়ে, কিন্তু একটা বাদশাহী মানুষ বটে। গোঁফ কী, হ্যাঁ, বিজয় মিস্তিরির ভগ্নীপতি একটা মানুষের মতো। দেখলে ভয় করে। লীলার কালো রূপে সবাই মুগ্ধ।

সকলেই যে খুশি আর মুগ্ধ, তা নয়। ওর মধ্যেই কেউ কেউ ঠোঁট বেঁকাল। চোখ কুঁচকে চলে গেল। কান্নার পর সামান্য পরিচয়ের পালা। হ্যাঁ, এই সুকুমারীর বড় মেয়ে। না, অভাগীর ছেলেপুলে নেই, একটি যা-ও বা হয়েছিল, মারা গেছে। মা ষষ্ঠীর কৃপা নেই। কেউ বলল, সেই ভাল, বেঁচে গেছে। কেউ বলল, আহা ! অমন লক্ষ্মীমন্ত বাপমা।

চালিস ততক্ষণে মালপত্র সব তুলে ফেলেছে ঘরে। তুলে পিপুলতলায় বসেছে গালে হাত দিয়ে, তাকিয়ে দেখছে ঘরের দিকেই। ঘরের সবাই কাঁদছে। তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। হয়তো মা এখন কোথাও কোনও বিলে অথবা জলায় নেমেছে ! কলমি শাক ছিড়ছে কিংবা ছেড়া লুঙ্গি দিয়ে কুঁচো মাছ ধরার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে হয়তো তার ন্যাংটো ভাইবোনগুলি। তার বেগম মা। অর্থাৎ মায়ের নাম জোহরা বেগম। রহমনের কথা তাদের হয়তো মনেই পড়ছে না এখন। রহমন, অর্থাৎ চালিস নিজেই।

ঘরের ভিতরে সুকুমারীই প্রথম কান্না থামাল। বলল, তিলি, দ্যাখগে যা, চুলো ধরল কিনা। চায়ের জল চাপাগে। বিজাটা খেয়ে যেতে পারল না।

তিলি বলল, বউকে যেতে বলো মা।

বউ তখনও হাঁ করে তাকিয়েছিল লীলার দিকে। আড়চোখে দেখছিল মেঘনাদকে। তার কোলে শোয়া ছেলেটাও আঙুল চুষতে চুষতে লীলাকেই দেখছিল।

সুকুমারী বলল, কই গো বউ, ওঠ ওঠ ওঠ, হাঁ করে দেখছ কী?

উঠতে যাচ্ছিল ষোড়শী, হাত চেপে ধরল লীলা। বলল, ওমা, বিজাটা কী পাজি গো মা। বলল, বউটা যেন গোবর ন্যাতা। কেমন দিব্যি টসটস করছে। বিজাটাই বরং ভূত। কী বলিস লো। বউ। আমি কিন্তু তোকে তুমি ঠুমি বলতে পারব না, আগেই বলে রাখছি। বড় কড়া ননদ, বুঝলি? বলে আরও কাছে টানল।

ষোড়শী একটু হাসল। হাসিটি কেমন করুণ। সুকুমারী বলল, সে তুই যাই বল না তাতে কী। তোর কত ছোট, তিলির বয়সীই হবে। তবে বড় কাজে কুঁড়ে।

লীলা বলল, তাই নাকি লো? বলে সকলের সামনেই মেঘুকে দেখিয়ে বললে, তোর ননদাইকে দেখেছিস?

সুকুমারীর অভিযোগে কোনও বিকার ঘটল না ষোড়শীর মুখের। তেমনি হেসে একটু ঘোমটা টেনে দিল। মেঘুর সবটাই ভাল লাগছিল, ঝুমির গালে তখনও জলের দাগ। কান্না ফোলা চোখ।

লীলা খুঁটিয়ে দেখল ষোড়শীকে। ফরসা রং কিন্তু অবহেলায় বেশ খানিকটা বিবর্ণ। মাথায় চুলও অনেক, বাঁধে না, জট পাকাচ্ছে চুল। নাকের নাকছাবিটি ছাড়া এক চিমটি সোনাও গায়ে নেই, কাঁচের চুড়ি আর শাঁখা ।

লীলা বলল, হ্যাঁ মা, বউটাকে কি ওর বাপ মা একটু সোনাও দেয়নি?

জবাব দিল তিলি, দিয়েছিল, হার, চুড়ি, দুল, রুলি। সব বিক্রি হয়ে গেছে।

নকুড় সা’র নাক দিয়ে কয়েকটা শব্দ বেরুল। সুকুমারী গম্ভীর মুখে বলল, যা রাক্ষুসে পেট এই সংসারের।

নকুড় বলল, নিজের কপাল দেখিয়ে, এই কপালখানি তো সঙ্গেই রয়েছে। এ পাপ ধুলে যায় না, চাঁচলে যায় না, বরাত।

মেঘুর মন বলল, থাক না এ সব কথা এখন। তাই থাকল, লীলা আর ও প্রসঙ্গে গেল না। ছেলেটাকে তুলে নিল নিজের কোলে, বলল, বাবা।

নকুড় বলল, কী রে !

বিজার ছেলে কিন্তু তোমার বংশের রং বদলে দিল। ছেলে তো বেশ ফরসা হয়েছে।

নকুড় বলল, হ্যাঁ, বদলে দিয়েছে মা। তবে ফরসা রং কালো হতে কতক্ষণ বলো। বরাতের কালি না ঘুচলে সবই কালো।

ছেলেটা চিৎকার জুড়ে দিল। লীলা তাকে তুলে দিল ষোড়শীর কোলে। ষোড়শী চলে গেল শাশুড়ির সঙ্গে সঙ্গে। ঘরের ভিড়ও ইতিমধ্যে পাতলা হয়েছে অনেকখানি।

লীলা ফিরল তিলির দিকে। বলল, কী লো, তুই তো একটা ধুমসী মাগি হয়ে গেছিস। তিলি লীলার সঙ্গে কথা বলার জন্যই বসেছিল। তিলির আর এক নাম ঠুমি, ঝুমির সঙ্গে সাট মিলিয়ে ঠুমি রাখা হয়েছে। গম্ভীরভাবে হেসে বলল, তা কী করব বল?

ঠুমির হাসিটা রীতিমতো গম্ভীর শুধু নয়, মানুষটাই যেন রীতিমতো ভারী। ঝুমির মতো ঘন কালো নয়। তবে কালোই। শক্ত বলিষ্ঠ দেহ। ঝুমির মতো একহারা নয়, দোহারা। সেজন্য স্ফীতিটা নজরে পড়ে একটু বেশি। ঝুমি ইচ্ছে করলে, তার দেহের তীক্ষ্ণতা খাপে মুড়ে আড়াল করতে পারে। তিলি পারে না। শরীরের বাঁকা রেখাগুলি তার বেশি উচ্ছ্বসিত। দৃষ্টি খোঁচা খায়। লহমায় নজরে পড়ে। ঝুমির বাড়াবাড়ি নেই। সুষ্ঠু অথচ এ বয়সেও তীব্র।

ঝুমি বলল, এখনও বিয়ে হল না তো কবে হবে?

তিলি হেসে উঠল। বলল, তার আমি কী জানি। ফিসফিস করে বলল, না হলে কী করব বল। বলে নিঃশব্দে হাসল ভূ নামিয়ে। বোধ হয়, হঠাৎ লজ্জা পেয়েছে বলে ফেলে। ঝুমি চকিতে। একবার দেখে নিল মেঘুকে। মেঘু শ্বশুরের সঙ্গে দেশের কথা বলছে। বলতে বলতে ঝুমির দিকে চোখ ঘুরছে তার। তিলির দিকেও। তার বাড়িতে লোক ছিল না। ছিল শুধু ঝুমি। সে ঝুমি আলাদা। বাড়ির বাইরেই যে সারাদিন গোলোকধাম আর তাস খেলেছে। অথচ বাড়িভরা মানুষ, তাদের হাসির কথা, এ সবে তো বিতৃষ্ণা ছিল না মেঘুর। ঘর ভরতি থাকবে, সে নিজে থাকবে গদিতে কারখানায়। সেখানেও ভরা ভরতি। সর্বত্র শুধু ভরা। আত্মীয়স্বজন কারিগর কর্মচারী, সব কিছুতে ভরা। অনেক সংশয় সন্দেহের মধ্যেও, অনেক লোকের মাঝে ভাল লাগছে তার। মা বাপ ভাই বোনের মাঝখানে ঝুমিকেও অন্যরকম লাগছে।

তিলি বলল, চল দিদি, তোদের ঘরে যাই।

লীলা বলল, আমাদের আবার ঘর কোথায়?

তোদের জন্য একটা ঘর নেওয়া হয়েছে, এঘরের পাশেই। খালি ছিল। পাঁচ টাকা ভাড়া।

দু জনে তারা সেই ঘরে এল। ছোট্ট অন্ধকার ঘর। মাটি দিয়ে ইটের গাঁথুনির দেওয়াল। চলাফেরা করার জায়গাও নেই। দোচালা টিনের শেড যেখানে ঢালু হয়ে নেমে শেষ হয়েছে, সেখানেই এ চতুষ্কোণ খুপরিটা রয়েছে। চালাটা মাথায় ঠেকে প্রায়। লীলা বলল, ওমা, এর ভাড়া পাঁচ টাকা ! তোর বোনাই তো ঢুকতেই পারবে না। অসুরের মতো চেহারা।

চমকে উঠল তিলি। স্বামীকে অসুর বলছে তার দিদি ! বলল, অসুর বলছিস যে?

লীলা বলল, সেই রকমই তো দেখতে, দেখলিনে?

অবাক হলেও তিলি ভাবল, হয়তো ওইটুকু তার দিদির প্রেমের খুনসুটি।

বলল, তোকে খুব ভালবাসে, না?

কে? তোর বোনাই? মরণ, মুখে আগুন ভালবাসার ! সারা দিন তো ময়দার ড্যালা নিয়ে পড়ে থাকে। মেয়েমানষের কিছু বোঝে না ও।

তিলি বলল, যাঃ, তুই যেন মাইরি কী!

তুই একবার চানকে দেখ তা হলে?

ও মা গো ! মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে উঠল তিলি। তারপর বলল, আমার তো দেখেই ভয় করে। কিন্তু তোকে কেমন করে দেখছিল বেচারি।

লীলা বলল, ওই রকম দেখে। বলে আচমকা নিশ্বাস ফেলল একটা। তিলি বলল, কতদিন বাদে তোকে দেখলাম দিদি। মাইরি, মনেই হত না যে আবার কোনওদিন দেখা হবে। খালি শুনতাম, তুই খুব বড়লোক, মেলা টাকা তোর।

লীলা বলল, আমার আবার টাকা কীসের। টাকা তো বোনাইয়ের।

তোর নয় বুঝি?

লীলা ঠোঁট উলটে বলল, চাইনে। ময়দার ড্যালাবেচা টাকা দিয়ে তোর বোনাই পাহাড় তুলুক, আমার কী?

তিলি অবাক হল। দিদির গলায় যেন আগুনের আঁচ। তীব্র অসন্তোষ। কিন্তু কেন? সবাই বলে, মেঘু ভাল মানুষ। খাঁটি মানুষ। আর এত গহনা দিদির গায়ে। গহনা শাড়ি। হোক টিনের বেড়ার বাড়ি। তবু চারঘরওয়ালা বাড়ি। চাকর, রাখাল, গোয়াল, গরু। তবে? হ্যাঁ, তবে মেয়েমানুষের তো সর্বনাশের কত দিক ভোলা রয়েছে। কতদিক। সেইদিকে বোনাই ঠকায়নি তো? কিন্তু বোনাইকে দেখে তো তা মনে হয় না। আর কোথাও কিছু করবে, এমন মানুষ বোধ হয় নয়।

 তিলি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। সংসারের কথা বলল। বউকে মা শুধু শুধু লাঞ্ছনা করে। কেন কে জানে? বউটা কিন্তু ভালমানুষ। সাতে পাঁচে থাকে না। অনেকসময় সোনাদা রাগ করে। সোনাদা হল বিজয়। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু কোনওদিন বউ নিয়ে যদি সরে পড়ে, তবে কী হবে। সবাই যে না খেয়ে মরবে। মা বোঝে না। তিলির উপর কথা বলতে এলে সে শুনিয়ে দেয়। তার সঙ্গে পারে না। যত দোষ বউটার। অবশ্য একটু গোবেচারি, ঘুমকাতুরে, কেমন যেন। বিমর্ষ সর্বক্ষণ! প্রথম এ রকম ছিল না। এখনই হয়েছে। অনন্ত থাকে কাছেপিঠেই। জুয়া খেলে, মদ ভাং খায়। শোনা গেছে, একটা মেয়েমানুষও আছে তার। হপ্তা শেষে বাবা যায়, গিয়ে টাকা। চেয়ে নিয়ে আসে। ইচ্ছে হলে দেয়, নয় তো নয়। বসনা তো ভেগেই গেছে। কেন জানে না, বসনাকে নাকি তিলির ভালই লাগে। সংসারের সাতে পাঁচে ভাল লাগেনি তাই সরে পড়েছে। এবার গেছে অনেকদিন হল। আবার আসবে নিশ্চয়ই। দিদি এসেছে শুনলে একবার আসবেই। দিদির কথা সে বলত প্রায়ই।

হঠাৎ গলা চেপে ফিসফিস করে বললে তিলি, জানিস, বাবারও গুণ কম নয়। গাঁজা ধরেছে বুড়ো বয়সে।

সুকুমারী চেঁচিয়ে বলল, ঠুমি, মেঘু আর ঝুমিকে জল দে, হাত মুখ ধুক। দোকান থেকে মুড়িটুড়ি যা হোক এনে দে।

লীলা বলল, তুই দোকানে যাস।

তিলি বলল, কে আর যাবে? পাড়ার মধ্যেই দোকান, জানাশোনা সকলেই।

লীলা অপাঙ্গে একবার তিলিকে দেখে বলল, অনেক বড় তো হলি। কারুর সঙ্গে…

দিদির গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল তিলি, তুই কী অসভ্য মাইরি।

অসভ্য কেন, বল না?

তিলি একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ভেসে যেতে আর কী আছে, বল না। পাড়ে উঠতে হবে তো? তোর না হয় মেঘনাদ দাস জুটেছে। ভাসতে পারি, তুলবে কে? ভাসিয়ে নিতে তো অনেকেই আছে।

বলে খিলখিল করে হেসে উঠল। লীলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল তিলির দিকে। যেন বিশ্বাস হয়নি তার পুরোপুরি। ভাসিয়ে নিতে যখন অনেকে আছে তখন নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে ভাবও হয়েছে। তিলি বলতে চায় না তাকে। সে তিলির দিকে চেয়ে আঙ্গুলের কড় গোনে আর বিড়বিড় করে।

তিলি বলল, ও কী রে দিদি? কী করছিস কী?

লীলা বলল, তোর বয়স হিসেব করছি।

তিলি আবার হেসে উঠল খিলখিল করে। দূর দূর ! তুই একেবারে মুখপুড়ি। হিসেব করতে হবে না। চব্বিশ পার হয়ে গেছি গত জষ্টি মাসেই।

লীলা বলল, হ্যাঁ, তাই হবে। তুই আমার চেয়ে প্রায় ছ বছরের ছোট।

তিলি বলল, তা কী বলবি এবার বল।

লীলা বলল, কী আবার। বয়স হয়েছে, চাপতে শিখেছিস। সহজে কি আর বলবি।

তিলি বলল ঘাড় দুলিয়ে, চাপব কেন। দশগণ্ডা লোক জুটিয়েছি, হল তো? এবার চল, আমার সঙ্গে দোকানে যাবি?

যেতে আপত্তি নেই লীলার। বাইরে যেতে আপত্তি তার কবেই বা ছিল। আজ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। বলল, চল, তোদের দোকানপাট দেখেই আসি।

তিলি বলল, তুই আবার বউ মানুষ। লজ্জা করবে না তো?

লীলা বলল, বউ হয়ে লজ্জা করিনি। বাপের বাড়ি মেয়ে এসে লজ্জা পাবে?

 হাসতে হাসতে দু বোনে বেরিয়ে গেল। রাস্তাটার নাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড। রোড না হয়ে লেন হলেই যেন শোভা পেত। তা ছাড়া এখানকার পৌরসভা কেন যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নামের প্রতি এতখানি শ্রদ্ধা দেখাতে গেল, অনুমান করা মুশকিল। বোধ হয়, এটা প্রফুল্লচন্দ্রের ভাগ্য। পৌরকর্তাদের গৌরববোধ।

ইতিমধ্যে খানিকটা বেলা হয়েছে। রোদ উঠেছে আকাশে। আকাশের এদিকে ওদিকে মেঘও ছড়িয়ে আছে।

ঝুমি তুমি দুই বোনকে রাস্তায় দেখে অনেকে উঁকিঝুঁকি দিল। মেয়েরাই বিশেষ করে। কয়েকটি ছোট মেয়ে তো সঙ্গে সঙ্গেই চলল। একটি বউ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও তুমিদি, কোথা যাচ্ছ গো দুই বোনে?

তিলি বলল, দোকানে। বলেই দু বোন হেসে উঠল খিলখিল করে। অকারণ হাসি। এ দেখে, ও দেখে। পথ চলতে চলতে আবার ফিরে ফিরে দেখে কেউ কেউ। কে? বিজয় মিস্তিরির বোনেরা? কেউ বলল, খাসা ! কেউ বলল মনে মনে, নচ্ছার।

দোকানদার অমৃত। লোকে বলে অমতো মুদি। যশুরে মানুষ। কুণ্ডুকুলের শিরোমণি, জাত। বৈষ্ণব। বিজয়ের শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের লোক। সে সুবাদে ঘনিষ্ঠতা আছে। কপালে বুকে ডানায় রসকলি আঁকা। গলায় চার ফেরতা কণ্ঠী। নাভির নীচে কাপড়। কোমর ভরে কালো দাগ। অবসর সময়ে ওইখানে চুলকনো অমৃতর বিলাস।

দুই বোনকে দেখেই অমৃত একেবারে অবৈষ্ণবোচিত লাফ দিয়ে উঠল। আপ্যায়নটা অবশ্য। বৈষ্ণবোচিতই হল। বাকি খদ্দের যারা ছিল তাদের ফেলে বলে উঠল, কে, তিলুদিদি? সঙ্গে নিশ্চয়ই বড়দিদি? কী ভাগ্যি ! শুনেছি এঁয়ারা এসেছেন। আসেন আসেন, বসেন।

লীলা তিলি, দু জনেই হেসে উঠল। তিলি ফিসফিস করে বলল লীলাকে, যে দশগণ্ডা জুটিয়েছি, এটি তার একটি। বলেই আবার দু জনে হাসি।

তিলি মুখ ফুটে বলল, বসব না অমর্তোদা। আধসের মুড়ি দাও।

আধসের? এত মুড়ি খাবে কে? কিন্তু অমৃত কিছু বলল না সে বিষয়। তার তেলচিটে বেঞ্চিটা দেখিয়ে বলল, বসো, বসো। আসোই তো না আজকাল। আজ বড়দিদি এসেছেন, তা-ই। খালি তো মুদি নই, বিজয়দার শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের লোকও তো বটে। কী বলেন বড়দি বলে এমন করে লীলার দিকে তাকাল যে, লীলা হেসে লুটিয়ে পড়ল তিলির গায়ে।

অন্যান্য খদ্দেরদের মধ্যেও হাসিটা ছড়াতে লাগল। দু একজন বিরক্ত হল। তিলিকে অনেকেই চেনে। লীলাকেই দেখছে সবাই আজ। লীলার অলঙ্কার দেখছে বড় বড় চোখে।

অমৃত বলল, বসো, দুটো মিষ্টি আনাই।

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল তিলি। বলল, মুড়ি দেবে, না চলে যাব? মিষ্টি খাওয়ার সময় নেই এখন।

তিলির এ গাম্ভীর্যকে বড় ভয় অমৃতর। যেন দুরন্ত দামড়া বাছুরটি ধরবার জন্য দড়ি নিয়ে এদিক ওদিক করা। টপ করে ফাঁসটি গলিয়ে দিয়ে বাঁধা। কিন্তু ধরে বাঁধা যায় না কিছুতেই। দামড়া বাছুর তো নয়, তিলি যে সেয়ানা বকনা। হতাশ হয়ে যেন সাময়িকভাবে দড়িটা কোমরে বাঁধল অমৃত। হেঁ হেঁ করে বলল, দিচ্ছি গো দিচ্ছি, রাধেকৃষ্ণ। দেখেন বড়দি একলা থাকি, হাত পুড়িয়ে বেঁধেবেড়ে খাই। আর এই কল মিল জায়গা। চোদ্দো পুরুষ অনাচার না করলে, এ জায়গায় কোনও শালা আসে না। তা একটু…

তিলি বাধা দিয়ে বলল, তুমি আর পনরো পুরুষ অনাচার কোরো না অমর্তোদা।

কে এক জন বলে উঠল, যা বলেছ তিলুদি।

দুই বোনই তাকাল। এ পাড়ার বিষ্ণু। কাজ নেই লোকটার। সংসারেও কেউ নেই। ভবঘুরের। মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মাথা ভরতি চুল। মুখটা দেখলে বোঝা যায় বেশ সুপুরুষ। দেখতে ছিল। রীতিমতো শক্ত সমর্থ লম্বা চওড়া মানুষ। এখন আর মাংস নেই, শুধু হাড়। হাড়গুলিও এত মোটা যে, ওকে রোগা মনে হয় না কখনও।

অমৃত ভেংচে উঠল, যা বলেছ তিলুদি। সাত সক্কালে ধার চাইতে এসে আবার ফোড়ন কাটা কেন?, যাও, কিছু পাবে না।

বিষ্টু বলল, উদাসীন শ্লেষভরা গলায়, খচে গেলে দাদা?

সেদিকে কান না দিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে অমৃত বলল, তা হ্যাঁ বড়দি, দেশের হালচাল কেমন দেখে শুনে এলেন। ভাগাভাগি নির্ঘাত, না?

অমৃতকে দেখা অবধি লীলার হাসি সংবরণ হচ্ছে না। বলল, তাই তো শুনেছি। অমৃত তু তু করে উঠল, আহা, অত বড় কারবার। আর সিরাজদিঘার মতো বন্দরে। তবে হ্যাঁ, খাঁটি মানুষ। আবার হয়ে যাবে। ফাঁদতে পারলে এখানেও জমবে মন্দ না। গলা চেপে বলল, তবে হ্যাঁ, ওই পশ্চিমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। খুব জোর কমনিশন চালাতে হবে।

কমনিশন হল কম্পিটিশন। গলা ছেড়ে, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, যশোর জেলাটাও কি পাকিস্তান হয়ে যাবে বড়দি?

তা তো জানে না লীলা। ভাগাভাগি কবে হবে, কতখানি হবে, সে তার কিছুই জানে না। কোথায় ব্যবসা ফাঁদলে কী হবে, সে কথা সে তিলেকের তরেও কোনওদিন ভাবেনি। সে তো ছুটছে। দিবানিশি ছুটছে কীসের পেছনে। একটি নিদারুণ অতৃপ্তি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে পেছনে ফেলে ছুটেছে সে দিগবিদিক জ্ঞানশুন্যা হয়ে। সে কেন অতশত ভাববে। যার নিজের ঠিক নেই, সে পরকে দেখতে যাবে !

অমৃতকে জবাব দিল তিলি, মেয়েমানুষ অত খোঁজ রাখে না। তুমি মুড়ি দাও দিকিনি।

অমৃত মুড়ি দিল। পাল্লা ঝোঁকতা দেখে দু মুঠো কম দিল। দিয়ে আবার একমুঠো ফাউ দিল। তিলি বলল, বেশি দিলে যে।

অমৃত বলল, না দিয়ে যে পারিনে গো।

তিলি বলল, কত বেশি দিলে, আমিও হিসেব রাখছি।

বলে আবার দু বোন হেসে উঠল। শেষ মুহূর্তে মুখ খুলল লীলা। বলল, মুদির চেয়ে পাল্লাটার পেরাণেই রস বেশি দেখছি।

সকলেই হেসে উঠল। কোঁচড় ভরে মুড়ি নিল তিলি। কিন্তু অমৃতর মুখটা কালি হয়ে গেল। পাল্লার চুরিটা ধরা পড়ে গেছে। সে জন্য পাল্লার প্রাণ বলে অমৃতর প্রাণে খোঁচা দিয়ে গেল। কিন্তু কী করবে? অভ্যাস হয়ে গেছে এমন, যাকে ভাল লাগে পাল্লাটি তাকেও ঠকিয়ে বসে।

দুই বোন বেরিয়ে এল রাস্তায়। সবাই তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। অমৃত কোমর চুলকোতে চুলকোতে মনে মনে বলল, হুঁ। দুটিই সমান।

হেলে দুলে চলেছে দুই বোন। দূর থেকে কে গেয়ে উঠল,

সাথী ছোড় গয়ে,
অব কহাঁ বসেরা আপনা।

তিলি বলল, শুনলি তো ! ভাসিয়ে নেওয়ার অনেক আছে। জলের অভাব কী? ডুবলেই হয়।

লীলা বলল, কে লো?

কে আবার? দশগণ্ডার আর এক জন। বোধ হয় পকেটমার, নয়তো সিঁধেল চোর। আর একটু ভাল হলে হয়তো, ফেরোজ গুণ্ডা, চাওয়ালাও হতে পারে। বলে হাসতে গিয়েও হাসিটা উদ্দাম হয়ে উঠল না।

লীলা হাসল খিলখিল করে। সত্যি, ভেসে যাওয়ার জন্য কত নদী আছে এ বিশ্ব সংসারে। নদী খাল বিল গাং। কাঁচা পাকা পঙ্কিল গভীর নর্দমাও আছে, ছড়িয়ে আনাচেকানাচে, পথের আশেপাশে। তাতেও কত স্রোত। ভেসে যেতে কী আর আছে? শুধু পার পাওয়া যাবে না। কোনওদিন। অথচ প্রতি পদক্ষেপে চোরাবালি। তলা ক্ষয়ে-যাওয়া পাড়। প্রতি মুহূর্তে পড়ি পড়ি, মরি মরি। তবুও ন যযৌ, ন তস্থৌ। ভাসা যায় না, দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। দিদি এর কী বুঝবে! যার আছে মেঘনাদ দাস, তিলির কথা সে বুঝবে না।

বুঝবে না ! যার আছে মেঘনাদ দাস, অষ্টপ্রহর তারও জীবন জলতরঙ্গে বাঁকা। সেই বাঁকা স্রোতের গতিবিধি তিলি বা কী বুঝবে!

নকুড় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংবাদ নিল দেশের। মেঘনাদকে সে বরাবরই একটু ভয় করে। ভয় নয়, বোধ হয় সমীহ করে। জামাই হলে কী হবে জামাইয়ের জীবনবৃত্তান্ত তার কাছে এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী। তা ছাড়া তার বিশ্বাস নোকটার উপর মা লক্ষ্মীর নজর আছে সব সময়। সুনজর সেটা। নইলে, লালমিঞা তো তাকেও সাহায্য করে ছিল কিছু। সে তো কিছুই করতে পারল না জীবনে। আর এই মদন সা’র বেটা তার জামাই। দূর পথে পাড়ি দিতে মদন সা অনেকবার এসেছে তার দোকানে সোনাদুলির চরে। নকুড় মুড়ি বাতাসা খাইয়েছে তাকে। খবরাখবর জিজ্ঞেস করেছে। মদন সা’র দুঃখে আহা উঁহুও যে না করেছে, তা নয়। হোক ভাঙা দোকান। তবু মদন সা’র মতো তাকে দেশে দেশান্তরে বেড়াতে হয়নি ঘুরে। সে বরং মদন দাসকে পরামর্শ দিয়েছে, বুঝলেন কী না দাসমশাই, অনেক বয়স হল। আর ঘোরাঘুরি করে কী হবে? যা হোক টিমটাম সাজিয়ে নিয়ে বসেন সিরাজদিঘার বাজারে। ছেলেটা আছে, তাকেও কাজে লাগান। দুটি মানুষ আপনারা। চলে যাবে। কোনওরকমে। নকুড় নিজে ভয়ানক গাভাসানো মানুষ। জীবনে কখনও সোনাদুলির বাইরে। যায়নি। শত অভাবে অনটনেও নয়। সোনাদুলি থেকে যেদিন বেরিয়েছে, সেদিন চিরদিনের জন্যই। বেরিয়েছে। সে কী বুঝবে মদন দাসের কথা? মদন দাস তাই তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। যার মাথায় লক্ষ্মণ সা’র দেনা, ভিটে মাটি বন্ধক, তাকে নকুড় সা এ সব কী বলছে?

সেই মদন দাসের ছেলে। তার জামাই মেঘনাদ। আজ হঠাৎ জীবনে একটা ধাক্কা খেয়ে ছুটে এসেছে এখানে। এ ধাক্কা সামলে উঠতে কতক্ষণ। নকুড় ভাবে, ভগবান যা করেন, তা মঙ্গলের। জন্যই করেন। বোধ হয় মেঘনাদকে এ ধাক্কাটা ভগবান দিয়েছেন নকুড়ের মুখ চেয়েই। যেন দেশব্যাপী ধাক্কাটা শুধু মেঘনাদকে কেন্দ্র করেই। হয়তো, এখনও আশা আছে নকুড়ের। মেঘুর ভেতরের অবস্থা সবটা না জানলেও, কিছুটা অনুমান করতে পারে সে। মেঘনাদের সঙ্গে জীবনটাকে। জড়ালে, লক্ষ্মীর স্পর্শলাভ ঘটে যেতে পারে এ বয়সে।

নকুড়ের ব্যর্থ হতাশ জীবনে আশার আলো নিয়ে এসেছে মেঘনাদ। তার ভাটাপড়া রক্তধারায় চোরা বানের গুনগুনানি বাজছে। সে নিজে একজন সাহা। হয়তো গদিতে বসার সুযোগ আসবে জীবনে। মহাজন নামের গৌরব অর্জন করতে পারবে। এই অষ্টপ্রহর ভাঙাচোরা সংসার, অভাব অনটন মিটতে পারে। বিজয়ের কলে খাটা পয়সার সান্ত্বনা প্রয়োজন হবে না। অনন্তের ভিক্ষার দান নিতে হবে না আর হাত পেতে। লক্ষ্মীমন্ত মানুষ যখন এসেছে এ সংসারে, তখন তার শ্রী ফিরতে পারে। গলার কাঁটা তিলিটার ব্যবস্থা হয়তো মেঘনাদ এবার নিজেই করবে।

তাই যখন সে মেঘনাদের হাত ধরেছিল, সেই স্পর্শের মধ্যে তার অসহায়তা ও আশা ব্যক্ত করেছিল। মেঘনাদ স্পর্শ বোঝে। তলিয়ে বিচার করতে জানে না। শ্বশুরকে তার ভাল লেগেছে। হতাশায় হোক, আনন্দে কিংবা স্নেহে হোক, ওই স্পর্শটুকুর প্রয়োজন ছিল মেধুর।

নকুড় সা ঘন ঘন গলার কণ্ঠী হাতড়াচ্ছে। অনেকদিনের পুরনো কষ্ঠী। তেলে জলে কালো। কুচকুচে হয়ে উঠেছে এখন। কোনওদিন টেনে ছিঁড়ে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারেনি সে। তেমনি উত্তেজিত মুহূর্ত কোনওদিন আসেনি তার জীবনে।

মেঘু বলল ধানমণ্ডাইয়ের সেই সাহেবের কথা। তার পরামর্শ ও মতামত। নকুড় বলল, অতি সত্যি কথা বাবা। এখানকার লোকেও দেখছি, দেশ ভাগাভাগি চায়। ধানমণ্ডাইয়ের সায়েব তোমার সত্যি ইষ্টজন। দেশ ভাগ হবেই। আগে এসে ভালই করেছ। এখন তোমার মনে অনেক দুঃখু কষ্ট ভয়। বুঝি তো। অমন সাজানো জিনিস ফেলে চলে এসেছ। ভাবো, মাথা ঠাণ্ডা করে, মন দিয়ে ভাবো। দেখো, শোনো, ঘোয়রা এদিক সেদিক। তারপর ভেবেচিন্তে কাজ আরম্ভ করা যাবে।

নকুড় সা’র আর তর সইল না। বলে ফেলল, বুড়ো হয়েছি। এ হাড়ে ভেলকি খেলবে না ঠিকই। তবু, তোমার কোনও কাজে যদি লাগি, সে আমি করব। তোমাকে বলতে হবে না। তোমার বাবা থাকলে যা করত, আমিও তাই করব। তুমি এখানকার হালচাল দেখো, এদিকে দেশেরও যা হয়, একটা কিছু হয়ে যাক। ধীরে সুস্থে আরম্ভ করা যাবে।

নকুড় সাকে বিশ্বাস করল মেঘু। ওটাই লালমিঞার শিক্ষা। যদি মন বলে, তবে আগে বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করে যদি ঠকতে হয়, তবে ঠকো। ঠকে, ঠেকে শেখো। চিরদিন কিছু আর ঠকতে হয় না মানুষকে। তবু বিশ্বাস আর ভরসা তো এক কথা নয়। তেমন ভরসা নেই মেঘুর। বিপিন থাকলে ভরসা করতে পারত মেঘু। তবে আপাতত বিশ্বাসটাই প্রয়োজন। মনের কথা বলেছে। নকুড়। অতবড় জিনিস ফেলে এসে মন মুষড়ে গেছে, ভেঙে পড়ছে। আবার আশাও দিয়েছে। হয়তো তাই। মেঘু তার নিজের উপর তো বিশ্বাস হারায়নি।

জমিজমা ঘরবাড়ি গদি কারখানার কথা উঠল। কে দেখবে শুনবে, কার উপরে ভার আছে? বিপিনের উপর। বিপিন? নকুড়ের কুঞ্চিত কপাল সর্পিল হয়ে উঠল। শত হলেও একজন কর্মচারী মাত্র।

বলল, সেটা কি ঠিক হয়েছে বাবা?

মেঘু বলল, কোনটা?

আন্দাজ করতেই পারেনি মেঘনাদ। নকুড় বলল, এই বিপিনের উপর সব কিছু

ভ্রূ দুটো কুঁচকে উঠল মেঘনাদের। তার নিজের ভালমন্দের উপর একমাত্র লালমিঞার কথাই তার সহ্য হত। আর মনে মনে যদি কাউকে সহ্য হয়ে থাকে, ভালবেসে থাকে, সে হল বিপিন। নকুড়কে সে কতটুকু জানে, যত জানে বিপিনকে ! তার কাছে নকুড় বিপিন আকাশপাতাল তফাত। হলই বা শ্বশুর, আর একজন কর্মচারী মাত্র। বিপিন তার দুর্দিনের সঙ্গী।

সে খালি বলল, ঠিকই করেছি। বিপিন ছাড়া আমার আছে কে?

কথাটা লাগল নকুড়ের বুড়ো বুকে। বিপিন শ্বশুরের চেয়েও বড় ! বিশ্বাস বলে কথা। হবে হয়তো তাই। বিরক্ত করতে চায় না মেঘনাদকে।

মেঘনাদ বলেই ফেলল, বিপিনদাটা এলে তো বাঁচতাম। আসতে চাইল না। বললে, তোমার গলগ্রহ হয়ে থাকব না এখন। কাজ আরম্ভ হোক, তারপর যাব। বড় খাঁটি মানুষ।

দু হাতে কণ্ঠী খুঁটতে খুঁটতে বলল নকুড়, তা ভালই।

মনে মনে বলল, কত খাঁটি তা ভগবান জানে।

তারপর অন্যান্য ব্যবসায়ের কথা উঠল। লক্ষ্মণ সা’র খবর কী। কী রকম চলছে তাদের কারবার? দুরবস্থার কথা নকুড় জানে। এও জানে লক্ষ্মণ সা’র নাতনিকে কেন বিয়ে করেনি মেঘনাদ। কিন্তু লক্ষ্মণ সা’র দুরবস্থায়ও মেঘনাদের দুশ্চিন্তা। বলল, কোনওরকমে চলছিল। তার উপরে এই ভাগাভাগি। কী হবে বলা যায় না? শত হলেও ব্যবসায়ী মানুষ। চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ সব দেখা যায় না।

মেঘনাদের সরল হৃদয়টি পরিষ্কার ফুটে উঠল নকুড়ের চোখের সামনে। পিতৃশ লক্ষ্মণ সা’র প্রতিও কোনও রাগ নেই মেঘনাদের। বিতৃষ্ণা আছে। কিন্তু কারও লক্ষ্মীলাভে তার হিংসা নেই। বরং মার খেলে কষ্ট পায়।

লালমিঞা বলত, শোধ নিবি অন্য রকম। সদ্ভাবে। পড়ে গিয়ে আছাড় খেলে আর তুই দাঁত বের করে হাসলি। একে বলে জানোয়ারের হাসি। নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়া, দেখবি, হিংসা নিয়ে সে তোর পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। এবার হাত বাড়া, ওকে তোল। তুলে দাঁড় করিয়ে দে। এর নাম শোধ। আর যদি দুশমন মরণ বাড় বাড়ে, তবে তোর সাচ্চাপনার আগুনে সে এমনিই পুড়ে মরে যাবে।

তবে আজকের কথা আলাদা। আগুন লাগতে যাচ্ছে সকলের ঘরে। কে কার ভিটেয় জল দেয়? যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। লক্ষ্মণ সা’র কথা ভাববার অবকাশ নেই মেঘনাদের। ভাবতে চায় না সে।

জামাই শ্বশুর কথায় ব্যস্ত। দরজার আড়ালে এসে দাঁড়াল লীলা আর তিলি। তিলির হাতে কানা উঁচু কলাইয়ের থালায় মুড়ি। তেল নুন পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে মেখে এনেছে। এক হাতে মুড়ি, অন্য হাতে চায়ের গেলাস। আসতে আসতে তিলি দাঁড়িয়ে পড়ল।

লীলা বলল, দাঁড়ালি যে। তোর আবার লজ্জা করছে নাকি?

তিলি বলল, লজ্জা না ছাই। মাইরি, তোর বরের চেহারা যেন বিজলি কারখানার মিঞা টিণ্ডেলের মতো। আমার ভাই বড় ভয় করছে।

লীলা বলল, তখন বললাম যে তোকে চেহারার কথা। দেখ না, চেহারাটা দেখলে ভাল মানুষ মনে হয়। ও তো টিলেই। নিজের কারখানার টিণ্ডেলের কাজ ওর কখনও পছন্দসই হত না। নিজে গিয়ে তণ্ডুল তাতাত।

ঠোঁট উলটে বলল, তবে ভয়ের কিছু নেই। দেখতেই ওই রকম। চল না।

মনে মনে অবশ্য তিলির অন্য কথা ছিল। প্রথম দেখায় সে কথা মনে আসেনি। এখন বড় জড়সড় হয়ে উঠল। তার এই অনুঢ়া এত বড় শরীরটা দেখাতে মরমে মরে যাচ্ছে সে। না জানি কেমন করে দেখবে। কী না জানি ভাববে এত বড় আইবুড়ো মেয়েটাকে দেখে। মানুষের মন যে। বড় বিচিত্র। এত বড় মেয়ে ঘরে, বিয়ে হয়নি। অমনি যেন কী এক বিচিত্র রহস্য উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে সে মেয়ের চোখে মুখে, সারা দেহে। মানুষের চোখ দিয়ে তিলি নিজেকে অনেকবার এমনি দেখে লজ্জায় ও ব্যথায় জড়সড় হয়েছে। এখন আর হয় না। তবে, মেঘনাদ নতুন মানুষ। অনেকদিন পর দেখা ; হয়তো হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।

লীলা বলল, নাকি, বনুয়ের প্রেমে পড়ে গেলি।

দু বছর আগে হলে মুড়ির থালাসুদ্ধ মারত তিলি লীলার মাথায়। খালি বলল, তোর মুখে আগুন মুখপুড়ি।

লীলা হেসে বলল, মুখে আগুন নয়, তোর মুণ্ডু। তুই কি তাই ভেবেছিস নাকি ওকে। ও এখন ওর নিজের কথায় মত্ত। কাউকে ওর মনেও নেই, চোখেও নেই। সে বোধ থাকলে তো ভালই। হত।

দূর হ, দুর হ তুই। বলে তিলি এসে পড়ল সামনে।

সঙ্গে সঙ্গে লীলাও এল। লীলা ঠিক বলেনি। যেমন ঠিক বিচার সে কোনওদিন করতে পারেনি মেঘনাদের উপর। দু বোনকে একসঙ্গে দেখে, মেঘনাদ খুশি হয়ে উঠল। তবে তার খুশি ধরা মুশকিল। হঠাৎ অনেক দিন পরে এক নতুন ঘরোয়া স্বাদ পেল সে। বাপের বাড়ি এসে লীলার অষ্টপ্রহর অতৃপ্ত প্রখর মুখ যেন শান্তিময় দেখাচ্ছে। কাঁদছে, হাসছে, ঘুরছে, বোনের সঙ্গে সঙ্গেই। অখণ্ড কাজের জীবনে বাড়ি ফিরেছে সে চিরদিন অতৃপ্ত মনে। ফিরেছে বেদের ডেরায়। লোক নেই জন নেই, দুটো কথা বলার মানুষ নেই এক লীলা ছাড়া। আর লীলা থেকেছে তার নিজের লীলা নিয়ে।

মুড়ি দেওয়ার আগে হাত বাড়িয়ে মুড়ি নিল সে। মুড়ি কিছু কম হয়েছে তার পক্ষে। তা হোক! খাওয়াটা তো সব সময় বড় নয়।

নকুড় বলল, ঠুমিকে তোমার মনে আছে তো?

এতক্ষণে গোঁফের ভেতর থেকে মেঘনাদের দাঁত দেখা গেল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে, অনেক বড় হয়ে গেছে।

লীলা চিমটি কাটল তিলিকে। তিলি ছটফট করতে লাগল পালাবার জন্য। যা ভেবেছিল তাই। বড় হওয়া, শুধু বড় হয়ে যাওয়াটাই বড়। নকুড় তাড়াতাড়ি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করব বাবা, এখনও ছুঁড়িটাকে বে দিতে পারলাম না। বোঝো তো সবই।

মেঘনাদ তবু হাসল দু বোনের দিকে তাকিয়ে। যেন নকুড়ের কথাটা হাসিরই।

নকুড় আবার বলল, মুড়ি তো দিলি। একটু হাত-মুখ ধোয়ার জল দে।

তিলি চা নামিয়ে দিল। মেঘু ক্রু কুঁচকে বলল, এ কী, চা? ও সব খাইনে। অতবড় বাবু এখনও হইনি। শত হলেও পেঁয়ো বাঙাল তো।

চা খাওয়াটা তার কাছে বাবু হওয়ার সামিল। ওটা তার ছোটকালের সংস্কার।

তিলি বলল, ওটা বুঝি বাবুরা খায়? আমরা বাঙাল গরিবেরাই তো ওই খেয়ে থাকি।

চা খেয়ে? ওরে বাপরে। আমি পারব না। তোমার দিদিকে দেও।

দুই বোন চোখাচোখি করে হেসে উঠল। তিলি বলল, আপনি না খেলে দিদিও খাবে না।

লীলা বলল, আমার বয়ে গেছে।

যেন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশেই নকুড় বলল, তা হলে আমাকেই দে।

মেঘনাদ ভেবেছিল, ঝুমি মুখ ঝামটা দেবে তার কথায়। কিন্তু আজ সে যেন সিরাজদিঘার কুমি নয়। আজ সে মায়ের মেয়ে, ছোট বোনের দিদির মতো কথা বলছে।

তিলি বলল, দিদি তুই বউকে জলটা এনে দিতে বল। আমি তোদের এই চালিস না ফালিস, ওই ছোঁড়াকে চাড্ডি মুড়ি দিয়ে আসি।

চলে গেল দুই বোন একসঙ্গে। জল এনে দিল লীলা। একটুখানি সময়ের মাত্র ফাঁক। এরই মধ্যে আবার মেঘনাদের মনে ভিড় ঠেলে এসেছে অনেক কথা। এখন মনে মনে শুধু আলো ছায়ার খেলা। আশা নিরাশার দোলা। তবু ভাল। ধানমণ্ডাইয়ের সাহেবের কাছ থেকে আসার দিন থেকে সে মুখ খুলতে পারেনি। কিছু ভাবতে পারেনি। এখানে এসে পৌঁছনোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নিকষ অন্ধকার ভরা ছিল মন। এখন মাঝে মাঝে আলো দেখা দিচ্ছে। নতুন করে কাজের কথা ভাবছে সে।

তার নীরব মুখের দিকে তাকিয়ে নকুড়ও নীরব। সে যেন শোল মাছের পিছনে পিছনে ল্যাজা হাতে শিকারি। নিঃশব্দে অদৃশ্যে ফিরছে জলে জলে। হয়তো উপমাটা একটু নিষ্ঠুর হল। তবু, এমনি ভাবেই যেন, মেঘুর মনের গতিবিধি নিরীক্ষণ করছে সে।

মেঘুও অন্যমনে নিরীক্ষণ করছে এখানকার মানুষগুলিকে। খানিকটা অসাবধানে, অন্যমনে। লীলা জল এনে দিল। চোখ বাঁকিয়ে একটু তাকাল মেঘুর দিকে। বলল, গায়ের জামাটা যে গায়ে গায়ে পচল। বাগেরহাটের কাপড় যে আর চেয়ে দেখা যায় না। খুলতে হবে, না কী?

সত্যি, জামাটা এখনও ভিজে রয়েছে। বলল, হ্যাঁ, এই যে খুলছি। বলে সে লীলার দিকে এক মুহর্ত তাকিয়ে রইল। বোধ হয় এমনি করে তাকিয়েছিল অনেক দিন আগে।

লীলার নাকের ডগা কেঁপে উঠল একটু। হঠাৎ একটু বিচিত্র হাসি হেসে বলল, মাথা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে মনে হচ্ছে?

মেঘনাদ উচ্চরবে হাসতে গিয়ে থেমে গেল। নকুড় রয়েছে। জামাটা খুলে ফেলে তুলে দিল লীলার হাতে। শক্ত বিশাল শরীর। গায়ে ঘামাচি উঠে লালচে দেখাচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে মুখে হাতে জল দিল। বিজয়ের বউ নিয়ে এল গামছা। লীলাকে বলল, এই নেও দিদি।

লীলা বলল, আমাকে কেন, তুই দে।

 ভাজকে ঠাট্টা করে বলছে লীলা কথাটা। একটু লজ্জা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ষোড়শী ঠাট্টা বোঝে কি না কে জানে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত লীলার দিকে। আবার ঘোমটা আর একটু টেনে দিয়ে গামছাটা হাত বাড়িয়ে ধরল মেঘুর কাছে।

লীলা হেসে উঠল খিলখিল করে।

চমকে উঠল নকুড়। অনেকদিন আগের, সোনাদুলি চরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হাসি শুনে। অনেকদিন আগের সোনাদুলির চরের এক বীভৎস ঘটনা। যেন একটা দুঃস্বপ্ন। মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয়। কত ভাবনা, কত দুশ্চিন্তা, কত ভয়। অথচ সিরাজদিঘার গদির মালিক মেঘনাদ দিব্যি শানাই বাজিয়ে বিয়ে করে নিয়ে গেল মেয়েটাকে। রাত্রেও কাটারি শাণিয়ে রেখেছিল নকুড়। মনে করেছিল ; গলায় বসিয়ে বস্তায় করে ফেলে দিয়ে আসবে ধলেশ্বরীর জলে। সুকুমারী বাধা দিয়েছিল। মেয়ে বলে নয়। হাঙ্গামার ভয়ে। সেই মেয়ে। আজ সংসারে সকলের চেয়ে সুখে রয়েছে। হঠাৎ ছানি পড়া আধ কানা হয়ে গেল নকুড়ের চোখ। পিট পিট করে তাকাল লীলার দিকে। এই মেয়েটাই বোধ হয় আছে আজ নকুড়কে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। এই মেয়েই হয়তো প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারে তাকে এ জীবনে।

সে কপালে হাত ঠেকিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, ঝুমি নাকি লো?

ঝুমি বলল, হ্যাঁ।

নকুড় বলল, আয় মা, একটু কাছে আয়। চোখে ভাল ঠাওর করতে পারিনে। ভাবলাম, তিলি বুঝি?

ভ্রূ জোড়া কুঁচকে উঠল লীলার। এত কানা যে, ঠাওর পর্যন্ত হয় না? ঠোঁট দুটো বেঁকিয়ে কাছে এসে বসল লীলা। তেমনি অগোছাল। বোম-খোলা জামা। লুটনো আঁচল। বলল, চোখে ওষুধ দেও না কেন?

মেয়ের পিঠে হাত দিয়ে বলল, আয় মা, বাঁশের মইয়ে চাপি, তাপর ওষুধ লাগাব। তার কম্পিত হাতটা ঘুরতে লাগল লীলার পিঠে। কাটারির কোপের, দাগটা অনুভব করতে চাইছে নকুড়। যে। দাগটা আজ অবধি মেঘনাদ পর্যন্ত দেখতে পায়নি। এই দশ বছরের মধ্যে।

মেঘনাদের হাতে গামছাটা তুলে দিয়ে ষোড়শী বলল লীলাকে, আমি যাচ্ছি দিদি।

লীলা বলল, চল আমিও যাই।

মেঘনাদ মুড়ি চিবুতে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *