১. প্রথমে দেখেছিল বীথি

অনুপম দিন – উপন্যাস – সৈয়দ শামসুল হক

প্রথমে দেখেছিল বীথি। দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। লোকটা কী রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন অন্তর পর্যন্ত তার দৃষ্টির কিরণ এসে বিঁধছে। তখন দুপুর বেলা। মাথার পরে খাড়া রোদ। শরীর খারাপ বলে আজ আর কলেজে যায় নি বীথি। অবশ্যি শরীরটা যে তার সত্যি সত্যি খারাপ ছিল, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, কলেজের গাড়ি আসার একটু আগেও তাকে দেখা গছে কলেজে যাবার উদ্যোগ করতে। তারপর হঠাৎ কী হলো কে জানে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘরে এসে দেখেছিল, আবু তার খাতায় লিখে গেছে—- আমার নাটক দেখতে তুই না এলি তো বয়েই গেল। আমি কি তোর জন্যে নাটক করছি? যা কলেজে, গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাক বইয়ের ওপর।

আবু ইউনিভার্সিটিতে নাটক করছে। বীথিকে যেতে বলেছিল রিহার্সেলে। লজ্জা করেছে বীথির। মাথা নেড়ে বলেছিল, না। সেটা শুনে দুমদুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে আবু। তারপর এই চিঠি। তাতেও কিছু হতো না। বই নিয়ে খোটা দেয়ায় ভীষণ অস্বস্তি হলো তার। চাচিমাকে গিয়ে বলল, গাড়ি এলে ফেরত পাঠিয়ে দিও। আজ যাবো না।

চাচিমার কাছে আজ আড়াই বছর আছে বীথি। এই আড়াইটে বছরে এই ছায়া–ছায়া, কম কথা বলা, মায়া পরানো মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছেন। হাতের রান্না ফেলে তিনি বললেন, কেন?

তাঁর উদ্বিগ্ন স্বর শুনে সংকুচিত হলো বীথি। যেন কিছু না, তাই সাহস দেয়ার জন্যে হেসে উত্তর করল, ভালো লাগছে না।

কী রে?

শরীরটা।

চাচিমা এক পলক তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। কী বুঝলেন, বললেন, তবে থাকগে, তোর কলেজে গিয়ে কাজ নেই।

তখন পরম স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বীথি গিয়ে ডুবেছে নিজের ঘরে।

খাতার যে পাতায় আবু লিখেছিল সেটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে তবে নিশ্চিন্ত হলো সে। তারপর দুপুরে চাচিমার সংগে খেতে বসেছে বীথি। মরিয়মের কাছে তার মনের দরোজাটা ছিল ভীষণ রকমে খোলা। একবার ভেবেছিল, আবুর কথা বলবে। ঠিক তখন বাধা পড়ল। মরিয়ম বললেন, আচ্ছা বীথি, তুই যে রান্নাবান্না কিছু শিখলিনে, তোর বাবা আমাকে কী বলবে বলতো।

কেন? কী আবার বলবে?

বিয়ে হলে কী করবি? বেঁধে খাওয়াতে হবে না?

বীথি হঠাৎ তার পাতের দিকে মনোযোগ নাবিয়ে এনে প্রসঙ্গটা বদলাতে চায়। বলে, তুমি কিন্তু সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছ, চাচি মা। এইটে নাও, এইটে নাও, আমি আর কিছু নিচ্ছি নে। বীথি বাটি উপুড় করে ঢেলে দেয় মরিয়মকে। কিন্তু তাঁর যেন তখন ঘোর লেগেছে। বীথির দিকে মায়া চোখে তাকিয়ে তিনি বলে চললেন, ছুটির দিনে তুই আমার সংগে রান্না করবি। রান্না না করলে কাছে বসে থাকবি। নইলে তোর বাবার কাছে নালিশ করে দেব।

দিও, যতো পার দিও তুমি।

খাবার ঘরের বাইরে নিম গাছটায় তখন খুশির রোদে ঝিলিমিলি লেগেছে। বীথির মনোযোগ তখন সেদিকে।

এমনি ছিল দুপুরটা।

দুপরে শুয়ে শুয়ে বই পড়া চলছিল বীথির। পানির তেষ্টা পাওয়াতে নেবে এসেছিল রান্নাঘরে। সারাটা বাড়ি তখন কেমন ঘুম ঘুম করছে। চাচা গেছেন অফিসে। চাচিমা শুয়ে আছেন পাখা ছেড়ে দিয়ে। নিম গাছটা নিথর হয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে কী মনে করে বসবার ঘরের বারান্দা দিয়ে ঘুরে আসতে গিয়েছিল বীথি। সেই তখন।

দেখে, একটা মানুষ, একমাথা রুখু চুল তার, চোখের কোলে কালিমা, কেমন চেনা চেনা—-সোফার ওপর দুপা তুলে নিবিষ্ট মনে কাগজ পড়ছে। বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তে যেন পাথর হয়ে গেল বীথির। লোকটা তার পদশব্দে কাগজ সরিয়ে বীথির দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন তাকে তন্ময় থেকে ফিরিয়ে এনে ভারী অন্যায় করেছে সে।

বিব্রত হয়ে চলে যাচ্ছিল কী যাবে, তখন লোকটা বুকের কাছে হাঁটুজোড়া আরো নিবিড় করে টেনে এনে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে একটু পানি দিতে পারো?

যেন এক জীবনের বিনিময়ে পানি চাইছে লোকটা।

মরিয়ম আলুথালু বেশে ছুটে এসে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলেন হাশেমকে। বললেন, বাবা, তুই এতদিন কোথায় ছিলি? এতদিন পর মায়ের কথা মনে পড়লো সোনা আমার। তার পেছনে পানির গেলাশ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বীথি। পাঁচ বছর পর বাড়ির বড় ছেলে এমন করে ফিরে আসবে, আজ সকালেও তা কে ভেবেছিল? হাশেমকে অনেক ছোটকালে দেখেছিল বীথি। সে দেখার সংগে কোন মিল নেই লোকটার। যেন একটা রাস্তার মানুষ উটকো এসে হাজির হয়েছে। বীথির বুকের মধ্যে কেমন দুপদুপ করতে থাকে, খানিকটা ভয়ে, অনেকখানি আনন্দে।

 হাশেম কিন্তু মায়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্যে এলোপাথারি হাত প ছুঁড়ছে। মুখে বলছে, আহা ছাড়ে। ছাড়ো না। কী শুরু করেছ?

তখন শান্ত হলেন মরিয়ম। তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ছাড়বোই তো বাবা। ছেড়ে তো দিয়েই ছিলাম। আবার তবে জ্বালাতে এলি কেন?

মরিয়মের কণ্ঠে কান্না আসতে চাইছে। সেটাকে তিনি আঁচলের মধ্যে লুকোলেন।

হাশেম তখন খুব আস্তে উচ্চারণ করল, হাসল, তোমাকে জ্বালিয়ে সুখ আছে, মা। তুমি জ্বলবে, কিন্তু কিছু বলবে না। আর আমি? জ্বলে যাচ্ছি, চীৎকার করছি।

বলতে বলতে হাশেম ঝটকা মেরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। যেন একটা দীর্ঘ সৌন্দর্য রেখার জন্ম হলো হঠাৎ। যেন পা থেকে মাথা অবধি একটা শেকল বাধা শক্তি মুক্তি পেয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াল। গাঢ় বেগুনি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ময়লা পাজামা, স্যান্ডেল। তবু মনে হলো রাজার পোশাক পরে দরবারে যাবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে হাশেম। দ্রুত বারকয়েক পায়চারি করল সে। মরিয়মকে উপেক্ষা করে, বীথির দিকে না তাকিয়ে, তাদের সমুখে থেকেও যেন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, খানিক হাঁটল হাশেম। একবার দাঁড়িয়ে পেছনে হাত বেঁধে মাটির দিকে চোখ রেখে কী ভাবল। তারপর আবার এক সর্বস্ব ধরে টান দেয়া অস্থিরতার তাড়ায় ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগল, তোমাকে জ্বালিয়ে সুখ আছে, মা। পাঁচ বছর আগে একটা নেশার মতো পেয়ে বসেছিল—- বুকের আগুন দিয়ে বিশ্বসংসারকে জ্বালিয়ে মারব। ঠিক এইখানটায়, দ্যাখো মা–মরিয়মের সামনে এসে হাত দিয়ে নিজের হৃদয়টাকে ইঙ্গিত করে হাশেম। বলে, সারাক্ষণ একটা আগুন। জ্বলছিলো। মস্ত বড় আগুন। মনে করেছিলাম, সব কিছু পুড়িয়ে মারব এ আগুনে। কিন্তু পারলাম কই, মা? হাজার হাজার মানুষ দেখলাম। তারা সবাই কী বলল, জানো? বললো, সাধু বাবা, বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে, তাকে নিভিয়ে দিতে পারো? হাজার হাজার মানুষ। আমার পা ধরে যখন কাঁদত, বলতাম—- ভাগ, পালা এখান থেকে। তবু কি ছাড়ে ওরা? ইস, একেকটা মানুষ ভেতরে ভেতরে, শরীরে চামড়া–মাংসের দেয়ালের ওপারে, দোজখ থেকে সব লকলকে আগুন নিয়ে এসেছে। আমি তার কী করব? একজনকে পা টেনে লাথি মারতে গিছলাম, পা উঠলো না।

বীথি দেখছিল মরিয়মকে। পাঁচ বছর পর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি। বোবা চোখ দিয়ে অসহায়ের মতো ছেলেকে অনুসরণ করে চলছেন। যাবার সময় লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, তবে কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে হাশেম? হাশেম কথা বলতে বলতে চলতে চলতে কখন বীথির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সেটা টের পেয়ে বীথি চঞ্চল হয়ে উঠল। তার হাত থেকে গেলাশ নিয়ে সবটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে শুধাল, এই মেয়েটি কে মা?

ছেলের হাত থেকে শূন্য গেলাশ ফিরিয়ে নিয়ে মরিয়ম বললেন, বীথি—- তোর ছোট চাচার বড় মেয়ে। তুই যাবার পর এখানে এসেছে।

তাই হবে। অনেক ছোট দেখেছিলাম।

বলতে বলতে হাশেম আবার গিয়ে বসল সোফায়। তার মুখ থেকে নিজের কথা শুনে বীথির কেমন সংকোচ হলো। চলে যাবার উদ্যোগ করল চাচিমার হাত থেকে গেলাশ নিয়ে, তখন পেছন থেকে ডাকল হাশেম।

এই শোনো।

বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর বীথির পা জোড়া অবশ করে দিয়ে গেল যেন।

শোনো এদিকে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো বীথি এসে দাঁড়াল তার সমুখে। হাশেম হাত বাড়িয়ে তার সুদীর্ঘ বাম বাহু দিয়ে স্পর্শ করল ওর কাঁধ। সঞ্চারিত করল শক্তি। আস্তে আস্তে সে মেয়েটাকে বসিয়ে দিল মেঝের ওপর, পায়ের কাছে। বীথি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে বিচলিত বোধ করলেন মরিয়ম। এগিয়ে এসে বললেন, কেন, বীথিকে চিনতে পারছিস না তুই?

আমি ওর চোখ দেখছি, মা। আমি ওর চোখ দেখছি। আমি ওর চোখ দেখছি।

মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করে বলতে থাকে হাশেম। তারপর হঠাৎ কাঁধ থেকে হাত টেনে নিয়ে আচমকা বলে, এত কষ্ট পাস কেন, বীথি?

কী ছিলো তার কণ্ঠে, কথা শুনে বীথির চোখ সজল হয়ে উঠতে চাইলো। কিছু বলতে পারল না। তখন জোর করে মাথা নাড়ল। মাথা নাড়তে গিয়ে সারা গা কেঁপে উঠল থরথর করে, যেন তার সব আবরণ খসে খসে পড়ছে।

ভীত হলেন মরিয়ম। বললেন, ওকে ঘাবড়ে দিয়ে আনন্দ হচ্ছে তোর?

তার ছেলে যে সত্যি পাগল হয়ে গেছে, এইটে মনে করে কান্না পেল তাঁর।

বীথির দিকে চোখ রেখেই হাশেম মাকে বলল, ঘাবড়ে দেব কেন মা? যা সত্যি তাকে কবর দিয়ে রাখলে বিশ্রী একটা অসুখ হয়। সে অসুখ থেকে মুক্তি মৃত্যুর পরেও আসে না, জানো না তুমি? কিরে বীথি, কী হয়েছে? কষ্ট পাস কেন?

বীথি মৃদুকণ্ঠে বলতে চায়, কই, নাতো।

কিন্তু শোনা যায় না।

হাশেম পা দুটোকে আবার গুটিয়ে আনে বুকের কাছে। চেপে ধরে নিবিড় করে দুহাতের বেষ্টনীতে। এই কবছরে এই মুদ্রাদোষটা দাঁড়িয়ে গেছে ওর। বলে, মানব জন্মের দোষই ওই, বুঝলি? শুধু কষ্ট পাবে। বুঝতে পারবে, অথচ কিছু করতে পারবে না। শোন, ভাল মন্দ বুঝতে পারিস? কোনটা আলো আর কোনটা অন্ধকার? নাহ, তোকে অনেক শেখাতে হবে, নইলে বেঁচে থাকবি কী করে? বেঁচে থাকার জন্যে বই পড়, এঞ্জিন বানানো, দালান গড়াই যদি যথেষ্ট হতো তাহলে মানুষ কাঁদতেই জানত না। ভালোই হলো, এখানে এসে আমাকে আর বসে থাকতে হবে না। তোকে নিয়ে একটা কাজ পাওয়া গেল। যাঃ পালা শীগগীর।

বীথি উঠে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তে কে যেন তাকে ভীষণ রকমে দুর্বল করে দিয়ে গেছে। হাশেম বলল, হ্যাঁ শোন, আমাকে একটা কম্বল দিতে পারিস? জ্বরটা খুব জেঁকে আসছে রে।

.

তিন ছেলে মরিয়ম আর মুরশেদ চৌধুরীর। একেবারে ছোট আবু, এবার এম এ পাট টু–তে পড়ছে। মেজ মাহবুব, চাকুরি করে, বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকে গেণ্ডারিয়ায়। আর সবার বড় হাশেম পাঁচ বছর আগে এম এ পড়তে পড়তে পরীক্ষা দিল না।

তখন জিজ্ঞেস করলে খুব একটা অন্যমনস্ক গলায় উত্তর করত, পড়ে কী হবে? পড়ে কিছু হয়?

এটা উত্তর হলো না; কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু বলত না হাশেম। বাবা শাসন করলেন, মা কাঁদলেন, বড় চাচা এসে বোঝালেন একদিন। কিসসু হলো না তাতে।

তখন ভীষণ চুপচাপ থাকত হাশেম। সারাটা দিন বসে বসে কী ভাবত তার হদিস কেউ পেতো না। একেকদিন দেখা যেত বারান্দায় পায়চারি করতে করতে দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে। কিংবা বাগানে একটা গাছ পছন্দ হয়ে গেছে, তার গোড়ায় পানি ঢালার অত্যাচারে সেটা যদ্দিন না মরছে, যেন নিস্তার নেই। মরে গেলে মুখ দিয়ে শুধু একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরুতো, যাহ।

হঠাৎ একদিন এ সব গেল থেমে। শুরু হলো বই পড়ার নেশা আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ছিঁড়ে ফেলা। সে লেখা দেখাতে না কাউকে। যক্ষের মতো কুটি কুটি কাগজ আগলে বসে থাকত, তারপর বাগানে বসে আগুন জ্বালিয়ে ছাই বানিয়ে শান্তি।

একদিন ভাটা পড়ল এতেও। তখন দুতিন দিন এক নাগাড়ে খোঁজ পাওয়া যেত না হাশেমের। দুদিন তিনদিন পরে যখন এসে হাজির হতো, তখন গা মাথা ধুলোয় ভর্তি, চোখ জবাফুলের মতো লাল। কাউকে কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ত। খেতে বললে সময় মতো খেতে আসত না। দুপুরের রান্না বাসি হয়ে যেত, রাতের দুধ বেড়ালে খেতো। অনাহারে কাটত একদিন দুদিন। আবার একেকদিন সাত রাজ্যের খিদে যেন পেয়ে বসত তাকে।

মরিয়ম একদিন রাতে তার খাটের ওপরে উঠে এসে কপালে হাত রেখে বললেন, বাবা, তুই কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবি?

কে? মা? আহ্ কাঁদছ কেন?

তোর কী হয়েছে আমাকে বলতে পারিস না?

তখন হাশেম চোখ বুজে অন্ধকারে মাকে, মার মুখ অস্থির আঙ্গুলে অনুভব করতে করতে বলল, তুমি বুঝবে না, মা।

তারপর নিজের ওপরে নিজেই যেন চটে উঠল হাশেম। আধো উঠে বসে প্রায় চিৎকার করে বলল, ছাই আমি নিজেও কী বুঝতে পারছি? মনে হয় আকাশ থেকে বজ্ৰ এনে দিই সব ঠাণ্ডা করে। যাক যাক—- সাধের পৃথিবীটা চুলোয় যাক। আমার কী?

মরিয়ম ছেলের কথা একবর্ণ বুঝতে পারেন না। বলেন, ও–কী বলছিস তুই হাশেম? আমার বুকের ভেতরটা যে কেমন করছে।

তখন লাফ দিয়ে হাঁটুর ওপর উঠে বসেছে হাশেম।

আমাকে তুমি খুন করতে পারবে, মা?

শুনে মরিয়ম পাথর হয়ে গেলেন। হাশেম বলে চলল, উহ, পৃথিবীতে এত অসঙ্গতি একবার তুমি যদি জানতে পারতে, মা। একবার যদি জানতে পারতে, এক মুহূর্ত তোমার বাঁচতে ইচ্ছা করত না। গলায় দড়ি দিতে।

সে রাতেই মরিয়ম স্বামীকে বললেন, ওগো দ্যাখোনা ছেলেটার কী হয়েছে। মনে মনে মুরশেদ চৌধুরীও কম ভুগছিলেন না। প্রসঙ্গ উত্থাপনে এতদিনকার জমানো ক্ষোভে ফেটে পড়লেন।

কী আবার হবে? ঢের বাঁদর ছেলে দেখেছি আমি।

মরিয়ম কান্নাভরা গলায় বললেন, তুমি একটা নিষ্ঠুর, বুঝলে? ছেলে আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে, তুমি বাপ হয়ে চুপ করে আছো?

পাগলই তো। নইলে অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে হঠাৎ লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, শুনেছ কখনো? পরদিন সকালে উঠে হাশেমকে পাওয়া গেল না।

.

আড়াই বছর আগে বীথির বাবা যখন মেয়েকে মেজভাই মুরশেদের কাছে রেখে গেলেন ঢাকায় কলেজে পড়বে বলে, মরিয়ম ততদিনে শোকের বরফে পাথর হয়ে গেছেন। হঠাৎ করে যেন বুড়িয়ে গেছেন তিনি। আত্মযত্নের দিকে কোনো লক্ষ্য নেই, সংসারের ভালোমন্দে চিরউদাসীন। এমন করে দিন চলে না। মুরশেদ চৌধুরী কম বোঝান নি। বড় জা আমেনা এসে কম সান্ত্বনা দেন নি। কিন্তু মরিয়মের যেন মৃত্যু হয়ে গেছে।

চাচিমাকে দেখে চমকে উঠেছিল বীথি। এর আগেও কি সে তাঁকে দেখেনি? দেখেছে। তখন কত উজ্জ্বল, মধুর হাসিতে মুখরিতা ছিলেন মরিয়ম। এখন সেই একই মানুষকে দেখে মনের মধ্যে বিষম একটা ধাক্কা পেয়েছিল বীথি। আর অন্যদিকে চাচা। সেই সদালাপী সদাহাস্য চিরউদার মানুষটিও যেন হঠাৎ করে পাথরের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বড় চাচা খোরশেদ চৌধুরী নিঃসন্তান মানুষ। ঢাকাতেই থাকেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, বীথি আমার কাছে থাক।

কিন্তু মরিয়মের জন্যে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেছিলেন, না, বীথি থাকবে তার কাছে। বীথিরও মনের টান ছিল মরিয়মের জন্যে।

প্রথম দিনই কোলের কাছে বসিয়ে মরিয়ম বীথিকে বলেছিলেন, আমার কী ভাগ্য দেখ, মা। নিজের ছেলে হারিয়ে মেয়েকে কাছে পেলাম। হারে বীথি, তুইও পালাবি নাকি?

বীথির তখন কতই বা বয়স। কিন্তু বুকের ব্যথা বোঝার মতো অন্তর ততদিনে তার তৈরি হয়ে গেছে। সে বলেছে, তুমি আমাকে পর মনে করো, চাচিমা?

মরিয়ম বুঝতে পারেন কথাটা গিয়ে কোথায় লেগেছে। লজ্জিত হন। তার চিবুক নেড়ে বলেন, নারে না। আমার কথা ধরতে নেই। হাশেম চলে গেছে থেকে কী বলতে কী বলি। তুই পর হতে যাবি কেন?

 বীথি বলেছে, আমি কিছু মনে করিনি, চাচিমা। আমাকে নিয়ে তুমি ভেবো না। এতদিন তোমার দেখবার কেউ ছিল না, আজ থেকে আমি হলাম।

মরিয়ম বলেছেন, বোস ভালো করে। তোর চুল আঁচড়ে দি। একেবারে জট করে ফেলেছিস পাগলি।

ঘরে হাশেমের একটা বড় ছবি বাঁধানো ছিল। বীথির মন তখন কৌতূহলী হয়ে সেই ছবিটা দেখছে। যে লোকটা তার চাচিমার এত কষ্টের কারণ ছবির মধ্যে তার মন খুঁজে মরছে সেই কারণটা। বলেছে, আচ্ছা চাচিমা, হাশেম ভাই চলে গেলেন কেন?

বড়ো সরাসরি শুধিয়ে ফেলেছিল বীথি। শুনে মরিয়ম তার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন খানিক। পরে বললেন, কী জানিরে। বোধহয় ও আমার কোলে বনের পাখি ছিল। একদিন তাই কাঁদিয়ে যেতে এতটুকু বাধলো না।

পরে আস্তে আস্তে শুনছে বীথি—- কিছুটা আবুর কাছ থেকে, কিছুটা মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে। কিন্তু তা থেকে কতটুকুইবা বোঝা যায়? আর দেয়ালে ঝোলানো ওই ছবিটা। ছবির ভেতরে যেন সাংকেতিক ভাষায় সব কিছু লেখা আছে। দুরাশায় কত কতদিন বীথি তার ছবিটাকে গভীর চোখে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখেছে।

একদিন কতগুলো চিঠি খুঁজে পেয়েছিল বীথি। হাশেমের ফেলে যাওয়া বাক্সের একেবারে তলায়, এককোণে পড়ে ছিল। ভেতরটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে এই কাণ্ড। খামগুলোর ওপর মেয়েরি হাতে সুন্দর করে লেখা হাশেমের নাম লুকিয়ে চিঠিগুলো পড়েছিল বীথি। কাছে রাখতে সাহস হয়নি। আবার রেখে দিয়ে এসেছে নিরুদ্দিষ্ট মানুষটার বাক্সে।

হাশেমের একটা অজানা অধ্যায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল সেদিন তার কাছে। কে এই মেয়েটা যার নাম বকুল?—- যে চিঠি লিখত হাশেমকে, যার চিঠি জমিয়ে রাখত হাশেম—- যার জন্যে এত কষ্ট?

প্রথম চিঠিটা ছিল এমনি

হাশেম সাহেব,
অনেকদিন পরে যেন একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ দেখলাম। বিচার, বিশ্লেষণ, মাপা সেঁকা, অনেক হলো। অনেক বাচাল মানুষের সাক্ষাৎ মিলল। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনার অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও হৈচৈ করে, ঢোল বাজিয়ে তা রাষ্ট্র করতে রাজি নন। আপনি যে পরিচ্ছন্ন, নির্মল, সেজন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। নির্মলতার পরিচ্ছন্নতার দুএকটি বিরল বিন্দুর দেখা না পেলে যে আত্মায় পচন ধরবে এতে আশ্চর্য কী! কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আত্মাকে আমি পচতে দেব না। আপনি মরে যান, তবু ভালো আপনার মনের সৌন্দর্য যেন না মরে এই কামনা করি। এটা দেখবেন আমার হয়ে, যারা এ পর্যন্ত সৌন্দর্যের পূজো। করেছে, মৃত ও জীবিত, তাদের হয়ে।
ইতি—- বকুল

কথাগুলো ভালো করে বুঝতে পারে নি বীথি। কম্পিত হাতে আরেকটা চিঠি সে খুলেছে।

কে বলেছে আমার হৃদয় প্রদীপের মতো? লোহা বলতে পারেন। আমাকে ডাকা মানে কষ্ট পাওয়া। আমার সান্নিধ্য খোজা মানে অভিশাপ ডেকে আনা। বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছু চাইবার নেই পৃথিবীতে। কিন্তু সে পথেও যদি নিয়তি অমঙ্গল বিছিয়ে রাখে তো তা থেকেও বিমুখ হতে হবে।

চিঠি পড়ে বীথি বুঝতে পারে না, একটু একটু মনে হয়, বকুলকে কি নিজের হৃদয়ের কাছে ডেকেছিল হাশেম ভাই? কিন্তু কেন বকুল পারছে না তার ডাকে সাড়া দিতে? বকুল কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে হাশেমকে, এ কথা কোনদিন জানবে না বীথি।

পরের চিঠিটা কিন্তু আবার অন্যরকম। একেবারে নতুন কণ্ঠ নিয়ে বকুল কথা বলছে এই চিঠিতে।

আপনার অস্থিরতার জন্যেই বোধ হয় আপনাকে চেনা মনে হলো। আমার আবেগ গিয়ে এখন আছে স্থিরতা; অভাবনীয়তা গিয়ে এখন আছে অত্যন্ত আটপৌরে এক মন। এটা ছিল অনিবার্য। আমার রক্তের ভেতরে যেন বৈরাগ্য বাসা করে নিয়েছে। মানুষের মিছিলে আমার প্রিয়জন গেছে হারিয়ে আর আমি সমানে এগিয়ে চলেছি. দূরত্ব বৃদ্ধি করার দুরাশায়। আমি অদ্ভুতভাবে বিজ্ঞ। একটা অস্তিত্ব খায় দায় কথা বলে, আরেকটি সারাক্ষণ উদাস চোখ মেলে বসে থাকে। আমাকে কি সহ্য হবে?

কী হয়েছিল কে জানে, পরের চিঠিটায় বীথি দেখল, বকুল চটে গেছে। দুঃখ করেছে। দুঃখ পেয়েছে। নইলে অমন করে লিখতে যাবে কেন?

বলেছি ডাকবেন না। তাকে ভুল বুঝলেন কেন? মানুষকে যে অবিশ্বাস করে তার জন্যে নরকের দুয়ার সারাক্ষণ হাঁ করে আছে এই সত্য থেকে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম। কিন্তু তার একমাত্র উপায় বোধ হয় মায়ার ভেতরে আশ্রয় নেয়া। অথচ কোনো মায়ার বন্ধনে পরাই এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ভেতরের একাকীত্ব কি কেউ ঘোচাতে পারে কখনো? আজ আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে, আমার জীবন আর ফিরে আসবে না। রক্তহীন আত্মা, মরা ঘাসের রং আর ধূসর গুমোট আকাশ ছাড়া আর কিছুরই নাগাল যেন আমি পাবো না। তাই আবার আপনাকে সাবধান করছি আমি আমাকে ডাকবেন না, ডেকে পাবেন না।

এর পরের চিঠি লেখা অনেকদিন পরের তারিখে।

ঈশ্বরের আশীর্বাদে আজ কলম হাতে নিতে পেরেছি। এমন করে বিছানায় পড়ে গেছি, ভয় হয়। স্বাস্থের জন্যে মনে মনে চিরটা কাল যুদ্ধ করেও যখন এই অবস্থা হয়, তখন মনের জোর হারিয়ে ফেলি।

তোমার চিঠি পড়ে নিজেকে অভিশাপ মনে হচ্ছে। অনেক মানুষকে ভুগিয়েছি না জেনে। কারো কারো কষ্ট পাবার তীব্রতা দেখে সমব্যথায় মন আর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ দুঃখ লাঘব করা সম্ভব হয়নি। জানো তো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। আমার নাক দিয়ে অসম্ভব রক্ত পড়ছে। চিন্তা করবার শক্তি নেই। শুধু এটুকু বলি আমার জন্যে যদি এতটুকু কষ্ট পাও তাহলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না। যে হাত দিয়ে তুমি আমার শ্যাওলার দাগ মুছেছে তা সরিয়ে দিতে পারবো না সত্যি, কিন্তু দুনিয়ার নিয়মে আরও দুটো হাত এখন আমাকে তুলে নিতে উদগ্রীব। সে দুটোর দাবি না মানলে আমার রক্ত বিষ হয়ে যাবে যে। আর সে হাতের উপস্থিতিতে তোমার মনে তো কষ্ট হবেই। আমি আজ বুঝিয়ে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছি না। ক্লোরোমাইটসিন বুদ্ধি লুটে নিয়েছে।

পড়তে পড়তে বীথির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। ঠিক যে চিঠিতে ওরা অন্তরংগ সুরে কথা কইছে, সেই একই চিঠিতে বিচ্ছেদের ইঙ্গিত।

বীথি বুঝতে পারে, বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাশেম কেন পেল না তার মন? তারপর আরো দুটি চিঠি রয়েছে বকুলের। শেষের চিঠিগুলো পড়ে বীথির মনে হয়েছিল, বকুল ভালোবাসত হাশেমকে, কিন্তু সম্ভব হয়নি, বিচ্ছেদের জের টেনেও তাই মমতা যায়নি বকুলের। অ

সুখের চিঠিটার পরদিনের তারিখেই লেখা—-

এখন অনেকটা সুস্থ। কেমন আছো? আজ আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে। খুব হাওয়া দিচ্ছে কিনা। তোমার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি এ কদিন।

ছোট্ট চিঠিটা, কিন্তু বীথির সারাটা মন যেন ভরে রইলো। পরের চিঠিটায় বকুলের আবার অসুখ করেছে।

তোমার চিঠি যখন পেলাম তখন আবার আমি বিছানায়। অসুখের জন্যে কেউ এত ব্যাকুল হবে, এতে আমার চোখ সজল হয়ে ওঠে। রাগ করেছি কে বলল?

আমি কী পুণ্য করেছি যে, তুমি এমন করে আমার জন্যে প্রার্থনা করবে? তোমার প্রার্থনায় আমার প্রয়োজন আছে। আজ এই অসুস্থ শরীরে ফল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছি। মানুষের জীবনে এমন একেকটা সময় আসে যখন একটার পর একটা বিপদ আসে। তবে কতটুকুই বা আমার ভয়? আমাকে ঘিরে তুমি আছো, তোমার মতো আরো একজন আছেন।

আজ তোমার জন্যে আবার আমি প্রার্থনা করলাম। অজান্তে যে ভার তোমার আত্মায় চাপিয়ে দিয়েছি তা থেকে যেন মুক্তি পাও। তোমার জন্যে আজকে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ঘেন্না করেও যদি বালিশের ওপর তোমার মুখ নিদ্রামগ্ন থাকতে পারে তবে সেও ভালো। তবু আমাকে বাসনা করে অন্দ্রি থেকো না। ভাবো, চলতে চলতে আমি থেমে গেছি, তবু তোমাকে যেতে হবে। এতে আমারও কষ্ট, তোমারও কষ্ট। তবু তোমাকে যেতে হবে। এমনি করে ফেলে যাওয়া অনেক ভালো।

চিঠি পড়ে চেনার বদলে আরো যেন কুয়াশা হয়ে উঠেছিল বীথির কাছে। একেকদিন রাতে হাশেম ভাইয়ের জন্যে ভীষণ কান্না পেত বীথির। বকুলকে মনে হতো রাক্ষুসী। মনে মনে অভিশাপ দিত বকুলকে। বীথির যেন সহজ বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, বকুলের জন্যেই ঘর ছেড়েছে হাশেম। চাচিমাকে কথাটা জিগ্যেস করতে সাহস হয়নি। আবুকে সে শুধিয়েছিল, বকুল কে, আবুভাই জানো?

বকুল?

অবাক হয়ে যায় আবু। এই মেয়েটা ও নাম জানল কী করে? পরে হেসে ফেলে ফিসফিস করে বলেছে, কাউকে বলবি না। হাশেম ভাই যে মেয়েটাকে ভালোবাসত তার নাম বকুল। বিয়ে হলো না কেন?

কী জানি। তুই নাম জানলি কী করে? জানিস বীথি, তোর মতো আমিও একদিন চুরি করে চিঠিগুলো পড়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *