৩. ডাক্তার এসে চলে গেছে

ডাক্তার এসে চলে গেছে। বাবা এসেছেন, বড় চাচা এসেছেন, আবু এসেছে সবাই এসেছে। মাহবুব জরুরি কাজে ব্যস্ত, পরে আসবে জানিয়েছে। যেন হাট লেগেছে আজ মরিয়মের বাড়িতে।

কিন্তু হাশেমকে কি সুস্থির রাখা যায়?

থেকে থেকেই বিছানা ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে রক্তচোখে লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারি করছে। তার রকম দেখে না কাছে আসা যায়, না কিছু বলা যায়।

বিছানায় কি সহজে আসতে চেয়েছিল? সেই বাইরের ঘরেই গো ধরে বসে থাকবে। কেউ তাকে একচুল নড়াতে পারেনি। ইতিমধ্যে জ্বরের ঘোরে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সেই তখন ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছিল ওপরের ঘরে।

জ্ঞান ফিরেছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। সাহস করে বড় চাচা খোরশেদ চৌধুরী স্মিত মুখে এগিয়ে আসেন। হাশেম তার দিকে দৃষ্টিবাণ হানে, যেন এই লোকটাকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিছুতেই মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে। খোরশেদ চৌধুরী বললেন, তোমরা সবাই যাও তো এ ঘর থেকে। দেখি আমি ওকে বোঝাতে পারি কি না।

তারপর হাশেমের কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন, এসো।

কী হলো হাশেমের, মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করল তাঁকে। গিয়ে সুবোধ ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল।

খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা?

না। নাতো।

আমাকে চিনতে পারছিস?

হুঁ।

কে আমি বলতো?

বড় চাচা। ছেলেমানুষের মতো টান তুলে উচ্চারণ করে হাশেম। শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। যাকে কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না, সে হঠাৎ এত শান্ত হয়ে গেল কী করে?

খোরশেদ চৌধুরী তখন হাশেমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, একটু চুপ করে থাকো। কেমন? নইলে সেরে উঠবে কী করে?

হাশেম তক্ষুনি চোখ বুজে তাঁর কথা পালন করলো।

খোরশেদ চৌধুরী মুখ ফিরিয়ে ভাইকে বললেন, দেখেছ মুরশেদ, এখনো আমার কথা ভোলেননি। পাগল হলে কী হবে, ঠিক মনে আছে।

তারপর হাশেমকে দেখিয়ে মরিয়মকে বললেন, ছোটবেলায় পুরো একটা বছর আমার কাছে। ছিল যে। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোত! এই ছোট্ট এতটুকুন। শোধও ছিল না, বোধও ছিল না। তারপরে–না এলো মুরশেদ রেঙ্গুন থেকে।

হাশেম হবার পরপরই চাকুরি সূত্রে মুরশেদ চৌধুরী এক বছরের জন্যে রেঙ্গুন গিয়েছিলেন। এক বাসাতেই থাকতেন তখন তিন ভাই। খোরশেদ চৌধুরী তখন, এখনো নিঃসন্তান। হাশেমকে সেই একটা বছর বুকে করে রাখার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেন নি। খোরশেদ চৌধুরীর চোখ সজল হয়ে উঠতে চায় যেন। বিব্রত হয়ে শাদা চুলের ভেতরে হাত চালাতে থাকেন খামোকা। মরিয়মকে বলেন, তোমার ভাগ্য ভালো এমন ছেলে কোলে পেয়েছিলে। কে বলল ও পাগল হয়েছে? আমি পাগল চিনি না? যেমন ছেলে তেমনি আছে।

হঠাৎ হাশেম চোখ খুলে বলল, পানি।

তাড়াতাড়ি গেলাশ ভরে পানি এনে দেন মরিয়ম। হাশেম ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে বিছানা থেকে আবার নেমে যেতে চায়।

খোরশেদ চৌধুরী বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

না, না, কী কচ্ছিস?

আহ।

যেন অসীম বিরক্ত হয়েছে হাশেম বাধা পেয়ে।

ছেড়ে দিন আমাকে। আজ আমার খুব অস্থির লাগছে যে। খালি হাঁটতে ইচ্ছে করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলুন, কথা বলুন।

বড় চাচার হাত ধরে বিষম ঝাঁকুনি দেয় হাশেম। তারপর উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে থাকে। বলে, ভয় হয়, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু

জানালার কাছে গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হাশেম। মাথা নত করে কী যেন ভাবল। কিসসু বুঝতে পারেন না মুরশেদ চৌধুরী। বাড়ির বড় ছেলে অমন করে চলে যাওয়াতে আঘাত তিনি কম পান নি। এবার ছেলেটাকে সুস্থ মানুষের মতো দাঁড়াতে দেখে গলা খাকারি দিয়ে শুধোলেন, এতকাল ছিলি কোথায়, হাশেম?

স্বামীর প্রশ্নে মরিয়মও এগিয়ে আসেন। কাছে এসে তিনিও জিগ্যেস করেন, হ্যাঁরে, হঠাৎ চলে গেলি, একবার বাপ–মার কথা মনে পড়ল না? চলে গেলি কেন, হাশেম? কী তোকে দিতে পারিনি, বলবি না? তোর বাবার কান্না শুনে পথের মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ত, আর তোর কানে গিয়ে পৌঁছোয় নি?

খোরশেদ চৌধুরী ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে ওঠেন, এ সব কথা এখন থাক।

হাশেম আবার পায়চারি করতে শুরু করল। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসে, বুকের কাছে দুপা টেনে নিয়ে একটা বাঁধা কবুতরের মতো ম্লান হয়ে রইল। বলল, কম্বলটা দাও।

কম্বলটা হাতে পেয়ে ভালো করে গায়ে জড়াতে জড়াতে অপরূপ পরিতৃপ্ত দেখালো তাকে। বলল, একবার এক গাঁয়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বিরাট এক পুকুর। সেই এ মাথা থেকে ও মাথা। শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ পাগলের মতো পানি তুলে ফেলছে।

তার কথা শুনে ঘরের ভেতরে সবাই চুপ হয়ে গেছে। হাশেমের কণ্ঠ যেন কোন এক সুদূরের দেশ থেকে ভেসে আসছে। এই যে ছেলেটা, যাকে তারা দেখেছেন জন্ম থেকে, তার ভেতরে আজ সম্পূর্ণ অজানা এক পৃথিবীর অস্তিত্ব টের পেয়ে বড় চাচা, মা, সবাই বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছেন। যেন তাদের নতুন চোখ খুলে যাচ্ছে। হাশেম বলে চলেছে, আমি দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলাম, হ্যাঁগো ভাল মানুষ, এখানে আজ কিসের উদ্যোগ? একটা লোক, তামার মত তার। গায়ের বরণ, খালি গা, মাথায় লাল গামছা বাধা। সে বলল, খাঁ সাহেবের হুকুম হয়েছে পুকুর থেকে তামাম পানি তুলে ফেলতে হবে। আমি শুধোলাম, কেন? তখন আরেকটা লোক জবাব করলো, এ পুকুর যে ফি বছর মানুষ খায়। সাঁতার দিয়ে মাঝপুকুরে গেলে আর ফিরে। আসে না, তাই এবার খা সাহেবের হুকুম হয়েছে পুকুর থেকে পানি তুলে দেখবেন তলায় কী আছে? হাশেম মৃদু হাসলো এইখানে থেমে। কাণ্ড দ্যাখো। মানুষটা কী ক্ষ্যাপা। বলে কী না, পুকুর শুকিয়ে দেখবে কোন রাক্ষস হাঁ মেলে আছে তার পাতালে। সেদিন সারাটা দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম কাঠফাটা রোদ্দুরে। চারধারের ফেটে যাওয়া মাঠে নহর বইলো। তবু যদি এক আঙ্গুল পানি কমলো পুকুরের। যত তুলে ফেলছে, কল কল কল কল করে পানি তত বাড়ছেই। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার রক্ত ওরা নিঙড়ে নিঙড়ে ছেঁকে তুলছে।

বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে হাশেম। প্রথমে মনে হয়, চোখ বুজে ভাবছে, দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু না, ঘুম এসেছে তার। একটানা কথা বলতে বলতে অবশ হয়ে গেছে স্নায়ু। তাকে তুলে এনে শুইয়ে দেয়া হলো বিছানায়। মরিয়ম গিয়ে বসলেন তার শিয়রে।

বারান্দায় এসে খোরশেদ চৌধুরী ভাইকে বললেন, হ্যাঁ ভালো কথা মুরশেদ, গেল কাল। ছোটমিয়া চিঠি লিখেছে বীথির ব্যাপারে। তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।

খোরশেদ চৌধুরীকে তখন বড় বিব্রত দেখাচ্ছিল। কাল চিঠি পেয়ে অবধি মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না, বুঝতেও পারছেন না কী করে কথাটা পড়বেন। মুরশেদ চৌধুরী উদ্বিগ্ন হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। বীথির নাম শুনে বুঝতেই পারলেন না তার আবার কি হতে পারে। বিহ্বল হয়ে বললেন, বীথি, বীথির কী?

কিছু না।

খোরশেদ চৌধুরী ভাইকে ভরসা দেয়ার মত করে হাসেন। আমতা আমতা করে বলেন, ইয়ে, লিখেছে যে, আবুর সংগে বীথির মেলামেশাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। মানে, তুমি বীথিকে আমার ওখানে পাঠিয়ে দাও না?

ভেতর থেকে কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন মরিয়ম। মাথায় ঘোমটা তুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে চোখ নত করলেন খোরশেদ চৌধুরী।

.

সন্ধ্যার অন্ধকারে বাগানে নির্মম হাতে ফুল ছিড়ছিল বীথি। বাসার বাঁ পাশে অনেকদিন থেকে অনেকটা খালি জায়গা পড়ে ছিল। আবু সেখানে বাগান করেছে। এক কোণে দুটো বুড়ো বাতাবি নেবুর গাছ। তারপরেই দেয়াল। ওপারে রাস্তা। বীথির পরনে ছিল তাঁতের গাঢ় সবুজ শাড়ি। অন্ধকারে দূর থেকে ভালো করে ঠাওর হয় না। থোকা থোকা অন্ধকারের ভেতর থেকে শাদা শাদা ফুল আর কিসের তন্দ্রা–সৌরভ যেন জ্যোতি হয় বেরুচ্ছে। চারদিকের ব্যস্ততা আর কোলাহল যেন দেয়ালের ওপারে ঠেকিয়ে রেখেছে এক মায়াবিনী হাত। আবু তাকে ওপরতলা নিচতলা খুঁজে খুঁজে হয়রান হলো।

মাকে জিগ্যেস করল, মা বীথি কই?

মরিয়ম বিরক্ত হলেন।

এই সন্ধ্যেয় বীথি বীথি করে চাঁচাস নে তো।

 নামাজ পড়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিলেন তিনি, তার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে আবু বলল, ছেলে ফিরে এসে দেখি তোমার মেজাজটাই বদলে গেছে।

আজ মায়ের অপ্রসন্ন মুখ দেখে আবুর বিস্ময় যেন বাধ মানছিল না। মরিয়ম বললেন, মাতামাতি করিস বলেই তো মেজাজ করতে হয়।

কেন? আজ নতুন নাকি?

নতুন না হলেও বীথি বড় হয়েছে।

কোনোদিন যে ছেলের ওপর রাগ করেননি তাকে বকতে গিয়ে চোখে পানি এসে যায়। তার ওপর ভরসন্ধ্যে। বুক কাঁপতে থাকে মরিয়মের। কিছু না বলে অশ্রু চেপে চলে যান। বোকার মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আবু।

অবশেষে বীথিকে পাওয়া গেল বাগানে। সে তখন বেলি গাছটার সর্বনাশ করেছে সবকটা ফুল ছিঁড়ে। একটা ডাল করুণ হয়ে কাঁপছে তার হাতের মুঠোয়। আবু তার পেছনে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইলো খানিক। বীথিকে ডাকতে গিয়ে কেমন সংকোচ হচ্ছে তার এই প্রথম। আর বুঝতে পারছে না বীথির কাছে গাছটা কী অপরাধ করেছিল। ইতস্তত করে সে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, শোন।

শুনল, বীথিমুখ ফেরাল না। তার শরীরে একটা অস্পস্ট সাড়া জাগল শুধু। হাতের ডালটা ছাড়া পেয়ে লাফিয়ে ফিরে গেল। আবু জিগ্যেস করল, এখানে কী করছিস?

বীথি জবাব দিল না।

পায়ের কাছে ফুলের শাদা শাদা অংশ ছড়িয়ে আছে। বেলি গাছটা আবুর খুব প্রিয়। কিন্তু আবু কণ্ঠ নামিয়ে মমতা করে বলল, অমন করে সব ছিড়লি কেন? আমি তোকে সারাটা বাড়ি খুঁজে খুঁজে পাচ্ছি না। কিরে?

হঠাৎ আবুর মনে হলো তার সামনে বীথির বদলে বিলকিস পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। বীথিকে খুঁজতে এসে যেন বিলকিসকে আবিষ্কার করে ফেলেছে সে তার বাগানে। বলল, বুঝতে পারছি আজ তোরও মেজাজ হয়েছে।

মোটেও না।

এই এতক্ষণ পর একটা কথা উচ্চারণ করল বীথি। তারপর সরে এসে সিঁড়ির একটা ধাপে বসে রইলো।

 তখন আবু এসে তার নিচের ধাপে বসলো। তার দিকে তাকালো না। জিগ্যেস করল, হাশেম ভাইকে দেখলি?

হ্যাঁ।

আমাকে দেখে বুঝলি, বীথি, আমার চোখের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে রইলো।

বীথির দিকে তাকালো আবু। কেঁপে উঠলো বীথির বুক।

ও–কী, কথা বলছিস না যে? কথা বলবি না তো মর।

তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে, যেন বীথিকে সে মোটেই উদ্দেশ করছে না, এমনি করে বলে, মা–ও খুব মেজাজ দেখালেন আজ। সারা বাড়িটার যে কী হয়েছে তোরাই বুঝিস। তুই আমার শত্রু, বুঝলি?

বীথি চমকে চোখ ফিরিয়ে বলল, কেন, চাচিমা কী বলেছেন?

কিছু না। তুই শুনে কী করবি?

আবু আর বসে থাকতে পারল না। চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আবার তক্ষুনি চলে না গিয়ে বলল, আচ্ছা, আমাকে সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?

বীথি বুঝতে পারে না, ভয় হয়, আবু বুঝি তার অন্তর পড়ে ফেলেছে। নিজেকে তাই পাথর করে রাখে সে। কী একটা বলতে গিয়ে বলতে পারে না। কোনোরকমে পায়ের কড়ে আঙুলে সিঁড়ির একটা ভাঙ্গা কোণ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। আবু বলে, বুঝতে পেরেছি, আজ তুই আমাকে পড়তে দিবিনে, খেতে দিবিনে, এমনি করে জ্বালিয়ে মারবি তুই।

মানুষের একেক সময় কী হয়, শখের পুতুল নিজের হাতে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। কণ্ঠে তিক্ততা এনে বীথি বলে, কেন, আমি তোমার কী করেছি?

কী করিসনি বল?

আবু আবার সিঁড়ির ধাপে বসে। বসে যোগ করে, তুই কি মনে করেছিস, অমন মেজাজ করে থাকলে আমি আজ খেতে পারব? না, দুদণ্ড বই খুলে বসতে পারবো?

বীথি হঠাৎ পরিপূর্ণ চোখ তুলে তাকাল আবুর দিকে। আত্মার ভেতরে চুর চুর হয়ে যেতে যেতে সে উচ্চারণ করল, আমাকে তুমি কেন জ্বালাতে আসো, আবু ভাই?

.

বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে বীথির। বাতি নিবিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে শুয়ে থাকে। মনে মনে একা হয়ে যায় সবার কাছ থেকে। মাথার ভেতরে ফিরে আসে আবার সেই ভাবনা হাশেম ভাই কী করে জানলেন, আমি কষ্ট পাই? যেন কষ্টটার কথা কেউ বলে দেয়াতেই কষ্টের মাত্রা গেছে বেড়ে। একদিন, অনেকদিন আগে আবু তাকে বলেছিল, বীথি, আমার সংগে বেরুবি?

বীথি থাকত চুপচাপ। বড় একটা কারো সামনে বেরুতো না, কোথাও যেত না। সে যে এ বাড়িরই একজন একেক সময় যেন টের পাওয়া যেত না তাও। আর আবুর সংগে তার কথা হতো একেবারেই কম। সেদিন আবুর এ প্রস্তাব শুনে সে থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে আবছা খুশি লাগে। বেরিয়েছিল আবুর সংগে। আবুর যেন ঘোর লেগেছিল সেদিন। পকেটে যা পয়সা ছিল সব খরচ করেছে রিকশয় রেস্তোরাঁয় বীথিকে নিয়ে। হাতে যা সময় ছিল সব। উড়িয়ে দিয়েছে অস্থির হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে। কোনখানেই দুদণ্ডের বেশি তার মন টেকেনি। বিকেল থেকে শুরু করে সন্ধ্যের সেই অনেক পর অবধি এই কাণ্ড। বীথির যে কী নামহীন আনন্দ হচ্ছিল সেদিন। কিন্তু বাইরে তার কোন জানান দেয়নি। লজ্জা করেছে। বুকের ভেতর তরংগ উঠেছে।

সন্ধ্যের পর আবু বলল, চল, কোথাও গিয়ে বসিগে।

না, না।

বীথির ভয় করে। আবু পরামর্শ দেয়, তাহলে হাঁটি কিছুক্ষণ?

হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্সের কাছে এসে পড়ে ওরা। পথ ছেড়ে পাড়ি দিতে থাকে বিশাল ময়দান। আবু বলে, তুই খুব একা, নারে বীথি? সারাদিন বই আর কলেজ। একেক সময় আমার খুব রাগ হয় তোর ওপর।

বারে, পড়াশোনা করব না?

করবি তো। তাই বলে অন্ধ হয়ে থাকবি?

বীথি বুঝতেই পারে না আবুর আজ কী হয়েছে। তাকে একেবারে অন্যমানুষ মনে হচ্ছে। অন্ধ হয়ে থাকার অর্থটাও কিছুতেই বোধগম্য হয় না। সেটা টের পেয়েই আবু যেন খেদ করে বলতে থাকে, মানুষ তো অন্ধই। অন্ধ নইলে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়? বলতে হয়, এইতো এখানে। কিরে, চুপ করে আছিস যে? তোর খারাপ লাগছে?

নাতো।

তবে?

আমি কী বলব?

আবু যেন আপন মনেই আবর্তের মতো ঘুরতে থাকে। প্রথমে একটু চটে যায়। বলে, তোকে কিছু বলতে বলেছি নাকি?

পরে মমতায় ভিজিয়ে আনে কণ্ঠ।

—-হারে, এত যে বকছি, তুই রাগ করছিস না? তোকে যেন মানাচ্ছে না মোটে। তুই আমাকে চটে উঠছিস না কেন? আমার বিচ্ছিরি লাগছে।

 বীথি মৃদু গলায় বলে, আমি রাগ করতে জানি না।

ঐটুকু বলতে গিয়েই যেন হাঁপ ধরে যায়। গা কেঁপে ওঠে। আবু ওর হাতটাকে অন্যমনস্কভাবে মুঠোর ভেতরে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে। যেন খুব তন্ময় হয়ে কী ভাবছে।

অনেকক্ষণ পরে সে বলে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনেক কষ্ট, বীথি। তুই যা ভালো বুঝবি, করতে পারবি নে। বাইরে থেকে যে কেউ বাধা দেয়, তাও না। মনে হয়, মানুষগুলো সব নিজের শক্র। জানিস বীথি, তোকে দেখে যেন বুঝতে পারি আমি বেঁচে আছি।

বীথির মনে ছোটখাটো একটা ঝড় ওঠে। আবুর জন্যে কেমন বেপরোয়া টান পড়ে বুকের ভেতরে। বলে, বাসায় চলো।

তোর খারাপ লাগছে?

বীথি উত্তর দেয় না। আবু হেসে বলে, জানি তুই রাগ করেছিস। তোকে এসব কথা বলতে গেলাম কেন? কী জানি কেন বললাম। আমাকে খুব অমানুষ অভদ্র বলে মনে হচ্ছে তোর, না?

বীথি বলতে চায়, নাতো। কিন্তু পারে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটবার পর আবু যেন হঠাৎ রুখে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে বলে, তাহলে তুই আমার সামনে এসে দাঁড়ালি কেন, বীথি? আমাকেও কি পাগল বানিয়ে ঘর ছাড়া করতে চাস?

কী বলছ, আবু ভাই!

বীথি আর্তনাদ করে ওঠে।

ঠিকই বলছি। আমি তোর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়েছি, না দাঁড়াব যে তুই অমন রানীর মতো মুখ বুজে থাকবি?

তুমি ঘর ছাড়বে কেন?

কী জানি! বড়চাচা বলেন, হাশেম ভাই সাধু হয়ে গেছে। আসল ব্যাপারটা তো জানি আমি। বীথির কৌতূহল হয়। এসে অবধি সে হাশেমের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথাই শুনছে। কেন গেছে, ভালো করে কেউ তাকে বলতে পারেনি। বীথি সব ভুলে গিয়ে শুধোয়, কী হয়েছিল?

আবু মুখ ফিরিয়ে বলে, কাউকে বলিস না যেন। হাশেম ভাই ভালোবাসতো। ভালোবেসে। ঘর ছেড়েছে। তোর বিশ্বাস হয় না?

বুকের ভেতরটা বরফ হয়ে যায় বীথির। আবু বলে, এক একজন অমন করেই ভালবাসে, বীথি। কোন বাধ মানে না, যুক্তি বোঝে না। পাথরের সংগে আত্মার বিয়ে দিয়ে দেয় ওরা।

—-নে, একটা রিকশ ডাকি। বাড়ি চল।

সেদিন বাড়ি ফিরে এসেই মরিয়মের সমুখে পড়ে গেল ওরা দুজন। আবু চলে গেল ভেতরে। মরিয়ম জিগ্যেস করলেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বীথিকে, কোথায় গিছলি?

একমুহূর্ত ভাবলো মেয়েটা। বলল, বড় চাচার বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখি আবু ভাই। তার কথা শুনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অবাক হলো আবু।

আরেকটা দিনের কথা মনে করতে পারে বীথি।

আবু ইউনিভার্সিটি যাবার আগে গোসল করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে তার দরোজায় দাঁড়িয়ে বলল, কী করছিস?

 কিছু না।

তোর চিরুণিটা দে, সিথি করি। ইস, চুলগুলো যা বেয়াড়া লম্বা হয়েছে।

বীথি চিরুণি দিয়ে বলে, সেলুনে গেলেই পারো। ভীষণ আলসে আর নোংরা হয়েছ তুমি। আবু সিথি করতে করতে উত্তর দেয়, তাই বুঝি রোজ আমার ঘর সাজিয়ে রাখিস তুই?

রাখতো বীথি। কিন্তু মিথ্যে করে বলল, বয়ে গেছে। চাচিমা করেন।

আমার কি চোখ নেই?

আবু হাসতে হাসতে বলেছিল কথাটা। কিন্তু কতখানি যে মোচড় তুলল বীথির বুকে তা যদি আবু জানতো!

আবু চিরুণি রেখে বলল, কাল বিকেলে মনে হলো তুই যেন আমার ঘরে এলি। আমি বার থেকে ফিরে এসে শুয়েছিলাম। তুই টের পেলি কী করে যে ঘুমোচ্ছি? আমার মুখ দেখছিলি কেন? কী চুরি করতে এসেছিলি? আমি যদি তখন খপ করে তোর হাত ধরে ফেলতাম। তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেল, আবু ভাই?

কী জানি।

ঘরে ফিরে এসে ঘুমোচ্ছিল আবু। বিকেল ছটা ঘুমোনোর সময় নয়। বীথি তাকে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিল। বুঝি অসুখ করেছে। পা টিপে ঘরে এসে আবুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কিছু ঠাওর করতে না পেরে কপালে হাত রেখেছিল। আবু যদি তার তাকিয়ে থাকা টের পেয়ে থাকে তো কপালে হাত রাখার কথা বললো না কেন?

আবু বলল, আমার ঘরে অমন করে আসিস না। শুধু শুধু কষ্ট পাবি। কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? আবু চলে যায়। দোটানায় পড়ে বীথি আছাড় খেতে থাকে কেবলি। এই যদি বলবে তো আবু অমন করে তাকে নিয়ে কেন একেকদিন মেতে ওঠে? বীথি বুঝতে পারে না। কান্না পেতে থাকে। আবুর ওপরে চটে যায়। তখন পেন্সিল আঙুলের মধ্যে বুনে ব্যথা সৃষ্টি করতে থাকে বীথি।

এর কদিন পরেই বীথিকে নিয়ে আবার বেরোনোর উদ্যোগ করে আবু। বীথি বাধা দেয়। বলে, আমার সময় নেই।

ইস্, আজকাল বড়ড সময়জ্ঞান হয়েছে তোর।

হবে না?

বীথি তখন মনে মনে ভাবছে, শুধু শুধু কষ্ট এনে লাভ কী? তার চেয়ে এই ভালো, এই ভেতরের মরে যাওয়া, জেদ করে বসে থাকা। আবুর দিকে তার মন লতিয়ে উঠতে শুরু করে। দিয়েছে। তার শেকড় কেটে ফেলার পণ করে বীথি। কিন্তু কিছুতেই ফেরানো যায় না আবুকে। বেরুতেই হয়। অনিচ্ছার সংগে আপোষ করতে গিয়ে সে নিশ্ৰুপ হয়ে রইলো সারাক্ষণ।

আবু সারা রাস্তা ধরে কী বকতে থাকে তার একবর্ণ কানে যায় না বীথির। রিকশায় তার পাশে চুপ করে বসে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে পড়ে। আবুকে বারবার থেমে ধরতে হয়। পার্কে বেঞ্চে পাশাপাশি বসেও মনে হয়, বীথি একাই বসে আছে, আৰু আবু সমানে কথা বলে। এক আধটা হ্যাঁ না ছাড়া আর কিছু বলার উৎসাহ পায় না বীল নিজেকে বড় একা আর নিঃস্ব মনে হয় তার।

আবু চটে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি একটা ছোটলোক। বুঝলি, আমি একটা ছোটলোক। আমার সংগে বেরোস কেন?

আসলে বীথির ব্যবহার দেখে যে রাগটা হচ্ছিল, সেটা নিজেকে বকে মেটায়। হন্ হন্ করে চলে যায় তাকে সত্যি সত্যি একলা ফেলে। বীথির তখন খুব খারাপ লাগে। নিজের জেদ দেখে নিজেকেই আর পছন্দ করতে পারে না। মনটা বলতে থাকে, দৌড়ে গিয়ে মানুষটাকে ডেকে আনতে। মনে হয় আবুর সামনে আছাড় খেয়ে পড়ে বলে, আমাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করো। তোমার যাতে সুখ আমারো তাতে অন্তরের সায়।

কিন্তু আশেপাশে মানুষ রয়েছে যে, তারা বলবে কী? মাথা হেঁট করে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে বীথি।

এমনি করে মাসের পর মাস ভুগতে থাকে বীথি। আবুর জন্যে থেকে থেকে অস্থির হয়ে ওঠে তার আত্মা। উনখ, অসহনীয় মনে হয় শরীরের একেকটা স্নায়ু। কিন্তু কিছু করা যায় না যে। তার বদলে জোর করে বীথি পড়া নিয়ে, কলেজ নিয়ে ডুবে থাকতে চায় সারাক্ষণ। আর বাকি সময়টুকু নিজেকে ব্যস্ত রাখে রান্নাঘরে, সংসারের কাজে।

ভেতরটা তো জানা যাচ্ছে না, মরিয়ম চোখে যা দেখলেন বড়ড বিব্রত বোধ করলেন। পরের মেয়ে পড়তে এসেছে, কদিনইবা থাকবে, তাকে ঘরের কাজ রোজ রোজ করতে দেখলে লোকে বলবে কী? একদিন তাকে বলতে শোনা গেল, বীথি, আবার তুই ঝাড় হাতে নিয়েছিস? তোকে কতবার মানা করবো বলতো।

বীথি হেসে বলে, চাচিমা, তুমি রান্না করছ। ঘরটা আমি সামলালে কী হয়? সারাদিন তুমি একা সব করবে, সে হবে না।

তার জন্যে বীথির মমতা দেখে মনে মনে খুশি হন মরিয়ম। কিন্তু বাইরে জানান দেন না। কপট আহত কণ্ঠে বলেন, যা খুশি করগে বাপু।

রান্নাঘর থেকে সন্ধ্যের আগে তিনি বেরিয়ে দেখেন, বীথি যে শুধু ঘরটাই ঝাঁট দিয়ে রেখেছে তা নয়, তার জন্যে জায়নামাজটা পর্যন্ত বিছিয়ে রেখেছে। আর বারান্দায় পরিষ্কার করে মাজা এনামেলের বদনায় ওজুর পানি। মরিয়মের মন তখন ভীষণ প্রসন্ন হয়ে ওঠে। নামাজ পড়ে উঠে বীথির ঘরে এসে কথা বলার ছলে তার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দোয়া মাখিয়ে দেন। বীথি সেটা বুঝতে পারে। অনেকক্ষণ তার মন নির্মল হয়ে থাকে। মনে হতে থাকে, কই তার কষ্ট?

হাশেমের কাছে লেখা বকুলের চিঠিগুলো পড়ে অবধি নিজেকে বোঝা যেন অনেক সহজ হয়ে যায় বীথির। মনের ভেতরে যা হয়, এতকাল তা যেন বোঝা যেত না, কথা দিয়ে ধরা যেত না। এখন ভাষা খুঁজে পাওয়া গেছে বকুলের চিঠি থেকে।

কষ্ট, আত্মা, সৌন্দর্য এই কথাগুলোর অর্থ যে নতুন ব্যঞ্জনায় কত অপরূপ হয়ে উঠতে পাবে, এই একেকটা ছোট্ট শব্দ যে কত বিরাট অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে, তা জেনে অবধি বীথির অন্তরটা মুখর হয়ে আছে। কথা বলতে ইচ্ছে করে আবুর সংগে।

কিন্তু বলা হয় না। ভেতর থেকে কিসের সংকোচ বোবা করে রাখে তাকে।

আবুকে সামনে পেলে মুখ অন্ধকার করে থাকা, তার কথার জবাব না দেয়া, জবাব দিলেও ইচ্ছে করে দুঃখ দেয়ার স্বভাবগুলো যেন তাকে পেয়ে বসেছে।

কিন্তু হৃদয়ের এই বিশাল তরংগকে সে ঠেকিয়ে রাখবে কী করে? বেঁধে রাখতে গিয়ে তার দোলা আরো প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। তার দুর্বার ধাক্কায় একেকদিন বীথি এই বাস্তব পৃথিবীর কুল থেকে অন্য অজানায় আছাড় খেয়ে পড়ে চেতনার প্রদোষ–প্রতিম আলোয়।

একদিন হয়েছিল এমনি। সে রাতের কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে বীথির। আৰু এসে তার বারান্দায় পায়চারি করছিল। শুয়ে শুয়ে টের পায় বীথি। সমস্ত অনুভূতি আর ইন্দ্রিয় সুচীমুখ হয়ে ওঠে। মাথার ভেতরে যন্ত্রণা হতে থাকে। বাইরে অবিরাম শোনা যাচ্ছে তার পায়ে পায়ে চলার শব্দ। বীথির আত্মা যেন সমুদ্রের মতো আছড়ে উঠতে চায়। বলতে চায়, কেন তুমি এলে আবু ভাই? আবু দরোজার কাছে মুখ রেখে বলে, বীথি, আয়।

না।

আয় নারে।

ডাকটায় কী ছিল, বীথি উঠে আসে তখন।

আবুর শাদা পাজামা অন্ধকারে একটা পতাকার মতো কাঁপতে থাকে বাতাসে। তার শরীরটাকে কী দীপ্তিময় মনে হয়। মনে হয়, আবু তার ভাবনা থেকে জন্ম নিয়ে আজ এই রাতে অশান্ত হয়ে বীথির দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবুকে সে একটা সৌরভের মতো মেখে নিতে পারবে যেন, এত অবাস্তব অশরীর মনে হয় তার উপস্থিতি।

তার মতো আবুরও কি কষ্ট হচ্ছে আজ?

আবু ওর হাত ধরে বলে, কেমন বাতাস দিয়েছে দেখেছিস, বীথি? বাগানে গিয়ে বসবি একটু? ভয় নেইরে, আমি তোকে আর জ্বালাবো না।

বীথি তাকে অনুসরণ করে।

বাগানের সিঁড়িতে হাত ধরে বীথিকে বসায় আবু। আর নিজে হাঁটতে থাকে অন্ধকারে। অন্ধকারে দাঁড়ানো গাছের ভেতর দিয়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে তারার অস্পষ্ট আলোর ভেতরে।

আবু আপন মনে বলে, তোকে কেন ডাকলাম, বীথি?

আর্তনাদের মতো শোনায় যেন আবুর কণ্ঠস্বর। বীথির মায়া হয়। তোকে কেন ডাকলাম? তোকে কি ডাকতে চেয়েছি? আজ এই রাতটা আমাকে যেন জ্বালিয়ে মারছে। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে আগুন ঝরে আমার একা অন্তরটাকে খাক করে দিচ্ছে। কী করি বলতো? বড়ড ভয় করছে। এক মুহূর্তের জন্যে ভুল হলো, যেন তুই আমাকে শান্ত করতে পারবি। কিন্তু তা হচ্ছে কই?

আবু এসে তার পাশে বসে। বলে, তোর হাতটা দে।

বলে নিজেই বীথির হাতটা টেনে নেয়।

তোর ভয় করছে, বীথি?

না।

তাহলে হাত কাঁপছে কেনরে?

হাতটা ফেলে দেয় আবু। খেদ ভরা কণ্ঠে বলে, আমার হাতে সাহস নেই, বীথি। নইলে সবাই অমন দেয়াল তুলে রাখে, দেয়ালটা ভাঙতে চাই, পারি না। আমাকে দিয়ে কিস্‌সু হবে না, দেখিস তুই।

বীথি চুপ করে শোনে। বলে, তোমাকে দেখে আমার ভয় করে, আবু ভাই। হাশেম ভাইয়ের। মতো তুমিও না একদিন ঘর ছেড়ে বেরোও।

আবু ওর চোখে চোখে তাকায়।

তোরও কি তাই মন হয়, বীথি?

তুমি একটু ভালো থাকতে পারো না, আবু ভাই? আমি যদি কিছু করতে পারি, বলো। বীথির কণ্ঠ স্পর্শ করে আবুকে। এক মুহর্তের জন্যে চমকে ওঠে। পরে বলে, আয় তাহলে। বীথিকে বুকের ভেতরে চেপে ধরে আবু। চুলের ভেতরে মুখ রেখে বলে, আমার চোখ ঢেকে দে, বীথি! আমার যে কী হয়েছে, খালি অস্থির লাগছে।

বীথি চুপ করে পড়ে থাকে খানিকক্ষণ। তার কানের ভেতর দিয়ে আত্মায় এসে ঘা দিচ্ছে। আবুর হৃদস্পন্দনের শব্দ। শব্দটা অলৌকিক মনে হয়। মনে হয়, আরেক পৃথিবী থেকে সাংকেতিক বার্তা আসছে।

অস্থির হয়ে ওঠে বীথি।

আবু তাকে ঠাস্ করে ছেড়ে দিয়ে বলে, তুইও পালালি। কী শূন্য হয়ে আছে এইখানটায়। থাকতে পারলি না তো।

বীথি দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে।

আবু উঠে দাঁড়ায়। বলে, বলেছি, তোকে জ্বালাবো না। জ্বলতে এলি কেন? আমার মুখের ওপর দরোজাটা বন্ধ করে দিতে পারলি না?

আবু অন্যমনস্কভাবে খুব করে হাঁটতে থাকে বাগানে। ফিরে এসে বলে, তুই আমাকে ছুঁয়ে যাবার স্পর্ধা করেছিস, বীথি। কিন্তু আমি তোকে নিয়ে খেলা করছি বুঝতে পারলি না কেন? হ্যাঁ, সত্যি। আমার চোখের ভেতরে তুই নেই। তাকিয়ে দ্যাখ।

বীথি হাঁটুর ভেতরে মুখ লুকোয়।

আবু বলে চলে, আমি তো বুঝি, মানুষের এ কষ্টটা কী ভীষণ। মরে যাবি তুই। আমাকে কষ্ট জ্বালানোর কাজ দিনে বীথি। তাতে আমার আরো কষ্ট। দেখছিস না, কিসের যে নেশা আমি নিজেই জানি না, তবু কষ্ট হয় শুধু। যদি লাফ দিয়ে মরতে পারতাম তো ভালো হতো। কিন্তু সে সাহসও নেই।

বীথিকে হাত ধরে তুলে আনে আবু।

তোর মুখ দেখে মায়া হয়। চল বাগানে একটু হাঁটবি।

কাটা কবুতরের মতো বিছানায় পড়ে ছটফট করতে থাকে বীথি। মাথার ভেতরে যেন একপাল যন্ত্রণা সোর বাধিয়েছে। না থামানো যায়, না সহ্য করা যায়।

অস্ফুট আর্তনাদ করতে থাকে মাথার দুরগ টিপে। হারিয়ে যেতে চায় বালিশে ব্যর্থ মুখ লুকিয়ে। ডান হাতটা কেবলি এপাশ ওপাশ করতে থাকে যেন এমনি করলে, যে ছবিগুলো মনের পর্দায় ফিরে আসছে, তারা মুছে যাবে।

মরিয়ম এসে ডাকলেন, ঘর অন্ধকার কেন, বীথি? ঘুমোলি নাকি? খাবিনে?

হঠাৎ শুনতে পেলেন বীথির কাতর শব্দ। বুঝতে পারলেন না সেটা তাঁর মনেরই ভুল কিনা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলেন। ইস, কী ঘামছে।

বীথি, বীথি রে।

মা।

অস্ফুট ডাকটা শুনে বিহ্বল হয়ে গেলেন মরিয়ম। একেবারে খাটের ওপর উঠে বীথির মাথাটা কোলের ভেতরে তুলে নিয়ে বললেন, এই তো মা, এই যে আমি। কী হয়েছে, সোনা আমার? কিছু না, কিছু না! তুমি কেন এলে, চাচিমা?

মরিয়মের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বীথি কেন এমন করছে বুঝতে না পেরে, আকুলি বিকুলি করতে থাকেন। যেন নিজের মেয়েটা, যদি নিজের মেয়ে থাকত মরিয়মের, তাহলে আজ তার কোলে মাথা রেখে এমনি কাতরাতো।

আমাকে তুই বলবিনে কী হয়েছে?

হঠাৎ ভয় পান মরিয়ম। আজ বিকেলে খোরশেদ চৌধুরী যে কথা আবুর বাপকে ডেকে বলেছেন, বীথির কানে তা যায় নি তো?

যাবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন, কথা যখন উঠেছে মোরশেদ, তখন সত্যি না হলেও মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিও না। ছোট মিয়া লিখেছে, বীথিকে হোস্টেলে দেবে। আমারও মনে হয়, কিছুদিনের জন্যে অন্তত বীথিকে দূরে সরিয়ে রাখা ভালো। এখন কিছু বলো না। মেয়েটাকে। দিন দুই পরে আমার বাসায় দিয়ে এসো। তারপর ওর বাবা এসে যা হয় করবে। হাজার হোক মেয়ে তো ওর।

কথাটা শুনে অবধি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন মরিয়ম। এই মেয়েটা যে তাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না, এই ব্যথাটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনকি এই সেদিনও এক মাস থাকবে বলে বাড়ি গিয়েছিল বীথি। কিন্তু মাত্র পনেরো দিন পরেই তার বাবা তাকে নিয়ে ফেরৎ এসেছেন।

তিনি এসে বলেছিলেন, আপনিই ওর মা হয়ে গেছেন, ভাবী। মেয়ের মন যেন টিকতেই চায় না আমাদের ওখানে।

সে কথা মনে করে মরিয়মের এখন ভীষণ কান্না পায়। বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরেন বীথিকে। বীথিও তাকে আঁকড়ে ধছে কাতরাতে থাকে, চাচিমা, চাচিমা গো।

ডাকে আর ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। কেন কাঁদছে তা সে নিজেই বুঝতে পারে না। কিন্তু মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে কেঁদে পরম এক নির্ভরতা ফিরে পায় বীথি। দুজনের ভেতরে একটা বোঝাঁপড়া হয়ে যায় যেন অলক্ষিতে।

মরিয়ম তার কপালে, চুলের ভেতরে, বুকে হাত বুলিয়ে তার মুখের ওপর নিজের গাল চেপে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, বীথি, তুই আমার কাছেই থাকবি। তোকে কোথাও যেতে হবে না। সোনা আমার, চুপ কর, চুপ কর একটু।

ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আবুর। আর একটু পরেই উঠবে আর একটি দিনের সূর্য। এখনো আকাশ থেকে আঁধার কাটেনি। এখনো ভালো করে ঠাওর করলে একটি দুটি তারা আবিষ্কার করা যাবে। আর বইছে কী নির্মল বাতাস। বিলকিসকে মনে হয় এই নিঝুম নিস্তরঙ্গ ভোরের মতো অস্পষ্ট, বিশাল, দৃষ্টির অতীত, রহস্যময়। তখন আকাশের মতো শুদ্ধ এবং গম্ভীর একটি বেদনা যেন বিলকিসের নাম হয়ে জন্ম নিল আবুর মনে।

অপূর্ণ, অক্ষম একটা পুঞ্জীভূত ইচ্ছার চাপে আবুর ভেতরটা ভারী হয়ে উঠছে। যেন সে ভীষণভাবে পরাজিত হয়ে গেছে কাল বিলকিসের কাছে। যে স্রোতটা উৎস থেকে লাফিয়ে গড়িয়ে এতকাল চলছিল, হঠাৎ একটা পাথরের মুখে পড়ে তা স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন! মরে যাওয়াই তো ভালো। কী ক্ষতি হবে কার, এখন যদি মরে যায় আবু? যাকে রক্ত দিয়ে ভালোবাসা গেল, সে যদি চিরকাল রইল দেয়ালের আড়ালে, তাহলে শুকিয়ে যাক রক্তের ধারা। কাল বিলকিসের সঙ্গে দেখা হলো না বিধাতার কোন্ অজ্ঞাত ইচ্ছায়? স্তব্ধ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে আবু। দূরে, ছড়ানোমেলানো শহরটা কী অপরূপ শান্তিতে শুয়ে আছে। বিলকিস কি কখনো জানতে পারবে, তার জন্য মরে যাচ্ছে আবু? আস্তে আস্তে আকাশটায় লাগছে শাদা রং। বীথি বালিশ থেকে বিছানায় মাথা রেখে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে আছে। বালিশের ওপর মেলানো তার চুল। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় বীথির মুখ এক মুঠো মমতা হয়ে আছে। কাল রাতে মরিয়ম শুয়েছিলেন এ ঘরে। একটু আগে উঠে গেছেন ফজরের নামাজ আদা করবার জন্যে। ওপাশের বারান্দা থেকে শব্দ আসছে তার ওজুর।

দরোজা ঠেলে খাটের পাশে এসে বসলো আবু। খোলা দরোজা দিয়ে এলো হাওয়া। হাওয়ার ঝলকে বীথির কোমল মুখোনা যেন অবগাহন করে উঠলো।

 বিলকিসও এখন শুয়ে আছে এমনি করে। বালিশ থেকে হয়তো তার মাথাও ঘুমের ঘোরে নেমে এসেছে। শিয়র ভরে উঠেছে একরাশ খোলাচুলের ঐশ্বর্যে। বুকটা উঠছে নামছে।

আবু করতল দিয়ে সন্তর্পণে স্পর্শ করল বীথির গাল। মনে মনে বলল, ঘুমিয়ে থাক, ঘুমিয়ে থাক, আমাকে দেখতে দে।

বীথির মুখ দুহাতে তুলে বালিশে রাখতে গেল আবু। বীথি চোখ মেলল। চোখ মেলবার আগে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আবুকে।

আমি, বীথি।

একটু পরে সে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল রে?

আবুর কণ্ঠ ভোরের মত আবছা আবছা, তেমনি সুদূর।

কী হয়েছিল তোর? কাঁদছিলি কেন?

বীথি পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকাল আবুর দিকে।

—-আমার ঘরে শুয়ে থেকে শুনছিলাম তুই কাঁদছিস। মনে করলাম তোর কাছে উঠে আসি। কিন্তু তুই যে মেজাজ করেছিলি কাল। এলে কি আমাকে তাড়িয়ে দিতি?

বীথি কথা বলে না। চুপ করে থাকে দুজনে। আবু বীথিকে করতল দিয়ে স্পর্শ করে থাকে। কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, আমাকে একবার ডাকলে কি আসতাম নারে?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবু।

হঠাৎ বীথি মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবুর করতল থেকে নিজেকে সরিয়ে বালিশের ওপর বলে, তোমাকে কি আমার সব কথা বলতে হবে?

না তাকিয়েও বীথি অনুভব করতে পারে, আবু আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *